ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৯
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
সকাল বেলা মিনু বেলীকে দেখে অনেকটাই অবাক হয়ে যায় । সে ভেবেছিল আজ সকালে এখানে অন্যকিছু হবে । হয়তো সে দেখবে তার বেলী ভাবী আর নেই । তাই রান্নাঘরে বেলীকে দেখে অনেক চমকে যায় মিনু । মিনু এদিক ওদিক তাকিয়ে পা টিপে টিপে বেলীর কাছে যায় ।
– ওই ভাবী , ভাবী,,,,,,,?
– জ্বি , বলো মিনু , ঘুম ভেঙেছে তোমার ?
– আপনে কি বেলী ভাবী ,,,,?
– এটা কি বলো মিনু ?
– একটা চিমুর দেই ?
– এই মিনু কিসব বলো আবলতাবল ?
– ব্যাথা ফাইলে চিক্কুর দিয়েন ,
এইবলে মিনু বেলীর হাতে একটা চিমটি কাটে ৷ চিমটিটা বেশ জোরে কাটে সে আর বেলীও ব্যাথা পেয়ে উফফফ করে উঠে । এইবার মিনুর বিশ্বাস হয় যে এটাই আসল বেলী । এতক্ষণ সে বেলীকে বেলী নয় বেলীর ভূত ভেবেছিল ।
– চিমটি দিলা কেন ?
– আমি ভাবছি আপনে ভূত , যাক আল্লাহ সারাইছে । আপনে মরেন নাই , বাইচা আছেন ।
– কি সব বলো উলটাপালটা । যাও চোখে মুখে পানি দিয়ে আসো ।
– ভাবী ফিডাইছে নি আপনেরে ভাইয়ে ?
– মারবে কেন আমাকে ?
– হেইতে তো কতায় কতায় ফিডায় আপনেরে ।
– হ্যাঁ , তবে কাল মারে নাই ।
– কিয়াচ্ছে তাইলে ,
এইবার বেলী আসলেই বিরক্তবোধ করছে । মিনু উল্টাপাল্টা বলা শুরু করলে করতেই থাকে তো করতেই থাকে । বন্ধ আর হয় না । এদিকে ইরফানের জন্যে সব নাস্তা বানিয়ে টেবিলে সাজিয়ে দেয় বেলী । কিছুক্ষণ পর ইরফান রুম থেকে বেরিয়ে সোজা বেরিয়ে যায় বাসা থেকে । হ্যাঁ আজ ইরফান নাস্তা না করেই অফিসে চলে গেছে । বেলীর উপর থেকে রাগটা এখনও কমাতে পারেনি ইরফান । তার চিন্তা অনুযায়ী বেলী তাকে অপমান করেছে । বেলী তাকে কথা দিয়ে অপমান করেছে । সে জন্যে আজ সে বেলীর দিকে একবারের জন্যে তাকায় নি । ইরফানের এইভাবে না খেয়ে চলে যাওয়াটাও বেলীর সহ্য হয়নি । হয়তো কাল রাতে যা হয়েছিল তা ইরফানের পছন্দ হয়নি । কিন্তু বেলী কি করতে পারে , সে যে অসহায় । কাল ধরা দিলে যন্ত্রণা যে আরও কয়েকগুন বেড়ে যেতো তার । সেই যন্ত্রণা হয়তো বেলীকে একেবারেই শেষ করে দিত । মিনু এসে বেলীকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেলীর সাথে কথা বলে ,
– ভাবী,,,,,, ও ভাবী,,,,,,?
– হু ,
– ভাইয়ে খাইয়া গেলো না ?
– উহু ,
– কিল্লাই , খাইয়া গেলো না কিল্লাই ?
– হয়তো অভিমান নয়তো রাগ ।
– অভিমান আবার রাগ , বাপুরে বাপু এডি মাতাত ঢুকে না আমার , কি হইছে খুইল্লা কইবেন নি একটু ?
– অভিমান যা প্রিয়জনের সাথে করা যায় , আর রাগ যা অপছন্দের মানুষের সাথে করা যায় । এখন আমি তো তোমার ভাইয়ের প্রিয়জন নই তাই অভিমানটা আমার জন্য প্রযোজ্য না । তাই রাগটাই হয়তো আমার জন্যে বরাদ্দকৃত ।
– কিছুই বুঝি নাই ,
– খেয়ে নেও , খেয়ে একটু হাতে হাতে সাহায্য করো আমাকে ।
– আইচ্ছা ।
এইদিকে অফিসে কাজ করে যাচ্ছে ইরফান । প্রমোশন হয়েছে তার , তার এই প্রমোশনে কোথাও না কোথাও বেলীও জড়িত । বেলী তার হয়ে সেম্পল বানিয়েছে তা যে সবার এত পছন্দ হবে ভাবে নি সে । অফিসের সবাই ইরফানকে বাহবা তো দিচ্ছে কিন্তু ইরফান তো জানে এই বাহবার আসল হকদার আসলে কিন্তু বেলী । আবার বেলীর কালকে রাতে বলা কথা গুলোও মনে পড়ে যায় ইরফানের । বেলী তাকে অপমান করেছে , তাই বেলীর উপর রাগও হচ্ছে । এরই মাঝে একটা ফোন আসে । ফোন হাতে নিতেই দেখে রুবির বাবা জাফর সাহেব ফোন দিয়েছেন । ভদ্রলোক আর সময় পেলেন না , না চাইতেও ফোনটা রিসিভ করে ইরফান ।
– আসসালামু আলাইকুম ,
– ওয়ালাইকুম আসসালাম , ইরফান কেমন আছো ?
– ভালোই , আপনি ?
– ভালো , বাসায় আসতা যদি । রুবিকে নিয়ে যাও ।
– রুবি কি ৪/৫ বছরের বাচ্চা যে আমি ও-কে নিয়ে আসবো ।
– ইরফান রাগারাগি তো অনেক হইছে , এইবার আসো ।
– আগেরবার আপনার মেয়েকে ধমক দেয়াতে আমাকে নিয়ে দরবার বসাইছেন , এইবার তো থাপ্পড় দিয়েছি , পারলে কেইস করেন ।
– ইরফান,,,,,,,,,,,,,,?
– আপনি কোন যুক্তিতে আমাকে আপনার বাসায় আসতে বলেন , আপনার মেয়ে রাত ১০ টার পর একা একা বাসা থেকে বের হয়ে গেছে , আপনার মেয়ের বিষ কত খেয়াল করছেন আপনি ? আর ও ১০০ টার মধ্যে ৯০ টা বলে মিথ্যা । ও যখন খুশি বের হয় যখন খুশি বাসায় আসে । ওর ছেলে বন্ধুদের অভাব নেই । মেয়ে বন্ধুদের কথা তো বাদই দিলাম । আমি কষ্ট করে টাকা কামাই করি আর আপনার মেয়ে তা তুষের মত উড়ায় । কেন আমার টাকার কি কোন বরকত নেই ? শুনেন , আপনার মেয়ে আমাকে কি ওর গোলাম পাইছে ? ২৪ ঘন্টা আমাকে বেলীর নামে নানান রকম কথা বলে যার মধ্যে ১০০ টাই মিথ্যা বলে । আর আমিও বলদের মত ওর কথা শুনে ওই মেয়েটাকে মারধর করছি মেয়েটা টু-শব্দ অবদি করে নাই এই পর্যন্ত । এত মিথ্যা কেন , আমি এখন অপরাধী হয়ে গেছি , কেন প্রথম বিয়ে করলাম আর প্রথম বিয়ে করার পর কেনই বা দ্বিতীয় বিয়ে করলাম । আপনার মেয়েকে একটা চড় মারাতে আপনার মেয়ে বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠেছে । একবার কি এটা ভেবে দেখছেন যেই মেয়েটাকে আজকে ৭ টা মাস আমি আপনার মেয়ের কথায় কত গালমন্দ করছি কত মারছি ওই মেয়ে তো চুপ করে পড়ে আছে । এক কাজ করেন , আপনার মেয়েকে কেবিনেটের মধ্যে সাজিয়ে রেখে দিন , দয়া করে আমাকে বিরক্ত করবেন না । রাখতেছি , আসসালামু আলাইকুম ।
লাইন কেটে দেয় ইরফান । ইরফান লাইন কাটার পর , জাফর সাহেব গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে যান । পরিস্থিতি ঘোলাটে আকার ধারণ করেছে । এখন যতই ঠিক করতে চাইবে ততই আরও সমস্যা বাড়বে । তাই আপাতত চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করছেন জাফর সাহেব । মেয়ে যখন সতীনের ঘর বেছে নিয়েছে তখন তিনি কি করবেন আর । নিজেকে ব্যর্থ বাবা ভাবা ছাড়া আর কিছুই করণীয় নেই তার ।
অন্যদিকে , রুবির বাবার লাইন কাটার পর ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করতে যাবে আবার ফোনটা বেজে ওঠে ইরফানের । এইবার মেজাজ বিগড়ে যায় । কে ফোন করেছে না দেখেই রিসিভ করে চেচিয়ে ওঠে ইরফান ।
– এই কেএএএ ?
– হেলো বাজান আমি , বেলীফুলের মায় ।
কথাটা শুনে থতমত খেয়ে যায় ইরফান । তাড়াতাড়ি কান থেকে মোবাইল সামনে এনে দেখে বেলীর মায়ের নাম্বার । অবশ্য নাম্বার সেভ করে নাই শুধু লাস্টে 359 এই তিনটা ডিজিট দেখে চিনতে পেরেছে যে এটা বেলীর মায়ের নাম্বার । ইরফান মন মনে লজ্জিত তার একবার নাম্বার দেখা উচিত ছিল , এইভাবে চেঁচানো উচিত হয়নি তাও একজন মায়ের বয়সী মহিলার সাথে । ইরফান নিজেকে দমিয়ে নিয়ে কথা বলে ,
– আসসালামু আলাইকুম , জ্বি কেমন আছেন ?
– ভালা আছি বাজান , তোমরা কেমন আছ ?
– জ্বি ভালো , কিছু বলবেন ?
– হ বাজান , বেলীফুলে কই ?
– বেলী তো বাসায় আর আমি অফিসে ।
– বাজান একটা কতা কইবার চাইছিলাম আমি ?
– হ্যাঁ বলেন ,
– আইজ্জা তো বুধবার , শুক্কুরবারে বেলীফুলের বাপের মিত্তুবাসসিকি , তোমার বাবায় মনে অয় ফোন দিবো তোমাগোরে ।
– ওহ আচ্ছা ,
– তই বাজান মাইয়াডারে লইয়া যদি আসতা গেরামে ?
– আমার তো অফিস , কিভাবে আসি ?
– আরে বাজান এমনে কইও না , মাইয়াডার বাপের মিত্তুবাসসিকি মাইয়াডায় না আইলে মনডা ছোড অইয়া যাবে বাজান ।
– আচ্ছা আমি বাসায় গিয়ে বেলীকে বলবো আপনার সাথে কথা বলতে কেমন ?
– আইচ্ছা বাজান , তইলে রাহি এহন ?
– জ্বি আচ্ছা ,
– ভালা থাহো তোমরা ,
বেলীর মায়ের লাইন কাটার পর কিছুক্ষণ ইরফান মাথা নিচু করে রাখে । অনেক কিছুই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তার । ইরফান সবটা জানে না তবে তার বাবার কাছে শুনেছিল বেলীর বাবা মারা যাওয়ার দুইমাস পরই বেলীকে তার সাথে বিয়ে দেয়া হয় । বেলীর বাবার সাথে তার বাবা কথা দেয়ার ১৫ দিনের মাথাতেই বেলীর বাবার এক্সিডেন্ট হয় আর সেখানেই spot death ঘটে ।
– বেলী তখন এতিম ছিল , সদ্য বাবাকে হারিয়ে এতিম হয়ে যাওয়া মেয়েটাকে আমার উপর ভরসা করে ওর সব দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছিল । আর সেই আমি কিনা বিয়ের রাতেই ও-কে ? আর তারপর একদিন জুতা দিয়ে পর্যন্ত মেরেছিলাম । বাপ মরা এতিম মেয়েটা সেইদিনও চুপ ছিল আর আজও চুপ করেই আছে । কেন বুঝলাম না সেদিন ওর কষ্টটা ? কেন দেখলাম না ওর বাবা হারানোর হাহাকারটা । বেলী আমার কাছে অবহেলিত , আসলেই অবহেলিত সে আমার কাছে । তাকে তার হক দিতে কার্পণ্য করলাম আমি ৷ অথচ এই বেলীই আমার জন্যে আজও ভেবে যাচ্ছে ।
এইসব ভাবছে আর মনে মনে আফসোস করছে ইরফান । ঝোকের বশে রুবির সাথে সম্পর্ক করা আর বিয়েও করে ফেলা । সবটাই ছিল তার ভুল পদক্ষেপ । তবে এখন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে ।
[ বিঃদ্রঃ একটা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবা না থাকা টা যে কতটা কষ্টের তা একমাত্র তারাই বুঝে যাদের বাবা নেই । এবার সে ছেলে হোক কিংবা মেয়ে । সেই পরিবারে যদি ছেলে থাকে তাহলে হয়তো একটু হলেও চিন্তা কম থাকে । কিন্তু যেই পরিবারে ছেলে না থেকে দুই থেকে তিনটা মেয়ে থাকে তাদের অত্যন্ত কষ্টের মাঝে দিন কাটাতে হয় । কেউ একজন বলেছিলেন , বাবা না থাকাটা তেমন কিছু না , ঘুরে দাঁড়ানোটাই প্রয়োজন । হ্যাঁ আমিও মানি তা কিন্তু একবার এটা কি ভেবে দেখেছি আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের কি হয় , তাদের মধ্যেই হয়তো একজন হয় যে বেলী হয়ে জন্মায় । যাদের শিক্ষাটাও ঠিকঠাক মত হয় না । সংসারের দায় সাড়তে গিয়ে মেয়ের ভালোর জন্য দুঃখিনী মা তো বিয়ে দিয়ে দেয় কিন্তু সবার কপালে বর ভালো পড়ে না । কেউ জুয়ারি , কেউ বা মদের নেশায় মাতাল , কেউ বা বউ পিটানোতে ওস্তাদ আর নয়তো কেউ বা নোংরা পল্লীতে যেতে মগ্ন এইসবই কপালে জুটে । ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যাপারে আমিও একমত , কিন্তু আমরা কতটা নিরাপদ । যেখানে নিজের ঘরেই আমরা নিরাপদ নই । যেখানে বাবার সমতুল্য শিক্ষকের হাতে ধর্ষিত হতে হয় , সেখানে কোথাও চাকরি করাটাও যে ১০০% নিরাপদ তাও কিন্তু নয় । তবুও আমরা নারীরা পিছিয়ে থাকার পাত্রী নই । আলহামদুলিল্লাহ আমরাও সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছি । ১০০% এর মধ্যে হয়তো ৫০% মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের কর্মসংস্থান খুজে নিচ্ছি । আর বাকি ৫০% এর মধ্যে ৩০% স্বামীর ঘরে আলহামদুলিল্লাহ হয়তো ভালো থাকি আর বাকি ২০% হয়তো কেউ স্বামীর ঘরে কষ্ট , অনাহার , কিংবা অত্যাচার হয়ে অকালেই প্রাণ হারাচ্ছি । মাথার উপর বাবার ছায়া থাকাটা অত্যন্ত আবশ্যক । বিশেষ করে মেয়েদের । একজন বাবা আর বড় ভাই থাকলে একবার মেয়েকে চোখের দেখা দেখে তো আসতে পারে । আর যাদের কপাল থেকে আল্লাহ পাক এই দুটো জিনিস কেড়ে নেন তাদের কপাল হয়ে ওঠে বেলীর মত । আবার অনেক জায়গায় বাপ মা মরা এতিম মেয়েও শ্বশুরবাড়িতে রাজরানীর মত দিন কাটাচ্ছে ৷ তারাই সেই ৩০% এর একজন । আল্লাহ পাক সকল মা বোনকে ভালো এবং সুস্থ থাকার তৌফিক দান করুন । সকল মা বাবাকে সুস্থ রাখুন । আল্লাহ পাক সকল মৃত বাবা মাকে জান্নাতবাসী করুন । আমীন ]
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে আছে ইরফান । আজ বেলীকে একবারের জন্যেও ডাকে নি ইরফান । কফির জন্যেও বলেনি কিছু । বেলী দরজা খুলার পর সেইযে রুমে এসেছে আর বের হয় নি ইরফান । বেলী ইচ্ছা করেই কফি বানিয়ে রুমের সামনে গিয়ে দরজায় নক করে । ইরফানের সাড়া পেয়ে রুমে যায় বেলী । ইরফান তখন বিছানায় শুয়ে আছে । ‘ আপনার কফি ‘ বলে বিছানার পাশে রাখা টেবিলের উপর কফির মগটা রেখে দরজার কাছে যেতেই ইরফান ডাক দেয় বেলীকে ।
– দাঁড়া ,
ইরফানের ডাকে পা জোড়া সেখানেই থেমে যায় বেলীর । পিছনে ফিরে ইরফানের দিকে তাকায় সে । ইরফান তখন মোবাইলে কি যেনো করছিল ।
– জ্বি ,
– তোর মা ফোন করছিল , নেহ কথা বল ।
– মা ফোন দিছিলো , কখন ?
– দুপুরে , নেহ কথা বল ।
রাজ্যের সবটুকু সুখ হয়তো তার কপালে ছিল এই মুহুর্তে তার তেমনটাই মনে হচ্ছে । তখন ইরফান আবার বলা শুরু করে ,
– সেইদিনও একবার ফোন দিছিল , কাজের চাপে বলতেই ভুলে গেছিলাম আমি ।
– সমস্যা নাই , রিসিভ করে না তো ?
– আবার কল ব্যাক কর ।
– কিভাবে করে ?
– কেন তুই টাচ মোবাইল ইউজ করতে পারস না ?
– আমি কখনো চালাই নাই মোবাইল , মায়ের আর বাবার বাটন মোবাইল ছিল ওইগুলাই দেখছি ।
– ওহ , দে আমার কাছে ।
– মোবাইল টা ভালোই বড় ,
– হ্যাঁ , feature 6.5 IPS LCD touch screen .
– ওহ , মায় ধরছে ?
– নাহ ,
– আরেকবার দেন ।
বেলীর কথায় ইরফান আরেকবার ফোন দেয় বেলীর মায়ের নাম্বারে । কিছুক্ষন পর বেলীর মা ফোন রিসিভ করে আর ইরফানও বেলীকে মোবাইলটা এগিয়ে দেয় । হাসি মুখে মায়ের ফোনটা কানে নিয়ে ‘ হ্যালো ‘ বলে ওঠে বেলী ।
– হ্যালো মা ,
– হেলো বেলীফুল ,
– মা কেমন আছ ?
– আমি ভালা আছি , তুই কেমন আছস ?
– আমিও ভালা আছি মা , কি করো মা তুমি ?
– পানি আনতাম গেছিলাম ।
– খাইছো নি মা ?
– হ , তোরা খাইছত নি ?
– এহনও খাই নাই মা , একটু পরেই খামু ।
বেলীর কথা শুনে ইরফান বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে । বেলী একই মুখে দুই ধরনের কথা বলতে পারে । মায়ের সাথে কথা বলছে সে তাই আঞ্চলিক ভাষায় আবার এখানে সবার সাথে শুদ্ধ ভাষায় । বেলী যদি তেমন পড়াশোনার সুযোগ পেত তাহলে হয়তো রুবির থেকেও উপরে যেতে পারতো । তারপর হঠাৎ করেই বেলী বলে ওঠে ,
– আমি কেমনে আসমু মা ?
– তুই আইবি না ?
– ওর তো অফিস আছে মা ,
– জামাইরে বল যাতে আফিসের থিকা ছুটি নেয় ।
– দেখি মা , কাইলকা জানামু তোমারে কেমন ?
– আইচ্ছা ,
– রাখি তাইলে , ঘুমাইয়া যাও মা ।
– হু ,
বেলী জানালার পাশে এসে কথা বলছিল । খুব আস্তে আস্তেই বলছিল । কিন্তু তবুও কিভাবে জানি ইরফানের কানে পৌঁছে যায় তার কথা গুলো । এইদিকে বেলীর বুক ফেটে কান্না আসছিল , দেখতে দেখতে তার বাবা মারা গেছে একটা বছর হয়ে গেছে । বাবার মুখে বেলীফুল ডাকটা এখনও তার কানে বাজে । চোখের পানি গুলো কোন রকম আটকে ইরফানকে মোবাইলটা দিয়ে রুম থেকে চলে যেতে নেয় বেলী । তখনই ইরফান আবার ডাক দেয় ,
– কিরে , কিছু না বলেই চলে যাচ্ছিস যে ?
– আসলে ,
– কি ?
– মা বলতেছিল শুক্রবারে বাড়িতে যাইতে । আমার বাবার প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী । মিলাদ দিবে মা ।
– তুই কি বললি ?
ইরফানের কথায় মাথা নিচু করে রাখে বেলী ।
– যাবি তুই ?
– আপনার তো অফিস আছে ।
– তুই যেতে চাস ?
– অনেকদিন মারে দেখি না ।
– ঠিকাছে কাল আমি হাফ টাইম করবো অফিসে । বিকালে যাবো আমরা ।
ইরফানের মুখ থেকে এই কথাটা শুনে বেলী যে কত্ত খুশি হয়েছে যা বলার মত না । মুখে প্রকাশ না করলেও চোখের পানি পড়তে তার দুই মিনিটও লাগে নি বেলীর । আজ প্রায় ৭ মাসের উপর হয়েছে সে তার মাকে দেখে নাই । তাই চোখের পানি আটকাতে পারে নি সে । ইরফানকে কি বলবে বুঝতেছে না বেলী । আর ইরফানও বেলীর চোখের পানি গুলো দেখে নেয় ।
– কাঁদিস না , নিয়ে যাবো কাল । কেমন ?
– আচ্ছা ।
– যাহ গিয়ে জামাকাপড় গুছিয়ে নে ।
– হু ,
– বেলী শুন ?
– হু ,
ইরফান কিছুক্ষণ বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে । বেলীর মুখের দিকে তাকালে একটা শান্তি আসে মনে । বেলী আসলেই তেমন সুন্দর না তবে ওর মনটা পবিত্র আর এটাই ওর আসল সৌন্দর্য । একটু কাঁদাতেই কেমন মায়া লেগে গেছে চেহারাটায় । আর এতটা দিন যে সে মারতো তখন জানি বেলীর কেমন লাগতো । তবুও কিছুই বলতো না বেলী ।
– কিছু বলবেন ?
– তুই মন খারাপ করিস নাহ ।
– এখন আর মন খারাপ লাগে না । এখন শুধু বাবাকে মনে পড়ে অনেক । বাবার মুখের ‘বেলীফুল ‘ ডাকটা আজও কানে ভাসে । বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে তখন । কান্নাও করি পরে আবার সব ঠিকঠাক । আমার বাবা আমাকে ফাঁকি দিয়ে আর আমার মাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে । এমন জায়গায় গেছে যেখানে বাবা বলে ডাক দিলেও আমার বাবা আর শুনতে পারবে না আর সাড়াও দিবে না । আর বেলীফুল বলে ডাকবে না । বাবা যখন বেলীফুল বলে ডাক দিত তখন আমি সাড়া না দিলে বলতো আমার মা ডায় কইরে , আমার ফুল ডায় কই । এখন আর কেউ বলে না আমাকে আমার মা ডায় কই , আমার ফুল ডায় কই৷
এইসব বলতে বেলী গুমরে কেঁদে ওঠে । এক দৌড়ে ইরফানের রুম থেকে বেরিয়ে যায় সে । ইরফান কিছুই বলার সুযোগ পায় নি । বিছানায় বসে মুখে হাত দিয়ে কিছু একটা ভাবছে সে । কেন জানি আজ নিজের বুকেও হাহাকার লাগছে ইরফানের । চোখ দিয়ে এক ফোটা পানিও পড়ে গেছে । কিন্তু কি যেনো ভেবে তার পর পরই কাকে যেনো একটা ফোন করে সে ।
.
.
চলবে…………….