#তি_আমো❤
#পর্ব_১৪
Writer: Sidratul muntaz
🍂
ভয়ে চুপসে আছি, ফোন নম্বর বলা তো দূরে থাক গলা দিয়ে আওয়াজটাও বের হচ্ছে না আমার। এদিকে হলুদ শার্টের ছেলেটা আমার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ভ্রু কুচকে তার বসের দিকে তাকাল। তাকিয়ে বলল,
ভাই! ম্যাডাম তো কথা কয়না।
নীল জ্যাকেটের ছেলেটা আড়চোখে আমার দিকে তাকাল। আমি আরো ভয়ে কাপতে লাগলাম। তাই দেখে ছেলেটা হাসল। হলুদ শার্টের ছেলেটার গালে চড় দিয়ে বলল,
কথা বলবে কিভাবে? তোকে পছন্দ হয়নি। চল হাট।
নীল জ্যাকেটওয়ালা কলার ঠিক করে আমার কাছে এগিয়ে আসল। আমার কপাল দিয়ে ঘাম ঝরছে। ভয়ে অস্থির আমি। কিন্তু এতোটা ভয় পেলে তো চলবে না। শক্ত হাতে সবটা সামাল দিতে হবে। আমি নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করলাম। নিজের মনে সাহস যুগিয়ে বললাম,
দেখুন। আমার পথ ছাড়ুন। আমাকে যেতে হবে।
পথ কি ধরে রেখেছি নাকি? অবশ্যই ছেড়ে দিবো। শুধু নম্বরটা বল, ছেড়ে দিচ্ছি।
আমি সুযোগ বুঝে পাশ কাটিয়ে দৌড় লাগাতে চাইলাম তখন ছেলেটা হাত ঠেকিয়ে আটকালো। সম্পুর্ণ ডান হাতটা দিয়ে আমার গলা বরাবর আড়াআড়িভাবে ঠেসে ধরল। আমি চিৎকার দেওয়ার আগেই নিহা আচমকা প্রকান্ড শব্দের চপোটাঘাত করলো ছেলেটির গালে। নিহার হঠাৎ আগমনে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম আমি। স্বস্তি নিয়ে নিহার কাধ চেপে ধরলাম। বিস্ফোরিত চোখে একবার নিহার দিকে আর একবার ছেলেটার দিকে তাকালাম। নিহা রাগে মুখ বিকৃত করে বলল,
আর কোনোদিন যদি দেখি রাস্তাঘাটে মেয়েদের এইভাবে হ্যারেস করতে তাহলে তোর চৌদ্দপুরুষের নাম ভুলিয়ে তোকে জেলের ঘানি টানাবো আমি। মনে থাকে যেন। ফালতু একটা।
পেছন থেকে এক গাদা সাঙ্গু পাঙ্গু হৈহৈ করে ছুটে আসতে নিচ্ছিল। কিন্তু নীল জ্যাকেটওয়ালার হাতের ইশারা পেয়ে থেমে যেতে হলো তাদের। ছেলেটা রক্তাক্ত চোখ আর কম্পিত দেহ নিয়ে গালে হাত চেপে দাড়িয়ে ছিল। নিহা আমায় টেনে নিয়ে আসল চোখের পলকেই। আমি নিরব দর্শকের মতো শুধু ঘটনা দেখে গেলাম। কলেজ গেইটের সামনে আসতেই আমি থমকে দাড়ালাম। নিহার হাত খামচে ধরে ত্রাসিত কন্ঠে বললাম,
দোস্ত কাজটা কি ঠিক হলো? তুই কেনো মারতে গেলি ছেলেটাকে? এবার যদি খারাপ কিছু হয়।
নিহা গর্জিত কন্ঠে উচ্চারণ করল, আমি না আসলে তোর সাথে অনেক খারাপ কিছু হতে পারতো। পাখির মতো আত্মা নিয়ে রাস্তায় চলাফেরা করিস? এদের সাথে মিয়াও মিয়াও করলে তো আরও বেশি পেয়ে বসবে তোকে। প্রতিবাদ করতে যতদিন না শিখবি উত্যক্ত হতে হবে। থামবে না এই অনাচার।ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়া মানেই কিন্তু অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। এখনো সময় আছে আওয়াজ তোলা শিখ। সবসময় তোর পাশে থাকবো না আমি।
ক্ষিপ্রবেগে কথাগুলো বলে ক্যাম্পাসের দিকে হাটা ধরল নিহা। আর আমি আগের জায়গাতেই দাড়িয়ে আছি। নিরবে নিহার ঝারিগুলো হজম করা ছাড়া আর কিচ্ছু করার নেই আমার। আজকে যে সাহস নিহা দেখালো, সেটা কি আমার পক্ষেও সম্ভব? নিহার মতো রোজ বড় গাড়ি করে কলেজে আসি না আমি।আমার পেছনে ছায়ার মতো শক্ত সামর্থ্য ড্রাইভার আঙ্কেল থাকে না। নিহার মতো প্রভাবশালী ক্ষমতাবান বাবাও নেই আমার। তাহলে কিসের ভিত্তিতে প্রতিবাদ তুলবো আমি? কার ভরসায়? আজকে নিহার জায়গায় চড়টা যদি আমি মারতাম, তাহলে হয়তো কালই খবরের কাগজের হেডলাইন হয়ে যেতাম। ধর্ষিত কিংবা এসিড নিক্ষিপ্ত অসহায় এক মেয়ে। যে কিনা প্রতিবাদ করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল। কিন্তু একটা কথা নিহা বেশ বলেছে। সবসময় আমার পাশে থাকবে না সে। দিনশেষে আমি একা। বড্ড একা।
.
কলেজ ছুটির পর নিহার গাড়িতে উঠতে হয়েছে আমায়। আমাকে বাসায় ড্রপ না করা পর্যন্ত শান্তি হবে না তার। যদিও নিহার বাসার রাস্তা আর আমার বাসার রাস্তা সম্পুর্ণ বিপরীত দিকে। প্রায় দশমিনিটের মাথায় সদর দরজার সামনে গাড়ি থামল। আমি নিহাকে বিদায় জানিয়ে ঘরে প্রবেশের উদ্দেশ্য নিয়ে পা বাড়ালাম। কিন্তু দরজায় তালা লাগানো। আমি খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়লাম। কোনো এক অবিদিত কারণে মনে শঙ্কা জেগে উঠল। এ সময় তো সবারই বাসায় থাকার কথা।ঠিক এই সময় তারিফের ভাইয়াও লাঞ্চের জন্য আসে। কিন্তু এখন কেউ নেই। অসময়ে ঘরের দরজায় তালা দেওয়া, বিষয়টা মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না। আমি পাশের বাসার পারবতী আন্টির দরজার টোকা দিলাম। মা উনার কাছে প্রায়সময় ঘরের চাবি দিয়ে যায়। পারবতী আন্টি দরজা খুলে আমায় দেখেই প্রত্যাশিত হাসি দিলেন। বললেন,
তারিন এসেছো?
মনে হচ্ছে আমার অপেক্ষাতেই ছিলেন উনি। আমি হালকা হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। আন্টি বললেন,
এসো ভিতরে এসে বসো।
না আন্টি আমি বসবো না। বাসার সবাই কোথায় গেছে?
শীঘ্রই চলে আসবে। তুমি ভিতরে আসো।
আন্টি কি হয়েছে বলবেন প্লিজ? আমার টেনশন হচ্ছে।
টেনশনের কিছু নেই। ছোটখাটো একটা ঝামেলা হয়েছে। তাই সবাই থানায় গেছে।
থানায়? থানায় কেনো গেছে আন্টি?
তোমাদের বাসায় একটা ফরসা করে ছেলে আছে না? ওই ছেলে আমাদের কমিশনারের ছেলের হাত মুচড়ে ভেঙে দিয়েছে। তাই নিয়ে কমিশনার মামলা করেছে। সেই ঝামেলা মেটাতেই সবাই থানায় গেছে। আয়েশা আপা বলে গেছে তুমি কলেজ থেকে আসলে আমার ঘরে বসিয়ে রাখতে। তুমি এসো তারিন।
আন্টি দরজা খোলা রেখেই ভেতরের চলে গেলেন। আর আমি স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছি। পা চালানোর শক্তিটকুও অবশিষ্ট নেই। কাধ থেকে অটোমেটিক ব্যাগটা খসে পড়ল। শরীর ছেড়ে দিচ্ছে। কে এই কমিশনারের ছেলে? ওই নীল জ্যাকেটওয়ালা নয়তো? হে আল্লাহ রক্ষা করো। আমি ঘরের চৌকাঠে পা রাখলাম না। মনটায় অস্থিরতা চেপে বসল। ফ্লোর থেকে ব্যাগটা তুলে নিয়েই দৌড় লাগালাম। একটা রিকশা নিয়ে পুলিশ স্টেশনের দিকে রওনা দিলাম। ঝামেলাটা দেখতেই হবে। পুলিশ স্টেশনের সামনে প্রকান্ড মাপের ভীড়। যেন মুভির শ্যুটিং চলছে। আমি ভীড়ের ঠেলাঠেলিতে এক প্রকার যুদ্ধ জয়ের মতো ভেতরে প্রবেশ করলাম। পুলিশ ইউনিফরম পড়া একজন লোক আমায় আটকালো। ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। বাধ্য হয়ে বিপরীত পাশের জানালায় উকি দিলাম। সেখানেও মানুষের ঠাসাঠাসি। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে জানালা ধরে দাড়াতেই ঈশানকে চোখে পড়ল। মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে ঈশান। হাতে ব্যান্ডেজ। ভাইয়া ঈশানের বরাবর দাড়িয়ে। দেয়াল ঘেঁষে লম্বামতো একটা বেঞ্চিতে বসে আছে ভুড়িওয়ালা সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত এক ভদ্রলোক। মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। গালে দাড়ি নেই তবে মুচ আছে। বিরক্তিকর চেহারা। ভদ্রলোকের পাশেই গলা থেকে হাত পর্যন্ত ব্যন্ডেজ নিয়ে বসে আছে এক যুবক। উনিই ব্রীজের সামনের সেই নীল জ্যাকেটওয়ালা, তা বুঝতে বেশি দেরি হল না আমার। কমিশনারের অপর পাশে পুলিশ অফিসার বসে আছেন। আরো একটু ভালোভাবে উকি দিতেই মা আর বুড়িকেও খুজে পেলাম। তারা চেয়ারে বসে আছেন। মা বোরখা পড়া, আর বুড়িটা বোরখার সাথে নিকাব পড়া। মায়ের পাশে বসে আছে বিধায় বুড়িটাকে শনাক্ত করতে সুবিধা হল। কমিশনার সাহেব বেশ গর্জন করে বলে উঠলেন,
হিরোগিরি দেখাও? সুন্দর চেহারা নিয়া হিরোগিরি না? এই কোন কোচিং এর টিচার তুমি? নাম কি কোচিং এর কও তো?
তারিফ ভাই বললেন, সেটা মুল বিষয় না। আমাদের এখানে কেনো ডেকে আনা হয়েছে আর ঈশানের বিরুদ্ধে কেনো অভিযোগ তোলা হয়েছে সেটাই মুখ্য বিষয়।
ভাইয়া ঈশানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঈশান। তুমি কি সত্যিই এই ছেলের হাত ভেঙেছো?
ঈশান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন। ভাইয়ার চেহারা কাঠিন্য ভর করল। কড়া গলায় ভাইয়া বললেন,
কেনো?
ঈশান বললেন, কলেজ গেইটের সামনে দাড়িয়ে মেয়েদের টিজ করছিল। বাজে ইঙ্গিত দিচ্ছিল। আর সবথেকে বাড়াবাড়ি যেটা করেছে, তারিনের গায়ে হাত দিয়েছে।
ভাইয়া আড়চোখে একবার নীল জ্যাকেটওয়ালা ওরফে সাদা ব্যান্ডেজওয়ালার দিকে তাকালো তারিফ ভাইয়া স্বাভাবিক কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
হাত ভেঙে দেওয়াটা ঠিক হয়নি। হারামজা*র হাত কেটে দেওয়া উচিৎ ছিল।
ঈশান মাথা নিচু রেখেই মুচকি হাসলেন। কিন্তু কমিশনার বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন।
🍂
চলবে
#তি_আমো❤
#পর্ব_১৫
Writer: Stdratul muntaz
🍂
কমিশনার সাহেব ঈশানকে জেলে ভরে তবেই ক্ষান্ত হয়েছিলেন সেদিন। তবে বেশিক্ষণ ঈশানকে জেলে রাখা সম্ভব হয়নি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। এটুকু সময়ের ব্যবধানেই ঈশানের জামিন সম্পন্ন হয়। জামিনের জন্য বেশ পরিমাণ টাকার প্রয়োজন ছিল। ভাইয়া ব্যবস্থাও করেছিলেন। ভেবেছিলেন বাইকটা বিক্রি করে দিবেন। সেই পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই ঈশান হাজির।
টাকার ব্যবস্থা কি করে হল এমন প্রশ্নের উত্তরে ঈশান ফ্রেন্ডের কথা বললেন। সেই ফ্রেন্ড, যে ঈশানকে উবার ড্রাইভিং এর জন্য গাড়ি বন্দক দেয়। ভাইয়ার মনবাসনা হলো ঈশানের সেই অস্তিত্বহীন ফ্রেন্ডকে একটিবার স্বচক্ষে দেখার। কে সেই ভালোমানুষ? ভাইয়ার মতে এমন বন্ধু পেতে কপাল লাগে। আমার বেশ মজাই লাগল ঈশানের মিথ্যে বলার কৌশলগুলো। এমন নিঃসংকোচে কয়জনই বা মিথ্যে বলতে পারে? এই মিথ্যে বলাটাও একটা গুণ। অবশ্যই খারাপ গুণ। কিন্তু খারাপ গুণ বলে কোনো শব্দ হয়না। সেটা তখন হয়ে যায় দোষ। আর এই দোষই আমার পছন্দ। খুব বেশিই পছন্দ।
.
.
নিহাদের বাসার সেই কাঠগোলাপের গাছ ধরে দাড়িয়ে আছি আমি। দেখছি, কি অপূর্ব সুন্দর এই গাছ। গাছের ফুল। আর মন মাতানো মিষ্টি সুভাষ। ছমছমে অন্ধকারে হালকা লাইটের আলোয় নিজেকেই ভালোমতো চোখে লাগেনা। অথচ ঝড়ে পড়া সাদা কাঠগোলাপগুলো সবুজ ঘাসে বিছিয়ে থাকায় মনে হচ্ছে যেন উজ্জল নক্ষত্রের মেলা।
আজরাতটা নিহার বাসায় যাপনের পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলাম। নিহার গায়ে হলুদ ছিল আজ।সেই উপলক্ষ নিয়েই ছুটে আসা। আমি একাই, তারিফ ভাইয়া পৌছে দিয়েই চলে গেছেন। বুড়িটার হঠাৎ জ্বর আসায় মাও আসতে পারেন নি হলুদে। ঈশান অবশ্য আমার সাথেই আছেন। কিন্তু সেটা বাসার কেউ জানেনা। সবাই জানে, ঈশান তার কাল্পনিক মা-বাবার সাথে দেখা করতে কিশোরগঞ্জ গেছেন।
কিছুক্ষণ আগেও চারদিকটা বেশ হৈ হুল্লোড়ে মেতে ছিল। কিন্তু এখন সব নিরব। গভীর রাতের নিস্তব্ধতা বেশ ভালোমতোই ঘিরে রেখেছে নিহাদের বাগানবাড়িটা। মোহনা আন্টি প্রস্থান করেছেন ঘণ্টা দুয়েক আগে। ঈশান আবার খুব লুকিয়ে বাচিয়ে রেখেছিলেন নিজেকে, মায়ের চোখের আড়ালে থাকার কি চেষ্টা উনার। কখনো ছাদে, কখনো বাগানের পেছন সাইটে, আবার কখনো কখনো তো ওয়াশরুমে গিয়েও অযথা সময় কাটিয়েছেন। অবশেষে মা নামক প্যারা বিদায় হলেন। তবে মোহনা আন্টি যতক্ষণ ছিলেন, বেশিরভাগ সময়টাই আমাকে পাশে রেখেছিলেন। খেতে বসার সময় আমি, হলুদ মাখানোর সময় আমি, স্টেজে নৃত্য দেখার সময়ও আমি। সবকিছুতেই উনার তারিনকে পাশে চাই। ঈশানের নামে গুণগান আর পার্টির মুখোশধারী অসভ্যের নামে বদনাম শুনে শুনেই কেটে গেছে আমার সন্ধ্যা। আর নিহার জন্য যেটা হলুদ সন্ধ্যা।
সবুজ ঘাসের উপর পা ফেলে ভারি আরাম করে বসে ঝি ঝি পোকার ডাক শুনছিলাম। সেই আরামে রং ঢালল মেঘলা। এক বালতি হলুদ মেশানো কাল রং আমার মাথায় ঢেলে দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুট লাগাল ঘরের দিকে। সে কি উল্লাসের হাসি তার। আর আমি তব্দা লেগে দাড়িয়ে আছি। অস্বাভাবিক এই পরিস্থিতিতে কি করণীয় সেটা বুঝে উঠার আগেই মেঘলা শাকচুন্নি নাগালের বাহিরে।অবশ্য এই সাজাটা আমার প্রাপ্য ছিল। আমিও যে একই কাজ করেছিলাম তার সাথে। কিন্তু সেই শোধটা যে মেঘলা এখন এসে তুলবে তা কি করে বুঝবো? চুপচুপে শরীর নিয়ে বেশিক্ষণ দাড়িয়ে থাকার চেয়ে রাত বিরাতে শরীর ভিজিয়ে গোসল দিয়ে নেওয়াটাই তুলনামূলক ভালো উপায় মনে হল আমার। ওদিকে নিহা বেচারি বড্ড কাহিল। আমার সাথে কথা বলার ইচ্ছে বা শক্তি কোনোটাই অবশিষ্ট নেই তার মধ্যে। সাফিন ভাইয়ের সাথে ঘণ্টাখানেকের মতো মেলা বকবক করে এখন দরজা দিয়ে ঘুমের সাগরে ডুবকি লাগিয়েছে। আর আমি ভেজা চুল শুকানোর মহান উদ্দেশ্য নিয়ে কফিহাতে চলে এসেছি ছাদে।
কিন্তু এখানে এসেও শান্তি নেই। গিটারের টুংটাং শব্দ তুলে জোৎস্না ঝরানো নিরব পরিবেশটাকে মাতিয়ে রেখেছেন আমাদের, মানে নিহাদের ভদ্রম্যান। তাকে ঘিরে গোল হয়ে জমেছে মেয়েদের মেলা। কমপক্ষে বিশজনের মতো মেয়ে এইখানে উপস্থিত হবে আমি নিশ্চিত! কিন্তু ঈশান নাকি মেয়েদের সংস্পর্শে যায়না? তার নাকি বিরক্ত লজ্জা দুটোই প্রবল। তাহলে এখন আমি কি দেখছি এটা? ছবি তুলে রাখা দরকার। ভবিষ্যতে প্রমাণ হিসেবে কাজে লাগানো যাবে। এমন চাক্ষুষ প্রমাণ হাতেনাতে তো আর সবসময় পাওয়া যায়না। সুযোগটা মিস হতে দিলাম না।তাই ক্যামেরাবন্দী করে ফেললাম।
ছাদের একপাশে দাড়িয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছি আর নজর রাখছি ঈশানের উপর। বেচারা অবশ্য এখনো আমায় লক্ষ্য করেনি। আমিও নিজেকে আড়াল রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছি। একটা বিষয় নিয়ে আপাতত আমি ভীষণ ক্ষিপ্ত। ঈশান মাঝরাতে ছাদে কেনো আসলেন? উনি কি জানেন না ছাদের সাইড মেয়েদের জন্য বরাদ্দ? নাকি ইচ্ছে করেই এসেছে, কু মতলব নিয়ে। যেখানে অপযিট সাইডে তন্ময়, সাফনান, সিয়াম, রিফাত ভাইয়ারা যত্রতত্র আড্ডায় মশগুল, সেখানে কিনা ঈশানের মতো ভদ্র ছেলে মেয়েদের সাথে ন্যাকামোতে ব্যাস্ত? অদ্ভুত! বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলাম। একটা বিষয় মাথায় নাড়া দিয়ে উঠল। ছেলেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী আজরাতে তারা ড্রিংক করার মাস্টারপ্ল্যান সাজিয়েছিল। সেইটা কি তবে সাকসেসফুল? আর সেই সুবাদেই ঈশান এখানে? উনি মদ্যপান করবে না বলে নিজেকে বাচানোর উদ্দেশ্য নিয়ে যদি ছাদে এসে থাকেন, তাহলে ঠিকাছে। কিন্তু মেয়েদের সাথে এমন ন্যাকামি আলাপে মেতে উঠার বিষয়টা একদম ঠিক নেই। আমার তো ইচ্ছে করছে প্রত্যেকটা মেয়ের চুল টেনে টেনে ছিড়তে। তারপর ঈশানের ঘাসের মতো চুলের উপর হামলা চালাতে। কিন্তু কি করার? বেশি সংখ্যক মেয়েই আমার ক্লাসমেট। আর বাকি যারা আছে তারা সিনিয়র। চাইলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছি না আমি। আর না পারছি সহ্য করতে।
দেয়াল ধরে নিচের দিকে দৃষ্টি দিলাম। এবার যেটা দেখলাম, তাতে আমার চোখ নিয়ে পৃথিবীতে বেচে থাকার ইচ্ছেটাও ঘুচে গেল। নাশফী আপু আর সাফনান ভাইয়ার প্রেমলীলা চলছে। আমি বুঝলাম না এরা কি সত্যিই হলুদের অনুষ্ঠানে এসেছে নাকি হানিমুনে? যে যার মতো যেটা ইচ্ছে করে যাচ্ছে। নিহা বলে না অভদ্র সোসাইটি? এইবার বুঝতে পারছি কেনো বলে। আমি আবার সামনের দিকে ঘুরে তাকালাম। অন্তরা ঈশানের চুল ঝেড়ে দিচ্ছে, সামিরা গাল টিপে দিচ্ছে, রিদিতা সেলফি তুলছে। হে আল্লাহ এসব দেখার চেয়ে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মরে যাই তাও ভালো। আমি কফিটা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। কফি খাওয়া শেষ হলেই চলে যাবো নিহার ঘরে, ঘুমাতে।
রাত চারটা না ভোর চারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে ঘড়ির কাটায় চারটা বাজে। চোখ ভেঙে ঘুম আসছে। কিন্তু ঘুমানোর উপযুক্ত জায়গা পাচ্ছি না। নিহাকে ডিস্টার্ব করতে ইচ্ছে হয়নি। তাই ওর ঘরেও যাইনি। হাতে একটা বালিশ নিয়ে ঘুমো ঘুমো চোখে হাটছি। এতোবড় বাড়ি, অথচ আমার মতো ছোটোখাটো মানুষের শোয়ার জায়গা হচ্ছে না। সামিরা, রিদিতারা অবশ্য ওদের সাথে ঘুমানোর অফার করেছিল। আমি ইচ্ছে করেই যাইনি। কারণ খুব ভালো করেই জানি ওদের সাথে আমার ঘুম হবে না।
ড্রয়িং রুমের পেছন দিক থেকে ফ্লাশলাইটের আলো আসছে। মনে হচ্ছে আমাকে উদ্দেশ্য করেই কেউ লাইট মারছে। আমি মুখে চিন্তার ভাজ নিয়ে এগিয়ে গেলাম৷ এগিয়ে যেতেই ঈশানকে খুজে পেলাম। দরজার সামনে সোজা হয়ে দাড়িয়ে আছেন উনি। আমি কোমরে এক হাত রেখে মুখ ফুলিয়ে বললাম,
কি সমস্যা আপনার? এখনো ঘুমান নি কেনো?
ঈশান উত্তর দিলেন না। আবছা আলোয় উনার মুখের এক্সপ্রেসনটা বুঝতেও অসুবিধা হচ্ছে। আমি আবার বললাম,
ও সরি! আপনি কেনো ঘুমাবেন? আপনি ঘুমিয়ে গেলে মেয়েদের গিটার বাজিয়ে গান শুনাবে কে? ফ্লার্ট কে করবে মেয়েদের সাথে? অসভ্য কোথাকার!
ঈশান এবারও কিছু বলছে না। আমার ভয় হল। সত্যিই আমার সামনে ঈশান দাড়িয়ে তো? নাকি ঈশানের অবয়ব নিয়েই অন্যকেউ? আমি নিজের ফোনের ফ্লাশলাইট টা অন করতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই সামনের মানুষটা আমার হাত ধরে সজোরে টান দিল। আমি রুমে ঢুকে পড়লাম। অতি সামান্য সময়ের মধ্যেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ছেলেটাকে দরজা লাগাতে দেখে আমার শরীর হিম হয়ে আসছে। গোল গোল চোখ করে ধীরপায়ে পিছিয়ে যেতে লাগলাম। আর সামনের মানুষটা এগিয়ে আসতে লাগল। বিছানার সাথে ধাক্কা খেয়ে ফ্ল্যাট হয়ে পড়লাম আমি। সাথে ছেলেটাও একই গতিতে চেটাল হয়ে পরল আমার উপর। উনার শরীরের ভারে দম আটকে আসার উপক্রম হল আমার। তার উপর ছেলেটা আমায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরার কারণে নড়াচড়া করারও জো নেই। আমি ঈশানের বুকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম,
ঈশান এসব কি হচ্ছে?
ঈশান আমার চুলে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে বিহ্বল কণ্ঠে বললেন,
এই মেয়ে। তুমি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাও? এই ভেজা চুল, এই স্নিগ্ধ মুখ, আর ঠোট জুড়ে মিষ্টি হাসি। আমাকে মাতাল বানিয়ে দিচ্ছে। এটা কেমন অত্যাচার বলোতো? নিরীহ ছেলেটার বুক আরেকবার ক্ষতবিক্ষত করে দিলে তুমি। এবার কি হবে আমার? বারবার আমাকে এমন পাগল বানিয়ে দিয়ে নির্দ্বিধায় চলে যাবে, তা তো হবেনা। এবার যে শাস্তি পেতে হবে তোমাকে। কঠিন শাস্তি।
আমার বুকটা ধক করে উঠল। পায়ের পাতা ভীষণরকম কাপছে। শীতল হয়ে আসছে শরীর। ঈশানের মাথা ঠিক নেই, নেশা টেশা করেছে নাকি কে জানে? উনার এই পাগলামিকে প্রশ্রয় দেওয়া যায়না। কিন্তু উনাকে ঠেকানোর সাধ্যি কই আমার? আমি ঢোক গিলে বললাম,
ঈশান, প্লিজ ছাড়ুন আমাকে। আমি পেশিতে ব্যাথা পাচ্ছি।
ঈশান এখনো আমার চুলে মুখ ডুবিয়ে রেখেছেন। কোনো সাড়াশব্দ নেই। ভয়ে আমার ভেতরে যা কিছু আছে সবটা যেন বমি হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ঈশান হালকা শব্দ করে হাসলেন। আমার ভয় তীব্র হল। উনার হাসিটাও সুবিধাজনক লাগছে না এখন। আমার দেহে কম্পন সৃষ্টি করে ঈশান গলাতে ঠোটের পরশ দেওয়া শুরু করলেন। আর আমি ধস্তাধস্তি শুরু করলাম। এর থেকে যদি গলায় ধারালো ছুড়ি চেপে রাখা হতো, তাও অনেক শান্তির ছিল। এমনটাই ধারণা হচ্ছে আমার। এই যন্ত্রণাময় অনুভূতি সহ্য করা দায়। বড্ড দায়।
ঠিক এই মুহুর্তে আশেপাশে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র পেলে ঈশানের দিকে তাক করতেও দু বার ভাবতাম না আমি। ঈশানের অত্যাচার প্রখর হচ্ছে ক্রমশ। আমার চোখজোড়া অশ্রুসিক্ত হয়ে আসছে। ঈশান আমার ওরনাটা সরাতেই শব্দ করে কেদে দিলাম আমি। তাই দেখে ঈশানের হোশ ফিরল। মাথা তুলে তাকালেন আমার দিকে। আর আমি? দাত কিড়মিড়িয়ে উনার গাল বরাবর সজোরে চড় বসিয়ে দিলাম।
গালে হাত রেখে উঠে বসলেন ঈশান। আমিও নিজের সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালাম।ঝড়ের গতিতে কাপা কাপা হাত দিয়ে দরজা খুলে নিলাম। সেই দরজা ধরেই কাদতে শুরু করলাম আবার।
কিছু সময় পর উপলব্ধি করলাম ঈশান আমার দিকে ওরনাটা এগিয়ে দিচ্ছে। আমি ঈশানের মুখের দিকে তাকালাম। উনার দৃষ্টি অন্যদিকে স্থির। আমি ক্রন্দনরত অবস্থাতেই ওরনাটা হাতে নিলাম। গলায় ওরনা জড়িয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে কাদতে দৌড়ে চলে আসলাম ছাদে।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছেমাত্র। আকাশ ভেদ করে সুর্যের অস্পষ্ট আলো উকি দিচ্ছে। আর আমি কেদে চলেছি। বুক ফেটে কান্না আসছে আমার, ভীষণ কান্না। ঈশানকে আঘাত করার জন্য এখন অনুশোচনা হচ্ছে। কি করলাম এটা আমি? কেনো করলাম? এই মনঃকষ্ট নিয়ে কি করে থাকবো আমি?যে হাতে চড় মেরেছি সেই হাতটা পর্যন্ত ব্যাথা করছে, জ্বালাপোড়া করছে হাতে। তার থেকেও বেশি জ্বালাপোড়া করছে আমার মনে। জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছি আমি।
🍂
চলবে