ছায়া মানব পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭

0
572

#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম

৩৫.
অহনার মুখ থমথমে। মাহতিমের দিকে তাকাতেই সে চোখ সরিয়ে নেয়। অহনা এক ঝটকায় আরিশের হাত থেকে ফুলগুলো নিয়ে নেয়। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল,’ আপনাকে মনে হয় ঠকিয়েছে ফুল বিক্রেতা। ফুলগুলো শুকিয়ে গেছে, এতে সুবাস নেই। ম’রা ম’রা লাগছে। আপনি দেখে আনতে পারতেন।’

টিকু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,’ কি হচ্ছে অহনা। ফুলগুলো একদম তাজা। আর এখানে ফুলের বিষয় না ভালোবাসা নিয়ে কথা হচ্ছে। সে তার ফিলিংস জানাল। এবার তোর পালা। তারাতাড়ি বলে দে।’

‘ কি বলব?’

‘ বল তুই তাকে ভালোবাসবি।’

অহনার ছোট করে বলল,’ কিন্তু আমি বাসব না।’

‘ মাথা খারাপ? বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তুই নিজেও রাজি ছিলি, এখন বলছিস… যাই হোক। এক্সেপ্ট করে নে, তারপর জীজুর থেকে ট্রিট নেব।’

অহনা চারিদিকে দেখছে। যেন পালানোর পথ খুঁজছে। মাথা পেঁচিয়ে গেছে, কি বলবে মাথায় আসছে না।

আরিশ অধৈর্য্য হয়ে বলে,’ ঠিক আছে, আমি ফুল চেঞ্জ করে আনি।’

‘ না লাগবে না। ঠিক আছে, এইগুলো‌ও সুন্দর,’ অহনা বলল।

‘ এখুনি বললে এগুলো শুকনো।’

‘‌সমস্যা নেই। বাড়ি গিয়ে ফ্রিজে রেখে দেব, আরো কয়দিন সতেজ থাকবে।’

সবাই হেঁসে উঠল। অহনার কথা তাদের মাথায় ঢুকছে না। আরিশ পুনরায় বলল,’ আমি কিছু বলেছি তোমাকে। উত্তর দিতে হবে তোমায়।’

অহনা সচকিত ভঙ্গিতে বলে,’ আমার কি বলার ছিল?’

‘ আমি বললাম একটু আগে।’

‘ কি বললেন?’

আরিশের ল’জ্জার বারোটা বাজিয়ে দিল এই অহনা। দুইবার বলল, এখন আবার বলতে হবে। আরিশ ভালো করে শ্বাস নিয়ে আবার বলল,’ তোমাকে আমি ভালোবাসি বললাম। তুমিও কি ভালোবাসো আমাকে? তুমি কি জীবনসঙ্গী হিসেবে আমাকেই চাও?’

‘‌কি উত্তর দেব আমি?’

‘ যেটা তোমার ইচ্ছে। আমি জোর করব না। হয়তো চাপে পড়েও বিয়েতে রাজি হতে পারো। মান-সম্মান রক্ষার্থেও নিজেকে বলি দিতে পারো। আমাদের সমাজে এটা অহরহ। পরিবারের কথা রাখতে গিয়ে অনেক মেয়েই নিজের ভালোলাগা, ভালোবাসাকে বিসর্জন দেয়। আমি চাই না আমার অর্ধাঙ্গিনীও তার শিকার হোক। আমি সবসময় এমন একজনকে লাইফ পার্টনার হিসেবে চেয়েছি, যে আমাকে ভালোবাসবে, আমার পরিবারকে ভালোবাসবে, নিজেকে আমার কাছে সঁপে দেবে নিজের ভিন্ন একটি দেহ ভেবে। আমি চাই এমন কাউকে যার ভাবনায় শুধুই আমি থাকব।
একটা কথা কি জানো, জোর করে আর যাই হোক, মনের মিলন হয়না কখনো। মনের মিলনের জন্য চাই ভালোবাসা, বিশ্বাস, ভরসা। আমি চাই তোমার সেই ভালোবাসা, বিশ্বাস এবং ভরসা অর্জন করতে। আমি চাই তোমার অস্তিত্ব জুড়ে একমাত্র আমার আমিটাই প্রাধান্য পাক।’

অহনা অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। সবাই বিভোর হয়ে আরিশের কথা শুনছে। আরিশের চোখ চিকচিক করছে। আবারো যোগ করল,’ আমার কখনো সৌভাগ্য হয়নি হাঁটু গেড়ে কাউকে প্রেম নিবেদন করার। পড়াশোনা আর নিজের ক্যারিয়ার তৈরি করতে গিয়ে এই বিষয়টা মাথায় ছিল না। আরো একটি বড় কারণ আমার কখনো কোনো মেয়েকে ভালো লাগতো না। তেমন নজরে দেখতাম না। মেয়েরা হাজার হাজার লাভ লেটার পায় ছেলেদের থেকে আর আমি পাই মেয়েদের থেকে। অথচ কাউকেই গ্রহণ করা হয়নি। কখনো ভাবিওনি। কিন্তু যখন তোমাকে বাবার বাংলোয় দেখলাম, বুঝাতে পারব না সেদিন আমার হৃদয়ের অবস্থা ঠিক কেমন ছিল। শুনেছি কাঁদলে মেয়েদের সুন্দর লাগে অথচ তোমার কান্নামাখা মুখ আমার কাছে সৌন্দর্যের রানী মনে হয়েছিল। আমি অঙ্ক কষতে থাকি, তুমি মানুষ নাকি পরী। অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করেছিল আমার মধ্যে। যখন জানতে পারলাম আমার ভাই তোমাকে অপ’হ’রণ করেছে, আমার মাথা ঠিক ছিল না। আমি কখনো ভাইয়ের উপর এত কঠোর হ‌ইনি। সেদিন হলাম, ভাইকে পুলিশের হাতে তুলে দিলেও আমি বাঁধা দেইনি। অথচ অন্য সময় ভাইকে জেলে নিলে একদিনের মধ্যেই তাকে বের করে আনতাম। আমি জানি সে খা’রাপ কাজ করে, খারাপ বন্ধুদের সাথে মিশে, খারাপ মেয়েদের সঙ্গ দেয়, মা’দক নেয় তবুও সে আমার ভাই। তাকে আমি ক্ষমা করে দিতাম। সেদিন পারিনি। কারণ আমি চেয়েছিলাম সে তোমাকে কষ্ট দেওয়ার শা’স্তি পাক।
রাতেও ঘুম হয়নি। ভেবেছি তোমার সেই মুখশ্রী। যখন মনে হলো তুমি আমাকে কাক* ডেকেছ, ইচ্ছে করেছে কিছু একটা করে বসি। পরদিন বাবা মেয়ে দেখার কথা বললেও আমার মন সাঁয় দেয়নি। কিন্তু কিছু করার ছিল না। বাবার সম্মানের ব্যাপার, কথা দিয়েছেন তিনি। আর তোমাকে একবার দেখেছি, দ্বিতীয়বার দেখা হবে কিনা বা তুমি অবিবাহিত কিনা তাও জানা ছিল না। তাই চলে গেলাম মেয়ে দেখতে। তোমাকে খেয়াল করতেই আমার আনন্দের সীমা র‌ইল না। যাকে চেয়েছি তাকে পেয়েছি মনে হলো। ঠিক সেদিন থেকেই মনে হয় ভালোবাসার জন্ম। আমি অনুভব করেছি তোমাকে, তোমার অস্তিত্বকে। অযথাই হাতড়ে বেড়িয়েছি তোমাকে।
ভালোবাসা এমন একটা জিনিস যেটা মুহুর্তেই তৈরি হয়। অপরপক্ষ বুঝতে সময় লেগে যায়। আমার ক্ষেত্রে ভিন্ন হলো। আমি প্রথম দেখায় হাজার বছরের সমান ভালোবেসে ফেলেছি। অনুভূতি আমার আকাশের থেকেও বিশাল। দুই সেকেন্ডেও ভালোবাসা হয় সেটা আমি বিশ্বাস করি নিজেকে দেখে। কিন্তু তোমার মতামত আমার কাছে জরুরি। আমি জোর করব না। জিজ্ঞেস করছি, তোমার কি আমাকে ভালো লাগে? আমাকে বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেইতো? আদৌ কি ভালোবাসো?’

অহনা নিশ্চুপ। উত্তর সে কোনোমতেই দেবে না। নিঃসন্দেহে আরিশ ভালো ছেলে। কিন্তু সে মেনে নিতে পারবে না। কখনোই না। এক মনে কখনো দুইজনকে ঠাঁই দেওয়া যায় না।
অহনা দোয়া করে, এই মুহূর্তে ঘূর্ণিঝড় আসুক, আর সবাই চলে যাক এখান থেকে। উত্তর সে হ্যাঁ বা না কোনোটাই দিতে পারবে না। অহনা চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ করে বলল, আল্লাহ্, ঘূর্ণিঝড়ে ভাসিয়ে নাও আমার সব বন্ধু আর আরিশকে। এরপর আমি পালিয়ে যাব। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ…

হঠাৎ আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায়। মুষলধারে বৃষ্টি নামে। অহনা চোখ খুলেই অবাক হয়। মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল,’ ভিজে যাচ্ছি আমি। সবাই নিরাপদ কোথাও যেতে হবে। লেটস্ গো।’

সবাই দৌড়ে একটা দোকানের ভেতরে আশ্রয় নেয়। অহনা মনে মনে খুশি হয়।

সকাল থেকেই আকাশটা মেঘলা ছিল। একদম ঠিক সময়ে বর্ষণ হলো। অহনার দোয়া কাজে লেগেছে কিনা তার জানা নেই। তবুও প্রকৃতিকে ধন্যবাদ জানায়।

আরিশের মুখ গোমড়া হয়ে আছে। মনের এতগুলো আবেগ উপস্থাপন করল কিন্তু উত্তর পেল না।

এতক্ষণ পিনপতন নিরবতা ছিল। হঠাৎ নটিফিকেশনে অহনা ফোনের স্ক্রিনে তাকায়। দেখল একটু আগের আরিশের প্রেম নিবেদন করাটা পুরোটা কেউ ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়াতে দিয়েছে। রুমি পেছন থেকে বলল,’ কি?‌ ভালো করিনি?’

অহনা নাক ফুলিয়ে বলল,’ তার মানে এটা তোর কাজ!’

‘ ইয়েস। এনি প্রভলেম?’

অহনা কিছু বলল না। পাশ থেকে একজন লোক এসে আরিশকে দেখে বলল,’ স্যার আপনি এখানে?’

আরিশ নিজের গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলে,’ কাজ ছিল।’

‘ কিছু মনে করবেন না স্যার। আপনার আর ঐ ম্যাডামের ভিডিওটা আমি দেখেছি। আমরা ভাবতাম আমি কখনো প্রেম নামক সম্পর্কে জড়াতে পারবেন না। কখনো আপনার সেই রূপ দেখিনি। আজ সত্যি অবাক হলাম। কিন্তু বৃষ্টির জন্য ম্যাম এর উত্তর শুনতে পারিনি। উনি কি উত্তর দিয়েছেন?’

‘ আমার হবু স্ত্রী। কিছুদিন পর‌ই বিয়ে।’

‘ তাহলে স্যার খুব শিঘ্রই দেখা হবে এবং আমরা কিছু আশা করতে পারি আপনার থেকে।’

‘ অবশ্য‌ই, দেখা হবে।’

লোকটা চলে যেতেই অহনা জিজ্ঞেস করল,’ আপনার সম্পর্কে কিছুই জানি না। লোকটা আপনাকে স্যার ডাকল কেন?’

‘ বৃষ্টি থেমে গেছে। আমাদের এখন যাওয়া উচিত। আমার কিছু কাজ আছে, তাই আমি গেলাম। তুমি তোমার বন্ধুদের সাথে লান্স করে চলে যেও।’

আরিশ হ্যারির হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলল,’ এটা তোমাদের প্রাপ্য। ট্রিটটা আমি দিলাম। তবে সাথে থাকতে পারছি না‌ তার জন্য স্যরি। গুরুত্বপূর্ণ কাজ অনেক। যেতেই হবে। পরে কোনো একদিন জমিয়ে আড্ডা দেওয়া হবে। আজকের জন্য বিদায় নিলাম।’

আরিশ আর এক মুহূর্তও দেরি না করে দ্রুত পায়ে হেঁটে যায়।

হ্যারি রেগে যায় অহনার উপর,
‘ তোর থেকে এমনটা আশা করিনি।’

অহনা খুশিতে আত্মহারা হয়ে ছিল। এহেন কথায় হ্যারির দিকে সন্দিহান চোখে তাকায়,
‘ কি করেছি আমি?’

‘ তোর উচিত হয়নি জীজুকে কষ্ট দেওয়া। বেচারা অনেক কষ্ট পেয়েছে। তুই কেন তাকে বলতে পারলি না তুই তাকে ভালোবাসিস।’

‘ যেটা আমি বলতে পারব না সেটা কেন বলতে যাব।’

‘ তুই কি তাকে ফিল করিস না? তাহলে বিয়েতে রাজি হলি কেন?’

‘ আরে তেমন কোনো ব্যাপার না। বৃষ্টি আসছিল যে দেখলি না?’

‘ থাক, আর ঢং দেখাতে হবে না। ঘূর্ণিঝড় আসার জন্য দোয়া করে এখন বৃষ্টির ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছিস।’

‘ তোকে কে বলল এই কথা?’

‘ এত বড় বড় করে বললে যে কেউ শুনবে।’

‘ তার মানে আরিশ শুনেছে?’

‘ আমরা সবাই শুনেছি। চোখ বন্ধ করে জোরে শব্দ করেই বলেছিস।’

‘ ইশশ্, আমি কত বড় ভুল করে ফেললাম। এবার আমার কি হবে?’

ভয় পেলেও অহনা মনে মনে বলল,’ ভালোই হলো। লোকটা বাড়ি গিয়ে অন্তত বুঝবে আমি তাকে ভালোবাসি না। যাক অদৃশ্য বাঁচা বাঁচলাম।’

হ্যারি বলল,’ তোর শত কপালের ভাগ্য সে এখনো তোর কথাই ভাবছে। দুপুরে কি খাবি সেটাও ভেবে রেখেছে। খেয়াল রাখে তোর। তাকে ঠকালে তোর কপালে শনি আছে। আমরা মানব না এটা কোনোমতেই।’

‘ আমার থেকেও দেখি তোদের আরিশের জন্য বেশি চিন্তা।’

‘ তোর জন্য কি চিন্তা করব? আমি এটা বুঝতে পারছি না তুই এমন করছিস কেন? একটা ছেলে তোর নেশায় নেশাক্ত, তুই তাকে পাত্তাই দিচ্ছিস না। উল্টো তাকে ঘূর্ণিঝড়ে ফেলে দেওয়ার দোয়া করছিস। আমি আর কিছু বলতে চাই না। তুই ভেবে দেখবি। আর যেন এমন ভুল না হয়। বাড়ি গিয়ে তাকে কল করে স্যরি বলবি। এখানেই আমাদের আলোচনা শেষ এখন জীজুর টাকায় খাওয়ার পালা। ইচ্ছেমতো খাওয়া হবে আজ। চলো সবাই।’
‘হুররে’ বলে উঠল সবাই।

সবাই আগে আগে যাচ্ছে। অহনা পেছনে মাহতিমের সাথে। মাহতিম নিরব পাঠক হয়ে ছিল‌ এতক্ষণ। মুখ খুলল এবার,’ কি চাও তুমি?’

‘ তোমাকে। আর কিছু জানতে চাও?’

অহনা রেগে আছে। মাহতিম পুনরায় বলল,’ আমাকে চাইলে আরিশের কি হবে?’

‘ ঠিক আছে, তাকেই বিয়ে করব।’

‘ রেগে যাচ্ছ কেন?’

‘ মূ’র্খের মতো কথা বলছ তুমি।’

‘এত রাগ করোনা। রাগ করলে তোমাকে আরো বেশি সুন্দর লাগে। আমি চাইনা রাস্তায় কেউ তোমাকে দেখে সৌন্দর্যতা উপভোগ করুক।’

‘ বাজে বকছ!’

‘ মোটেও না। তোমাকে আসলেই সুন্দর লাগে রেগে গেলে।’

‘ সত্যি সুন্দর লাগে?’

‘ হুম, অনেক।’

‘ তাহলে আমি রাগটাই করব না। দেখি এবার কিভাবে সুন্দর লাগে। আর তুমি একদম আমার পেছনে আসবে না। গিয়ে খোঁজ নাও আরিশ কে? তার কাজ কি? কি করে সে? এতদিন প্রকৃতপক্ষে ছিল কোথায়? সব জানাও আমাকে।’

‘ আমি কেন জানব?’

‘ কেন জানতে চাইবে না? আমার সাথে পরবর্তীতে কি হবে সেটা কি তুমি জানো না?’

‘ না। এটার ক্ষমতা আমার নেই। তবে খুঁজে নিতে সময় লাগে না।’

‘ ড্রেক যে রাতে আমার ক্ষতি করবে সেটা কি করে জানলে?’

‘হঠাৎ এমন প্রশ্ন?’

‘ কারণ তুমি আমার বিষয় ছাড়া বাকি সব বিষয় স্কিপ করে যাও। এখন বলো, কি করে জানলে?’

‘ সে কল করে কাউকে বলছিল আজ রাতেই তোমাকে শিকার করবে। আমি তোমার ছায়া হয়ে ছিলাম তাই সব বিষয়ে নজর দিয়েছি। এমনটা না আমি সব আগে থেকে জানি।’

‘ ঠিক আছে। এখন আর একটাও কথা বলবে না।’

‘ তুমি রাগ করবে না বলেছিলে, এখন কেন দেখাচ্ছ?’

‘ এটা আমার ইচ্ছের উপর ডিপেন্ড করছে। আমার ইচ্ছে হলে রাগ দেখাব ইচ্ছে হলে দেখাব না।’

‘ মাথায় অন্য চিন্তা তোমার। বিষয়টা কি খুলে বলবে আমাকে?’

অহনা ব্রু কুঁচকে বলল,’ আরিশের কথা ভাবছি।’

‘ ভালো তো, ভাবো তবে। আমি যাই, আমিতো আর খাবার খাব না।’

‘ লোকটা আরিশকে স্যার বলল কেন?’

‘ বলতেই পারে।’

‘ না, পারে না। আরিশ মাত্র পড়াশোনা করে বেরিয়েছে, কিছু করে না। তাহলে একজন উকিল কেন তাকে এটা বলবে এবং দেখা হ‌ওয়ার কথা বলল।’

‘ উকিলকে তুমি চেনো কি করে?’

‘ অনেক আগে থেকেই….

চলবে…..

#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম

৩৬.
অহনা নিজের ঘরে বসে সাজছে। হঠাৎ কেন জানি তার সাজতে ইচ্ছে হলো। গাঢ় করে কাজল দিল চোখে। গোলাপি লিপস্টিক ঠোঁটে লাগিয়ে ঘুরেফিরে নিজেকে আয়নায় দেখল। মুখ কুঁচকে গেল। কপালে গুটিকয়েক ভাঁজ পড়ে। টিস্যুতে ঠোঁটজোড়া মুছে নিয়ে আরো কয়েক প্রকার লিপস্টিক দেখল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। শেষমেশ নীল রংয়ের একটা লিপস্টিক থেকে কিছুটা ঠোঁটে লাগিয়ে নিল‌। আয়নার দিকে তাকিয়ে হাসল। নিজেকে তার কাছে খুব সুন্দর লাগছে। মাহতিম পাশেই ছিল। অহনার এমন কান্ড দেখে মিটিমিটি হাসছে সে। কাউকে কখনো নীল লিপস্টিক দিতে দেখেনি সে।

অহনা উড়ন্ত চুমু খেল আয়নায়। নিজেকে নিয়ে কখনো ভাবে না সে। আজ ভাবছে, কেন তা জানা নেই।

মাহতিম হাত দুটো বুকের সাথে ভাঁজ করে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গলা খাঁকারি দিতেই অহনা ফিটফাট হয়ে নেয়। লিপস্টিক মুছে নিতে যাবে, তখনি মাহতিম বাঁধা দেয়,’ এভাবেও সুন্দর তুমি।’

‘ মিথ্যে বলা স্বভাব তোমার।’

‘ হতে পারে। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে না। তোমাকে যা বলি সব সত্যি। তুমি হলে পরী। আর পরীদের যেকোনো সাজে ভালো লাগে। না সাজলেও সুন্দর লাগে।’

‘ যার চোখ পবিত্র তার সবাইকেই ভালো লাগে। আর যে ভালোবাসে, তার ভালোবাসার মানুষের সব ভালো লাগে।’

‘ঠিক বলেছ, তাইতো তোমায় এত ভালো লাগে।’

‘ তুমি আমায় ভালোবাসো?’

‘ ভেবে দেখতে হবে।’

‘ ভাবতে ভাবতে শহীদ হয়ে যাও। এখান থেকে যাও না হয় কি করব বুঝতে পারছ না। আমি কিন্তু রেগে আছি।’

‘ আজকাল বড্ড বেশি রাগ কর তুমি। সামলাতে কষ্ট হয় আমার।’

‘ আমি তোমার উপর নিজের ভার ছেড়ে দেইনি। সামলানোর কি আছে?’

‘ এভাবেই আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। ভার ছেড়ে দিলে আমাকে আর পৃথিবীতে পাওয়া যাবে না।’

‘ পাওয়া যাবে কি করে? তুমিতো এখন‌ ভিনগ্রহের প্রাণী। পৃথিবীর মানুষের ডিনার জোগাড় করতে এসেছ।’

‘ মজা নিচ্ছ তাই না?’

‘ সে সাধ্য কি আমার আছে?’

‘ আজকাল বেশি কথা বলো। আগের মতো হয়ে যাও। তখন যেমন গোমড়া মুখে থাকতে এখনো হয়ে যাও। তখন ওভার রিয়্যাক্ট করতে এখনো করো। তবে আগে কম কথা বলতে, এখন বেশি বলো।’

‘ মনে হচ্ছে আমার আগের জন্মের কথা বলছ। এখন যাও, আমি গোসল করব।’

মাহতিম বুঝাতে পারে না অহনাকে। সত্যিটা বলতেও পারছে না। অহনা শুনতেই নারাজ। মাহতিম কথা ঘুরিয়ে বলল,’ এখন কিসের গোসল? সন্ধ্যা নেমেছে।’

‘ বেশি বুঝো তুমি।’

‘ বলবে, কেন এই অনিয়ম?’

‘ আমি ভার্সিটি থেকে এসে গোসল করিনি, ঘুমিয়ে গিয়েছি, তোমার কি খেয়াল নেই?’

‘ একটু আগে সাজলে কেন তাহলে?’

‘ গোসল না করে কি সাজতে মানা? মূলত গোসল করেই সাজবো তাই একটু দেখে নিলাম কেমন লাগবে।’

‘ তোমার কি শরীর খারাপ? জ্বর আসল না তো আবার?’

মাহতিম অহনার গলায় কপালে হাত রেখে দেখে জ্বর আসল কিনা,
‘ না জ্বর আসেনি। তাহলে এমন আচরণ করছ কেন?’

‘ কেমন আচরণ করছি আমি?’

‘ তুমিতো কখনও সাজো না, তাই ভাবছি জ্বরের ঘোরে উল্টা পাল্টা বকছ।’

‘ কিছু বলব না। এখন আমার গোসল করা জরুরি। বায়!’

অহনা চলে যায়। মাহতিম অপেক্ষা করে অহনার ফেরার। ত্রিশ মিনিট চলে গেলেও অহনার বের হ‌ওয়ার নাম গন্ধ নাই। মাহতিম বাথরুমের দরজার কাছে গিয়ে ডাকল,
আছো তুমি?’

ভেতর থেকে আওয়াজ এলো,’ কি হয়েছে?’

‘ তার মানে আছ‌। ঠিক আছে।’

‘ এতো ডাকার মানে কি?’

‘ আমি ভাবলাম আজকে ওখানেই থেকে যাবে।’

‘এটা থাকার জায়গা না।’

অহনা বেরিয়ে আসে। মাহতিম বলল,’ এত দেরি করলে কেন? তোমার তো গোসল করতে পাঁচ মিনিট লাগে তাই না?’

‘ আজ দেরি লাগল। আমিতো মেয়ে তাই না। মেয়েদের একটু বেশি সময় লাগে।’

‘ তার কারণ কি?’

‘ বাজে কথা রেখে একটু চুপ থাক।’

মাহতিম চুপ হয়ে যায়। অহনার মধ্যে সে পরিবর্তন লক্ষ্য করল। অন্য মেয়েদের মতো সময় নেওয়া, সাজা সব‌ অনুশীলন করছে। আগে তার মধ্যে যা ছিল না তা স্পষ্ট হচ্ছে। মাহতিম মনে মনে খুশিই হয়।

অহনা চুলের পানি নিচ্ছে। মাহতিম‌ তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কয়েক ফোঁটা পানি তার চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়তেই সে অনুভব করে অন্যরকম ভালোলাগা। মাহতিম পেছন থেকে অহনার চুলে হাত বুলায়। অহনা থেমে যায়,’ কি করছ?’

‘ দেখছি।’

‘, কি দেখছ?’

‘ তোমাকে।’

‘ আর কখনো দেখনি মনে হয়! সরে দাঁড়াও।’

মাহতিম না সরে অহনার চুলের ঘ্রাণ নেয়। ভেজা চুলের ঘ্রাণ।
‘শ্যাম্পু করা চুলের ঘ্রাণ সবচেয়ে মিষ্টি লাগে, তুমি জানো?’

‘ আজ জেনে নিলাম তোমার বোকা কথা থেকে।’

মাহতিম পুনরায় অহনার কপালের চারপাশে লেপ্টে থাকা গুটিকয়েক চুলকে সরিয়ে বলল,’ বোকা কথা না। এটাই সত্যি। ভালোলাগা, ভালোবাসা কাজ করে এই চুলের সংস্পর্শে আসলে।’

‘ তাই বুঝি?’

‘ কবি বলেছেন, আমি না।’

‘ কবিরা স্বার্থপর।’

‘ কেন?’

‘ তারা নারীদের পায়ের তলা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত বর্ণনা করে গেছেন। সব ভালোলাগা নিয়ে কবিতা লিখেছেন অহরহ। অথচ কোন কবি আজ পর্যন্ত পুরুষের রুপ নিয়ে কথা বলেনি। কেউ পুরুষের ভেজা চুল নিয়ে কিছু বলেনি। তারা জানেই না একজন পুরুষ যখন খুব কাছাকাছি থাকে তখন তাকে ঠিক কতটা সুন্দর লাগে।’

‘ তুমি কি অনুভব করেছ?’

‘‌হুম, ভীষণভাবে। আমি টের পাই যখন তুমি খুব কাছে থাক। আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। খাপছাড়া লাগে নিজেকে। সকল নিয়ম-কানুন ভুলে যাই আমি। সমাজ-সংসারের কথা ভুলে যাই। শুধু ইচ্ছে করে সময়টাকে থামিয়ে আজীবন দেখতে থাকি তোমায়।’

‘ অমরত্ব চাইছ নাকি।’

‘তোমাকে বার বার পাওয়ার ইচ্ছে যদি অমরত্বের কথাই বলে, তাহলে আমি অমরত্ব‌ই চাই। যেন তোমায় দেখার তৃষ্ণা কখনোই না ফুরিয়ে যায়।’

মাহতিম অহনার দুগালে হাত রেখে নিজের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসে,
‘ এতো ভালোবাসো?’

‘ স্টুপিড! তোমার বোঝা উচিত ছিল।’

‘ রাগছ কেন? মুখে প্রকাশ করলেই কি ভালোবাসা হয়?’

‘ সে যাই হোক। তুমি যদি প্রকাশ নাই করো তাহলে অপরপক্ষ বুঝবে কি করে?’

‘ প্রতিটি ছোঁয়া কি অপরপক্ষ অনুভব করে না? সেকি অনুভূতিতে তলিয়ে গিয়ে ভালবাসা অনুভব করতে পারে না?’

‘ আরিশ কত সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করল। আর তুমি?’

‘ তুমি চাও, আমিও তার মত ভালোবাসা নিবেদন করি?’

‘ আমি চাই।’

‘ ঠিক আছে, আজ রাতেই হবে তেমনটা। রাত বারোটার পর।’

‘ সত্যি বলছ?’

‘ একদম।’

মাহতিম অহনার থুতনিতে হাত দিয়ে অহনাকে আরো সামনে নিয়ে আসে। এই মুহূর্তে তারা খুব কাছাকাছি। আর কয়েক সে. মি. এর দুরত্ব শুধু। মাহতিম তাকিয়ে আছে অহনার ভেজা ঠোঁটের দিকে। এগুলো টানছে তাকে নিজের দিকে। চোখ, কপাল সবকিছু থেকে আলাদাভাবে টানছে। একবার ছুঁয়ে দেওয়ার তীব্র ইচ্ছে জাগছে। অহনার বুকের ভেতর হাতুড়ি পে’টা শুরু হয়েছে। রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না।
মাহতিম থুতনিকে আরো কিছুটা সামনে আনতেই অহনার গলা শুকিয়ে আসে। চোখ নিবদ্ধ করে নেয়। হাত দুটোর মৃদু কম্পন শুরু হয়েছে। মাহতিম উদাস সুরে বলল,’ এভাবে কাঁপছ কেন?’

কোনো উত্তর দিল না অহনা। মাহতিম অহনার ঠোঁটের দিকে ঝুঁকে যায়। বিবেক তাকে বাঁধা দিচ্ছে এই কাজটা না করতে অথচ মন মানছে না। মনকে প্রাধান্য দিয়ে সে অহনার ঠোঁট দখল করতে চাইল। মাহতিম অহনার ভেজা ঠোঁটে নিজের ঠোঁট জোড়া স্পর্শ করতে যাবে, ঠিক তখনই রোস্তমের গলা ভেসে আসে,
‘ দরজা খোল অহনা মা।’

ছিটকে দূরে সরে যায় দুজন। অহনা লজ্জায় লাল হয়ে দরজার দিকে অগ্রসর হয়। দরজা খুলে দিতেই রোস্তম ঘরে আসে,’ সন্ধ্যা হয়ে গেল, দরজা বন্ধ, তাই ভাবলাম ডেকে দিই। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলি।’

‘ হ্যাঁ বাবা, আমি ঘুমিয়েছিলাম, একটু আগেই উঠে গোসল করলাম।’

‘ আচ্ছা, তৈরি হয়ে নিচে আয়।’

অহনা দ্বিতীয়বার মাহতিমের দিকে তাকাতে পারছে না। চোখে-মুখে ভারী এক লজ্জার আস্তরণ তৈরি হয়েছে। এতদিন শুধু জড়িয়ে ধরেছিল, আজ খুব কাছে মিলতে চাইছিল। হলোনা রোস্তমের জন্য।

অহন ঘর থেকে বের হয়। সন্ধ্যা সাতটা বাজে তখন। টিভিতে নিউজ চলছিল। মাহতিম বের হতেই সেটায় খেয়াল করে। স্পষ্ট বয়ানে সাংবাদিক বলছে, দেশটা খারাপ লোকে ছেয়ে গেছে। এখনো কোনো একটা গ্যাং তাদের নীতিবর্জিত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এসব বন্ধ না করলে কিছুদিনের মধ্যেই দেশটা রসাতলে যাবে।

মাহতিমের মাথা ধরে আসে। ভেবেছিল তার কাজ শেষ, সবাইকে সে শেষ করে দিয়েছে। কিন্তু বুঝতেই পারেনি তার চোখে ধুলো দেওয়া হয়েছে। আসল অপরাধীকে সে এখনো চিনতেই পারেনি…

চলবে…..

#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম

৩৭.
রাত আটটা ছুঁই ছুঁই। অহনা পড়ার টেবিলে বসে আছে। মাহতিম খাটের উপর বসে কিছু ভাবছে। ভাবনার ইতি টেনে অহনাকে বলল,’ আমি একটু আসছি।’

‘ কোথায় যাবে?’

‘ কিছু দরকারি কাজ আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসব। তুমি পড়ো, আসছি আমি।’

‘ বলে যাও আমাকে। কি কাজ করতে যাও সবসময়, যেটা আমাকে বলা যায় না? তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না?’

‘ তেমন কোনো ব্যাপার না। আমার কাজটা আমি নিজেই সামলাতে চাই। আমি চাই না সেটা নিয়ে তুমি ভাবো। আমি যা করছি তা সবার ভালোর জন্য‌ই করছি।’

‘ কিছু তোমার উচিত আমাকে সেটা সম্পর্কে বলা। কারণ আমি তোমার দূরের কেউ না। হয়তো পরিচয় কিছুদিনের অথচ তোমাকে আমার আরো বেশি ঘনিষ্ঠ মনে হয়। মনে হয় পুরনো কোনো সম্পর্কে বেঁধে আছি আমি।’

মাহতিম অহনার কাছে আসে,’‌আমি সেটাই বার বার তোমাকে বুঝাতে চেষ্টা করি। কিন্তু তুমি বুঝো না।’

‘ তুমি না বললে আমি বুঝবো কি করে? সব কিছু লুকিয়ে রাখো আমার থেকে। আসলে এখনো বিশ্বাসটাই করতে পারলে না। যাও তুমি, আমি আর কিছু বলব না কখনো।’

মাহতিম অহনার দুই কাঁধ স্পর্শ করে তাকে চেয়ার থেকে তোলে। মৃদু হাসি দিয়ে আলতো স্পর্শ করে অহনার নরম গালে,’ বিশ্বাস করো তো আমায় তাই না?’

‘ অনেক, অনেক বেশির চেয়েও বেশি।’

‘ তাহলে এটা বিশ্বাস করে নাও। আমি যা করছি তা তোমার, আমার, আমাদের সবার ভালোর জন্য‌ই করছি। তুমি ভুলে গেছ আমাদের অতীত, ভুলে গেছ সম্পর্ক, আমি কি করে সব বলে বুঝাই তোমাকে? তুমি আমাকে বিশ্বাস করবেই না।’

‘ কিসব বলছ? অতীত বলতে আমাদের কিছুদিন আগেই দেখা হয়েছিল। তুমি বলো, আমি বিশ্বাস করব তোমাকে।’

মাহতিম অহনার দিকে তাকায়। চোখে মুখে তার জানার আগ্রহ খুব। মাহতিম সিদ্ধান্ত নেয় সব বলবে,
‘ আমি কোনো সাধারণ মানুষ ন‌ই। এটা কি তুমি বিশ্বাস করবে?’

‘‌আমি জানি তুমি একজন ম্যাজিশিয়ান।’

‘, উহুম,‌ এটা না। আরো একটা পরিচয় রয়েছে।’

অহনা ব্রু কুঁচকে তাকায়,’‌ তুমি কি আবার রাক্ষস নাকি?’

‘ না।’

‘ তাহলে তুমি কি কোনো এলিয়েন?’

‘ না। আমি বলছি তো।’

‘ তাহলে কে তুমি? বুঝেছি, তুমি একটা ভূত তাই না?’

অহনা ফিক করে হেসে দেয়। মাহতিম তার হাসিমাখা মুখ দেখে। কত সুন্দরভাবে হাসছে। এই হাসির জন্য নিজের প্রাণ দিতেই প্রস্তুত মাহতিম। হৃদয়ে দাগ কেটে নিয়েছে অহনা। এতোই জোড়ালো সে দাগ, কখনোই মুছে যাবে না।

মাহতিম বলল,’ আমার শরীরে প্রাণ নেই। আমি একটা আ’ত্মা।’

অহনা থমথম খেয়ে যায়। মাহতিমের চোখে তাকিয়ে দেখল মিথ্যের ছিটেফোঁটাও নেই। অহনা ঠোঁট বাঁকা করে বোঝার চেষ্টা করে মাহতিম আসলে কি বলেছিল।

মাহতিম পুনরায় বলল,’ তুমি আমাকে মানুষ ভেবেই হয়তো মন দিয়ে বসেছ। এমনিতে আমি হয়তো তোমাকে পাওয়ার যোগ্যতা রাখি না।’

‘ মাথাটা গেছে তোমার। এতদিন ভেবেছি তোমার ঘটে একটু সমস্যা আছে, এখন মনে হচ্ছে একটু না পুরোটাই সমস্যা। জানি না কোথা থেকে এই ম্যাজিক শিখলে, তার পর থেকেই হয়তো নিজেকে আ’ত্মা ভাবতে শুরু করেছ।’

‘ আমি বলেছিলাম তুমি বিশ্বাস করবে না।’

‘ এটা বিশ্বাস করার মতো বিষয়? তুমি আর কখনো এমন কথা বলবে না। মনে থাকে যেন। আমি শুনতে চাই না।’

‘ ঠিক আছে, এখন বিদায় দাও।’

‘ দিলাম, তবে মনে থাকে যেন একটা বিষয়। সন্ধ্যায় বলেছিলে।’

‘ মনে থাকবে। আমি ফিরে আসব খুব শিঘ্রই।’

মাহতিম অহনার থেকে মুখ সরিয়ে চলে যেতেই আবার ফিরে আসে। অহনা বলল, ‘ কি হলো? যাচ্ছ না কেন?’

মাহতিম এগিয়ে আসল। অহনার খুব কাছে‌ এসে এক ঝটকায় তাকে বুকের সাথে চেপে ধরল। খুব জোড়ালোভাবে। অহনার শরীরে বিদ্যুৎ বয়ে গেল। কেঁপে উঠল পুরো শরীর, মন।

‘ আজ নিজে থেকেই জড়িয়ে ধরলে তুমি। কি যে আনন্দ হচ্ছে আমার।’ বলল অহনা।

মাহতিম কোনো উত্তর দিল না। আরো শক্ত করে চেপে ধরল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেড়ে দিয়ে সাথে সাথে চলে গেল। আর এক মুহূর্তও দেরি করল না।

অহনা অবাক হয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে পড়তে বসল পুনরায়। মাহতিম জড়িয়ে ধরলেই ওর সব কাজে মন বসে। সব ভালো লাগে। মেয়েলি আ’ত্মাটা জেগে উঠে পুনরায়। শরীরে তার ওম স্পষ্ট হয়। কিছুক্ষণ আগেও পড়ায় মনোযোগ দিতে পারেনি। এখন পারছে।

অহনা আরিশকে কল করল। সকালের আচরণের জন্য তাকে স্যরি বলতে হবে।

আরিশ তার বাবার বাংলোতে বসে কিছু ফাইল দেখছে। ফাইলগুলো ছিল কয়েকজন আর্মি অফিসারের লাইফ স্টাইল সম্পর্কে।

অহনা একবার ভাবছে কল করবে। আরেকবার পিছিয়ে আসছে। গতদিন আরিশ ওর নাম্বার নিয়েই মিসড্ কল করেছিল। নাম্বারটা চোখের সামনেই ভাসছে। অহনা কল করল। ওপাশ থেকে শব্দ এলো,
হ্যালো।’

অহনা কল কেটে দে‌য়। কথা বলতে পারছে না। আরিশ কল ব্যাক করে। অহনা রিসিভ করেই চুপ করে র‌ইল।
আরিশ বলল,’ কথা বলার জন্য কল করেছ নাকি শুধু আমার কথা শোনার জন্য?’

‘ আমি আসলে…’

‘ বলো।’

‘ আজকের ঘটনার জন্য স্যরি। আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ এতকিছু হলো তো তাই।’

‘ আমি কিছু মনে করিনি। আসলে দোষটা আমার‌ই। আমি অল্প সময়ে অনেক বড় উত্তর চেয়েছি তোমার কাছে।’

‘ আমি স্যরি। আপনি হয়তো কষ্ট পেয়েছেন।’

‘ কষ্ট পেয়েছি ব‌ইকি। তুমি আমাকে ঘূর্ণিঝড়ে ফেলে দেওয়ার কথা ভাবছ।’

অহনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,’ আমি স্যরি। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম তখন। কি উত্তর দেব বুঝতে পারিনি।’

‘ বুঝেছি আমি। আমার উচিত ছিল তোমাকে আরো কিছু সময় দেওয়া। আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা বাড়ানোর জন্য কিছু সময় কাটানো দরকার। কাছাকাছি থাকলে অনুভব করতে পারব। তুমি কি কাল দেখা করতে চাও?’

‘ না।’

অহনা পুনরায় হ্যাঁ সূচক শব্দ করল,
‘ হুম।’

‘ ঠিক আছে। কাল দেখা হচ্ছে।’

‘ তাহলে এবার রেখে দিই?’

‘ আমার সাথে কথা বলতে কি তোমার খারাপ লাগে?’

অহনা মনে মনে বলল,’ খারাপ লাগে কিনা জানি না। তবে যাকে মেনে নিতে পারব না। তাকে কেন ঠকাবো?’

মুখে বলল,’ না, খারাপ লাগে না। তবে আন‌ইজি লাগে।’

‘ সেটা ঠিক হয়ে যাবে। আর ঠিক করার জন্য কথা বলতে হবে।’

‘ কিন্তু আমিতো এখন পড়ব।’

‘ তাহলে পড়ো। ডিস্টার্ভ করা ঠিক হবে না। রাতে কল করব।’

‘ রাতে তো আমি ঘুমাব। আমি রাত জাগি না।’

‘ তাহলে কাল সকালেই দেখা করলে কথা হবে।’

‘ হুম, রাখলাম।’

মাহতিম আশিশের সাথে দেখা করতে যায়। রাত দশটা প্রায়। আশিশ তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে সময় কাটাচ্ছিল। এমন সময় মাহতিমের আগমনে অনেকটা বিরক্ত এবং লজ্জিত হয় আশিশ। আশিশ তার গার্লফ্রেন্ডকে বলল,’ পরিপাটি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাও এখুনি।’

‘ কেন? মাত্র‌ইতো আসলাম।’

‘ যেতে বলছি আমি।’

মাহতিম বুঝতে পারেনি এমন কান্ড হবে। আশিশ বলেছিল বিয়ে কিছুদিন পর। তাই বলে বিয়ের আগে তারা এসব কি করছে? মাহতিম নিজের চোখ বন্ধ করে বলল,’ আমি কিছু দেখিনি ভাই।’

আশিশ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,’ হ‌য়েছে আর ঢং করিস না। আমার গার্লফ্রেন্ড মানে তোর গার্লফ্রেন্ড‌ইতো, দেখলে সমস্যা নাই।’

‘ তোর গার্লফ্রেন্ড আমার হবে কেন?’

‘ বুঝলি না? আমরা তো বন্ধু। তাই আমার গার্লফ্রেন্ড মানে‌ তোর গার্লফ্রেন্ড, তোর গার্লফ্রেন্ড মানে আমার গার্লফ্রেন্ড।’

মাহতিম রেগে যায়, বলল,’ তোর গার্লফ্রেন্ড আমার লাগবে না। আর আমার গার্লফ্রেন্ড না অহনা আমার জীবন। তাকে তুই কেন কোনো পুরুষকেই নাম নিতেও দেব না।’

‘ আরে রেগে যাচ্ছিস কেনো? আমিতো মজা করলাম। এখন বল, কেন আসলি হঠাৎ।’

‘ আমি ভেবেছি আমি হয়তো অপরাধীদের শাস্তি দিয়েছি। কিন্তু আমার ধারণা ভুল। আসল অপরাধী এখনো আমাদের মাঝেই আছে। এ অনেক চালাক, হয়তো সে আমার পরিচয়‌ও জানে। না হয় কি করে এত ফাঁকি দিতে পারল। আমার কিছু মাথায় আসছে না। কি হচ্ছে এসব?’

‘ তোকে এসব কে বলল? অনুজ ছিল আসল অপরাধী। তার পরে আর কেউ আছে কিনা আমার জানা নেই।’

‘আছে। তার জন্য তোর সাহায্য চাই।’

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে