#তুমিময়_আসক্তি
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব_____০৮
চোখে মুখে কারো উষ্ণ নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে অনবরত। গালে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রু রেখার ওপর আঙুলের স্পর্শ পেতেই নিশ্চিত হলাম আমার সামনে খুব কাছাকাছি কেউ অবস্থান করছে। চোখ দুটো খোলার চেষ্টার করলেও বারংবার ব্যর্থ হতে হচ্ছে আমায়। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে এক ঝটকায় শোয়া থেকে উঠে বসলাম। ধীর গতিতে চোখ মেলে তাকাতেই ঝাপসা দৃষ্টি ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগলো।
চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, এটা কোনো হাসপাতালের কেবিন। বিস্মিত দৃষ্টিতে ভাবতে ভাবতে কাছে বসে থাকা ব্যক্তিটাকে দেখতেই চোখ দুটো স্থির হয়ে গেল। গাল বেয়ে মোটা দুই ফোঁটা অশ্রু কণা ঝরে পড়লো।
নির্জন আমার গালে কপালে হাত দিয়ে পরখ করে ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললো,
-খারাপ লাগছে? কষ্ট হচ্ছে খুব, তাই না? আমি ডক্টরকে ডেকে আনছি!
নির্জন চলে গেল। খুব ইচ্ছে করছিলো, ওনাকে আটকাতে। দু’হাতে ওনার হাত আঁকড়ে ধরে বলতে,
-যাবেন না। আপনি যতক্ষণ পাশে থাকবেন, ততক্ষণ আমি ঠিকই থাকবো। দূরে সরে গেলে কষ্ট হয় তো!
কিন্তু! এই ‘কিন্তু’ টার জন্যই বলা হলো না। আর কখনো হবেও না! যে মানুষটা আমার নয়, তাকে নিয়ে এসব ভাবাও পাপ। বলা তো দূরের কথা!
নির্জন ভেতরে এলেন। পেছনে একজন ডক্টর ও একজন নার্স। ডক্টর এসে স্টেথোস্কোপ দিয়ে পালস চেক করে স্যালাইনের গতিটা বাড়িয়ে দিলেন। প্রসন্নের হাসি দিয়ে বললেন,
-প্রেশার ফল করেছিলো। এখন চিন্তার কিছু নেই। রেগুলার মেডিসিন নিলে আর নিজের যত্ন নিল শরীরের ব্যালেন্স ঠিক হয়ে যাবে।
-ডক্টর, বাসায় কবে নিয়ে যেতে পারবো?
-আজই। স্যালাইনটা শেষ হোক।
ডক্টর চলে গেলেন। নার্স একটা ইনজেকশন ক্যানোলায় পুশ করে সেও চলে গেল। কাঁপা কাঁপা বললাম,
-ব্ বাবাকে ডাকুন।
নির্জন আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
-কিছু লাগবে? লাগলে আমাকে বলো। তোমার বাবা-মা এখানে নেই।
অবাক হয়ে বললাম,
-এখানে নেই মানে? আর আমি এখানে কেন? আমি তো বাসায় ছিলাম! ফ্লোরে বসে বসে কাঁ……….
থেমে গেলাম। কী থেকে কী বলছিলাম নিজেও খেয়াল করিনি! নির্জন ভ্রু নাচিয়ে বললো,
-কী করছিলে ফ্লোরে বসে বসে? কাঁদছিলে? এটাই তো বলতে চাইছিলে, তাই না? কী হলো? বলো! থেমে গেলে কেন?
থমথমে গলায় বললাম,
-আমি আপনাকে যেটা জিজ্ঞেস করেছি, সেটা বলুন আগে!
-তুমি জেদ ধরে বসে ছিলে। দরজা খুলবে না। বের হবে। খাবে না। তাই বাবা, আই মিন, তোমার বাবা আমায় ফোন দিলে আমি তোমাদের বাসায় আসি। তোমায় অনেক ডাকাডাকি করি, কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছিলাম না। অবশেষে বাধ্য হয়ে দরজা ভাঙতেই দেখি, তুমি সেন্সলেস হয়ে ফ্লোরে পড়ে আছো। তারপর আর কী? বাসা টু হসপিটাল!
বিরক্ত লাগছে ওনার কথা শুনতে। রাগও হচ্ছে প্রচুর। বাবা-মা কেউই নেই এখানে! নাক-মুখ কুঁচকে বসে রইলাম।
-কী হলো? চেহারাটা বাংলার পাঁচের মতো করে বসে আছো কেন?
বিস্ফোরিত চোখে নির্জনের দিকে তাকালাম। উনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। বিরক্তি নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিতেই কানে শীতল বাক্যস্রোত ভেসে এলো,
-এতোই বিরক্তিকর হয়ে গেছি আমি? তোমার এভাবে কান্নাকাটির কারণ আমি এখনো জানি না! বাবাকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ বা ইচ্ছে কোনোটাই ছিল না তখন! তোমার ঐ অবস্থা দেখে নিজের মধ্যেই ছিলাম। কিন্তু এখন তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, আমার জন্যই তুমি নিজের বেহাল দশা করেছো। কী করেছি আমি? বলো! আমি কোনো ভুল করে থাকলে বলো, সেটা আমি শুধরে নেব। আমায় শাস্তি দাও! নিজেকে কেন এভাবে কষ্ট দিচ্ছো?
হাসলাম। না চাইতেও কেন যেন তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো মুখে! উনি এমন ভাবে বলছেন যেন কিছু বুঝতেই পারছেন না। কথাবার্তায় কেমন একটা ইনোসেন্স ভাব! কিন্তু উনি কি জানেন আমার ভেতরে ঠিক কতোটা কষ্ট হচ্ছে? যাকে নিয়ে কয়েকদিন পরই জীবন বাঁধার কথা ছিল, যাকে এতোটা বিশ্বাস করেছিলাম, যাকে নিয়ে এক আকাশ স্বপ্ন বুনে ফেলেছিলাম ; সে আমাকে ভেঙে চুরমার করে দিলো!! এটা সহ্য করার চেয়ে তো গলা দিয়ে কাটা গেলাটা আমার জন্য বেশি সহজ হতো!
নির্জনের দিকে তাকালাম। উনি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। গলা ঝেড়ে বললাম,
-মানুষকে ঠকিয়ে কী লাভ পান আপনারা? অন্তত আমার সাথে এমনটা না করলেও পারতেন। আমি অতি সাধারণ। কোনো বিশেষত্বই নেই আমার মধ্যে। ত্…………..
-আমি তোমাকে ঠকিয়েছি? লাইক রিয়েলি!!!
নির্জন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। বিস্মিত চোখে রাজ্যের অবাকতা ছেয়ে আছে তার! এই ব্যক্তিটার দিকে তাকালেই কেন যেন এক অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে পড়ি আমি! খুবই চেনা একজন বলে মনে হয়। যেন তার সাথে হাজরো বছরের পবিত্র এক বন্ধনে আবদ্ধ আমি! এসব অনুভূতির সূত্র কবে মেলাতে পারবো, জানি না। মিলিয়েই বা কী লাভ? উনি তো অন্য কারো আঁচলে অনেক আগেই বাঁধা পড়ে গেছেন! যেখানে আমি একটা তৃতীয় ব্যক্তি মাত্র।
-ত্ তুমি কাঁদছো কেন? তুমি আমার জন্য কাঁদছো! আমি তোমাকে এতোটাই কষ্ট দিয়ে ফেলেছি, গুঞ্জন, যে তুমি অসুস্থ হয়ে গেলে!! আবার কাঁদছো ও।
নির্জনের কথা শুনে গালে হাত দিতেই ভেজা অনুভব হলো। কখন আবার গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়েছে খেয়ালই করিনি! বারবার ভেঙে পড়ছি আমি। আমাকে শক্ত হতে হবে। এমন ছিঁচকাঁদুনে টাইপ মানুষদের বেশি কষ্ট পেতে হয়। কঠিন দৃষ্টিতে নির্জনের দিকে তাকালাম। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম,
-নাটকটা একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে না!! আপনি নিজের সম্পর্কে আমায় মিথ্যে বলেননি? আপনি যে ম্যারেড, সেটা আমার কাছে হাইড করেননি? এর পরেও এতো অবাকতা আসে কোত্থেকে?
নির্জন আরেক দফা অবাকতা নিয়ে বললো,
-আমি মিথ্যে কবে বললাম? আমি তো এ পর্যন্ত কখনো বলিনি যে, আমি অবিবাহিত! আর হাইড করার কী আছে? তুমি তো কখনো জিজ্ঞেসও করোনি!
বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম নির্জনের দিকে। রাগে গাঁ জ্বলে উঠছে যেন! সেটাকে দমন করে বললাম,
-মজা নিচ্ছেন আমার সাথে? আমি কেন আপনাকে জিজ্ঞেস করতে যাবো? যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন, তার কাছে আগে থেকেই সবটা ক্লিয়ার করা উচিত ছিল আপনার।
-ইট ওয়াজ আ কম্পালশান, গুঞ্জন। আমার অবস্থা যদি তোমায় বলে বুঝাতে পারতাম, তাহলে একদম নির্ঝঞ্ঝাট হয়ে যেতাম। বিশ্বাস করো! অনেকটা মুখ বাঁধা, বাট হাত-পা খোলা টাইপ অবস্থা আমার। কিছুই মুখ খুলে বলতে পারছি না, কিন্তু হাত-পা ঠিকই চালাতে হচ্ছে।
কথার মর্মার্থ কিছুই বুঝতে পারলাম না। তাই মাথা না ঘামিয়ে জেদ ধরে বললাম,
-আমি আপনার কথা বুঝতেই পারছি না আর না বুঝতে চাইছি! শুধু এটাই বলবো, আপনি বিয়ের বিষয়টা লুকিয়ে খুবই জঘন্য একটা কাজ করেছেন। আমার সাথে প্রতারণা করেছেন। ইউ আর দ্য বিগেস্ট বেট্রেয়ার ওফ দ্য ওয়ার্ল্ড।
নির্জন চমকে গেলেন। হয়তো আমার মুখ থেকে ‘প্রতারক’ সম্বোধন শুনবে, এটা ওনার কল্পনারও বাইরে ছিল! নিজেরও কেমন যেন লাগছে ওনাকে এভাবে বলে! নির্জনকে কষ্ট দিলে সেটা আবার আমি কীভাবে ফিল করতে পারি? ভাবতেই অদ্ভুত লাগে। কিন্তু অদ্ভুত হলেও এটাই সত্য! এসবের জন্য এখন নিজের প্রতিই বিতৃষ্ণা বোধ হচ্ছে।
হঠাৎ নির্জন এগিয়ে এসে একদম আমার গাঁ ঘেঁষে বসে পড়লেন। চমকে উঠে তার দিকে তাকাতেই আমার দুই গালে দুই হাত দিয়ে মুখটা নিজের দিকে ফিরেয়ে নিলেন যেন মুখ ঘুরিয়ে নিতে না পারি। আমি মুখ সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই দু’হাতে জোরে চেপে ধরলেন। স্থির হয়ে একটা ঢোক গিললাম। নির্জন আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
-কীভাবে বললে তুমি এই কথাটা? তোমার আমার মধ্যে ঠিক কী আছে, সেটা তোমায় বলে বোঝাতে পারবো না, গুঞ্জন! ইন ফ্যাক্ট, বলতে পারবোই না আমি। ঐ যে বললাম না! মুখ বাঁধা। একবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখো তো! কিছু খুঁজে পাও কি-না! আমায় তোমার কাছে প্রতারক বলে মনে হয় কি-না!!
নির্জনের আকুলতা মিশ্রিত কথা গুলো কানে ঝনাৎ ঝনাৎ করে বাজছে। ওনার দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলালাম। অদ্ভুত রকমের গভীর সেই অক্ষিদ্বয়! যেন ভিন্ন এক মায়ার জগৎ, যেখানে নিজের অজান্তেই ডুবে যাচ্ছি! হারিয়ে যাচ্ছি! দুই বার পলক ফেললেও এখন আমার দৃষ্টি স্থির। প্রতিটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন হিম ঠান্ডা হয়ে জমে যাচ্ছে। নড়তে-চড়তে পারছি না। নির্জন এখনো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। চিরচেনা চোখ জোড়ায় চিরচেনা সেই আসক্তি! দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। চোখ বন্ধ করে ফেললাম। তড়িৎ গতিতে চোখের কার্ণিশ বেয়ে তরল উষ্ণ অশ্রু কণা ঝরে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। গালে রাখা নির্জনের দু’হাতের ওপর হাত রেখে ওনার কপালে কপাল ঠেকিয়ে দিলাম। কান্নার গতি বেড়ে গেল। পর মুহূর্তেই নিজের গালে টপ টপ করে পড়া পানির স্পর্শ পেতেই বুঝলাম নির্জন কাঁদছে। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে কী ঘটলো জানি না! আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম যেন! এটাই কি তাহলে নির্জনের বলা সেই *তুমিময় আসক্তি*?
#চলবে………