#চুপিসারে ভালবাসি
–পর্বঃ৪
Sadia afrin nishi
__________________
স্কুলে যাওয়ার আগে সোহা বারকয়েক চুপিচুপি নীলের ঘরে উঁকিঝুঁকি মা’র’ছে। এই দৃশ্য ঠিক দেখে নিয়েছে সূর্য। সূর্য এসে পেছন থেকে সোহার এক পাশের বিনুনি টেনে ধরে বলল,
“কী রে সুয়োরানী এভাবে ভাইয়ের ঘরে উঁকিঝুঁকি মা’র’ছিস কেন?”
সোহা চুলে টান অনুভব করে ‘আহহ’ বলে মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। ঘরের ভেতর থেকে সেই আর্তনাদ কর্ণগোচর হলো নীলের। পরক্ষণেই নীলের কর্কশ কন্ঠে ধমকানি কর্ণগোচর হতেই সেখান থেকে ছুট্টে পালালো সূর্য আর সোহা।
___
বাইকের ওপর আধশোয়া হয়ে পড়ে আছে নীল।
শার্টের ওপরের তিনটি বোতাম খোলা হওয়ায় বক্ষের আংশিক অংশ দৃশ্যমান। চোখে ব্ল্যাক সানগ্লাস, হাতে ব্রান্ডেড রিলিক্স ওয়াচ, পরনের শার্টটির কালারও ব্ল্যাক। গোলাপি ওষ্ঠজোড়া দিয়ে চেপে ধরে নিকোটিনের ধোঁয়া ওড়াতে ব্যস্ত সে।সিল্কি চুলগুলো বাতাসে খেলা করছে। মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে খুব শীঘ্রই তার অপেক্ষার অবসান ঘটবে। সূর্য, জিসান,ইশান সকলেই তার সঙ্গে আছে। ওরা গাড়ি করে এসেছে। নীল একাই বাইকে।গাড়ির ওপরে বসে হাত দিয়ে ড্রাম বাজানোর মতো ভঙ্গিতে আছে সূর্য। হঠাৎই সে জিসানকে শাহাদাত আঙুল দ্বারা খোঁচা মে’রে বলল,
“এতদিন কেন লুকিয়ে গেছ এসব আমার থেকে ভাই। সকালের ওই ঘটনা না দেখলে আমি তো জানতেই পারতাম না এতসব।”
জিসান বিরক্ত হয়ে বলল,
“এসব কী বলার মতো কোনো কথা সূর্য। লুকিয়ে তো যাইনি শুধু চেপে গেছি। এখনো তো তেমন কিছু হয়ইনি তাহলে কী বলতাম তোকে।”
“ভাই এসব কথা তোমাকে নিজে থেকে বলেছে?”
“আরেহ না আমি হাবভাবে বুঝে নিয়েছি। ছোট থেকেই সোহার প্রতি ভাইয়ের কেয়ারনেস আমাকে খুব ভাবাত। দিনে দিনে সেটা আরও গভীর আর দায়সারা হয়ে উঠছিল। তারপর একদিন ভাইকে খুব করে চেপে ধরি। পুরোপুরি স্বীকার না করলেও খুব দক্ষতার দ্বারা বুঝিয়ে দিয়েছে।”
“আমিও তো আজ সকালে ভাইয়ের ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি সেই রোমাঞ্চকর দৃশ্য। ভাই সোহার আঙুল…… ”
আর কিছু বলতে দিল না জিসান সূর্যকে। সে ইশারায় ইশানের দিকে দেখতে বলল সূর্যকে। ইশান তখন এদিক ওদিক তাকানোতে ব্যস্ত। জিসান আর সূর্য ইশানের হাবভাব বোঝার চেষ্টা করছে। জিসান নিজের জায়গা থেকে উঠে ইশানের কাছে গেল। অতঃপর ইশানের পিঠে একটা জোরে চড় বসিয়ে দিয়ে বলতে লাগল,
“কী হয়েছে তোর?এদিক ওদিক কী দেখছিস?”
ইশান নিজের হাত পিঠ বরাবর চেপে ধরে আহত কন্ঠে বলল,
“আহ ভাইয়া আস্তে দেবে তো ভীষণ লেগেছে।”
জিসানের সাবলীল উত্তর,
“লাগার জন্যই তো দিয়েছি। তা বল এভাবে কী দেখছিলি?”
ইশান একটু ভাব ধরতে ধরতে বলে,
“দেখছি আশেপাশে কাউকে পাই কিনা। তাহলে ভাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমারও হিল্লে টা হয়ে যেত আরকি।”
জিসান ইশানের কান টেনে ধরে বলে,
“একদম সূর্যর মতো হচ্ছিস তাই না। তোর হিল্লে এবার আমি করব।”
জিসানের কথায় সূর্য দাঁত কেলিয়ে,
“দেখতে হবে না ভাইটা কার।”
অবশেষে ইশান বলল,
“ভাইয়া কী করছ কী তাড়াতাড়ি ছেড়ে দাও।আমার মান সম্মান দিয়ে তো একদিন টিনের কৌটা বানিয়ে ফুটবল খেলবে দেখছি। কানটা ছেড়ে দাও প্লিজ এখনই সোহার স্কুল ছুটি হয়ে যাবে। অতঃপর সুন্দ্রীদের আনাগোনা।”
জিসান আরও কিছু বলতে নিবে তার আগেই নীলের বিরক্তিমাখা কন্ঠ,
“কী শুরু করেছিস তোরা। সমানে ফিসফিস করে চলেছিস। কী বলছিস আমাকেও বল আমিও একটু শুনি।”
জিসান ইশানকে ছেড়ে দিয়ে মেকি হেসে বলে,
“না নাহ না, তেমন কিছুই না৷ ওই আসলে এমনিতেই কথা বলছিলাম আমরা। ”
নীলের উত্তরটি পছন্দ হলো কিনা কে জানে? সে সিগারেটে শেষ টান টি অব্যাহত রেখে বলল,
“সবাই গাড়িতে ঢুকে পড়৷ সোহার ছুটির সময় হয়ে গেছে।”
অগত্যা সকলে গাড়িতে গিয়ে বসে পরল।
___
সোহার চোখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ । এরা এখানে আসা মানে এক ভয়ংকর পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া। এই পরিস্থিতির মূল কেন্দ্র বিন্দু হচ্ছে নীল। তার ওই কি’লা’র লুকে সোহার স্কুলের প্রত্যেকটি মেয়েই দিশেহারা। নীল যে সোহার কাজিন এটা এই কয়েক বছরে সকলেই জেনে গেছে।তার কারণ সোহার স্কুলের সামনে নীলের প্রায়শই আনাগোনা। ইতোমধ্যে মেয়েদের কুদৃষ্টি নীলের ওপর পড়েও গেছে। সকলে নানারকম কমেন্ট করতে শুরু করে দিয়েছে। কমেন্ট গুলো ঠিক এমন, “এই দেখ দেখ ওই যে সেই হ্যান্ডসাম ছেলেটা আজ আবারও এসেছে, ওই যে সোহার কাজিন, ইশ কী ফিগার আমি তো ফিদা হয়ে যাব, বাবাকে বলে লাইনটা খুব শীঘ্রই ক্লিয়ার করে নিতে হবে, শার্টের বোতামগুলো খোলা ইচ্ছে করছে টুক করে একটা চুমু খেয়ে আসি, আরও ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক রকম কমেন্ট’স। সোহা রাগে ফুঁসছে। কেন জানি এই মেয়ে গুলোকে কাঁচা চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে তার। সবথেকে বেশি রাগ উঠছে তার নীলের ওপর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে আশেপাশের পরিবেশটা পর্যবেক্ষণ করছে সোহা। আর মনে মনে ভীষণ রাগ হচ্ছে। এরই মধ্যে তার বেস্ট ফ্রেন্ড সাথী তাকে ধাক্কা মে’রে বলল,
“এই কী এতো ভাবছিস। ওই দেখ তোর ওই হ্যান্ডসাম ভাইটা আজ আবার এসেছে। এতবার বলেছি আমার সঙ্গে তার লাইনটা একটু ক্লিয়ার করে দে কিন্তু তুই তো আমার কোনো কথাই শুনিস না। দেখ দেখ আমাকে দেখতে কতটা কিউট তোর ভাইয়ের পাশে একদম ঝাক্কাস লাগবে। বাই দি ওয়ে, তোর ভাই এখানে কেন আসে বলত?এ্যাট এনি চান্স, তোর সঙ্গে আমাকে দেখে প্রেমে পড়ে যায়নি তো? এজন্যই বোধহয় আমাকে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে ছুটে আসে। হায় আল্লাহ, মে তো মা’র’গা’য়া।”
শেষ উক্তিটি সাথী বেশ লজ্জার সহিত বলল। যেটা দেখে সোহার মনের এতক্ষণের চাপা রাগটা দাবানলের ন্যায় দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। সোহা সাথীর মুখের ওপর বলতে চাইল অনেক কিছু কিন্তু শেষ পর্যায়ে কিছুই বলতে পারল না। রাগে,দুঃখে, অভিমানে ধপ ধপ করে কয়েক কদম এগিয়ে চলে গেল সোহা। পেছন থেকে সাথী বারকয়েক ডাকল কিন্তু সোহা পুরোটাই ইগনোর করল। এদিকে সোহাকে হনহনিয়ে চলে যেতে দেখে আশ্চর্য হলো নীল,জিসান,ইশান, সূর্য। সকলেই অবাক। এই কয়েক বছরে এমন কখনো হয়নি। তাদের দেখলে বরাবরই সোহা ছুট্টে চলে আসত কিন্তু আজ তার কী হলো? নীল কিছু একটা ভেবে সূর্যকে পাঠালো সোহাকে দাড় করানোর জন্য। সূর্য অনেক চেষ্টার পরেও সোহার জেদের কাছে পরাস্ত হলো। সোহার এক কথা, ‘সে কিছুতেই তাদের সঙ্গে যাবে না তারা যেভাবে এসেছে ঠিক সেভাবেই যেন চলে যায়।’ সোহার মুখের বানীটি খুব সুন্দর করে সূর্য নীলকে শুনিয়ে দিল। নীলের মাথায় ধপ করে ক্রোধ এসে হানা দিল। সে জিসানকে বলল সূর্য আর ইশানকে নিয়ে বাড়িতে চলে যেতে সে পরে আসছে। জিসান আটকাতে চেয়েও পারল না নীলকে ধরে রাখতে। তবে এটা সে বেশ বুঝতে পারছে আজ সোহার কপালে দুঃখ আছে।
___
সোহা প্রায় রিকশায় উঠে পরবে ঠিক তখনই নীল তার হাত খুব শক্ত করে চেপে ধরল। হতভম্ব সোহা কিছুটা ভয় পেয়ে গেল আচমকা।ফের কিয়ৎক্ষণ আগের স্মৃতি গুলো মনে পরতেই অভিমান মাথা চাড়া দিয়ে উঠল তার। নীল অন্যায় করেছে, বহুত বড় অন্যায়। নীলের জায়গায় তার অন্য কোনো ভাই হলে এতক্ষণে দু,চারটে বসিয়ে দিত তাদের গায়ে। কিন্তু নীলকে ঘিরে এমন কিছু কল্পনা করাও সোহার জন্য দুঃসাধ্য।
নীলের শক্তির সঙ্গে পেরে উঠছে না সোহা। তবুও আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নীল থেকে মুক্তি পাবার। নীল রিকশাওয়ালাকে ইশারায় চলে যেতে বলল। সোহা তখনও সমানে জোড়াজুড়ি করে চলেছে। এতক্ষণে নীল মুখ খুলল। সোহার হাত নিজের হাতের বন্ধনে আরও শক্ত করে বেঁধে নিয়ে বলল,
“আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিস না সোহা। দ্রুত চল বলছি।”
সোহা পারে তো প্রায় কেঁদেই দেয়। অভিমানের পাল্লা যেন আরও ভারী হচ্ছে খনে খনে। এক পর্যায়ে তার বিদ্রোহী উত্তর,
“আমি কিছুতেই তোমার সঙ্গে যাব না। তুমি ছেড়ে দাও আমায়। চলে যাও আমার কাছ থেকে।”
নীলের রাগের প্রকোপ দিগুণ হচ্ছে। সে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
“এটা পাবলিক প্লেস। সিনক্রিয়েট করিস না।”
সোহা এবার নীলের চোখে চোখ রেখে বলল,
“তোমার আদৌ সে জ্ঞান আছে?”
নীল বুঝল এখানে অযথাই কথা বাড়াচ্ছে সে। সোহা কখনোই সেচ্ছায় যাবে না। অতঃপর সে বিনাবাক্যে সোহাকে কোলে তুলে নিল। আশেপাশের সবার দৃষ্টি ওদের দিকে। সোহার স্কুলের প্রত্যেকটি মেয়ে চোখ রসগোল্লার মতো করে চেয়ে আছে। মনে হচ্ছে কোনো জন্তু দেখছে। সাথী তো অলরেডি হা করে চেয়ে আছে। মনে হয় তার মুখে এই মুহুর্তে শ’খানেক মশা অনায়াসে ঢুকে যেতে পারবে। এদিকে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে সোহার। সে কোনো দিক তাকানোর সাহস করছে না চুপচাপ নীলের কাঁধে মুখ লুকিয়ে আছে। নীল যে এমন কিছু করে বসবে এটা সোহার ধারণার বাহিরে ছিল। এখন এই পরিস্থিতি এখন তো সে পাড় করে নিল কিন্তু কাল, কাল কী হবে তার? স্কুলে আসলেই তো নিশ্চিত নানা রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তাকে। বাইকের ওপর এক প্রকার ছুড়ে মে’রে’ই নীল সোহাকে বসিয়ে দিল। সোহা কাচুমাচু মুখ করে বসে আছে। অগত্যা বাইকে চেপে সাই সাই করে বাইক স্টার্ট দিল নীল।
চলবে,