তুমি আমার প্রণয়িনী পর্ব-০২

0
375

#ধারাবাহিক গল্প
#তুমি আমার প্রণয়িনী
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী

এতে জোবায়দার রাগের পারদ বাড়তে থাকে। সেদিন বাসায় ফিরে এসে ও ছাদে হিমেলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কারন হিমেল প্রতি সন্ধারাতে ছাদে থাকা ফুলের গাছগুলোতে পানি দেয়। সেদিন ছিলো আষাঢ়ের ভরা পূর্ণিমা। হিমেল ছাদে আসা মাত্রই জোবায়দা রেগে গিয়ে বলে,
—-আপনার বন্ধুদের নিষেধ করবেন আমারসাথে যেন এ ধরনের ঠাট্টা মশকরা আর কোনোদিন না করে?
হিমেল জোবায়দার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। চাঁদের আলো ওর মুখের উপর পড়েছে। এমনিতেই জোবায়দা দেখতে বেশ সুন্দরী। তারউপর ভরা যৌবনা চাঁদের আলো ওর মুখের উপর পরতেই মেয়েটাকে ভীষণ মায়াময় লাগছে। সেদিকে তাকিয়ে হিমেল ভাবছে,রাগলেও একটা মেয়েকে যে এতো সুন্দর লাগে তা জোবায়দাকে না দেখলে ওর জানা হতো না। জোবায়দা হিমেলের দিকে তাকিয়ে বলে,
—এভাবে ক্যাবলার মতো তাকিয়ে কি দেখছেন? আমার কথার জবাব দিন।

ওর রাগের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে হিমেল কোনো উত্তর না দিয়ে ওর উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফুলগাছগুলোতে আপনমনে পানি ঢালতে লাগলো। জোবায়দা এবার সত্যি রেগে যায়। কাছে এসে বলে,
—-যতটুকু জানি আপনি তো ঠসা নন। আমার কথাগুলো ভালোই শুনতে পেয়েছেন।
—হুম,তো এখন কি করবো?
—-বন্ধুদের নিষেধ করবেন।
একথা বলে জোবায়দা চলে যাওয়ার জন্য উদ্যেগ নিতেই হিমেল ওর হাতটা টেনে ধরলো। জোবায়দা ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পালাতে গেলেই হিমেল ওর পথ আগলে দাঁড়ায়। জোবায়দা একসময় পিছু হটতে থাকে। তারপর ছাদের দেয়ালের কাছে সেঁটে দাঁড়ায়। হিমেলও দুহাত দেওয়ালের উপর চেপে ধরে। তারপর নিজের মুখটা জোবায়দার মুখের কাছে এনে বলে,
—-আমার বউ হতে তোর এতো আপত্তি কেন? ছোটো বেলায় যখন কেউ ভাবী বলে ডাকতো তখন তো মুচকি মুচকি হাসতি। এখন আবার কি হলো?
—-তখন আমি ছোটো ছিলাম। তাছাড়াও এসব কথার মানে পরিপূর্ণ বুঝতাম না।
—এখন কি বড় হয়ে গিয়েছিস? তা অবশ্য ঠিক। তখন তো গায়ে ওড়না দিতি না। এখন আবার আপাদমস্তক দোপাট্টায় নিজেকে জড়িয়ে রাখিস। ইস,তোর দোপাট্টাগুলোকে দেখলে আমার খুব হিংসে হয়। ওভাবে যদি একটু আমায় জড়িয়ে নি_তিস
হিমেলের কথা শেষ হওয়ার আগেই জোবায়দা ওর হাত দুটোকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দৌড়ে পালাতে গিয়ে বলে,
—-আপনার মুখে না কিছুই আটকায় না।
সেই থেকে জোবায়দাও হিমেলকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এরমাঝে হিমেল গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে এইচএসসি পাশ করে ঢাকা মেডিকেলে চান্স পায়। পাশাপাশি দুই পরিবারের সখ্যতাও বাড়তে থাকে। যদিও হিমেলের বাবা একটু বিরক্ত হতো। বিশেষ করে হিমেলের মায়ের আদিখ্যেতা দেখে। হিমেলের বাবা জমির মোল্লা খুব হিসেবী মানুষ। যখন তখন জোবায়দাদের বাসায় হিমেলের মায়ের খাবার পাঠানো উনি খুব একটা পছন্দ করতেন না। কিন্তু হিমেলের মা জোৎস্না বেগম জমির মোল্লার এসব বিষয়ে পাত্তা দিতেন না। তবে সমস্যাটা শুরু হলো জোবায়দার বাবা অবসরে যাওয়ার পর। জমির মোল্লা লক্ষ্য করে জোবায়দা মেডিকেলে চান্স পাওয়াতে হিমেল আর ওর মা খুব খুশী হয়। মা ছেলের এমন খুশী দেখে জমির মোল্লার বিরক্ত অনুভব হয়। আর এদিকে ছেলের মন বুঝতে পেরে জোৎস্না বেগম জোবায়দাকে বউ করার জন্য মনস্থির করে। কথাটা জমির মোল্লার কানে তুলতে উনি রেগে গিয়ে বলেন,”উনার ছেলের এখনও বিয়ের বয়স হয়নি।” যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে হিমেলও জোবায়দাকে এখনও প্রপোজ করেনি।

তবে জোবায়দার বাবা আলতাফ সাহেব অসুস্থ হয়ে আইসিইউতে ভর্তি হওয়াতে জমির মোল্লা স্ত্রীর এই প্রস্তাবে বাধ সাধে। উনার কথা হচ্ছে এতোদিন আইসিইউতে থেকে আলতাফ সাহেবের সবটাকা খরচ হয়ে গেছে। এখন ঐ পরিবারের সাথে সম্পর্ক করা মানে উলুবনে মুক্ত ছড়ানো। সারাজীবন ধরে ঐ পরিবারকে টানতে হবে। এভাবে পরের বোঝা কাঁধে তোলার জন্য উনি কষ্ট করে ছেলে মানুষ করেননি। বরং উনি জেবায়দার জন্য ছেলে খুঁজে দিয়ে আলতাফ সাহেব কন্যা দায় হতে কিছুটা মুক্ত করতে পারবেন।
তবে হিমেল বাবার এসব কথার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। জমির মোল্লা ছেলের কণ্ঠ চিরদিনের জন্য বন্ধ করতে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দেন। জোৎস্না বেগমকে জানিয়ে দেন সব সম্পত্তি উনি উনার ভাইয়ের বাচ্চাদের লিখে দিবেন। জমির মোল্লা বিএডিসির ডাইরেক্টর ছিলেন। তবে উনার ভাই আক্কাস মোল্লা গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করে। উনারও চার ছেলেমেয়ে। টানাটানির সংসার। স্কুলের আর কটা টাকা বেতন। বলা যায় জমির মোল্লাই ভাইয়ের সংসারটা চালিয়ে নেয়।
পরিবারের এই অবস্থায় হিমেল রমনা পার্কে জোবায়দার সাথে দেখা করে। বৈশাখের তপ্ত রোদে জোবায়দা মুখটা রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। পার্কের বেঞ্চটায় বসে ও একদৃষ্টিতে দূরের রাঁধাচূড়া গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে। গরম বাতাসের ঝাপটায় বিনুনী থেকে আলগা হয়ে যাওয়া চুলগুলো অবিন্যস্তভাবে জোবায়দার কপালে এসে পড়েছে। ও আজ মন শক্ত করে হিমেলের সাথে দেখা করতে এসেছে। পরিবারের এ অবস্থায় ওকে দুর্বল হলে চলবে না। পুরো পরিবার ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তাই হিমেলকে নিয়ে দেখা স্বপ্নের ভালোবাসার ঘরটাকে ও নিজহাতে তালাবদ্ধ করে রেখেছে। হিমেলের হাজারো ইমোশনাল কথায় ও ঐ ঘরের তালা খুলবে না। মনে মনে এই শপথ নিয়ে ও এখানে এসেছে। এজন্য যতো কঠিন হতে হয় ও আজ তাই হবে। হিমেল ওকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে একসময় ওর হাতদুটো নিজের মুঠোর মধ্যে পুরে নিয়ে বলে,
—-তুই আমার সাথে পালিয়ে যেতে পারবি না?
জোবায়দা হিমেলের হাতের বন্ধন থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
—-বাবা মায়ের মুখে আমি চুনকালি মাখাতে পারবো না। তাছাড়া আপনার সাথে আমার প্রেম হলো কবে যে আমি আপনার হাত ধরে পালাতে যাবো?
—-একথা তুই বলতে পারলি? সেই কোন ছোটোবেলা থেকে আমরা দু’জন দুজনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। আর আজ তুই এই স্বপ্ন তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে দিলি?
—-আমার মতো এক হাভাতে ঘরের মেয়েকে বিয়ে করে কেন সারাজীবন কষ্ট করবেন? তার থেকে বরং রাজত্বসহ কোনো এক রাজকন্যাকে বিয়ে করে নিশ্চিম্ত জীবন যাপন করুন।
একথা বলে ও আর একমুহুর্ত অপেক্ষা না করে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। হিমেল ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে, ভালোবাসা এমন এক অনুভব যার উৎপত্তি হয় হৃদয়ের গভীরে। ভালোবাসার অনুভূতীগুলো জানে না ধনী গরীব কিংবা সুন্দর অসুন্দরের মধ্যে পার্থক্য করতে। সমাজ সংসার যতবার দুটো ভালোবাসার মানুষের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ততবারই সত্যিকার ভালোবাসাগুলো সব বাধা ডিঙ্গিয়ে একে অপরকে চিরজীবনের মতো আপন করে নিয়েছে। হিমেলও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে সব বাধা ডিঙ্গিয়ে ও একদিন ওর ভালোবাসার মানুষকে আপন করে নিবে।

আদিবার ডাকে জোবায়দা ভাবনার জগত থেকে ফিরে এসে বলে,
—-কিছু বলবি?
—আম্মু ডাকছে। এভাবে অন্ধকারে একা ছাদে বসে থাকা ঠিক নয়।
—-তুই যা। আমি আসছি।
জোবায়দার একটা বৈশিষ্ট আছে ও মানুষের বডিল্যাঙ্গুয়েজ দেখে অনেক কিছু বুঝতে পারে। হিমেল কিংবা ওর মা জোবায়দার ক্ষেত্রে পজিটিভ হলেও হিমেলের বাবা জমির মোল্লার এতে মত নেই। এটা জোবায়দা ভালোই বুঝতে পারে। পরমানুষের কথা আর কি বলবে যেখানে আপন মানুষগুলো জোবায়দাকে নিয়ে অনেক নেগিটিভ কথা বলে বেড়ায়।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে