তুমিময় প্রাপ্তি পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0
489

#তুমিময়_প্রাপ্তি🍁
#পর্ব_৩৪
#মেহরিন_রিম
শত্রুরা যেন পিছুই ছাড়ছেনা আদৃতের। যাদেরকে সহ্য করতে পারেনা তাড়াই বরং বারবার চোখের সামনে চলে আসছে। দশদিনের গ্যাপ নিয়ে একটা কনসার্ট করছে, কিন্তু এখানে নিরবের দেখা পাওয়ার কোনো মানে হয়! একেতো রিফাত এর কথা মাথা থেকে বের হচ্ছেনা, তার উপর নিরব কে দেখে আরো মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে আদৃতের। কনসার্ট চলাকালীন টাইমে খেয়াল না করলেও কনসার্ট শেষ হওয়ার কিছুক্ষন আগে দেখতে পায় নিরব এবং তার কিছু বন্ধুকে।

ব্যাস,মেজাজ টা তখনি বিগড়ে যায়। কনসার্টে আসা লোকজন বিশেষ করে মেয়েরা সেলফি তোলার অনেক চেষ্টা করছিল,কিন্তু আদৃতের এখন এই ক্রাউড এর মধ্যে থাকার কোনো ইচ্ছে নেই। স্টেজ এর পিছন থেকে তাই কোনোভাবে বেড়িয়ে যায় আদৃত, অতঃপর সকলে হতাশ হয়ে চলে যায়।

একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে কনসার্ট ছিল, আদৃত সেখান থেকে বেড়িয়ে বাইক নিয়ে একটু সামনে চলে আসে। রাত হয়ে যাওয়ায় এখানে খুব একটা মানুষ নেই, তার উপর অন্ধকারে কেউ তাকে তেমনভাবে চিনতে পারবে না। একটা লেক এর পাশে বসে পকেট থেকে সিগারেট এর প্যাকেট টা বের করে আদৃত। মাথাটা একটু হালকা করা প্রয়োজন, সিগারেটে আগুন ধরিয়ে টান দিতে যাবে তখনি দেখতে পায় নিরব এবং তার বন্ধুরা এইদিকেই আসছে। বিরক্ত হয় আদৃত, বারবার সামনে চলে আসছে কেনো এরা? ওদের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সিগারেট এর ধোয়া ছাড়লো আদৃত। পকেট থেকে ফোনটা বের করে স্ক্রোল করতে শুরু করে, তবে ফোনের দিকে তার বেশিক্ষণ খেয়াল থাকেনি। নিরব এবং তার তিনজন বন্ধু আদৃত এর থেকে কিছুটা দূরত্বে বসে পড়ে,তারাও এখানে আদৃত কে খেয়াল করেনি। নিরবের সাথে থাকা একটা ছেলেকে আদৃত এর আগেও কলেজে দেখেছে।
আদৃত ফোনের দিকে চোখ রেখেই ওদের কথা শোনার চেষ্টা করলো।

নিরবকে খানিকটা মুড অফ করে থাকতে দেখে তার পাশে থাকা ছেলেটি তাকে সামান্য ধাক্কা দিয়ে বলে,
_একবার ছ্যাকা খেয়ে তোর এই অবস্থা ভাই! আর আমিতো এখন পর্যন্ত কতগুলো ছ্যাকা খাইলাম,কই আমি তো একদম ঠিক আছি।

_তুই কারোর সাথে সিরিয়াস রিলেশন এ গেলে তো বুঝবি!

_তো তুই এতো সিরিয়াস হইতে গেছিস কেনো? চিল মামা, লাইফ তো এখনো বাকি।

নিরবকে চুপ করে থাকতে দেখে ছেলেটা আবারো বলে,
_আচ্ছা তুই সিরিয়াস রিলেশন এ যেতে চাস তাই তো? তাহলে তেমন মেয়ের সাথে যা।

নিরব ভ্রু কুঁচকে বলে,
_কেমন মেয়ে?

নিরবের অন্য পাশে থাকা আরেকটি ছেলে বলে,
_আরে মেয়েতো তোর চোখের সামনেই থাকে,তুই দেখতেই পারিস না।

_ক্লিয়ারলি বলবি তোরা?

_ও ইশার কথা বলছে, দেখ আই থিংক মেয়েটা যথেষ্ট সিরিয়াস থাকবে রিলেশনশিপ নিয়ে। আর ও তো তোকে অনেক আগে থেকেই লাইক করে,এটা তুই একটু হলেও জানিস।

_দেখ ফালতু কথা বলবিনা।

_ফালতু কথা কই বললাম ভাই? তুইও এখন সিঙ্গেল,আর ইশাও হয়তো সিঙ্গেল। তাহলে প্রবলেম টা কোথায়? আমার মনে হয় তুই একবার প্রপোজ করলেই ও এক্সেপ্ট করে নেবে।

_আর যদি না করে?

_সেটা তো আলাদা কথা,কিন্তু ট্রাই করতে ক্ষতি কি?

_বলছিস?

_হ্যা বলছি।

বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় আদৃত। হাতে থাকা ফোনটা ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। অন্যহাতে থাকা সিগারেট টা চেপে ধরায় হাতে ছ্যাকা লাগতেই সেটা দূড়ে ছুড়ে ফেলে দেয় আদৃত। অসহ্য লাগছে তার, কোথায় মাথা ঠান্ডা করতে এখানে বসেছিল সেখানে হলো উল্টোটা।

দ্রুতপায়ে বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট দিলো আদৃত, স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি স্পীড এ বাইক চালাচ্ছে সে। বাহিরের শীতল বাতাসেও তার মাথা বিন্দুমাত্র ঠান্ডা হচ্ছেনা।
বাইক গ্যারেজে রেখে লিফট এ উঠে পড়লো আদৃত। চুল টেনে ধরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। দড়জা খুলে ফ্লাট এ ঢুকে শব্দ করে দড়জা আটকে দেয় সে। ডাইনিং রুমের লাইট জ্বলছে আর বাকি সব লাইট নেভানো। আদৃত নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় বসে দুহাতে মাথা চেপে ধরে। আজকের দিনটাই খারাপ তার জন্য। সকালে রিফাত এর ঘটনা, আর এখন নিরব তো সব সীমাই ছাড়িয়ে গেলো। যদিও সেদিন ইশার কথা শুনে মনে হয়নি তার মনে নিরব এর জন্য কোনো ফিলিংস অবশিষ্ট আছে, তবুও ভয় হচ্ছে আদৃত এর।
কিছুক্ষন আগে পর্যন্ত রিফাত কে নিজের শত্রু মনে হচ্ছিল আদৃতের কাছে,তবে নিরব কে এখন তার চেয়েও বড় শত্রু মনে হচ্ছে। কি করা উচিৎ তার? বলে দেবে ইশাকে তার মনের কথা? কিন্তু কি করে? যার সাথে ঝগড়া ছাড়া কোনো কথা বলেনি এখনো তাকে কি করে ভালোবাসার কথা বলবে?

বেশ চিন্তায় পরে গেলো আদৃত,মায়ের কথা মনে পরছে খুব। মায়ের কথা ভাবতেই একজনের কথা মনে পরলো আদৃতের। মাথা থেকে হাত সরিয়ে কিছুক্ষন চিন্তা করলো, মনে হলো সেই ব্যাক্তি আদৃতকে কিছু উপায় বলতে পারবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো আদৃত,কাল ই যাবে তার সাথে কথা বলতে।

____
পূর্ণর সামনে নিজের কান্না নিয়ন্ত্রন করলেও বাড়িতে এসে তা আর সম্ভব হচ্ছে না। কথাগুলো কিভাবে বলেছে সেটা কেবল ফাইজাই জানে। অতি কষ্টে আটকে রাখা কান্নাগুলো যেন এখন আর বাঁধ মানছে না। ইশার কিছুটা মাথা ব্যাথা থাকায় সে নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছে,নাহলে সে এতক্ষনে ঠিকই ফাইজার ঘরে চলে আসতো।
হাটুতে মুখ গুজে কাঁদছে ফাইজা। আগের চেয়েও যেন এখন বেশি কষ্ট হচ্ছে তার। আগে জানতো পূর্ণ তাকে ভালোবাসেনা,তাই নিজের মনকে শান্ত রাখতে পেরেছিল। কিন্তু এখন কি করে শান্ত হবে, যেখানে সে নিশ্চিত পূর্ণ তাকে ভালোবাসে। যদি তাকে নাই পাওয়ার ছিলো, তাহলে কেন নতুন করে আশা জেগেছিল মনে?

রাতে আর খাওয়া হলোনা ফাইজার,কাঁদতে কাঁদতে একসময় ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়লো সে। এই সময়টুকুই হয়তো কষ্টগুলো ভুলে থাকতে সক্ষম হবে সে।

___
জানালা থেকে আসা সূর্যের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় ফাইজার। চোখ খুলে মাথা তুলতেই বুঝতে পারে তার মাথা ভার হয়ে আছে। বিছানায় হাতের ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। এত আলো তার ভালো লাগছে না,তাই গিয়ে জানালার পর্দা টেনে দেয় সে। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দড়জা খুলে দেয় সে। ইশা এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি দেখে নিচে চলে আসে। রান্নাঘরে গিয়ে দেখতে পায় রুকসানা অনেক ধরণের নাস্তা বানাচ্ছেন। ফাইজা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
_এত কিছু কার জন্য করছো ছোট আম্মু? ছোট আব্বু আসবে নাকি?

রুকসানা ফাইজার দিকে তাকিয়ে বলে,
_না না তোর ছোট আব্বু নয়। ভাইয়া ভাবি আসছে, কতদিন পর আসছে বলতো!

ফাইজা চোখ বড়বড় করে বলে,
_আব্বু আম্মু আসছে?

_হ্যা..

_কখন? আমি তো কিছু জানিনা।
#তুমিময়_প্রাপ্তি🍁
#পর্ব_৩৫+৩৬
#মেহরিন_রিম
ফাহমিদার কথা শুনে রুকসানা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে হাসতে শুরু করলো। ফাহমিদা অবাক হয়ে তাকাতেই রুকসানা হাসি থামিয়ে বললো,
_আপনি পারেন ও ভাবি, ফায়াজ এর সঙ্গে ইশার বিয়ে! হাসালেন..

তাদের কথার মাঝে এবার জাফর বললো,
_হাসির কি আছে এখানে? মেয়েকে তো একদিন বিয়ে দেবেই,তাহলে পরিবার এর মধ্যে বিয়ে দিলেই তো ভালো হয়।

_আপনি নিজেও জানেন ভাইয়া, ফায়াজ এর কাছে ফাইজা আর ইশা দুজনেই সমান। আর ইশাও ওকে বড় ভাই হিসেবে যথেষ্ট ভালোবাসে। এত সুন্দর সম্পর্কটা কে আমি নষ্ট করতে চাইছিনা..

ফাহমিদা আরো কিছু বলবে তার আগেই ফাইজা তার কাছে গিয়ে হাত ধরে বলে,
_আরে ছোট আম্মু তুমি ছাড়তো,আম্মু তো মজা করছিল। তাই না আম্মু?

ফাহমিদা কড়া চোখে ফাইজার দিকে তাকায় তবে রুকসানা ফাইজার কথা শুনে হেসে টেবিলে সবকিছু গোছাতে শুরু করে। ফাহমিদা ফাইজার উদ্দেশ্যে কিছু বলার আগেই ফাইজা তার হাত ধরে দাড় করিয়ে বলে,
_আম্মু এক্ষুনি আমার সঙ্গে ঘরে চলো, মাথা নষ্ট হয়ে গেছে তোমার।

ফাইজা ফাহমিদার হাত ধরে ঘরে নিয়ে গিয়ে দড়জা আটকে দিতেই ফাহমিদা রাগান্বিত স্বরে বলে,
_তুই বললি কেন আমি মজা করছিলাম?

_তোমার সম্মান বাঁচানোর জন্যই বলেছি।

_মানে?

_তুমি জানোনা ভাইয়া একটা মেয়েকে আগে থেকে ভালোবাসে,দেশে ফিরে তো তাকেই বিয়ে করবে বলেছে। আর সেখানে তুমি এসেছো ইশার সঙ্গে ওর বিয়ে দিতে!

_পছন্দ করেছে তো কি হয়েছে,বিয়ে তো আর করে ফেলেনি।

_আম্মু প্লিজ,আর নিচে নেমোনা।

_ফাইজা,আমি তোর মা। আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারিস না তুই।

_এটাই তো,তুমি আমার মা বলেই তোমার এসব কার্যকলাপে আমার লজ্জা লাগে। ভাইয়া তো এসব কিছু জানেই না,জানলে কি হবে বুঝতে পারছো?

ফাহমিদা প্রতিত্তরে কিছু বলার আগেই ফাইজা আবারো বলতে শুরু করে,
_আমি তোমার মেয়ে মা, তোমার কি মনে হয় আমি তোমার প্ল্যান সম্পর্কে কিছু জানিনা? সবই জানি আমি, ছোট আব্বুর বেশিরভাগ সম্পত্তি ইশার নামে করা,আর এটাই তুমি সহ্য করতে পারছো না। নিজের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে পারলে ঘুরেফিরে সবটা তোমরাই পেয়ে যাবে। সেইজন্যই তো ইশার সঙ্গে ভাইয়ার বিয়ে দিতে চাইছো তাইনা?…

_ফাইজা…অনেক বেশি কথা বলছিস আজকাল।

_বাধ্য হচ্ছি বলতে। কখনো কোনো কিছু নিয়ে তোমাদের কিচ্ছু বলিনি আমি, কিন্তু এই বিষয়ে আর একবারো কথা বললে আমি সবকিছু ভাইয়াকে জানাতে বাধ্য হবো। তোমার ছেলে এগুলো জানতে পারলে কিন্তু আর কখনো দেশে ফিরবে না আম্মু,এইটুকু সিওর থাকতে পারো।

_আমাকে হুমকি দিচ্ছিস তুই?

_ধরে নাও তাই।

আর এক সেকেন্ড ও রুমে দাঁড়ালো না ফাইজা। দড়জা খুলে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে, আর ফাহমিদা একই যায়গায় দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসতে থাকলেন।

____
ফাহমিদা আর জাফর ডাক্তার দেখিয়ে সেখান থেকেই বাড়ি চলে যাবে। ফাইজা বোধহয় একমাত্র মেয়ে যে কিনা বাবা মায়ের সঙ্গে থাকতে চায়না, তাদের থেকে দূড়ে থাকলেই সে ভালো থাকে। যথেষ্ট শক্ত মনের মেয়ে ফাইজা, তবে সবসময় সেটা ধরে রাখা যায়না। কিছু কিছু সময় সেও নিজেকে সংযত রাখতে পারেনা। দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষে ইশার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে ফাইজা। ইশার সঙ্গে থাকলে কষ্ট করে হলেও নিজের মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখতে সক্ষম হয় সে।

ইশা বসেবসে ফোনে গেইমস খেলছিল। ফাইজা তেল দেওয়া শেষে হাত ধুয়ে আসতে যাবে তখনি দেখে তার ফোনটা বাজছে। সাইলেন্ট করা বোধ হয় তাই শুনতে পায়নি। ফাইজা ফোনটা রিসিভ করে বলে,
_হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।

_…..

_হ্যালো? কে বলছেন?

_……

ফাইজা ভ্রু কুচকে ফোনটা সামনে আনে, একটা অপরিচিত নম্বর। ফাইজা আরো কয়েকবার হ্যালো বলার পরও কোনো উত্তর না পেয়ে বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দেয়। বিছানার উপর ফোনটা রেখে হাত ধুয়ে এসে দেখে একই নম্বর থেকে একটা মেসেজ এসেছে। ফাইজা মেসেজ চেক করে দেখে,
_একবার দেখা করতে চাই আমি। একই জায়গায়,বিকেল ৫ টায়। থাকবে প্লিজ..

হৃদয় জুড়ে আবারো বিষাদ ছড়িয়ে যায়। মেসেজ টা থেকে বেড়িয়ে বিছানায় বসে পরে ফাইজা, কলটাও তাহলে পূর্ণই করেছিল। কিন্তু সে যাবেনা, ফোনটা হাতে নিয়ে ‘না’ লিখেও মেসেজ সেন্ড করলো না ফাইজা। যাওয়া উচিৎ?

____
গতকালকের সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ফাইজা এবং পূর্ণ। তবে আজ তারা মুখোমুখি দাঁড়ায়নি,দুজনে পাশাপাশি দাড়িয়ে আছে। অনেক জল্পনা কল্পনার পর ফাইজা এসেছে পূর্নর কথায়,পূর্ণ জানতো ফাইজা আসবে।

নিরবতা কাটানোর লক্ষ্যে ফাইজা বললো,
_বেশি সময় নেই আমার,কেন ডেকেছো বলো।

পূর্ণ পাশ ফিরে ফাইজার দিকে তাকিয়ে বলে,
_বলতে বলছো? তাহলে শুধু আমিই বলবো আজ, তুমি শুনবে।

ফাইজা তাকায়নি পূর্ণর দিকে,পূর্ণ এবার বুকে হাত গুজে ফাইজার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে,
_জানো আমি না কখনো জীবন নিয়ে খুব বেশি ভাবি ই নি।শুধু ভেবেছি, আমি স্বেচ্ছায় এই প্রফেশনে এসেছি, আর এখানে থেকে মৃত্যুকে ভয় পেলে চলবে না। বাবা-মা এর বয়স হয়েছে,আর আমি না থাকলেও আমার বোন ওদের দেখে রাখবে এটা আমার বিশ্বাস। তাই আমি নির্ভয়ে যেকোনো রিস্ক নিতে পেরেছি। আমার মনে হয়েছে,কারোর জীবন আমার সঙ্গে জড়িয়ে থাকলে আমি কাজে মনোযোগ দিতে পারবোনা,এই রিস্কগুলো নিতে পারবোনা। আর সেই কারণেই আমি এসব থেকে নিজেকে দূড়ে সরিয়ে রেখেছি, তবে হ্যা তোমার কথাও কোনো অংশে ভুল ছিলোনা।

থামলো পূর্ণ, বড় নিঃশ্বাস নিয়ে আবারো বললো,
_আমি অনেক বুঝিয়েছি নিজেকে, আমি যেমনটা চেয়েছিলাম সবটা সেভাবেই হয়েছে। কিন্তু এতকিছুর পরে গিয়ে আমার মনে হলো, আমারো জীবন নিয়ে ভয় করা উচিৎ।

এরক্ষনে এই প্রথম পূর্ণর দিকে তাকালো ফাইজা। পূর্ন আবারো বললো,
_ফাইজা আমার না হুট করে ভীষণ বাঁচতে ইচ্ছে করছে, তবে একা নয়…তোমার সঙ্গে। নিজেকে সুরক্ষিত রাখার একটু বেশিই চেষ্টা করবো নাহয়। যেসব জায়গায় একা যেতাম সেখানে অন্য একজনকে সাথে নিয়ে যাবো নিজের সেফটির জন্য। নিজেকে ঠিক রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো…

ফাইজা চুপচাপ কেবল পূর্নর কথা শুনছে। পূর্ণ এবার “এক সেকেন্ড” বলে বেঞ্চে থাকা ব্যাগ থেকে সেই বইটা বের করে ফাইজার সামনে ধরে বললো,
_অন্য মেয়েদের চেয়ে তোমাকে একটু বেশি ই চিন্তায় থাকতে হবে। হয়তো হুট করে আমার কোনো খোজ পাবেনা, তখন ধৈর্য ধরে আমার ফেরার অপেক্ষায় থাকতে হবে। আমি ঠিক আছি কিনা ভেবেই তোমার দিনের অর্ধেক সময় কেটে যাবে, নিশ্চিন্তে তুমি কখনোই থাকতে পারবেনা। দিনশেষে আমি তোমার সামনে এসে দাঁড়ালে স্বস্তি পাবে তুমি। আমি জানি, তুমি এই সবগুলোর জন্য প্রস্তুত। তবুও জিজ্ঞেস করছি, এতটা স্যাক্রিফাইস স্বিকার করে ভালোবাসবে আমায়?

ফাইজা এখনো চুপ করে আছে। পূর্ন এবার কিছুটা অসহায় ভঙ্গিতে বলে,
_একটার জায়গায় প্রয়োজনে দুটো রিভলভার সাথে রাখবো..

এতক্ষন চুপ করে থাকলেও এবার ফিক করে হেসে দিলো ফাইজা। মুখে হাত দিয়ে নিজের হাসি লুকোনোর চেষ্টা করলো। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
_মেয়েদের গোলাপ দিয়ে প্রপোজ করতে হয়।

_ইউনিক মানুষ ইউনিকভাবেই প্রপোজ করে।

_তাই না? আর আমি কেনই বা এক্সেপ্ট করবো তোমাকে? কম কষ্ট দিয়েছো আমায়?

বইটা বেঞ্চের উপর রেখে দিলো পূর্ণ। এরপর ফাইজার দিকে আরো কিছুটা এগিয়ে মৃদু হেসে বললো,
_কষ্ট যখন আমি দিয়েছি,এবার ভালোবাসার সুযোগটাও আমাকেই দাও।

ফাইজা কিছুটা ধরা গলায় বললো,
_বলো আর কখনো কষ্ট দিবে না আমায়, তাহলে ভেবে দেখবো।

মাথা নাড়লো পূর্ণ। ফাইজা এবার আর সামলাতে পারলো না নিজেকে, পূর্ণকে জাপটে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো সে। পূর্ণ বাধা দিলোনা, কাঁদুক একটু। মাঝে মাঝে কান্নাও সুখের হয়।

____
গতকাল অফিসের কাজে ব্যাস্ত থাকায় আর সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষের কাছে আসা হয়নি আদৃতের। তাই আজ অফিসের কিছু কাজ সেরেই চলে এসেছে আশ্রমে। সেদিন রাতে আয়শার কথাই মনে পড়েছিল, হয়তোবা উনি কোনো সাজেশন দিতে পারবেন। তাই ওনার কাছেই যাচ্ছে আদৃত।

আশ্রম এ ঢুকে আশেপাশে তাকিয়ে আয়শাকে খোজার চেষ্টা করলো আদৃত,তবে তাকে কোথাও দেখা গেলো না। ভিতরে যেতেও কিছুটা আনইজি ফিল হচ্ছে। তাই কয়েক মিনিট আশ্রমের উঠানের পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো। ভাগ্য ভালো ছিলো আদৃতের,মিনিত দু’একের মধ্যেই আয়শা আশ্রমের ভিতর থেকে বেড়িয়ে এলো কোনো এক কাজে। আদৃত তাকে দেখতে পেয়েই খুশি হয়ে উঠানের মাঝে আয়শার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আয়শা আদৃতের দিকে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করব বললো,
_তুমি..

_আমি আদৃর আন্টি, সেদিন ইশার সাথে..

_ওহ হ্যা,মনে পড়েছে। কেমন আছো বাবা?

আদৃত মুচকি হেসে বললো,
_খুব একটা ভালো নয়।

আয়শা চিন্তিত হয়ে বললেন,
_ওমা কেন?

_ভালো থাকার সাজেশন এর জন্যই এসেছি আপনার কাছে।

_আমার কাছে, আচ্ছা তুমি দাড়াও আমি চেয়ার নিয়ে আসছি।

কথাটা বলে আয়শা আশ্রমের ভিতর থেকে দুটো চেয়ার নিয়ে এলেন। আদৃত গিয়ে বসার পর আয়শাও পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। আদৃতের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
_এবার বলো কি হয়েছে, দেখি তোমার কোনো সাহায্য করতে পারি কিনা।

আদৃত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। নিজের ব্যাক্তিগত জীবনের কথা সে কাউকে খুব বেশি জানায় না। তবে আজকে আয়শার কাছে বলতে কোনো দ্বিধাবোধ করছে না সে। অত:পর, একে একে সবকিছু খুলে বললো আয়শাকে।

তবে আশ্চর্যজনক ভাবে সবটা শোনার পর আয়শা কেমন গম্ভীর হয়ে গেলেন। আদৃত সবকিছু বলার পড় কিছুটা থেমে আবারো আয়শার উদ্দেশ্যে বললো,
_আমি কি করবো সেটাই বুঝতে পারছিনা আন্টি,তাই আপনার কাছে..

_ইশাকে ভালোবাসো তুমি?

সামনের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় কথা বললেন আয়শা। আদৃত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছোট করে উত্তর দিলো,
_হ্যা..

আয়শা অদ্ভুত ভাবে আদৃত এর দিকে তাকিয়ে বললেন,
_কি করে নিশ্চিত হচ্ছো? ভালোবাসা তো কদিন বাদে ফুঁড়িয়েও যেতে পারে।

আদৃত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
_আপনি হঠাৎ এমন কথা জিজ্ঞেস করছেন যে..

তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলো আয়শা। চোখ বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,
_আমাকেও তো একজন ভালোবেসেছিল। আমার জন্য বাড়ি পর্যন্ত ছেড়েছিল। ছোট্ট টিনের ঘরে আমাদের সুখের কোনো কমতি ছিল না। তবে সেই সুখ, ভালোবাসা সবই ছিল ক্ষণস্থায়ী। ভালোবাসা ফুড়িয়ে গেলো, আর আমার প্রয়োজন ও। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো বাড়ি থেকে।

আদৃত এর দিকে তাকালো আয়শা, শক্ত গলায় বললো,
_তোমার ভালোবাসা যে স্থায়ী হবে তার কি কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারবে?

আদৃত নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,
_আপনার সাথে যা হয়েছে তা অবশ্যই ভালো হয়নি। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে তো তা নাও হতে পারে আন্টি। আমি ইশাকে কতটা ভালোবাসি জানিনা। কিন্তু ভালো থাকার জন্য, ভালোভাবে বাঁচার জন্য আমার ওকে চাই।

মুখভঙ্গি পরিবর্তন হলো আয়শার, হঠাৎ করেই তার মুখের কঠিন ভাব কেটে গেলো। মুচকি হেসে আদৃতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
_তাহলে যাকে ভালোবাসো তাকে একেবারে নিজের কাছেই নিয়ে এসো।

আদৃত অবাক হয়ে বললো,
_আপনি কি কোনোভাবে বিয়ে করার কথা বলছেন?

_অনিশ্চিত সম্পর্কের চেয়ে সেটা ভালো নয় কি?

_কিন্তু ইশা এখনো অনেকটা ছোট,ওর মা বাবাই বা এত কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দিতে যাবে কেন?

_ঠিকই বলেছো। তাহলে মনে সাহস জুগিয়ে বলে দাও নিজের মনের কথা।

_ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা হলো সাপেনেউলে সম্পর্ক। সেখানে আমি এমন কিছু কি করে বলি আন্টি?

_তাহলে বন্ধুত্ব করো ওর সঙ্গে, ইশার সাথে বন্ধুত্ব করা কিন্তু খুব একটা কঠিন কাজ নয়।

_চেষ্টা করে দেখতে পারি।

আয়শা মুচকি হেসে বললেন,
_এতো চিন্তা করোনা, যে তোমার তাকে তোমার থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবেনা।

স্মিত হাসলো আদৃত। কিছুটা শান্তি লাগছে এখন, আয়শার সাথে আরো কিছুক্ষন কথা বলে আশ্রম থেকে বেড়িয়ে আসে আদৃত। তবে বাইকের কিছুটা দূড়ে থাকতেই দেখতে পারে ইশা আর মোহনা এদিকেই আসছে। এখন ইশার সামনে পড়ার ইচ্ছে নেই,তাই একটু আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আদৃত।

_আমি তোকে আন্টিমনির কথা বলেছিলাম না? আন্টিমনি এই আশ্রমেই থাকে,চল আজ তোর সঙ্গে দেখা করাবো তার।

_হ্যা চল, অনেকতো গল্প বললি আন্টিমনির। এবার একটু সামনাসামনি ও দেখে নেই।

কথাটা বলে রাস্তা পার হতে যাবে তখন তাদের সামনে এসে হাজির হয় রিফাত। ইশাকে দেখে মেকি হেসে বলে,
_বাসায় যাচ্ছিস বুঝি?

ইশা হেসে উত্তর দেয়,
_হ্যা ভাইয়া,কলেজ থেকেই ফিরছি।

রিফাত এক হাত পিছনে রেখেছিল। ইশাকে এদিকে আসতে দেখেই পাশের গাছ থেকে একটা ফুল ছিড়ে এনেছে সে। রিফাত কিছুটা লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলে,
_আসলে তোকে কয়েকদিন ধরেই একটা কথা বলবো ভাবছি,কিন্তু বলা হয়ে উঠছে না।

মোহনা ইশার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করলো। ইশা রিফাত এর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
_আরে ভাইয়া বলে দাও কি বলবে,এত লজ্জা পাচ্ছো কেন?

রিফাত এবার সাহস সঞ্চয় করে ইশার সামনে হাটু গেড়ে বসে ফুলটা এগিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে,
_ফুলের ন্যায় দেখতে তুমি, চাঁদ মাখা সেই হাসি….
সত্যি করে বলছি আমি,তোমায় ভালোবাসি!..

হা করে রিফাতের দিকে তাকিয়ে রইলো মোহনা। ঘাড় ঘুরিয়ে ইশার দিকে তাকিয়ে দেখলো তার ও একই অবস্থা। রিফাত দাঁত বের করে হেসে বললো,
_ইশা,কিছু বল..

মুখ বন্ধ করে নেয় ইশা। তারপর তড়িঘড়ি করে বলে,
_আরে কি করছো,ওঠো ওঠো..

রিফাত উঠে দাড়ানোর পর ইশা চট করে ওর হাত থেকে ফুলটা নিয়ে নেয়। মেকি হেসে বলে,
_ফুলটা খুব সুন্দর..প্রপোজ টাও খুবইইই সুন্দর ছিলো। কিন্তু..

_কিন্তু?

ইশা হতাশ ভঙ্গিতে নিজের বাম হাতটা উপরে তুলে বলে,
_আমিতো এনগেইজড…

#চলবে

_তোর ফোন কোথায় রাখিস? ভাবি বললো তোকে ফোনে পাচ্ছে না। আর আমিও জানতাম না তো,ভাবি ভোরবেলা ফোন দিয়ে বললো ভাইয়ার হাটু ব্যাথাটা একটু বেড়েছে তাই ডাক্তার দেখাতে আসছে। এইতো এক্ষুনি চলে আসবে, তুই একটু হাতেহাতে কাজ করে দে না মা। না থাক,তুই গিয়ে বরং ইশাকে ডেকে দে। বন্ধ পেয়ে আর ঘুম থেকেই ওঠার নাম নেই।

_হুম যাচ্ছি।

ফাইজা রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে ইশার রুমের দিকে যেতে লাগলো। তবে তার চিন্তা হচ্ছে, আদতেও কি তারা ডাক্তার দেখানোর উদ্দেশ্যেই আসছে নাকি অন্য কাজে? ভাবতে ভাবতেই ইশার ঘরে চলে এলো ফাইজা,এখন ইশাকে ঘুম থেকে ওঠানোও আরেকটা যুদ্ধ..

দশমিনিট এর মধ্যেই ফাইজার বাবা মা অর্থাৎ জাফর সাহেব এবং ফাহমিদা বাড়িতে প্রবেশ করলেন। রুকসানা তাদের আপ্যায়নে ব্যাস্ত,ফাইজাও তাকে কিছু কাজে সাহায্য করছে। তবে তার নজর বাবা মায়ের দিকে, তাদের হাবভাব ভালো ঠেকছে না। নিজেরা ফিসফিস করে কোনো বিষয়ে আলোচনা করছে।

ইশাকে ঘুম থেকে ওঠাতে ব্যার্থ হয়েছে ফাইজা,আজ ছুটির দিন তাই সে বারোটার আগে ঘুম থেকে উঠবেনা। টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে জাফর আর ফাহমিদা কে ডেকে আনলো ফাইজা। তাড়াও হাসিমুখে ডাইনিং টেবিল এ বসে নাস্তা করতে করতে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললো। তবে ফাইজা আছে অন্য চিন্তায়, আর তার ধারণা সত্যি প্রমাণিত হলো কিছুক্ষন পরেই।
ফাহমিদা রুকসানার উদ্দেশ্যে বললেন,
_ইশা তো বড় হচ্ছে,ওর বিয়ের কথা কিছু ভেবেছো নাকি?

রুকসানা হেসে উত্তর দেয়,
_ওর তো এখনো বিয়ের বয়স ই হয়নি ভাবি। আগে ভার্সিটি তে উঠুক,তারপর ভাববো এই নিয়ে।

ফাহমিদা জাফর এর দিকে একনজর তাকিয়ে আবারো রুকসানার দিকে তাকিয়ে বললো,
_বলছিলাম যে, আমাদের মেয়ে আমাদের কাছে থাকলেই ভালো হয়না?

_ভাবি ঠিক কি বলতে চাইছেন বুঝলাম না..

_আমার ছেলেও তো বড় হয়েছে, তাই ভাবছিলাম ফায়াজ এর সঙ্গে ইশার বিয়ে দিয়ে দিলে কেমন হয়।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে