ছায়া মানব পর্ব-২০+২১+২২

0
623

#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম

২০.
অহনার মুখ থেকে অস্ফুট কিছু শব্দ বের হচ্ছে শুধু। ভালো করে খেয়াল করে দেখল, এটা মতি। অহনা ছাড়ানোর চেষ্টা করে সফল হয়। হাতে কামড় বসাতেই সে ছেড়ে দেয়। পরক্ষণেই অহনার দিকে এগিয়ে আসে,’ কেন করলে এমনটা?’

অহনা নিজেকে সামলে বলে,’ আমি কিছুই করিনি। এভাবে আমাকে ধরার সাহস করে দিল আপনাকে?’

‘ আমি মানতে পারব না কোনোমতেই। তুমি এই বিয়ে করবে না। আমি বার বার বলছি এই বিয়ে করবে না।’

‘ আমি আপনার কথার গোলাম ন‌ই। আপনার যা ইচ্ছা করে নেন।’

‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি, বিশ্বাস করো!’

অহনা অবাক হয়ে যায়। কথাটা তার কাছে ভালো লাগেনি,
‘ কি বললেন?’

‘ আমি সত্যি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’

‘ আমি বাসি না। এসব কি শুরু করলেন?’

‘ ভালোবাসি আমি তোমাকে, সেদিন দেখার পর থেকেই। আমি ভেবেছি বাড়িতে বিয়ের কথা বলব, কিন্তু তার আগেই কি করে এসব ঘটে গেল। আমি আগেই ভেবেছি বাবাকে বলব, কিন্তু তোমাকে আকাশে উড়তে দেখে আমি ভেবেছি ভূতে ধরেছে, আগে সুস্থ করব তারপর বিয়ে করব। কিন্তু এর আগেই এতসব ঘটে গেল। আমি এখন কি করব অহনা? বলে দাও।’

‘ কিছু করার নেই। আপনার বাবা বিয়েটা ঠিক করেছে। আর এখানে আমার বাবার সম্মানের প্রশ্ন, আমি কিছু করতে পারব না।’

‘ তুমি পারবে। তুমি ছাড়া আর কেউ ভরসা নেই। তুমি তোমার বাবাকে বলো, তুমি আমাকে ভালোবাসো, বিয়ে করতে চাও।’

‘ কিন্তু আমি মিথ্যে কেন বলব? পারব না আমি।’

‘ পারতে হবে তোমাকে। আমি কিছুতেই ভাইয়ের সাথে তোমাকে মেনে নিতে পারব না। আমার ভাইটা একদম বোকা, তোমার সাথে তাকে মানাবে না।’

‘কেন মানাবে না। আপনাকে যদি গোয়ালের গাভীর সাথে মানায় তাহলে উনাকে কেন আমার সাথে মানাবে না?’

‘ একবার বোঝার চেষ্টা করো।’

‘কিছূ চেষ্টা করব না।’

মতি এগিয়ে এসে অহনার হাত চেপে ধরে,
‘এমন করো না। আমি ভালো হয়ে যাব একদম। আর কখনো কোনো অন্যায় কাজ করব না। তোমাকে বিয়ে করতে পারলে আর কিছু চাই না।’

‘ নিজের সীমার মধ্যে থাকুন। আমাকে কে বিয়ে করল না করল, এতে আমার কিছু যায় আসে না। চলে যান এখান থেকে, না হয় বাবাকে ডাকব।’

‘ তার মানে তুমি ভাইকেও বিয়ে করতে চাও না। ঠিক আছে আমি ব্যবস্থা করছি।’

মতি চলে যায়। অহনা তার কপালে ভালোবাসা হারানোর ভাঁজ দেখতে পেল। নিজেকে নিজে শুধালো,’ এসব কি হচ্ছে আমার সাথে? কেন হচ্ছে? আমি কেন বার বার এত এত প্রশ্নের সম্মুখীন হ‌ই? কেন আমার সাথেই সব অনিয়ম হয়?’

মাহতিম বন্দরের একটি জাহাজে উঠে যায়। সেখানে থেকে সোজা নরসিংদীতে ফিরে আসে। খবর নিয়ে জানতে পেরেছে ক্যাপ্টেন নিমো এখানেই থাকে। তার সাথে দেখা করাটা জরুরি ছিল, তাই এসেছে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। ক্যাপ্টেন সেখান থেকে চলে গেছে দুইদিন আগেই। কোথায় গেছে কেউ জানে না।

মাহতিম আবার ফিরে আসে। তার প্রিয় বন্ধু নাজের কাছে যায়। অল্প বয়সী যুবতী নাজ। নিজের ঘরে বসে সে ফোনে কথা বলছিল, এমন সময় আগমন ঘটে মাহতিমের। মাহতিম তার পাশে গিয়ে বলল,’ নাজ, আমি এসেছি।’

চমকে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে নাজ। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চিৎকার করতে যাবে, তার আগেই মাহতিম তার মুখ চেপে ধরে,’ দোহাই লাগে, কথা বলিস না, সবাই জেনে যাবে।’

‘ তুমি? তুমি এখানে কি করে? এটা কিভাবে সম্ভব?’

‘ সব পরে বলছি, এখন চিৎকার করিস না।’

মাহতিম আস্তে আস্তে নাজের মুখ থেকে তার হাত সরিয়ে আনে,
‘‌তোর সাহায্য দরকার আমার!’

‘ কিসের সাহায্য? আর তুই এতদিন দেখা করিসনি কেন?আমিতো ভাবতেই পারিনি তোকে আবার দেখতে পাব। ঠিক কি হয়েছিল তোর সাথে?’

‘ সে অনেক লম্বা কাহিনী। তুই আগে আমাকে সাহায্য কর।’

‘ অবশ্যই! তোকে সাহায্য করব নাতো কাকে করব?‌ কি করতে হবে বল, আমি তোকে সাহায্য করব।’

মাহতিমের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে আসে। নাজের প্রতি তার ভালোবাসা আরো বেড়ে যায়,
‘ আমি জানতাম তুই আমাকে না করবি না। তোকে ছাড়া এখানে আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। এবার আমার টার্গেট ফিলাপ হবে।’

‘ সিউর মাই ফ্রেন্ড। তোকেতো আমি শেষ পর্যন্ত সাহায্য করব।’

‘ এখন বল ক্যাপ্টেন নিমো কোথায় আছে?’

নাজের চোখে-মুখে চিন্তার রেখা পড়ে। কিছু ভাবছে সে। মাহতিম আবার বলল,’ ক্যাপ্টেনের সাথে কথা বলা দরকার। তিনি আমার সব বিষয় জানেন। ওনার সাহায্য লাগবে আমার।’

‘ ক্যাপ্টেন আজ দু’দিন নিখোঁজ। কেউ জানে না তিনি কোথায়!’

‘ ঠিক আছে আমি খুঁজে বের করব। তুই শুধু বাইরের দিকটা নজরে রাখ, তাহলেই হবে।’

মাহতিম চলে যেতেই নাজ কল করে তার সঙ্গী রিভাকে,
‘ রিভা শুনতে পাচ্ছ?’

‘হ্যাঁ বলো।’

‘ মাহতিম ফিরে এসেছে।’

‘ হোয়াট? তোমার কি মাথা ঠিক আছে? ভুলভাল বকছো কেন?’

‘ আমার মাথা একদম ঠিক আছে। একটু আগে মাহতিমের সাথে আমার দেখা হলো। সে আমাকে বলল, তাকে সাহায্য করতে।’

‘ তুমি করবে তাকে সাহায্য?’

‘ হ্যাঁ, আমি তাকে সাহায্য করব।’

‘ বিষয়টা কি সবাইকে জানাবো?’

‘ এখন না। সময় হলে আমি জানাবো। আমার আরো কিছু খোঁজ নেওয়া বাকি।’

নাজ কল রেখে শুয়ে পড়ে। অনেক প্রশ্ন মাথায় রয়ে যায়।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই অহনা তার বাবার কাছে যায়,
‘ বাবা আমি বিয়েটা করব।’

রোস্তমের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে আসে। হ্যারি, টিকু, রুমি, ইরা ‘হুররে’ বলে উঠে। অহনা সিদ্ধান্ত নেয় ময়নাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। তাই ময়নার বাবাকে খবর জানায় আসতে।

খবর জানাতে দেরি হলো, কিন্তু তার আসতে দেরি হলো না। এসেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরল। অহনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে মেয়েকে নিয়ে যেতে চাইলে রোস্তম বাঁধা দেয়,
‘ভাই, মেয়েটা এই কয়দিনে মন জয় করে নিয়েছে। এখন হঠাৎ চলে গেলে আমরা সবাই কষ্ট পাব। কিছুদিন পর আমার মেয়ের বিয়ে, বিয়ের পর‌ই না হয় যাবে।’

‘ তাহলেতো ভালোই হলো। ঠিক আছে তবে।’

‘ আপনিও থেকে যান। কয়টা দিনের‌ই ব্যাপার শুধু। তারপর মেয়ে নিয়ে চলে যাবেন।’

ময়নার বাপ আর অমত করে না। তিনিও থেকে যান।
রোস্তম আরেক দফা মোড়ল বাড়ি গিয়ে জানিয়ে আসেন, মেয়ে তার বিয়েতে রাজী হয়ে গেছে। মোড়ল‌ও খুশি হয়। বাড়ির মহিলাদের ডেকে বলে, ‘কাল‌ই তাহলে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। ছেলেকেও নিয়ে যাব। বিয়ে হবে ছেলে-মেয়ের, তাদের দেখা হ‌ওয়া, কথা হ‌ওয়াটা জরুরি।’

রোস্তম চলে আসে বাড়িতে। এখন তার অনেক কাজ। একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। বাজারে গিয়ে নিজের হাতে বাহারী খরচ করে আনলেন। এলাকার অনেক মহিলা সাহায্য করতে আসল। মোড়লের বাড়ির ব‌উ হবে অহনা, সেটা ভেবেই সবাই হিংসেয় জ্বলছে, কিন্তু প্রকাশ করছে না, উপরে উপরে ভালো সাজতে সবাই ইচ্ছুক।

অহনার মনে খারাপ প্রচুর। বার বার‌ মাহতিমের কথা মনে পড়ছে। কয়েকদিনেই কেমন আপন হয়ে গেল লোকটা, আর এখন কাছে নেই। হাঁসফাঁস লাগছে অহনার। জানালায় চোখ দিতেই পুনরায় মতিকে দেখতে পায়। একটা লোকের সাথে কথা বলছে সে। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কোনো কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে। অহনা বিরক্ত হয়‌ মতিকে দেখে। মনে মনে আওড়ালো,’ এই উটকো ঝামেলা আবার কি করতে আসছে কে জানে? সতর্ক থাকতে হবে আমাকে…..

চলবে…..

#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম

২১.
অহনা জানালার কাছে যেতেই মতি এগিয়ে আসে। অহনা জানালা বন্ধ করে দিতে চাইলে মতি ধরে ফেলে,
‘‌আমাকে দেখতে ভালো লাগে না, সেটা না হয় মানলাম। কিন্তু এখন দেখছি ঘৃণাও করো।’

‘ অযথা কথা বাড়াবেন না। আমি মোটেও আপনাকে তেমন কোনো কথা বলিনি। চলে যান।’

‘ চলেতো যাব, কিন্তু তোমাকে সাথে নিয়ে।’
মতি চোখ মেরে লোকটাকে আসতে বলল। লোকটা এসেই অহনার মুখে রুমাল চেপে ধরে। জ্ঞান হারিয়ে অহনা লুটিয়ে পড়ে। মতি পৈশাচিক হাসি দিয়ে অহনাকে সাথে নিয়ে চলে যায়।

রাত হয়ে এসেছে, অথচ অহনাকে পাওয়া যাচ্ছে না। রোস্তম পায়চারি করছে ঘরে। বিকেলের পুরো সময়টা খুঁজে কাটিয়েছে। এই মুহূর্তে থানায় ডায়রি করতে পারে না। লোকে মন্দ কথা বলবে। কাল দেখতে আসবে, আর আজ মেয়ে পালিয়েছে, বিষয়টা মানুষের কানে যাওয়ার আগেই অহনাকে খুঁজে পেতে হবে। ময়না রোস্তমের পাশে এসে দাঁড়ায়। বলল,
‘চাচা, আমি অহনা আপাকে দেখেছি বিকেলে, এরপর থেকে আর দেখিনি। শেষবার তার ঘরে যেতে দেখেছি। বের হতে দেখিনি ঘর থেকে, আমিতো বাইরে ছিলাম, তবুও খেয়াল ছিল। ভেতরে ঢুকল কিন্তু আর বের হলো না। আমার কেমন জানি খটকা লাগছে।’

‘ কি বলতে চাইছো তুমি? তার মানে…. কেউ তাকে ঘর থেকে..’

‘ না চাচা, আমি এমনটা বলিনি। এখনতো সব বিপদ শেষ। এখন কেউ কেন ঘর থেকে নিয়ে যাবে?’

‘ নিশ্চয় আমার মেয়েকে কেউ অপহরণ করেছে। কিন্তু এখন আমি কি করব? আল্লাহ না করুক, যদি মেয়েটার কিছু হয়ে যায়?’

‘ এমন কথা বলবেন না। অহনা আপা ঠিক চলে আসবে।’

সবার মন ভার। বাইরের লোককে জানানো হয়নি। অহনার ঘরে দরজা লাগিয়ে বলা হয়েছে, পরদিন অনেক কাজ তাই এখন ঘুমাচ্ছে। ঘুমের কথা বলে পুরো বিকেল কাটিয়ে দিল। এখন‌ও আসছে না।

মতি অহনাকে নিয়ে যায় একটি বাংলোতে। চারিদিকে গাছপালায় আবৃত জায়গাটার মাঝ বরাবর বাড়িটি। রাত গভীর হতেই অহনার জ্ঞান ফিরে আসে। পাশেই দেখতে পায় মতি সিগারেট টানছে। নাকে গন্ধ আসতেই অহনা কাঁশি দিয়ে উঠে।
সাথে সাথেই মতি সিগারেট ফেলে দিয়ে অহনার কাছে আসে।

অহনা নিজেকে বড় একটি খাটে আবিষ্কার করে। উঠেই বলল,’ আমি এখানে কেন?’

মতি গলা পরিষ্কার করে বলে,’ এখানেই থাকার কথা ছিল তোমার।’

‘আপনি এখানে এনেছেন তাই না?’

‘ জানার পরেও আবার জিজ্ঞেস করো কেন?’

‘ আমি বাড়ি যাব।’ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলে,’ রাত হয়ে গেছে অনেক। বাবা চিন্তা করছে হয়তো। এতক্ষণে সবাই জেনে গেছে। কি করলেন আপনি?’

‘ এছাড়া উপায় ছিল না। কি করতাম আমি? নিজের ভাইয়ের সাথে তোমার রোমান্স দেখতাম?’

‘ দরকার হলে সেটাই করতেন। আমার পেছনে কেন পড়ে আছেন? আমি কি ক্ষতি করেছি আপনার? আমার দোষটা কি?’

‘ তোমার একটাই দোষ, তুমি সুন্দরী। তুমি এতটাই সুন্দর যে সারাজীবন তাকিয়ে থাকলেও নজর লাগবে না কখনো।’

‘আপনার নজরটাই খারাপ। কখনো কাউকে ভালো চোখে দেখেন না। কাউকে মন দিয়ে ভালো নজরে দেখলেই বুঝতেন প্রতিটা মানুষ কত সুন্দর।’

‘ তুমি ছাড়া আর কেউ সুন্দর না। তোমার মধ্যে কোনো খুঁত নেই। সবার মাঝেই কিছু না কিছু খুঁত থাকে। তুমি নিখুঁত। তাই তোমাকেই চাই।’

‘ মানুষ তার খুঁতের জন্য‌ই নিখুঁত। আপনার মন থাকলে আমি হয়তো একটু হলেও গলতাম। এখন তা মনে হচ্ছে না। আমাকে যেতে হবে। বাবা হয়তো খুঁজে মরছে।’

‘ সে যাই বলো। কার মধ্যে কি আছে না নেই, আমার সেটা দেখার দরকার নেই। আমার তোমাকে চাই, ব্যাস। আর কিছু লাগবে না। আর এই বাড়িটা দেখছ যে, এটা আমার বাবার তৈরি বাংলো। মাঝে মাঝে বাবা আসেন, আমি আর ভাইও আসি। এখন কেউ আসবে না এদিকে। সবাই বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত। কেউ আসবে না এখানে। তোমাকে বাঁচাবে কে আমার থেকে?’

‘ আপনাকে আমি খারাপ ভাবলেও কিছুটা মানবিক ভেবেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে আপনার মতো নরপশু আর কেউ নেই। পৃথিবীর খারাপ লোকগুলোর মধ্যে আপনি একজন।’

‘ কালকেই তোমাকে বিয়ে করব। তুমি রাজী না থাকলেও।’

‘ আমি আপনাকে বিয়ে করব না।’

‘ করতেতো তোমাকে হবেই। আমি যে মানব না।’

‘ আমি এখান থেকে যেতে চাই। যেতে দিন আমাকে। আমি কখনোই আপনাকে চাই না।’
অহনা চিৎকার করে বলে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে,’ কেন আমার সাথেই বার বার এমনটা হয়। আমি কি এমন দোষ করেছি, যার জন্য এমন শাস্তি পাচ্ছি? আমি চাই না আর কাউকে জীবনে, আমাকে মুক্তি দাও তোমরা।’

‘ কি করে মুক্তি দিই তোমাকে?’ মতি অহনার কাছে বসে বলল। পরক্ষণেই আবার বলল,’ চাইলেই আমি তোমার সাথে এখন যা ইচ্ছা করতে পারি। কেউ বাঁচাতে আসবে না। কিন্তু আমি সেটা চাই না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তাই চাইবো নিজে থেকে আমার কাছে ধরা দাও।’

অহনা কাঁদে। ঘৃণা ভরা চোখে তাকায় মতির দিকে,
‘ কাপুরুষ আপনি।’

‘ হজম করে নিলাম। যা ইচ্ছা বলো।’

অহনা উঠে দরজার দিকে যায়। মতি তার হাত টেনে ধরে,
‘ তোমাকে বেঁধে রাখিনি কষ্ট পাবে বলে। কিন্তু এভাবে তিড়িং বিড়িং করলে বাঁধতেই হবে। কিছু করার নেই।’

অহনা নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয়। মতি বিরক্তিতে ‘চ’ এর মতো করে শব্দ করে,
‘এভাবে লাফাচ্ছ কেন? আমাকে কি শান্তিতে থাকতে দেবে না? আমি আজ পর্যন্ত কখনোই মেয়ে দেখে এতক্ষণ কিছু না করে থাকিনি। তোমাকে বিয়ে করব বলেই কিছু করছি না, সহ্য করছি।’

অহনা দেখে, এসব কথা বলার পরেও চোখে কোনো লজ্জা নেই মতির,
‘ সব মেয়েদের সাথেই ফ্লার্ট করেন?’

‘ অনেকের সাথে করেছি। কিন্তু আর করব না। তোমাকে পেয়ে গেছিতো।’

‘ ঘৃণা করি আপনাকে। আপনি একটা অস*ভ্য লোক, খারাপ লোক, বাজে লোক।’

‘ অসভ্যতামির কি দেখেছ?। সব করা বাকি আছে এখনো। বিয়েটা করে নিই কালকে, তারপরেই সব অস*ভ্যতামি করব, অপেক্ষা করো। আর যদি এভাবে লাফালাফি করো তাহলে আমি নিজের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলব। কিছু একটা করে বসব তখন।’

অহনা ভয়ে চুপ হয়ে যায়। কোনো কথা বলে না। দু-হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে খাটের উপর গিয়ে বসে।

মাহতিম নিমোকে খুঁজে মরছে। আরেকবার নাজের সাথে দেখা করবে ভেবে নেয়। ইতিমধ্যে নাজের কাছে খবর এসেছে ক্যাপ্টেন নিমোকে কেউ হ*ত্যা করেছে নির্ম*মভাবে। মাহতিম নিজের বাড়ি আসে। মাহতিম কে দেখেই নাজ এগিয়ে আসে,’ একটা নিউজ আছে!’

‘ কি নিউজ?’

‘ ক্যাপ্টেনকে কেউ মে*রে দিয়েছে।’

‘ এটা হতে পারে না। এবার আমি কিভাবে সব সামলাবো? উনি আমার একমাত্র ভরসা ছিল।’ মাহতিমের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে।

‘ শান্ত হয়ে বোস। এত ভাবলে হবে না। তুই স্ট্রং, তুই পারবি একাই সব সামাল দিতে।’

নাজ আর মাহতিম যখন কথা বলছিল তখন শুনে নিল ইশতিয়া‌। পুরো ব্যাপারটা হজম করে সে এপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল।

চলবে……

#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম

২২.
এপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে ইশতিয়া তার বাইকটা নিয়ে চলে যায়। ত্রিশ মিনিটের মাথায় অনুজ কুমারের সাথে দেখা করে। অনুজ একজন আর্মি অফিসার। ইশতিয়া গিয়েই তার ঘাড়ে চুমু খেল। শার্টের কলারটা ধরে নিজের দিকে নিয়ে এলো। অগণিত চুমু খেয়ে অনুজ বলেই বসল,’ আজ এতো আদর কেন?’

‘ পরে বলব।’

‘ সন্দেহ হচ্ছে। কি হয়েছে আজ? অনেক খুশি মনে হচ্ছে!’

‘ হুম অনেক খুশি, কারণ তুমি হেরে গেছ আমার কাছে।’

‘ কিহ? আমি কিভাবে হারলাম?’
অনুজ ইশতিয়াকে থামিয়ে দিয়ে তার গাল চেপে ধরে। ব্যথা পাওয়া সত্ত্বেও ইশতিয়া হাসে, বলল,’তোমার প্রিয় নাজের আশা বাদ দাও।’

‘ কেন, কি হয়েছে? আবার কোনো ভুল করল নাকি?’

‘ পা*গল হয়ে গেছে সে।’

‘ সেটা তুমি। ওকে কেন বলছ?’

‘ কারণ আমি নিজে চোখে দেখেছি। আমি এপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখতে পেলাম নাজের ঘরে ফিসফিস আওয়াজ হচ্ছে। তাই উঁকি দিলাম। দরজা খুলে দেখলাম ভেতরে কেউ নেই, অথচ নাজ কাউকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, এমন ভাবে বিহ্যাভ করছিল, মনে হয় তার পাশেই বসে আছে কেউ। কেমন অদ্ভুত কথা বলছিল। আমি আগেই বলেছি এ মেয়েটা সুবিধার না। আজ বুঝলাম তার মাথায় সমস্যা আছে।’

‘ আমি বিশ্বাস করি না। এটা কখনোই হতে পারে না।’

‘ কেন পারে না। নিজের চোখে দেখছি আমি। একা একা কথা বলছিল। আমার কথাই ঠিক ছিল, তুমি ভুল। তুমি বলেছিলে, আমি ভুল প্রমাণিত হলে তুমি আমাকে বিয়ে করবে। এবার করে নাও।’

‘ বিয়ে? তোমাকে? আমার বাড়ির ঝাড়ুদার‌ও রাখব না। বেরিয়ে যাও এখান থেকে।’

‘ আমি সবাইকে বলে দেব তুমি কথা দিয়ে কথা রাখোনি।’

‘ আমার তাতে কিছু আসে যায় না। যা ইচ্ছা করে নাও হটি।’

ইশতিয়া তেড়ে আসে অনুজের কাছে। অনুজ তাকে বলল, ‘ চলো মজা করি, এসব বাদ দাও‌।’

ইশতিয়া রাজি হয়ে যায়। অনুজ অন্যদিকে তাকাতেই মোবাইলের ক্যামেরা অন করে ফুলদানিতে রেখে দেয় ইশতিয়া। একজন আর্মি অফিসারকে ফাঁসাতে পারলে তাকে আর চিন্তা করতে হবে না। মনে খুশি নিয়ে অনুজের দিকে তাকায়। অনুজ তার ঘাড়ে নাক ঘষে, চুলের ঘ্রাণ নেয়। মুহুর্তেই একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তারা দুজন। ইশতিয়াও সাড়া দিতে থাকে অনুজের ছোঁয়ায়।

দীর্ঘ ত্রিশ মিনিট শেষে অনুজ তাকে ছেড়ে দেয়। ইশতিয়া পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে। অনুজ ইশতিয়াকে সামনে এনে তার কোলে বসায়।
অনুজ হাতের কাছে থাকা ফল কাটার ছু”রিটা হাতে নেয়। ইশতিয়া অনুজের ঠোঁটে দীর্ঘ চুম্বন করতেই ছ্যাঁত করে উঠে। ছু*রিটা তার বক্ষ ভেদ করে বেড়িয়ে এসেছে। অনুজ তাকে মাটিতে ফেলে দেয়। একটানে ছু*রিটা বের করে টিস্যু দিয়ে মুছে নেয়। ইশতিয়ার দম ফুরিয়ে আসে। কিছু বলতে চেয়েও আর পারে না। এর আগেই প্রাণ পাখি চলে যায়। অনুজ পৈশাচিক হাসি দিয়ে একজন কর্মচারীকে ডাকে। লা*শটাকে বাঁশঝাড়ে ফেলে দিতে বলে।

নাজ মাহতিমকে তার নিজের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে‌। মাহতিম কিছু বলে না। শুধু বলল,’ আমি ফিরে এসেছি আবার। কারণ আমার কাজ অসমাপ্ত ছিল। কাজ শেষ দিয়ে আবার চলে যাব।’

নাজ সন্দিহান হয়ে বলল,’ আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছিস?’

‘ নারে। তবে একটা কথা বলতে চাই, আমিতো থাকবো না, তাই বলেই দিই।’

‘ কি এমন কথা?’

‘ আহিকেতো চিনিস তাই না।’

‘ হ্যাঁ চিনি, কি হয়েছে? ও এখন কোথায়?’

‘ওর নিজের বাড়িতে আছে।’

‘ দেখা করেছিস?’

‘‌হু, কিন্তু সে আমাকে চিনতে পারেনি।’

‘চেনার কথাও না। আমি নিজেও চিনতে পারিনি।’

‘ আচ্ছা বাদ দে। তুই কি এখানেই থাকবি নাকি চলে যাবি?’

‘ এখানে কেন থাকব? বাড়ি যাব আমি।’

‘ আমি পৌঁছে দিই তাহলে।’

‘ লাগবে না। আমি যেতে পারব।’

‘ধন‌্যবাদ!’

নাজ চলে যেতে লেগেও দাঁড়ায়,’ ধন্যবাদ কেন?’

‘ আমাকে সাহায্য করছিস তাই। তুই ছাড়া আর কেউ নেই আমাকে সাহায্য করার।’

‘ আচ্ছা ঠিক আছে। এখন যা।’

মাহতিম চলে যায়। সকালেই খবর নিয়েছে একজন বড় মাদক ব্যবসায়ী আটক পড়েছে। কিন্তু তাদের সঙ্গীরা ধরা পড়েনি। মাহতিম চলে যায়, বিপদের পরোয়া না করে সে তাদের ধরতে যায়। বন্দর পাড় হয়ে সিদ্ধারমোড় যায়। সেখান থেকে শ্রীপুর গোডাওনে যায়। দেখতে পায় লোকগুলো তারাতাড়ি করছে। আজ রাতের মধ্যেই সব আলাদা করে রাখবে। মাহতিম পুলিশকে কল করে। কন্ঠ নকল করে মহিলার স্বরে ইন্সপেক্টরকে বলল,’ স্যার আমাকে বাঁচান। ওরা আমাকে মে*রে ফেলবে। বাঁচান আমাকে।’
তারপর সেখানকার ঠিকানা দিয়ে দিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ আসে। এভাবে মাদক সাপ্লাই করতে দেখে লোকগুলোকে নিয়ে যায়। কিন্তু কোনো মহিলা পায় না। লোকগুলোকে আরেকদফা মেরে জিজ্ঞেস করে কোন মেয়ের সাথে কি করেছে? একজন শেষে মার সহ্য করতে না পেরে বলে দিল, সে মে*রেছে মেয়েটাকে।

তার আরও গভীর হতেই অহনা পা টিপে টিপে বের হয়। দরজা খোলার চেষ্টা করতেই সেটা নিজে নিজে খুলে যায়। অহনা আনন্দিত হয়ে বাইরে বেরোয়। দেখল মেইন গেইটটাও খোলা। দৌড়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু আর যেতে পারে না। বাড়ির গেইট লাগালো। অহনা চেষ্টা করে বিফল হয়। অনেকবার চেষ্টা করো যখন সফল হয়না তখন হতাশ হয়ে পড়ে,আবার ঘরে ফিরে যায় । দেখতে পায় মতি জেগে আছে। খাটের কিনারায় ঘুমিয়ে ছিল,
‘ পালাতে চেয়েছিলে কেন?’

অহনা কিছু বলে না, চুপ করে থাকে। মতি আবারো ধমক মেরে বলে,’ পালাতে কেন গিয়েছিলে? আমি তোমাকে বিয়ে করার পর তোমার বাড়ি যাব। এখন দয়া করে পালানোর চেষ্টাও করো না‌।’

অহনা দমে যায়‌। কিছু না বলে খাটে এসে শুয়ে পড়ে। ওর উদ্দেশ্য, দিনের বেলা পালাতে সুবিধা হবে‌।

সকালের সূর্য উঠতেই সবাই কাজ শুরু করে দেয়। রোস্তমের থেকেও গ্রামের মহিলাদের আগ্রহ বেশি। তারা নিজেরাই সব করে নিচ্ছে। কেউ কেউ অহনাকে খুঁজছে।

মোড়ল বাড়ির সবাই তৈরি হয়ে নেয় মেয়ে দেখতে যেতে। আরিশের মা গয়না নেয় অহনার জন্য। আরিশের বিয়ের প্রতি কোনো ইচ্ছা ছিল না। রসালো রশিদ এমনভাবে মেয়ের বর্ণনা দিল যে, না দেখেই এক প্রকার ভালোবেসে ফেলল। রশিদ তাদের বাড়ির অতি পরিচিত একজন কাজের লোক। সে সবসময় মোড়লের সাথে থাকে। তাই সেও দেখেছে অহনাকে। আরিশের মনে কিছুটা জায়গা করে নেয় অহনা। অহনা বা আরিশ কেউ কাউকে দেখেনি। দুজনেই পড়াশোনার জন্য শহরে ছিল।

ভোর হতেই নাজ বেরিয়ে পড়ে। মাহতিম বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। নাজকে বেরুতে দেখে তার খটকা লাগে। তাই পিছু নেয়। দেখতে পায় নাজ গাড়ি নিয়ে সোজা অনুজের অফিসের দিকে র‌ওনা হচ্ছে ‌। মাহতিম‌ও পিছু পিছু যায়। একবার ভেবেছে, ডেকে ঘটনাটা জেনে নেবে কিন্তু পরে আর এটা করেনি। নাজকে যেতে দিল। গেলেই জানতে পারবে, কেন নাজ শত্রুর কাছেই যাচ্ছে…..

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে