জ্যামিতিক ভালোবাসা পর্ব-১১

0
1121

#জ্যামিতিক_ভালোবাসা-১১ তম পর্ব
©শাহরিয়ার

— ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে একাকার দু’জন, এদিকে দৌঁড়ে সোজা বাড়িতে যেয়ে পৌঁছাইছে মিলু। ইকরা সোহানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো বাড়িতে যাবে নাকি এখানে দাঁড়িয়েই ভিজবে?

সোহান:- বাস্তবতায় ফিরে এসে হুম চল।

— বলেই ইকরার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো, ইকরা শক্ত করে সোহানের হাত চেঁপে ধরে হাঁটা শুরু করলো। দু’জন কথা বলতে বলতে বাড়ির খুব কাছাকাছি চলে আসলো। সোহান ইকরার হাত ছেড়ে দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে বাড়ির ভিতর ঢুকলো।

ফুফু:- দু’জনকে ভিজে বাড়ির ভিতর ঢুকতে দেখে ফুপু বলে উঠলো তাড়াতাড়ি জামা কাপড় চেঞ্জ করে নে না হলে দু’জনের ঠাণ্ডা লেগে যাবে।

— দু’জন দৌঁড়ে নিজেদের রুমে চলে যায়, ইকরা রুমে যেতেই দেখতে পায় মিলু জামা চেঞ্জ করে কম্বল মোড়া দিয়ে বসে আছে। মিলু বলে আপু কি ঠাণ্ডা। ইকরা বলে কোথায় এতো ঠাণ্ডা তুই অল্প ভিজেছিস তাই তোর এতো ঠাণ্ডা লাগছে। বলেই হাসতে হাসতে ঘরের সাথে এটাস্ট ওয়াশ রুমটার ভিতর চলে গেলো ইকরা। এদিকে ইকরার কথার কিছুই বুঝতে পারলো না মিলু। সোহানও নিজের রুমে এসে জামা কাপড় নিয়ে সোজা ওয়াশ রুমে চলে গেলো। দু’জনেই অল্প কিছু সময়ের ভিতর শাওয়ার নিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে বের হলো। ইকরা বের হয়ে দেখতে পেলো মিলু কম্বলের নিচে আরাম করে ঘুমিয়ে আছে। ভেজা চুল গুলো মুছতে মুছতে যেয়ে সোহানের ঘরের দরজায় থাক্কা মারতেই খুলে গেলো। সোহান তখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। শব্দ হবার কারণে পেছনে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেলো তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ইকরা ঘরে ঢুকেছে।

ইকরা:- ছেলে মানুষের এতো সময় লাগে নাকি ফ্রেস হবার জন্য?

সোহান:- আড় চোখে ইকরার দিকে তাকিয়ে কেন বাড়ি থেকে বের হয়ে আবার ভিজবো নাকি?

ইকরা:- আমি এমনটা বলছি নাকি? বলতে বলতে যেয়ে খাটের উপর বসে পরলো।

— সোহান ড্রেসিং এর সামনে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে খাটের উপর বসে থাকা ইকরার দিকে হাঁটা শুরু করলো। ইকরার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ভেজা চুলে হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই ইকরা কি করছো তুমি? সোহান কোন কথা না বলে নিজের মুখটা নিচের দিকে নামাতে শুরু করে, ইকরার মুখোমুখি হতেই ইকরা দু’চোখ বন্ধ করে নেয়। সোহান অপলক চেয়ে রয় ইকরার দিকে ঝুম বৃষ্টি আর দক্ষিনা বাতাসে ইকরার খোলা চুল গুলো হালকা হালকা উড়ে এসে সোহানের গাল স্পর্শ করে দিচ্ছে। সোহান মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রয়েছে সামনে বসা অপরূপ সুন্দরি মেয়েটার দিকে। মনে হচ্ছে এমনি করে তাকিয়ে থেকে জনম জনম কাটিয়ে দেয়া যাবে। হঠাৎ করেই ইকরা চোখ খুলে তাকাতেই সোহান অপস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো।

সোহান:- চল বাহিরে যাই। সবাই হয়তো অপক্ষা করছে।

ইকরা:- হুম চলো।

— দু’জন রুম থেকে বের হয়ে বসার রুমে যেয়ে ঢুকলো। সেখানে সকলে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ফুপু অল্প সময়ের ভিতর চাল ভাজা নিয়ে আসলো। বৃষ্টির দুপুর সাথে চাল ভাজা ব্যপারটা একদমই অন্য রকম। সকলে মুঠো ভর্তি চাল ভাজা খাচ্ছে আর খুশ গল্প করছে। এদিকে ফুপুরা সকলে মিলে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলো অনেক মাছ ধরা হয়েছে দুপুরে মাছ রান্না হবে। মিলুও কিছু সময় পর ঘুম থেকে উঠে বসার রুমে চলে আসলো সকলের সাথে আড্ডায় যোগ দিলো।

বাবা:- আহ কতদিন পর এমন বৃষ্টির দিনে টিনের চালের টং টং শব্দের সাথে মিলিয়ে চাল ভাজা খাচ্ছি। শহরে বৃষ্টির শব্দই পাওয়া যায় না।

ফুপা:- আপনারাতো আসেনই না। গ্রামে থাকার যে কি এক আনন্দ তা বলে বুঝাতে পারবো না।

চাচা:- সত্যিই গ্রামে আসলে মনে হয় বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি কিন্তু কি করবো বলো, ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা করেই আর গ্রামে আসা হয়না।

ফুপা:- তা যা বলেছেন, সত্যিই দেখতে দেখতে ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে যাচ্ছে। সকলেরই প্রায় পড়া লেখা শেষের দিকে। সামনেই বিয়ে নিয়ে ভাবতে হবে।

বাবা:- হ্যাঁ তাতো হবেই সকলেই এখন বিয়ের উপযুক্ত হয়ে গেছে।

— গল্প করতে করতে রাসেল আর জুহিও চলে আসলো দু’জনেই ভিজে গেছে। টপটপ করে শরীর থেকে পানি পরছে। দু’জন সবাইকে সালাম দিলো। রাসেল এক দৃষ্টিতে ইকরার দিকে চেয়ে রয়েছে দেখে ইকরা অন্য দিকে চোখ ফেরালো। রাসেল আর জুহি সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজেদের রুমে চলে গেলো ফ্রেস হবার জন্য।

— দুপুরের খাবার খেয়ে যে যার রুমে চলে গেলো। এখন বৃষ্টি নেই দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে এলো। সোহান দক্ষিনের জানালার কাছে বসে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে। ইকরা দরজা খুলে কখন এসেছে সেদিকে সোহানের খেয়াল নেই। ইকরা খাটের উপর বসে সোহানকে বললো বসে থাকবে নাকি কোথাও বের হবে। সোহান চমকে ঘুরে তাকিয়ে।

সোহান:- কখন আসলি?

ইকরা:- এইতো আসলাম। বসে থাকবে নাকি বের হবে?

সোহান:- হ্যাঁ বের হবো তুই কি রেডি?

ইকরা:- হুম রেডি বললেই চলে।

সোহান:- আজ নদীর ধারে ঘুরতে যাবো তুই এক কাজ কর যেয়ে শাড়ি পরে নে।

ইকরা:- নদীতে ঘুরতে গেলে শাড়ি পরতে হবে কেন?

সোহান:- শাড়িতে তোকে অনেক সুন্দর লাগে।

ইকরা:- সেটা জানি।

সোহান:- তাহলে যা দেরী করছিস কেন?

— ইকরা আর কথা না বলে রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে চলে আসলো। ব্যাগ খুলে খুঁজে আকাশি রঙের একটা শাড়ি বের করলো। ওয়াশ রুমে ঢুকে শাড়িটা পরে বের হতেই সোহানকে খাটের উপর দেখতে পেলো। মিলু আর সোহান গল্প করছে।

সোহান:- হয়েছে তোর?

ইকরা:- হ্যাঁ আমি রেডি চলো।

মিলু:- কোথায় যাবে তোমরা? আপু তোমাকে আজ পরীর মত লাগছে।

— মিলুর কথায় বেশ লজ্জা পেয়ে গেলো ইকরা।

সোহান:- গ্রামটা একটু ঘুরে দেখে আসি। তোদের সবাইকে নিয়ে কাল যাবো আজ আমরা একটু ঘুরে আসি।

মিলু:- যাও যাও বুঝিতো আমি সব বুঝি।

সোহান:- মিলুর কান টেনে ধরে বেশী বুঝা ভালো না।

— বলেই দু’জন হাসতে হাসতে বের হলো। বাহিরে তখন কেউ নেই সবাই হয়তো নিজেদের রুমে রেস্ট নিচ্ছে তাই কাউকে কিছু বলতে হলো না। দু’জন বাড়ি থেকে বের হয়ে হাঁটা শুরু করলো।

ইকরা:- নদী কত দূরে?

সোহান:- বেশী দূরে না আর মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই পেয়ে যাবো।

— দু’জন হাতে হাত রেখে গল্প করতে করতে হাঁটতে শুরু করেছে। কিছু সময় হাঁটার পর নদীর কাছে চলে আসলো। নদীতে তখনো তেমন পানি হয়নি। ঘাটে সাঁরি সাঁরি নৌকা বাঁধা। চোখ জুড়িয়ে যায় নদীতে তাকালে নদীর ওপারেই কাশফুল দেখা যাচ্ছে। ইকরার মনে স্বাদ জাগে সে ফুল ছুঁয়ে দেবার জন্য। সোহান বুঝতে পারে ইকরা মনে মনে কি চাচ্ছে।

সোহান:- কিরে যাবি ঐই পাড়ে?

ইকরা:- মাথা নাড়িয়ে হুম যাবো।

সোহান:- ঘাটে বাঁধা নৌকা নিয়ে বসে থাকা মাঝিকে বলে ওদের ও পারে নিয়ে যাবার জন্য।

— সোহান নৌকায় উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় ইকরার দিকে, ইকরা শক্ত করে সোহানের ধরে উঠে আসে নৌকাতে। দু’জন মিলে হেঁটে এগিয়ে যায় নৌকার শেষ মাথার দিকে। মাঝি নৌকা চালাতে শুরু করে। বাতাসে ইকরা চুল এলো মেলো করে দেয়। দাঁড়িয়ে থাকতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছে দেখে সোহান ইকরার হাত চেঁপে ধরে।

ইকরা:- আমি পানি ছুঁয়ে দিতে চাই।

সোহান:- ইকরাকে হাত ধরে বসিয়ে দেয়।

— ইকরা পানিতে হাত দিয়ে বাচ্চাদের মত উচ্ছাস করে পানি নাড়তে থাকে। মাঝে মাঝে সোহানের দিকে পানি ছিটিয়ে দেয়। সোহান মুগ্ধ হয় ওর পাগলামি দেখে। এক দৃষ্টিতে সোহান ইকরার দিকে তাকিয়ে রয়। বাচ্চামি স্বভাব আর প্রাণ চঞ্চল এই মেয়েটাকে যে সোহান অনেক অনেক ভালোবাসে। মাঝে মাঝে সোহান ইকরাকে সাবধান করে বলে উঠে বেশী হেলা যাবে না। নয়তো পরে যেতে পারে।
ইকরা সোহানের কথা শুনে হাসে সোহান নানান রকম ভঙ্গীমায় ইকরার ছবি তুলতে থাকে। ইকরার মনে হতে থাকে সে কোন গল্পের নায়িকা। যেমনটা নাটক সিনেমায় সে দেখে আজ তার জীবনে বাস্তবতায় তেমনটাই হচ্ছে। ইকরা মনে মনে ইস এটা যদি টাইটানিকের সে জাহাজ হতো তবে সোহানকে বলতো আমাকে জড়িয়ে ধরো ঠিক যেমন করে রোজকে জড়িয়ে ধরেছিলো নায়ক জ্যাক। ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়ায় ইকরা। দু’হাত মেলে ধরে ঠিক রোজের মত করে। সোহান কেন পিছিয়ে থাকবে। সেও এগিয়ে যায়য় ইকরার দিকে। বাতাসে নৌকা দোল খাচ্ছে সেদিকে কারো কোন খেয়াল নেই। সোহান যেয়ে পেছন থেকে যেয়ে ইকরার বাড়িয়ে দেয়া দু’হাতে স্পর্শ করতেই ইকরার ঠোঁট হেসে উঠে। ইকরার সব ইচ্ছে গুলো যেন বাস্তবতায় প্রাণের ছোঁয়া পেয়েছে। মাঝি এক দৃষ্টিতে ওদের দিকে চেয়ে রয়েছে, জীবনে সামনা সামনি এতো সুন্দর দৃশ্য সে তার চোখে আগে কখনো দেখেনি। ইকরার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো সোহান ভালোবাসি বড্ড ভালোবাসি তোকে। ইকরা দু’চোখ বন্ধ করে নিয়ে আমিও যে তোমাকে অনেক ভালোবাসি। বাতাসে চুল গুলো আঁচড়ে পরছে সোহানের মুখে নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত পাড়ের দিকে দু’জন চেয়ে রয়েছে নদীর অপর প্রান্তে কাঙ্খিত সেই কাশ ফুলের দিকে।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে