ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-০২

0
607

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_২

“তুমি মরিয়মের মেয়ে না? নামটা যেন কি?;

তিতিরকে নিয়ে স্টেজে বসানো হলো। সঙ্গে আছে তুতুন এবং তানু। বোনের দু’পাশে জায়গা দখল করে বসে আছে দু’জনে । ইশানি তিতিরকে বসিয়ে দিয়ে নীচে নামার সময় কেউ একজন তার হাতটা টেনে নিয়ে হঠাৎ প্রশ্নটা করলেন। ইশানি একটু চমকালো আকস্মিক টান পড়াতে। নিজেকে ধাতস্থ করতে কয়েক মুহুর্ত সময় নিয়ে হাসি মুখে জবাব দিলো,

“জি। আমার নাম ইশানি।;

মহিলা ফকফকা দাঁতের হাসি দিলো। হলদেপাখিকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ফের বলল,

“দেখেই চিনেছি। এই খান বাড়িতে এতো সুন্দর পরীর মতো মেয়েটা আমাদের ইশানিই হবে।;

কথাটা ঠিক পছন্দ হলোনা ইশানির। তার বাকি তিন বোনও ভীষণ সুন্দর। এককথায়, একেবারে চোখে লাগার মতো। কিন্তু বাঙালি সর্বদা গায়ের রঙ দিয়েই বিচার করতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ইশানি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে মহিলার কথার প্রতিবাদ করে বলল,

“এটা আপনি ভুল বললেন আন্টি। আমাদের বাড়ির সব মেয়েরাই কিন্তু পরী সমতুল্য। আমি তো বলি, পরির চেয়েও বেশি মায়াবতী।;

মহিলার মুখ খানা খানিক কাচুমাচু হয়ে এলো। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল,

“একদম একদম। তা বলছিলাম যে, শাড়িতে কিন্তু তোমাকে একদম নতুন বউয়ের মতো লাগছে। বুঝতেই পারছিলাম না, কার হলুদে এসেছি!;

শাড়ি’ শব্দটা মাথায় বাজলো ইশানির। মনে পড়লো শ্রাবণের দেওয়া ডিরেক্ট হু/ম/কি/র কথা! শাড়িটা ওকে পাল্টাতে হবে, ভুলেই গিয়েছিলো কয়েক মুহুর্তের জন্য। মহিলার কথায় আর জবাব দিতে পারলো না ইশানি। তাড়াহুড়ো করে ছুটে গেলো নিজের রুমে। এবার রুম ফাঁকাই পেলো। সবার আগে রুমের দরজাটা লক করে খানিক সস্তির নিঃশ্বাস নিলো। শ্রাবণকে আর কোথাও দেখেনি। হয়তো নিজের রুমেই আছে। আরব ভাই বলছিলো, তুর্জকে আরেকবার কল করতে! কিন্তু ওর যে মোটেই ঐ মানুষটাকে কল করতে ইচ্ছে করেনা। মানুষটা যে বড্ড সুযোগ সন্ধানী। কিন্তু করবে তো করবে কি? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কল দিয়েই দিলো তুর্জর নাম্বারে। কয়েক সেকেন্ড পেরোতে কল তোলে তুর্জ,

“আজ সূর্য কোন দিক থেকে উদয় হলো?;

তুর্জর কথা শুনে মৃদু হাসার চেষ্টা করলো ইশানি। তবে সেই হাসি এলোনা যেন ঠোঁটের কোনে।

“আজকে আসছেন তো?;

“তুমি বললে!;

“বড় মামা বারবার বলছিলো আপনার কথা। হাতে একটু সময় নিয়ে চলে আসেন।;

“জো হুকুম মহারানী।;

“হু, ছাড়ছি।;

“সেকি কথা? কল দিলেই রাখি রাখি করো কেন বলোতো? এই পাগল বরটার সাথে দু’দন্ড কথা বলা যায়না?;

“ছোট মামি বলে, বিয়ের আগে এতো কথা না বলাই ভালো। বিয়ের পর অঢেল সময় হবে কথা বলার!;

“কিন্তু মহারানী, বিয়ের আগের যে নবজাত অনুভূতি, সেটা তো বিয়ের পর হবেনা! এজ লাইক, আমাদের ফার্স্ট ডেট, ফার্স্ট হাগ, ফার্স্ট কি…;

“আমার হাতে অনেক কাজ পড়ে আছে। পরে কথা হবে।;

বলেই কলটা কেটে দিলো ইশানি। এই তো সবে শুরু। খানিক বাদে লোকটা বিছানা অব্দি চলে যাবে তার নবজাত অনুভূতি নিয়ে। ফোনটা বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে উঠে গেলো। আলমারিটা খুলে শুরু করলো চিরুনি তল্লাশি। তবে, আশানুরূপ ভাবেই হতাশ হতে হলো। কেননা সে জানতো হলুদের জন্য তেমন বিশেষ কোনো পোশাক পাবেনা। তার মানে, শ্রাবণের আদেশ মোতাবেক হলুদ শেষ না হওয়া অব্দি তাকে নিজের ঘরেই থাকতে হবে।

হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। খান সাহেব এবং তার বউ আনোয়ারা অর্থাৎ তিতিরের দাদা-দাদী সবার প্রথমে হলুদ ছোঁয়ালেন আদরের নাতনিকে। তারপর এলেন আফিয়া বেগম, নুপুর বেগম এবং মরিয়ম বিবি। সবাই মিলে একে একে হলুদ মাখাতে লাগলেন। অতঃপর এলেন বাড়ির বাবা-চাচারা। সবার হলুদ মাখানো শেষ হতে এবার খোঁজ পড়লো ছোটদের। ছোটদের মধ্যে গন্য হলো বাড়ির ছেলে-মেয়েদের। আরব, শ্রাবণ, তুতুন, তানি এবং ইশানি। আরব তিতিরকে হলুদ মাখাতে গিয়ে ভূত করে ফেললো। সে নিয়ে শুরু হলো তোলপাড়। হাসাহাসির রোল পড়লো ক্ষণেই। আরব বকাও খেলো নিজের মায়ের কাছে। মেয়েটাকে এত সুন্দর করে সাজানো হলো, ভালো ছবি ওঠার আগেই ভূত করে ফেললো। আরব বকা খেয়ে শ্রাবণের কাছে গিয়ে দুঃখ বিলাস করতে চাইলে আরেক দফা ধমক পড়লো তার কপালে।

সবশেষে খোঁজ পড়লো ইশানির। প্রায় অনেক্ষণ কারোর চোখে পড়েনি সে। একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে আফিয়া বেগম আরবকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,

“ইশা কই রে? অনেক্ষণ যাবত নিখোঁজ। তিতিরকে হলুদ মাখাবে না?;

আবর এবং মায়ের পেছনেই দাঁড়িয়ে ফোন টিপছিলো শ্রাবণ। মায়ের প্রশ্নে সে মুখ তুলে আড়চোখে একবার তাকালো চারপাশে। অনেক্ষণ যাবত সেও দেখেনি তাকে! তবে কি, ম*রা*র ভয়ে নিজের ঘরে ঘাপটি মে*রে*ছে, নাকি হবু বরের সঙ্গে টাইম স্পেন্ড চলছে?

“ভালো কথা বলেছো তো বড় মা! আমিও ওকে দেখছিনা অনেক্ষণ হলো।;

আশেপাশে দেখতে দেখতে বড় মায়ের ন্যায় দুশ্চিন্তাগ্রস্থ কন্ঠে বলল সে।

“এই তুতুন?;

হাত উঁচিয়ে ডাকলো তুতুনকে। ভাইয়ের ডাক পেয়ে দৌড়ে এলো তুতুন।

“হ্যাঁ ভাইয়া, বল!;

“ইশু কই?;

“মেঝআপা.. এখানেই ছিলো?;

সেও দৃষ্টি বুলালো চারপাশে। কোথাও দেখতে না পেয়ে বলল,

“মনে হয় ঘরে।;

“এই সময় ঘরে কি করছে?;

শুধালেন আফিয়া বেগম। তুতুন ভাবুক কন্ঠে বলল,

“জানিনা গো বড় মা। মনে হয় তুর্জ ভাই কল করেছে। কথা বলছে হয়তো!;

“কাজের সময় কথা বলতে হবেনা। বোনের বিয়েতে একটু মন খুলে আনন্দ করবেনা? এখন কথা বললে হবে? যা-তো, ডেকে নিয়ে আয়। বল আমি ডাকছি।;

“ওকে বড় মা।;

আবারও দৌড়ে চলে গেলো তুতুন। আফিয়া বেগমের কপালের মাঝে তীক্ষ্ণ ভাজ। তিনি জানেন না কেন, তবে তুর্জকে সে ঠিক পছন্দ করতে পারেন না। দেখেই কেমন অস্বাভাবিক মনে হয়। মনে হয় যা সে নয়, সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা করে। জানেনা, সবাই মিলে মেয়েটার ভবিষ্যত ন*ষ্ট করছে কিনা!

দরজায় দু’বার টোকা পড়তেই দরজার পানে তাকালো ইশানি। সম্মুখ পানে বড় একটা ড্রেসিং টেবিল। বড় আয়নাটায় নিজেকে আপাদমস্তক একবার দেখে, গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“কে?;

জবাব এলোনা কোনো। নীচে সাউন্ড বক্স বাজার কারনে আরও শোনা গেলোনা। জবাব না এলেও দ্বিতীয় পূণরায় টোকা পড়লো দরজায়। ইশা এবার উঠে দাঁড়ালো। কে’ আরেকবার জিজ্ঞেস করতে করতে দরজা খুলে দিলো।

“ত্ তুমি!;

শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে গম্ভীর মুখে।

“এখনও এই বেহুদা পোশাকে?;

“ত্ তো কি করবো? দেখনি সেদিন.. শপিংমলে! তিতির আপু বলছিলো সবাই সেম শাড়ি নিবে! তাই বড় মামিও আমাকে শাড়ি দিলো। এখন, এই মুহুর্তে আমি নতুন ড্রেস কোথা থেকে জোগাড় করবো?;

“জানিনা।;

“না জানলে কেন বলছো চেঞ্জ করতে?;

কথাটা বেশ বির*ক্ত নিয়েই বলল ইশানি। সঙ্গে সঙ্গেই গরম চোখে তাকালো শ্রাবণ। যা দেখতেই তুবড়ে গেলো সে। দরজা ছেড়ে সরে গেলো ভেতরে। রা/গ থাকবে সর্বদা নাকের ডগায়! এমন মানুষ গোটা জন্মে দেখেনি ইশানি। শ্রাবণ ইশানির পানে রা/গি চোখে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলো,

“নেক্সট টাইম থেকে এসব বেহুদা পোশাক পড়তে দেখলে!(দাঁতে দাঁত চেপে) যা নীচে যা। সবাই খুঁজছে তোকে ;

প্রথম রাগ, পরক্ষণেই আবার নরম হতে দেখে চোখ জোড়া বড়বড় হয়ে গেলো ইশানির। বিহ্বল গলায় শুধালো,

“আমাকে ‘তুমি বলছো নীচে যেতে?;

এবার বির*ক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো শ্রাবণ। বলল,

“যেতে বলেছি তো!;

ইশানির আনন্দ হলেও প্রকাশ করতে পারলোনা। বেটা খারাপ, কিন্তু একটু ভালো খারাপ। খারাপ খারাপ না।

আর কোনো জবাব দিতে গেলেও ধমক খেতে হবে ইশাকে। তাই শাড়ির কুঁচি আগলে দ্রুত পায়ে ছুটলো নীচে। পেছনে বিছানার উপর পড়ে রইলো ওর ফোনটা। ওর ফোনটা দেখতেই একবার পেছন মুড়ে তাকালো শ্রাবণ। না, ইশা আর ফোন নিতে আসবেনা। তাই কিছু না ভেবেই ফোনটা হাতে তুলে নিলো। ভেবেছিলো লক করা থাকবে। তবে তাকে প্রশান্তি দিতে ফোনটা আনলক করাই ছিলো। শ্রাবণ আর সাত-পাঁচ না ভেবে কল লগে ঢুকলো। তুর্জর নাম্বারে কল গিয়েছিলো। তবে মাত্র ১৭ সেকেন্ডই কথা হয়েছে। যা দেখে শ্রাবণ মলিন হাসলো। পরক্ষণেই ফোনটা রেখে দিলো বিছানার উপর।

নীচে ভাইবোনদের হল্লা হল্লি শুরু হয়েছে। হলুদ নিয়ে একজন আরেকজনে পেছনে ছোটা, একে কতক্ষণ হলুদ মাখানো আবার ওকে কতক্ষণ হলুদ মাখানো। বাড়িটাকে মাতিয়ে তুললো মাত্র কয়েক মুহুর্তেই।

শাকিলদের পরিবার আসাতে তাদের আতিথেয়তায় অস্থির হয়ে উঠলেন গুরুজনেরা। এরই মাঝে ঘটলো এক আতংকিত ঘটনা। হলুদ নিয়ে ছোটাছুটি করার এক পর্যায়ে বাটি ভর্তি হলুদ গিয়ে পড়লো শ্রাবণের সাদা পাঞ্জাবিতে। বন্ধুদের নিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে খোশগল্পে মেতে ছিলো সে। হঠাৎ এমন আকস্মিক আ/ক্র/ম/ণে/র স্বীকার তা যেন কল্পনাতীত ছিলো। ভড়কে যাওয়া মুখশ্রীতে একবার নিজেকে দেখে সামনে তাকাতেই মেজাজটা যেন ভ*য়া*ন*ক ভাবে চড়ে গেলো। পড়লো তো পড়লো, কিন্তু কার হাত থেকে পড়লো? একদম ইশার হাত থেকে! এজন্যই হয়তো বলে, “যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়!”

“হোয়াট দ্য…;

র*ক্তিম চাহনিতে ভ*স্ম করে দিবে ধরনী, এমনই এক লাল চক্ষু নিক্ষেপ করলো ইশার পানে। ইশা অসহায় নেত্রে মুখে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। ভ*য়ে রীতিমতো কাঁপছে সে। সঙ্গে কাঁপছে তানিও। মূলতও তানিই ওকে ধাক্কাটা দিয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে এহেম ঘটনা।

শ্রাবণ ইশার পানে তেড়ে আসতে নিলেই নিজেকে আড়াল করে কুঁজো হয়ে পড়লো ইশা। তানি প্রথমেই নিজের প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে পালিয়েছে।

“কি করলি এটা? এতো ফূর্তি কিসের তোদের!;

“আ্ আমি না! আমি না!; ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বলল ইশানি।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে