#চুপিসারে ভালবাসি
সাদিয়া আফরিন নিশি
–পর্বঃ৮
__________________
“বাড়ি যাব”
বিছানা থেকে ওঠার চেষ্টা করতে করতে কথাটি বলল সোহা। উপস্থিত সবাই হতভম্ব। শুধু নীল নির্বিকার। সে আগেই জানত এমন কিছুই হবে।
সকলে অনেক চেষ্টা করছে তবুও সোহাকে মানানো অসম্ভব হয়ে উঠছে। ডক্টর বলেছে এই মুহুর্তে সোহাকে কোনো প্রেসার না দিতে। নয়তো খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে। নীল অসহায়ের মতো চেয়ে চেয়ে দেখছে সোহার অবস্থা। সকলের সামনে কিছু বলতেও পারছে না। জিসান অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছে নীলকে। সে আস্তে করে নীলের কাছে গিয়ে দাড়িয়ে নিন্মস্বরে জিজ্ঞেস করল,
“ভাই কী হয়েছে? এনি প্রবলেম? সোহা এমন করছে কেন?”
নীল একটা দীর্ঘ শ্বাস টেনে জিসানের দিকে তাকালো। কপাল ডলতে ডলতে বলল,
“রিয়া…”
জিসান মুহূর্তেই বুঝে নিল সবটা। সে ক্রোধান্বিত হয়ে বলল,
“আমি আগেই ভেবেছিলাম একবার। এখন কী হবে। শুধু শুধু মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে। ওকে রিয়াকে তো আমি……. ”
শেষ কথাটি বলে জিসান ঘর থেকে বেড়িয়ে রিয়ার কাছে যেতে নিচ্ছিল কিন্তু নীল তার হাত ধরে পথ আটকায়। ধীর কন্ঠে বলে,
“আগে এদিক টা ঠিক করি তারপর আমি নিজেই রিয়াকে দেখে নিব।”
জিসানের রাগ কমলো না তবুও নীলের কথাকে প্রাধান্য দিয়ে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করল।
___
সকলের জোরাজুরিতে চৌধুরী বাড়িতেই বাধ্য হয়ে থেকে যেতে হলো সোহাকে। সোহার মাও আজ তার মতের সঙ্গে এক মত নয়। তিনিও চান আজ এখানেই থাকতে। অগত্যা বাধ্য হয়ে এখানে থেকে গেল সোহা।
নিস্তব্ধ পরিবেশ। বাড়ির সকলে গভীর ঘুমে আছন্ন। কেবল ঘুম নেই দু জোড়া চোখে। সোহা তার মায়ের সঙ্গে একঘরে শুয়েছে। মালিহা আহমেদ অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সোহা চোখ মেলে চেয়ে আছে। তিক্ত সৃতি মনে করে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। অনেক সময় যাবৎ কান্নার ফলে সোহার পানির পিপাসা পেয়ে গেছে। টেবিলের ওপরের জার টা একদম ফাঁকা।সোহা একবার তার মাকে ডাকতে গিয়েও ডাকল না। নিজে নিজেই জার নিয়ে বেড়িয়ে গেল ড্রইংরুমের উদ্দেশ্যে।
মাঝপথে কেউ সোহার এক হাত টেনে নিয়ে এক কোণে দেওয়ালের সঙ্গে চেপে ধরল তাকে। আচমকা ভয় পেয়ে ঘাবড়ে গেল সোহা। চোখ খুলতেই তার সামনে দৃশ্যমান হলো চিরচেনা সেই প্রিয় মুখ। ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় নীলকে চিনতে একটুও অসুবিধে হলো না সোহার। সেই সঙ্গে তর তর করে বেড়ে উঠল মস্তিষ্কে চেপে রাখা কষ্ট গুলো। রাগে সোহার মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। সে নীলের থেকে মুক্তি পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে একনাগাড়ে। এরই মাঝে নীলের অসহায় কন্ঠ,
“প্লিজ শান্ত হ গোলাপ রানি। আগে আমার কথাটা তো শোন।”
“কিচ্ছু শুনতে চাই না আমি। ছেড়ে দাও আমায়। নয়তো কিন্তু আমি চিৎকার করে সকলকে ডাকব।”
“তোর যা খুশি তাই কর তবে তার আগে আমায় নিজেকে এক্সপ্লেইম করার সুযোগ দে। একবার সবটা শুনে নিলে তুই বুঝতে পারবি ওই ঘটনায় আমার কোনো দোষ ছিল না।”
সোহা নাছোড়বান্দা। সে কিছুতেই নীলের কোনো কথা শুনতে নারাজ। সে নীলের বাহু থেকে নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে বলল,
“কীসের এক্সপ্লেইম? কীসের কী?প্রবলেম কী তোমার? মাঝরাতে এসব কী নাটক শুরু করেছ?ছেড়ে দাও আমায়।”
অসহায় নীল শক্ত করে বুকের সঙ্গে মিলিয়ে নিল সোহাকে। সোহার রাগ হলো ভীষণ। যে বুকে অন্য নারীর ঠাই মিলেছে সে বুকে সে কখনোই মাথা রাখবে না, কখনোই না। সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও নীলকে নিজের থেকে ছাড়াতে ব্যর্থ হলো সোহা। অবশেষে রাগে,দুঃখে কাঁদতে শুরু করল। সোহার কান্না উপলব্ধি করতে পেরে নীল অস্থির হয়ে পড়ল। সোহার মুখ টা তুলে ধরে বলল,
“কী হয়েছে গোলাপ রানি কাঁদছিস কেন?কাঁদিস না প্লিজ। তুই কাঁদলে যে আমার কলিজায় লাগে।”
“কেন, কীসের এতো দরদ শুনি?তোমার তো ভালবাসার লোকের অভাব নেই তো তাদের নিয়েই থাকো না। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।”
“জানি অভিমান হয়েছে, কষ্ট পেয়েছিস তবুও একটা সুযোগ চাইছি নিজেকে প্রমাণ করার।”
“নাহ, নাহ, নাহ আমি কোনো কথাই শুনতে চাই না। তোমার কথা শোনার মতো বিন্দু মাত্র ইচ্ছে আমার নেই। প্লিজ যেতে দাও আমায়। তোমাকে দেখলে আমার ভীষণ ঘৃণা হচ্ছে। আই হেট ইউ। আই হেট ইউ। আই হেট ইউ।”
সোহা কাঁদতে কাঁদতেই দৌড়ে চলে গেল। নীল সেখানেই স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে। তার কর্ণে শুধু একটি কথারই প্রতিধ্বনি চলছে, “আই হেইট ইউ।” ভালবাসার মানুষের মুখ থেকে ভালবাসি কথাটি শোনার আগে ঘৃণা করি কথাটি শোনা যে কতটা ভয়ংকর তা এখন নীল হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছে। একটু অসাবধানতায় এতকিছু হয়ে গেল। তার গোলাপ রানি তার থেকে দুরে চলে গেল।
___
সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে সকলেই উপস্থিত শুধু নীল বাদে। নিত্যদিন অবশ্য নীল সকলের সঙ্গেই ব্রেকফাস্ট করে তবে আজকে বলে দিয়েছে সে পড়ে খাবে। সোহা নিরব দর্শকের মতো দেখছে সবটা কিছু বলছে না। সকলে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে সোহা এখন পর্যন্ত কিছুই মুখে তোলে নি। কেবল হাত দিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করে যাচ্ছে। এটা দেখে সোহার বড় মামি বলে উঠলেন,
“কী হয়েছে আম্মা খাচ্ছো না কেন?খাবার পছন্দ হয়নি?”
সোহা কিঞ্চিৎ হাসার চেষ্টা করে বলল,
“খেতে ইচ্ছে করছে না মামনি। আমার খাবার টা তুলে রাখো যখন ইচ্ছে হবে আমি খেয়ে নেব।”
সোহার কথার ঘোর বিরোধিতা করে তার মা বললেন,
“একদম নয়। তোমার শরীর ঠিক নেই। আগে খাবার শেষ করো।”
সোহা অনুনয়ের সুরে বলল,
“আম্মু প্লিজ জোর করো না। আমি বলছি তো পরে খেয়ে নেব।”
সোহার মা আর কিছু বললেন না। টেবিল ছেড়ে উঠে গেল সোহা। যেতে যেতে আবার থমকে দাড়াল রিয়ার কথা কর্ণগোচর হতেই। রিয়া বলছে সে গিয়ে নীলকে ডেকে আনবে। সোহার বুক চিড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো। একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আঁকাবাঁকা হেঁটে রুমে চলে গেল।
___
বিকেল পড়তে না পড়তেই সকলে মিলে রওনা হয়েছে ঘুরতে যাবে বলে। এটা অবশ্য রিয়ার প্ল্যান। রিয়া হলো সূর্যের মামাতো বোন। একটু বেহায়া কোয়ালিটির। সেই প্রথম যখন নীলকে দেখেছে তখন থেকে নীলের পেছনে পরে আছে। নীল নানাভাবে তাকে অপমান করেও কোনো ফায়দা হয়নি বরং তার বেহায়াপনা দিনকে দিন আরও বাড়ছে। এই তো গতদিন হুট করেই নীলের ঘরে ঢুকে তাকে জাপটে ধরে দাড়িয়ে ছিল। এই দৃশ্য দেখে সোহা নীলকে ভুল বুঝে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় দুরত্ব।
সকলে যেতে রাজি থাকলেও সোহা আর নীল কিছুতেই ঘুরতে যেতে রাজি নয়। এমতাবস্থায় জিসান একটা প্ল্যান খাটায়। সে নীলকে বলে এটাই সুযোগ সোহার সঙ্গে প্যাঁচআপ করার। নীল এটা শুনে কিছু একটা ভেবে রাজি হয়ে যায়। সোহাকে রাজি করানোর জন্য জিসান গিয়ে তার ফুপ্পিকে বলে সোহার শরীর, মন ভালো নেই। বাহিরের পরিবেশ তারজন্য ভালো হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব শুনে সোহার মা সোহাকে ঠেলে ঠুলে পাঠিয়ে দেয় ওদের সঙ্গে।
সকলে মিলে একটা নির্জন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। রিয়া বারংবার নীলের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছে। সোহা এসব আড়চোখে দেখছে আর রাগে ফুঁসছে। হঠাৎই জিসান তার পাশে এসে দাড়িয়ে বলল,
“পিচ্চি একটা গল্প শুনবি?”
চলবে,