ছায়া মানব পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
675

#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম

১৬.
সকালে ফ্রেস হয়েই অহনা ব্যাগ গোছাতে থাকে। রোস্তম এসেই মেয়েকে ব্যাগ গোছাতে দেখে জিজ্ঞেস করে। কিছু বলে না অহনা। তৈরি হয়ে অন্যদের বলল,’ তারাতাড়ি রেডি হয়ে নে। আজকেই চলে যাব।’

রোস্তম বাধা দিয়ে বলে,’ নারে মা, আর কয়দিন পর না হয় যাবি। এখন যাস না।’

‘ না বাবা, পরীক্ষা আছে আমার। তুমিও চলো, আমি কি একা রেখে যাব নাকি তোমাকে?’

‘ আমি এই বাড়ি ছেড়ে কীভাবে যাব। তুই আর দুদিন পর যাস।’

অহনা নারাজ। বাবাকে নিয়ে সে চলে যাবে। হ্যারি বলল,’ গ্রামে কখনো আসা হয়না। একদিন অন্তত থাক। এলাকাটা ঘুরে দেখি আমরা।’

‘ এখানের পরিবেশ পরিস্থিতি আমাদের বিপরীত। এখানে থাকা মানেই বিপদ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে গেলেই ভালো হয়।’

মাহতিম পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। বুকের সাথে হাত দুটো ভাঁজ করে এক পাশে দেয়ালের সাথে ঠেস মেরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলল না। অহনার দিকে তাকিয়ে আছে সে। অহনা এক নজর মাহতিমকে দেখেই আবার চোখ সরিয়ে নেয়।
ইরা একদম যেতে নারাজ। রোস্তমকে বলল,’ আঙ্কেল, ওকে চলে যেতে বলুন, আমরা থাকব।’ তারপর অহনার দিকে তাকিয়ে বলে,’ তুই যেতে পারিস, আমরা কিছু বলব না। পারলে এখুনি চলে যা। আমরা থাকব আঙ্কেলের সাথে।’

অহনা চোখ রাঙায় ইরাকে। ইরা দমে যায়। রুমি বলেই ফেলল,’ তুই আমাদের বের করে দিতে চাস নাকি তোদের বাড়ি থেকে?’

অহনা করুণ চোখে তাকায় রুমির দিকে,’ ছি, কি বলছিস এসব? দেখলি না কতকিছু ঘটে গেল এখানে। আমরা গেলেই মঙ্গল হবে। তোদের কথা ভেবেই ভয় পাচ্ছি। আমার কিছু হয়ে গেলে সমস্যা নেই, কিন্তু তোদের কিছু হলে আমি আঙ্কেল আন্টিকে কি জবাব দেব? তোদের ক্ষতি হোক আমি চাই না। আমাকে ভুল বুঝিস না।’

অহনা মাহতিমের দিকে চোখ দিতেই সে ইশারায় ডাকে। অহনা নজর দেয় না তার দিকে। গোছগাছ প্রায় শেষ। নাস্তা করেই র‌ওনা দেবে।

অহনা কল পাড়ে যায় হাত-মুখ ধুঁতে। কল পাড় পিচ্ছিল খুব। পা দিতেই উল্টে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হতেই একটি শক্তপোক্ত হাত ওকে ধরে নেয়। মাহতিম বলল,’ সামলে চলবে। এতো তাড়াহুড়োর কি আছে?’

‘ তুমি জানো না, এখানে পদে পদে বিপদ লুকিয়ে আছে। আমাদের যাওয়া উচিত। তুমিও তৈরি হ‌ও।’

‘ আমি কেন?’

‘ তাহলে ঠিক আছে, যক্ষ হয়ে এই বাড়ি পাহারা দাও।’

‘ আমি বলতে চেয়েছি, আমি কি তৈরি হবো?’

‘ আমিতো ভুলেই গিয়েছি তুমি কখনো ফ্রেস হ‌ও না। সবসময় এক‌ই ড্রেস, কিছু খেতেও দেখি না। অদ্ভুত তুমি! অথচ তোমার কাছে গেলেই কেমন নেশালো গন্ধ পাই। তোমার হরমোনের প্রভাব পড়ে আমার উপর। মানে আমি বলতে চেয়েছি, তোমার গায়ের স্মেলটা আমার ভালো লাগে। আমাকে তোমার দিকে টানে। ইচ্ছে করে সারাজীবন তোমার সাথে ঐ মুহুর্তকে থামিয়ে কাটিয়ে দিই। কিন্তু এটা হ‌ওয়ার নয়। আমি…..’

অহনাকে থামিয়ে দিয়ে মাহতিম বলল,
‘ তোমার কি বলা শেষ?’

‘ না আরো অনেক কিছু বলার আছে, সেটা শোনার সময় হয় না তোমার।’

‘ এখন বলবে?’

‘ বলব না। তুমি শোনার যোগ্য না।’

‘ আচ্ছা শুনো!’

অহনা পেছনে তাকিয়ে দেখল ইরা এসে গেছে। ইরা অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলল,’ একা একা কার সাথে কথা বলছিস? এখানেতো কেউ নেই। তোকে বার বার দেখছি কারো সাথে কথা বলছিস, আদৌ কেউ নেই। বিষয়টা ভাবাচ্ছে আমাকে।’

‘ এদিকে তাকা!’

অহনা হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল একটা বিড়ালকে, বলল,’এই বিড়ালটার সাথে কথা বলছিলাম। গম্ভীর থাকে সবসময়। ইচ্ছে করে তার গলা টিপে দেই।’

‘ ওফফ্ তোর যা ইচ্ছা কর। আমি যাচ্ছি।’

ইরা চলে যেতেই মাহতিম বলল,’ আমাকে কি তোমার বিড়াল মনে হয়?’

‘ ইশশ্, তার মানে বুঝে গেছ এটা তুমি? আমি কিন্তু বলিনি একবার‌ও। নিজেকেই নিজে বিড়াল বললে।’

‘ তুমি একটু বেশিই বুঝ।’

‘ কারণ আমার ব্রেইন ভালো।’

‘ একদম না।’

‘ প্রমাণ চাই নাকি তোমার?’

‘ হ্যাঁ চাই, আমার জানামতে তোমার ঘটে বুদ্ধি নেই।’

‘ কি প্রমাণ দিতে হবে?’

‘ বুদ্ধিমান হলে এখান থেকে যেতে না। আর কয়টা দিন থেকে যেতে। বুদ্ধি নেই বলেই চলে যেতে চাইছো!’

‘ এটা কেমন কথা হলো?’

‘ যা বলছি ঠিক বলছি। দেখো আহি, তোমার মা চলে গেছে বেশিদিন হয়নি। এখন পিতৃভূমি ছেড়ে চলে গেলে লোকে কথা শোনাবে। তুমি জানো না লোকের কথা কতটা বিষাক্ত হয়। এখানে থাকাটা উত্তম হবে।’

অহনা চমকে উঠে, আহি? আহি কে? তুমি কি আমাকে আহি বলে ডাকলে নাকি?’

মাহতিম আমতা আমতা করে বলে,’ আসলে, তোমার নামটা ছোট করে নিয়েছি। অহনা থেকে আহি।’

‘ ওহ, ঠিক আছে, আমি যাব না। কিছুদিন থেকে যাই আরো। খুশিতো এবার তুমি?’

‘ বুদ্ধিমানের মতো কাজ করলে।’

‘ এদিকে আস। আমি কেমন বুদ্ধিমান তোমাকে দেখাবো।’

মাহতিম চলে যায়। আর এক মুহূর্তও দেরি করে না। অহনা হেসে উঠে।
ঘরে গিয়ে সবাইকে একবার গম্ভীর মুখে পর্যবেক্ষণ করে দেয় অহনা। মুখে হাসি নেই কারো। চলে যাবে ভেবে কষ্ট পাচ্ছে।
অহনা খাটের উপর পা ছড়িয়ে বসে বলল,’ বৃষ্টি আসবে আজকে।’

‘ টিকু বলল,’ হ্যাঁ, সেই বৃষ্টিতে মাছ পড়বে প্রচুর, সেটা তুই ধরবি আর গালে ফুরবি।’

‘ আমরা যাচ্ছি না কোথাও।’

অহনার কথায় সবাই সচকিত হয়ে উঠে। রুমি আয়েশি ভঙ্গিতে বলে,’ কি বললি এখন? আমরা যাচ্ছি না ফিরে?’

‘ কানে এয়ারফোন নেই, তাও শুনতে কষ্ট হচ্ছে নাকি তো। এক কথা দুইবার বলব না‌।’

রুমি মন খারাপ করে নিতেই অহনা তার কাছে এসে হেসে বলল,’ চলো এবার, পার্টি করি‌। অনেক মজা হবে।’

অহনার ভিন্ন রূপ দেখে সবাই আনন্দিত হয়ে উঠে। আজকাল তাকে একটু বেশি গম্ভীর বা হাসিখুশি মনে হয়। আগে তেমন ছিল না।

সবাই মিলে বের হয় গ্রাম ঘুরে দেখতে। অহনা সবার থেকে আলাদা হাঁটছে, পেছনে। হ্যারি, টিকু, রুমি, ইরা অনেক এক্সাইটেড। মাঝে মাঝে অহনাকে বলছে, কিন্তু তার কর্ণপাত নেই। একেতো গ্রাম তার আগের পরিচিত অন্যদিকে মাহতিমের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটছে সে‌।

হাঁটার সময় অহনার মনে হলো কেউ তার পিছু নিয়েছে। পেছন ফিরে দেখল কেউ নেই। মাহতিম তার পাশেই হাঁটছে, বলল,’ কি হলো?’

অহনা নিজেকে ঠিক রেখে বলল,’ কিছু না।’

আবারো অহনার মনে হলো কেউ পেছনে। গ্রামের সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, বাঁশঝাড় অগণিত। কেউ থাকলেও তাকে দেখা যাবে না। অহনা বার বার পেছনে দেখছে। এক পর্যায়ে মাহতিমকে বলল,’ তুমি কি পেছনে কাউকে দেখতে পাচ্ছ?’

মাহতিম পেছনটায় ভালো করে চোখ বুলিয়ে বলল,’ না, কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।’

‘ ওহ।’

ইরা অহনার সামনে থাকায় ওর কথা সব শুনতে পায়। একা একা কারো সাথে কথা বলতে দেখে ইরা আরো ঘাবরে যায়। ভাবে, হয়তো জিনে আছর করেছে অহনাকে। না হয় এতবার একা একা কথা বলে কেন?

অহনা আবারো বিরক্ত হয়, কেউ তার পিছু নিয়েছে সেটা বেশ ভালো বুঝতে পেরেছে। মাহতিম‌ও অহনার দুশ্চিন্তার জন্য সতর্ক দৃষ্টি দেয়। একটু পর‌ই অহনাকে বলল,’ কেউ তোমাদের অনুসরণ করছে।’

অহনা ব্রু কুঁচকে ফেলে,’ কেউ কেন অনুসরণ করবে?’

‘ আমার জানা নেই। খুব শিঘ্রই সে সামনে আসবে।’

‘ কে সে?’
Sathi Islam : সাথী ইসলাম

চলবে….

#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম

১৭.
গ্রামের পাশের সরু গলি দিয়ে ধান ক্ষেতে আসতেই মোড়লের সাথে দেখা হয়। রোস্তম সালাম দিতেই লোকটা থামে। সবার দিকে তাকিয়ে বলল,’ রোস্তম যে, তা কেমন আছো?’

‘আপনাদের দোয়ায় ভালোই আছি।’

‘এরা কারা? এলাকায় নতুন মনে হচ্ছে।’

রোস্তম গলা নামিয়ে সরল কন্ঠে বলল,’ শহর থেকে এসেছে, আমার মেয়ের বন্ধু সকল।’

‘ মেয়ে ক‌ই? তাকে তো অনেক দিন দেখি না। কলেজে পড়ে না?’

রোস্তম পেছন থেকে টেনে অহনাকে সামনে দাঁড় করালো,’ এই যে আমার মেয়ে। অনেকদিন পর গ্রামে পা রাখল। শহরেই পড়ে।’

অহনা সালাম দিল মোড়লকে। সালাম নিয়েই মোড়ল অহনাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে,
‘ মেয়েতো বড় হয়ে গেছে অনেক। তা কিছু কি ভেবেছ?’

‘ এখনো ভাবা হয়নি। মা ম/রা মেয়েটাকে এখন চাপ দিতে চাই না‌।’

‘ বিষয়টা আমি ভাবব। আসি রোস্তম আলী, আবার দেখা হবে।’

অহনা রোস্তমের দিকে তাকালো,’ বাবা, লোকটা তোমাকে কি ভাবতে বলেছে?’

‘ কিছু না। চল তুই।’

অহনা আবার পেছনে চলে আসে। মাহতিমের মুখটা লাল হয়ে আছে। অহনা তুড়ি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করে,’ কি হলো? কি ভাবছ?’

মাহতিম অহনার দিকে তাকায়,’ যা তোমার বাবা ভাবছে।’

‘ বাবা আবার কি ভাবছে?’

‘ কিছু না। কেউ পেছনে আসছে।’

মাহতিম দাঁড়িয়ে পড়ে। অহনা সবার সাথে তাল মিলিয়ে তাদেরকে চারিদিকটা দেখায়।

পেছন থেকে মতিকে দেখে মাহতিম ভাবার চেষ্টা করে তাকে চিনে কিনা। না চিনে না। কখনো দেখেনি। অহনা পেছনে তাকালেই লোকটা কেমন লুকিয়ে পড়ছে। মাহতিম ভেবে পায় না লোকটা এমন করছে কেন?

অহনাকে গিয়ে বলল। অহনা থেমে যায়। সবাই অনেকটা সামনে চলে যায়। মতি বেরিয়ে আসতেই অহনা তার কাছে যায়,
‘ সমস্যা কি আপনার? পিছু নিলেন কেন?’

মতি পাশে কাউকে না দেখে বলল,’ কাল রাতে একটা বিষয় দেখেছি, বুঝতে পারছি না সত্যি কিনা।’

‘ কি দেখেছিলেন?’

‘ আমি দেখেছিলাম তুমি উড়ছিলে আকাশে। আমি অনেকবার খেয়াল করেছি দেখলাম উড়ছিলে। স্যরি তুমি করে বললাম, আসলে তুমিতো এখন আর ছোট না, তাই বললাম।’

অহনা আঁতকে উঠে, বলল,’ ঠিক আছে, কিন্তু আমাকে দেখলেন কিভাবে?’

‘ আমি মানে…. আমার ঘুম আসছিল না রাতে, তাই হাঁটতে বেড়িয়েছিলাম।’

‘ আর কাউকে কি দেখেছেন?’

‘ না, তুমি একা। কিন্তু এটা বুঝতে পারছি না কিভাবে উড়েছিলে তুমি?’

অহনা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, বলল,’ আপনি ভুল দেখেছেন। মানুষ কখনো উড়তে পারে নাকি।’

‘ আমি ঠিক দেখেছি, এবার তুমি আমাকে সত্যিটা বলবে। কিভাবে তুমি পারলে। আমাকে বলো, না হয় খারাপ হয়ে যাবে।’

‘ এমন কিছুই হয়নি। আপনি কাকে দেখে আমাকে ভাবছেন কে জানে। চোখে দুই চামচ বেশি দেখেন। আমাকে যেতে হবে, বায়।’

‘ আমি জানি তুমি মিথ্যে বলছ। আমি জেনেই ছাড়ব কিভাবে এই শক্তি পেলে তুমি। এবার দেখো আমি কি করি!’

‘ কি করবেন? কিডন্যাপ করবেন?’

‘ দরকার হলে সেটাই করব। আমার জানতে হবে।’

অহনা চলে যেতেই মতি তার হাত চেপে ধরে,’ সত্যিটা বলে যাও। আমি ভুল দেখিনা কখনো। আমি একা নয় আরো অনেকে দেখেছে, সবাইতো আর ভুল দেখেনি।’

‘ বাহ, একটু আগে বললেন আপনি হাঁটতে বেরিয়ে দেখেছেন এখন বলছেন আরো অনেকে দেখেছে?’

‘কথা না বাড়িয়ে সত্যিটা বলো।’

‘ হাত ছাড়ুন।’

‘ ছাড়ব না।’

মতি হাত ছাড়ছে না দেখে মাহতিম তার নাক বরাবর ঘু*ষি মারে। নাক ফেটে র*ক্ত পড়তে থাকে। অদৃশ্য মার খেয়ে মতি চমকে উঠে। ব্যথার দিকে খেয়াল করল না সে।বলল,’ কে মা*রল আমাকে? এখানে কিছু তো গোলমাল হচ্ছে। আমি খালি চোখে দেখতে পাচ্ছি না।’

‘ নিজেকে গুটিয়ে নিন, আর চলে যান।’ অহনা রেগে চলে যেতেই মতি আবারো হাত চেপে ধরে।
মাহতিম কন্ট্রোল হারিয়ে ধা’ক্কা দেয় তাকে। মতি এবার কিছুটা ভয় পেল। কিছু বলতে যাবে, তখনি ময়না ডাকল অহনাকে। পেছনে পড়ে যাওয়ায় সবাই আবার ফিরে এলো। মতির এমন হাল দেখে রোস্তম জানতে চায় কি হয়েছে! মতি কোনো কথা না বলে প্রস্থান করে। অহনা

দাঁয়সাড়া দাঁড়িয়ে থাকে। মতিকে নিয়ে ভাবছে সে। ভয় পাচ্ছে এটা ভেবে, একদিন বিষয়টা সবাই জেনে যাবে, খুব শিঘ্রই। ময়না ওর কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকি দিতেই অহনার হুঁশ ফিরে। সবার সাথে আবার চলতে থাকে।

দুপুর হতেই সবাই ফিরে আসে বাড়িতে। ফ্রেস হয়ে খাবার খেয়ে নেয়। বাড়িতে মাত্র তিনটা রুম। একটায় রোস্তম থাকে, বাকি দুইটায় অহনা ও তার বন্ধুরা। ছেলেদের জন্য একটা রুম মেয়েদের জন্য একটা। বিকেলে সবাই শুয়ে আছে। ইরা আর রুমি দিনের তোলা সব ছবি স্ক্রল করে দেখছে। ময়না অহনার পাশেই তার কোমর জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে।

ইরা আর রুমির ছবি তোলা দেখে মাহতিম বলল,’ মেয়েরা এতো ছবি তুলে কি পায়?’

অহনা হেসে বলল,’ শান্তি।’

‘ আর কিছুতে কি শান্তি নেই?’

‘ এতো প্রশ্ন করো কেন? যেটা বুঝো না সেটা নিয়ে কথা বলতে নেই।’

মাহতিম চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার বলল,’ মন খারাপ?’

অহনা ফিসফিস করে বলল,’ তাতে তোমার কি? কথা বলো না। সবাই এমনিতেও আমাকে পাগল মনে করে।’

‘ বাইরে যাবে?’

‘ না।’

‘‌আচ্ছা, তুমি কেন ছবি তুললে না?’

‘‌আমার ভালো লাগে না।’

‘ কেন? তোমার কি শান্তি পেতে ইচ্ছে করে না?’

‘ সবার ভালো লাগা এক না। মেয়েরা স্বভাবত অনেক ছবি তুলে। আমি নই।’

‘ সেটা দেখতেই পেলাম। প্রায় হাজারটা ছবি তুলল। কিন্তু তুলে লাভ কি, বসে বসে এখন সব ডিলেট করছে। একটু পর সেখান থেকে পাঁচটা ছবি অবশিষ্ট থাকবে শুধু।’

‘ কি বলতে চাও?’

‘ তেমন কিছু না। কথা হলো, ডিলেট‌ই যখন করবে, তখন এতো ছবি তোলার মানে কি?’

‘ সেটা ওদের ব্যাপার।’

ময়না উঠে বলল,’ আপা তুমি কার সাথে কথা বলছ?’

অহনা মাহতিমের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙায়। মাহতিম বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। অহনা বলল,’ মনে মনে!’

ময়না যথাযথ উত্তর না পেয়ে আবারো শুয়ে পড়ে। অহনা উঠে পড়ে। বাইরে বেড়িয়ে দেখতে পায় মাহতিম কল পাড়ে থাকা একটি বেঞ্চের মধ্যে বসে আছে। অহনা পেছন থেকে তার কাঁধে হাত রাখে। মুহুর্তেই তা ভেদ করে বেরিয়ে আসল তার বুক বরাবর। মাহতিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অহনা দেখতে পায় তার চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। অহনার মনটাও হুঁ হুঁ করে উঠে,
‘ কাঁদছ নাকি?’

মাহতিম নিজেকে সামলে নেয়,’ ক‌ই নাতো।’

‘ আমি বুঝতে পারছি। কেন কষ্ট পাচ্ছ?’

‘ একদম না। বেশি ভাবছ।’

‘ আমি ভুল বলিনি। তোমার চোখ পড়তে পারি আমি।’

মাহতিম অহনার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দেয়,
‘ আচ্ছা, মৃ*ত মানুষ কি ভালোবাসার অধিকার রাখে?’

অহনা এমন প্রশ্ন শুনে উত্তর খুঁজে পায় না। নির্বাক দৃষ্টিতে তাকায় মাহতিমের দিকে। মাহতিম আবার বলে,’ মৃ*ত মানুষের কি কষ্ট হয়?’

অহনা এবার উত্তর দেয়,’ ভালোবাসার অধিকার সবার আছে। কষ্ট সবার হয়। কিন্তু তুমি এসব কেন বলছ?’

‘ আমার কষ্ট হয় কেন?’

‘ ধুর বোকা, তুমি কি আর…’

অহনা থেমে যায়। নিরবতা গ্রাস করে নেয় তাকে। বুকে কেমন চিনচিন ব্যথা হচ্ছে। কেমন একটা খাপছাড়া ভাব তার মনটাকে বিষিয়ে তুলে। হারানোর ভয় জেগে ওঠে।

রোস্তম অহনার মায়ের ছবিটা দেখছিল। কান্নাভেজা চোখ তার। ছবিটায় হাত বুলিয়ে বলল,’ মেয়েটাকে কোনো কূল কিনারা না করে চলে গেলে তুমি! স্বার্থপর তুমি। আমি কিভাবে কি করব? তুমি কি জানো, বাবা না থাকলেও মা তার সন্তানকে ভালোভাবে মানুষ করতে পারে। কিন্তু মা না থাকলে বাবা কেন পারে না? সবাই এটাই বলে। আমি জানি, আমি পারব মেয়েটাকে ভালোভাবে রাখতে, তবুও ভয় হয়, তুমি থাকলে সবকিছু আরো ভালো হতো।’

দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। রোস্তম চোখ-মুখ মুছে দরজা খুলে দেয়। মধ্যবয়স্ক একটি লোক এসেছে। রোস্তম আসার কারণ জিজ্ঞেস করতে বলল,’ কর্তা আমনেরে যাইতে ক‌ইছে।’

রোস্তম ভয় পেয়ে যায়। মোড়লকে তার ভালো মনে হয় কিন্তু বড়লোকদের সে বিশ্বাস করে না। কখন কি ঝামেলা দিয়ে বসে বলা যায় না। লোকটা আবার বলল,’ কর্তা বলেছে আছরের পর যাইতে। কথা আছে নাকি।’

চলে যায় লোকটি। রোস্তম বিভোর হয়ে ভাবে, কোনো ভুল করেছে কিনা। হঠাৎ ডাকাতে রোস্তম ভয় পেয়ে যায়। কিভাবে ক্ষমা চাইবে এই বিষয়টা কয়েকবার ভেবে নেয়…..
Sathi Islam : সাথী ইসলাম

চলবে……

#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম

১৮.
‘আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবে?’

মাহতিমের চোখ স্থির হয়ে যায়। উঠে যায় সে, দায়সারাভাবে দাঁড়িয়ে থাকে অহনার সামনে। অহনা পুনরায় বলল,’ একবার জড়িয়ে ধরবে?’

‘ কেন?’

‘ আমি চাইছি তাই!’

‘ কিছু চাওয়া অগোচরে থাকা ভালো।’

‘ ধরো না। একবার শুধু।’

মাহতিম নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। কষ্ট হচ্ছে তার, হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে দম নেয়,
‘ আমি দৃশ্যমান হলেই আমার শক্তি কমে যাবে। যে কাজের জন্য এসেছি সেটা অপূর্ণ থেকে যাবে।’

‘ এতো বাঁধা কেন? তাহলে কেন এসেছিলে আমার জীবনে?’

‘ আমি আসতে চাইনি। তুমি ডেকে এনেছো।’

‘‌আমি ডেকে এনেছি? কিন্তু আমিতো কখনোই তোমাকে ডাকিনি, চিনতাম‌ও না।’

‘ কে বলেছিল অর্ণব নামের সেই ছেলেটার সাথে সম্পর্কে জড়ানোর?’

‘ আমি তাকে চিনতে পারি নি। দু’মাসের পরিচয়ে তাকে আমার বিশ্বাস করা উচিত হয়নি।’

‘ এটাই কারণ।’

‘ক্ষমা চাইছি।’

মাহতিম অন্য দিকে চোখ ঘুরিয়ে রাখে। চোখ তার নত। কিছুতেই অহনার দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। গাল বেয়ে তার কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল,
‘ মানুষ কত সহজে হারিয়ে যায়। যাকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছি সেও হারিয়ে গেল।’

অহনা নাক টেনে বলে,’ তোমার এত কষ্ট কিসের? বলো আমাকে।’

‘ আমার কোনো কষ্ট নেই। জীবন নিয়েও কোনো আফসোস নেই। শুধু….’

‘ শুধু কি? এটাই বলবে তো, তুমি একজন ম্যাজিশিয়ান। তুমি ম্যাজিক করে সব করতে পারো। আমি জানি, আমার আগেই মনে হয়েছিল। কি, ঠিক বলছি তো?’

মাহতিম অহনার দিকে চেয়ে থাকে,
‘ হ্যাঁ, তুমি ঠিক। ঠিক তুমি। আমি একজন ম্যাজিশিয়ান, আমি জাদু জানি।’

‘ তাহলে কষ্ট কিসের? তুমি কেন কাঁদছো? চোখের পানি কখনো মিথ্যে হয় না।’

‘ আমি বুঝতেই পারছি না, কেন আমি কাঁদছি! কারণ অজানা।’

বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠে অহনার। মাহতিমের কাছে এগিয়ে আসে। অশ্রুসজল চোখজোড়া রক্তিম হয়ে আছে মাহতিমের। অহনার দিকে হাত বাড়ায়। কাঁধে দুহাত রাখে। অহনার চোখের কোণে জমে থাকা পানির কণা আঙুলের ঘষায় সরিয়ে দেয়,
‘ কাঁদছো কেন?’

‘ তুমিওতো কাঁদছো।’

মাহতিম দু হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নেয়,’ কাঁদছি না আমি। তুমি খুব বোকা, বুঝতে পারো না।’

‘ জড়িয়ে ধরো। আমার হাঁসফাঁস লাগছে।’

মাহতিম এক ঝটকায় অহনাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। উষ্ণ স্পর্শে কেঁপে উঠে অহনা। শক্ত করে মাহতিমের শার্ট খামচে ধরে। ছেড়ে দিলেই বুঝি হারিয়ে যাবে। কেঁদে কেঁদে শার্টের অনেকটা ভিজিয়ে ফেলেছে।
মাহতিম অহনার হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া টের পায়। গরম নিঃশ্বাস অনুভব করে। আলতো করে মাথায় চুমু খায়। কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দেয়,
‘ পাগলী মেয়ে, কান্না শেষ হয়েছে?’

অহনা জড়িয়ে ধরে আছে মাহতিমকে। মাহতিম ছাড়াতে চাইলেও সে আরো জোড়ালোভাবে ধরে আছে। অহনা বিরক্ত হয়ে বলল,’ এমন অদ্ভুত আচরণ করছো কেন? আর একটু থাকতে দাও।’

‘ ঘরে যাও। সবাই অপেক্ষা করছে।’

‘ সবাই ঘুমাচ্ছে।’

‘ তাহলে তুমি কি করছো?’

‘ চোখে দেখো না? আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি আগলে রেখেছি।’

‘ কোনটা তোমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি?’

অহনা মাহতিমের বুকে হাত রেখে বলে,’ এটা, এটা আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। কেউ ছিনিয়ে নিতে চাইলেও দেব না‌। এর উষ্ণতা থেকে আমি বঞ্চিত হতে চাই না কখনো।’

‘ তোমার জ্ঞান লোপ পেয়েছে। হুঁশে নেই তুমি। ছাড়ো আমাকে আর ঘরে চলো।’

‘ আরেকটু!’

মাহতিম সরিয়ে দেয় অহনাকে। বুকের গরম ওম থেকে ছাড় পেতেই অহনার কেমন শীত লেগে উঠে। শরীর তার তেজ হারিয়ে ফেলে। মাহতিম বলল,’ কতক্ষণ এভাবে ছিলে মনে আছে?’

অহনা অনুভূতির রোষানল থেকে বেরিয়ে আসতেই ওর মনে হয়, একটু আগেই জড়িয়ে ধরেছিল। লজ্জায় নুইয়ে যায়। আবেগের বশে কি করে বসল?

দৌড়ে ঘরে চলে যায় অহনা। মাহতিম ভাবতে থাকে, একটু আগে নিজেই এতো কান্ড করল একটু জড়িয়ে ধরার জন্য। আর এখন নিজেই লজ্জা পাচ্ছে।

ভালোবাসা সবাইকে কেমন বেহায়া করে দেয়। নির্লজ্জ করে দেয় নিমেষেই। প্রমময়‌ ছোঁয়া পেলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। সেটাই হলো অহনার ক্ষেত্রে।

আছরের পর রোস্তম হাজির হয় মোড়ল বাড়ি। বিশাল দৈর্ঘ ও প্রস্থ ব্যাপী বাড়ি। তবে আধুনিক বাড়ি বলা যায়। রোস্তম থমথমে পরিবেশ দেখে পিছিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরপরই প্রবেশ করে।

মোড়ল বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন। রোস্তমকে দেখে হেসে বলল,’ আসো, আসো। তোমার জন্য‌ই অপেক্ষা করছিলাম। একটু দেরি করে ফেললে বটে, তবে সমস্যা নেই‌।’

রোস্তম ক্ষমা চেয়ে নেয়। মোড়ল তাকে বসতে বলে। কিন্তু সে বসে না। মোড়ল অনেক জোরাজুরি করতেই রোস্তম সোফায় বসে। মোড়ল ঘরের দিকে মুখ করে বলে,’ অতিথির জন্য নাস্তা নিয়ে আয়।’

রোস্তম থমথম খেয়ে যায়। ভয়েভয়ে বলল,’ কর্তা, কেন ডেকেছেন আমাকে? আমি কোনো ভুল করিনি। কিছুদিনের মধ্যেই শহরে চলে যাব, মেয়েটা পড়বে, আমিও পাশে থাকতে পারব।’

‘ সেকি কথা? মেয়ে আবার চলে যাবে কেন? এবার না হয় একেবারে থেকে যাক। নিজের দেশের মাটি বলে কথা।’

‘ না কর্তা, মেয়েটা নিজের পায়ে দাঁড়ালে আমিও শান্তি পাব।’

নাস্তা এসে যায়। মোড়ল থাকে চা এগিয়ে দেয়। এতো খাতির যত্ন দেখে রোস্তম আরো কাঁচুমাচু হয়ে বসে। মোড়ল আবার বলল,’ মেয়ের চিন্তা আর করো না। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।’

‘ তা কেমন করে হবে? কখন আমার প্রাণ‌ও চলে যায়। মেয়েটাকে কোনো কূল করে দিতে পারলেই আমি শান্তি পেতাম।’

‘ আচ্ছা শুনো, আমার বড় ছেলেকে কেমন লাগে তোমার?’

রোস্তম ভেবে পায় না হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন?
‘ আপনার ছেলেরা হলো হিরে, নজরকাড়া, কার না ভালো লাগে বলুন?’

‘ আমি জিজ্ঞেস করেছি তোমার কেমন লাগে?’

‘ ভালোই লাগে, শহর থেকে পড়াশোনা করে আশা ছেলে, এলাকার‌ও উন্নয়ন হবে তাকে দিয়ে।’

‘ একটা অনুরোধ রাখবে রোস্তম?’

রোস্তম বিনীত হয়ে বলে,’ ছি ছি কর্তা, কি বলছেন আপনি? আপনি বললে জীবনটাও দিয়ে দেব। আপনি কেন অনুরোধ করবেন, আপনি আদেশ করবেন।’

‘ না, এখানে তুমি নিজেকে ছোট করে দেখবে না। এই মুহূর্তে আমি আর তুমি সমান। এটা ভেবেই আমি বলছি কথাটা।’

রোস্তম ঢোক গিলে নেয়,’ কি কথা?’

‘ তোমার মেয়েকে আজ সকালে দেখেই ভালো লেগে গেছে। বড় ছেলে আরিশের জন্য কবে থেকেই মেয়ে দেখছি, মনের মতো কাউকে পাইনি। তোমার মেয়েকে দেখে মনে হলো রুপে, গুনে সে আমার ছেলের জন্য উত্তম। আমি চাই তাদের দুই হাত এক করতে। তোমার কি মতামত? আমি জোর করবো না। জানতে চাই শুধু।’

রোস্তম আনন্দিত হবে নাকি বিষন্ন হবে বুঝতে পারছে না। চুপ করে র‌ইল।
মোড়ল আবার বলল,’ আমার ছেলে ভালো, তোমরা এই এলাকায় আছো, কখনো কি তাকে নিয়ে কোনো খারাপ কথা শুনেছো?’

রোস্তম এক গাল হেসে বলল,’ আমি ভাবতে পারিনি আপনার আমার মেয়েকে ভালো লেগেছে। আমার মেয়ের সৌভাগ্য এই বাড়িতে বিয়ে হবে। আমি রাজি।’

‘ আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে তারাতাড়ি তারিখটা ফেলে দেব, কি বলো বেহাই?’

রোস্তম ভেবে বলল,’ মেয়েকে একবার কথাটা জানানো জরুরি। যদি….’

‘ আরে কোনো ব্যাপার না। আর এমন ভয়ে ভয়ে থাকবে না। মনে করবে আমরা সমান। বেড়াই আমরা, গলায় গলায় ভাব থাকবে। মেয়ের সাথে কথা বলে আমাকে জানাবে। আমি নিজে যাব তোমার মেয়েকে দেখতে বাড়ির মহিলাদের নিয়ে।’
বলেই মোড়ল রোস্তমের কাঁধে হাত রাখল। রোস্তম জোরপূর্বক হাসল। তারপর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

পুরো বিষয়টা খেয়াল করল মাহতিম। সে পাশে থেকেই মোড়ল আর রোস্তমের সব কথা শুনে নিল….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে