তুমি আমার প্রণয়িনী পর্ব-০১

0
94

#ধারাবাহিক গল্প
#তুমি আমার প্রণয়িনী
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

মুক্ত আকাশের নীচে খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে জোবায়দা ভাবছে, ওর জীবনটা রাতের কালো আকাশের মতো হয়ে গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাতের আকাশে যখন হঠাৎ মেঘ জমে চাঁদের আলোটা ঢেকে যায়। সেসময় গাঢ় কালো তমসাচ্ছন্ন চাদরে পুরো পৃথিবীটা ঢেকে রয়। ওর জীবনের আকাশটাও আজ তেমনি হয়ে আছে। অথচ দু,মাস আগেও এমন ছিলো না। ঊনিশ বছরের জীবনটায় হাসি, আনন্দ, শান্তি কোনো কিছুর অভাব ছিলো না। দু,মাসের ব্যবধানে সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেলো।

গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পেয়ে জোবায়দা এইচএসসি পাশ করেছে। বাবা আলতাফ সাহেব মেয়ের রেজাল্টে ভীষণ খুশী। উনার খুব ইচ্ছে মেয়ে যেন তার অনেক বড় ডাক্তার হয়। দু,ভাই দুবোনের মধ্যে জেবায়দা সবার বড়। এলপিআর শেষ করে চাকরি থেকে পুরোপুরি অবসরের মুহুর্তে প্রতিটি মানুষের মন বিষাদে ঢেকে যায়। আলতাফ সাহেবও এর ব্যতিক্রম নন। উনার চিন্তাটা অন্য সবার থেকে একটু বেশী। কেননা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেষ হয়নি। নিজের পায়ে দাঁড়াতে এখনও প্রচুর সময় বাকি। অনেকে ভাবে আলতাফ সাহেব লেট ম্যারেজ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বিয়ে উনি ঠিক বয়সে করেছেন। কিন্তু বিবাহিত জীবনের দশ বছরের মাথায় জোবায়দার জন্ম হয়। তারপর আড়াই, তিনবছরের ব্যবধানে সবার জন্ম হয়।সেই কারনে সবার ছোটো জাফর কেবল ক্লাস ফোরে পড়ে। ছেলেমেয়েদের মানুষ করার চিন্তাটা ইদানিং আলতাফ সাহেবকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। এরকম মুহুর্তে মেয়ের এরকম রেজাল্ট সিনিয়র একাউন্টটেন্ট আলতাফ সাহেব আবারো স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। একদিন মেয়ে তার অনেক বড় ডাক্তার হবে।

স্বপ্নের আকাশটা ছোঁয়ার জন্য দিনরাত এককরে জোবায়দা পড়াশোনা করে। অবশেষে স্বপ্নটা ওর হাতে ধরা দেয়। ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে চান্স পায়। বাবা, মা ভাই বোন মিলে সবাই সেদিন সেই আনন্দকে সেলিব্রেট করতে ধানমন্ডীর শেফ টেবিলে খেতে গিয়েছিলো। ডিনার শেষ করে বাড়ি ফেরার পর আলতাফসাহেব বুকের ব্যথায় ছটফট করতে থাকে। যদিও উনি ডায়াবেটিস আর হাইপ্রেসারের রোগী। কিন্তু হার্টের কোনো সমস্যা ছিলো না। তাই সবাই ভেবে নিয়েছিলো উনার গ্যাসটিকের ব্যথা উঠেছে। জোবায়দা ওষুধের বক্স থেকে একটা গ্যাসের ট্যাবলেট নিয়ে বাবাকে খাইয়ে দেয়। কিন্তু ব্যথা তো কমে না। একসময় পুরো শরীর ঘামে ভিজে যায়। মা শেফালী বেগম জোবায়দাকে বলে,
—-তোর বাবাকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা কর। আমার কাছে মনে হচ্ছে তোর বাবার হার্ট অ্যাটাক করেছে।
সেই মুহুর্তে আলতাফ সাহেব জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। শেফালী বেগম চোখের সামনে স্বামীর এই অবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে উঠেন। জোবায়দা নিজেকে শক্ত রেখে ছোটোবোন আদিবাকে ডেকে বলে,
—ওমরকে ডেকে বল অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিতে হবে। বাবাকে হাসপাতালো নিতে হবে।
আদিবা দৌড়ে ওমরের রুমে গিয়ে বলে,
—ভাইয়া আব্বুর শরীর খুব খারাপ। আপু অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে বলেছে। এখনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
আদিবার কাছে এখবর পেয়ে ওমর ছুটে আসে। জোবায়দাকে জিজ্ঞাসা করে,
—-আপু,আব্বাকে কোন হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে?
—আব্বুর যেহেতু ডায়াবেটিস আছে বারডেমে নিয়ে গেলে ভালো হবে।
একথা শুনে শেফালী বেগম ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্যে বলেন,
—তোর বাবার বারডেমের বই করা আছে।
অবশেষে অ্যাম্বুলেন্সে করে আলতাফ সাহেবকে বারডেম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর দীর্ঘ দেড়মাস আইসিইউতে থেকে বিশ লক্ষ টাকা বিল পরিশোধ করে মোটামুটি সুস্থ করে বাসায় নিয়ে আসা হয়। যদিও শরীরের বাঁপাশটা অবশ হয়ে আছে। আলতাফ সাহেবের একদিকে যেমন সিভিয়ার এ্যাটাক হয়েছে তেমনি আবার স্ট্রোকও করেছেন। এখন প্রতিদিন ফিজিওথেরাপিস্ট এসে উনাকে ফিজিওথেরাপি করাচ্ছেন।
এদিকে আলতাফ সাহেবের একটা বেসরকারী কোম্পানীতে একাউন্টেট হিসাবে চাকরি হয়েছিলো। কথাছিলো এলপিআর শেষ করে ওখানে জয়েন করবেন। সে আর কপালে হলো না। এলপিআর শেষ করে পেনশন বাবদ পঞ্চাশলক্ষ টাকা পেয়েছিলেন। সেখান থেকে পঁচিশ লক্ষ টাকা এক ধাক্কায় খরচ হয়ে যাওয়াতে শেফালী বেগম মুষড়ে পড়েন। বাকি পঁচিশ লক্ষ টাকা আর প্রতি মাসে তিরিশ হাজার টাকা পেনশন দিয়ে কিভাবে সংসার চালাবেন? আলতাফ সাহেবের ওষুধের খরচ, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, বাসাভাড়া এসব চিন্তায় উনার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। যদিও উনি ভেবেছেন পঁচিশলক্ষটাকা পুরোটা দিয়ে পারিবারিক সঞ্চয় পত্র কিনবেন। ওখান থেকে যে টাকাটা পাবেন সেটা দিয়ে বাসা ভাড়া দিবেন। আর পেনশনের টাকা দিয়ে সংসার চালাবেন। তবে জোবায়দাকে দুটো টিউশনি করাতে বলবেন। তাহলে হয়তো কোনোমতে সংসারের চাকাটা সচল থাকবে।
মানুষ বিপদে পড়লে বন্ধু আর শত্রুকে চিনে নিতে পারে। জোবায়দাদের জীবনেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ওরা এখন তাজমহল রোডে ভাড়া থাকে। তিরিশ হাজারটাকা বাসা ভাড়া দিতে হয়। তবে সামনের মাসে এ বাসাটা ছেড়ে দিতে হবে। বাড়িওয়ালা আঙ্কেল নোটিশ দিয়েছেন। দু,হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্লাট। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে তার সাথে তাল দিয়ে উনিও বাসা ভাড়া বাড়িয়ে দিবেন। তিরিশ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দেওয়াই এখন ওদের পক্ষে সম্ভব নয়। আর বাসা ভাড়া বাড়ালে তো আরোও সম্ভব হবে না। তাই শিয়া মসজিদের কাছে একটু ভিতরে বিশহাজার টাকায় একহাজার স্কয়ার ফিটের একটা বাসা ভাড়া নেওয়া হয়েছে। পুরোনো আমলের চারতলা বিল্ডিং
এর তিনতলা ওরা ভাড়া নিয়েছে। তবে বাড়িওয়ালা আঙ্কেলের হঠাৎ এভাবে বাসা ভাড়া বাড়ানোর ছুঁতো ধরে ওদেরকে বাসা ছাড়ার নোটিশ দেওয়াটা আর কেউ না বুঝলে জেবায়দা ঠিকই বুঝতে পেরেছে। বাড়িওয়ালার একমাত্র ছেলে হিমেল এবছর সোহরাওয়ার্দি মেডিকেল কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। জোবায়দা ওর কাছেই মেডিকেলে ভর্তির জন্য প্রাইভেট পড়েছে। বাড়িওয়ালা আঙ্কেল আন্টি দুজনেই জোবায়দাকে অনেক স্নেহ করতো। প্রিপাটরী স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ও এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করেছে। হিমেলের কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্য উনারাই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। জোবায়দার বাবা মাও সানন্দে রাজী হয়। জোবায়দা যখন ক্লাস সিক্সে পড়ে তখন থেকে এ বাড়ীতে থাকা শুরু হয়। বাড়ীওয়ালাদের কোনো মেয়ে না থাকাতে জোবায়দাকে ওরা খুব স্নেহ করতেন। জোবায়দা দেখতে যেমন সুন্দরী তেমনি ছাত্রী হিসাবে ভীষণ মেধাবী। বিশেষ করে হিমেলের মা জোবায়দাকে ভীষণ ভালোবাসতো। ভালো কিছু রান্না করলে জোবায়দার জন্য আলাদা করে তুলে রাখতো। পরিমানে বেশী থাকলে ওদের বাসায় পাঠিয়ে দিতো। আর কম থাকলে জোবায়দাকে ডেকে খাইয়ে দিতো। এই কারনে হিমেলের কাজিনরা বেড়াতে আসলে জোবায়দাকে দুষ্টুমী করে ভাবী ডাকতো। ওদের মুখে ভাবী ডাক শুনতে জোবায়দার মন্দ লাগতো না। হিমেলও মিটি মিটি হাসতো।
জোবায়দা তখন সবে ক্লাস নাইনে উঠেছে। হিমেল তখন রেসিডেন্সিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে ইন্টার সেকেন্ডে ইয়ারে পড়ে। সেদিন ও একা স্কুল থেকে রিকশা করে বাড়ির পথে ফিরছিলো। পথের মাঝখানে হিমেল আর ওর বন্ধুদের সাথে দেখা হয়। ওকে দেখে হিমেলের বন্ধুরা রাঙ্গাভাবী বলে ডাক দেয়। জোবায়দার খুব লজ্জা লাগে। পাশাপাশি হিমেলের উপর ভীষণ রাগ হয়। জোবায়দা তখন একটু বড় হয়ে যাওয়াতে এসব দুষ্টমীর মানে ভালোই বুঝতে পারতো। আর একটু ভয়ও কাজ করতো। যদি বাবা মায়ের কানে যায় তাহলে বিষয়টা কোনদিকে গড়াবে কে জানে। কিন্তু ও রিকশা থেকে দেখতে পায় বন্ধুদের এমন আচরনে হিমেল খুব আনন্দিত অনুভব করছে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে