#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
২৪.
আজও সারারাত বসেই কেটেছে দ্বিজার। সকালের দিকে মাথার ব্যথা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সকাল আটটার মতো বাজছে। ফারজাদ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে করে রুমে ঢুকল। একটা বালিশ মাথায় অপরটা কোলে চেপে ধরে এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে দ্বিজা। হঠাৎ-ই ফারজাদ লক্ষ করল–এখন দেখতে সেই অপরিণত, ছোট্ট দ্বিজা লাগছে মেয়েটাকে। বুক ফুলিয়ে একটা শ্বাস নিলো ফিরজাদ। কিছুক্ষণ কী মনে যেন চেয়ে রইল দ্বিজার দিকে। ছোট্ট এই মেয়েটা নিজের পরিচয়, পরিবার ছেড়ে কতদূর চলে এসেছে তার হাতটা ধরে। তাহলে ঠিক কতবড়ো দায়িত্ব সে ফারজাদের জন্য! এই দায়িত্ব শব্দটা খুব অপছন্দের ফারজাদের কাছে, যাথে খালি ত্যাগ আর ত্যাগ। ঘড়ির দিকে তাকাল–সোয়া আটটা বাজছে। ডাকল, “দ্বিজা!ʼʼ
মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। আরও কয়েকবার ডাকল ফারজাদ। চোখ মেলে তাকাল দ্বিজা। ফারজাদ দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে শার্ট। মুখটা ওমন শুকনো লাগছে কেন লোকটার? কোথাও গেছিল নাকি? ফারজাদ চারদিকে তাকাতে তাকাতে ভরাট গলায় বলল, “ওঠ, খাবার এনেছি খেয়ে নে।ʼʼ
-“পরে খাব। এখন ঘুমাব আমি।ʼʼ
এবার আরও একটু কড়া লাগল শুনতে ফারজাদের কণ্ঠস্বর, “তোর সিদ্ধান্ত জানতে চাইনি। বলেছি, খেয়ে নে। জলদি ওঠ!ʼʼ
-“আমার পেট, আমার ক্ষুধা লাগলে আমি খেয়ে নেব। এখন খাওয়ার চেয়ে ঘুমটা বেশি জরুরী। মাথা ব্যথা করছে খুব।ʼʼ
ফারজাদ দাঁড়িয়ে রইল ওভাবেই। চোখে ভাসমান শিরাগুলো লালচে হয়ে আছে। সারারাত না ঘুমানোর ফল। আর এই নির্ঘুম এক রাতের পর সকালটা ঠিক কী পরিমাণ যন্ত্রণার হয় তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারও পক্ষে বোঝাটা অসম্ভব। পুরো পরিস্থিতি এবং শরীরের অবস্থা মিলিয়ে ফারজাদের ইচ্ছে করছে নিজের কপাল বরাবর পিস্তলের মুজেলটা ঠেকিয়ে আস্তে করে ট্রিগারটা প্রেস করে দিতে। মস্তিষ্কে যেন বিষাক্ত পোকারা আন্দোলন শুরু করেছে, সেই সাথে মেরুদণ্ড বেঁকে আসছে, পুরো শরীর ভঙ্গুর হয়ে আসছে। সে রাত জাগায় অভ্যস্ত না, তা নয়। তবে আজ প্রেশার ইনফেক্ট করছে বাজেভাবে। দ্বিজার কোলের বালিশটা একটানে কেঁড়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারল বিছানার এক পাশে। বিক্ষিপ্ত একটা শ্বাস ফেলে বলল,
-“খেয়ে এরপর ঘুমাবি আবার। রাতে কিছু খাসনি, উঠে খেয়ে নে।ʼʼ
-“বলছি তো পরে খেয়ে নেব।ʼʼ
-“সে তো আমিও কিছু বলছি–এখন উঠে খাবি। নাকি কথা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে?ʼʼ
দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বসল দ্বিজা। বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, “আপনি খুব অবুঝ, ফারজাদ।ʼʼ
-“হুম, অজানা কথা নয়।ʼʼ এরপর গায়ের শার্টটা খুলতে খুলতে বলল, “হাত-মুখ ধুয়ে আয় দ্রুত। আমি গোসলে যাব।ʼʼ
ফ্রেস হয়ে এসে অলস ভঙ্গিতে বসল দ্বিজা বিছানার ওপর। সামনেই টি-টেবিলের ওপর খাবার রাখা। এত খাবার আনার মানে কী? নাকি সারাদিনের খাবার একেবারে নিয়ে এসেছে। সে ওভাবেই বসে রইল খাবারের দিকে তাকিয়ে। পেটে একটুও খিদে অনুভূত হচ্ছে না। বিশ মিনিট পর ফারজাদ গোসল সেরে বেরিয়ে দেখল–ঠিক একই ভাবে এখনও বসে আছে দ্বিজা। মেজাজ খারাপ হলো, তবে বলল না কিছু। একটুও চোটপাট করতে ইচ্ছে করছে না আপাতত মেয়েটার ওপর। ঘাঁড়ের পেছনটা মুচরে মুচরে আসছে। এখন অল্প একটু শান্তির সাথে ঘন্টাকয়েক ঘুম অপরিহার্য। তবে এই অপরিহার্য ঘুমকে পরিহার করে তাকে নিজের ডিউটিতে নেমে পড়তে হবে এখন।
থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট ছেড়ে নিজের অভ্যাস অনুযায়ী গ্রে কালারের একটা কার্গো প্যান্ট পরল। হাতাকাটা টিশার্টের ওপর ডেনিম শার্ট গায়ে জড়িয়ে বলল, “আমার ডিউটি আছে। এখন বের হবো। ফিরতে সন্ধ্যা হতে পারে। তৈরী থাকিস, ফিরে এসে বাইরে যাব একটু। দুপুরে খেয়ে নিস।ʼʼ
দ্বিজার মনটা আরও বিষণ্ন হয়ে উঠল, এই এরকম একটা বদ্ধ ফ্লাটে একা থাকবে সে, তার ওপর এমনিতেই মন-মেজাজ ভালো নেই। ফারজাদ উবু হয়ে বসে পায়ে পরা হাই-বুটের ফিতে বাধছে। দ্বিজা খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে তাকাল সেদিকে। জিজ্ঞেস করবে, আপনি খেয়েছেন? করতে পারল না কেন জানি! গলায় আটকাচ্ছে কথা। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। হুট করে খেয়াল করল–ফারজাদকে দেখতে পুরো সাহেব লাগছে। লম্বা, বলবান শরীরটায় এক এক করে যেসব আচ্ছাদন জড়িয়েছে, তাতে নেহাত সুদর্শন লাগছে দেখতে তার বরকে। নিজের ভাবনার ওপর চট করে তার খুব রাগ হলো। চোখ ফিরিয়ে নিলো। মানুষ ওপরে সুন্দর হলে তাকে সুন্দর বলা গেলে ফারজাদ একজন সুন্দর মানুষ। অথচ মানুষ হিসেবে সে নিতান্তই ইতর।
এই রুমে ছোট্ট একটা খাট এবং পার্টেক্সের একটা ড্রেসিং টেবিল ছাড়া আর আছে একটা হ্যাঙ্গার। মাঝারি এই ফ্লাটটা একদম ফাঁকাই বলা চলে। তাহলে এত বড়ো ফ্লাট ভাড়া করবার কী দরকার? মাসে কত হাজার টাকা গুণে দিতে হয় এর বিনিময়ে আল্লাহ জানে। দ্বিজা অবাক হলো নিজের ভাবনায়। সে এত হিসেবী হলো কবে! সে কি এই সংসার নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে!
-“চোখ দিয়ে খাবার গিললে তো আর পেট ভরবে না। মুখে তুলে খেতে হবে। পেট ভরা থাকলে ভাবতে ভালো এনার্জি পাবি।ʼʼ
ঠেস দেওয়া কথাবার্তা! এরকম খিটখিটে মানুষ যে জীবনে বদলায় না, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ এই লোক। দ্বিজা একটু শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, “আপনি খেয়েছেন?ʼʼ
ফারজাদ হাতে থাকা বডি স্প্রেটা শরীরে এপাশ-ওপাশে লাগাতে লাগাতে এগিয়ে আসল। এসে দাঁড়িয়ে একটু ঝুঁকে শব্দ করে স্প্রেটা টেবিলের ওপর রেখে দ্বিজার দিকে তাকিয়ে বলল, “না। আমার খাওয়া জরুরী নয়। আমার নিজের পেট এবং আমি আমার ওপর অভিযোগ করব না.. সেই সুযোগ নেই..ʼʼ
-“কিন্তু, আমি অভিযোগ করব। এজন্য খাওয়ানোর এত জলদি?ʼʼ–ফারজাদের কথা কেড়ে নিলো দ্বিজা।
ফারজাদ বসল দ্বিজার সম্মুখে টুলের ওপর। দ্বিজার খুব মেজাজ খারাপ লাগছে ফারজাদের এমন টিপটাপ সাজ দেখে। এই নাকি দেশের সেবক। একে দেখে তো তার ছিটেফোটাও আন্দাজ করার উপায় নেই।
মাঝে টেবিলের ওপর খাবারের প্লেট রাখা। ফারজাদ দ্বিজার দিকে পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকিয়ে একটা গভীর শ্বাস নিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল, “একদম তাই! আমার কর্তব্য পালনের ওপর অপর পক্ষের অভিযোগ আমি একটুও সইতে পারি না। তবে বাদ-বাকি আমিটা পুরোই সকলের অভিযোগ দিয়ে গড়া। আমার উপাদানই হলো মানুষের অভিযোগ।ʼʼ
দ্বিজা অল্প একটু পরোটা ছিঁড়ে হাতে রেখে স্বাভাবিক স্বরে বলল, “আপনার কারও ওপর অভিযোগ নেই?ʼʼ
“না, নেই।ʼʼ
“কেন নেই?ʼʼ
-“কারও প্রতি অভিযোগ করার মতো খারাপ সময় যায় না আমার কখনও।ʼʼ
-“নিজের খারাপ দিনে মানুষ অভিযোগ করে অন্যের ওপর?ʼʼ
-“হু। যখন মানুষ কারও থেকে নিজের চাহিদা মাফিক আশানুরূপ কিছু পায় না, তখন অভিযোগ জমে। আমার কোনো চাওয়া নেই কারও কাছে, সেক্ষেত্রে অভিযোগের প্রশ্ন ওঠে না।ʼʼ
দ্বিজা খোঁচা দিয়ে বলল, “সব সময় এমন মিনারেল ওয়াটারের মতোন বিশুদ্ধ করে কথা বলা জরুরী?ʼʼ
ফারজাদ দাম্ভিকতার সাথে ঘাঁড় নাড়ল, নাক উঁচিয়ে বলল, “আমার সাথে যায় এমনটা, কিছু করার নেই।ʼʼ
খাওয়া শেষ করে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে চাবি বের করে নিয়ে বেরিয়ে এলো ফারজাদ রুম থেকে। তার পেছনে এলো দ্বিজা প্লেটটা রান্নাঘরের সিংকে রাখার উদ্দেশ্যে। হঠাৎ-ই ফারজাদ কেন জানি চটে গেল। বিশ্রী একটা ধমক দিয়ে বলল, “তোকে বলেছি রুম থেকে বের হতে? যা ভেতরে যাʼʼ
দ্বিজা হতবাক হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ-ই কোনো কারণ ছাড়া এমন অমানুষের মতো আচরণের মানে কী? ফারজাদ জোরে দুটো শ্বাস নিয়ে শাসানোর মতো করে বলল, “যতক্ষণ আমি বেরিয়ে না যাই, রুম থেকে যেন বের হওয়া না দেখি। আমিও যেন বুঝতে না পারি এই ফ্লাটে আমি ছাড়া আর কারও অস্তিত্ব আছে। আদারওয়াইজ, খুন করে ফেলব। ভেতরে যা।ʼʼ
ফারজাদকে দেখতে নিষ্ঠুর জানোয়ারের মতো লাগল। তাকে সচরাচর রাগান্বিত হতে দেখা যায় না, রাগলেও এরকম উত্তেজিত আর পাগলের মতো ক্ষেপাটে চেহারা দেখে নি দ্বিজা। খুব শান্ত আর দায়সারা গোছের মানুষ ফারজাদ। দ্বিজা শুকনো মুখে রুমে চলে গেলে মাথার চুলগুলো মুঠো করে টেনে ধরল ফারজাদ, শরীর ও মন এত প্যারা দিচ্ছে কেন? এত অসুস্থ লাগছে নিজেকে! নিজেকে সর্বহারা পাগলের মতো লাগছে। জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করল, “রিল্যাক্স, ফারজাদ! ক্যাম ডাউন! কুল!ʼʼ
চাবির গোছা থেকে নির্দিষ্ট চাবিটা বেছে নিয়ে গিয়ে দাঁড়াল সেই দরজাটার কাছে। খুলল দরজাটা। কিছুক্ষণ নিজেকে ধাতস্থ করতে পারল না। ফাঁকা রুম, কোনো আসবাব নেই সেখানে। একটা মাদুর বিছানো আছে, আর কিচ্ছু না। সেই মাদুরের ওপর শ্রান্ত, ক্লান্ত রূপে আলামিনের বসে থাকার কথা থাকলেও সে নেই। মাথা ফাঁকা লাগল ফারজাদের। চুপচাপ নির্বাক, হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে রইল ফাঁকা ঘরের মেঝের দিকে। চারজন পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল তার ফ্লাটের আশপাশ জুড়ে। ঘরটা তালা মারা ছিল বাইরে থেকে। ঘরের জানালা কাঁচের হলেও তার ফ্লাট চার তলা। কাচের জানালা ভেঙে নিচে লাফ দিলে জানে বাঁচবে না। ড্রাগ এডিক্টেড মানুষ আত্মহত্যা করতেই পারে। তবে আলামিনের কাছে আর কোনো ড্রাগ অবশিষ্ট ছিল না। সুতরাং সে ঠিক ছিল। আর তাছাড়াও এ ঘরের জানালা দিয়ে লাফালে যেখানে গিয়ে ও পড়বে সেটা মেইন-রোড। সেখানে মানুষ মরে পড়লে…
ফারজাদ ভাবতে পারল না আর। সহ্য ক্ষমতা পেরিয়ে গেছে তার। নিস্প্রভ, নিস্পন্দন পায়ে ঘরের মধ্যে ঢুকল। মাদুরের সামনে ঠিক একটা প্লাস্টিকের হাতলবিশিষ্ট চেয়ার রাখা। যেটাতে বসে সে আলামিনেকে জিজ্ঞাসাবাদ করত। তার স্পষ্ট খেয়ালে আছে–শেষবার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কোনো আশানুরূপ ফল না পেয়ে সে ভীষণ রাগান্বিত হয়ে উঠেছিল। লাথি দিয়ে চেয়ারটা উল্টে রেখে গিয়েছিল। অথচ এখন চেয়ারটা ঠিক সেভাবে রাখা যেভাবে এবং যেখানে রেখে সে আলামিনের সামনে বসে আলামিনকে জেরা করত। কী ঘটেছে সে আন্দাজ করতে পারছে। তবে তা কতটুকু সঠিক তা জানা নেই। একহাতে চেয়ারটা মাথার তুলে শরীরের প্রায় সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল তা মেঝেতে। সাদা টাইলসের মেঝেতে চেয়ারটা দূরে ছিটকে পড়ে বিকট আওয়াজে ভেঙে পড়ে রইল।
বদ্ধ ফ্লাটে আওয়াজটা গমগম করে বেজে উঠেছে। দ্বিজা ফারজাদের নিষেধের পরোয়া না করে ছুটে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। দৌঁড়ে গেল রুমটার সামনে। ফারজাদ একহাতে কপাল চেপে ধরে অপরহাতের তালু দেয়ালে ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে। ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে খনিক পরপর।
চলবে..
#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
২৫.
ফারজাদের ফ্লাটে পুলিশের ছোটো খাটো ভীড় জমেছে। বসার ঘরে একপাশে চেয়ার পেতে গম্ভীর মুখে বসে আছেন সিনিয়র এএসপি মহোদয় রুহুল আমিন সাহেব। দুজন ইন্সপেক্টর দাঁড়িয়ে আছেন পাশেই। আলামিনকে রাখা হয়েছিল যে রুমেটায় সেখানে আরও দুজন কর্মী ঘরটা পর্যবেক্ষণ করছেন ঘুরে-ফিরে। দ্বিজা নিজের রুমের দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে ফারজাদের দিকে। রুহুল সাহেব বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে রয়েসয়ে প্রশ্ন করলেন, “বাড়ি কেন গিয়েছিলে?ʼʼ
ফারজাদ চোখ তুলে তাকাল, তবে কোনো জবাব দিলো না। তাকে দেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, আসলে তার ভেতরে চলছে কী! নির্বিকার জড় বস্তুর ন্যায় স্থবির মুখভঙ্গি। রুহুল সাহেব আবারও কিছু বলবেন তার আগেই ফারজাদ বলে উঠল, “আমি যথাযথ পাহারার ব্যাবস্থা করেছিলাম, স্যার!ʼʼ
রুহুল সাহেবের চেহারা দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল–তিনি মোটেই সন্তষ্ট নন ফারজাদের জবাবে। কিছুক্ষণ ফারজাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমাকে দেখে এমন ইরিস্পন্সিবল মনে হয়েছিল না আমার।ʼʼ
ফারজাদ চোখটা চেপে বুজে নিয়ে ঘাঁড় ঘুরিয়ে গুমোট এক শ্বাস নিলো। বলতে চাইছে না যেন, তবুও বলল আস্তে করে, “সরি, স্যার!ʼʼ
“কেন গেছিলে বাড়ি?ʼʼ
“জরুরী ছিল।ʼʼ
ভ্রুকুটি করে তাকালেন রুহুল সাহেব ফারজাদের দিকে। কতটা দুঃসাহস বুকে সঞ্চিত থাকলে সিনিয়রের সামনে এভাবে এমন সংক্ষিপ্ত জবাবে অশিষ্টতা প্রকাশ করা যায়!
“এমন কীসের জরুরী ছিল? যখন জরুরী ছিল, তো সাসপেক্টকে আমাদের হাতে তুলে দিয়ে যেতে পারতে। ঘরে বন্দি রেখে এভাবে …
“স্যার, দায়িত্বটা শুধু আমার একার ছিল না। ওকে ঘরে রেখেছিলাম–তার পেছনে যথাযথ কারণ ছিল। এবং আপনি ব্লেইম পরে করবেন, আগে এই…ʼʼ
বলেই চারজনের দিকে তাকাল। দাঁত চেপে ধরল। বোঝা গেল–মুখে আসা বাজে ভাষাটা গিলে নিলো সে। মোতায়েনকৃত চারজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিঁচু করে। রুহুল আমিন সাহেব কিছুক্ষণ নিচের দিকে চেয়ে থেকে ঘাঁড় ঘুরিয়ে দ্বিজার দিকে তাকালেন, ভালো করে দেখে নিয়ে ফারজাদের দিকে ফিরে বললেন,
-“প্রফেশন এবং পজিশন অনুযায়ী যদি নিজেকে ট্রিট না কোরে বরং আর পাচটা সাধারণ পুরুষের মতো এলিয়ে দাও নিজেকে, তবে এই প্রফেশনে টিকতে পারবে না, ম্যান! তোমাকে টুয়েন্টি-ফোর আওয়ারস নিজের ডিউটিতে ফোকাস রাখতে হবে। তা রাখতে পেরে যদি ব্যক্তিগত জীবনে সময় দেয়ার এনার্জি পাও, তবে তা অবশ্যই ভালো। কিন্তু ডিউটির মাঝে যেন ব্যক্তিজীবন ইন্টারফেয়ার না করে, এটা ভুললে তোমারও চলবে না। এটা শেখানো হয়েছিল মেইবি তোমাদের। ব্যক্তিজীবন থাকা যাবে না ব্যাপারটা এমন নয়, বাট ডিউটি ইজ মোস্ট ইম্পর্টেন্ট দ্যান অল দ্য থিংস ফর ইউ নাও! ইট ক্যান নেভার বি ফরগোটেন।ʼʼ
স্পষ্ট খোঁচা এবং ভৎসনা। খুব সন্তর্পণে ফারজাদকে আরেকবার কাণ্ড ও দায়িত্বজ্ঞানহীন আখ্যা দেয়া হলো। ফারজাদ এবারেও শুধু নির্বিকার দাঁড়িয়ে রইল। নীরব দৃষ্টিতে রুহুল সাহেব কিছুক্ষণ ফারজাদের দিকে চেয়ে থেকে সতর্ক করার ভঙ্গিতে বললেন, “বুঝতে পারছ–তোমার চলাচল এখন ঠিক কতটা রিস্কি হয়ে উঠল? আইডিয়া তো আছে নিশ্চয়ই! ড্রা গ স্মাগলিংয়ের পেছনে যার-তার হাত থাকে না, ফারজাদ। যারা সাসপেক্টকে বের করে নিয়ে গেছে একজন এসবি অফিসারের ফ্লাট থেকে, তাদের দৌড়ের তেজ একটু হলেও আন্দাজ করতে পারছ হয়ত।ʼʼ
ফারজাদ কিছু বলল না। তিনি আবার বললেন, “এবার তোমার সাসপেক্ট হয়ত মরবে অথবা তাকে আন্ডাগ্রাউন্ড করে দেয়া হবে। তোমার জন্য এখন থেকে একটা সেকেন্ডও সেফ নয়। যারা তোমার চারতলার ওপরকার ফ্লাট থেকে লোক ভাগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তাদের কাছে ভেবে নাও তোমার জন্ম-বৃত্তান্ত থেকে শুরু করে এখন হয়ত ডেড সার্টিফিকেটের তারিখও ঠিক করা হয়ে গেছে।ʼʼ
দ্বিজা আতকে উঠল। তার বুকের ভেতর কোথাও একটা মোচড় দিলো শক্ত করে। তার জন্যই হয়েছে এসব, সে বেশ বুঝতে পারছে। তার মানে ওই ঘরে একজন সন্দেহভাজনকে আটকে রেখে ফারজাদ তার জন্য ছুটে গেছিল কুমিল্লা। মাথাটা নিঁচু করে নিলো আরও খানিকটা।
রুহল সাহেব ডাকলেন ফারজাদকে, “শোনো, ফারজাদ! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফ্লাট ফাঁকা করো, অন্য কোথাও শিফ্ট হও। কালকের রাতটা তোমার কতটা রিস্কে কেটেছে বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই। আমি তোমার নতুন ঠিকানায় কিছু পুলিশ মোতায়েন করছি..
ফারজাদের খুব হাসি পেল। সে তা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেও পারল না, চট করে উপহাসের হাসি হেসে ফেলল। থামলেন রুহুল সাহেব। একটু সভ্যতার ছিটেফোঁটা নেই এর মাঝে। কড়া চোখে তাকালেন ফারজাদের দিকে। ফারজাদ তা একদম উপেক্ষা করে মজার ছলে বলল,
-“এত বড়ো ক্ষতি আমার করবেন না, স্যার। আমি এখান থেকে শিফ্ট হব। তা কালপ্রিটেরা জানতে পারবে না এবং কোনো ক্ষতি করতে পারবে না ততক্ষণ, যতক্ষণ না আপনার পুলিশ আমার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে। তারা নিজেদের কর্তব্যে একটু বেশি একটিভ তো, স্যার! আই স্যালুট টু অল অফ দেম, স্যার! ইউ নো–আমার ফ্লাটের তালা ভাঙা হয়নি, কোনোরকম উলোট-পালোটের চিহ্ন নেই, একটু টোকাও পড়েনি কোথাও। কতটা আলগোছে কাজ সারলে পুরো রাত, সকাল কেটেছে। তালা খোলার আগ অবধি আমি টের পাইনি পাশের ঘর থেকে একটা আস্ত মানুষ বাতাসের সংস্পর্শে বিক্রিয়া করে কর্পূরে পরিণত হয়ে উড়ে গেছে। কী ভাবছেন? অসম্ভব এই বিক্রিয়া! স্যার! কাম অন! টাকার উপাদান প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল বিক্রিয়ায়!ʼʼ
স্পষ্ট তাচ্ছিল্য ফারজাদের কথায়। সে বেশ মজা নিয়ে বলছে কথাগুলো। একটু থেমে আবার বলল,
-“বিক্রিয়ার প্রক্রিয়া ছিল এমন—হাত ধরে তাদেরকে আমার ফ্লাটে আনা হয়েছে, আস্তে করে চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলে দেয়া হয়েছে, তারা সহি-সালামতে সাসপেক্টকে বের করে নিয়ে চলে গেছে।ʼʼ
একটা হতাশ শ্বাস ফেলল ফারজাদ। যেন খুবই হতাশ এবং দুঃখিত সে। নিজের ওপর অনুতাপ করার মতো ঢং করে বলল, “আর…. আমার মতো ইরিস্পন্সিবলের পাশে এমন একটিভ অফিসারদের বেশিক্ষণ রাখা সেফ হবে না, স্যার। আমার হিংসা প্রচুর। কখন জানি এদের কর্তব্যপরায়নতায় ইর্ষান্বিত হয়ে চারটা বুলেট ইউজ হয়ে যাবে। এরকম নিরাপত্তাদাতারা আমার আশেপাশে না থাকলে তারাও সেফ, আমি তো অবশ্যই!ʼʼ
শীতল স্বরে কথাগুলো বলে থামল ফারজাদ। চারজন ঘামছে, খুব হাঁসফাঁস করছে নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়ে। রুহুল সাহেব থতমত খেয়ে গেছেন। কী বলছে ফারজাদ! ধমকে বলতে চাইলেন–কথাগুলোর কোনো প্রমাণ আছে তোমার কাছে? বললেন না। এই ছেলে ভয়ানক। তার কথাগুলোতে ভুল নেই। রক্ষক ভক্ষক না হয়ে উঠলে এমন ঘটনা এত স্মুথলি করে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না তিনি । চেয়ে রইলেন ফারজাদের দিকে। চারজন বারবার নিজেদের কপাল, গলা, থুতনিতে হাত বুলাচ্ছে। চঞ্চল চোখের চাহনি। রুহুল সাহেব তাকালেন ওদের দিকে। কিছু বলতে যাবেন ফারজাদ বিরক্তিতে ‘চ্যাহʼ করে উঠল,
‐“স্যার! এটা আমার ফ্লাট, ব্যক্তিগত জীবনে বসবাসের জায়গা। আপনারা আপনাদের বোঝাপড়া এজেন্সিতে অথবা বাইরে গিয়ে করুন। আমি খুব ক্লান্ত, নতুন বিয়ে করেছি, বুঝতেই পারছেন।ʼʼ
রুহুল সাহেব ফুঁসে উঠলেন, “বোঝাপড়া মানে? ডোন্ট ফরগেট ইট–ইউ আর স্পিক ইন ফ্রন্ট অফ ইওর সিনিয়র। স্পিক কেয়ারফুলি এন্ড উইথ সিভিলাইজেশন!ʼʼ
ফারজাদ দুপাশে ঘাঁড় দুলালো, “অভাব, খুব অভাব স্যার। আমার ভেতরে সিভিলাইজেশনের খুব অভাব। ডোন্ট গেট হাইপার, স্যার! আপনার ডিপ্লয় করা অফিসারদের খেলা দেখে আমি নিজেই হাইপার হয়ে আছি। এই উত্তেজনা দূর করতে আমাকে আরজেন্টলি ব্যক্তিগত জীবনে ফিরতে হবে।ʼʼ
ফারজাদের ঠাণ্ডা খোঁচায় রুহুল সাহেব সরু দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইলেন ফারজাদের দিকে। ফারজাদ দায়সারা ভঙ্গিতে বলল, “আমার যা দায়িত্ব ছিল, আমি অবভিয়েসলি প্রোপার অবজার্ভ করেছি। এখন আপনার অফিসাররা কাগজ দেখে জিব বের করে শ্বাস নিলে, সারটেইনলি ইটস নট মাই কনসার্ন! ইন দ্যাট কেইস, আই হ্যাভ টু রিজাইন ফ্রম দিজ ইনসিডেন্ট।ʼʼ
রুহুল সাহেব উঠে দাঁড়ালেন, বোঝানোর মতো করে বললেন, “ফারজাদ! ওরা যা করেছে তার সাঁজা ওরা পাবে। তার জন্য তোমাকে নিজের ডিউটি থেকে ইস্তফা দেবার অনুমতি আমি দেই নি।ʼʼ
কথা কেড়ে নিলো ফারজাদ, “ওকেহ…. আই উইল কান্টিনিউ মাই জব। আপনি সাসপেক্টকে খুঁজে এনে আমায় কল করবেন। আমি ইন্সটেন্ট পৌঁছে যাব আমার কর্মে।ʼʼ
-“এটা কি ধরণের ধৃষ্টতা, ফারজাদ! ডিউটি এটা তোমার। আবারও নেমে পড়ো কাজে, খোঁজ লাগাও। এটা প্রথমবার নয় যে কোনো সাসপেক্ট বা ক্রিমিনাল আমার হাত থেকে ছুটে গেছে।ʼʼ
ফারজাদ আঁড়চোখে তাকাল চারজনের দিকে, “জি জি, নিশ্চয়ই! আগেও ছুটে গেছে। সচরাচর ছোটাছুটি করতে থাকে এসব সাসপেক্টরা। তবে কারও লেজ নাড়ানিতে নয় সবসময়।ʼʼ
কথাটা বলে ত্যাড়ছা চোখে পুলিশ চারজনের সারির দিকে তাকাল। এরপর থামল একটু সে। তাকে দেখতে খুব রিল্যাক্স লাগছে। কথার ভঙ্গিমায় দুষ্টু উগ্রতা দৃশ্যমান। তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে আছে ঠোঁটের কোণে অস্পষ্টভাবে। এবার দায়িত্ববোধ দেখানোর মতো কৃত্রিম ভঙ্গি করে চুলে হাত চালাতে চালাতে বলল, “আমি ডিউটিতে ফিরব স্যার। কন্ডিশন– এদেরকে দেওয়া লেজ সোজা করার থেরাপি যদি আমার মনমতো হয়, মানে ভালো লাগে। ততদিন আমি মানে আমার ব্যক্তিগত জীবনে একটু সেটেল হই, স্যার। আপনার অফিসারেরা যে চোখা বাঁশের মাথা আমার পেছনে ঠেলে দিয়েছে, তা সামাল দিতে জান-প্রাণের লড়াই চালাতেই হবে মিনিমাম। প্রে ফর মি। আর একটা এসিসট্যান্টের ব্যবস্থা করুন আমার জন্য। একা হেন্ডেল করতে একটু চাপ পেতে হচ্ছে। সিলেক্ট করার আগে একটু থাপড়ে-থুপড়ে বাজিয়ে নেবেন, ভেতরে যেন আবার ফাঁপা না থাকে।ʼʼ
রুহুল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইন্সপেক্টর বাবুলকে ইশারা করলেন ওদের নিয়ে যেতে।
—
বিকেল হয়ে আসছে। আছরের আজানের সময় হয়ে এলো। দ্বিজা বারান্দা থেকে রুমে এলো ফারজাদের ডাকে। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে রাখল ফারজাদ। দ্বিজা এসে দাঁড়াল ফারজাদের সামনে। বিছানার সাথে বালিশটা খাঁড়া কোরে রেখে তাতে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে ফারজাদ। মাথাটা এলিয়ে দিয়ে রেখেছে বালিশের সাথে। চোখ বুজে শুয়ে আছে। ওভাবেই বলল, “বস।ʼʼ
ফারজাদ পা গুটিয়ে নিলো। বসল দ্বিজা বিছানায়। ফারজাদ খাটের বক্সের সাথে মাথা ঠেকিয়ে ওভাবেই বসে আছে। দ্বিজা তাকিয়ে রইল সেদিকে। জীবনটা এত জটিল হয়ে উঠছে কেন দিনদিন। ফারজাদ কিছু বলছে না, ও নিজেই বলল, “বাসা চেঞ্জ করতে হবে আমাদের?ʼʼ
-“না।ʼʼ
-“কিন্তু..
-“কিন্তু কিছু না। বাসা পরিবর্তনে ফায়দা? সমস্যা কি আসলে এই বাসাতে? এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও ভাড়া নিলে ওরা আর হারিকেন জ্বালিয়েও খুঁজে পাবে না, এমন কিছু? মোদ্দাকথা, কিছু হবার থাকলে দেশ ছাড়লেও ফায়দা নেই। তার চেয়ে বড়ো কথা, ওরা করছেটা কী? কিছুই না। এখন অবধি এট লিস্ট কিছুই করেনি। করলেও সেটা স্বাভাবিক। আমি নিরিপত্তা বিভাগের কর্মকর্তা। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এবং অপরাধীর সাথে আমার আজন্মের সম্পর্ক থাকবে। ওরা চোর, আমি পুলিশ। আমরা খেলব–এটাই স্বাভাবিক। এতে এমন দৌড়া-দৌড়ি করে বেড়ানো মাতলামি হবে।ʼʼ
একটু থামল ফারজাদ। চট করে সোজা হয়ে বসল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল দ্বিজার দিকে। দ্বিজার খুব অস্বস্তিকর লাগছে ব্যাপারটা। এভাবে তাকিয়ে থেকে
আন-ইজি ফিল করানোর কী দরকার? এমনিতেই লোকটার মুখ-চোখ ব্যাপক সিরিয়াস লাগছে দেখতে। ফারজাদ চরপাশে দেয়ালে চোখ ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,
-“সব বাদ। তুই বল, তুই কেমন উপভোগ করছিস এসব?ʼʼ
দ্বিজা চোখ তুলে তাকাল। ফারজাদ ভ্রু নাচাল, “কেমন লাগছে?ʼʼ
দ্বিজা কথা বলল না। ফারজাদ কিছুক্ষণ চুপচাপ মাথা নিচু করে বিছানার চাদরে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে বলল, “আবেগে ভেসে যাওয়া বয়সটাকে যেমন ঘৃণা করি আমি। সেই বয়সকে বয়ে নিয়ে বেড়ানো প্রতিটা মানুষের প্রতিও আমার ঠিক ততখানিই বিরক্তি আছে। কী লাফালাফিটাই না করলি এই এভাবে আমার সঙ্গে একটা উদ্ভট জীবন কাটানোর লোভে। এতদিনে এডমিশন কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে পড়া শুরু করার কথা। ক’দিন বাদে এডমিশন টেস্ট শুরু। তোর সঙ্গে কী হচ্ছে? এক অনিশ্চিত পরিণতির দিকে এগোচ্ছি আমি, সেই সাথে জুড়ে গেলি তুই। এসবের পেছনে কী ছিল আসলে?ʼʼ
দ্বিজা জবাব দিলো না কোনো। ফারজাদ দ্বিজার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আবেগ। তোর উঠতি বয়সের আবেগ। বেশিদিন ভালো লাগবে না এসব ঝঞ্ঝাট।বিতৃষ্ণা ধরে যাবে।ʼʼ
দ্বিজার আপাদমস্তক পরখ করল ফারজাদ। ভ্রু নাচিয়ে বলল, “এই জামাটা কবে পরেছিস? তিনদিন হলো। এখানে তোর কোনো কাপড় নেই। নতুন কিনতে হবে… আমার কাছে টাকা নেই।ʼʼ
দ্বিজা ওভাবেই নির্বিকার তাকিয়ে থেকে কিছুটা সময় নিয়ে আস্তে করে বলল, “চলবে।ʼʼ
-“চলবে?ʼʼ
দ্বিজা মৃদু ঘাঁড় নাড়ল উপর-নিচ, “হু, চলবে।ʼʼ
-“কতদিন?ʼʼ
কথা বলল না দ্বিজা। ফারজাদ ছাদের দিকে মাথা উচিয়ে প্রশ্ন করল, “আর কী কী চলবে তোর?ʼʼ
-“কী কী চালাতে বলছ, ফারজাদ ভাই!ʼʼ
চট করে তাকাল ফারজাদ। বহুদিন বাদে দ্বিজা ‘ভাইʼ ডেকেছে। বহুদিন বাদে ‘তুমিʼ সম্বোধন করেছে। ফারজাদ আবারও হেলে বসে তাকিয়ে রইল দ্বিজার দিকে শুকনো দৃষ্টিতে। নির্লিপ্ত চোখে একদৃষ্টে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ফারজাদ। ছোট্ট মুখটা দ্বিজার। খুব ফর্সা নয় মেয়েটা। তবে ফর্সা। চোখে একটা চঞ্চল মায়া ছিল, যা এখন দেখতে একদম শান্ত, স্থির লাগছে। চোখের নিচে কালো স্পট পড়েছে। চুলগুলো হাত খোঁপা করে রাখা। পরনে গোলাপি রঙা কামিজের সাথে সাদা ওড়না আর সালোয়ার পরে আছে সেই গত পরশু থেকে। তবুও সুন্দর! ফারজাদ একটুও সাহিত্যিক গোছের মানুষ নয়। তবুও আজ হুট করেই দ্বিজাকে একটু সেভাবে আখ্যা দিতে ইচ্ছে করল–মায়াবী। মায়বী নাকি মায়াবতী? কেন দিচ্ছে এই আখ্যা ফারজাদ? ফারজাদ জানে না। শুধু জানে দ্বিজার ওই শুকনো মুখে তাকিয়ে থাকতে তার একটুও খারাপ লাগছে না। দেখতে ইচ্ছে করছে, তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। এই মেয়ের ধৈর্য্য আর মেনে নেয়ার ক্ষমতাকে আরও বিশ্লেষন করে দেখতে মন চাইছে।
দুজনের কারোই আর দুপুরে খাওয়া হয়নি। মেয়েটা গোসল করেনি আজ। দেখতে একদম বিবর্ণ, অগোছালো লাগছে দ্বিজাকে। ফারজাদ মনে মনে হাসল–কোন আশায় এই জীবন যাপনেও মৌখিক অভিযোগহীন এই মেয়ে! একসময় তাদের পুরো বাড়ি হৈ হৈ করতো এর দাপটে। পুরো গ্রামে ডানপিটের মতো ঘরে বেড়াত। অথচ ফারজাদ তো ওকে ওর বাপের কাছ থেকে এনে একদিনে মেয়েটার বেহাল দশা করে ছেড়েছে। ফারজাদ খেতে বলল না দ্বিজাকে।
পা ছড়িয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। চোখজোড়া বুজে নিয়ে দ্বিজাকে বলল, “এগিয়ে আয় এদিকে। মাথা ধরেছে খুব, টিপে দে। আমি ঘুমাব। আমায় ডাকবি ঠিক মাগরিব নামাজের পর। দেরী যেন না হয়। আর্জেন্ট কাজ আছে।ʼʼ
চলবে..
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]
#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
২৬.
ফারজাদের ফোনটা বাজছে, বেজেই যাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে নাক-মুখ কুঁচকে ফোন হাতরাতে শুরু করল ফারজাদ। নাহ! পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু কানের তালা ঝনঝনিয়ে ফোনটা বাজছে কোথায়? ফোনটা পাওয়া গেল বিছানার ওপর অগোছালো পড়ে থাকা বালিশটার নিচে,যেটার ওপর হাত চেপে শুয়ে ছিল সে এতক্ষণ। কিছুক্ষণ নির্বিকার চেয়ে রইল ফোনের স্ক্রিনে। কলটা কেটে গেল। আবার এলো—ফুপুর নাম্বার। লম্বা এক শ্বাস নিয়ে কল রিসিভ করে কানে ধরল। ওপাশ থেকে দিলরুবা বেগম কথা বলছেন। হালচাল জিজ্ঞেস করছেন। এক পর্যায়ে বললেন,
“কথা বলতেছিস না ক্যান, আব্বা? রাগ হইছে আমার উপরে? রাগ তো আমার করার কথা, আমার মেয়ে কেড়ে নিয়ে গেছিস আমার বুক থেকে।ʼʼ
-“হুম, রাগ করার কথা। করছো না কেন?ʼʼ
দায়সারা কথাবার্তা। দিলরুবা বেগম একটু হাসার চেষ্টা করলেন, “করছি তো রাগ। কিন্তু রাগ দেখাচ্ছি না।ʼʼ
ফারজাদ কথা বলল না। দিলরুবা বেগম আবার বললেন,
-“ভালো আছিস তোরা, বাপ?ʼʼ
ফারজাদ সে জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করল, “তুমি ভালো আছো?ʼʼ
ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল ফারজাদ। ফারজাদের আক্কেল জ্ঞান কম তা অনস্বীকার্য। নিজের স্বভাব অনুযায়ী অবাঞ্ছিত এক প্রশ্ন করল, “তুমি কি কাঁদছো, ফুপু?ʼʼ
ভেজা গলায় বললেন ফুপু, “কাঁদব ক্যান?ʼʼ
-“সেটাই। কাঁদার কোনো কারণ দেখছি না।ʼʼ
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দিলরুবা বেগম, “গতকাল থেকে কতবার কল দিলাম, রিসিভ করিস নাই তুই, ফারজাদ।ʼʼ
-“আজ করেছি তো!ʼʼ
দিলরুবা বেগম হতাশ শ্বাস ফেললেন। কিছু মানুষ জীবনে বদলাবে না, তার মধ্যে ফারজাদ ভালো নাম করবে, না বাদলানো মানুষ হিসেবে। আস্তে করে বললেন, “আমার পাগলিটা কী করতেছে? ওর কাছে দিবি একটু!ʼʼ
ফারজাদ উঠে বসল এবার। নজর থামল তার। একদম পুচকে বাচ্চার মতো করে হাত-পা গুটিয়ে, হাঁটু জড়িয়ে থুতনিতে ঠেকানোর যোগাড় করে তার পায়ের কাছে শুয়ে আছে দ্বিজা। বালিশ নেই মাথার নিচে। মুখটা তেলতেলে হয়ে আছে। চুলগুলো উলকো-খুশকো, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মুখ, গলা সমেত। ওড়নাটা এলোমেলো হয়ে কাধের একপাশে পড়ে আছে। ফারজাদ চট করে ঘাঁড় ঘুরিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বিক্ষিপ্ত শ্বাস ফেলল দুটো। আস্তে করে বলল,
-“ঘুমাচ্ছে। বলো তো ডেকে দিই।ʼʼ
কেন জানি ডাকতে ইচ্ছে করছে ফারজাদের। কী আদুরে ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। তার ওপর সারারাত ঘুমায় নি, সকালে জোর করে টেনে তুলেছে, এরপর থেকে আরেক কেলেঙ্কারি বেঁধেছিল। তবুও ডাকতে হলো। দ্বিজা কপাল চেপে ধরে উঠে বসল নাক-মুখ জড়িয়ে। বোঝা যাচ্ছে মাথা ব্যথা করছে হয়ত তার। ফারজাদ কল কেটে দিয়েছিল। আবার কল করল ফুপুর নম্বরে। দ্বিজার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “তোর আম্মা কথা বলবে।ʼʼ
দ্বিজা সপ্রতিভ হলো। হুট করে সোজা হয়ে বসল। ফারজাদ উঠে গেল বিছানা ছেড়ে। মাগরিব নামাজ শেষ হয়ে আরও বেশ কিছুটা সময় কেটে গেছে, ইশার আজানের সময় হয়ে আসছে। ফারজাদ বাথরুমে ঢুকল। দ্বিজার কণ্ঠ পেয়ে দিলরুবা বেগম ডুকরে উঠলেন। মা তো! দ্বিজা কিছু বলছে না, ফোন কানে চেপে ধরে নিশ্চুপ বসে আছে।
-“কেমন আছিস পাখি?ʼʼ
-“তুমি কেমন আছো, আম্মু?ʼʼ
-“তোরা কেউই নিজেদের খোঁজ দিচ্ছিস না ক্যান? খালি আমারে জিগাস কেমন আছি? কেমন থাকা যায়? আমি কেমন থাকতে পারি এ অবস্থায়? তোরা একজনও তো বললি না তোরা কেমন আছিস?ʼʼ
সব এড়িয়ে ছোটো ভাইয়ের খোঁজ করল দ্বিজা, “দিহান ভালো আছে?ʼʼ
-“আছে। খাইছিস দুপুরে?ʼʼ
-“হুম। তুমি?ʼʼ
-“রান্না করছিলি তুই?ʼʼ
অকপট মিথ্যাচার করে দিলো, “না, ফারজাদ করেছিল।ʼʼ
-“আম্মার ওপর রেগে আছিস, ময়না?ʼʼ
-“কীসের রাগ, আম্মা? কাঁদছো কেন? কী হয়েছে কাঁদার মতো, আশ্চর্য? তোমরাও তো তাড়িয়েই দিচ্ছিলে, আমিও চলেই এসেছি। শুধু যা হয়েছে, আমি আমার চাওয়া মানুষটার পেছনে বেরিয়ে এসেছি। যাওয়ার তো ছিলই তাই না? পাঠাচ্ছিলে তো অন্য কোথাও! এমন তো না, জোর করে পালিয়েছি। তোমরা আর রাখতে চাইছিলে না, পড়াতে চাইছিলে না, মান-সম্মানের ভয়, সমাজ-পাড়া, ছেলের বাড়ির লোক, বহুত সমস্যা মেয়ের বাপ-মায়ের। এত সমস্যার ঝাড় বিদায় করে কাঁদাটাও কেমন যেন– উমম ফারজাদ কী যেন বলে.. অবাঞ্ছনীয়। মেয়ে হিসেবে ঠাঁই হচ্ছিল না, হয়ে গেলাম সংসারী হয়ে অন্যঘরের বউ। ভালোই আছি, আম্মা। ভীষণ ভালো যাচ্ছে হাঁটিহাঁটি পা পা করে দিনগুলো। চিন্তা কোরো না। ফারজাদ খারাপ রাখবে না আমায়। আমি জানি, ফারজাদ অন্তত নিজের কর্তব্য পালন করতে জানে। আমার জন্য এটুকুই এখন অনেক। এর বেশি পাওয়ার বা চাওয়ার নেই আমার আজ।ʼʼ
দিলরুবা বেগমের বুক ছেঁড়া কান্না দ্বিজা চুপচাপ শুনছে। মেয়ের অভিযোগ! তার আজ বলার কিছু নেই যেন কাঁদা ছাড়া। দ্বিজার চোখে পানি নেই, পাথরের মতো কানে ফোন চেপে বসে আছে। ফারজাদ খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে রইল ওর পেছনে। আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা নামিয়ে রাখল দ্বিজা কান থেকে। ফারজাদের পা চলতে চাইছে না কেন জানি। আজকাল ফারজাদের মতো অদ্ভুত পদার্থে তৈরী লোকটাও কেমন যেন হুটহাট কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। একটু থমকে যায়, নড়েচড়ে ওঠে ভেতরটা। নিজের প্রতি অভিযোগ করে ওঠে নিজের ভেতরের ফারজাদটা আজকাল–যা ফারজাদের সাথে আগে হয়নি, বিষয়টা তার পছন্দও না। তার করণীয় কী আসলে এ পর্যায়ে–সে ব্যাপারে ধাতস্থ হতে পারছে না সে। ঘরের লাইট জ্বালিয়ে ধীর পায়ে এসে বসল দ্বিজার সামনে। দ্বিজা ফারজাদকে দেখে বিছানা গোছাতে ব্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। ফারজাদ খপ করে থাবা দিয়ে হাতটা ধরে ফেলল দ্বিজার। চোখ দিয়ে নিজের পাশে ইশারা করে বলল, “বস এখানে।ʼʼ
-“আমি একটু ফ্রেস হব। পরে বসব, আপনি একটু অপেক্ষা করেন। আমি ফ্রেস হয়ে আসছি। আপনি কোথাও যাবেন বলেছিলেন..ʼʼ
ফারজাদ শুনতে পেল না বোধহয় কথাগুলো। হেচকা টান দিয়ে কাছে এনে বসাল। কানের এপাশ-ওপাশ, কপাল, মুখে চুল ছিটিয়ে আছে দ্বিজার। ফারজাদ সেগুলো আঙুল দিয়ে আলগোছে সরাতে সরাতে গম্ভীর গলায় বলল, “আমাকে এতো ছাড় দিচ্ছিস কেন? আমার দোষগুলো এড়িয়ে যাচ্ছিস বারবার।ʼʼ
দ্বিজা অস্পষ্ট তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল, “দোষ? আপনার? কীসের দোষ? দোষ যেখানে করে বসে আছি আমি বহুকাল আগে, সেখানে আজ আর কাউকে দোষী করাটা অবিচার হবে না?ʼʼ
আজকাল মেয়েটা খুব ভারী ভারী কথা বলে, সুবিন্যস্ত শুনতে লাগে কথাগুলো। ফারজাদ জিজ্ঞেস করল, “এত বড়ো কবে হয়ে গেলি?ʼʼ
অবহেলার দৃষ্টি দ্বিজার, দায়সারা ভাবে বলল, “হয়েছি নাকি? হলে, কবে হয়েছি জানা নেই।ʼʼ কথাটা বলেই ফারজাদকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবার বলে উঠল, “শোনেন, আমার গা চিটচিট করছে কেমন, একটু মুখে-চোখে পানি লাগাতে হবে..
ফারজাদ চমৎকার হাসল, “এড়িয়ে চলতে চাইছিস নাকি আমায়?ʼʼ
দারুন সুন্দর দেখতে লাগল হাসিটা ফারজাদের। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, হালকা এলোমেলো চুলে পুরু কালো ঠোঁটের হাসি! দ্বিজা শান্ত চোখে তাকাল, “সেই সাহস আছে নাকি দ্বিজার! জড়িয়ে চলতে চাচ্ছি না আর, এই যা।ʼʼ
ফারজাদের অভিব্যাক্তির পরিবর্তন হলো না। তাদের নীরব লড়াইয়ে দুজনেই আজ পরিপক্ক খেলোয়ার বুঝি! ফারজাদ হাসিমুখেই ভ্রু জড়াল, “আমার সামনে তোর হুশিয়ারী কথাবার্তা! ইন্টারেস্টিং!ʼʼ
কথাটা বলে ফারজাদ ঠোঁট উল্টে ভ্রু নাচাল। দ্বিজা একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। ওই হাসি আজ বিষাক্ত লাগছে খুব। তার ধ্বংসের মূল ফুটে আছে যেন ওই হাসিতে–এমনটা লাগল দ্বিজার। সচরাচর না হাসা পুরুষের এই হাসিতে দ্বিজা কাবু ছিল এককালে, আজ সেই কারণে হলেও আক্রোশ ধেয়ে এলো নিজের দিকে হুট করে। ফারজাদ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখল দ্বিজাকে। মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তোর কাছে অপরাধী না, দ্বিজা?ʼʼ
-“এত আবেগী কথাবার্তা মানায় না আপনাকে, ফারজাদ!ʼʼ
ফারজাদ শ্লেষের হাসি হেসে অবুঝের মতো জিজ্ঞেস করল, “কেন?ʼʼ
-“এমনি। সবার সাথে সবকিছু যায় না।ʼʼ
-“আচ্ছা! তাহলে আমার সাথে কী যায়?ʼʼ
-“জানি না আমি।ʼʼ
-“এদিকে তাকা।ʼʼ
দ্বিজা তাকাল না। মাথাটা নুইয়ে বসে আছে। ফারজাদ অস্বস্তিকর একটা শ্বাস ফেলে হাতের আজলায় দ্বিজার মুখটা তুলে নিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “এত বড়ো বড়ো কথা বলবি না তুই আমার সামনে। সকলের সমনে জায়েজ আছে, কিন্তু আমি তোর এরকম ভরসম্পন্ন অভিমানিনী রূপ কনসিডার করব না।ʼʼ
দ্বিজা কথা বলল না। ফারজাদ ভেতর ভেতর অস্থির হয়ে উঠছে। নিজেকে সামলালো। নাহ! সে তো উত্তেজিত হয় না! সে সব রকম অবস্থাকে খুব নিষ্ঠূরভাবে নিজের নির্লিপ্ততা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে। তবে আজ নিজেকে খুব অপদার্থ, আর লজ্জিত মনে হচ্ছে। এই যে মেয়েটাকে এনেছে, এই দুদিনে কী দিয়েছে, কী হাল করে ফেলেছে? সে এনেছিল নিজের স্বস্তির জন্য। আবার আনার পর সে তো ইচ্ছে করেই করছে এসব! তাহলে এমন অপরাধী লাগছে কেন নিজেকে? নিজেকে বাজে ভাষায় একটা ধমক দিলো, “ক্যাম ডাউন! কুল!ʼʼ
দ্বিজাকে ধমকে বলতে ইচ্ছে করল তার, ‘এই! কেন এসেছিস আমার সাথে? আমি আনলেই আসতে হবে? তোর জন্য আমার শান্তি হারাম হয়ে গেছে। এত চাপ আমি নিতে পারব না। এসব মানসিক ভারী কর্তব্যের চাপ আমি নিই নি কোনোদিন। কোনোদিন এভাবে অস্থির হতে হয়নি, কাউকে পরোয়া করিনা আমি, জানিস তো তোরা। অথচ তোর পরোয়া করতে হচ্ছে। না করার উপায় দেখছি না। আমাকে নিরুপায় মনে হচ্ছে না তোর? খুব নিরুপায় হয়ে উঠেছি তাই না? কেন হচ্ছে এরকম? আমি নিরুপায়? তোকে পরোয়া না করতে পারার এই অসহ্য প্যারায় ভুগতে হচ্ছে আমায়। তুইও তো ভুগছিস…ʼ
বলল না কিছু, জোরে জোরে শ্বাস ফেলল। দ্বিজা নিশ্চুপ তাকিয়ে আছে। আসলে তার এই নির্বিকারত্বই সহ্য হচ্ছে না ফারজাদের। মেয়েটা এত ধৈর্য্যে আর মেনে নেওয়ার ক্ষমতা পাচ্ছে কোথায়? ফারজাদ ভুল প্রমাণিত হচ্ছে কি! শান্ত হয়ে উঠল ফারজাদ, “সুখে থাকতে পারতি তুই। আমাকে বাদ দিতে পারলে, চিরদিন সুখে থাকতে পারতি। আমার ফ্যাকাশে জীবনে এসে তুইও দিনদিন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছিস, যাবি। এটাকে কেমন ভাবে দেখছিস?ʼʼ
দ্বিজা হেসে ফেলল মুচকি। যা একদম অপ্রত্যাশিত ছিল। কেন হাসল, এই পরিস্থিতিতে হাসিটা একদম আশাতীত। তবুও হাসল কেন মেয়েটা! হাসিমুখেই বেশ বুঝমতীর মতো করে বলল দ্বিজা, “এত কথা বলছেন কেন আজ?ʼʼ
ফারজাদ ভ্রুটা কুঁচকে ফেলল। ঘাঁড় কাত করল, “বেশি কথা বলছি?ʼʼ
-“হু, বলছেন। যা আপনার সাথে যাচ্ছে না।ʼʼ
ফারজাদ দ্বিজাকে ছেড়ে মাথাটা সামান্য নিচু করে ডান হাতের মধ্যমা আঙুলি কপালে ঘষলো। মুখটা বেজায় গম্ভীর হয়ে উঠেছে তার। নাক শিউরে এদিক-ওদিক তাকাল কয়েকবার। বড়ো করে একটা শ্বাস ফেলে একটা ঢোক গিলল। তাকাল দ্বিজার দিকে, কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। এরপর আস্তে করে অদ্ভুত স্বরে, অকৃত্রিম ভঙ্গিতে বলল, “একটা চুমু খাব তোর ঠোঁটে?ʼʼ
দ্বিজা কিছুক্ষণ কথাটাকে নিতেই পারল না। তার থমকানো, চমকানো বিস্ময় কাটলোই না, ফারজাদ চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। এই যে এতক্ষণের কর্মকাণ্ড ফারজাদের সবটা অতিরিক্তই অগোছালো ছিল। যা একদমই তার সাথে যায় না। শেষ কথাটা দ্বিজার মস্তিষ্ক বোধহয় ধরতেই পারেনি এতক্ষণে। সে থ মেরে বসে রইল। ফারজাদ এগিয়ে গেছে হ্যাঙ্গারের দিকে, ভারী কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “ফ্রেস হয়ে আয়। বের হব।ʼʼ
—
রাত নয়টা পার হয়ে গেছে। শান্তিনগর রোডের সিদ্ধেশ্বরী লেনের সম্মুখ দিয়ে হাঁটছে দ্বিজা। কী যে অস্বস্তিকর একটা ব্যাপার। কার পাল্লায় ফেলেছে আল্লাহ পাক! তাকে এক প্রকার ধরে-বেঁধে আনা হয়েছে। কিডন্যাপিংও বলা চলে! এই জামাটা দ্বিজা পরেছে প্রায় তিনদিন আগে গোসল করে। জড়িয়ে গেছে, কেমন নিজেরই গা চিটপিট করছে। তা পরে নাকি সে যাবে মার্কেটে। আসতে হয়েছে তা-ই। আজ ফারজাদকে সরাসরি পাগলের খেতাব দিয়ে দিয়েছে দ্বিজা। লোকটার আসলে অদ্ভুত না, উন্নত জাতের পাগল। একাধারে গালি দিচ্ছে আর হাঁটছে। সামনে হাঁটছে ফারজাদ, তার সাথে ইচ্ছে করে হাঁটছে না দ্বিজা। রুচি নেই, মানে ইচ্ছে নেই তার।
নিজে সাহেব সেজে বেরিয়েছে, তার পাশে নিজেকে ওর বাড়ির কাজের লোকের চেয়ে কম মনে হবে না নিজেকে। একা গেলে তাও লোকে ভাববে হয়ত গরীবের মেয়ে। কিন্তু ওই সাহেবী সাজে লোকটার সাথে হাঁটলে নিশ্চিত লোকের ধারণা জন্মাবে লোকটা তার বাড়ির কাজের মেয়েটাকে সঙ্গে করে এনেছে বাজারে। কত উদার মনের মানুষ ওই লম্বু! কাজের মেয়েটাকে এমনটাই ধারণা দ্বিজার।
পনেরো মিনিট খানেক সময় হাঁটার পর তারা মৌচাক মার্কেটের একদম নিকটে পৌঁছাল। ফারজাদ পিছন ফিরে তাকাল। দ্বিজা অস্বস্তিতে বুদ হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। ডাকল ওকে দ্রুত হেঁটে কাছে আসতে। জিদ করে হাঁটার গতি আরও কমাল দ্বিজা। কেমনটা লাগে! ফারজাদের রাগ হলো। তার চোখে সমস্যা হচ্ছে মনে হলো, আলোর সামনে গেলে মাথাটা চিনচিন করে উঠছে। পকেট থেকে চশমাটা বের করে চোখে আঁটল। দ্বিজার মনে হলো এবার ফারজাদকে ডাক্তার ডাক্তার লাগছে। ভদ্রলোকের ঘরের ডাক্তার ছেলে আর কী! দাপুটে পায়ে হেঁটে পেছনে এসে খপ করে চেপে ধরল দ্বিজার হাত।
মার্কেটের ভেতরে হাঁটতে আরও অস্থির লাগছে দ্বিজার। আচ্ছা! এই লোকটার খারাপ লাগছে না? এই যে এভাবে হাত চেপে ধরে, সকল ভীড় ঠেলে, ওকে বাঁচিয়ে নিজের সঙ্গে নিয়ে হাঁটছে–খারাপ লাগছে না? নিজের পাশে বেমানান লাগছে না? মৌচাক মার্কেটের ইউরো গার্ডেনের ভেতরে ঢুকে দ্বিজাকে নিয়ে মেয়েদের পোশাকের শোরুমে ঢুকল ফারজাদ। চারটা পছন্দ হলো ফারজাদের, কিনল তিনটা। বেরিয়ে এসে একজায়গায় দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থেকে ডানদিকে দ্বিজার দিকে একটু ঝুঁকে বলল,
-“আপাতত এই দিয়েই চালিয়ে নে। খুব অভাবে আছি, হাতে বিষ খাওয়ার পয়সা নেই। ইচ্ছে করলেই ঠিকমতো
আ ত্ম হ ত্যাও করতে পারব না।ʼʼ
দ্বিজার হাসি পেল। সে হাসল না। তার রাগ হচ্ছে কেন জানি, তাই হাসতে ইচ্ছে করল না একদম। মুখ গোজ করে দাঁড়িয়ে রইল। ফারজাদ জিজ্ঞেস করল, “এখন কি কুমিল্লা ফিরে যাবার চিন্তা করছিস? আসলেই, তোর জায়গায় আমি থাকলেও এরকম বেকার স্বামীর কাছে জীবনেও থাকতাম না। মনে আছে সেদিন কত বড়ো বড়ো কথা বলেছিলাম! অথচ আজ! বিশ্বাস কর, এই মুহুর্তে বাস ধরে কুমিল্লা চলে যেতাম। কোনো ভাবেই করতাম না এর স্বামীর ঘর।ʼʼ
দ্বিজা কপাল জড়ালো, “নিজে কী করতেন তা বলছেন নাকি আমাকে ইন্সপায়ার করছেন এক্ষুনি কুমিল্লা চলে যেতে?ʼʼ
ফারজাদ তড়াক করে তাকাল, তার মুখ ভার। তা দেখেও হাসি আসছে দ্বিজার। কিন্তু হাসল না। এটা হাসার উপযুক্ত অবস্থা নয়। তবে ফারজাদের হালের ওপর তার দয়া না হয়ে হাসি আসছে কেন? ভালো প্যাঁচাকলে পড়েছে ব্যাটা! ফারজাদ কিছুক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “চল কোথাও বসি। আজ বাইরে খেতে ইচ্ছে করছে, বিয়ে করে থেকে বাইরে খাইনি?ʼʼ
তাইলে এটা কোনো কথা? দুই-চার যুগ বিয়ে করে সি সংসারী হয়েছে! সে বিয়ে করেছে দু’দিন হলো। তার মাঝে একরাত না খেয়ে, পরের দিন সকালে বাইরের খাবার খেয়ে, তারপর আর কিচ্ছু না খেয়ে এই অবধি। কতটা আক্কেল-জ্ঞানহীন হলে মানুষ এর পরিপেক্ষিতে এমন মন্তব্য করে! দ্বিজা ভেবে পেল না। তার মেজাজ চটে উঠল এবার, “আসলেই খুব কষ্টদায়ক ব্যাপার। বিয়ে করে থেকে বাইরের খাবার না খেতে পেয়ে আপনার মাথার তার কেটে গেছে। এই পোশকে, এই অবস্থায় আমি যাব মার্কটে? আপনি যান, বাড়িতে যা খাবার আছে খেয়ে নেব আমি।ʼʼ
বলেই হাঁটা শুরু করল সেই। হাত চেপে ধরল ফারজাদ। চিবিয়ে বলল, “আর এক পা এগোবি তো, একদম পায়ের গোড়ালি বরাবর শ্যুট করব একটা। তোর জামার কী হয়েছে? তোর হিটলার বাপ যেসব কাপড় চোপড় পরিয়েছৃ তোকে। মাসখানেক না বদলালেও তা পরে বাইরে বের হওয়া যাবে। আমি তো কোনোরকম সমস্যা দেখছি না ড্রেসে! তুই যাবি আমার সাথে, বউ আমার, যেভাবেই যা সেটা আমি দেখব। তুই কাঁদছিস কেন?ʼʼ
দ্বিজা হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার ধারণা হলো, বেশি চুপচাপ লোক কথা বললে বোধহয় এমন পাগলাটে কথাবার্তাই বলে! বেশি একা লোক মানুষের সাথে চলতে গেলে এমন উল্টোপাল্টা কাণ্ডই করে নিশ্চয়ই! তার ইচ্ছে করছে ফারজাদের চুলের মুঠি ধরে ধারাম করে মাথাটা কোনো দেয়ালের সাথে ঠুকে দিতে। হয়ত একটু আক্কেল ফিরবে! সকাল থেকে অদ্ভুত আচরণ করছে লোকটা। পুলিশরা এরকম পাগল হলে আসামীদের অবস্থা কেমন হবে? এটা ভেবে ডিপ্রেশনে চলে যেতে ইচ্ছে করল দ্বিজার!
চলবে..