#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৯
#ফিজা_সিদ্দিকী
২১.
আরাধ্য আজ দেশে ফিরেছে। এই খবর যেনো হাসনাহেনা ফুলের তীব্র সুগন্ধের ন্যায় অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো ফ্ল্যাট জুড়ে। পুরো ফ্ল্যাটে একটা হৈ হৈ রব। তবে এতো আয়োজনের মাঝেও নিশ্চুপ শ্রেষ্ঠা। খুশি প্রকাশ করবে নাকি দুঃখ! আর খুশি হলেও তার কোনোরূপ কারণ খুঁজে পাচ্ছে না শ্রেষ্ঠা। কিংবা হয়তো খোঁজার চেষ্টা করছে না। সে তো আর বাড়ির মালিক নয়! তবুও তার আগমনী বার্তায় যেনো উৎসব নেমেছে পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে। শ্রেষ্ঠা বাদে ফ্ল্যাটের সকলে নেমেছে নানা আয়োজনে। সকলের পুরোদস্তুর প্রচেষ্টায় সন্ধ্যার আগে আগেই সেজে উঠলো বাড়ি। লাইটিং থেকে শুরু করে ফুল, কিছুই বাদ রাখেনি যেনো। তাদের ফ্ল্যাটের নীচতলায় একটা বিশাল হলরুম আছে। বাড়ী বানানোর সময় মালিকপক্ষ এই জায়গাটা বিয়ে কিংবা পার্টির স্পট হিসেবে ভাড়া দেওয়ার জন্য আলাদা ভাবে তৈরি করেছিলেন। আজ সেখানেই চলছে নানান আয়োজন।
সূর্য ডুবি ডুবি অবস্থা। দূর থেকে ধীরে ধীরে উঁকি দিচ্ছে চাঁদের আলোর ছটা। দিনের আলো নিভে নেমেছে সাঁঝবেলা। শ্রেষ্ঠা সবেমাত্র মেয়েকে টিফিন করিয়ে কিচেনে টুকিটাকি যাবতীয় কাজ সারছে। ইতিমধ্যে বেজে ওঠে কলিংবেল। একবার, দুইবার থেকে বারবার এভাবে বেজেই চলেছে। শ্রেষ্ঠার অবস্থা বেগতিক। হাত পা কাঁপছে ঠক ঠক করে। যেনো এখানে দাঁড়িয়েই সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে দরজার ওপাশের মানুষটাকে। পড়ে ফেলতে পারছে তার মনের অভিব্যাক্তি। এইতো কয়েকমাস আগেই দেখা হলো তার সাথে। কাটানো হলো কতখানি সুন্দর সময়। কুড়িয়ে নেওয়া হলো সুমধুর কিছু স্মৃতি। তবুও আজ কেনো তার এতো নার্ভাস লাগছে? কেনো মনে হচ্ছে লোকটার সামনে এসে নিজেকে ধরে রাখতে পারবে না। তবে কী এই মানুষটা তার দুর্বলতা? যার সাথে কঠিন থাকা যায়না। যাকে চেষ্টা করেও কোনো কঠিন কথা শোনানো যায়না। প্রতিটা শক্তপোক্ত মানুষেরই কোনো না কোনো দুর্বলতা থাকে। যেখানে চলে না তার রাজত্ব। বরং সে হয় সেই রাজ্যের প্রজা। রাজত্ব চলে অন্য কারোর। তবে কী তার এই দুর্বলতার রাজ্যের রাজা আরাধ্য!
ড্রয়িংরুমের সোফায় মুখোমুখি বসা দুই প্রাণী। অথচ কারোর মুখে কথা নেই। শ্রেষ্ঠা আড়চোখে বার কয়েক তাকিয়েছে সেদিকে। কিন্তু ভস্ম করার মতো একজোড়া মোহনীয় দৃষ্টিতে দৃষ্টি স্থির রাখতে পারেনি। তৎক্ষণাৎ সরিয়েছে চোখ। স্কুলের ভাইভা থেকে শুরু করে কলেজের এক্সটার্নালের মুখোমুখি, সব জায়গায় বসেছে সে। তবে আজকের মতো অনুভূতি কখনোই হয়নি। কখনও মনে হয়নি যে এই পরীক্ষায় সে ফেল করবে। কিন্তু আজ! আরাধ্যকে কেনো যেনো রুঢ় এক ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন পরীক্ষক লাগছে তার কাছে। যে খুঁটিতে খুঁটিতে পর্যবেক্ষণ করছে তাকে। খুঁজছে কোনো এক কারণ তাকে এই পরীক্ষায় ফেল করানোর জন্য। যেনো পুরোদস্তুর উঠে পড়ে লেগেছে তাকে এই যাত্রায় হারিয়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতায়। কিন্তু শ্রেষ্ঠাকে পুরোপুরি অবাক করে দিয়ে আরাধ্য বলে ওঠে,
“তাকাও আমার দিকে।”
থমথমে তার কণ্ঠস্বর। আচমকা কেঁপে উঠলো শ্রেষ্ঠা। খামচে ধরলো জামার একাংশ। দৃষ্টি আরো গাঢ়ভাবে নিবদ্ধ করলো মেঝের দিকে।
“এদিকে তাকাতে বলেছি আমি।”
“না মানে শ্রেয়া একা রুমে..”
“শ্রেয়া ঠিক আছে। নিজের গিফট আর চকলেট নিয়ে ব্যাস্ত। ওকে ডিস্টার্ব না করে সোজাসুজি তাকাও আমার দিকে। কিসের ভয় এতো?”
“ভ ভভয় কই? ভয় কেনো পাবো? আমি কী অন্যায় কিছু করেছি নাকি?”
“করোনি?”
“নাহ”
শ্রেষ্ঠার নির্লিপ্ত জবাব।
“শ্রেয়া কে?”
“শ্রেয়া আমার মেয়ে। ও শুধুই আমার মেয়ে। যেটুকু বলার ছিলো তোমাকে চিঠিতে জানিয়েছি। এর বাইরে আর কিছু জানার নেই। আর কোনো সত্যি নেই।”
শ্রেষ্ঠার কণ্ঠে দৃঢ়তা। এবার খানিকটা নরম হলো আরাধ্য। কোমল কণ্ঠে বললো,
“পারবে তো বেড়ে ওঠা শ্রেষ্ঠার সকল জবাব দিতে? পারবে তো আজীবন তাকে মিথ্যা বোঝাতে? পারবে তো সত্যিটা তার থেকে আড়াল রাখতে? আর যেদিন সত্যিটা তার চোখের সামনে আসবে, সেদিন পারবে তো তাকে সামলাতে? পারবে তো নিতে সেই দায়ভার, যেখানে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তার থেকে আড়াল করার জন্য দোষারোপ করবে সে! পারবে তো তার ঘৃনা ভরা দৃষ্টি সহ্য করতে?”
চকিতে চোখ তুলে তাকায় শ্রেষ্ঠা। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে ওঠে, ” শ্রেয়া আমার মেয়ে। এর বাইরে আর তো কোনো পরিচয় নেই ওর।”
“বিয়ে না করেই তার মানি কিভাবে তার মা হয়ে গেলো? এই প্রশ্ন করাটা কী খুব অস্বাভাবিক? সমাজ তো আর তোমার মতো চুপ করে থাকবে না। নানা ভাবে উত্যক্ত করবে তার মন মস্তিষ্ককে।”
“আরাধ্য, আমি এসব নিয়ে কথা বলতে চাইনা। ফিরে আসার আগে নিজের অনুভূতির কথাটা আপনাকে জানিয়েছিলাম। সেই সাথে মনে হয়েছিল আমার জীবনে ঘটে যাওয়া নোংরা এক লোকের ছোঁয়া, সেই বিষয়টাও আপনার জানা উচিৎ। এছাড়া আপনার জানার আয়ত্তের মধ্যে থাকা সম্ভাব্য সব কথাই আমার মনে হয় আপনি জানেন। এরপরের সিদ্ধান্ত আপনার। আমি অপেক্ষা করেছি। তবে আজ এই আচরণ প্রত্যক্ষভাবে বয়ান দিচ্ছে আপনার উত্তরের। আর কিছু বলার না থাকলে আসুন।”
“তাড়িয়ে দিচ্ছ?”
“নাহ। যে নিজে থেকে চলে যেতে চায়, তাকে তাড়িয়ে দেওয়া নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। আমি শুধু আপনাকে রাস্তাটা দেখিয়ে দিলাম।”
“বাড়ীতে এক্সট্রা ম্যাট্রিক্স আছে তো? নাকি থেকে যেতে গেলে ম্যাট্রিক্স আমাকেই কিনে আনতে হবে?”
“মানে?”
“বাই এনি চান্স তুমি আমাকে তোমার রুমে, তোমার বেডে, পাশাপাশি, কাছাকাছি ঘুমানোর জন্য বলছো না তো?”
ভ্রু কুঁচকে আরাধ্যর মতিগতি বোঝার চেষ্টায় রত শ্রেষ্ঠাকে দেখে আচমকা শব্দ করে হেসে দেয় আরাধ্য। আরাধ্যর ঠাট্টা বুঝতে পেরে বেশ খানিকটা লজ্জা পায় শ্রেষ্ঠা।
“অচেনা দেশে একই ফ্ল্যাটে থেকেও যে ছেলেটা সুযোগ নেয়নি, তোমার কি মনে হয় সে এই পরিচিত জায়গায় সুযোগ নিতে চাইবে?”
নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই লজ্জা পেলো শ্রেষ্ঠা।আসলেই তো, তার যদি সুযোগ নেওয়ার হতো তবে তেমন অনেক সুযোগ সে পেয়েছে। তবুও কখনও বাজে ভাবে স্পর্শ তো দূর ইচ্ছাকৃত ছুঁয়ে দেয়নি তাকে। বরং বেশ কয়েকবার সে নিজেই উত্যক্ত করেছে আরাধ্যকে। কী ভীষণ পরিমাণ কন্ট্রোল নিজের উপর থাকলে একটা মানুষ সেই মুহূর্তেও নিজেকে সামলে নেয়। প্রশ্ন এড়াতে লাজুক কণ্ঠে শ্রেষ্ঠা বলে,
“হুট করে এতো আয়োজনের কারণ?”
“সেটা তো সময় হলেই জানতে পারবে। এখন রুমে গিয়ে রেডি হয়ে নাও। আমি নীচে অপেক্ষা করছি।”
২২.
প্রবানহমান সময়ের ধারায় কিছু থেমে থাকে না। সময়ের সাথে পাল্টায় পরিস্থিতি। কখনও কখনও পরিস্থিতি হয়ে ওঠে জটিল তো কখনও সরল। আরাধ্য আর শ্রেষ্ঠার জীবনের সবচেয়ে জটিল মুহুর্তটা বোধহয় শুরু হয়ে গেছে। সেদিন রাতে সকলের সামনে হাতে হাত রেখে স্বীকৃতি পাওয়া মেয়েটা আজ ছন্নছাড়া। অনেকখানি লক্ষ্যভ্রষ্ট। জীবনের কূল কিনারা খুঁজতে গিয়ে উথাল পাথাল অবস্থা।
আয়োজনটা মূলত একটা গেট টুগেদার হিসেবে থাকলেও, সেদিন সকলের সামনে শ্রেষ্ঠাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় আরাধ্য। সেই সাথে এটাও বুঝিয়ে দেয়, তার অতীত নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই আরাধ্যর। তার সবটুকু চিন্তা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। শ্রেষ্ঠার বাবা মা তাদের এই সিদ্ধান্তে খুশি হলেও অসন্তোষ রিয়ে গেলো আরাধ্যর মায়ের। যদিও এর আগে ছেলের সাথে এই বিষয়ে বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছে তার। কিন্তু ছেলে নাছোড়বান্দা। এই মেয়েকে ছাড়া সে বিয়ে করবে না। এমনকি দেশেও ফিরবে না আর। অগত্যা বাধ্য হয়ে এই সম্পর্কটা মেনে নিতে হয়েছে তাকে। নয়তো অন্যের সন্তানের বোঝা নিজের ছেলের ঘাড়ে কিছুতেই চাপাতে দিতেন না তিনি।
যেখানে শুরু থাকে সেখানে অন্তও থাকে। তাইতো সখের পুরুষকে পেয়ে অতীতকে ভুলতে বসা শ্রেষ্ঠার সামনে হুট করে খুলে যায় অতীতের আরও একটা পাতা।
সেদিন শ্রেষ্ঠাকে নিয়ে প্রথমবারের মতো নিজের বাড়িতে গিয়েছিলো আরাধ্য। প্রাথমিকভাবে নাকচ করলেও আরাধ্যর জোরাজোরিতে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তার সঙ্গ দেয় শ্রেষ্ঠা। বাড়ীর ড্রয়িংরুমের এক সাইডে টাঙানো বড়োসড়ো একটা ফটোফ্রেম। সাধারণের চেয়ে বেশ বড়ো হওয়ায় কৌতূহলবশত সেটা দেখার আগ্রহ নিজের মাঝে চেপে রাখতে না পেরে সেদিকে এগিয়ে যায় শ্রেষ্ঠা। ফ্রেমের সামনে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকাতেই নিঃশ্বাস আঁটকে আসে তার। শরীর কাঁপতে থাকে মৃগী রুগীদের মতো। নিঃশ্বাসের গতি আচমকা মাত্রা ছাড়িয়েছে। এক পা দুই পা করে পিছাতে পিছাতে টেবিলের কোনা লেগে পড়ে যায় সে। শব্দ পেয়ে রুম থেকে ছুটে আসে আরাধ্য। শ্রেষ্ঠার অস্বাভাবিক আচরন আর গোঙানো দেখে ভয়ে প্রাণ তার ওষ্ঠাগত। আচমকা শ্রেষ্ঠার এহেন আচরনের কিছুই বুঝতে না পেরে তার মাথা টেনে নেয় বুকে। দুইহাতে জড়িয়ে নানাভাবে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে তাকে। সেই প্রচেষ্টা সফলও হয়। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে শ্রেষ্ঠা। কিন্তু তার দৃষ্টি নিবদ্ধ সেই বড়ো করে বাঁধানো ফ্রেমের দিকে।
২৩.
“প্রতিশোধ” এটা কোনো ডায়রির নাম হতে পারে? শ্রেষ্ঠার বুকশেলফের একদম শেষের দিকে খানিকটা আড়ালে থাকা এই ডায়রির নাম দেখে অনেকখানি অবাক হয় আরাধ্য। প্রতিশোধ! কিসের প্রতিশোধ? আর এই নামে কোনো ডায়রি হয় নাকি? কার প্রতি শ্রেষ্ঠার এতোখানি রাগ? এতোখানি উন্মত্ততা? আরাধ্য ডায়রিটা হাতে নিয়ে জমে থাকা ধুলোগুলো পরিষ্কার করে। অতঃপর প্রথম পাতা ওল্টাতেই যা দেখে তাতে তার চোখ আঁখিকোটর হতে বের হয়ে আসার উপক্রম।
#চলবে!