গোধূলি রাঙা দিগন্ত পর্ব-০১

0
710

#গোধূলি_রাঙা_দিগন্ত
#পর্বঃ১
#লেখিকাঃফারিহা_খান_নোরা

বিয়ের ভরা আসরে হবু ব‌উয়ের ব্যাগ থেকে এনগেজমেন্টের রিং এর সঙ্গে প্রেগন্যান্সি কিট বেরিয়ে আসায় অনুষ্ঠানের উপস্থিত সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় রূপার দিকে।রূপা সবার দিকে এক পলক তাকিয়ে পড়ে যাওয়া জিনিস গুলো তুলে নিয়ে‌ ব্যাগ থেকে রির্পোট বের করে তার বড় বোনের স্বামীর হাতে তুলে দেয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই যেন হতবাক।একের পর এক চমক পেলে এমন হতবাক সবারই হবার কথা।

আজ খালাতো ভাই প্রণয় শেখের সাথে রূপার বিয়ে ছিলো।রূপা কিনা বিয়ের আসরে সবার সামনে তার দুলাভাইয়ের দিকে প্রেগন্যান্সি কিট এগিয়ে দেয়।রূপার দুলাভাই নাবিল মাথা নিচু করে ফেলে। রূপার বাবা রাশেদ সাহেব নাবিলের থেকে রির্পোট নিয়ে খুলে স্তব্ধ হয়ে বসে পড়ে। নাবিলের দিকে তাকিয়ে আক্রোশের সহিত বলে,

‘আমার বড় মেয়ে রুনা মা’রা গেছে তিন মাস‌ও হয় নি। আমার ছোট মেয়ে রূপা দুই মাসের প্রেগন্যান্ট! এই রিপোর্ট এ অভিভাবক এর জায়গায় তোমার নাম দেওয়া তাও স্বামী হিসাবে।এসবের মানে কি?তোমাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম সেজন্য বড় মেয়ে মা’রা যাবার পরেও তোমার অগাধ যাতায়াত ছিলো আমার বাড়িতে।সেই তুমি আমার বিশ্বাসের এই মূল্য দিলে?’

রাশেদ সাহেব রূপার দিকে এগিয়ে যেয়ে গায়ের জোরে দুইটা থা’প্প’ড় লাগিয়ে দেয়।তার ভাবতেও ঘৃ’ণা হচ্ছে যে,তার মেয়ে কিনা এতো গুলো মানুষের সামনে তার‌’ই সম্মান নিয়ে এভাবে খেলবে। ইতিমধ্যে অনুষ্ঠানের সবাই কা’না’ঘু’ষা শুরু করে দিয়েছে।রূপার হবু বর প্রণয় শেখ এক নজরে সামনে তাকিয়ে আছে কি হচ্ছে সব যেনো তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।এদিকে প্রণয়ের বাবা আরমান শেখ এমন পরিস্থিতিতে কি করবে বুঝতে পারছে না।স্ত্রী নাসিমার ছোট বোন নাসরিন এর দুই মেয়ে রুনা ও রূপা। পাঁচ বছর আগে নাসরিন গত হয়েছে।সন্তান জন্ম দিতে যেয়ে তিন মাস আগে বড় মেয়ে রুনা ও তার অনাগত সন্তান পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে।ফলে রূপা ও তার বাবা একা হয়ে যায় ।সেজন্য আদরের মৃ’ত বোনের একমাত্র ছোট মেয়েকে কাছে রাখতে নাসিমা তার বড় ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেন।রূপার সাথে প্রণয়ের বেশ ভালো সখ্যতা ছিলো।ছেলেকে বিয়ে করিয়ে ব‌উ নিয়ে যাবার কথা ছিলো।স্ত্রীর জোরাজুরিতে এই সম্পর্ক নয়তো এই মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ের কথা তিনি ভুলেও ভাবতেন না।রূপাকে তার আগে থেকেই পছন্দ না।তার মতে রূপা একটি অ’হং’কা’রী ও ওভার স্মার্ট মেয়ে।এতো গুলো মানুষের সামনে এখন মাথা কাটা যাওয়ার মতো অবস্থা তার।এক এক করে বিয়ে আসর থেকে সবাই চলে যেতে শুরু করেছে।আরমান সাহেব যে করেই হোক আজ ছেলের ব‌উ ঘরে নিয়ে যাবেন মানে যাবেন’ই।ব‌উ নিতে এসে এভাবে খালি হাতে ফিরবে না।এই মেয়ে না হোক অন্য মেয়ে খুঁজবে তবুও এই আসরেই ছেলের বিয়ে দিবেই।এমন ন’ষ্ট মেয়ে তার ছেলের ঘাড় থেকে নেমেছে আল্লাহ এর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া।বিয়ের পর এসব ঘটলে কি হতো।না আর ভাবতে পারছে না।

রূপার বাবা এগিয়ে আসেন।আপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করেন।আরমান শেখের দিকে দুই হাত জোড় করে অপরাধীর সুরে বলে,

‘ভাই সাহেব আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি সন্তানকে ঠিক ভাবে মানুষ করতে পারি নি ,মা ম’রা দুই মেয়ে।বেশি আদর দিয়ে মাথায় তুলেছি। বুঝতে পারি নি এই দিন দেখতে হবে। আমার জন্য আপনার মাথা নিছু হলো।পারলে ক্ষমা করবেন।’

আরমান শেখ মাথা তুলে তাকলেন।রাশের সাহেবের হাতের উপর হাত দিয়ে আস্বস্ত করলেন।এর থেকে বেশি কিই বা করতে পারতেন।রাশেদ সাহেব সত্যিই অত্যান্ত ভদ্র মানুষ। স্ত্রীর মৃ’ত্যু’র পর বেচারা একা হাতে সব কিছু সামলিয়েছেন।এমনকি নতুন করে বিয়ে অবধি করেন নি।পিছে সন্তান গুলোকে যদি নতুন ব‌উ দেখতে না পারে সেই ভয়ে।

প্রণয় যখন আসল ঘনটা বুঝতে পারলো তখন থেকে রা’গে ফুঁ’স’তে ফুঁ’স’তে বাবার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে।কখনো তাকে কারো কাছে এতোটা অপমানিত হতে হয় নি যতটা আজ হতে হয়েছে।রূপা তার সাথে ভালোবাসার নামে ছলনা করে তার‌’ই দুলাভাইয়ের সঙ্গে অ’বৈ’ধ সম্পর্কে জড়িয়েছে।এভাবে তাকে ঠকালো?বিয়ের নাম করে বাড়িসহ আত্মীয় স্বজদের সামনে বিয়ে করতে নিয়ে এসে এভাবে ধোঁ’কা দিলো? নাবিলের সাথে তার যখন এতোই গভীর সম্পর্ক আগেই বলতো।এভাবে তার সাথে ছলনা না করলেও পারত!
___________________________

আরমান শেখের মাথা নিচু হয়ে গেছে সবার সামনে।তার স্ত্রীকে এতো বার নিষেধ করা শর্তেও তিনি তার কথা শুনেন নি।তার স্ত্রীর সাথে অবশ্য প্রণয়ের ও মত ছিলো।তারজন্য মা ছেলের সাথে গত সাতদিনে তার মনমালিন্য চলছে।আজ ছেলের জীবণে অত্যন্ত খুশির দিন বলে নিজের ইচ্ছাকে বির্সজন দিয়ে এসেছে। এসব ভাবতেই আরমান সাহেবের বুকের বাম পাশে চিনচিন ব্যাথা করে উঠে।তিনি তার বাম হাতটি বুকে চেপে ধরলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরমান সাহেবের ম্যানেজার তাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেন।প্রণয় সহ বাকি সব কাছের আত্মীয় গুলো ছুটে আসেন।আরমান শেখ’কে তড়িঘড়ি করে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলে তিনি খেয়ে কিছুটা স্বাভাবিক বোধ করে।

কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে আরমান শেখ তার ম্যানেজার হাসান এর উদ্দেশ্যে বলেন,

‘হাসান সাহেব কি ভাবে যে কথাটা বলি,আপনি আমাদের পরিবার, আমায় ও আমার ছেলে সম্পর্কে সব কিছুই জানেন ‌।আজ আমি আপনার কাছে একটা আবদার নিয়ে এসেছি প্লীজ না করবেন না।’

অফিসের বস এমন হাত ধরায় হাসান সাহেব একটু অবাক হয়ে যায়।কারণ তার মত সামান্য কর্মচারীর কাছে কিসের আবদার করবে আরমান শেখ তাও আবার হাত জোড় করে।তিনি ধীরে ধীরে হাতটি ছাড়িয়ে নেন।মাথা নিচু করে কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,

‘স্যার এভাবে বলতে হবে না। আমার সাধ্যের মধ্যে হলে আমি অবশ্যই আপনার আবদার রাখবো।আপনি বিনা সংকোচে বলুন।’

আরমান সাহেব এবার যেনো খুশি হলেন।তার কন্ঠে প্রফুল্লতা বিরাজ করছে।বললেন,

‘হাসান সাহেব,আমার ছেলে প্রণয়ের জন্য আমি আপনার ছোট মেয়ে আরিবার হাত চাইছি প্লীজ না করবেন না।এমনিতেও আজ সবার সামনে আমার সম্মান ধূলায় মিশে গেছে।এখন সেই সম্মান আপনার হাতে।’

আরমান শেখের কথায় হাসান সাহেবের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়।প্রণয়কে তিনি ব্যাক্তিগত ভাবে পছন্দ করেন তবে রূপা নামের মেয়েটার সাথে প্রণয়ের আগে থেকে ঘ’নি’ষ্ঠ’তা ছিলো তা জানা শর্তেও কি করে তার আদরের ছোট মেয়েকে এমন একটা ছেলের হাতে তুলে দিবেন।তিনি ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে কম্পনরত কন্ঠে বলেন,

‘স্যার‌ প্রণয় বাবাকে আমার পছন্দ কিন্তু আমার মেয়েটা এখনো ছোট সবে মাত্র অর্নাস ফার্স্ট ইয়ারে পড়াশোনা করছে আর বড় মেয়েকে এখনো শশুড়বাড়ি তুলে দেই নি,তার আগেই কিভাবে ছোট মেয়েকে বিয়ে দেই বলেন?’

আরমান শেখ এবার আত্মবিশ্বাসীর সুরে বলে,

‘তোমার মেয়ে মানে আমার মেয়ে।আমি তোমার কাছে আমার ছেলের ব‌উ না,মেয়ে চাইছি। তোমার আরিবাকে আমায় দেও আরশির দিকটা আমি দেখছি।বাকিটা এখন তোমার উপর নির্ভর করছে।’

প্রণয় জেনো এতোক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে সবকিছু দেখছিলো।আরমান শেখ আর কোনো কথা বলতে না দিয়ে প্রণয় ও তার চাচা মিলে কাজিসহ হাসান সাহেবের বাড়িতে যান।

_______________________

মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আরিবা।দেখতে সুন্দর গায়ের রঙ ফর্সা,হাসলে জেনো তার হাঁসির মায়ায় সবাই পড়ে।এখন রাত আটটা বাজে আরিবা বসে গান শুনছিলো হঠাৎ করে তার মা রেবা খাতুন ও বড় বোন আরশি হন্তদন্ত হয়ে রুমে এসে বলে,

‘আরিবা এখন সময় নেই উঠে পড়।আর আরশি তুই আরিবাকে রেডি করে দে।হাতে থাকা লাল জামদানি শাড়িটা আরশিকে দিয়েই বেরিয়ে গেলেন উনি।’

আরিবা অবাক হয়ে আরশিকে বলল,

‘কি হয়েছে আপু, রাত বিরাতে এসবের মানে কি? আমি শাড়ি পড়বো কেন?’

আরশি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো।বলল,

‘বোন তুই চলে গেলে কিভাবে থাকবো আমি?’

বলেই আরশি কেঁদে দিলো।আর আরিবাকে শাড়ি পাড়াতে শুরু করলো।শাড়িট সুন্দর করে পড়িয়ে দিয়ে আরিবার কোমড় ছড়ানো চুল গুলো খোঁপা করে তাতে আর্টিফেসিয়াল জুঁই ফুলের গাজরা দিয়ে দেয়।চোখে গাড় কাজল ও ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক।সাজানোর মধ্যে আরিবা আরশিকে হাজারটা প্রশ্ন করে।আরশি তখন‌ও চুপ করে ছিলো।

এরমধ্যে তার বাবা হাসান সাহেব আসলেন রুমে।ছল ছল চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন।আরিবার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

‘মা আমার,বাবা যা করি তোমার ভালোর জন্য। তুমি আমায় ভুল বুঝো না। দোয়া করি তুমি সব সময় ভালো থাকবে।’

আরিবা এবার অবাক হয়ে যায়।তার মে’জা’জ খা’রা’প হতে শুরু করে।বাবাকে বলে,

‘তোমরা কি শুরু করলে বলো তো? একবার মা এসে এসব করছে।একবার আরশি আপু কান্না করছে এখন আবার তুমি এসে এসব বলছো।তোমরা কি করছো আমি বুঝতে পারছি না।দয়াকরে আমায় সবকিছু খুলে বলো।’

এবার বাবার মুখ থেকে আরিবা অপ্রত্যাশিত একটি বাক্য টি শুনতে পেলো।

‘আজ তোমার বিয়ে…….!’

।চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে