#গৃহযুদ্ধ পর্ব ১০
________________
জানোয়ার ছেলেগুলোকে কেউ খুন করে ফেলে রেখেছে,
শুনেই সুপ্তির কান্না থেমে গেলো। প্রশান্তির একটা আভাস সুপ্তির কালি পড়ে যাওয়া চোখে খেলা করে বেড়াচ্ছে। রেশমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়৷ ওয়েটার কফি দিয়ে যাওয়ার পরে, রেশমি ও সুপ্তি কফি হাতে নিয়ে ক্যাফের বাইরে বের হয়ে আসে।দুজনেই এরপর প্রচুর ঘোরাঘুরি করে, কেনাকাটা করে,ছবি তোলে।
দু বান্ধবী-ই যেনো একলাফে চলে যায় তাদের কলেজের ফেলে আসা দিনগুলোতে। দুজনের জীবনে ঘটে যাওয়া বড় বড় দুটো দুর্ঘটনার কথা মন থেকে কিছুক্ষনের জন্য একদম ই দূরীভূত হয়ে যায়।
দিনশেষে কয়েক বস্তা জামাকাপড়, কসমেটিকস, জুতা এবং সাজসজ্জার প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনে বেশ ক্ষুধার্ত অবস্থায় তারা প্রবেশ করে একটি পাঁচ তারকা রেস্তোরাঁয়।
ম্যানু হাতে নিয়ে রেশমি বিভিন্ন রিচ ফুড এবং ড্রিংকস অর্ডার করে।
ওয়েটার খাবার দিয়ে যাওয়ার পরপর ই রেশমি গো-গ্রাসে একপাশ থেকে খাওয়া শুরু করে দেয়। কিন্তু সুপ্তি কোন খাবার হাত দিয়ে স্পর্শ পর্যন্ত করে না। বরং উদাস মনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে।
বিষয়টা কিছুক্ষন পরে খেয়াল করে রেশমি।
জিজ্ঞেস করে,
– কিরে খাবার না খেয়ে বাইরে তাকিয়ে আছিস কেনো?
– খেতে ইচ্ছে করছে না।
– কেনো কি সমস্যা?
– রিলশনে যাওয়ার পর থেকেই আমি রোহানকে ছাড়া কখনো কোন রেস্তোরাঁয় খাইনি। ও নিজেও আমাকে ছাড়া কখনো একা একা ভালোমন্দ কিছু খায়না। রোহানের কথা খুব বেশি মনে পড়ছে আমার। না জানি ছেলেটা কত দুশ্চিন্তায় আছে! না খেয়ে মনে হয় একদম শুকিয়েই গেছে। আর যা-ই বলিস আমি ওকে রেখে এখানে বসে ভুড়ি-ভোজ করব সেটা কি করে হয়!
রেশমি খাওয়া থামিয়ে কিছুক্ষন চিন্তা করলো। বললো, একটা চিরকুটে ওর জন্য কিছু একটা লিখে দিস। আমি চিরকুট আর খাবার ওর বাসায় পাঠানোর ব্যবস্থা করবো৷ এবার প্লিজ খেয়ে নে।
রেশমি সেদিম রোহানের বলা জঘন্য কথা গুলো সুপ্তির কাছে গোপন করে। সুপ্তির এমন মানসিক অবস্থায় রেশমি চাচ্ছে না আবার কোনো ভাবে ও নতুন করে মনে আঘাত পাক।
রেশমি মনে মনে রোহানকে প্রচুর গালি দিতে থাকে। যে মেয়েটা রোহানকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, সে কিভাবে পারলো সুপ্তিকে নিয়ে এতটা জঘন্য কথা বলতে!!
ধর্ষণ তো সুপ্তির দেহকে করা হয়েছে। ওর মন টা তো আর ধর্ষিত হয়নি!
যে ছেলেরা যে মেয়েরা নিজ ইচ্ছায় তার পার্টনার কে ঠকায়, খারাপ তো তারা।
চার দেয়ালের মাঝে বন্দী থাকা কোনো মেয়ে যদি তার স্বামীকে ভালো না বেসে সব সময় অন্য ছেলেদের নিয়ে চিন্তা করে, তাহলে তাদের উপর অরুচি আসতে পারে।কিন্তু কোন ধর্ষিত মেয়ের নিষ্পাপ, গভীর ভালোবাসার প্রতি অরুচি কোন যুক্তিতে আসে?
এক মুহুর্তের জন্য রেশমির ইচ্ছে করছিলো,
রোহান এবং রফিক দুটাকেই একটা বস্তার ভেতরে ঢুকিয়ে বস্তার মুখ বেধে উপর থেকে বাঁশ দিয়ে বেধড়ক পেটাতে কিংবা শিল পাটায় ব্যবহৃত পুঁতা দিয়ে ওদের থেতলে ভর্তা করে দিতে।
বিমর্ষ মনে হালকা কিছু খাবার খায় সুপ্তি। রেশমিরও খাবারের প্রতি অরুচি চলে আসে। বেঁচে যাওয়া খাবারগুলো ফেলে না রেখে পার্সেল করে নিয়ে দুজনে বের হয়ে যায় রেস্তোরা থেকে।
ব্যক্তিগত গাড়িতে ‘চলা- ফেরা করার সময়ে যখন সিগন্যালে অপেক্ষা করতে হয়, তখন প্রায়শই অতি অল্প বয়সী কিছু বাচ্চারা ফুল কিংবা নকশি রুমাল সহ বিভিন্ন ছোট খাটো পন্য নিয়ে গাড়ির জানালায় নক করে।
ওগুলো বিক্রি করেই চলে ওদের কণ্টকাকীর্ণ জীবন। রেশমির গাড়ির কাছেও সেদিন একটা ফুটফুটে ছোট্ট মেয়ে ফুল বিক্রি করতে আসে, একটা ফুল নিয়ে বিনিময়ে মেয়েটার হাতে খাবারের পার্সেল আর কিছু টাকা তুলে দেয় রেশমি।
দুপাশে চুল বেনী করা মেয়েটি খুশিতে নাচতে নাচতে ওদের গাড়ি থেকে সামনের দিকে চলে যায়।
যাওয়ার পথে সে সবাইকে তার ঝুড়ি থেকে একটা করে ফুল দিতে থাকে আর চিৎকার করে বলতে থাকে, ট্যাকা লাগবোনা। এমনি ই দিছি।
রেশমির বা হাত চেপে ধরে সুপ্তি।
ওর কানের কাছে গিয়ে বলে,
জানিস রেশমি আমার অনেক শখ ছিলো আমার খুব ফুটফুটে একটা মেয়ে বাবু হবে। আমি আর আমার রাজকুমারী একই রকম ড্রেস পড়ে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াবো।
কথাটি বলেই খিলখিল করে হাসতে থাকে সুপ্তি।
পরক্ষনেই ওর চেহারায় নেমে আসে কালো মেঘের অন্ধকার।
নিজে নিজেই বলে,
কিন্তু আমার মত পোড়া-কপালির ভাগ্যে, সংসার ই নেই! আবার বাচ্চা!
রেশমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
হঠাৎ আকাশ ভেংগে বৃষ্টি শুরু হয়।
গাড়ির জানালার কাঁচ বেয়ে বৃষ্টির ভাড়ী ফোঁটা গড়িয়ে পড়তে থাকে। জানালার কাঁচের ওপাশে দু’হাত রেখে গড়িয়ে পড়া পানির ফোঁটার দিকে একমনে চেয়ে থাকে সুপ্তি।গাড়ির চাকাগুলো কাঁদাপানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে সামনের দিকে।
আহা! এটাইতো জীবন। কোথাও কোথাও মন থমকে দাঁড়ালেও দেহটাকে জীবনযুদ্ধে নামিয়ে দিয়ে এগিয়ে নিতে হয় ক্রমশই দূর থেকে বহুদূরে।
.
.
.
বাথরুমে ঝর্ণা ছেড়ে দিয়ে বেশ অনেক্ষন ধরে ভিজে চলেছে রোহান।
আজ ফুলীর সামনে কাটা দাগটা উন্মুক্ত হয়েই পড়লো! একটু সাবধানে চলতে হবে তাকে।জলীয়বাষ্পে আবছা হয়ে যাওয়া আয়নাটা হাত দিয়ে ডলে পরিষ্কার করে সে।
শুধু হাতে নয়৷ বুকে, পেটেও অসংখ্যা আচড় এবং কাটাছেঁড়ার দাগ।এটা নিয়ে অবশ্য বেশি একটা চিন্তা নেই তার।
যে ছয়জন মারা গেছে তারা আগে থেকেই ক্রিমিনাল হিসেবে প্রশাসনের ধুলোপড়া খাতায় কালো তালিকাভুক্ত হয়ে ছিলো। ওদের এমন মৃত্যু নিয়ে কারো কিছু আসবে যাবে না।
পুলিশি ইনভেস্টিগেশন ও তেমন বেশি হবে না। এসব ভেবে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের চেহারা দেখে রোহান ডেভিলের মত হা হা হা করে হাসতে থাকে।
কোন এক অজানা নেশা তাকে পেয়ে বসেছে। হিংস্রতার নেশা।
.
.
.
.
মণিকা ভাবীর স্বাস্থ্য দ্রুত উন্নতির দিকে চলে এসেছে।
তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হয়েছে।
বাসায় ফেরার পর পর ই সে যখন রোহানকে দেখলো একটা মিষ্টি হাসি দিলো।
রোহান বলল, “আরে বাহ আপনার হাসি দেখে তো মনেই হচ্ছে না! আপনি মারাত্মক একটা এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন এতদিন।”
মণিকা ভাবী কাঁপা গলায় উত্তর দেয়, আমার যত দুঃখ ব্যাথা তোমার মুখদর্শনে দূরীভূত হয়ে গেলো।
রোহান মণিকা ভাবীর কথা শুনে হাসে।
যতটা না মুখে হাসে, তার থেকেও বেশি হাসে মনে।
” আপনার রান্নাটা অনেক মিস করেছি ভাবি। ভাবছি আপনি কবে পুরোপুরি সুস্থ হবেন! আর পেট পুরে আপনার রান্না খাবো!”
কথাটা বলার পরেই রোহান স্পষ্ট মণিকা ভাবীর চোখে উচ্ছাস উথলে পড়তে দেখলো!
মণিকা ভাবী বললো! আচ্ছা ঠিকাছে, খাওয়াবো তোমাকে। আগে দেহটা একটু শক্তপোক্ত হোক!
রোহান মণিকা ভাবীর কথা শুনে মনে মনে বলে,
” ঘুঘু দেখেছ এতদিন, এবার ঘুঘুর ফাঁদটাও দেখবে।”
.
.
.
বেশ বিগড়ে আছে রফিক সাহেবের মাথা। এতদিন এতটা বছর ধরে তিলে তিলে জমানো টাকাপয়সা সবকিছু হারিয়ে আজ পথের ফকির সে। কি ভুল করেই যে সে কাজটা করেছিলো! সম্পত্তির সবকিছুই উইল করে দিয়েছে তার স্ত্রীর নামে। অথচ রেশমি ছিলো মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন সাধারণ মেয়ে। তবে স্ত্রী হিসেবে খুবই বিশ্বস্ত একজন। রফিক সাহেব বিয়ের আগে ও পড়ে যতদিন ধরে মিশেছেন রেশমির সাথে৷ ফান করেও রেশমিকে কখনো মিথ্যা কথা বলতে দেখেন নি। অগাধ বিশ্বাস ছিলো ওর উপরে কিন্তু শেষের দিকে এসে এমন একটা সিচুয়েশন তৈরি হবে সে নিজেও বুঝেনি।
দুঃখের কথা সবটাই রফিক সাহেব তার বন্ধু কাব্যর সাথে শেয়ার করেন।
কাব্যর সাথে পরিচয় বিজনেসের লেনদেনের মাধ্যমে। এই লোকের চিকন বুদ্ধি বেশি। ব্যবসা বানিজ্য ও তাই ফুলে ফেঁপে উঠেছে অতি অল্প সময়েই।
রফিক সাহেবের মনে একটা আস্থা ছিলো,
ওর কাছে গেলে কোনো না কোনো উপায় ঠিক ই পাওয়া যাবে।
কিন্তু সব ঘটনা কাব্য সাহেবের সাথে শেয়ার করার পরে, সে শুনালো উল্টা কথা।
– রফিক, কিছু মনে করোনা বন্ধু! তোমার মত একজন রেপিস্ট এর থেকে ভালো কিছু ডিজার্ভ করেনা।
– আমাকে রেপিস্ট বললে কেনো! ঐ পর্যন্ত তো যেতে পারিনি। তার আগেই..
– তোমার মন কাউকে রেপ করতে চাইছে মানেই তুমি রেপিস্ট। তুমি আমার অফিসে কি করছো!!
তোমার তো জেলে থাকার কথা। নেহাৎ তোমার স্ত্রী তোমাকে ভালোবাসে তাই ধরে পুলিশে দিয়ে দেয়নি।
– দেখো ভাই, কন্ট্রোল ছিলোনা।
বিয়ের সময় রেশমির ফিগার ছিলো অন্যরকম, মেদহীন পেট, কামুক নাভী! সিমসাম গড়নের। বিয়ের কয়েকবছর পরেই গেলো হুট করে মোটা হয়ে। ইউ নো হট? মোটা মেয়েদের সাথে ফিজিকাল রিলেশন করে কোন রকম ইনজয় ই করা যায়না।
– তাই বলে বৌ এর বান্ধবীর দিকে নজর যাবে? ছিহ, রফিক! তোমার তো লজ্জায় মরে যাওয়া উচিৎ। তুমি সুইসাইড করো গিয়ে। আমি বরং ভাবির সাথে গিয়ে নতুন কোন বিজনেসের ব্যাপারে ডিল করি। তাতেই আমার লাভ।
– লাভ? লাভ খুজছো তুমি? আমাকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করো। আমার বিজনেসের কোয়ার্টার ভাগ তোমাকে দিয়ে দিবো পাক্কা!!
– নড়েচড়ে বসে কাব্য। গলা চাপিয়ে বলে,
মরে টরে গেলে কোন সমস্যা আছে?
– কে?
– যার নামে তোমার সব সম্পত্তি, সে।
– কি বলো?
– হুম। ওকে সরিয়ে দিলেই তো সবকিছু আবার তোমার হয়ে যাবে। এই একটা উপায় ই আছে।
– দেখো ওকে আমি অনেক ভালোবাসি। তবে এখন আমার কাছে আমার সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ।
তোমার যেটা ভালো মনে হয়, করো।
– বেশ। তবে রেশমিকে সরিয়ে দেই। আর সাথে ঐ ঝামেলা সুপ্তিকেও বা রাখবে কেনো! ওটাকেও খতম করে দেয়া ভালো হবে।
– কি বলো! দুটা মার্ডার! যদি ধরা পড়ে যাই!
– ধুর বোকা মার্ডার আমরা করবো নাকি! আমরা টাকা দিবো, ভাড়াটে খুনীদের। ওরা কাজ সম্পন্ন করবে। কিভাবে কি করবে ওদের ব্যপার। আমরা তো শুধু পরদিন নিউজপেপারে শোক সংবাদ পাঠ করবো!!
এতক্ষনে চোখেমুখে হাসি ফোটে রফিক সাহেবের।
কাব্য চোখের ভ্রু কুঁচকিয়ে রফিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে,
শোনো রফিক,
তুমি তো তোমার স্ত্রী কে মেরেই ফেলতে চাইছো। তোমার যদি আপত্তি না থাকে তবে দুটোকেই তুলে আনি আগে।
ভোগ উপভোগের হিসেব চুকিয়ে তারপর না হয় খালাস করলাম!!
– চলবে….
লেখকঃ হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ