#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#অন্তিম_পর্ব(প্রথমাংশ)
#ফিজা_সিদ্দিকী
“শিল্পীর হাতে আঁকা নিখুঁত কোন ছবি বা পোর্ট্রেট দেখেছ?”
ঘাড় ঘুরিয়ে আরাধ্য তাকালো শ্রেষ্ঠার দিকে। ভাবখানা এমন যেন হুট করে সুস্বাদু বিরিয়ানি মুখে দিয়ে তাতে এলাচ খুঁজে পেয়েছে। চরম বিরক্তি নিয়ে আবারও সামনে তাকাতেই শুনতে পায় শ্রেষ্ঠার কণ্ঠস্বর।
“ছবির বিপরীত পাশ হয় ঘোলাটে। এই পিঠ দেখতে পছন্দ করে না কেউ। সে যত বড়ই শিল্পীর আঁকা ছবি হোক না কেন।”
পিনপতন নীরবতার মাঝে গতিবেগে চলতে থাকা গাড়ি আর বাতাসের সংঘর্ষে সৃষ্টি হয়েছে শা শা শব্দ। শ্রেষ্ঠা পিঠ এলিয়ে বসে আছে সামনের সিটে। আরাধ্যর দৃষ্টি ঘোলা। অনেক কিছুই বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। অসহ্য ব্যথায় আঁকড়ে ধরছে বুকের বাম পাশটা। এই বুঝি মারা যাবে সে!
“আরাধ্য”
নীরবতার মাঝে শ্রেষ্ঠার থমথমে কণ্ঠ শুনে আতঙ্কে গা শিউরে উঠলো আরাধ্যর। যেন কোনো এক অশরীরী আত্মা ডাক দিল তাকে। আরাধ্য ফিরে তাকালো না একবারও। ভয় নয় বরং বিরক্তি আর একরাশ ক্ষোভ উন্মাতাল ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে তার মনের আঙিনায়। ঠিক সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে শ্রেষ্ঠা উপলব্ধি করলো তার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ রকমের কষ্ট। আরাধ্যর ফিরিয়ে নেওয়া মুখ, আক্রোশে ফেটে পড়া দৃষ্টি, গনগনে এক ব্যথার সূচনা করেছে তার সমস্ত শরীর জুড়ে। বলার জন্য অনেক কিছু গুছিয়ে রাখলেও শব্দগুলো একে একে ধসে পড়লো বালুর স্তূপের ন্যায়। জীবনের এই পর্যায়ে এসে সে উপলব্ধি করল তার বানানো ঘরের কোনো ভিত ছিল না। তাসের ঘরের মতো আলগোছে ঘর বেঁধেছিল সে তাইতো আজ সামান্য আঘাতেই ভেঙে খন্ড খন্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ল।
“আজও শ্রেয়ার পরিচয় লুকিয়ে রাখবে? আমাদের মধ্যে লুকানোর মতো আর কিছু কি আদৌ আছে?”
২৭.
বেশ কয়েকমাস থেকেই বেশ ঘন ঘন বাড়ি আসছে স্নিগ্ধা। অন্তত প্রতি মাসে একবার হলেও কয়েকটা দিন বাড়িতে থাকছে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে মাসের এই দিনগুলোতেই সবচেয়ে বেশি চুপচাপ থাকে শ্রেষ্ঠা। প্রথম প্রথম বিষয়গুলো শিমুল নিহারের কাছে স্বাভাবিক লাগলেও, সময়ের সাথে সাথে আভাস পাচ্ছিলেন জটিলতার। শ্রেষ্ঠা আর আগের মতো চঞ্চল নেই। তার সবকিছুতেই কেমন কেনো অনীহা। সহজ সরল প্রাণখোলা মেয়েটা ক্রমে গুটিয়ে নিচ্ছিলো নিজেকে। নিজের চারদিকে শক্ত কোকুনের ন্যায় অভেদ্য এক আবরণের মাঝে ঘিরে ফেলছিলো নিজেকে।
সেদিন চৈত্রের দুপুর। খা খা রোদ্দুরের তাপে প্রাণ ওষ্ঠাগত। অনেকদিন পর স্কুলে গেছে শ্রেষ্ঠা। আজকাল স্কুল, টিউশনে তার আনাগোনা নগণ্য। বকাবকি করেও বিশেষ লাভ হয়না। মুখে কুলুপ এঁটে চুপ করে সব শোনে। এরপর রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। একটা রা কাটে না মুখে। আদিল সাহেব ছোটো মেয়েটার চিন্তায় নিজেকে জর্জরিত করে ফেলছেন দিন দিন। বয়ঃসন্ধিকালে হটাৎ বদলে যাওয়া মেয়েটার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা হয় শিমুলেরও। মাঝে মাঝেই স্বামীর আড়ালে আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদেন তিনি। আজ প্রায় পনেরো দিন পরে নিজে থেকে স্কুলে যাচ্ছে শ্রেষ্ঠা। প্রথম প্রথম এই গরমে বাইরে বের হতে বারণ করতে গিয়েও থেমে গেলেন শিমুল। কী যেনো মনে করে শ্রেষ্ঠার মতামতের গুরুত্ব দিলেন।
বিকাল পার হতেই দৌড়াতে দৌড়াতে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ী ফিরলো শ্রেষ্ঠা। গায়ের জামা ঘামে চুপচুপে। বাড়িতে ঢুকতেই মুখোমুখী হলেন শিমুলের। চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিলো শ্রেষ্ঠা। অতঃপর রুমে ঢুকেই খিল টানলো দরজায়। শ্রেষ্ঠার চোখের কোল ঘেঁষে গড়িয়ে পড়া জল আর মুখের ঘামের মধ্যে পার্থক্য করতে পেরেছিলেন শিমুল। হুট করেই বুকটা ছ্যাত করে উঠলো তার। পুরো দুই ঘণ্টা ধরে শাওয়ার নিয়ে বের হতেই শিমুলকে বেডে বসে থাকতে দেখে টালবাহানা শুরু করলো শ্রেষ্ঠা। কিন্তু শিমুল নাছোড়বান্দার মতো ঘাপটি মেরে বসে আছে।
“তুমি কি কিছু বলবে মা?”
“তোর কাহিনী কী বল?”
“কাহিনী? কিসের কাহিনী? কিসব বলছো তুমি?”
“শ্রেষ্ঠা, তুই বোধহয় ভুলে যাচ্ছিস তোকে পেটে ধরেছি আমি। ঠিক কোন সময়, কোন কারণে তোর মাঝে কেমন পরিবর্তন ঘটতে পারে সেসবই আমার জানা। তাই অহেতুক কথা না বাড়িয়ে সত্যিটা বল। কেউ তোকে কিছু বলেছে? ”
“এই সামান্য একটা বিষয় নিয়ে অনেক বেশি ভেবে ফেলছ মা। পাড়ার রাস্তায় ঢোকার মুখে একটা কুকুর ছিলো। তাকে দেখে আমি দৌড় দিয়েছি। দৌড়াতে দেখে আরো তাড়া করেছে আমাকে। এজন্য এভাবে দৌড়ে এলাম।”
কথাটুকু কেনো যেনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারলেন না তিনি। কিন্তু অবিশ্বাসের মতো কোনরূপ কারণ না পেয়ে এবার যেনো সস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন শিমুল। তবুও বেশ খানিকটা সময় গজগজ করে নিজের মতো বেরিয়ে গেলেন। মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ফিকে হাসলো শ্রেষ্ঠা। অতঃপর রুমের দরজা লক করে বসে পড়লো টেবিলে। খাতা থেকে একটা কাগজ বের করে লিখতে শুরু করলো,
“প্রিয় আপা,
অনেককিছু বলার আছে তোমাকে। অথচ সামনাসামনি কোনো কথাই বলতে পারি না। কেমন যেনো জড়তা কাজ করে আমার মধ্যে। তোমার সামনে যেতে ইচ্ছে করে না। তুমি হয়তো ভাবো আমি তোমাকে দেখতে চাইনা বা ঘৃনা করি বলেই সামনে আসিনা। কিন্তু বিষয়টা এমন নাহ। তোমার অজানায় ঘটে গেছে অনেক কিছু। যার সবকিছুই একটা দুঃস্বপ্নের মতো। আমার ছোটো জীবনটা এমন কেনো হয়ে গেলো আপা? আমি তো জগতের এই কালো দিক সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। রঙিন জীবনটা নর্দমার পচা কাদায় মাখামাখি হয়ে কী বিশ্রী দুর্গন্ধ! আমার দমবন্ধ হয়ে আসে আপা। তুমি ছাড়া আর কারো কাছে আমি সমস্যাগুলো তুলে ধরতে পারি না। তাই আজও সবকিছু উজাড় করে তোমাকেই বলার সিদ্ধান্ত নিলাম।
সার্থক ভাইয়া আমাদের এখানে আসেন আপা। মাঝে মাঝেই ওনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম আমাদের স্কুলের সামনে। সেদিন তোমার ওখান থেকে পালিয়ে আসার মধ্যে একটা কারণ ছিলেন ওই মানুষটা। তার স্পর্শ ছিলো গা ঘিনঘিন করার মতো। তার চোখ ছিলো শরীরের বিভিন্ন বাঁকে। তার কথা ছিলো অশ্লীল। নিজের অজান্তে উঠিয়ে নেওয়া একটা অ্যাডাল্ট স্টোরি বুকের জন্য সে আমাকে কিসব দিয়েছে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। তার কারণে আমি স্কুলে যাইনা ঠিক মতো। টিউশনিতেও যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।
প্রথম বেশ কিছুদিন শুধু দাঁড়িয়ে থাকতেন তিনি। সেই কারণে আমিও সেভাবে পাত্তা দিইনি। কোনক্রমে গা ঢাকা দিয়ে চলে আসতাম। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই একদিন ফাঁকা রাস্তা দেখে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। বিশ্বাস করো আপা, সে যখন আমার হাত ধরেছিল, মনে হচ্ছিল আমার হাত ঝলসে যাচ্ছে। এরপর একটা প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিয়েই উল্টো পথে হাঁটা ধরলেন তিনি। আমি ভাবলাম হয়তো তুমি আমার রাগ ভাঙ্গানোর জন্য কিছু পাঠিয়েছ। বাড়ি এসে প্যাকেটটা খুলতেই যা যা দেখলাম, তাতে আমার শরীর গুলিয়ে উঠলো। সাথে সাথেই মুখ ভর্তি করে বমি করে ফেলেছিলাম। সেখানে ছিলো একটা ম্যাগাজিন। যার মধ্যে ছেলেদের নগ্ন, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির ছবি। আর দুটো গল্পের বই। যে গল্পগুলো ছিলো ছবিগুলোর চেয়েও অশ্লীল। এরপর থেকে বেশ কয়েকদিন আমি আর বের হইনি বাড়ি থেকে। গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিলো। সুস্থ হয়ে আবারও স্কুলে যাওয়ার পথে, পাড়ার গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকতো সে। অনেকবার তাকে বারন করেছি এমন না করতে। তোমাকে বলে দেওয়ার হুমকি দেখালেও কোনো কাজ হয়নি। কিন্তু আজ! আজ তো সে সব সীমা অতিক্রম করে ফেলছিল আপা। সরাসরি আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। তোমার সাথে তার সম্পর্ক আছে, এ কথা বলার পর তার রূপ বদলে যায় একেবারেই। তোমাকে রক্ষিতা বলতেই তার দুইবার ভাবতে হয়না। আমি একদলা থুতু তার মুখে ছুঁড়ে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে এসেছি আপা।
আপা, ছোটো থেকেই তোমরা সবাই বলতে আমি নাকি অনেক সুন্দর। এই সৌন্দর্য্য এভাবে কাল হয়ে ধরা দেবে কেনো বলোনি? কেনো বোঝাওনি রঙিন দুনিয়ার উল্টোপিঠ এতখানি কর্দমাক্ত? নিকৃষ্ট অমানুষে ভরা।”
২৮.
বিগত দুই মাসে বাড়ি যাওয়া হয়ে উঠেনি স্নিগ্ধার। আজকাল একটু বেশিই অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। তাই বাড়ী থেকে চিঠি এসেছে শুনে সেটা আনার জন্য আঁকুপাঁকু করতে শুরু করলো। শ্রেষ্ঠা ফোনে বারবার করে বলেছে চিঠিটা যেনো সে একাই পড়ে। কিন্তু নিয়ে আসার কথা কিছু বলেনি। তাছাড়া এই গরমের মধ্যে বাইরে বের হওয়ার কোনো ইচ্ছে না থাকায় সার্থককেই আনতে বললো চিঠিটা।
#চলবে?
#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#অন্তিম_পর্ব(দ্বিতীয়াংশ)
#ফিজা_সিদ্দিকী
২৯.
গত দুইমাসে শতাধিক কল, টেক্সট, চিঠি পাঠিয়েছে শ্রেষ্ঠা। অথচ তার একটাও জবাব আসেনি ওদিক থেকে। ফোন সুইচড অফ। মাঝে মাঝে একটা করে বেনামী চিঠি আসে তাদের ঠিকানায়। যার মূল বিষয়বস্তু দেখে বোঝা যায় চিঠিটা স্নিগ্ধার লেখা। কিন্তু কোথাও কোনো ঠিকানা কিংবা নাম লেখা থাকে না। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো চিঠিগুলো যেনো সে নিজের ইচ্ছেতে লেখে না। সেখানে শুধু লেখা থাকে বাবা, মা, আর স্নিগ্ধার কথা। শ্রেষ্ঠার কথা এই দুইমাসে আসা কোনো চিঠিতেই উল্লেখ্য নয়। এমনকি এরই মাঝে নিজের ঠিকানাও পরিবর্তন করে ফেলেছে সে। সবকিছু ধরা, ছোঁয়া, নাগালের বাইরে। আদিল সাহেব দিন দিন কেমন যেনো ঝিমিয়ে পড়ছেন এসবের চিন্তায়। শ্রেষ্ঠাও কেনো যেনো আর নিতে পারছে না এগুলো। যদিও বিগত একমাসে সার্থককে আর দেখা যায়না এই গ্রামে। তাও কেনো যেনো সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকে সে।
এইচ এসসিতে ভালো রেজাল্ট হওয়ায় খুব সহজেই ভালো সরকারী কলেজে চান্স পেয়ে যায় শ্রেষ্ঠা। সমস্যা শুধু একটাই কলেজ থেকে বাড়ীর দূরত্ব। ঠিক এই সময়েই সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নেন আদিল সাহেব। গ্রামের জমিসহ বাড়িটাও বিক্রি করে সপরিবারে উঠে আসেন কলকাতা শহরে। শ্রেষ্ঠা কলকাতার আশুতোষ মুখার্জী কলেজে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে যতীন দাস পার্ক শিশু উদ্যানের কাছাকাছি খানিকটা ভেতরের দিকে একটা পুরোনো বাড়ি ভাড়া নেন তিনি। নোনা ধরা স্যাঁতস্যাতে বাড়ির আনাচে কানাচে অন্ধকার থাকলেও শহরে ফেরার পর মনের কোনো একটা কোনে আলো জ্বলে তার। বড়ো মেয়ে স্নিগ্ধার খোঁজ পাওয়ার আলো। একই শহরে যখন আছে, তবে একদিন না একদিন ঠিকই মিলিয়ে দেবে নিয়তি তাদের। এমনই নানান জল্পনা কল্পনা নিয়েই কেটে গেলো আরও দুটো মাস।
৩০.
ঘুটঘুটে অন্ধকার রুম। অথচ বাইরে দিনের আলো। সময়টা ঠিক পড়ন্ত বিকেল কিংবা সন্ধ্যার মিলনকাল। নিস্তব্ধ অন্ধকার হয়ে ভেসে আসছে গোঙানির শব্দ। করুন সুরে কেউ যেনো কিছু বলছে। সময়ের সাথে সাথে সেই সুর মিলিয়ে গেল। অতঃপর ঝনঝন শব্দ করে খসে পড়লো টেবিলের উপরের স্টিলের গ্লাস। চাপা আর্তনাদের সাথে হু হু করে চাপা কান্নার শব্দ শব্দহীন রুমের ছন্দপতন ঘটিয়েছে। আচমকা দরজা খুলে কারোর প্রবেশের ফলে একছটা আলো এসে পরলো স্নিগ্ধার শরীরের অর্ধাংশে। আবছায়া পরিবেশে দৃশ্যমান তার আঁখিকোটরের কালিমা, গলার পাশের কালচে দাগ। চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।
“তোর মতো থার্ড ক্লাস মেয়ের পাল্লায় পড়ে জীবনটা শেষ হয়ে গেলো আমার। আমাকে কী চাকর পেয়েছিস তোর? এসব বাচ্চার দোহাই দিয়ে মহারানীর মতো শুয়ে বসে থাকবি আর তোর সেবা করবো আমি? সার্থক আহসান রুদ্র তোর মতো মেয়েদের বিছানায় নিয়ে মজা লুটতে পছন্দ করে শুধু।”
গলা শুকিয়ে কাঠ স্নিগ্ধার। আচমকা পানি পিপাসার চোটে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় গুঙিয়ে ওঠে। অতঃপর ঘুমের ঘোরে তাড়াহুড়ো করে পানির গ্লাস হাতে নিতে গিয়ে পড়ে গিয়ে শব্দের উৎপত্তি। অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে আজকাল স্নিগ্ধার। কিন্তু অজানা কোনো এক কারণে গলা থেকে কোনো শব্দ বের হয়না। চেনা জগৎটা হুট করেই অচেনা হয়ে গেলে মানুষের বোধহয় এমনটাই হয়। এইযে চেনা মানুষগুলোর হুট করে বদলে যাওয়া। যেনো এই নতুন সত্তার সাথে কোনোকালেই মিল ছিল না তার। কোথায় গেলো সেই আগের ভালোবাসা, মিষ্টি কথন। রক্ষকই যখন ভক্ষক হয় পড়ে তখন পুরো দুনিয়াটা অসহ্য লাগে। কতোদিন হয়ে গেলো বাবা মায়ের সাথে কথা হয়না। শ্রেষ্ঠা কেমন আছে কে জানে? সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষটাকে সার্থক হিসেবে মেনে নিতে বড্ডো কষ্ট হয় তার। এমন দানব রূপ কী তার আগেও ছিলো? অবশ্যই ছিলো হয়তো, তবে লুকায়িত।
“তোমার খেলার সঙ্গী হিসেবে আমিই কেনো? চাইলে তো মেয়ের অভাব হতো না তোমার। যে কেউ স্বেচ্ছায় বিছানায় আসতে রাজি হতো। তবে আমার মতো সাধারণ একটা মেয়ের জীবন এভাবে তছনছ কেনো করলে? আমি তো কখনও কোনো ক্ষতি করিনি তোমার।”
গর্জে ওঠে সার্থক। স্নিগ্ধার কোনো কথাই আজকাল সহ্য হয়না তার। দিনের পর দিন বাচ্চাটাকে পেটে রেখে তার জন্য একের পর এক সমস্যার সৃষ্টি করছে। বিগত কয়েকমাসে শ্রেষ্ঠারও কোনো খোঁজ পাচ্ছে না। বাড়িটাও বিক্রি করে দিয়েছে তারা। কিন্তু কোথায় গিয়েছে কেউ জানে না। এখন তুরুফের তাস হিসেবে একমাত্র স্নিগ্ধা। তাইতো এখনও পর্যন্ত সহ্য করে যাচ্ছে তাকে। নাহলে কবেই এসব কেচ্ছা কাহিনী খতম করে দিতো। শ্রেষ্ঠার রূপ, যৌবন দেখার পর থেকে মাথা খারাপ হয়ে গেছে সার্থকের। যে কোনো মূল্যেই তার চাই শ্রেষ্ঠাকে। এই রূপ সে অন্য কাউকে ভোগ করতে দেবে না। প্রয়োজনে বিয়ে করে প্রত্যহ সেই রূপ সৌন্দর্য্যের ভাগীদার হবে সে। তবুও এই মাথা ধরে যাওয়ার মতো সৌন্দর্য্য হাতছাড়া করবে না।
দিনের পর দিন শ্রেষ্ঠাকে খুঁজে না পাওয়ার হতাশা থেকে ধীরে ধীরে সার্থক হয়ে ওঠে অন্য মানুষ। ঠিক মানুষ নয়, বরং হয়ে ওঠে পশু। আর তার পুরোটা দিনের রাগ, ঝঞ্ঝা সবটা উগড়ে দেয় স্নিগ্ধার উপর। সার্থকের পাশবিক অত্যাচারের কারণ প্রথম প্রথম বুঝতে পারতো না স্নিগ্ধা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বুঝতে পারে, সার্থক সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষ না। মেয়েদের শরীর নিয়ে খেলা তার কাছে একপ্রকার নেশার মতো। ইতিমধ্যে স্নিগ্ধা জানতে পারে সে অন্তঃসত্ত্বা। অবিবাহিতা একটা মেয়ের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ব্যাপারটা সমাজের কাছে নিকৃষ্ট এক ঘটনা। কয়েক মাস আগেই আগের বাড়ী ছেড়ে দিয়ে নতুন বাড়ী নিয়েছে তারা। এমনকি বাড়ির কারোর সাথেও কোনরূপ যোগাযোগ করতে দিতো না সার্থক। শ্রেষ্ঠার আসা একটা চিঠি, তারপর থেকেই সার্থকের এই পরিবর্তন। কোনো কিছু নিয়ে অভিযোগ কিংবা রাগারাগির এক পর্যায়ে গায়ে হাত তুলতেও বাদ রাখতো না। অনেক চেয়েও বাড়িতে কারোর সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি স্নিগ্ধা। ভালোবাসায় অন্ধ স্নিগ্ধা এই সময় সবচেয়ে বেশি করে উপলব্ধি করে নিজের করা ভুলগুলো।
সংরক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা মেয়েটা হুট করে মুক্ত বাতাসের স্বাদ পেয়ে কিভাবে যেনো ভুলে গেলো সব শৃঙ্খল। ভুলে গেলো বাবা মায়ের আদর্শ, তাদের সম্মানের কথা। বয়ঃসন্ধিকালের প্রেমের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে কখন যেনো ভাসিয়ে দিলো নিজেকে। যখন বুঝতে পারলো, তখন অনেকটাই দেরী হয়ে গেছে। না পারছে বাচ্চাটাকে নষ্ট করতে আর না পারছে সার্থককে এসব ব্যাপারে বলতে। ইতিমধ্যেই সার্থকের যে আমূল পরবর্তন ঘটেছে তা মেনে নিতেই কষ্ট হচ্ছে তার। উপরন্তু বাচ্চার কথা শুনে কিভাবে রিয়েক্ট করবে বুঝতে পারেনি। বিধায় স্নিগ্ধার অনেকগুলো দিন কেটে গেল নিজের সাথে বোঝাপড়া করতে। অতঃপর কোনো এক গভীর রাতের একান্ত সময়ে সার্থক জানতে পারে স্নিগ্ধার গর্ভধারণের কথা। এরপর থেকেই তার সাবলীল জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। বাচ্চা নষ্ট করতে না চাওয়ায় প্রচুর মারধর করতে শুরু করে সার্থক। যার প্রতিটা চিহ্ন আজও বয়ে বেড়ায় শরীরের প্রতিটা অঙ্গ। শরীরে লেপ্টে থাকা কালশিটে দাগগুলোকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে সময় নিয়ে দেখে স্নিগ্ধা। আর ভাবে, ভালোবাসার নাজানি আর কতো রূপ হয়!
জোরপূর্বক স্নিগ্ধার গাল চেপে ধরে সার্থক। অতঃপর হিশহিশিয়ে বলে ওঠে,
“ধীরে ধীরে প্রেম থেকে শুরু করে অধিকার পাওয়া। অতঃপর বিছানা সঙ্গী। এই ব্যাপারটা একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো। যা স্বেচ্ছায় পাওয়া সঙ্গিনীর মধ্যে কোথায়? আবার সেটা যদি হয় তোর মতো হাবাগোবা, রক্ষনশীল পরিবারের মেয়ে। তাহলে তো ব্যাপারটা আরও জমজমাট।”
স্নিগ্ধার চোখ বেয়ে জল জড়িয়ে পড়ে। খানিকটা ব্যথা শরীরের। তবে বেশিরভাগটাই মানসিক। দুই হাতে ধস্তাধস্তি করছে সে নিজেকে সার্থকের থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার। অতঃপর ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠতেই তাকে ছেড়ে দিয়ে সার্থক হনহন করে বেরিয়ে যায় রুমের বাইরে। স্নিগ্ধা ওখানেই বসে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের জল যেনো ফুরিয়ে গেছে। আজকাল কান্না করলে হু হু করে জ্বলে ওঠে চোখের কোল। কান্নাগুলোও ছন্দহীন লাগে।
#চলবে!
#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#অন্তিম_পর্ব(শেষাংশ)
#ফিজা_সিদ্দিকী
৩১.
পাশের ফ্ল্যাট থেকে ভাঙচুরের শব্দ ভেসে আসছে। সেই সাথে কারো করুণ আর্তনাদ। ক্ষণে ক্ষণে বুকটা কেঁপে উঠছে শ্রেষ্ঠার। অজানা কারণেই চোখ ভিজে আসছে তার। মেয়েটার করুন অবস্থা যেনো সে এখানে বসেই টের পাচ্ছে। ইতিমধ্যে ছাত্রীর মা এসে বসেন তার মুখোমুখী। চোখ মুখে তার বেদনার ছাপ। আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বেদনার্ত কণ্ঠে বলেন,
“মেয়েটা কেনো যে এখনও এখানে পড়ে আছে বুঝিনা। কয়েক মাস আগেই পাশের ফ্ল্যাটে এসেছে একজোড়া দম্পতি। প্রথম প্রথম বেশ ভালোই চলতো। মেয়েটা বেশ ভালো, মিশুকে স্বভাবের। কিন্তু ইদানিং বোধহয় কোনো সমস্যা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই ছেলেটা এমন করে। মেয়েটাকেও আর বাইরে বের হতে দেখা যায়না।”
“আপনারা কেউ কিছু বলেন না কেনো? প্রতিবেশী হিসেবে তো আপনাদের কিছু করা উচিৎ।”
“শহরের মানুষ কেউ কারোর না। তুমি তো গ্রামে থাকতে, তাই এসব বোঝো না। শহরের মানুষ কারোর সাতেও নেই পাঁচেও নেই।”
“কিন্তু তাই বলে একটা মেয়েকে একা পেয়ে এভাবে অত্যাচার করছে, আর আপনারা মুখ বুঁজে সহ্য করবেন?”
“একবার দরজা খোলা ছিলো দেখে উঁকি দিয়েছিলাম, মেয়েটা কেমন আছে জানার জন্য। বিশ্বাস করো মেয়েটাকে দেখে চোখে পানি এসে গেছিলো। রুগ্ন শরীরে যেনো কিচ্ছু নেই। চোখে মুখে কালশিটে দাগ। আমাকে যেতে দেখে ছেলেটা কড়া চোখে তাকিয়ে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়। এরপর আর কিভাবে যাই বলো?”
পড়াশোনার পাশাপাশি কয়েকটা টিউশনি নিয়েছে শ্রেষ্ঠা। কলেজের পাশের এলাকায় থাকা বেশ ব্যয়বহুল। আদিল সাহেব অনেক কষ্টে ছোটো খাটো একটা দোকানে কাজ পেয়েছেন। তার আর শ্রেষ্ঠার আয় করা টিউশনির টাকা দিয়ে মোটামুটি কোনো রকম চলে যায় তিনটে মানুষের সংসার। নীলাকে পড়ানোর অফার পেয়েছিল এক বান্ধবীর কাছ থেকে। তার দূর সম্পর্কের কেউ হয় বোধহয়। যদিও জায়গাটা বালিগঞ্জের দিকে। তার বাড়ি থেকে বেশ অনেকটাই দূরে। কিন্তু মাইনে ভালো অঙ্কের। তাই কষ্ট হলেও এই টিউশনিটা হাতছাড়া করেনি সে।
ছাত্রীর পরীক্ষা। তাই পড়াতে পড়াতে খানিকটা রাত হয়ে যায় শ্রেষ্ঠার। বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাড়াহুড়ো করে সিড়ি দিয়ে নামছিলো সে। আচমকা সিঁড়ির কোণে কাউকে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকতে দেখে চমকে ওঠে সে। এই ফ্ল্যাটের সিড়ির দিকে তেমন একটা আলো আসেনা। প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন বলা চলে। এমতাবস্থায় কাওকে এভাবে বসে থাকতে দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে মতো অবস্থা শ্রেষ্ঠার। তার উপর মেয়েটার খোলা চুল পিঠে ছড়িয়ে রয়েছে। কেমন যেনো কান্না আর গোঙানির মিশ্র শব্দ ভেসে আসছে সেখান থেকে। ভয়ে ভয়ে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালাতেই মুখ তুলে তাকায় বসে থাকা মেয়েটা। থেমে যায় শ্রেষ্ঠার হৃদস্পন্দন। হাত পা কাঁপতে শুরু করে। আচমকা হাত থেকে ফসকে পড়ে যায় ফোনটা। আবারও আঁধারের মাঝে নিস্তব্ধ হয়ে যায় সবকিছু। শ্রেষ্ঠা প্রতিক্রিয়া দেখাতে ভুলে গেছে। বরফের ন্যায় জমে গেছে যেনো তার সারা শরীর। নাড়াতে পারছে না একটুও। মুখ দিয়ে উচ্চারিত হচ্ছে না কোনো শব্দ। বহু কষ্টে একটাই শব্দ উচ্চারিত হলো শুধু।
“আ আআআপু!”
অন্ধকারে সামনের মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছিলো না স্নিগ্ধা। অতঃপর পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনেই দুই হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কাঁদতে শুরু করে। এতক্ষণে যেনো হুঁশ ফেরে শ্রেষ্ঠার। ঠোঁট কেটে ঠোঁটের কোণায় রক্ত জমে। চোখে, মুখে ক্লান্তির ছাপ। কপালের একদিকে বহু আগের কেটে যাওয়া একটা দাগ। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কালশিটে দাগ আবার কোথাও তাজা রক্ত। মুহুর্তের জন্য চেনা মুখ অচেনা ঠেকলো। আঁতকে উঠেছিলো শ্রেষ্ঠা।
৩২.
দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেছে স্নিগ্ধার বাড়ি ফেরার। সেদিন রাতে বাড়ীতে ঢোকার সময় শ্রেষ্ঠার সাথে স্নিগ্ধাকে দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠেন শিমুল নাহার। আদিল সাহেব থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকেন দূরে। মনে মনে ভাবতে থাকেন, এই কী তার সেই আদরের কন্যা? পাড়ার সেরা মেধাবী সেই মেয়েটা তার? যার রেজাল্টের দিকে মুখিয়ে থাকতো পুরো গ্রাম। গোটা একটা গ্রামের কাছে উদাহরন হিসেবে থাকা তার সেই ছোট্ট মেয়েটা কবে এতো বড়ো হয়ে গেলো? একদিকে ক্ষত, বিধ্বস্ত, রক্তশূন্য চেহারা। শরীরে নির্মম আঘাতের ছাপ। অপরদিকে তার বেড়ে ওঠা উঁচু পেট। এক পা এগোনোরও সাহস পাননি তিনি। উল্টো পথে ফিরে যান নিজের রুমে। শিমুল নাহারও কাঁদতে কাঁদতেই আহাজারী শুরু করে দেন। জীবনের সবচেয়ে বড়ো সর্বনাশ আর সমাজের দোহাই দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেন। গেটের সামনে অশ্রুসিক্ত, অসহায় অবস্থায় বসে পড়ে স্নিগ্ধা। দুই হাতে মুখ ঢেকে বলে ওঠে,
“এজন্য আমি এতোদিন কোনো সাহস দেখাইনি শ্রেষ্ঠা। আমার করা ভুল যে কোনো ছোটো ভুল না। আমি জানতাম এই সমাজ, আমার পরিবার, কেউই কখনও মেনে নেবে না আমাকে। আমি তো বলেছিলাম ফিরবো না এখানে। সকাল হলে সার্থক ঠিকই নিজের ভুল বুঝতে পারতো। ভালো ব্যবহার না করলেও গেট ঠিকই খুলে দিতো আমার জন্য। এখন যে আমার আর যাওয়ার কোনো জায়গা রইলো না শ্রেষ্ঠা। ওখানে থাকলে দুই বেলা খাওয়া পরা আর আমার বাচ্চার দায়িত্ব তো অন্তত নিতো সার্থক। এখন আমি কী করবো শ্রেষ্ঠা? আমার যে যাওয়ার আর কোনো জায়গা রইলো না।”
শ্রেষ্ঠা অসহায় চোখে তাকায় স্নিগ্ধার দিকে। মানুষটাকে এভাবে দেখে তার কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। কথা ছিলো তার বড়ো বোন পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবে। বাবা মা আর তাদের দুই বোনের সুখের একটা জীবন হবে। অভাবের সংসারে বাবার করা প্রতিটা ত্যাগের প্রতিদানে একটা সময়ের সুখ লুটিয়ে দেবে তার কদমে। কিন্তু এ কী হলো? সময় এমন কেনো? আমাদের করা প্রতিটা জল্পনা কল্পনা কিভাবে যেনো তছনছ করে বয়ে যায় অন্য স্রোতে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মলিন কণ্ঠে শ্রেষ্ঠা বললো,
“তুমি এখানেই থাকবে আপু। মা বাবার সাথে আমি কথা বলবো। প্লীজ এভাবে আর কান্না কোরো না। তোমার ড্রেসিং এর প্রয়োজন আছে। অন্তত যে আসছে তার কথা ভেবে নিজেকে সামলাও।”
৩৩.
নয় মাসের উঁচু পেট নিয়ে কিচেনে নিজের আর শ্রেষ্ঠার জন্য রান্না করছে স্নিগ্ধা। যেদিন থেকে স্নিগ্ধা এই বাড়িতে এসেছে বাবা মা রুম থেকে বের হওয়া কম করে দিয়েছেন। এমনকি নানা বিষয়ে শ্রেষ্ঠার সাথে বিবাদও লেগেছে তাদের। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে শিমুল নাহার সিদ্ধান্ত নেন এই বাড়িতে তিনি থাকবেন না। ফিরে যাবেন গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু সব বিক্রি করে চলে আসার ফলে সেই পথও বন্ধ হয়ে গেছে।
“একটা পরপুরুষের সাথে ফুর্তি করার সময় ওর মনে ছিলো না? এখন আমাদের ঘাড়ে এসে কেনো পড়েছে? যেতে বল ওই ছেলের কাছে। ওই মেয়ের মুখও আমি দেখতে চাই না। আমার বড়ো মেয়ে মরে গেছে আমার জন্য।”
শিমুল নাহারের কথার প্রেক্ষিতে গর্জে ওঠে শ্রেষ্ঠা। জীবনে প্রথমবারের মতো মায়ের কথার উপর উঁচু কণ্ঠে বলে ওঠে,
“বাবা তো একা এই সংসার সামলায় না। এই সংসারের প্রতি আমারও কিছু অবদান আছে। মাসের শেষে পুরো টাকাটাই আমি তোমার হাতে তুলে দিই সংসারের জন্য। তাহলে এই বাড়ীতে আমার কথায় একজন সদস্য নাহয় খাওয়া দাওয়া করলো। এতে এতো আপত্তি কেনো তোমার মা?”
মুখের উপর কথা বলায় শ্রেষ্ঠাকে বেয়াদব আখ্যান দিয়ে স্বামীর কাছে বিচার চান শিমুল। আদিল সাহেব সবকিছু দেখে যাচ্ছিলেন শুধু গম্ভীর মুখে। আজকাল তার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় এইতো দুটো দিনের অতিথি আর তিনি এই দুনিয়ায়। প্রাণপাখিটা উড়াল দিলেই বাঁচেন যেনো। অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে শ্রেষ্ঠাকে বলেন,
“আমার ইনকামের টাকায় আমাদের দুজনের বেশ চলে যাবে। বাকিটা তোমরা দেখে নিও।”
ছোটো শ্রেষ্ঠার বুকের উপর একরাশ হতাশা, ভার, দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে আলাদা হলো সংসার। স্নিগ্ধা অনেক চেষ্টা করেও আর এর সমাধান করতে পারেনি। অতঃপর সবাই সবকিছু ছেড়ে দিয়েছে সময়ের উপর। রান্নাঘর একটাই। অথচ রান্না হয় দুইভাগে। শিমুল নাহার রান্না করেন তাদের জন্য। আর শ্রেষ্ঠা করে স্নিগ্ধা আর তার জন্য। তবে মাঝে মাঝে শ্রেষ্ঠার ফেরার আগে কিচেন ফাঁকা ফেলে স্নিগ্ধা নিজেই সেরে রাখে রান্নাটা। এতগুলো দিনে একবারের জন্যও শ্রেষ্ঠা জানতে চায়নি স্নিগ্ধার সাথে ঘটে যাওয়া অতীতের কথা। বরং সে যতটা সম্ভব চেয়েছে স্নিগ্ধাকে সেসব কিছু ভুলিয়ে দিতে। যদিও মানুষ ভোলা গেলেও স্মৃতি কখনও ভোলা যায়না। হোক সেটা সুখের বা দুঃখের। তবে পুরোনো স্মৃতিতে মরিচার প্রলেপ পড়ে নতুন সুখময় স্মৃতিদের আগমনে। দুই বোনের ছোটো সংসার খুব একটা মন্দ কাটে না। সারাদিনের ক্লাস, টিউশন শেষে বাড়ি ফেরা। আবার রাত জেগে পড়াশোনা করার সময় স্নিগ্ধার তার প্রতি খেয়াল রাখা, আগত সন্তানকে নিয়ে দুজনের খুনসুটিময় মুহূর্ত, এসব নিয়ে বেশ ভালোই কাটছে সময়। তবে অভিমানের মস্ত এক পাহাড় জমেছে শ্রেষ্ঠার মনে বাবা মায়ের প্রতি। যেটা টপকে তারা আর কখনো এক হতে পারবে কিনা জানা নেই।
দুপুর থেকেই শরীরটা বেশ খারাপ লাগছে স্নিগ্ধার। বিকালে রুম থেকে বের হয়ে কিচেনে যাওয়ার সময় চেয়ার ধরে বসে পড়ে সে। হাত লেগে নীচে পড়ে যায় কয়েকটা থালা বাসন। শব্দ শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন শিমুল নাহার আর আদিল সাহেব। রাগ হোক বা অভিমান, মেয়েকে এমন অবস্থায় যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখে স্থির থাকতে পারেন না তারা কেউই। তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে পড়েন হসপিটালের উদ্দেশ্যে। শ্রেষ্ঠা তখন মাত্র কলেজ শেষ করে টিউশনিতে যাচ্ছে। রাস্তায় থাকা অবস্হায় বাবার কল পেয়ে উল্টো পথে দৌড় দেয় সেও।
৩৪.
গর্ভাবস্থায় পেটে আঘাত পাওয়ায় বাচ্চা সঠিক অবস্থানে নেই। তাই সিজারের জন্য রেডি করা হচ্ছে পেশেন্টকে। আদিল সাহেব হসপিটালের সমস্ত ফর্মালিটি পূরণ করতে ব্যস্ত। চোখ ভিজে আসছে তার। শিমুল নাহার থম মেরে বসে আছেন কেবিনের বাইরে। শ্রেষ্ঠা কাউকে তোয়াক্কা না করে হন্তদন্ত পায়ে ঢুকে পড়ে কেবিনে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ওটিতে নিয়ে যাওয়া হবে স্নিগ্ধাকে। একজন নার্স বেশি কথা বলতে বারণ করে বের হয়ে যায় কেবিন থেকে। নার্স বের হয়ে যেতেই স্নিগ্ধা বড়ো এক নিঃশ্বাস টেনে নেয় নিজের মধ্যে। অতঃপর বলতে শুরু করে,
“বাবা মায়ের মতো তুই কখনো আমাকে ছেড়ে যাসনি। বরং ছায়ার মতো পাশে থেকেছিস প্রতিটা মুহূর্তে। এমনকি আমার অতীত, এতদিন ঠিক কী হয়েছে আমার সাথে এসব কিছুই জানতে চাসনি কোনোদিন। কিন্তু আমার কেনো জানি না মনে হচ্ছে আজ না বললে আর কখনো বলা হবে না এসব। আমার হাতে সময় বোধহয় বড্ডো কম। তাই আমাকে কয়েকটা কথা বলতে দে প্লিজ।”
“আপু, এভাবে ভেঙে পড়িস না। এখন এতো কথা বলিস না। আমি শুনবো। সব শুনবো। কিন্তু আগে তুই সুস্থ হয়ে ওঠ।”
“এসব ভূমিকা করার সময় এখন নেই শ্রেষ্ঠা। আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোন। সার্থক শুধুমাত্র তোকে পাওয়ার জন্য এতোদিন বাঁচিয়ে রেখেছিল আমাকে। যেদিন তোকে প্রথমবারের মতো দেখেছিল, তোর রূপের প্রতি জন্মেছিল তার লালসা। যে কোনো মূল্যে তোকে পেতে চেয়েছে। এমনকি তোর পাঠানো চিঠিও আমাকে পড়তে দেয়নি। তার বদলে দেখিয়েছিল অন্য চিঠি। যেখানে লেখা ছিল তুই পছন্দ করিস সার্থককে। আমি তোদের মাঝখান থেকে যেনো সরে যাই। ছোটো বোনের সুখ যেনো না হাতিয়ে নিই, এমন সব কথা। আমিও অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিলাম সেসব। এই কারণেই ধীরে ধীরে দূরত্ব তৈরী হয় আমাদের মাঝে। ঘৃনা করতে শুরু করি তোকে। সার্থক প্রটিনিয়ত আমাকে বোঝাতে চাইতো যে ও আমাকে ভালোবাসে শুধু। আর তুই চেষ্টা করছিস আমাদের মধ্যে ঢুকে পড়ার। এসব মেনে নিতে পারিনি। তাই সবার সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করে নতুন বাড়িতে উঠি সার্থকের সাথে। পড়াশোনা শেষ হলে বিয়ে করবো, এমন প্ল্যান ছিলো আমাদের। কিন্তু হুট করেই কিভাবে যেনো কনসিভ করে গেলাম। ব্যপারটা জানার পর থেকেই সার্থক বদলাতে শুরু করলো। বারবার প্রেশার দিলো বাচ্চা নষ্ট করার জন্য। কিন্তু একটা নিস্পাপ শিশুকে মেরে ফেলার মতো ক্ষমতা কখনোই হয়ে ওঠেনি আমার। তাই চুপচাপ মুখ বুঁজে সহ্য করে যাই তার ব্যবহার। অথচ আমি একবারের জন্য টেরও পাইনি সার্থক এতো নোংরা একটা লোক। যে শুধু ভালোবাসে নতুন নতুন নারী শরীর, নারীকে না।”
শ্রেষ্ঠার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ইতিমধ্যে। আর কোনো কথা বলতে পারলো না সে। তাকে শিফট করা হলো ওটিতে। শুরু হলো অপারেশন।
দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা পর ওটির লাইট অফ হলো। ছোট্ট একটা শিশুকে তোয়ালে পেঁচিয়ে নিয়ে এলো একজন নার্স। শ্রেষ্ঠা প্রথম কোলে নিলো তাকে। এরপর একে একে আদিল সাহেব আর শিমুল নিহার। স্নিগ্ধাও মোটামুটি সুস্থ বলা চলে। তাকে শিফট করা হয়েছে কেবিনে।
৩৫.
সদ্যোজাত এক সপ্তাহের দুধের শিশুকে রেখেই চিরতরে চোখ বুঁজলো স্নিগ্ধা। আত্মহত্যা করলো সে নিকশ কালো গভীর এক রাতে। সাথে লিখে রেখে গেলো ছোটো একটা চিরকুট।
“আমি সত্যিই আর পেরে উঠছি না। সকলের অবজ্ঞা, ঘৃনা সহ্য করার পর যখনই বাচ্চাটাকে দেখি মনে পড়ে যায় ওই বেইমান লোকটার কথা। ও যে পুরো বাবার আদল পেয়েছে! আমাকে ক্ষমা করিস সবাই।”
বাড়িতে শোকের ছাড়া। অথচ শ্রেষ্ঠা কোথাও নেই। তাকে কল করেও পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে বের হাওয়ার আগে বলে গেলে তার ফেরার আগে যেনো দাফন কার্য সম্পন্ন না করে।
৩৬.
অচেনা নম্বর থেকে পাওয়া কল দেখে বেশ বিরক্ত হয় সার্থক। এমনিতেই স্নিগ্ধা যাওয়ার পর থেকেই মেজাজ আরও বেশি খিটখিটে থাকে তার। অতঃপর বিরস মুখে ফোন কানে তুলতেই তার চোখে মুখে খেলে যায় অদ্ভুত এক প্রশান্তি। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে লালসার বিশ্রী হাসি। অতঃপর ঝটপট রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে কোথাও যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
নির্জন রাস্তা। গাড়ি ছুটে চলেছে গন্তব্যহীন পথে। গাড়ির মধ্যে বসে আছে একজন সুন্দরী রমণী আর একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। যার চোখের দৃষ্টি এলোমেলো ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে রমণীর শরীরের বিভিন্ন বাঁকে। শ্রেষ্ঠা হাসছে। প্রাণ খুলে হাসছে। ঠোঁটের কোণ হতে হাসি যেনো সরছেই না। আচমকা বেশ শুনশান, জঙ্গলে আবৃত একটা জায়গা দেখে সার্থককে গাড়ি দাঁড় করাতে বলে শ্রেষ্ঠা। সার্থক মনে মনে হাসে, পৈশাচিক হাসি হাসে। শারীরিক ক্ষুদা নিবারণের মতো পর্যাপ্ত এক জায়গা বেছে নিয়েছে শ্রেষ্ঠা। একথা ভেবেই যেনো ক্ষুধার্ত কুকুরের ন্যায় লালা ঝরতে থাকে তার জীভ হতে। শ্রেষ্ঠা হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়ে জঙ্গলের খানিকটা ভেতরের দিকে। সার্থকও এগিয়ে যায় তার পিছু পিছু। একটু ভেতরের দিকে গিয়ে অচমকা পিছনে ঘুরে সার্থককে জড়িয়ে ধরে শ্রেষ্ঠা। সার্থক হকচকিয়ে যায় মুহূর্তেই। অতঃপর ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার কাজে। এদিকে কাঙ্খিত জিনিস পেয়ে নিমগ্ন সার্থকের ঘাড়ের ডানপাশে খুব সূক্ষ্মভাবে মেডিসিন ভর্তি একটা ইনজেকশন পুশ করে দেয় শ্রেষ্ঠা। সামান্য ব্যথা পেলেও সেদিকে তেমন একটা গুরত্ব দেয় না সার্থক। কাজ শেষ করে পিছিয়ে যায় শ্রেষ্ঠা। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় জঙ্গলের আরও গভীরে। খানিকটা সময় অতিবাহিত হতেই মাথা ঝিমঝিম করে সার্থকের। অবশ হয়ে আসে শরীর। পা টেনে টেনে চলতে হচ্ছে যেনো তাকে। শরীরটা পাথরের মতো ভারী লাগছে। একসময় হাঁটতে গিয়ে ধপাস করে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। সজ্ঞানে থাকা সত্বেও শরীরের একটাও অঙ্গ নাড়াতে পারছে না সে।
শ্রেষ্ঠা হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে সার্থকের সামনে। চোখে মুখে তার পৈশাচিক আনন্দ। খিল খিল করে হেসে পকেট থেকে বের করে ধারালো এক ছুরি। গাছের ফাঁক দিয়ে পড়া সূর্যের আলোকরশ্মি সেই ধারালো ছুরির উপর হতে প্রতিফলিত হয়ে তার তীক্ষ্ণতার প্রমান দিচ্ছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তার ধার। আঁতকে ওঠে সার্থক। গো গো শব্দ ছাড়া তার মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে না আর কোনো শব্দ। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে শ্রেষ্ঠা তাকিয়ে থাকে সেই ধারালো ছুরির দিকে। অতঃপর জোরে আঁচড় টানে সার্থকের বুক বরাবর। ঘাড় থেকে শুরু করে তলপেট অবধি জামা ভেদ করে চামড়া ছিঁড়ে যায়। বেরিয়ে আসে রক্তের স্রোত। খানিকটা রক্ত ছিটকে পড়ে শ্রেষ্ঠার পরনের জ্যাকেটেও। এরপর বিরতিহীন ভাবে এমনভাবেই ছুরি দিয়ে আঘাত করে যায় শ্রেষ্ঠা। ব্যথায় কাতরানোর মতো অবস্থাও রাখেনি সার্থকের। তার চোখে মুখে ছিটকে আসে কয়েক ফোঁটা রক্তের ছটা। হাঁপিয়ে না ওঠা পর্যন্ত এমনই বিরতিহীন ভাবে ছুরি চালায় সে। অতঃপর উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে ওঠে,
” আপুর শরীরের প্রতিটা ক্ষত সময় নিয়ে দেখেছি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। যেদিন ওই বাড়ি থেকে বিধ্বস্ত অবস্থায় নিয়ে আসি তাকে, সেদিনই ঠিক করেছিলাম তার পাওয়া প্রতিটা আঘাতের সুদ সমেত জবাব দিতে হবে আপনাকে। তবে সেটা এতো তাড়াতাড়ি হবে সেটা ভাবিনি। আপনার আয়ু আরও কয়েকটা দিন ছিলো। কিন্তু যেই মুহুর্তে পাহাড়সম কষ্ট, হাহাকার নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে আমার আপু। সেই মুহূর্ত থেকে এই দুনিয়ায় তোর মতো শয়তানের বাঁচার কোনো অধিকার নেই। তোর দেওয়া আঘাত গুলো ঠিক এভাবেই মুখ বুঁজে সহ্য করতো আমার আপু। আজ তুই বুঝবি তার কষ্ট। তোর সন্তান পেটে থাকা অবস্থায় যে পেটে লাথি দিয়েছিস, তোর সেই পেট আমি ঝাঁঝরা করে দেবো। শুধু তোর মুখটা বাদ রাখবো? কেনো জানিস? নাহলে তোর এই নৃশংস মৃত্যুর খবর তো কেউ পাবে না। কেউ দেখবে না একজন প্রতারকের শাস্তি কতো ভয়ানক হতে পারে।”
চুরির গা চুঁইয়ে পড়ছে রক্তের স্রোত। ছুরিটা পাশে রেখে খালি সিরিঞ্জ হাতে নিয়ে তাতে বাতাস ভরে নেয় শ্রেষ্ঠা। এরপর সেই বাতাস ভর্তি সিরিঞ্জ পুশ করে দেয় সার্থকের দুই বাহুর শিরায়। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে,
“আপুর লাশটা ফেলে রেখে এসেছি। তোর লাশ ফেলে তবেই সেই খাটিয়া উঠবে বলে প্রতিজ্ঞা করে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম। তাই ইচ্ছে থাকলেও পর্যাপ্ত সময়ের অভাবে এর চেয়ে বেশি শাস্তি দিতে পারছি না তোর মতো শয়তানকে। ইওর গুড লাক।”
শ্রেষ্ঠা এগিয়ে যায় সামনের দিকে। পিছনে পড়ে থাকে ফুলে ফেঁপে ওঠা শিরার যন্ত্রনা আর হাইহিলের জুতো দিয়ে পিষে ফেলা গোপনাঙ্গের যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়া চেহারার মানুষটা।
গাড়ি থেকে পানির বোতল বের করে শরীর, হাত মুখ আর ছুরিতে লেগে থাকা রক্ত ধুয়ে ফেলে শ্রেষ্ঠা। অতঃপর ছুরি আর সিরিঞ্জটা আবারো ঢুকিয়ে নেয় জ্যাকেটের পকেটে। এরপর পা বাড়ায় নির্জন সেই রাস্তার শেষ প্রান্তে। এখান থেকে মিনিট দশেক পথ হেঁটে গেলেই একটা নদী আর চারপাশে জনসমাগম এলাকা। নদীর কাছে এসে চুরি সহ জ্যাকেটটা ছুঁড়ে মারে নদীর ঢেউয়ের মাঝে। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকায় না। একটা গাড়ি ধরে সোজা ফিরে আসে বাড়িতে। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হওয়ার পর সম্পন্ন হয় স্নিগ্ধার দাফন কার্য। সেইদিন সেই মুহূর্ত থেকে সে হয়ে ওঠে ছোটো শ্রেয়ার মানি। মা ডাকটা কখনও ডাকতে শেখায়নি তাকে। কেনো যেনো তার মনে হয় জন্মদাত্রী মায়ের জন্যই তৈরী এই ডাক শোনার কোনো অধিকার তার নেই। এই ডাক শুধু স্নিগ্ধারই প্রাপ্য ছিলো, তার নয়।
৩৭.
বন্ধ করা চোখ আচমকা খুলে ফেলে শ্রেষ্ঠা। নমনীয় দৃষ্টিতে তাকায় আরাধ্যর দিকে। অতঃপর ডান হাত এগিয়ে নিয়ে যায় আরাধ্যর দিকে। তার গালে হাত ছুঁইয়ে ভেজা কণ্ঠে বলে ওঠে,
“শ্রেয়া তোমাদেরই বংশের সন্তান। তোমাদের রক্ত বয়ে চলছে তার মাঝে। আমাকে যতো খুশি ঘৃনা করো, কিন্তু তাকে কখনো অবহেলা কোরো না প্লিজ।”
“কী পরিচয় শ্রেয়ার? সত্যিটা বলো।”
“চাইলেও সব কথা বলতে পারবো না তোমাকে। পারবো না দেবতার আসনে বসিয়ে রাখা কোনো মানুষকে ধপ করে মাটিতে বসিয়ে দিতে। শুধু আমার শেষ চাওয়াটা রেখো, আমার শ্রেয়ার খেয়াল রেখো। আমাদের স্বপ্ন ছিল একসাথে ঘর বাঁধার। কিন্তু সে ঘর চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর এর মতো জরাজীর্ণ, দমবন্ধকর হবে, তা কী কারো জানা ছিল? ভালোবাসি তোমাকে। হাসতে হাসতে বিদায় নিলাম তোমাদের থেকে। বিদায় নিলাম এই জগৎ সংসার থেকে। অনেক তো চেষ্টা করলাম বাঁচার। লড়াই করতে করতে এখন ক্লান্ত। জগতের কারোর পরোয়া না করলেও এই দুটো চোখে যে ঘৃণা আমি দেখেছি নিজের জন্য, তা এক জীবন বিষের চেয়েও বেশি বিষাক্ত করার জন্য যথার্থ। এর চেয়ে ভালো থেকো প্রিয়।”
কথাটুকু শেষ করে আরও কাছাকাছি এগিয়ে আসে শ্রেষ্ঠা আরাধ্যর। দুই চোখ বন্ধ করে অধর ছোঁয়ায় ললাটে। গাঢ় মোহময় এক চুম্বনে তাকে আবিষ্ট করে বাম হাত বাড়িয়ে খুব সন্তর্পনে খুলে দেয় গাড়ির গেট। অতঃপর সজোরে ধাক্কা দেয় আরাধ্যকে। গাড়ির খোলা গেট দিয়ে আরাধ্য ছিটকে পড়ে ডানপাশের পাথরের অমসৃণ দেওয়ালে। খানিকটা আঘাতও পায় মাথায় । সেই অবস্হায় অবিশ্বাস্য চেহারা নিয়ে সে তাকিয়ে থাকে এলোমেলোভাবে এগিয়ে যাওয়া গাড়িটার দিকে। গতিশীল গাড়িটার মধ্যে শ্রেষ্ঠা আরাধ্যর ফোন থেকে কল করে নির্ঝরকে। এরপর তাদের লোকেশন বলার সাথে সাথেই গাড়িটা গড়িয়ে পড়ে খাদে। আর কিছু বলার মতো অবস্থায় থাকে না শ্রেষ্ঠা। আরাধ্য নিশ্চুপ পাথরের মূর্তির মতো অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে থাকে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে খাদে পড়তে থাকা গাড়িটার দিকে। অতঃপর একদফা চিৎকার করে শ্রেষ্ঠার নাম নিয়ে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ে সেখানে।
৩৮.
আজ শ্রেয়ার আঠারোতম জন্মদিন। আরোহী খাঁন আর আরাধ্য দুজনে মিলে সস্নেহে বড়ো করে তুলেছেন শ্রেয়াকে। কখনও কোনো কিছুর অভাববোধ হতে দেননি। তবে সারা জীবন একটাই আফসোস রয়ে গেলো শ্রেয়ার। সে কখনো বাবা মা দুইজনকে একসাথে পায়নি। যখন মা ছিলো তখন কষ্ট পেতো বাবার জন্য আর যখন বাবা আছে তখন মা নেই। আরাধ্য আর শ্রেয়া দুজনে বসে আছে সেই জায়গায়, যেখানে শেষ বারের মতো গাড়িসহ শ্রেষ্ঠা পড়ে গিয়েছিল খাদে। কয়েক মাস ধরে অনেক খোঁজা খুঁজি করেও পুলিশ কোনো বডি পায়নি শ্রেষ্ঠার। তাই তারা ধরে নেয় গভীর জঙ্গলে থাকা কোনো হিংস্র পশু তার শরীরটাকে অক্ষত রাখেনি। শ্রেয়া বুঝতে শেখার পর থেকে কখনো নিজের জন্মদিন পালন করে না। বরং এই দিনটা সে আর আরাধ্য আসে এই জায়গায়। এখানে আসলেই যেনো তারা খুঁজে পায় শ্রেষ্ঠাকে। মনের মাঝে জমানো কত শত অভিযোগ ব্যক্ত করে দুজনে। এই জায়গায় বছরের আরও একটা দিন আসে আরাধ্য। সেটা শ্রেষ্ঠার মৃত্যুবার্ষিকীর দিন। এই দিন আরাধ্য কাঁদে। প্রচুর কাঁদে। হাহাকার করে প্রিয়তমার শোকে। লুকানো সমস্ত দুঃখ বিলীন করে এই নির্জন বিশালাকায় বিস্তৃত পাহাড়ের কাছে।
#সমাপ্ত।