ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-১৪+১৫+১৬

0
568

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই ♥️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_____১৪

মেঘাচ্ছন্ন আকাশে হঠাৎই বজ্রপাতের আহাজারি শুরু হলো। গুড়ুম গুড়ুম শব্দে মেঘের প্রতিটি খন্ড দিগুণারে খন্ডিত হচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ বিকট শব্দ। আঁতকে উঠে শ্রাবণের শার্টের হাতা খামচে ধরলো ইশা। শ্রাবণ পাশ ফিরে বাইরে তাকালো। ঝড় হাওয়া শুরু হয়েছে। আকাশ পাতাল এক করে তীব্র বাতাসে লেগুনা চালক গাড়ি থামিয়ে দিলো। যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলল,

“বইন্যা শুরু হইছে! গাড়ি দশ মিনিট পর চালাইতে হইবো।;

একটা দোকানের সামন গাড়ি থামালো লেগুনা চালক। এক এক করে সবাই গাড়ি থেকে নেমে গেলো। ইশা তখনও স্থবির হয়ে বসে আছে। দু’হাতে শ্রাবণের শার্ট খামচে ধরা। শ্রাবণ ইশার মতিগতি পর্যবেক্ষণ করলো। ভয় পেয়ে আছে ইশা। যা বুঝে শ্রাবণ ইশার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

“এখানে বসে থাকা রিস্কি। বাইরে চল। দেখি, কোথাও থাকার ব্যবস্থা করা যায় কিনা।;

ইশা ভ/য় জড়ানো গলায় বলল,

“আমরা যদি বন্যার কবলে পড়ে ম/রে যাই শ্রাবণ ভাই?;

“ম/র/ন এলে ম/র/বো। অসুবিধা তো নেই!;

“আমি এতো করুণ ভাবে ম/র/তে চাইনা!;(কাঁদো কাঁদো গলায়) যেখানে ম/রা/র সময় একটু টক বা ঝালও খেতে পারবোনা!;

শ্রাবণ বোকা চোখে তাকিয়ে রইলো ইশার পানে। তেমন গলাতেই প্রশ্ন করলো,

“এই ম/রা/র সময় টক আর ঝাল খেয়ে কে ম/রে?;

“ওমা, এখন আমি ম/রে যাচ্ছি, তো ম/রা/র আগে একটু আমার পছন্দ খাবার খেতে চাইবোনা?;

“কোন দেশের পাগলরে তুই?;

শ্রাবণ অতিষ্ঠ কন্ঠে শুধালো ইশাকে। ইশা দাঁত বের করে হাসলো। শ্রাবণ দিলো এক রামধমক। ইশা পূণরায় জড়োসড়ো হয়ে গেলো। তবে এবার বজ্রপাতের শব্দে নয়, বরং শ্রাবণের ধমকে।

মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। আশেপাশের প্যাসেঞ্জাররা সবাই যে যেখানে পারলো দাঁড়িয়ে গেল। শ্রাবণ ইশাকে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালো একটা ভাঙা বাড়ির সামনে। উপরে ছাউনি থাকায় বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা। তবুও দৌড়ে আসতে আসতে অর্ধেক ভিজতে হলো দু’জনকেই। ইশার শাড়ির অবস্থাটা বেশি নাজেহাল হলো। সামান্য জলে যেখানে শাড়ির এপিঠ ওপিঠ স্পষ্ট হয়ে আসে, সেখানে এতোখানি জলে বাদ রাখেনি কিছুই।

“আরব ভাইদের সাথে চলে গেলেই ভালো হতো!;

“সব সময় সব ভালো করতে নেই। দাদাজানকে চিনিস না তুই?;

“আমিও একই কথা বললাম আরব ভাইকে।;

“দাদাজানকে এতো কৈফিয়ত কে দিবে?;

“তুমি।;

“পারবোনা। চুপচাপ দাঁড়া।;

ইশা আর কথা বাড়ালোনা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। ক্যালেন্ডারে অক্টোবর পড়েছে। অক্টোবরে না গরম না ঠান্ডা’ মৌসুম হওয়ার কথা। সেখানে রোজকারের এই বৃষ্টি বন্যায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে শ্রাবণ। বৃষ্টি তার ভালো লাগেনা। সামান্য বৃষ্টিতেই কাদা পানিতে গা গোলায়। বরং ফকফকা রোদ্দুর বরাবর পছন্দ তার। তার সাথে মৃদুমন্দ বাতাস। কিন্তু ইশা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। বৃষ্টির মৌসুম ইশার সবচেয়ে পছন্দ মাস। কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানো, ছাদে উঠে বৃষ্টিতে ভেজা, খিচুড়ি খাওয়া এ যেন রোজকারের অভ্যাস। খীচুড়ির কথা মনে পড়তেই পেটে ডাক দিলো যেন ওর। মাঝরাতে ক্ষিধে পাওয়াটা আজকাল খুবই কমন একটা রোগ ওর।

ইশাকে পেট চেপে ধরে কাচুমাচু করতে দেখে শ্রাবণ এক পলক তাকালো ওর মুখের দিকে। মুখটা শুঁকনো লাগছে। হয়তো ক্ষিদের জ্বালায়।

“কি হয়েছে, পেট চেপে ধরোছিস কেন?;

ইশা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ইচ্ছে করলোনা জবাব দিতে। তবুও না দিয়েও উপায় কি?

“এমনিই।;

“ক্ষিদে পেয়েছে?;

ক্ষিদের সময় ক্ষিদের কথা জিজ্ঞেস করাটাও ক্ষিদে বাড়ানোর তারিকা যেন। পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো ইশার। অতিকষ্টে পূণরায় বলল,

“হ্যাঁ, খুব।;

শ্রাবণের কপালে চিন্তার ভাজ দেখা গেলো। সে কপাল কুঁচকে আশেপাশে নজর ঘুরালো। বিশেষ কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে আশেপাশে। আশেপাশে দেখতে দেখতেই পূণরায় শ্রাবণ বলে উঠলো,

“তানির থেকে দুটো সমুচা খেলিনা কেন?;

এই প্রশ্নতো ইশার নিজেরও। কেন খেলোনা?

“ওর খুব ক্ষিদে পেয়েছিলো তো। আমি সেখান থেকে কিভাবে খেতাম?;

“ওর ক্ষিদে পেয়েছে বলে ও একাই খাবে, বাকিরা সব হা করে থাকবে? ওখানে মোট ৮টা সমুচা ছিলো। তুই দুটো খেলে কম পড়তো না ওর।;

ইশা আর কথা খুঁজে পেলোনা। আবারও নিরবতা বিরাজ করলো চারপাশে। বৃষ্টি থামার যেন নামই নিচ্ছেনা। বাতাসের তোড়ে বৃষ্টির ঝাপটা এসে বারবার ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ওদের। শ্রাবণ ইশার হাত ধরে কাছে এনে দাঁড় করিয়ে দিলো। যেন বজ্রপাতের শব্দে পূণরায় ভ*য় না পায়।

হঠাৎ পেছন থেকে যেন দরজা খোলার শব্দ পেলো ওরা দু’জনে। দু’জনেই একসাথে পেছন মুড়ে তাকালো। এক বৃদ্ধ হারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার উপর বহুকাল পুরোনো একটা ছাতা। ইশা আর শ্রাবণকে এক পলক দেখে ধীর গলায় বলে উঠলো,

“বৃষ্টিতে আঁটকা পড়েছো বাবা?;

শ্রাবণ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। দূরে দেখিয়ে বলে,

“ওখানেই নেমেছি। তবে, দাঁড়ানোর জায়গা ছিলোনা বলে..;

“আমার বাসা খালিই আছে। তোমরা চাইলে আমার বাসায় উঠতে পারো।;

শ্রাবণ লোকটাকে ডিঙিয়ে পেছনের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। ঘরের বাইরেটা টুকিটাকি ভাঙাচোরা হলেও ভেতরটা এতোটাও খারাপ লাগছেনা। দেখে ঠিকঠাকই মনে হচ্ছে।

“ওভাবে দেখছো কি? ভাঙাচোরা ঘর?;

“না না! এমন কিছু নয়। এতো রাতে আপনাকে শুধু শুধু কষ্ট দেওয়ার কোনো মানেই হয়না। তাই ভাবছিলাম..;

“ওতো ভাবাভাবি রাখো দেখি। আমি প্রতিদিন রাতে একবার করে বের হই। ভাবি আমার ছেলে আর বউমা বুঝি এলো। দেখো আজ সত্যি সত্যি আল্লাহ আমার ছেলে আর বউমার মতোই কাউকে পাঠিয়ে দিলো। এসো এসো, ভেতরে এসো।;

শ্রাবণ আর বাঁধ সাধলো না। ইশাকে নিয়ে বৃদ্ধর পেছন পেছন চলে গেলো। ঘরে ঢুকতেই বৃদ্ধ হইহই করে গলা ছাড়লো,

“ও বুড়ি, বুড়ি? দেখো কারা এসেছে?;

ভেতরে থেকে রাগ পায়ে হেঁটে এলো এক বৃদ্ধা। লাল পাড়ের সাদা কাপড় পড়নে। এ যেন কোনো শুভ্রপরী। ইশার চোখ আঁটকে গেলো বৃদ্ধার প্রশংসনীয় রূপে। চোখ আটকালো শ্রাবণেরও। এ যেন ইশাই। ইশা বুঝি বৃদ্ধকালে এমনই হবে দেখতে?

“কে এলো গো? খোকা এলো? বউমাও এলো বুঝি?;

“দেখোনা কে এলো।;

বৃদ্ধর মুখে তৃপ্তির হাসি। বৃদ্ধার মুখে দিগুণ উৎসাহ। তবে সেই উৎসাহ ঘেরা মুখটায় নিমিষেই পর্দা পড়লো ইশা আর শ্রাবণকে দেখে। মুষড়ে পড়লো নয়ন জোড়া। বৃদ্ধর উদ্দেশ্যে আহত স্বরে শুধালো,

“এরা কারা?;

“বৃষ্টিতে আঁটকে পড়েছে। বাড়ির বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলো।;

বৃদ্ধার মুখে পূণরায় হাসি ফুটলো। ইশা আর শ্রাবণের পানে এগিয়ে এসে বলল,

“সে ভালো করেছো। আহারে, একদম ভিজে গেছো দেখছি। জামাকাপড় ছাড়বে মা?;

কি মোহাচ্ছন্ন ব্যবহার তাদের। মোহিত হয়ে গেলো ইশা। স্মিত হেসে বলল,

“আপনি ভীষণ সুন্দর। একদম উপন্যাসের মতো।;

বৃদ্ধা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। পরক্ষণেই আবার ফ্যাকাসে রঙ ধারণ করলো তার মুখ। চোখ টলমল করতে লাগলো। ইশা ভড়কে গেলো এমন অবস্থায়। ইশা শ্রাবণের পানে তাকালো ভয়ার্ত চোখে। তাকালো শ্রাবণও। ইশা এগিয়ে এসে বৃদ্ধার হাত ধরলো। অপরাধী গলায় বলল,

“আপনি কি আমার কথায় কষ্ট পেয়েছেন? আমি সরি। আসলে আমি এতো ভেবে..;

“না মা। ও কষ্ট পায়নি। আসলে ওর সমস্যাটা হলো অল্পতেই বড্ড চোখের জল ছাড়ে। সেই বাচ্চাকালের স্বভাব। এখনও রয়ে গেছে।;

ইশা একটু স্বস্তি পেলো যেন। বৃদ্ধার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,

“কাঁদবেন না প্লিজ, আপনাকে কাঁদলে কিন্তু মোটেও ভালো লাগেনা।;

বৃদ্ধা হেসে উঠলো খিলখিলিয়ে। যেন কোনো বাচ্চাকে মজার কাহিনী শুনিয়েছে কেউ। হাসলো ইশাও।

বৃদ্ধ পূণরায় বলল,

“ছেলে-মেয়ে দুটোকে এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখবে? বসতে দাও। আমি ওদের জন্য তোয়ালে আনছি।;

বলেই চলে গেলেন বৃদ্ধ। বৃদ্ধা ইশা আর শ্রাবণকে বসতে দিলো। বুড়ো কি করছে দেখে আসি বলে, সেও চলে গেলেন ভেতরে। বৃদ্ধাও প্রস্থান করলে বড়ো কৌতুহল নিয়ে ঘুরে বসলো ইশা। শ্রাবণের পানে তাকিয়ে বলল,

“উনাদের একটু অদ্ভুত লাগছেনা তোমার কাছে?;

শ্রাবণের কৌতুহলও কিছু কম নয় যেন। সেও একই কৌতুহলে জবাব দিলো,

“অদ্ভুত তো লাগছেই।;

“আমাদের এখানে আসাটা একদম উচিৎ হয়নি বলো?;

“অনুচিতও হয়নি। তুই যেমনটা ভাবছিস, ওরকম কিছু না। আজকাল বৃদ্ধ বাবা-মাকে একা করে কত সন্তান শুধু বউকে নিয়ে দেশান্তর হচ্ছে জানিস? এরাও তেমনই এক অসহায় বাবা-মা। যাদের সন্তান উনাদের একলা ফেলে চলে গেছে।;

ইশার মনটা বিষাদে ঘিরে ধরলো হঠাৎ। মানুষ কত নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। কত পা/ষা/ণ!

“আহারে! এমন মানুষও হয়?;

“হয়।;

বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা তোয়ালে আর কিছু শুঁকনো খাবার নিয়ে হাজির হলো। খাবার পেয়ে যেন চাঁদ হাতে পাওয়ার আনন্দ হলো ইশার।

“তোমরা চাইলে আজকের রাতটা এখানে কাটাতে পারো বাবা। যে হারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, তাতে আমার মনে হয়না এই বৃষ্টি সহজে থামবে বলে।;

“গোটা রাতটা থাকা তো সম্ভব নয়। বাড়ির লোক চিন্তা করবে।;

বলল শ্রাবণ। যার জবাবে এবার বৃদ্ধা বলল,

“চিন্তা করাটা তো স্বাভাবিকই বাবা। কিন্তু তুমি যদি একবার টেলিফোন করে দাও, তাহলে তো আর চিন্তা করবেনা।;

“এদিকে নেটওয়ার্ক একদম ডাউন। এক লাঠিও নেটওয়ার্ক তোলা যাচ্ছে না।;

বির*ক্তির সুরে বলল শ্রাবণ। বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। জবাবে আর কিছু বলতে পারলোনা।

“তোমরা একটু বিশ্রাম নাও বাবা। তারপর বৃষ্টি কমলে না হয়..;

“ঠিকাছে।;

বৃদ্ধা এবং বৃদ্ধ পূণরায় মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। শ্রাবণ হয়তো তাদের মনের ভাবটা ধরতে পেরেছে। তারা চায়না আজ রাতেই শ্রাবণ আর ইশা তাদের এখান থেকে চলে যাক।

______

বন্ধ ঘরটায় হারিকেনের আলো নিভু নিভু করে জ্বলছে। ইশা লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো শক্ত বিছানায়। মাথার নীচেও একটা শক্ত বালিশ। কতক্ষণ এপাশ ওপাশ করে সামনে তাকালো। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো শ্রাবণ। শ্রাবণ ভেতরে ঢুকতেই চোখে চোখ পড়লো দু’জনের। ইশা ভীত মনে চোখ সরিয়ে নিলো। বাইরে এখনও মুষলধারে বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে। শ্রাবণ নেটওয়ার্ক তোলার চিন্তায় তিক্ত হয়ে উঠেছে এবার। কে জানে, বাড়ির সবাই কতটা চিন্তা করছে তাদের।

শ্রাবণ ধীরপায়ে হেঁটে এসে বসলো বিছানার একপাশে। ইশা আঁড়চোখে দেখছে গম্ভীর মানুষটাকে। হারিকেনের হলদে আলোতে অন্যরকম লাগছে শ্রাবণকে। শীতল পরিবেশে শ্রাবণের এমন বিমোহিত রূপ উষ্ণতা ছড়াচ্ছে রমনীর হৃদয়ে। বুক কাঁপছে দুরুদুরু। যেটাকে কোনো ভাবেই পাত্তা দিতে চাইলোনা ইশা। তাই পাশ ফিরে শ্রাবণের থেকে মুখ ফিরিয়ে শুলো। শ্রাবণ গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে ইশার পানে তাকালো কিছু বলবার উদ্দেশ্যে। তবে তাকে থমকাতে হলো। থমকাতে হলো ইশার ভেজা পিঠে লেপ্টে থাকা চুলগুলো দেখে। থমকাতে হলো ইশার ফর্সা ঘাড়ে কালো তিলটা দেখে।

শ্রাবণের কি হলো জানেনা সে। শুঁকনো গলায় ঢোক গিলে উঠে গেলো ওখান থেকে। এখানে বসবে না সে।ইশা আর শুয়ে থাকতে পারলোনা। উঠে বসলো। এতো শক্ত বালিশে মাথা রাখার অভ্যাস নেই একদম। ইশাকে উঠে বসতে দেখে শ্রাবণ গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“কি হয়েছে? উঠে বসলি কেন?;

“ভালো লাগছেনা।;

“বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার হয়েছিস। চেঞ্জ করলেই পারতিস।;

“তুমিই তো যাওয়ার তাড়ায় আছো। তাই আর কষ্ট করে চেঞ্জ করিনি। এখন ঠান্ডা লাগছে।;

” জ্বর আসেনি তো?;

ব্যস্ত গলায় কথাটা বলেই এগিয়ে আসলো শ্রাবণ। তার বরফ শীতল হাতটা ইশার কপালে ঠেকাতেই শিউরে উঠলো ইশা। ইশার গা বেশ গরম। বুঝতে পারলো সে। কপালের হাত গালে ঠেকিয়ে অতঃপর গলায় ঠেকিয়ে বলল,

“গা তো গরম।;

ইশার বুক কাঁপল। কেমন অস্থির লাগছে ওর। হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে উঠলো ধরনী। মাথার উপরেই যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। ভয়ে আতংকে বিটক চিৎকার করেই শ্রাবণকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ইশা। শ্রাবণ হতভম্ব হয়ে গেলো এমন ঘটনায়। ইশা কাঁপছে যেন। শ্রাবণ পূণরায় ঢোক গিললো। এবার যেন ইশার শরীরের উষ্ণ ভাব জ্বা*লিয়ে দিলো তার ভেতরে। নিঃশ্বাস ভারি হতে লাগলো ক্রমশই। বুক ধড়ফড় করতে লাগলো ঠিক ইশার ন্যায়।

“ভ*য় পেলি?;

শীতল গলায় প্রশ্ন করলো শ্রাবণ। শ্রাবণের ঘনঘন দম নেওয়া ইশা টের পেলো। তার গরম নিঃশ্বাস ক্রমশ আঁচড়ে পড়ছে ইশার মুখের উপর। শ্রাবণ হাত তুলে আরেকটু জড়িয়ে নিলো ইশাকে। নিজের সাথে আরেকটু শক্ত করে রাখতে ইচ্ছে করলো যেন। এই ভালোলাগার কোনো নাম নেই। কোনো ব্যাখ্যা নেই।

“আমার ভ*য় করছে শ্রাবণ ভাই!;

“তুই তো সত্যি বড্ড পাগল! আমি থাকতেও তোর এতো ভ*য়?;

ইশার বড্ড বলতে ইচ্ছে করলো, ” তুমি থাকলে যে আরও ভ*য়, তোমাকে হারানোর ভ*য়।;

#চলবে

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব______১৫

“সোজা হ, এখন আর বজ্রপাত হচ্ছে না।;

প্রশান্তির দফারফা করে লজ্জারা ঢাকঢোল পেটাতে লাগলো ইশার মনে। শ্রাবণের এই ধরনের কথা সে মোটেও আশা করেনি, সেটাও এই মুহুর্তে। ইশা শ্রাবণকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কাচুমাচু করতে করতে পিছিয়ে যেতেই মনে হলো তাকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে এলো কেউ। সোজা এসে শ্রাবণের বুকে। শ্রাবণ চকিতে তাকালো ইশার পানে। ইশা অসহায় নেত্রে শ্রাবণের পানে তাকালো। অসহায় গলায় মাথায় হাত চেপে বলল,

“আমার চুল!;

শ্রাবণ ইশার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো। ইশা এক হাতে নিজের মাথা চেপে ধরেছে, আর অন্যহাতে শ্রাবনের বুক। ইশার চুল আঁটকে পরেছে শ্রাবণের পাঞ্জাবির বোতামে।

“আহ্ এতো নড়ছিস কেন?;

ধমকের সহিত বলল শ্রাবণ। ধমক খেয়ে স্থীর হয়ে গেলো ইশা। মনেমনে দু-চারটে গাল পেড়ে বলল, এখানে সমস্যাটা ওর হয়েছে, আর ওকেই কিনা ধমক খেতে হচ্ছে।

“আমি ছাড়িয়ে দিচ্ছি, চুপ করে দাঁড়া।;

“ব্যাথা হলে বলবোনা?;

“চুপ থাকবি। হজম করবি।;

কপাল কুঁচকে তাকালো ইশা। এ কথার কোনো আগামাথা নেই যেন। শ্রাবণ ওর পাঞ্জাবির বোতাম থেকে একটা একটা করে চুল ছাড়িয়ে দিতে লাগলো ইশার। ইশা কতক্ষণ কপাল কুঁচকে থেকে পাত্তা না পেয়ে মুখ উঁচিয়ে তাকালো শ্রাবণের পানে। গৌরবর্ণ মুখে কালো ঘণ দাঁড়িতে শ্রাবণের রূপ বরাবরই বিমোহিত লাগে। ইশা তার থুঁতনিতে পলকহীন চেয়ে রইলো। সেই সাথে শ্রাবণের শরীর থেকে সকালের সেই পারফিউমের তীব্র ঘ্রানটা পূণরায় নাকে ভাসতে লাগলো ওর। কি প্রখর এখনও সেই ঘ্রাণটা।

“তোর মতিগতি আজকাল অন্যরকম লাগছে কিন্তু।;

চুল ছাড়িয়ে ইশাকে নিজের থেকে সরিয়ে পাশে সরে এলো শ্রাবণ। ইশা বোকাকান্ত দৃষ্টিতে তাকালো শ্রাবণের পানে। এ কথার মানে না বুঝে বোকাকান্ত গলাতেই শুধালো,

“আমি কি করলাম?;

“কিছু করিসনি। বস এখানে, আমি উনাদের থেকে তোর জন্য কোনো ড্রেস পাই কিনা দেখি!;

বলেই প্রস্থান করলো শ্রাবণ। ইশা তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে আওড়ালো,

“যা বাবা, আমি আবার কি করলাম?;

ড্রেস না মিললেও পেয়ে গেলো একটা সুতির শাড়ি। আর তার নিজের জন্য পেলো বুড়োর পড়া একটা সাদা ফতুয়া। সেটা নিয়েই ফিরে এলো শ্রাবণ। শাড়িটা ইশাকে ধরিয়ে দিয়ে সে চলে গেলো নিজে চেঞ্জ করার জন্য। শাড়ি ইশার সহজে হজম হয়না। এই শাড়ি এতক্ষণ ধরে সামলে রাখতে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে যে যু*দ্ধের স্বীকার হতে হয়েছে, সে কথা তে এতো সহজে ভোলা যাবেনা।

শাড়িটা উল্টে পাল্টে দেখা কিংবা, এর ভেতরে বাহিরে সুন্দর নকশিকাঁথার কাজ দেখা ছাড়া ইশার আর কিছু করণীয় নেই। শ্রাবণ পাঞ্জাবি পাল্টে বুড়োর দেয়া ফতুয়া পড়ে ফিরে এলো। শ্রাবণের পেটা শরীরে সুন্দর লাগছে ফতুয়াটা। ইশা শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে আর চোখ ফেরাতে পারলোনা। শ্রাবণ ইশার তাকিয়ে থাকা দেখে ভ্রু নাচালো। ইশা মৃদু হেসে না সূচক মাথা নেড়ে একই ভাবে তাকিয়ে দেখতে লাগলো শ্রাবণকে। ওর হাতে ধরে রাখা শাড়ির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো শ্রাবণ। ভারী গলায় বলল,

“তোকে চেঞ্জ করার জন্য কি আলাদা ভাবে ইনভাইটেশন দিতে হবে?;

“অ্যা?;

শ্রাবণ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। খানিকটা এগিয়ে এসে ইশার মাথায় চাটি মে/রে বলল,

“জলদি যা।;

মাথায় মা/র পড়তে জ্ঞান ফেরে ইশার। তবে পূর্ণ ভাবে নয়। আশেপাশের পরিস্থিতি সম্মন্ধে সে জ্ঞাত নয়। এমন ভাবেই বলল,

“কোথায়?;

“চেঞ্জ করতে।;(দাঁতে দাঁত চেপে)

এবার মনে পড়লো ইশার। পরক্ষণেই আবার মনে পড়লো সে, শাড়ী পড়তে জানেনা। এবার? এবার কি হবে? ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে লাগলো ইশা। বোকাকান্ত দৃষ্টিতে তাকালো শ্রাবণ। চিন্তান্বিত এবং ব্যস্ত গলায় বলল,

“কি হলো, কাঁদছিস কেন?;

“আমি তো শাড়ি পড়তে পারিনা!(কাঁদতে কাঁদতে)

“তাহলে এটা কি পড়ে আছিস?;

ইশা নিজের দিকে তাকালো। নিজের পরনের শাড়িটা পূণরায় দেখে আরও জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো।

“এটা তো বড় মামি পরিয়ে দিয়েছে!;

“এবার তোর বড় মামিকে, মানে মাকে কোথায় পাবো?;

“বড় মামিকে পেলে তো আর আমরা এখানে আঁটকে যেতাম না।;

“ওয়েট, নেট থেকে ডাউনলোড করে দেখি।;

“ধ্যাৎ, এখানে নেট আছে নাকি?;

“ড্যাম!;

“এখন আমি কি করবো?;

“আরে দাঁড়া, দেখছি কি করা যায়!;

“তুমি শাড়ি পড়াতে পারো?;

“না, পারিনা। বাট ট্রাই করা যেতে পারে। কাম টু মি।;

ইশা যেন আঁতকে উঠলো। লজ্জায় গাল লাল হয়ে ওঠার দশা। শ্রাবণ ওকে শাড়ি পড়িয়ে দিবে, এটা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়।

“তাকিয়ে আছিস কেন? আসবি তো!;

ইশা এখনও স্তব্ধতার গন্ডি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলতে পারছেনা।

“ওকে ফাইন!;

শ্রাবণ ওর কাছে এগিয়ে আসতে নিলেই চেঁচিয়ে উঠে দু’কদম পিছিয়ে গেলো ইশা। আমতাআমতা করতে করতে বলল,

“ক্ কোনো দরকার নেই! আমি যেভাবে পারবো, করে নিবো, আই মিন পরে নিবো!;

শ্রাবণ বুঝলোনা ইশার কথা। এই যে কান্না জুড়ল শাড়ি পড়তে পারেনা বলে, এই আবার আতংকে কাচুমাচু হয়ে যাচ্ছে।

“ঠিকাছে, পড়ে নে। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। শেষ হলে ডেকে নিস।;

“হ্ হ্যাঁ, ডাকবো।;

শ্রাবণ পূণরায় প্রস্থান করলো। ইশা অস্থিরতা নিয়ে ধপ করে বসে পড়লো বিছানায়। এভাবে হয় নাকি? ধ্যাৎ!

“শ্রাবণ ভাই, ভেতরে এসো?;

দরজার ওপাশ থেকে ইশার ডাক পরতে উঠে দাঁড়ালো শ্রাবণ। একবার দরজার পানে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলো। অতঃপর দু’হাতে প্যান্ট ঝেড়ে চলে গেলো ডাকের উৎস বরাবর। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আর আশেপাশে তাকালো না সে। দরজাটা ভেতর থেকে ছিটকিনি দিয়ে এগিয়ে গেলো বিছানার পানে। এবার যে তাকেও একটু রেস্ট নিতে হবে।

ভাবতে ভাবতে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। নেটওয়ার্ক বিজি প্রত্যেক জায়গাতে। কাউকেই কোনো খবর দেওয়া হয়নি। কে জানে, কতটা দুশ্চিন্তা করছে সবাই।

“মা গো!;

বিকট শব্দ। পায়ে শাড়ি পেঁচিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো ইশা। তবে যে সে জায়গায় নয়, সোজা গিয়ে শ্রাবণের বুকে। আঁতকে উঠল শ্রাবণ। এ যেন ভাবনায় তলিয়ে থাকার ছোট খাটো শা*স্তি। ইশা তার বুকের উপর ধপাস করে পড়তেই দম বেরিয়ে আসার পালা। খানিক মতিগতি তৈরী হলো, এক্ষনি ইশাকে একটা রাম ধমক দিবে বলে তবে মুহুর্তেই যেন সব ওলট-পালট হয়ে গেলো। হারিকেনের হলদে আলো এবার উপচে এসে পড়লো এই মনোহারিণীর মুখবিবরে। জ্বলজ্বল করে জ্বলছে তার গভীর নেত্রদ্বয়। নরম গালে খেলা চলছে অবাধ্য চুলগুলোর। একফালি স্নিগ্ধ আলো এসে জড়িয়ে ধরলো তার ঠোঁট, গলা এবং তার যতসামান্যই নীচে। শাড়ির আঁচল সরে গেছে কিঞ্চিৎ। যেটা টেনশনে আর খেয়াল হলো না ইশার। সে গভীর আতংকে তার শাড়ি নিয়ে।

“স্ সরি, সরি! আমার পা স্লিপ হয়ে গেছে!;

অসহায় গলায় নিজের দোষ স্বীকার করলো ইশা। ফের শ্রাবণ বুকে ভর দিয়েই উঠে বসতে নিলো সে। কিন্তু পারলোনা। শ্রাবণ এক টানে তাকে পূনরায় নিজের বুকের উপর এনে ফেললো। ইশা হকচকিয়ে তাকালো। কিছু বলবে, তবে তার পূর্বেই থেমে গেলো। ঢিপঢিপ করে বাজছে অন্তরের অন্তস্তল। অস্থির লাগছে ক্রমশ।

শ্রাবণ কিছু না বলেই ইশাকে তার নীচে নিয়ে, সে ইশার উপর উঠে গেলো। অদলবদলের জার্নিতে পূণরায় ইশা চকমালো। চোখ জোড়া আলুর সেপের আকার নিয়েছে তার। অবাকের শীর্ষে পৌঁছে বলে উঠলো,

“ক্ কি হলো এটা?;

“আমি আবারও ফল করেছি ইশুপাখি।;

বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে পুড়ে গেলো ইশার। শ্রাবণের কন্ঠে ঘোর, নয়নে নেশা। ঢোক গিললো ইশা। নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা ও এই দম বন্ধকর মুহুর্তে। শ্রাবণ ওর হাতটা নামিয়ে আনলো ইশার কোমরে। উষ্ণ দেহে শ্রাবণের শীতল স্পর্শ কাঁপিয়ে তুললো ইশাকে। ফট করে চোখ বন্ধ করে পূনরায় দম আঁটকে নিলো। শ্রাবণ মাতাল হাসে ইশার প্রতিক্রিয়ায়। ইচ্ছে করেই ইশার উন্মুক্ত জঠরে হাত চেপে ধরলো সে। ইশার দেহ আবারও শিহরণে কেঁপে উঠলো। বন্ধ নেত্র জুগল আরও কুঁচকে গেলো। বুক ভারী হয়ে ঘণ নিঃশ্বাসের মাত্রা তেজ হতে লাগলো।

পূণরায় মাতাল হাসে শ্রাবণ। কাছে এগিয়ে ইশার কপালে কপাল ঠেকিয়ে ধীর স্বরে ঠোঁট নেড়ে আওড়ায়,

“আই এম সরি!;

বলেই মুখ ডুবিয়ে দেয় ইশার গলায়। ইশা স্তব্ধ হয়ে পড়ে শ্রাবণের এই পাগলামি তে। এক হাতে বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরে অন্যহাতে শ্রাবণের কাঁধের কাছটা খামচে ধরে। শ্রাবণ টের পায়। টের পায় ইশার তীব্র অনুভূতি গুলোকে। টের পায় ইশার বর্তমান মনের অবস্থাকে। তবুও সে অপারগ। ইশাকে সে ভালোবাসে। গভীর অনুভূতিতে ভালোবাসে।

শ্রাবণের হাত বিচরণ করতে থাকে ইশার কোমরে, জঠরে এবং গলায়। ইশা কাঁপছে। থরথর করে কেঁপে উঠছে প্রতি মুহুর্তে। শ্রাবণের স্পর্শ গুলো ক্রমশ গভীর হচ্ছে। উষ্ণ হচ্ছে দুটো দেহই। একজনেরটা তীব্র অনুভূতিতে, আরেকজনেরটা তীব্র ভ*য়ে।

ইশা পারছেনা নিজের অনুভূতিদের সাথে যু*দ্ধ করে কুল পেতে। যার ফলে সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো শ্রাবণকে। জড়িয়ে ধরলো শ্রাবণও। নিজের সাথে একদম মিশিয়ে নিতে চাইলো তার প্রাণনাশিনীকে। কিছুতেই আর দূরে রাখতে চায়না সে।

হঠাৎ তীব্র বেগে কেঁপে উঠলো শ্রাবণের ফোনটা। সেই সাথে অসহ্য কর একটা রিংটোন। ঘোর কেটে গেলো শ্রাবণের। ছিটকে উঠলো সে ইশাকে ছেড়ে। বালিশের পাশ থেকে ফোনটা তুলতেই দেখলো দাদাজানের কল। আর কিছু ভাবার সময় নিলোনা শ্রাবণ। দ্রুত ফোনটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

_______

সকাল ১১টা। বাসায় ফিরেছে ইশা আর শ্রাবণ। তবে এই আসার মাঝের দীর্ঘ সময়টা আর কেউই কারোর সাথে প্রয়োজন ব্যতীত কথা বলতে পারেনি। ইশা ভ*য় আর জড়তা নিয়ে পুরোটা সময় পার করেছে। শ্রাবণ অপরাধ বোধে আর মুখ নাড়তে পারেনি। বাড়িতে ফিরে আর কাউকে তেমন কৈফিয়ত দিতে হয়নি। কারন রাতেই শ্রাবণ সবাইকে জানাতে পেরেছিলো তাদের বর্তমান অবস্থা। আসার সময় সেই বুড়ো এবং বুড়িকে কথা দিয়ে এসেছে, তারা মাঝে মাঝে এসে তাদের সাথে দেখা করে যাবে। বুড়ি আনন্দে তখনও কেঁদেছে। শ্রাবণ এক ধ্যানে চেয়ে দেখেছে বুড়ির কান্না। ইশা আর তার মাঝে বয়সের পার্থক্যটি ছাড়া আর কোনো ব্যবধান দেখতে পায়নি সে।

ড্রয়িং রুমে আসর জমালো ছেলেমেয়েরা। গুরুজনরাও অবস্থানরত। ডাক পড়লো ইশা আর শ্রাবণের। এসে থেকে আর কেউই নীচে নামেনি এখনও অব্দি।

তিতির বলল,

“কই রে ইশুরানি? আর কি দেখা পাবো তার?;

আফিয়া বেগম আর নুপুর বেগম ডাইনিং টেবিলে নতুন জামাইয়ের জন্য নাস্তার পরে কফি সাজাচ্ছিলো। তিতিরের গলা পেয়ে আফিয়া বেগম বললেন,

“ওকে ডাকিস না তো এখন! ক’টা দিন তোর বিয়ে বিয়ে করে খুব খেটেছে মেয়েটা। আর কাল রাতের কথা তো বাদই দিলাম।;

সিঁড়ি ধরে নামছিলো শ্রাবণ। মায়ের কথাটা কানে ভাসতে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। কাল রাতের ঘটনা মনে পড়ছে তার। কি থেকে কি করেছে সে নিজেও জানেনা! একবার সরি বলা দরকার ছিলো ইশাকে!

“হ্যাঁ রে তিতির। তোরা আড্ডা দে মা।;

বললেন নুপুর বেগমও। তখনই এসে হাজির হন মরিয়ম বিবি। দুই ভাবির আলোচনার মুল উৎস নিজের মেয়ে, এই ভেবে মৃদু হাসলেন তিনি। দুই ভাবিকেই উদ্দেশ্য করে বললেন,

“তোমরা আমার মেয়েটাকে একটু বেশিই আশকারা দিচ্ছো ভাবি।;

“তুমি থামোতো, ও তোমার একার মেয়ে নাকি?;

বকার সুরে বললেন আফিয়া বেগম। হাসলেন নুপুর বেগম। বললেন,

“এই কথা আপাকে বুঝাতে বুঝাতে আমি একদিন পাগল হয়ে যাবো দেখো তোমরা!;

নুপুর বেগমের কথায় শব্দ করে হেসে উঠলেন আফিয়া বেগম আর মরিয়ম বিবি। মরিয়ম বিবি হাসি থামিয়ে বললেন,

“ঠিকাছে বাপু, আর বলবোনা। এবার যাই একটু মেয়েটার কাছে। দেখি, কি করছে?;

“হ্যাঁ আপা যাও।;

মরিয়ম বিবি হাঁটা ধরলেন মেয়ের রুমের উদ্দেশ্যে। সিঁড়িতে শ্রাবণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনিও।

“শ্রাবণ? ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস? যা নীচে যা, সবাই মিলে আড্ডার আসর জমিয়েছে তোকে ছাড়াই। যা যা।;

এই বলে তিনি উপরে উঠতে লাগলে শ্রাবণ নড়েচড়ে ডেকে ওঠে তাকে।

“মনি?;

“হ্যাঁ রে, বল?;

“ইশা কি ঘুমচ্ছে?;

“জানিনা তো। গিয়ে দেখছি কি করছে সে মহারাণী।;

“ওর জ্বর-টর এলো কিনা দেখো একটু। রাতে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে তো।;

শ্রাবণের চিন্তান্বিত গলায় দিগুণ উদ্বিগ্ন হয়ে গেলেন মরিয়ম বিবি। আতংকের সহিত বলে উঠলেন,

“তাই তো! আমি তো এ কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।;

আর এক মিনিটও দাঁড়ালেন না তিনি। দ্রুত পায়ে চলে গেলেন মেয়ের ঘরে। কম্বলের নীচে গুটিশুটি হয়ে ঘুমাচ্ছে ইশা। মরিয়ম বিবি একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে এসে বসলেন ওর পাশে। গলা উঁচিয়ে মেয়ের মুখ খানা দেখতে বৃথা চেষ্টা করলেন। উপায় না পেয়ে আস্তেধীরে ডাকতে লাগলেন ওকে।

“ইশা, ও মা? জেগে আছিস?;

বেঘোরের ঘুম খানিক পাতলা হয়ে এলো মায়ের ডাকে। তবে নড়েচড়ে স্বভাব বসত পূণরায় ঘুমে ডুব দিলো ইশা। মরিয়ম বিবি ওর মুখ থেকে কম্বলটা নামিয়ে কপালে হাত রাখলেন। খুব গরম না হলেও স্বাভাবিকের তুলনায় যেন একটু বেশিই গরম। তিনি হাত নামিয়ে গালে আর গলায় ঠেকাতেই ঘুমের ঘোরে লাফিয়ে উঠে বসলো ইশা। সেই সাথে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো এক অপ্রত্যাশিত কথা,’শ্রাবণ ভাই’!

মরিয়ম বিবি হকচকিয়ে গেলেন। অবাক স্বরে বললেন,

“শ্রাবণ?;

মায়ের গলায় আতংকে পড়ে গেলো ইশা। পাশ ফিরে মাকে দেখে আরেকদফা চমকে উঠলো। বোবা গলায় বলল,

” মা?;

“হ্যাঁ। কি স্বপ্ন দেখছিলিস?;

“হ্ হ্যাঁ মা। স্ স্বপ্ন দেখছিলাম।;

কপাল ডললো ইশা। সেই সাথে পুরো মুখ একবার মালিশ করলো। পরক্ষণে আবারও বলল,

“তুমি এখানে? কিছু বলতে এসেছো?;

“ঘুমচ্ছিস না জেগে আছিস,দেখতে এসেছিলাম। আর শ্রাবণ বলল…;

“বলল? ক্ কি বলল?;

ঘাবড়ানো গলায় বলল ইশা। মরিয়ম বিবি মেয়ের রিয়াকশন দেখে কপাল কুঁচকালেন। বলল,

“বলল রাতে বৃষ্টি ভিজতে হয়েছে নাকি তোদের? তাই আবার জ্বর এলো কিনা!;

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইশা। মরিয়ম বিবি এখনও কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। সন্দিহান গলায় বললেন,

“কি ব্যাপার রে? কিছু হয়েছে?;

কট খেয়ে গেলো যেন। চোখ জোড়া বড়বড় করে নিলো ইশা। পরমুহূর্তেই মাকে ভুলানোর জন্য শব্দ করে হাসতে লাগলো। হসতে হাসতে বলল,

“কি আবার হবে? কিছুই না, কিছুইনা। আ্ আমি এখন ঘুমাবো মা। ত্ তুমি এখন যাও তো।;

বলেই ধপাস করে শুয়ে পড়লো উল্টো দিকে ফিরে। মরিয়ম বিবি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকালেন। মেয়ের এই উদ্ভট আচরণ সে যে ধরতে পারছেনা।

#চলবে

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব______১৬

“মনি, ইশা আসেনি?;

নাস্তা সামনে নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বসে ছিলো শ্রাবণ। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ইশার কথা। অশান্তি লাগছে ওকে দেখতে না পেয়ে। তাই হঠাৎ মরিয়ম বিবিকে পেয়ে যেন খানিক স্বস্তি পেলো। কিঞ্চিৎ তাড়াহুড়োতেই ইশার কথা জিজ্ঞেস করে বসলো মনিকে। মরিয়ম বিবি এসে বসলেন চেয়ার টেনে। গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে শ্রাবণের প্রশ্নের জবাবে না সূচক মাথা নাড়লেন। অতঃপর বললেন,

“না। ঘুমাবে বলল। তাই আর উঠাইনি।;

“কেন, শরীর কি বেশি খারাপ? জ্বর এসেছে?;

শ্রাবণের অস্থির ভাব ভঙ্গিমা মরিয়ম বিবির মনে সন্দেহের বীজ রোপন করলো যেন। তিনি কয়েক ঢোক পানি খেয়ে সন্দিহান নয়নে তাকালেন শ্রাবণের পানে। তবে সন্দেহ প্রকাশ না করেই বললেন,

“না শরীর তো ঠিকই আছে। তবে আচরণ একটু অন্যরকম ছিলো!;

শ্রাবণ আরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। শুধালো,

“কেন, কি করেছে ও?;

“হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে বসলো তোর নাম নিয়ে, তারপর হঠাৎ আবার ধপাস করে শুয়ে পড়লো উল্টো ঘুরে।;

শ্রাবণ বিষম খেলো মনির এহেম কথা শুনে। কাশতে কাশতে মুখে হাত চাপতেই দাঁড়িয়ে গেলেন মরিয়ম বিবি। চটজলদি পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে খেতে বললেন। ওদিকে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে আসলেন আফিয়া বেগম।

“কি হলো বাবা?;

চিন্তান্বিত হয়ে প্রশ্ন করার মাঝে পানি খেয়ে শান্ত হলো শ্রাবণ।

“ক্ কিছুনা মা। আমার আর ক্ষিদে নেই। আমি ঘরে গেলাম।;

বলেই উঠে চলে গেলো।

“ক্ষিদে নেই মানে? সকাল থেকে তো কিছু খেলিনা!;

কোনো জবাব এলো না ছেলের থেকে। মরিয়ম বিবি শ্রাবণের যাওয়ার পানে তাকিয়ে সন্দিহান সুরে বলে উঠলেন,

“আমার কিছু ভালো ঠেকছেনা ভাবি।;

“কি? কি ভালো ঠেকছেনা!;

“শ্রাবণ কেমন অদ্ভুত আচরণ করলো বলে মনে হলোনা তোমার?;

“হ্যাঁ গো, ঠিকই বলেছো।;

“ইশাও জানো ঠিক এমনই আচরণ করলো। অদ্ভুত!;

“সন্দেহ জনক কিছু মনে হচ্ছে তোমার?;

“মনে তো হচ্ছেই। তবে কিছু না জেনে কিছু বলা যায়না।;
,
“ঠিক।;

“চলো রান্না ঘরে যাই।;

রান্না ঘরে চলে গেলো ননদ ভাবি। শুধু খাবার টেবিলে পড়ে রইলো শ্রাবণের ফেলে যাওয়া আধখাওয়া রুটি আর ডালভাজি।

ইশার রুমের দরজাটা ভেজিয়ে রেখে গেছে মরিয়ম বিবি। প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। ভেতরে যাবে কি যাবেনা, এই ভাবনাতেই পুরো পাঁচ মিনিট ব্যয় হয়ে গেলো। অবশেষে মনের সাথে যুদ্ধ করে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে আছে ইশা। শ্রাবণ হাসফাস করছে ভেতরে ভেতরে। সে এখানে কেন এসেছে এর উত্তর তার কাছে নেই। কেন দাঁড়িয়ে আছে, কেন ইশার কাছে যাচ্ছে জানেনা সে। তবে এটুকু জানে, এই মুহুর্তে একবার ইশাকে দেখতে না পেলে এক্ষনি যেন দমটা বেরিয়ে আসবে।

এতক্ষণ ওপাশ ফিরে ঘুমালেও, ঘুমের মাঝেই এপাশ ফিরে শুলো ইশা। এতে যেন শ্রাবণর বেশ ফায়দা হলো। সে পা গুণেগুণে এগিয়ে গিয়ে ঠিক ইশার সামনে বসলো। কম্বলের নীচে কেবল চোখ ব্যতীত বাকি সবই ঢেকে আছে ওর। সেই চোখ জোড়াও লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে একঝাঁক চুলের আড়ালে। শ্রাবণ হাত বাড়িয়ে ইশার মুখ থেকে কম্বলটা নামাতেই বুকের ভেতরটা তার দারুণ ভাবে কেঁপে ওঠে। ঘুমন্ত ইশুপাখিকে মায়াবনো বিহারিণীর উপাধি দিতে ভুললো শ্রাবণ। মনোজ্ঞ হাসলো সে। হাত বাড়িয়ে ইশার চোখগুলো উন্মুক্ত করলো চুলগুলোর জোরপূর্বক ভালোবাসা থেকে। অতঃপর ক্রমে হাতটা নামিয়ে রাখলো ওর নরম গালে। ঠোঁট জোড়া গাঢ় লালে ছেয়ে আছে। লিপস্টিক পরেনি, তবুও! শ্রাবণের অবাধ্য মন যেন বারবার তাকে ঠেলে দিচ্ছে ইশার লাল ঠোঁটের দিকে। মন তাকে উস্কাচ্ছে এই বলে, ছুঁয়ে দে, ছুঁয়ে দে। এই কথা ভেবে শ্রাবণ আপন মনেই হাসলো। মানুষের মন কতই না অবুঝ হয়। ঠিক যেন নবজাতকের শিশু।

ঘুমের মাঝে বড়বড় নিঃশ্বাস টানছে ইশা। স্বপ্নে দেখছে শ্রাবণকে। শ্রাবণ তার খুব কাছে, এতোটাই কাছে যে দু’জনের মাঝে এক ইঞ্চিরও তফাৎ নেই। ইশার ঘুমন্ত চোখ জোড়া বারবার কুঁচকে যাচ্ছে। এলোমেলো হাত নাড়ার চেষ্টা করছে। শ্রাবণ ইশার এমন অবস্থা দেখে শঙ্কিত মনে তাকালো। হালকা গলায় কাশি দিয়ে ইশাকে ডাকতে লাগলো।

“ইশা, কি হয়েছে তোর? ইশা! ইশা?;

“ন্ ননন না! না!;

ঘুমের ঘোরেই হাত নাড়ছে ইশা। শ্রাবণ ইশার হাত চেপে ধরলো। অনন্তর, আবারও ডাকতে লাগলো। শ্রাবণের ডাক ইশার মগজ ছুঁতে পারছেনা কিনা জানা নেই। তবে আচমকাই ‘না’ বলে এক চিৎকারে উঠে বসলো ও। হাঁপাতে হাঁপাতে গলায় গালে হাত বুলালো। শ্রাবণ চকিতে তাকিয়ে আছে ইশার পানে। ওর ডান হাতটা এখনও তার হাতের ভাজে।

“কি হলো? দুঃস্বপ্ন দেখেছিস?;

“প্ পানি!;

একহাতে মুখে চেপে ধরলো ইশা। পরক্ষণেই পানির আকুতি জানালো। শ্রাবণ ওকে পানি দিলো। পানি পেয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো।

“এবার বল?;

“হু?;

“এবার বল কি দেখেছিস?;

ইশার এবার হুঁশ ফিরলো। শ্রাবণের গলা পেয়ে দম আঁটকে এলো মুহুর্তেই। চোখ জোড়া বড়বড় করে পাশ ফিরে তাকাতেই এক রকম ছিটকে সরে পড়লো দূরে। শ্রাবণ দৃঢ় চাহনিতে এখনও তাকিয়েই আছে।

ইশা ভয় মিশ্রিত গলায় বলে উঠলো,

“ত্ তুমি?;

“হ্যাঁ আমি! কাকে এক্সপেক্ট করছিলিস?;

ইশা ডান হাতটা মুখে চাপলো। লজ্জা,ভয়, সংকোচ তিন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে ওর ভেতরে। চোখ খুললেও শ্রাবণকে দেখছে আবার চোখ বন্ধ করলেও শ্রাবণকেই দেখছে। কি মহাবিপদে পড়লো বেচারি!

“বল?;

অনন্তর ধমকের জোরে শোনা গেলো শ্রাবণের গলা। ইশা ভীত হয়ে নখ কাটতে লাগলো। যা হচ্ছে ওর সাথে সে কথা চাইলেও কাউকে বলা সম্ভব নহে।

” ত্ তুমি আমার ঘরে কেন এসেছো?;

এই প্রশ্নটা ভারি হলো শ্রাবণের ধমকের আগে। শ্রাবণ এবার আমতাআমতা করতে লাগলো। কেন এসেছে সে এখানে? উত্তর থাকলেও কিভাবে বলবে সে?

“এ্ এসেছি আমার দরকারে! তোকে এতো কৈফিয়ত দিতে পারবোনা।;

“কেন? আমার ঘরে দরকারে এসেছো আর আমাকেই বলতে পারবেনা?;

জোর গলায় বলে উঠলো ইশা। বলে মনে হলো সে ভুল করেছে। শ্রাবণের মুখে মুখে তর্ক করাটা একদমই ঠিক হয়নি ওর। মনেমনে জিভ কাটলো। শ্রাবণ ত্যাড়া চোখে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে চোখের মাঝে বন্দু*ক বসানো থাকলে তার সুবিধাই হতো! চোখ দিয়েই গু*লির বর্ষণ করে ফেলতো।

” ঘুমা চুপচাপ।;

এই বলেই গটগট পায়ে উঠে চলে গেলো শ্রাবণ। ইশা ফিক করে হেসে ফেললো শ্রাবণের পালিয়ে যাওয়া দেখে। মনে মনে খুব করে বকে বলল, আগে তো মুখে শুধু কথার খৈ ফুটতো। আর এখন? বড্ড ইগো হয়েছে জনাবের!

__________

পড়ন্ত বিকেলে শিশিরে ভেজা ঘাসের উপর পা ফেলতেই শরীর শিউরে উঠলো ইশার। পায়ের তলায় কেউ ইচ্ছে করে সুড়সুড়ি দিচ্ছে যেন। সঙ্গে সঙ্গে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। ওর হাসি দেখে হাসলো তিতির, তানি এবং তুতুন। দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো তিনবোন। একই ছন্দে সবাই একত্রে খিলখিল করে হাসতে লাগলো। দূর থেকে এই বিরল দৃশ্য নজর বন্দী করছে শাকিল আর শ্রাবণ। ইশাকে দিয়ে বলে কয়ে সব কাজ করানো গেলেও খালি পায়ে ওকে কোথাও দাঁড় করানো যাবেনা। কারন ছোট বেলা থেকেই ওর পায়ের তলাতে বড্ড সুড়সুড়ি। আজ তিতিরের জোড়াজোড়িতে একরকম বাধ্য হয়েই নরম ঘাসে পা রাখার সিদ্ধান্ত নিলো। তবে সেই সিন্ধান্ত যেন কাল হলো ওর জন্য। পায়ে সুড়সুড়ি লাগাতে হাসতে হাসতে দম বেরিয়ে যাওয়ার দশা হচ্ছে।

“আমি আর পারছিনা রে আপা! আমাকে যেতে দে প্লিজ।;

হাসতে হাসতে কোনো রকমে বলল ইশা। তিতির ওর হাসিতে তাল মিলিয়ে বলল,

“একদম না। অভ্যাস কর।;

“ধুর, এই বেহুদা অভ্যাস আমি করতে পারবোনা! মাফ কর।;

“কোনো মাফ হবেনা। এই তানি, ধরে রাখতো ওকে? আমি আসছি।;

হুকুম পেয়ে ইশাকে ঝাপটে ধরে রাখলো তানি। ইশা এখনও হাসতে হাসতে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। এর পরের প্লান তারা ফুচকা খেতে যাবে। সেই সাথে যত ফাস্ট ফুড আছে, আজ সব ট্রাই করবে। নতুন দুলাভাই এসেছে বলে কথা।

ইশা আর হেসে কুলাতে পারছেনা। পেট চেপে ধরে নরম ঘাসের উপর বসে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গেই ওর পাশ ঘেঁষে বসে পড়লো তুতুন আর তানি। ইশা ক্ষেপে যাওয়ার ভান করে তানির পিঠে দু’চার ঘা বসালো। বকে বলল,

“আমার সঙ্গে আজ যা করলি মনে রাখিস কিন্তু। একদম সুদেআসলে উসুল করবো।;

“এহ্, আমার এমন কোনো সমস্যাই নেই, তুমি হয়তো ভুলে গেছো।;

” ও তাই না? সারাক্ষণ মিষ্টি মুখে পুড়ে রাখে কে রে? শাকিল ভাইয়া হাঁড়ি হাঁড়ি মিষ্টি এনেছে। যদি একটাও তোর কপালে জুটেছে, দেখে নিস?;

কারোর থেকে কিডনি চাইলেও বোধহয় এতোটা কষ্ট হবেনা, যতটা কষ্ট ওকে মিষ্টি দিবেনা বলে হচ্ছে ওর। চোখেমুখে নিমিষেই আষাঢ় মাস নেমে এলো তানির। এক্ষনি কেঁদে ভাসাবে যেন।

“আপা আমার সাথে এই না-ইনসাফি টা করিসনা, প্লিজ! মিষ্টি না খেয়ে আমি কিভাবে থাকবো। মাও এখনও অব্দি একটাও খেতে দিলোনা।;

শব্দ করে হেসে উঠলো ইশা। সঙ্গে যুক্ত হলো তুতুন। ইশার দিকে তাকিয়ে তুতুন বলে উঠলো,

“আল্লাহ আমি কোনোদিন এমন মিষ্টি পাগলা দেখিনাই গো আপা।;

“আমিও না রে। আচ্ছা কাঁদিস না! শাস্তিস্বরূপ তুই হাফ হাফ ভাগে পাবি, যা।;

মুহুর্তেই আনন্দে চোখমুখ চকচক করতে লাগলো তানির। হেসে উৎসাহিত গলায় বলল,

“সত্যি?;

“হু সত্যি। এবার যা আমার জুতোটা এখানে নিয়ে আয়। আমি খালি পায়ে আর মোটেই যেতে পারবোনা এখান থেকে।;

জুতো আনার কথা শুনে একটু শয়তানি হাসলো তানি। তবে ইশা আবারও ওকে ওর মিষ্টির কথা মনে করিয়ে দিতে উঠেপড়ে দৌড়ে গেলো। চটজলদি জুতোটা এনে পড়িয়েও দিলো ইশার পায়ে। ইশা জুতো পড়ে দাঁড়াতেই সামনে এসে দাঁড়ালো তিতির। কোমরে হাত চেপে ইশার পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

“আবার জুতো পরলি?;

“আপা আর না প্লিজ! এই কষ্ট আর সহ্য করতে পারবোনা!;

“ঠিকাছে চল। আর কষ্ট পেতে হবেনা।;

“আমার লক্ষী আপা। এবার কি ফুচকা খেতে যাবো?;

“হু, ঐ যে শ্রাবণ ভাই আর শাকিল একজন ফুচকাওয়ালাকে ধরে এনেছে।;

“ইয়ে!(খুশিতে আত্মচিৎকার করে)

“আস্তে মা। চল, তুতুন তানি জলদি আয়।;

সবার আগে এসে হাজির হলো ইশা। জিভে জল চলে এসেছে ওর। কোনোমতে ঢোক গিলেই ফুচকাওয়ালাকে বলল,

“মামা এক প্লেট ঝাল দিয়ে!;

“হ মামা দিতাছি।;

দক্ষ হাতে ফুচকা মাখাতে আরম্ভ করলেন ফুচকাওয়ালা। তবে ইশার যেন দেরী সয়না। পারলে নিজেই হাতে মেখে খাওয়া শুরু করে।

“জলদি জলদি!;

তাড়া দিয়ে পূনরায় বলল ইশা। ফুচকাওয়ালা ওর দিকে চেয়ে হেসে উঠলো। মাথা ঝুলিয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর জানালো।

“এতো কিসের তাড়া! আপনি আস্তেধীরে বানান।;

একখানা গম্ভীর স্বর ভেসে এলো পেছন থেকে। শ্রাবণ এসেছে। সঙ্গে শাকিলও আছে। শ্রাবণের কথায় বিশেষ পাত্তা দিলো না ইশা। ও ওর মতো চেয়ে রইলো ফুচকা মাখানোর দিকে। তার জবাবে শাকিল স্মিত হেসে বলল,

“শুনেছি আমার বড় শালিকা ফুচকা বলতে অজ্ঞান। তাই একটু কসরত করে ফুচকা মামাকে একরকম তুলে নিয়ে এসেছি।;

শাকিলের কথা শুনে ইশা মুগ্ধ গলায় বলল,

“ও দুলাভাই ইউ আর দ্য বেস্ট। জানো, সেই ভোর থেকে আমার মনটা শুধু ফুচকা ফুচকা করছিলো।(শ্রাবণ তাকাতেই) ন্ না মানে, দুপুর! দুপুর থেকে;

কি ঢব দিচ্ছেরে বাবা। শ্রাবণের এমন তাকানো যেন কাজে দিয়েছে। ওদিকে শাকিল শব্দ করে হেসে উঠলো। বলল,

“হ্যাঁ জানি তো শালিকা সাহেবা। আজকে বের হওয়ার সময় তোমার আপা বলেই দিয়েছে, ইশানির জন্য ফুচকা মাস্ট।;

“এমন আপা যেন প্রতি ঘরে ঘরে পাওয়া যায় দুলাভাই। দোয়া করো।;

“নো নো নো! আমার তিতির শুধু আমার কাছেই ঠিকাছে। অন্য কোনো ঘরে দ্বিতীয়টি থাকারও দরকার নেই।;

আরও ভালো মন্দ টুকিটাকি কথা বলতে বলতে ইশার ফুচকা রেডি হয়ে গেলো। লাল টকটকে রঙ হয়েছে ফুচকা গুলোর। কি ভয়ানক ঝাল নিয়েছে দেখে মাথা ঘুরতে লাগলো সকলের। তিতির ওকে এতো ঝালের ফুচকা কিছুতেই খেতে দিবেনা। কিন্তু ওকে তো এটাই খেতে হবে। তাই হাজার বারন স্বত্বেও ভোজন রসিকের ন্যায় দুই প্লেট ফুচকা সাবাড় করেছে। এখন যে ঝালের তোড়ে মাথা ঘুরছে ওর।

এরপর খাওয়া হয়েছে চিজ বার্গার, আইসক্রিম, চকলেট। একটার পর একটা খেতে কারোরই কোনো ক্লান্তি ছিলো না আজ। তবে এই যদি ঘরের খাবার হতো, তবে কেউ মুখেও তুলতো কিনা বড্ড সন্দেহ ছিলো সকলের।

সারা বিকেল,সন্ধ্যা খাওয়া দাওয়া আর ঘোরাঘুরিতেই কাটলো ওদের। এখন বাসায় যাওয়ার সময় হয়েছে। বাড়ি থেকে ইতিমধ্যে কল চলে এসেছে।

“সো, আজকের দিনটা কে কেমন ইনজয় করলে?;

রসানো গলায় প্রশ্ন করলো শাকিল। তিতির শাকিলের পানে তাকিয়ে লজ্জা মিশ্রিত হাসলো। তানি, তুতুন আর ইশা এক সাথে বলে উঠলো, ‘বেস্ট’। ওদের চেঁচানো গলায় রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া গুটি কতেক লোক অবাক বিস্ময়ে চেয়ে ছিলো। যা দেখে আবার চার বোন চুপিচুপি হেসেছে। হাসতে হাসতে আবার হাঁটতে লাগলো সকলে। তবে হঠাৎ আনন্দের মেলায় যেন মেঘের হাট দেখা গেলো। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে একটা কল এলো ইশার ফোনে। বোনদের সাথে হাসি মজায় অন্যমনস্ক হয়েই কলটা রিসিভ করলো ইশা। কানে তুলে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো এক পরিচিত গলা,

“বউ, আমার বউ! আমাকে ছাড়া তুমি কিভাবে আছো বলো তো? একটাবারও কি মনে পড়ছেনা আমার কথা? মন কেমন করছেনা আমার জন্য?;

ইশার পদতল থমকে গেলো। এতো তুর্জর গলা। কিন্তু তুর্জ কি করে কল করবে? ও তো ব্লক করে দিয়েছিলো তুর্জর নাম্বার।

“ক্ কেন ফোন করেছেন?;

এক দলা অস্বস্তি নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো ইশা।

ঠিক তখনই সম্মুখে এসে দাঁড়ালো শ্রাবণ। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,

“কে কল করেছে?;

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে