তুমি এলে তাই পর্ব-১২

0
117

#তুমি_এলে_তাই
#লেখিকাঃইশরাত_জাহান_অধরা
#পর্বঃ১২

চৈতিদের বাসা থেকে বের হতেই মোবাইলে ফোন আসল।পকেট থেকে ফোনটা বের করে রিসিভ করতে অপর পাশ থেকে আরশি বলল,

“শুভ্র ভাই!খবরে দেখলাম চৈতি যে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল সে রেস্টুরেন্টে নাকি আগুন লেগেছে?

” হুম।”

আরশির ভয়ে গলা কাঁপছে।কথাগুলা যেন গলার মধ্যে আটকে আসছে।বের হতে চাইছে না।কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

“চৈতি!চৈতি ঠিক আছে?ওর কিছু হয়নি তো?”

“একটু বিপদ হয়েছিলো!”

“কিহ?”

শুভ্র হেসে বলল,

“কিন্তু আমি সামলে নিয়েছি।এখন আপাতত ভালোই আছে।চিন্তার কোন কারন নেই।”

আরশি চোখ বন্ধ করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

“ভাগ্যিস!ভাগ্যিস তুই বলেছিলি চৈতির কাছে টাকা নেই। ওকে যেন নিয়ে আসি। নাইলে কি যে হতো!ভেবেই আমার হাতের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।”

“থাক! এখন এসব কথা ভেবে লাভ নাই।আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে এরকম বাজে একটা ঘটনা থেকে চৈতি রেহাই পেয়েছে।ওর কিছু হয়নি।

” হুম।তুইও চিন্তা করা বাদ দে ”

“অই ছেলের কি খবর?যে দেখা করতে চেয়েছিলো?”

“জানি না।চৈতিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বাট উনি বিষয়টা এড়িয়ে গিয়েছেন।”

“কি হলো আবার?আচ্ছা আমি ওকে জিজ্ঞেস করে দেখব। দেখি কি বলে।রাখি এখন।”

শুভ্র কি একটা মনে করে আবার কল দিলো আরশিকে।

“শুন, তোর সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।দেখা করা যাবে?”

“হ্যা,কিন্তু কি কথা?”

“সেটা বললেই বুঝবি।আমি আসছি। ”

আরশি কল কেটে ভাবল শুভ্র ভাই ওকে কি এমন কথা বলবে যেটা কলে বলা যায়না?পরেরটা পরে দেখা যাবে।নিশ্চয়ই জরুরি কোন কথা নইলে তো এভাবে আর ডাকতো না।ভেবেই চিন্তা করা বন্ধ করে দিল।

.
.
পরেরদিন,
বাসা থেকে বের হয়ে গেটের বাইরের দিকে তাকালো চৈতি। নাহ্,শুভ্র তো নেই।অন্যদিন তো গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তাহলে আজকে কি হলো?নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে!আজকে বাস দিয়েই যাওয়া যাক।এমনিতেও অনেক দিন বাস দিয়ে যাওয়া হয় না।ভেবেই একটু হাঁটতেই একটা বাস পেয়ে গেল। খালি বাস থেকে উঠেও গেল।কিছুক্ষন পর কলেজের সামনে আসতেই নেমে গেল। গেটে প্রবেশ করে একটু দুরেই আরশির মতো কাওকে একটা দেখা যাচ্ছে। একটু ভালো করে তাকাতেই দেখল ওটা তো আরশিই।দৌড়ে আরশির কাধে হাত রাখল।আরশি একবার চৈতির দিকে তাকিয়ে পাত্তা না দিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠে চলে গেল।চৈতির হাসিমুখটা নিমিষেই কালো হয়ে গেল।পরক্ষনে নিজেকে সামলে ক্লাসরুমের ভিতরে ঢুকে দেখল আরশি এখও আসেনি।চৈতি নিজের সিটে বসার কিছুক্ষন পরই আরশিকে আসতে দেখে হাত নাড়ালো।পাশের সিট থেকে নিজের ব্যাগটা উঠিয়ে আরশিকে বসার জায়গা করে দিল।কিন্তু আরশি একবার তাকিয়ে সামনের একটা সিটে গিয়ে বসে পরল।চৈতির মন এবার আরও বেশি খারাপ হয়ে গেছে।আরশি কেন এমন করছে তাই বোধগম্য হচ্ছে না তার।বারবার সামনে আরশির দিকে তাকাচ্ছে।আরশি পাশে বসা একটা মেয়ের সাথে দিব্যি হেসে কথা বলছে।ওর সাথে কেন কথা বলছেনা?ওর উপর কি রাগ করেছে?কিন্তু ও তো কোন দোষ করেনি তাহলে এরকম কেন করছে?কিছুক্ষনের মধ্যেই স্যার এসে পরল।
আশরাফ ক্লাসে ঢুকেই সর্বপ্রথম চৈতির সিটের দিকে তাকালো।কিন্তু মেয়েটার মুখটা এমন কালো হয়ে আছে কেন?কিছু কি হয়েছে?মাথা নিচু করে বসে আছে চৈতি।আশরাফ একটু ভালো করে দেখেই বুঝল আরশি যে কিনা প্রতিদিন চৈতির সাথে বসে সে বসে নি।চৈতির পাশের সিটটা খালি।

“মিস আরশি!চৈতির পাশে গিয়ে বসুন।”

“সরি স্যার!লাস্ট বেঞ্চে আমার গরম লাগে আর তাছাড়া লেখাও ভালো করে বুঝি না।”

“এতদিন কি করে বুঝতেন?আমি এই কলেজে আসার পর থেকেই দেখেছি প্রতিদিন আপনি লাস্ট বেঞ্চেই বসেছেন।তাহলে আজকে কি এমন হলো যে আপনি বোর্ডের লেখা দেখতে পান না?আমি কোন কথা শুনতে চাই না।আপনি এক্ষুনি গিয়ে চৈতির পাশে বসবেন।”

“কিন্ত স্যার….”

“আমি কোন কথা শুনতে চাচ্ছি না।”

আরশি মুখ কালো করে চৈতির পাশে এসে বসল।প্রথমে চৈতি খুশি হলেও পরে আরশির কালো মুখ দেখে কোন কথা বলল না।
ক্লাস শেষে,

“কি হয়েছে তোর?আমার সাথে কথা বলছিস না কেন?আমি কি করেছি বল?এভাবে চুপ করে থাকিস না!”

আরশি বিরক্ত হয়ে বলল,

“তোর জন্য স্যার আমাকে লাস্ট বেঞ্চে বসতে বলেছে।”

“সরি,আমি চাইনি তুই মন খারাপ করে আমার পাশে বসবি।”

“হইছে!আর কিছু বলা লাগবে না।ভালো লাগছে না আমার। আমি গেলাম।”

আরশির যাওয়ার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে মন খারাপ করে কলেজ গেটের বাইরে এসে দেখল শুভ্রও আসেনি।উনি কি ভুলে গিয়েছেন আমার কথা নাকি আজকে আসেই নাই?
আর কিছু না ভেবে বাসে উঠে পরল।
.
.
ইফতার করে বিছানায় বসে বসে রেস্ট নিচ্ছিলো
চৈতি।কোনসময় যে চোখ লেগে গিয়েছে টের পায়নি সে।ঘুম ভাংগল ৮:৩০ এর দিকে। শোয়া থেকে উঠে এক কাপ কফি বানিয়ে পড়ার টেবিলে বসল সে।হঠাত পাশে টেবিলের উপর রাখা মোবাইলের আলো জ্বলে উঠতে দেখে মোবাইলটা চেক করতে একটা মেসেজ দেখতে পেল সে।

“আমি আপনার বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছি।আসুন জলদি।”

চোখ ভালো করে ঢলে আবারও তাকালো।ঘুমের মধ্যে কি সে ভুলভাল দেখছে নাকি?এত রাতে কে ওকে মেসেজ করবে?তাও আবার বলছে বাসার নিচে!

“কে আপনি?আমার বাসা চিনলেন কি করে?”

“সেটা নিচে আসলেই দেখতে পারবেন।তাড়াতাড়ি নামুন।আমার হাতে বেশি একটা সময় নেই।আপনি না আসলে আমি আপনার বাসার ভিতর আসতে বাধ্য হবো।আপনি নিশ্চয়ই সেটা চান না!”

কে এই লোক?রীতিমতো কিনা হুমকি দিচ্ছে!

“আপনার আসতে হবে না।আমিই আসছি।”

মেসেজটা সেন্ড করেই মাথায় ওড়না দিয়ে ঘর থেকে বের হলো নিচে আসতেই আশরাফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে।গাড়িতে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে সে।আশরাফকে এত রাতে আসতে দেখে অবাক হলো খুব চৈতি।দ্রুত পায়ে হেঁটে সামনে গিয়ে মোবাইলে টাইপ করে বলল,

“আপনি এত রাতে এখানে কি করছেন?আর আমাকে নিচে ডাকলেন কেন?”

“কথা বলেতেই ডেকেছি।”

“কলেজই বলতেন!এখানে আসার কি দরকার ছিল?আচ্ছা কি বলবেন বলুন?একটু তাঁড়াতাঁড়ি বলুন আম্মু জানতে পারলে রেগে যাবে।”

“চৈতি আপনি শুভ্র ছেলেটার সাথে আর মিশবেন না!”

আশরাফের কথা শুনে চৈতি অবাক হয়ে বলল,

“মানে?এই কথা বলার জন্য আপনি এখানে এসেছেন?সিরিয়াসলি?আমি কার সাথে মিশব কার সাথে মিশব না সেটা কি আপনি ডিসাইড করে দিবেন?”

“নাহ,আমি সেভাবে বলিনি।”

“অইভাবেই বলেছেন।আপনার কোন রাইট নেই আমাকে আদেশ করার।হ্যা আছে সেটা শুধু কলেজের মধ্যে।এর বাইরে না।আর একটা কথা আমি শুভ্রের সাথে কথা বলব। একশবার কথা বলব।অই মানুষটাই একমাত্র আমাকে প্রাধান্য দিয়েছে।আমার সব প্রয়োজন -অপ্রয়োজন সবকিছু বুঝেছে।আপনার মতো কথায় কথায় অপমান করেন নি।সবসময় আমার পাশে থেকেছেন।সবরকমের সাহায্য করার চেষ্টা করে গেছেন কোন স্বার্থ ছাড়াই।আপনার এক কথায় আমি উনার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিব ভাবলেন কি করে?আমি আসছি।”

“আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি চৈতি।আপনার সাথে কাওকে আমার সহ্য হয় না।এতে দোষটা কোথায়? কি করব আমি?”

ফিরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই আশরাফের এমন মেসেজ দেখে স্তব্দ হয়ে গেল চৈতি।পিছনে ফিরে দেখল আশরাফ অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে চৈতির দিকে।

” আপনি এসব কি বলছেন?”

আশরাফ মলিন হেসে বলল,

“আমাকে পাগল ভাবছেন তাই না?ভাবছেন মাথার তার ছিড়ে গেলো কিনা?প্রথমে আমিও ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম যে মেয়েটাকে আসি দু চোখে দেখতে পারিনা,যাকে দেখলেই শুধু তাচ্ছিল্যের কথা বের হয় মুখ থেকে তাকে আমি কি করে ভালোবেসে ফেললাম?কিন্তু আমি অসহায়! নিজেকে আটকাতে পারি নি।”

“দেখুন,আপনার আর আমার মাঝে যে সম্পর্ক আছে সেটা শুধু টিচার আর স্টুডেন্টের!একজন টিচার হয়ে আপনি আপনার স্টুডেন্টকে এসব বলেন কোন সাহসে?”

“তোমার সাথে যেদিন আমার ফাস্ট দেখা হয়েছিল সেদিন তো আমি তোমার টিচার ছিলাম না!”

“হ্যা ছিলেন না।কিন্তু এখন আপনি আমার টিচার।একজন টিচার হিসেবে আপনার এসব বলা উচিত হয়নি।আর আপনি ভাবলেন কি করে আপনি বললেই আমি রাজি হয়ে যাবো,আপনাকে ভালোবাসবো?আপনি আমাকে রিজেক্ট করেছেন আমি করিনি।আপনার মা আমাকে দেখতে এসে যাচ্ছে তাই বলে অপমান করেছেন।সেটা আমি এখনও ভুলিনি।”

“আমি এর জন্য ক্ষমা চাচ্ছি।মানুষ তো ভুল করেই তাই না?এটাও আমার ভুল! আমি মেনে নিচ্ছি সেটা।”

“আপনি মেনে নিলেই সবকিছু আমি ভুলে যাব না।আপনার মুখে আমি যেন আর এ কথা না শুনি।”

“কি করলে তুমি আমাকে ক্ষমা করবে?”

“আপনি ক্ষমার যোগ্যই না।ক্ষমা করবার চিন্তা করা তো দুরের কথা! আমি আসছি।”

এক মুহুর্তও দেরি না করে দৌড়ে গেটের ভিতর ঢুকে গেল চৈতি।জীবনে এমন একটা মুহুর্ত, পরিস্থিতিতে পরবে তা সে কোনদিন চিন্তা তো দুরের কথা, কল্পনাও করেনি।চৈতির যাবার দিকে আশরাফ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে।কিন্তু সবদিক থেকে বিবেচনা করলে তো সব দোষ তারই।সে যদি তার মার কথা না শুনত! যদি চৈতিকে বিয়ে করার ডিশিসন নিতো,চৈতির পাশে এসে দাঁড়াতো তাহলে তো তাকে আজ এভাবে অসহায় হতে হতো না।দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়িতে উঠল।বাসার সামনে আসতেই রোবটের মতো গাড়ি থেকে বের হয়ে সিড়ি দিয়ে নিজের রুমেই যাচ্ছিলো।

“আশরাফ!তোকে আজ এমন এলোমেলো লাগছে কেন?কি হয়েছে তোর?”

“কিছুনা!”

“কিছুনা বললেই হলো?চোখ মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে।”

বলেই আশরাফের কাছে এসে মুখে হাত বুলিয়ে দিতেই আশরাফ এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল।

“ছোবে না তুমি আমায়।”

“কি হলো?তুই এভাবে কথা বলছিস কেন?”

“আমার এ পরিস্থিতির জন্য তুমি দায়ী।তুমি যদি সেদিন চৈতিকে অপমান না করে এ বাড়ির বউ হিসেবে আনতে তাহলো আমার আজ এ অবস্তা হতো না।”

“তুই শান্ত হো!চৈতি?কোন মেয়েটা? অইযে কানে শুনেনা আর বোবা?”

আশরাফ নিজেকে আটকাতে পারলো না।কাদঁতে কাঁদতে বললো,

“হ্যা মা!জানো?আমি না অই বোবা মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছি।অনেক চেয়েছিলাম নিজেকে আটকাতে কিন্তু পারিনি।আমার মস্তিষ্ক বলছে ওকে ভালোবাসা উচিত না!আবার আমার মন তার ঠিক বিপরীত কাজটা করছে!আমি আর পারছিনা নিজেকে সামলাতে।আমি হাপিয়ে উঠেছি প্রতিনিয়ত মস্তিষ্ক আর মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে।”

পরক্ষনেই হেসে বলল,

“অবশ্য আমিও না! এসব কথা কাকে বলছি যে মানুষটা অই মেয়েটাকে দেখতে পারে না তাকে?কি বোকা আমি।বাদ দাও!এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না।চৈতি আমাকে রিজেক্ট করে দিয়েছে।আমার করা অন্যায়গুলো আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। তোমার টেনশন করার কোন কারণ নেই। ”

বলেই রোবটের মতোই সিড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে গেল।ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন,

“আমার ছেলেটা তো এমন ছিলো না!না না,আমি এই আশরাফকে চিনি না।হঠাত করে এমন কি করে হয়ে গেল ও?”

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে