চোরাবালি পর্ব-০১

0
2007

#চোরাবালি
#সূচনা_পর্ব
#আহিয়া_আমান_অণু


“ছোটো ভাবী তুমি এতদিন পর?কোথায় থেকে আসলে?”

বাসষ্ট্যান্ডে বাস থেকে নামামাত্র পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম আমি।কন্ঠটা উহাশীর,আমার ছোটো ননদ।আশপাশে নজর বুলালাম।উহাশী আমার থেকে দুহাত দূরে দাড়িয়ে আছে।একহাতে ব্যাগ অন্যহাতে ছেলেকে ধরে আছি।ছেলে আমার কাধে মাথা রেখে কোলেই ঘুমাচ্ছে।আমি উহাশীকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে পা বাড়ালে উহাশী এসে পথ রোধ করে দাড়ায়।আমি প্রশ্নবিদ্ধ চাহনী নিক্ষেপ করলাম।উহাশী আমার উদ্দেশ্য বলে উঠে,

“এভাবে এড়িয়ে চলে যাচ্ছো যে?আমি তো কোনো দোষ করিনি। তাহলে?”

“দেখো উহাশী আমি আমার অতীতের মুখোমুখি হতে একদমই ইচ্ছুক নই।তাই আমার থেকে দূরত্ব রাখলেই খুশি হবো।তাছাড়া আমার স্বামীও চান না আমি অতীতে জড়ানো কোনো মানুষের সাথে কথা বলি।”

“তুমি আবার বিয়ে করেছো?”

উহাশী চমকে প্রশ্নটা করে।আমি উত্তর দিলাম;

“কেনো?আমি বিয়ে করতে পারিনা কি?তোমার ভাইয়ের শোকে পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াবো এটাই চাচ্ছো?আমি এসেছি বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে। পুরো চারটা বছর পর আমার স্বামী আমায় অনুমতি দিয়েছে দেখা করার ;সেজন্য এসেছি আমি গ্রামে।আশা করি উত্তর পেয়ে গেছো!এবার পথ ছাড়ো।আমার কাধ ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে ছেলেকে কোলে রাখতে সাড়ে তিনবছরের বাচ্চা কাধে নিয়ে দাড়িয়ে থাকা নিশ্চয় কষ্টের বাইরে নয়।আর আমি তো ভালো করেই জানি কে দোষ করেছিলো আর কে করেনি।”

উহাশী দেখলাম আমার উত্তরে মুখ চুপসে রাস্তা ছেড়ে সরে দাড়ালো।আমি একটা অটোভ্যান ডেকে উঠে পড়লাম।পিছন ফিরে তাকালাম একবার।উহাশী কেমন নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।আমিই বা কি করতাম।সত্যিটা বলার মতো সাহস আমার নেই।তাই এটুকু মিথ্যে বলতেই হলো যে বিয়ে করেছি।নয়তো আমার ছেলে এই ছেলেটাকে তো এরা কেড়ে নিতে আসতো আমার থেকে।চারবছর আগে তো সবই কেড়ে নিয়েছিলো ;কিন্তু এখন আমার সন্তানকে ঘিরে আমার দুনিয়া, ছেলেটাকে হারাতে চাইনা।আমি তো নতুন করে আবার সংসার সাজাইনি তার ভাইয়ের মতো তবুও আমায় মিথ্যে বলতে হলো।ছেলেটার বয়স তিন বছর তিনমাস চলছে।নাম তাহিফ আহমেদ।ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে যখন এসব ভাবনায় মত্ত আমি তখন অটোভ্যানটা থেমে যাওয়াতে আমি সামনে তাকাই এটা দেখতে যে ভ্যানটা কেনো থামলো।ভ্যানে আরও কয়েকজন যাত্রী উঠলো।যাত্রীদের মাঝে গ্রামের পরিচিত তিনজন চাচা উঠেন।আমাদের বাড়ির পাশেই বাড়ি।আমার বিপদের সময় অনেকটা সাপোর্ট করেছিলেন উনারা।আমাকে দেখে একেকজন চরম পর্যায়ের অবাক।হবারই কথা পুরো চারটা বছর পর আসলাম গ্রামে।আমি সবাইকে সালাম দিলাম।উনারা জবাব নিয়ে একজন চাচা যার নাম নাজমুল উনি বলে উঠলেন,

“আদ্রিজা মা এদ্দিন কুনখানে আছিলা? তোমারে এত খুজলো তোমার বাপ মায়;এদ্দিন পর বাপ মায়ের কতা মনে আইলো তোমার?”

“ছিলাম ঢাকায় চাচা।নিজের একটা পরিচিতি গড়ে নিয়ে আমি ফিরলাম।নয়তো এই গ্রামে সেই কলঙ্কিনী পরিচয়টা আরোপ করা হতো আমার উপর।”

আমার উত্তরে সন্তোষ হলেন উনারা।আমি গল্পগুজব করতে লাগলাম সবার সাথে।অন্যান্য গ্রামের আরও যাত্রী উঠেছিলেন তারা তাদের গ্রাম আসতেই নেমে যায়।আমাদের গ্রাম থেকে মেইন টাউন কাছেই প্রায়।অটো ভ্যানে করেই যাওয়া আসি করা যায়।বিশ মিনিটের মাথায় গ্রামের বাজারে ভ্যান থামলে আমি ভাড়া মিটিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিলাম;একহাতে ব্যাগ ধরলাম।


নাজমুল চাচা এসে হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিলেন জোড় করে।উনি আমার দাদুর ভাইয়ের ছেলে;মানে বড় দাদুর ছেলে।তাদের বংশেরই মেয়ে আমি বিধায় আদর করছেন এত।ছোটো থেকে উনার মেয়ে আর আমি সমবয়সী বিধায় আমাকে মেয়ের মতোয় আদর করতেন। চাচার সাথে পাশাপাশি হাটছি আর কথা বলতে বলতে বাড়ির দিকে যাচ্ছি।বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে হাটায় শাড়ির কুচিতে পা পেচিয়ে যাচ্ছে আমার।তাহিফ জেগেই আছে কিন্তু ঘুমের রেশটা কাটেনি বলে কাধে মাথা রেখে ঝিমুচ্ছে ও।আরও দুজন চাচা যারা ছিলেন উনারা বাজারে চায়ের আড্ডায় বসে গেলেন।চারদিকে ভোটের ব্যানার দেখলাম।হয়তো ইউনিয়ন পরিষদের ভোট হবে এবার।চাচার সাথে এইসব ব্যাপারে টুকটাক কথা বলতে বলতে চাচা বলে উঠলেন

“আম্মা আমান তো এইবার গ্রামের ওয়ার্ড মেম্বার পদে ভোটে দাড়াইছে।আমাগো গেরাম আর তাগো গেরাম দুই গেরাম মিইলা এক ওয়ার্ড।জানিনা কি অইবো আম্মা!ডর লাগে বহুত।”

আমি আমানের নামটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।গ্রামে ফিরতেই আবার সেই নাম।হয়তো দেখা যাবে মামুষটার মুখোমুখিও হতে হবে।আমি চাচার উদ্দেশ্যে বলে উঠলাম,

“চাচা আপনি আর ওর কথা আমায় বলবেন না।কষ্ট হয় বুঝেন তো; অনেক কষ্ট হয়।কিন্তু ও আমাকে বুঝেনি চাচা।”

চাচা আমার কথায় দেখলাম মিইয়ে গেলেন।তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

“সবই বুঝিরে আম্মা।কিন্তু ওর একবার হাছা মিছা যাচাই করোন লাগতো।ঘরের বউরে এমনে ধাক্কা মাইরা বাইর কইরা দেওন তো ঠিক অয় নাই।”

“চাচা দয়া করে আর এসব বইলেন না।আমার কোলে যে বাচ্চাটারে দেখতেছেন,কেউ জিগাসা করলে বলবেন এটা আমার নতুন ঘরের সন্তান।আমি আবার বিয়ে করছি এটাই গ্রামে কপউ জিগাসা করলে জানাবেন।আমি নিজেকে শক্ত করে গড়েছি চাচা।ছেলেটাকে নিয়ে বাচতে চাই।ওরে হারালে আমি বাচবোনা চাচা।”

চাচা আমার কথায় কিছুটা ক্ষান্ত হলেন।ভরষা দিলেন উনি আমার বলা কথা সবাইকে বলবেন বলে আশ্বাস দেন।উনার সাথে কথা বলতে বলতে বাড়িতে পৌছে যাই।চাচা হাক ডেকে বলে উঠলেন,

“কই গো বউমা;বাইরে বাইর হও।দেহো কেডা আইছে.”

বাড়ির উঠোনে পা ফেলতেই দেখলাম মা বারান্দায় বসে চাল ঝাড়ছিলেন কুলোয়।আমায় দেখে ছুটে চলে আসলেন আমার সামনে।আমার দিকে জলে টইটম্বুর চোখে তাকালেন।আমি তাহিফকে কোল থেকে নামিয়ে দিলাম।মাকে দুহাতে জড়িয়ে কেদে ফেললাম।মাও কাদছে। কান্নারত অবস্থায় দেখলাম চাচিরা,দাদী,আমার ভাইটা এসে ভীর জমিয়ে ফেলেছে।বাবা হয়তো আরদে আছে তাই দেখছিনা তাকে।কাদাকাটির এক পর্যায়ে মা আমায় ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলেন নিজের থেকে।আমি আশ্চর্য হওয়ার পাশাপাশি উপস্থিত সবাই আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে দেখলাম।আমার ছোট্ট ছেলেটা আমার আচল আঙুলে পেচিয়ে রেখেছিলো।আমি তা ছাড়িয়ে নিয়ে মায়ের দিকে।আগালাম।মায়ের বাহু ধরে বললাম,

“কি হয়েছে মা?এমন করছো কেনো?”

“কে মা?কার মা?কে তুমি?আমার মেয়ে!আমার মেয়ে মরে গেছে।তোমাকে চিনিনা আমি;চলে যাও বাড়ি থেকে।”

আমি আকাশ থেকে পড়লাম এমন অবস্থা মায়ের কথায়।চুপ করে দাড়িয়ে আছি আমি।চাচীরা মাকে বুঝিয়ে যাচ্ছেন, মেয়ে এতদিন পর এসেছে;এমন যেন না করে।


“ভাইয়া ভাবীকে দেখলাম আজ বাসষ্ট্যান্ডে।”

খাবার টেবিলে বসে উহাশীর এই কথায় চমকে তাকায় আমান।দুপুরের খাবারটা মাত্র খেতে বসেছিলো সে।সারাদিন ভোটের মিছিলে ছোটাছুটি করে ক্লান্ত শরীরে বিকেলে বসেছে দুপুরের খাবার খেতে বসতেই উহাশীর বলা কথায় যেন গলা দিয়ে আর খাবার নামছেনা তার।আমান প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকায় উহাশীর দিকে।বাড়ির সবাই আমন ধান বাড়িতে আসায় কাজ করছে বিধায় এই সময়টা রান্নাঘরের পাশে রাখা খাবার টেবিলটার পাশে কেউ।তাই উহাশী সাহস নিয়ে কথাটা বলেছিলো।কারণ এই মির্জা বাড়িতে আদ্রিজার নাম উচ্চারণ করাটাও নিষেধ জারি করা। এজন্য আমানের নিস্তব্ধতায় ভিতরে ভিতরে ভয়ে শিক্ত হয়ে যাচ্ছে সে।আমান ভাতের গ্রাস মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে বলে উঠে,

“কখন দেখলি?চারটা বছর পর হঠাৎ কেনো আসলো ফিরে?এসব কিছু বলেছে তোকে?আর তুই কেনো গন্জে গিয়েছিলি বলতো?”

উহাশী ভাইয়ের প্রশ্নে ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয়,

“ভাবীর নাকি স্বামী আসতে দিত না গ্রামে;তাই এতদিন ভাবী আসেনি।আর মাউইমা-তাউই কে দেখতে নাকি এসেছে এতদিন পর।আমি গন্জে কেনো যাবো আবার!আমার কলেজ যে সেখানে ভুলে গেছিস!”

উহাশীর উত্তরে থমকে গেলো আমান।আদ্রিজা বিয়ে করেছে আবার!কথাটা বড্ড পীড়া দিতে লাগলো তাকে।কিছুক্ষণ ভাতের থালাতেই আঙুল ঘুরিয়ে ভাতে পানি ঢেলে উঠে দাড়ালো সে।কিছু একটা মনে হতেই নিজেকে শক্ত করে উহাশীকে বললো,

“এই বাড়ির নিয়ম ভুলে যাস না উশু।ভুলেও আর ঐ মেয়ের কথা মুখে আনবিনা।আর সে অন্যের বউ তোর ভাবী না।ফারদার আর ভাবী বলবিনা তারে।”

আমান হনহনিয়ে চলে যায় উহাশীকে কথাটা চলে।উহাশী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সম্পর্ক গুলো ভেঙে কি গুড়ো হওয়ার খুব প্রয়োজন ছিলো!উহাশী নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে