#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_______৩৩.
দুপুর ২টা। সাতসকালের পাখির কিচিরমিচিরের চেয়েও দিগুণ হারে চেঁচামেচি গোটা খান বাড়ি জুড়ে। আজ শ্রাবণ-ইশার বিয়ে। জনেজনে আত্মীয় স্বজন ঢুকছে খান বাড়িতে। গার্ডেনে বিশাল প্যান্ডেল করা হয়েছে বিয়ের। পাঁচ’শ জন মানুষ অনায়াসে বসতে পেরেছে। তবে পাঁচ’শ জন মানুষের একসাথে নিঃশ্বাস ফেলাটা বো*মা বি*স্ফো*র*ণের মতো শব্দধ্বনি তৈরি করছে।
খানিক্ষণ আগেই প্রায় দশজনকে রঙবেরঙের জুস দিয়ে গেছে আরব আর আশফি। এখন আবার ডাক পড়লো, নতুন করে। আরও বিশ জনকে দিতে বলা হয়েছে। আরব,আশফি, শ্রাবণের বন্ধুরা, আরবের বন্ধুরা, এমনকি আরাফও রয়েছে মেহমানদারিতে। এরা হলো বাড়ির এক একটা পিলার যেন। গোটা বিয়েটার যেকোনো কাজে, যেকোনো সময় এদের একদম হাতের কাছে পাওয়া গেছে। যেমন আরব! সবচেয়ে ঘোড়ার মতো দৌড়ঝাঁপ সেই বেশি করেছে। আজও এর ব্যতিক্রম নয় যেন। জুসের অর্ডার আসতেই এক ছুট্টে চলে গেলো বাড়ির ভেতর। মহিলা মহলের কাজ বাড়ির ভেতরে। মা-চাচিরা আজকের জন্য স্রেফ পাহারায় রয়েছেন।
“বড় মা, আরও জুস চাই। বিশজনের মোটামুটি। দিতে পারবে?;
“তুই একটু জিরিয়ে নে বাবা! আর কত খাটবি।;
চিন্তান্বিত হয়ে বললেন আফিয়া বেগম। বলতে বলতে আবার রান্না ঘরে উঁকি দিয়ে জুসের কথা বলে দিলেন। বড়মা অলওয়েজ বেস্ট। বলতেই হবে। তার সবদিকেই যেন নজর। আরব মুচকি হেসে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো বড় মায়ের দিকে। তা দেখে আফিয়া বেগম ভ্রু নাচালেন।
“ওমন করে কি দেখছিস?;
“আমার মাকে দেখছি।;
আফিয়া বেগম স্নেহের হাতজোড়া রাখলেন আরবের গালে। ফের বললেন,
“পাগল ছেলে আমার।;
“বড় মামি, একটু লেবুর শরবত হবে? তিতির আপুর শরীরটা ভালো লাগছেনা বলল।;
দ্রুত পায়ে মা-ছেলের মাঝে উপস্থিত হয় নামিরা। আরবকে প্রথমে খেয়াল করেনি। কথাটা বলতে বলতে পাশে চোখ পরে তার। ওমনি বীরপুরুষের পরিচয় দিয়ে চোখ টিপে দেয় আরব। নামিরা আঁতকে ওঠে মনেমনে। আফিয়া বেগম দেখে ফেললো কেমন বাজে হয়ে যাবে ব্যাপারটা। তবে আফিয়া বেগম দেখেননি। তিনি উদ্বিগ্ন হলেন তিতিরের নামটা শুনে।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি এক্ষনি দিচ্ছি।; বলেই রান্না ঘরে চলে গেলেন তিনি।
রাস্তা ক্লিয়ার হয়ে যেতেই আরব এসে দাঁড়ায় নামিরার সামনে। ঠোঁটের কোনে দুষ্টমিভরা হাসি। নামিরা চোখ তুলে তাকায় আরবের দিকে। আরব ফ্লায়িং কিস দিয়ে পূণরায় চোখ টিপে। এবার নামিরার চোখ জোড়া বড়বড় হয়ে যায়। চোখ পাকিয়ে তাকায় সে। আবর উল্টে মুখ টিপে হাসে। এরই মাঝে ফের এসে পরেন আফিয়া বেগম। হাতে লেবুর শরবত। নামিরা আরবকে পাশ কাটিয়ে আফিয়ার বেগমের কাছে গিয়ে লেবুর শরবতটা নিয়ে চলে যায়। নামিরা চলে যেতেই আফিয়া বেগম বলেন,
“মেয়েটা কি ভীষণ লক্ষি, তাই-নারে?;
“ভীষণণণ!; আরবের চোখ তখন নামিরার চলে যাওয়ার পানে স্থীর। ধ্যানও যে বিশেষ তার আমলে নেই, গলার স্বর শুনেই বেশ বোঝা গেলো।
আফিয়া বেগম আরবের পানেই চেয়েছিলেন। মূলত তিনি বাজিয়ে দেখছেন আরবকে। তাই হাসি চেপে পূণরায় বলেন,
“তা বিয়ের ডেইট টা কি ফাইনাল করবো বাবা?;
“হ্যাঁ… অ্যা?(আঁতকে উঠে) ক্ কার বিয়ে বড় মা?;
“কেন তোর আর নামিরার?;
দ্বিতীয়বারের মতো আঁতকে উঠলো আরব। থতমত খেয়ে কপাল, গাল, গলা ডলতে লাগলো। ধরা পরে গেছে তো সে! এবার কি হবে?
“কার বিয়ের কথা হচ্ছে ভাবি?;
পেছন থেকে ভেসে এলো নুপুর বেগমের গলা। আরব হকচকিয়ে গেলো মাকে দেখে। এবার তার আত্মা শুকাতে লাগলো ক্রমশ। আর যাই হোক, মায়ের কাছে এভাবে ধরা পরতে চায়না সে।
“জ্ জুস গুলো হয়ে গেলে আমাকে প্ প্লিজ ডেকে নিও বড় মা।;
বলেই পালাই পালাই করে পালালো আরব। আফয়িা বেগম শব্দ করে হেসে উঠলেন। নুপুর বেগম আহাম্মক হয়ে চেয়ে রইলেন দু’জনের দিকে। কিছু যে পূনরায় জিজ্ঞেস করবেন, তা ভুলে গেলেন আফিয়া বেগমের হাসির শব্দে।
_________
“এতো কড়া লিপস্টিক দিতে হবে?;
অসহায় গলায় শুধালো ইশা। তিতির চোখ পাকালো। হাতে ধরা লেবুর শরবতটা খেতে নিয়েও খেলোনা। ওকে চোখ পাকিয়ে বলল,
“ম্যান্ডেটরি। বাঙালি বিয়ের কনে, কড়া লিপস্টিক না হলে চলবে কি করে?;
হাল ছেড়ে দিলো ইশা। নাহ্, আজ এদের কবল থেকে কোনোমতেই ছাড় পাবেনা। লাল বেনারসির সাথে ভারী সাঝগহনা। সবই ঠিকঠাক ভাবে করলেও কড়া লিপস্টিকের বেলায় তার বড্ড অনীহা। তবে বুঝলোনা কেউই। পার্লারের মেয়েটা তিতিরের কথা মতোই কড়া লাল লিপস্টিক লাগিয়ে দিলো। অবশেষে কনের সাজ পরিপূর্ণ।
“দেখি দেখি, মাশা-আল্লাহ। ভীষণ সুন্দর লাগছে।;
গাল ফুলিয়ে তাকালো ইশা। তিতির ওর গাল টেনে বলল,
“একদম এভাবে তাকাবিনা। তাকিয়ে দেখ, কতটা মানিয়েছে।;
তিতিরের কথার অবাধ্য হলোনা ইশা। মুচকি হেসে সম্মুখে তাকালো বড় আয়নাটার দিকে। লাল টুকটুকে বউ একটা। দু’হাত ভরে আছে মেহেদির গাঢ় রঙে। তারউপর হাত ভর্তি লাল চুড়ি।
“শ্রাবণ ভাইয়া তো জিতেছে আপু।;
পাশ থেকে বলে উঠলো নামিরা। সঙ্গে সঙ্গে তিতির ধমক দিয়ে বলল,
“চুপ, ওটা আমার ভাই!;
বলতেই হাসির রোল পড়লো ওখানে। এদিকে ইশা লজ্জায় না পারছে হাসতে, না পারছে মুখ লুকাতে।
_______
গোল্ডেন কালারের শেরওয়ানিতে শ্রাবণের সুঠাম দেহখানা নজর কাড়লো সবারই। পাশে তার লাল টুকটুকে বউ। পাশাপাশি রাজকীয় চেয়ার দু’টোতে বসানো হলো দু’জনকে। বর-কনের থেকে কারোরই দৃষ্টি সরছে না যে।
“ভয় করছে?;
সবার সামনেই আলতো করে ইশার হাতটা নিজের হাতে তুলে নিলো শ্রাবণ। ইশা কাঁপছিলো। ভয়ে নাকি ভয়ানক অনুভূতিতে কে জানে? তবে আজকের মতো এমন মিশ্র অনুভূতি ওর গোটা জীবনে হয়নি। সব কিছু বড্ড অদ্ভুত লাগছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। লজ্জা লাগছে। আরও কতকি। ক্ষণে ক্ষণে ধড়ফড় করছে বুকের ভেতরটা। আর এই সব মিশ্র অনুভূতির খেলা তখনই বন্ধ হলো, যখন শ্রাবণ দায়িত্ব নিয়ে ওর হাতটা আলতো করে স্পর্শ করলো।
“জ্ জানিনা।;
“সত্যি করে বল!;
“এ্ একটু!;
“তাহলে বিয়েটা ক্যান্সেল করে দেই।;
আঁতকে উঠলো ইশা। শ্রাবণের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই বেশরমরে মতো চোখ টিপ দিলো সে। সাথে দম আঁটকে দেওয়ার মতো মধুর হাসি এঁটে দিলো ঠোঁটের কোনে।
“সবাই দেখছে!;
লজ্জায় মরিমরি করছে ইশা। কথাটা বলতে বলতে পূণরায় মাথাটা নীচু করে নিলো। শ্রাবণ মুচকি হাসলো। ফের সম্মুখে তাকালো। কাজী সাহেবকে নিয়ে এলেন সাদ্দাত সাহেব। এখন বিয়ে পড়ানো শুরু হবে। খান সাহেব কোথায়?
“দাদাজান কোথায়?; প্রশ্ন শ্রাবণের।
সাদ্দাত সাহেব বললেন,
“বাবা অপরাধবোধের জন্য আসতে পারছেন না এখানে।;
ভ্রু জুগল কুঁচকে গেলো শ্রাবণের।
“কিসের অপরাধবোধ?;
“খোরশেদ আঙ্কেলের নাতনীর কথা ভেবে বাবা খুব কষ্ট পাচ্ছেন। ভাবছেন, এক নাতনীর বিয়ে ভেঙে তিনি আরেক নাতনীর বিয়ে দিচ্ছেন।;
শ্রাবণ আর কিছু বলতে পারলোনা। তবে ভেতরে ভেতরে জমে রইলো অনেক কথা। গতকাল খোরশেদ সাহেবকে সে সবটা বুঝিয়ে এসেছে। এমনকি এও বলেছে, সে যেন তার বিয়ের সময় এখানে উপস্থিত থাকে। খোরশেদ সাহেব তাকে কথাও দিয়েছিলো। কিন্তু কোথায় তিনি? তাকে তো কোথায় দেখতে পাচ্ছেনা।
“কোথায়, খান কোথায়? এদিকে নাতির বিয়ে শুরু হয়ে গেছে, কোথায় গিয়ে লুকিয়ে আছে বেটা?;
খোরশেদ সাহেবের গলা সামনে থেকেই ভেসে উঠলো। চকিতে তাকালো বাড়ির লোক। এমনকি শ্রাবণও। মানতেই হবে, এক সেকেন্ডের জন্য হলেও শ্রাবণ ভেবেছিলো, খোরশেদ সাহেব আসবেন না। তার কথা রাখবেন না।
খান সাহেব এবং খোরশেদ সাহেবের ভুল বোঝাবুঝির অন্ত হলো। এবার যে বিয়েটা হওয়ার পালা। ছেলে-মেয়ের নামধাম লিখে শ্রাবণকে কবুল বলতে বললে শ্রাবণ বিনা দ্বিধায়, বিনা দ্বিমতে শান্ত স্বরে মৃদু হেসে জানিয়ে দেয় তিন কবুল। এবার ইশার পালা। ইশাকেও কবুল বলতে বলা হলে ইশার যেন গলা দিয়ে শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে না। সামান্য তিনটে শব্দ, তাতেও কত পরিশ্রম হচ্ছে। ইশার নিশ্চুপ আচরণ ভাবালো সবাইকে। তবে শ্রাবণ নির্বিকার। সে ইশার হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরলে ইশা তাকে দেখে। গোটা মানুষটাকে একটু একটু করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। না, এযে তারই শ্রাবণ। তার ভালোবাসার মানুষ। তার আপন মানুষ।
“আলহামদুলিল্লাহ্, কবুল, কবুল, কবুল।;
ইশার মুখ থেকে উচ্চারিত ধ্বনিমালা দীর্ঘ কোলাহল বাঁধিয়ে দেয় উপস্থিত মহলে। সবাই একই সাথে জাগর দিয়ে জানান দেয়, ” আলহামদুলিল্লাহ”
#চলবে
#ডাকপিয়নের_ছুটি _নেই ♥️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_____৩৪.
বাসর রাতে ঝগড়া! খানিক রসহ্য নয় কি? না না, কেবল খানিক রহস্য নয়, বিশাল রহস্য লুকিয়ে আছে এখানে। রাত আনুমানিক ২টা। এখনও বিয়ের সাজপোশাকে বসে আছে ইশা। গাল দুটো ফুলিয়ে, চোখের কোনে জল নিয়ে। কি হলো, কি হচ্ছে শ্রাবণের বুঝতে অনেকটা সময় লেগেছিলো বটে। তবে সে যখন ঘটনার মুল অনুমান করতে সক্ষম হয়েছে, তখন ইশার শ্রাবণের ঘর ছেড়ে নিজের ঘরে যাওয়ার পালা। অনেক কষ্টে তাকে আঁটকানো গেলেও, এখনও মানানো যায়নি। কান্না করে ঠোঁট ফুলিয়ে আপাতত ব্যালকনিতে অবস্থান করছে সে।
শ্রাবণও এখনোও চেঞ্জ করতে পারেনি। আরব আর নামিরাকে বলে ইশার জন্য খাবার আনিয়েছে। সবেই তারা দরজার ওপাশ থেকে এক প্লেট ভাত আর বিভিন্ন আইটেমের ভর্তা মাখানো দিয়ে গেলো। সবই ইশার পছন্দের। দেখা যাক এতে তার মনোহারিণীর রাগ কমে কিনা?
ব্যালকনির থাইয়ের উপর টোকা দিলো শ্রাবণ। ওপাশ থেকে ইশার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলোনা। শ্রাবণ আরেকবার টোকা দিতে নিয়েও দিলোনা। থাই খুলে ব্যালকনিতে পা রাখলো। মুহুর্তেই এক দমক ঠান্ডা বাতাস এসে বারি খেলো তার শরীরে। রাতের শহরে শীত নামের বস্তুটির আবির্ভাব ঘটেছে বেশ কিছুদিন পূর্বেই। তবে একে উপলব্ধি করতে হলে অবশ্যই রাতবিরেতে এরকম অভিমানে মন নিয়ে ঝিমোতে হবে ব্যালকনিতে।
“ইশা!;
ইশা অন্যমনস্ক, নিশ্চুপ ভঙ্গিতে পা তুলে, হাঁটু জড়িয়ে বসে আছে ছোট্ট মোড়াটায়। তার সামনে আরেকটি মোড়া, সাথে ছোট্ট একটা টি-টেবিল। শ্রাবণের হাতে ধরে রাখা প্লেটটা সে ছোট্ট টেবিলটাতে রাখলো। পরক্ষণেই একপলক তাকালো ইশার পানে। ইশা এখনও আগের মতোই বসে আছে। ওকে দেখে মনেই হচ্ছে না, বাস্তব জগতে তার কোনো অস্তিত্ব আছে কিনা। কেননা, সে ভাবনার জগতেই বিভোর।
“সারাদিনে এতো ধকল গেলো, তিতির বলছিলো, একদমই কিছু খেতে পারিসনি।;
বসতে বসতে কোমল গলায় কথা পাড়লো শ্রাবণ। ইশা এখনও নিশ্চুপ। মুখে রা’ কাটছে না একদম।
“এতক্ষণে তো অনেক ক্ষুধা লাগার কথা!;
নাক টানলো ইশা। এবারেও জবাব না পেয়ে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লো শ্রাবণ। ইশা যে কথাই বলছেনা। আর না কোনো প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। এভাবে হলে কিভাবে হবে? কিন্তু শ্রাবণ হাল ছাড়লোনা। ইশার চুপ থাকাটাকেই সে সম্মতি ধরে নিয়ে ইশার পাশাপাশি বসলো। প্লেটটা তুলে নিরব থেকে ভাত মাখালো। অতঃপর এক লোকমা তুলে ধরলো ইশার সামনে। ইশা মুখে কিছু না বললেও শ্রাবণকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করালোনা। চুপচাপ খেয়ে নিলো। ইশা যখন খাচ্ছিলো তখন মনে মনে নিজেকে শাবাশি দিলো শ্রাবণ। এটলিস্ট একটু হলেও ইশার মনের কথা সে বুঝতে পেরেছে।
“কম হয়ে গেলো, তাইনা?;
খালি প্লেটটা নির্দেশ করে শুধালো শ্রাবণ। ইশা জবাব দিলোনা। শ্রাবণ আর এই নিয়ে ঘাটলোনা ইশাকে। আসল টপিক তো এখনও পরেই আছে।
“ঐ চিঠিগুলো আমার নামে এলেও, আমি জানিনা কে পাঠিয়েছে। ইভেন কখনোও জানার চেষ্টাও করিনি। বিশ্বাস কর, কখনও পড়া তো দূর হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখিনি!;
‘চিঠি’ হ্যাঁ চিঠি নিয়েই এই মন কষাকষির সূত্রপাত। শ্রাবণের আলমারিতে শ্রাবণের নাম করেই বেশ ক’খানা চিঠি পেয়েছে ইশা। যা দেখেই হৃদয় ভাঙে ইশার। যে মানুষটা ছোট থেকেই ওকে ভালোবেসে এসেছে, আজ তার আলমারি জুড়ে এ কার বসবাস? কে এই রমনী? কে তার শ্রাবণকে এতো যত্ন করে চিঠি লিখে আলমারি ভর্তি করেছে। আজকেও একখানা চিঠি এসেছে। শ্রাবণের বিয়ের দিনটাও পার পেলোনা!
“আমাকে বিশ্বাস কর, আমি এসব বিষয়ে জানিনা কিছুই। মনোহারিণীর অশ্রুসিক্ত নয়ন আমাকে দ্বি-খণ্ডিত করছে ইশুপাখি! তীব্র ভাবে আঘাত করছে অন্তস্থলে!;
এটুকু বলে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লো শ্রাবণ। অভিমানের চূড়া বড্ড উঁচু ইশার। কিছুতেই গলছেনা।
“বউপাখি, আমাকে একটু বিশ্বাস করো;
‘বউপাখি’ ডাকটা ইশার অপরিচিত নয়। ছোট বেলায় অনেকবার, হাজারবার শুনেছে এই মানুষটার মুখে। তবে ‘তুমি’ বলে সম্মোধন, এক তীব্র অনুভূতি নাড়া দিয়ে উঠলো ভেতরে। সে পাশ ফিরে দেখলো শ্রাবণকে। তার আকুলতা মিশ্রিত নেত্রজুগল কোনোদিন মিথ্যে বলেনি। আজও বলছেনা। তবুও ইশার রাগ অভিমান কমলোনা এক ইঞ্চিও। অবশ্য এর পেছনেও যথাযথ কারণ রয়েছে।
“আমি কি একদমই ক্ষমার অযোগ্য?;
“কেন তুমি ঐ চিঠিগুলো কখনোও খুলে দেখোনি? কেন জানতে চাওনি এর পেছনে কে আছে? আছে কোনো যুক্তিযুক্ত জবাব?;
এতক্ষণে কথা ফুটলো ইশার মুখে। শ্রাবণ ভাবনায় পড়ে গেলো ইশার কথায়। রেগে হলেও যথাযথ কথাই বলেছে ইশা।
“জানিনা, তবে একজনকে সন্দেহ হয়েছিলো কয়েক বছর পূর্বে।;
“বাহ বেশ তো, তবে কেন তার খোঁজ নাওনি?;
“প্রয়োজন মনে করিনি। কারন আমি সর্বদাই আমার ইশুপাখিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছি। অন্যকেউ কে আমার জন্য ম/র/লো, বা কে আমার জন্য বাঁচল , আমার সত্যিই কোনো মাথা ব্যাথা ছিলোনা। আজও নেই, আগেও ছিলোনা।;
ইশা নিষ্পলক চেয়ে রইলো শ্রাবণের পানে। এমন নয় যে সে অবিশ্বাস করছে তার ভালোবাসার মানুষটিকে, কেননা ইশা চেয়েও কোনোদিন অবিশ্বাস করতে পারবেনা তাকে। সেই দুঃসাহসও নেই ওর। তবে এটাও সত্যি প্রায় শ’খানেক চিঠি দেখে ওর বুকটা কেঁপে উঠেছিলো অজানা ভ*য়ে। আজই ওদের জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচণা ঘটলো, আর আজই এমন এক বি*ষাদিত অনুভূতির স্বীকার হতে হলো? কেন আজই এসব ঘটতে হলো?
“কে সে? যে আমার একমাত্র ডাকপিয়নকে আমার থেকে কেঁড়ে নেওয়ার ফন্দি নিয়ে বসে আছে?;
“ওর নাম মায়া।;
ইশার বুকটা আরও একবার কেঁপে উঠলো। মায়া? এই মায়া আবার কে?;
“আমার সাথেই পড়তো। ফার্স্ট ইয়ার থেকেই আমার উপর ওর ভীষণ ক্রাশ ছিলো। বারবার প্রপোজ করা থেকে শুরু করে অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলো! তবে শুরু থেকেই ও জানতো তোমার কথা। কেবল ও নয়, আমার বন্ধুমহল থেকে শুরু করে এমন কেউ ছিলোনা যে তোমার কথা শোনেনি আমার মুখে। কিন্তু ঐ যে পাগলামি, সেটা কখনোই ছাড়তে পারলোনা! বড়লোক বাপের একমাত্র মেয়ে। চলাফেরা ছিলো অত্যাধুনিক। কিন্তু যেদিন থেকে বুঝতে পারলো আমি এসব পছন্দ করিনা কিংবা চিঠির সাথে আমার অদ্ভুত একটা টান রয়েছে সেদিন থেকেই মায়া একদম পাল্টে গেলো। ওয়েস্টার্ন ছেড়ে চলে এলো শাড়িতে। স্মার্টফোন ছেড়ে চলে এলো চিঠিতে।;
“এতোকিছু করেও তোমার মন পেলোনা কেন?;
“কারন আমার মনটা সর্বদাই এই মনটার সাথে জুড়ে ছিলো!;
বলতে বলতে ইশার গালে হাত রাখলো শ্রাবণ। ইশা মনোযোগী হয়ে শুনছিলো শ্রাবণের কথা গুলো। হঠাৎ শ্রাবণের গাঢ় ছোঁয়া পেয়ে শিউরে উঠলো। খানিক কাঁপলো। চোখ বুঁজে অনুভব করলো এই পবিত্র ছোঁয়া। এই মানুষটা ওকে ঠিক কতটা ভালোবাসে, সেটা কখনোও মুখে বলে বা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
“ভালোবাসি,খুব ভালোবাসি।;
“আমি ভয় পেয়ে গিয়ছিলাম।; (ফুঁপিয়ে উঠলো)
“কিসের ভয়?;
“মনে হচ্ছিলো আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলবো!;
বলতে দেরী হলেও কাঁদতে ইশার একদন্ড সময় লাগলোনা। কান্নায় ভেঙে পড়তে শ্রাবণ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ইশাকে। একদম বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। ফের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“মৃ//ত্যু ছাড়া আমাকে কেউ কোনোদিন তোমার থেকে আলাদা করতে পারবেনা, বউপাখি;
কপালে উষ্ণ ছোঁয়ায় কান্নার দমক কমলো ইশার। নাক টেনে টেনে, চোখ মুছে, বাচ্চা সুলভ গলায় বলল,
“আমার শীত করছে।;
“ভেতরে যাবে?;
“না।;
“এখানেই শুরু করবো?;
“কি?;
চোখ বড় বড় হয়ে গেলো ইশার। শ্রাবণ বাঁকা হাসলো। গাল ডলে খানিক ঝুঁকলো ইশার পানে। ফিসফিসিয়ে বলল,
“সোহাগ;
একবালতি লজ্জা যদি মাথার উপর হঠাৎ কেউ ঢেলে দেয়, তখন বুঝি এমনই অনুভূতি হয়। দম বন্ধ হয়ে এলো ইশার। শুকিয়ে এলো গলা। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো।
আজ কোনো বাহানা নেই ইশার কাছে। তাছাড়া ওর একটা শাস্তিও যে পাওনা ছিলো শ্রাবণের কাছে। সে কথাতো বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো সে।
“ঘ্ ঘুমাবে না?;
কেমন বোকার মতো প্রশ্ন! শ্রাবণ নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকালো ইশার পানে। কি বলবে ভেবে পেলোনা। তবে ছাড়ও দিলোনা।
“ঘুমাবো। এসো।;
“ক্ কোথায়?;
ইশার হাত টেনে ধরলো শ্রাবণ। ইশা খিঁচে বসে রইলো মোড়ার উপর। একদম শক্ত হয়ে। শ্রাবণ ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকস্মিক পাঁজা কোলে তুলে নিলো ইশাকে। ইশার এবার অজ্ঞান হয়ে রাতটা পার করে দিতে বড্ড ইচ্ছে জাগলো। ভয়ে ভেতরে ভেতরে ভীষণ কাঁপছে ও। এই অনুভূতিকে বকতে ইচ্ছে করছে। এ কেমন অনুভূতি, কেন এমন হচ্ছে?
সোজা বিছানায় এনে বসালো ইশাকে। ইশা হাঁপাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে এদিক সেদিক তাকালে শ্রাবণ সন্দিহান গলায় বলল,
“কোলে তুললাম আমি, হাঁপাচ্ছো তুমি। ব্যাপার কি?;
“ক্ ককিছুনা।;
ইশা অস্বাভাবিক আচরণ করছে। যেটা দেখে বড্ড হাসি পাচ্ছে শ্রাবণের। ঠিক একারণেই সে ইশাকে জ্বালাতে এতোটা ভালোবাসে।
শ্রাবণ এগিয়ে গেলো ইশার কাছে। হাত দু’টো ইশার পানে এগিয়ে দিলে ইশা মৃদু চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“দ্ দাঁড়াও, দাঁড়াও! আমার ভয় করছে!;
“কিসের ভয়? এগুলো তো নর্মাল। এখানে ভয় পাওয়ার কি আছে?;
ইশা সত্যিই ভীষণ ভয় পাচ্ছে। তবে শ্রাবণের মনেমনে যে অন্যকিছু।
“আমাকে একটু সময় দাও, প্লিজ। আমি নিজেকে প্রিপেয়ার করতে চাই।;
“কোনো সময় হবেনা। তোমার কি একটুও খারাপ লাগছেনা? আমার কিন্তু বিরক্ত লাগছে এবার। আর কতক্ষণ;
শ্রাবণের অস্থিরতা দেখে ইশা মনে মনে নিজেকেই বকছে। সত্যিই তো, শ্রাবণ তার অনুভূতি গুলোকে আর কতভাবে দমিয়ে রাখবে। তার না হয় ভয় হচ্ছে। কিন্তু শ্রাবণের বেলায় তো সম্পূর্ণ ভিন্ন।
“ঠ্ ঠিকাছে! আ্ আমি রেডি;
বলতে বলতে চোখ জোড়া বুঁজে নিলো ইশা। বক্ষঃস্থল ওঠানামা করছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে মৃদু আকারে। শ্রাবণ ওর এহেম প্রতিক্রিয়ায় বেশ মজা পাচ্ছে। ছোট্ট শব্দ আওড়ালো,
“হু।; বলেই ইশার মাথায় হাত দিলো।
চুলের ক্লিপ খুলছে ধৈর্য্য সহকারে। প্রায় অনেক্ষণ যাবত শ্রাবণের হাত জোড়া ইশার চুলের ক্লিপে এঁটে থাকলে একটু একটু করে চোখ মেলে তাকায় ইশা। শ্রাবণ ওর চুল খুলতে সাহায্য করছে। ইশা এক ধ্যানে চেয়ে থেকে কিছু বলবে তার পূর্বেই শ্রাবণ কোমল স্বরে বলে উঠলো,
“সবে সবে সূচণা ঘটলো আমাদের জীবনের এই নতুন অধ্যায়টির। হাতে অঢেল সময় রয়েছে। তুমি সেই অঢেল সময় থেকে যতটা খুশি সময় নিতে পারো। আমি অপেক্ষা করবো। প্রয়োজন পড়লে সারাজীবনের অপেক্ষা। কোনো তাড়া নেই।;
“মানে?;
“চুল গুলো ভীষণ জট পাকাতো। এখন আর জট পাকাবেনা। সাবধানে একটা একটা করে ক্লিপ খুলেছি। এবার শাড়িটা পাল্টে একটা কমফোর্ট ড্রেস পড়ে লম্বা একটা ঘুম দাও। আমি ততক্ষণে একটু কফি করে আনি।;
ইশার গলা ওখানেই আঁটকে গেলো। কোনো জবাব তৈরী হলোনা মনের ভেতরে। তবে অনেক কৃতজ্ঞতা বোধ জন্মালে মানুষটার প্রতি। সে তো আর এমনি এমনি বলেনা, সবচেয়ে আলাদা এই মানুষটা। সবচেয়ে।
#চলবে
#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব____৩৫.
আজ তানির এইচএসসি এক্সাম শুরু হয়েছে। শ্রাবণ-আর ইশার বিয়ের আনন্দের দিনগুলো কোনো মতে পার করে উঠতে উঠতে বেচারির কষ্টের দিন শুরু। দুই সপ্তাহ মোটামুটি ভাবে কাটিয়েছে। তবে আজ থেকে ওর হতাশার দিন শুরু হলো। তানি সর্বকালের অলস মেয়ে। তবে আজকের এই বিশেষ দিনে সে সবার আগে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসেছে ভালো মেয়ের মতো। নুপুর বেগম মেয়ের অবস্থা দেখে রীতিমতো আতংকে পরে গেছেন। ছুটে এসে তার কপালে মাথায় হাত ঠেকিয়ে বিস্মিত হয়ে শুধালেন,
“ওমা তোর শরীর ঠিকাছে তো?;
তানি জানে তার মা তাকে বিদ্রুপ করছে, তবে ইচ্ছাকৃত নয়। তাই আর পাত্তা দিলোনা। আনোয়ারা বেগম ওর পেছনে পায়েস নিয়ে ছোটাছুটি করেছেন কতক্ষণ, আজ সে এতোই সিরিয়াস যে মিষ্টির কোনো খাবারই মুখে তুলতে দেখা যায়নি। তিতির,ইশা,আরব এবং তুতুন বেজায় দুশ্চিন্তায় পরে গেলো এই বিষয়ে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এক্সামের চাপে মিষ্টি পাগলি মিষ্টি খেতে ভুলে গিয়েছে।
ইশার সেমিস্টার ফাইনাল শুরু হয়েছে দু’দিন আগে। ওদিকে আরবেরও মাস্টার্স ফাইনাল চলছে। সময়টাই যেন পরীক্ষা ময়। তাই আজ তানির প্রথম এক্সাম হলেও ভাই বোনরা কেউই তাকে সঙ্গ দিতে পারলোনা। বেচারি তানি এক বুক হাহাকার নিয়ে একাই ছুটলো এক্সাম দিতে। অবশ্য ইশা আর আরব কথা দিয়েছে, ওদের এক্সাম শেষ হলেই তানির হলের সামনে পৌঁছে যাবে। তারপর তিনজন মিলে মজা করতে করতে একসাথে ফিরবে।
“তুমি আরবের বোন না?;
রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে তানি। ওর বান্ধবী নিলার আসার কথা। কথা হয়েছে দু’জন একসাথেই যাবে এক্সাম দিতে। তবে নিলা না এলেও কিছু অবাঞ্ছিত অপ্রয়োজনীয় লোকের দেখা পেলো তানি। ওর সামনে হ্যাংলাপাতলা গড়নের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। নাম বাদশা। দেখলেই মনে হয়, এক পেগ মদ গিলে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক ওভাবেই ঢুলতে থাকে। আজও এর ব্যতিক্রম নয়। তানি বাদশাকে চেনে। গলির মোড়ে প্রায়শই দেখা যায় ছেলেটাকে। বাইকের উপর বসে সিগারেট খেতে খেতে বখাটেদের মতো আড্ডা দেয়, সঙ্গে মেয়েদের টিজ করতে ছাড়েনা।
“হ্যাঁ।;
তানি ছোট্ট করে জবাব দেয়। বাদশা অদ্ভুত চাহনিতে দেখতে থাকে তানিকে। তানির শামলা গায়ের রঙ। তবে মুখভর্তি মায়া। বাদশা চোখ বুলিয়ে বলে,
“তোমার মুখটায় অনেক মায়া। দেখতে ঠিক..;
“আপনার মায়ের মতো, তাইনা?;
তানির কথায় ভাবনারা জট পাকিয়ে গেলো বাদশার। থতমত খাওয়া গলায় বলল,
“অ্যা!;
হঠাৎ পেছন থেকে কারোর দম ফাটা হাসির শব্দ পাওয়া গেলো। হাসির উৎস বরাবর তানি এবং বাদশা দু’জনেই তাকালো। কিঞ্চিৎ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে একজন হ্যান্ডসাম ছেলে। মুখে মিষ্টি হাসি। চোখে মুখে দিগুণ বিদ্রুপতার ছাপ। তানির কথাটা বাদশা হজম করতে না পারলেও, সে ভীষণ মজা পেয়েছে।
“আরাফ, তুই এখানে?;
বাদশার মুখে আরাফের নামটা শুনে বির*ক্ত লাগলো তানির। ওর কাছে দু’জনের আলাদা কোনো বর্ণনা নেই। দু’জনকেই এক লাগে। দু’টোই বখাটে। মনেমনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তানি। আরাফ হেঁটে এসে দাঁড়ায় তানির বাহু ঘেঁষে। তানির চোখমুখ শক্ত হয়ে ওঠে অনাকাঙ্ক্ষিত ছোঁয়ায়। সে পেছন ফিরে তাকায় গরম চাহনিতে, কিন্তু আরাফের মুখের বা চোখের কোনো পরিবর্তন নেই। সে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।
“টিজ করার জন্য আজ বোধহয় পর্যাপ্ত রমনী মেলেনি, তাই না?;
ভদ্র ভাষায় অত্যন্ত অভদ্র একটি প্রশ্ন করলো আরাফ। তানির রাগ হচ্ছে এসব মুহুর্তের সাক্ষী হতে। সে চলে যেতে চাচ্ছে কিন্তু কোনো অদৃশ্য বাঁধা তাকে যেতে দিচ্ছেনা।
“মানে?; (দাঁতে দাঁত চেপে)
“মানে ফানে এক্সপ্লেইন করার সময় নেই। শ্রাবণ ভাইকে চিনিস তো?;
বাদশা মনেমনে বড্ড ক্ষেপছিলো আরাফের উপর। তবে শ্রাবণের নাম শুনতে ওর রুহু কেঁপে উঠলো। একবার শ্রাবণের হাতে পরেছিলো এই বখাটে। অবশ্যই কোনো মেয়েকে উত্ত্যক্ত করাকালীন। যা মা*রটা খেয়েছিলো সেদিন। আজও ভুলেনি।
“ক্ কেন! চিনলে চিনি না চিনলে নাই! তোর সমস্যা কি?;
“ও কে জানিস তো?; তানিকে ইশারা করে।
ভয় হলেও বুকে সাহস জমিয়ে রেখেছিলো বাদশা। কিন্তু আরাফের কথার ধরণে সে সাহস টুকু ধরে রাখতে পারছেনা। মনে হচ্ছে দুর্ভোগ জাতীয় কিছু আছে কপালে।
“তুই কি বলতে চাস ক্লিয়ার করে বল! এতো পেঁচাবি না।;
“ওকে, সো লেট মি টেল ইউ ব্রো, ও শ্রাবণ ভাইয়ের বোন। আরব, তানি, তিতির, তুতুন সবাই শ্রাবণ ভাইয়ের ভাই বোন। জানতিস না নিশ্চয়ই। কি বল, কত বড় উপকারটা করলাম তোর?;
বলে দাঁত কেলিয়ে ভ্রু নাচালো আরাফ। বাদশার মাথার উপর বড়সড় একটা বজ্রপাত ঘটে গেলো। সত্যি বলতে আরাফ ওর উপকারই করেছে। নয়তো আজ স্বয়ং যমরাজও ওকে উদ্ধার করতে পারতোনা ঐ যমদূত থেকে।
বাদশা পালালো। এক রকম দৌড়েই পালালো। ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে আরাফ। তানি একবার বাদশার দৌড়ের পানে আরেকবার আরাফের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“নিজের এটুকু ক্ষমতা ছিলোনা ওকে ভাগানোর? আমার ভাইয়ের নামটাই কেন নিতে হলো?;
“সেকি, তোমার জন্য এখন আমি এসব বখাটেদের সাথে মা/রা/মা/রি করবো নাকি?;
“দরকার হলে করবেন। আরেকজনের নাম ভাঙিয়ে কেন খাবেন?;
“ইওর সেফটি ফার্স্ট। আমি চাইলেই ওকে মে*রে ভাগাতে পারতাম। কিন্তু এরপরে এই মা*রে*র ক্ষোভ প্রকাশে ও একটা না একটা সিনক্রিয়েট ঠিকই করতো। তবে এখন ব্যাপারটা কেমন হলো? শ্রাবণ ভাইয়ের ভয়ে হলেও ও তোমার দিকে দ্বিতীয়বার চোখ তুলে দেখার দুঃসাহস করবেনা।;
এতো লম্বা বর্ণনার পর তানির আর কোনোরূপ জবাব দিতে ইচ্ছে করলোনা। সে চুপচাপ অন্যদিকে তাকিয়ে নিলার অপেক্ষা করতে লাগলো। আরাফ হাত ঘড়িতে দৃষ্টি বুলালো। সাড়ে নয়টা বাজে। ফের তানির পানে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“এক্সাম দিতে যাচ্ছো?;
“হু।;
“বাড়ির গাড়ি নিয়ে যেতে।;
“কেন?;
“আজকে প্রথম দিন। আর আজই এমন একটা সিনক্রিয়েট হলো। বাড়ির গাড়িতে রিলাক্সে চলে যেতে, হোপফুলি এমন কোনো প্রবলেম আসতোনা।;
“আপনাকে এতো ভাবতে হবেনা। আমি আমার ইচ্ছে মতো যাবো!;
“এজন্যই কারোর ভালো ভাবতে নেই। অসহ্যকর একটা মেয়ে;
“আপনি খুব সহ্যের পাত্র। হয়েছে?;
“তোমার জবাব অলওয়েজ জবাব ঠোঁটের আগায় জমে থাকে? ভাবার জন্যও তো মানুষ টাইম নেয়।;
“হ্যাঁ থাকে। আপনি এবার আসুন। আমি কষ্ট করে যা পড়েছি আপনার সাথে কথা বলতে যেয়ে সব ভুলে যাচ্ছি।;
আরাফ দমে গেলো। না, আজ সে মনেমনে ঠিক করেই এসেছে তানির সাথে কোনোরূপ ঝগড়া সে করবেনা। কিন্তু মনেমনে ঠিক করলেও কি, এই মেয়ের মুখ যে হারে ছুটে, বাঁচতে হলেও জবাব দেওয়া আবশ্যক হয়ে পরে।
“উহুম.. ওকে আই এম স্যরি। কখন যাবে? লেট হচ্ছে না।;
তানির মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখা গেলো। হাত ঘড়িতে নজর বুলালো। আজকে তো ফোনটাও সাথে আনেনি। নিলা কখন আসবে, কতদূর আছে কে জানে?
“কারোর জন্য অপেক্ষা করছো?;
“হ্যাঁ, আমার ফ্রেন্ড আসবে।;
“ছেলে না মেয়ে?;
ফট করে প্রশ্ন করে বসলো আরাফ। তানি স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিতে চাইলেও আরাফের আগ্রহতে কপালের ভাজ তীক্ষ্ণ করে তাকালো।
“সেটা দিয়ে আপনার কি কাজ?;
থতমত খেয়ে গেলো আরাফ। আমতাআমতা করে বলল,
“ন্ না মানে ছ্ ছেলে হলে তো এতক্ষণে এসে যাওয়ার কথা, মেয়ে বলেই বোধহয় লেইট হচ্ছে!;
“হাহা সো ফানি!;
আরাফের চালাকিটা তানি ধরতে না পারলেও ব্যঙ্গ করলো তার ভাবনাকে। অতঃপর নিজেই আবার বিরবির করে বলল,
“বেহুদা কথা হলেও একদম সত্যি কথাই বলেছে লোকটা।;
“কিছু বললে?;
“না।;
“তুমি চাইলে আমি তোমাকে লিফ্ট দিতে পারি।;
তানি মনেপ্রাণে চাইলো আরাফকে না করতে, তবে সময়ের চিন্তা করে আর না করলোনা। বলল,
“ঠিকাছে।;
আরাফ মনেমনে বেজায় খুশি হয়ে গেলো। তবে মুখে একদমই প্রকাশ পেলোনা।
__________
এক্সাম শেষ করে বের হলো নামিরা আর ইশা। ক্যান্টিনে যাবে বলে সেদিকেই রওনা হলো। তবে যেতে যেতে মাঝপথে দেখা হয়ে গেলো আরবের সাথে। আরবেরও এক্সাম শেষ হয়েছে। আবরকে পেতে ইশা প্রথমেই ব্যস্ততা দেখালো তানিকে আনতে যাওয়ার। আরব তাড়া খেয়ে বলল,
“আমি গেইটের বাইরে অপেক্ষা করছি, তুই আয়।;
বলে চলে গেলো আরব। ইশা আর নামিরা কিছু খাওয়ার জন্য চলে গেলো ক্যান্টিনে। কোনোরকমে দু’টো সিঙ্গারা খেয়ে তাড়াহুড়ো করে বের হলো তারাও।
শ্রাবণ আজ দু’দিন ধরে ঢাকায় নেই। চট্টগ্রামে গেছে। কাজের সূত্রে। ক্যাডারের পদেই নাম করা জব হয়েছে তার। সেই খাতিরেই এদিকে সেদিকে ছোটাছুটি। আজ ফেরার কথা ছিলো। তবে গেটের বাইরে শ্রাবণের গাড়িটা দেখতে মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা ইশা। হ্যাঁ, শ্রাবণ ফিরেছে। আর ফিরতেই সোজা তার কাছে চলে এসেছে। তবে, এখানেও একটা কিন্তুর আবির্ভাব ঘটলো। কালো ব্লেজার পরিহিত তার শ্রাবণ গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে কথা বলছে একটা মেয়ের সাথে। সাথে অবশ্য আরেকটা ছেলেও আছে। দেখে মনে হচ্ছে সমবয়সী তারা। ইশার চোখে আলাদা কিছু না পরলেও মেয়েটার মায়ামিশ্রিত মুখ খানা সুচের মতো ফুটলো। কে এই মেয়ে? মায়া নয়তো?;
“ইশু, জলদি আয়।;
আরবের ডাকে ইশার ঘোর কাটে। ইশা সম্ভ্রম ফিরে পেয়ে এগিয়ে যায় ওদের দিকে। ইশার নাম কানে বাজতে শ্রাবণ আর ঐ মেয়েটা একসাথেই ফিরে তাকায়। শ্রাবণের চোখে পরিশুদ্ধ ভালোবাসা আর মেয়েটার চোখে অদ্ভুত অসহায়ত্বতা। ইশা ধীরপায়ে এগিয়ে যায় ওদের দিকে। তাদের সাথে থাকা দ্বিতীয় ছেলেটি সবার আগে উৎসুক হয়ে শুধালো,
“ভাবি নাকি?;
“হ্যাঁ। আমার বউপাখি।;
ইশার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তখনও মেয়েটার প্রতিই। শ্রাবণের মুখে ‘বউপাখি’ সম্মোধনে মেয়েটার যেন বুকে ব্যাথা হলো। হঠাৎ হোঁচট খেলে মানুষ যেমন পড়ে যেতে নেয়, মেয়েটাও যেন পরে যেতে চাইলো। তবে নিতান্তই নিজের মাঝে, নিজের মনে।
ইশা কাছে আসতে আসত শ্রাবণ এগিয়ে এসে ওকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে। একদম বেপরোয়া ভাবে। যেন কাউকে দেখাতেই এমনটা করলো।
“মিসড ইউ সো মাচ!;
ইশার দু’গালে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল শ্রাবণ। ইশা মুচকি হাসলো। শ্রাবণ ওর কাঁধ জড়িয়ে নিয়ে দাঁড়ালো ছেলেটা আর মেয়েটার সামনে। পরিচয় করাতে বলল,
“ও হলো তন্ময়। আমার স্কুল, কলেজ এবং ভার্সিটি সবসয়মের ক্রাইম পার্টনার। অনার্স শেষ করে পগারপার হয়ে যায় লন্ডনে। আজই দেশে ফিরেছে।;
ইশা মৃদু হেসে সালাম দিলো। তন্ময় সালামের উত্তর দিয়ে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বলল,
“কেমন আছেন ভাবি?;
” ভালো ভাইয়া। আপনি ভালো আছেন?;
“২০ বছরের দুঃস্বপ্নকে আজ বাস্তবে রূপ পেতে দেখে কি করে ভালো না থেকে পারি বলেন তো!;
ইশা বুঝতে পারে তন্ময় ওকে কোন দুঃস্বপ্নের কথা বলেছে। তাই মুচকি হেসে মাথা দুলায়। শ্রাবণও হাসে মুচকি মুচকি। ফের মেয়েটার দিকে ইশারা করে স্বাভাবিক গলাতেই বলে,
“ও মায়া। আমার ভার্সিটি ফ্রেন্ড।;
বুকের ভেতরটা কেমন করে কেঁপে উঠলো ইশার। সমস্ত সুখ, সমস্ত আনন্দ এক মুহুর্তেই বিষাদময় হয়ে উঠলো। তবুও স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলল,
“হাই মায়া আপু। কেমন আছেন?;
মায়ার মুখখানা সত্যিই বড্ড মায়াবী৷ ইশা মলিন হাসে। মায়া জবাবে বলে,
“ভালো আছি। আমি কিন্তু তোমাকে ভাবি ডাকতে পারবোনা। ইশাই ডাকবো।;
সুমধুর কন্ঠ মায়ার। তবে তার প্রতিটি কথার ছন্দমালা ইশার হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দিচ্ছে কোনো অজানা ভয়ে। ইশার মলিন হাসিও বিলুপ্ত হলো। পাশ থেকে শ্রাবণ তার হয়ে জবাব দিলো,
“তোর যা খুশি ডাকতে পারিস।;
“সতীনও ডাকতে পারি, কি বলিস?;
ঠাট্টা করলো বুঝি মেয়েটা। সবার হাসি হাসি মুখ গুলো নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো। সবচেয়ে বেশি ভয় পেলো ইশা। এ কেমন মজা?
“আরে সবাই দেখি সিরিয়াস হয়ে গেলি! মজা করছিলাম।;
সবাই আর চেয়েও স্বাভাবিক হলোনা। তন্ময় পরিস্থিতি সামলাতো বলল,
“খুবই অদ্ভুত মজা।;
মায়া সশব্দে হাসতে লাগলো তন্ময়ের কথায়। যদিও এখানে হাসির মতো বিশেষ কিছুই ঘটেনি।
________
দুপুর দুইটা। এক্সাম শেষ করে বের হয়ে তানি সবার প্রথমেই খুঁজতে লাগলো তার বাড়ির লোককে। তবে বিশেষ কাউকেই নজরে পড়লোনা একজনকে বাদে। আর সে হলো আরাফ। আরাফকে দেখতেই তানি চলে যায় তার কাছে। উদগ্রীব গলায় জিজ্ঞেস করে,
“আপনি এখনও যাননি?;
তানিকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে আরাফ। তানির প্রশ্নের জবাব না দিয়েই বলে,
“ও গড। জানো কতটা ভ*য় পেয়ে গিয়েছিলাম।;
তানি ভ্রু কুঁচকায়,
“কেন?;
“কেন আবার! সেই কখন এক্সাম শেষ হলো। সবাই চলেও যাচ্ছে। একা তোমারই পাত্তা নেই।;
“অপেক্ষা করছিলেন বুঝি?;
“হ্যাঁ তা নয় তো…;
বলতে যেয়েও থেমে গেলো আরাফ। চোরা নজরে তাকালো তানির পানে। আমতাআমতা করে কথা ঘুরিয়ে বলল,
“ন্ না মানে, এখান থেকেই ফিরছিলাম তো, তাই ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই। এক্সাম কেমন হলো জানার জন্য!;
তানি জানে আরাফ ঢব মা*র*ছে। তবে ধরা দিলোনা তাকে। হঠাৎ কেউ পেছন থেকে ডেকে ওঠে আরাফকে,
“পেয়েছো তোমার বউকে?;
মধ্যবয়স্ক এক লোক। আরাফকে ডেকে এহেম কথা বলতেই তানির চোখ চড়কগাছ। আরাফ যেন আকাশ ভেঙে নীচে পড়লো। দু’জনের চোখই ডিম্বাকৃতির আকার নিলো। দু’জন দু’জনের দিকে তাকাতেই লোকটা ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সামনেই আরাফের বয়সের একটা ছেলের সাথে কথা বলে। তাতে ওদের আর বুঝতে অসুবিধা হয়না লোকটা আরাফকে নয়, ঐ ছেলেটাকে বলেছে কথাটা। পরক্ষণেই দু’জনে শব্দ করে হেসে ওঠে। আরেকটু হলেই যে তানি আরাফের মাথা ফাটাতো।
#চলবে