টরেটক্কা পর্ব-০১

0
2145

টরেটক্কা – ১
Afsana Asha (কপি করা যাবে না)

‘তুই তো চায়ের রেপ করে দিয়েছিস!’ আঁতকে উঠে চিৎকার করলাম আমি!

আমার চাইতে বেশি আঁতকে উঠল খান্ডারনি দ্য গ্রেট মেয়েটা ‘কী? চায়ের রেপ করে দিয়েছি, মানে কী?’

আমি একটা ভুরু বেশ খানিকটা উঁচু করে বললাম ‘তুই চায়ে দুধ দিলি ক্যান?’

‘মানে কী? দুধ দেবো না? চায়ে দুধ দেবো না!’ ওকে বিভ্রান্ত দেখালো। বিভ্রান্ত হয়ে একশব্দ কমবেশি করে একই বাক্য দুবার বলল। একবার প্রশ্নবোধক আরেকবার বিস্ময়সূচক!

যদিও ভয় হচ্ছে, গরম তরল ভরা কাপটা এখন আমার মাথায় পড়ে কয়েক টুকরো না হয় তবুও নির্বিকার একটা ভাব ধরে বললাম ‘না। চায়ে দুধ দেওয়া মানে চায়ের রেপ করা!’

‘চায়ে দুধ দেওয়া মানে চায়ের রেপ করা?’ আহত ও অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ও।

‘হ্যাঁ। চায়ের লিকার হচ্ছে বিশুদ্ধতম স্বাদ, ভার্জিন লেডি। তার ভেতর অন্য কিছু দেওয়া মানে অবৈধ অনুপ্রবেশ, ভার্জিনিটি নষ্ট করা। তুই চায়ে দুধ ঢাললি, চাপাতার কনসেন্ট নিয়েছিলি?’

‘কন্সেন্ট?’

‘হ্যাঁ, কন্সেন্ট। নিসনি তো? তাহলে তো এটা রেপই।’

‘শোন। এখনই আমি তোকে দুধচিনিছাড়া এক কাপ লিকার চা করে দিচ্ছি।’

‘চিনি দেওয়া যায়। ওটা ভার্জিনিটি নষ্ট করে না।” উদাসকন্ঠে সিলিংফ্যানের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি।

ও চলে গেলে সোফায় বসে পড়লাম। সোফার উপর বসে পা নাচাতে শুরু করেছি। এই বাসার সোফাটা খুবই আরামদায়ক। বসলেই অর্ধেক ঢুকে যেতে হয়। এখানে বসলেই আনন্দিত মনে একটা ভাব আসে। কবিতা মাথায় আসে। একটা কড়াটাইপ কবিতা মাথায় এসে বসে আসে। সরসর করে লিখে ফেলতে হবে। মাত্র এক লাইনই মাথায় এসেছে তাই লিখতে পারছি না। এক লাইনই ব্যপক কড়া।

“তুই এক টলটলে দীঘি, তাতে ডুব দেওয়া বাকি”

এক লাইনে তো আর কবিতা হয় না, আরও কয়েকটা লাইন দরকার। এই আরও কয়েকটা লাইনের জন্য মাথা কুটা বাকি। কল্পনায় নিজের মাথা কুটছি, দীঘি এসে ঢুকল। হাতের পিরিচে একটা চায়ের কাপ। আমার জন্য লিকার চা করে এনেছে সম্ভবত।

‘ও মাই গড! ওহ মাই গড!’ বিড়বিড় করলাম আমি। এ আমি করেছি কী, এই মেয়ের নামে কবিতা লিখে ফেলেছি! সর্বনাশ! সর্বনাশের আরেক নাম এই দীঘি। সর্বনাশের নামই দীঘি!

‘শোন। খুব সামান্য এক কাপ চায়ের জন্য রেপ শব্দটা টেনে আনিস না। রেপ খুব ভয়াবহ ব্যাপার। লাইফটাইম ফিজিক্যাল এন্ড সাইকোলজিক্যাল ট্রমা, এটাকে এক কাপ চায়ের সাথে তুলনা করা যায় না।’

‘আমি তো যাস্ট এমনি এমনি বলেছি। সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই। চা টা ভালো হয়েছে। একদানা চিনি বেশিও না, একদানা কমও না। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের পাতায় যেরকম চায়ের বর্ণনা পাওয়া যায় ঠিক সেইরকম চা হয়েছে। অপূর্ব!’ আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললাম আমি।

‘অবশ্যই সিরিয়াসলি নেবো। এইভাবে হালকা চালে, ইয়ার্কি করে, রেপ, কন্সেন্ট এসব শব্দগুলোকে হালকা করে ফেলেছিস তোরা। সবকিছুকে নিয়ে ইয়ার্কি চলে না রাফিন!’

‘সর্বনাশের মাথায় বাড়ি! তুই তো বিরাট জ্ঞানী হয়ে গিয়েছিস! ভারী ভারী কথা বলছিস। তোর মোটা মোটা কথার চাপে আমি তো চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছিরে…! দ্যাখ দ্যাখ আমার গোলগাল চোখদুটো কেমন চ্যাপ্টা হয়ে তাকিয়ে আছে তোর দিকে…!’

দীঘি তার দীঘির মতো চোখদুটো তুলে সূচের মতো করে তাকালো। আপনারা মনে হয় বুঝতে পারছেন না, সূচের মতো কী করে তাকায়? এই যে মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে তাকিয়েই আমার চোখ গেলে দেবে, এটাকেই সূচের মতো তাকানো বলে। এই মেয়ের নাম আজ থেকে সূচ্যদৃষ্টি!

আমি এই সূচ্যদৃষ্টিকে থোড়াই কেয়ার করি। হাতের চা টা ওর মাথায় ঢেলে দিলে এই দৃষ্টি গলে নরম দীঘির মতো টলটলে হয়ে যেত। কিন্তু সেটা করা সম্ভব না। চা টা গরম। আগুনগরম। কীভাবে অনেকক্ষণ চা গরম রাখা যায় সেই কৌশলটা এই মেয়ের কাছ থেকে শিখে নিলে ভালো হতো। কিন্তু সেটা করা যাবে না। ওর কাছ থেকে কিছু শিখতে চাওয়া মানে ওর সুপিরিয়রিটি স্বীকার করে নেওয়া। সেটা এই বান্দা রাফিনের পক্ষে সম্ভব না। দুনিয়া উলটে আদুনি হয়ে গেলেও সম্ভব না। আমি চা টা কাপ উলটে কাপপিরিচসহই ফ্লোরে ফেলে দিলাম। চা ছিটকে সারা ফ্লোরে, কাচের কাপপিরিচও কয়েকখন্ড হয়ে ছড়িয়ে গেল। দীঘি প্রথমে একটা লাফ দিয়ে সরে গেল। তারপর অবাক হয়ে তাকালো।
এরপরে এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার হয়ে যাবে। মাথাটা সত্যিই চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যেতে পারে। আট নম্বর বিপদসংকেত মাথার উপর নাচছে। আমি রিস্ক নিলাম না। দৌঁড়ে বের হয়ে এলাম। পেছন থেকে দীঘির গালাগাল শুনছি ‘শয়তান, কুত্তা, বদ, হারামি, খান্নাস…’

ছিঃ এই মেয়েটার মুখ তো অতিশয় বিশ্রী! একেবারে খালের উপর চিৎ করা টয়লেটের মত নোংরা। ভার্সিটিতে পড়া একটা মেয়ের মুখ এত বিশ্রী হয় কীভাবে? আমি হতাশ হলাম। আমার পুরো জীবনটা নিয়েই আমি হতাশ। মানুষ কৃতকর্মের ফল পায় জীবন ধরে আর আমি জন্মেছিই কর্মের ফলভোগ করতে। নইলে এতমানুষ থাকতে এই খটখটে দীঘি আর আমরা প্রতিবেশী হব কেন? আমার আব্বু কেন এই জঙ্গলের ভেতর বাড়ি বানাবেন? সেই বাড়ির ভাড়াটিয়া কেন হায়াত আংকেলকে হতে হবে? হায়াত আংকেলের কেন একটাই মেয়ে থাকবে? সেই মেয়ে এত খান্ডারনি, দজ্জালনি কেন হবে? কেন? হোয়াই? হোয়াই দিস কোলাভেরি ডি?

নিজের জীবনের হতাশা নিয়ে হতাশ হয়ে হতাশা কাটানোর উপায় মনে মনে ভাবতে ভাবতে বাসায় ঢুকতেই মনে হলো জীবনটা আসলে এতটাও খারাপ না। খাবারের সুঘ্রাণ ছুটেছে। কী রান্না হয়েছে বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে পাবদা মাছের পাতলা ঝোল করেছে আম্মু। এই রান্নাটার জন্য আম্মুকে মাস্টারশেফ পুরস্কারটা দিয়েই দেওয়া যায় অনায়াসে। পানি পানি করে পানিঝোল রান্নার এই টেকনিকটা মা যদি কোনোভাবে আমার বউকে শিখিয়ে দিতো, বাকি জীবনটা আরামসে কেটে যেত। কিন্তু তার জন্য বউ তো দরকার। অন্তত এই পাবদা মাছের পানিঝোল রান্নার জন্য একটা বউ খুব জরুরি আমার জন্য।

বান্দার মনে যা আল্লাহর মনেও তাই। হাতধুয়ে খেতে বসেছি, আব্বু আমার বিয়ের কথা টানলেন। আমি লাজুক মুখে পাবদার পেটের তৈলাক্ত কাঁটা চিবোতে শুরু করেছি, আব্বু বললেন ‘দীঘিকে তোর কেমন লাগে?’
‘কেমন লাগে মানে? দীঘিকে কেমন লাগে মানে কী? ও এইখানে কী করছে?’
‘দীঘিরও তো পরীক্ষা শেষ হলো। হায়াত ভাই বলছিলেন ওকে বিয়ে দেবেন এবার৷ বিয়ের পরেই মাস্টার্স করবে। কথা বলতে বলতে তোর কথাও জানতে চাইলেন। এই চাকরি পেয়েছিস, এখন বিয়ে করবি কী না এইসব। বুঝলাম তোর ব্যাপারে ওনাদের আগ্রহ আছে। আর আমরাও মেয়েটাকে পছন্দ করি। তোদেরও ভাব আছে। তাই জানতে চাইছি। তোর মত হলে আমরা প্রস্তাব দেবো।’

‘দুনিয়া উল্টায়ে আনিদু হয়ে যাক, চাঁদ পৃথিবীরে বাদ দিয়া গার্লস স্কুলের দারোয়ানের পেছনে ঘুরুক, আমগাছে কাঁঠাল, কলা, লেবু, বিলম্ব, টমেটো, শসা – সব ধরুক। ওই দীঘিপাগলিকে আমি বিয়ে করব না। আমি বিয়েই করব না। বিয়ে শব্দটাই ভুলে যাব’ – ডাইনিং টেবিলের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিতে দিতে শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গিয়েছে আমার, গায়ে জোশ এসে গিয়েছে, মনে হচ্ছে কর্ণফুলীর পাড়ে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে দৃপ্তকন্ঠে নিজের স্বাধীনতার প্রচারপত্র পাঠ করছি। কিন্তু শ্রোতা দর্শকদের মাঝে কোনো বিকার দেখলাম না। কী এক চ্যাপ্টা পাবদা মাছের পাতলা ঝোল আর তার চাইতে পাতলা কবুতরের সাইজ মুরগির ঝোল, আরও তিনগুণ পাতলা হাতধোয়া পানির মতো ডাল, তাতেই গভীর মনোযোগ সবার। আব্বু তো আরও অসহ্য ,মাছের কাঁটাটাকেও এমনভাবে চাটছেন যেন এটা সবচেয়ে দামি কেভিয়ার! প্রথমে দুইঠোঁটে চেপে কাঁটাটাকে চাটলেন, তারপর প্লেটটা বুড়োআঙুলে চেটে পরিস্কার করলেন আর এখন একে একে আঙুলগুলোকেও চাটছেন।

আমার আম্মুও কম যায় না, সে পুরো কাঁটাটাকেই মুখের ভেতর চালান করে দিয়েছে, সূচ্যগ্র কাঁটাটুকুকেও ছাড়বে না সে। সেটাকে পানের মতো চিবিয়ে, রসটুকু খেয়ে উচ্ছিষ্ট বোনপ্লেটে ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল ‘খোকা, একটু আচার নে, মুখে রুচি আসবে!’
‘কতখানি রুচি আসবে? ওই দীঘিপাগলিকে বিয়ে করে ফেলার মতো রুচি আসবে?
‘শোন, মাথা ঠান্ডা কর। তুই বিয়ে করতে না চাইলে করবি না। জোর করে কি বিয়েশাদি হয় নাকি? তুই না চাইলে আমরা এই নিয়ে আর কথাই বলব না।’
‘বলব না, মানে কী? বললা কেন?’ টেবিলে দুটো চাপড় মারলাম বাঁহাত দিয়ে, সংসদ অধিবেশনের কোনো জোরদার ইস্যুতে কোরামে অংশ নেওয়ার মতো করে।
‘দেখ এত মিষ্টি একটা মেয়ে। আমরা ভাবছি এত মাখামাখি তোদের, দুইজন, দুইজনকে ছাড়া থাকতেই পারিস না তাই…’
‘মানে কী? মাখামাখি কোথায় দেখলে? কোথায় দেখলে মাখামাখি সেটা আমাকে বলতে হবে তোমার। ওই পাগলি আমার পেছনে আঠার মতো লেগে থাকে। আমি কবে ওকে ছাড়া থাকতে পারলাম না?’
‘আচ্ছা যা। মাফ কর। দীঘি চ্যাপ্টার বাদ। তা বিয়ে তো করবি না কি? দীঘি বাদেও দেশে অনেক মেয়ে আছে।’
আমি জানি দীঘি বাদেও অনেক মেয়ে আছে। অবশ্যই আছে। না থাকলেও সমস্যা নেই। পাবদা মাছের ঝোল খাওয়ার জন্য বিয়ে করার দরকার নেই। সেরকম হলে আমি পাঙাস মাছ দিয়ে ভাত খাব। সারাবছর শুকনো শসা চিবিয়ে খাব!

তবে আম্মুর কথাটা সত্যি, স্বভাব যাই হোক না কেন, মেয়েটা অতীব মিষ্টি। মিষ্টি টু দ্য পাওয়ার ইনফিনিটি। এই কথা শুনেই আপনারা ধরে নিলেন এই মিষ্টি ইনফিনিটির সাথে আমার কোনো ইঞ্চি ইঞ্চি আছে? আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে আদৌ এরকম কিছু ঘটেনি, এই ইনফিনিটির সাথে আমার ইঞ্চি ইঞ্চি, মিটার কিলোমিটার কিছু নেই।

আর মিষ্টি হলেই হবে? আপনারাই বলেন যে মেয়ে সামান্য চা নিয়ে এইরকম বিশ্রী মুখ করতে পারে তাকে বিয়ে করা যায়?

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে