গানের ওপারে তুমি পর্ব-০৫

0
350

“গানের ওপারে তুমি”
পর্ব- ৫
(নূর নাফিসা)
.
.
মিহির মাকে মতামত দেওয়ার দুদিন পরেই বাজারের ছোট রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলো ড্রাইভারের সাথে। সরু পথ আবার লোকেদের চলাচলের আধিক্য হওয়ায় এমনিতেই গাড়ির গতিবেগ ধীর রাখা হয়েছিলো। এরইমধ্যে একটা বিড়াল ছানা লাফিয়ে এসে যেন গাড়ির সামনে পড়লো। সাথে সাথেই এক চিৎকার ভেসে এলো মেয়েলি কণ্ঠের! গাড়িও থেমে গেলো। মিহির বামে তাকিয়ে দেখলো গেইটের সামনে মুখে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে রিপ্তি মেয়েটা। সে-ই চিৎকার করে উঠেছিলো ভয়ে৷ ভয়ের সন্দিগ্ধ কারণে নিশ্চিত হতে ওদিকে ব্যস্ত হয়ে নেমে পড়লো তারিকুল ভাই। পরক্ষণে মিহিরও নেমে দাঁড়িয়ে দেখলো বিড়াল ছানার অর্ধাঙ্গ গাড়ির চাকার নিচে চাপা পড়ে আছে! তারিকুল ভাই ছানাটিকে হাতে নিয়ে দেখলো তার প্রাণ নাশ ঘটে গেছে। মাথা গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। একটা পা ছেঁচে গেছে। মিহির দ্বিতীয়বারের মতো রিপ্তির দিকে তাকাতেই দেখলো তারিকুল ভাইয়ের হাতের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটো অশান্ত স্রোতে ছলছল করছে। মুখ থেকে নির্লিপ্ত হাত দুটোও নেমে গেলো অতি শান্ত গতিতে। কেবল একটা পশুই নয়, একটা জীবন্ত শখেরও যেন হত্যাকাণ্ড ঘটলো মুহুর্তটায়। সেই চোখের স্রোতে এক দলা অভিমান ও অনুচ্চ অভিযোগের পাল তুলে সে দৃষ্টি ফেরালো মিহিরের দিকে। উত্তপ্ত প্রখর দৃষ্টিটুকু একটা মুহুর্তের জন্য মিহিরের চোখে স্থির করেই সে ছুটে গেলো বাড়ির ভেতর। মিহিরকে অনুশোচনা প্রকাশের সুযোগটুকু দেওয়া হলো না যেন। সে আপন মনে অপরাধী দৃষ্টিটুকু ফেলে রাখলো কিছুক্ষণ ওই ছুটে যাওয়ার পথে। বুঝতে বাকি নেই, এটা মেয়েটির পোষা বিড়াল ছিলো। কিন্তু এ কি হলো! অবেলায় কারো শখের ঘাতক হয়ে গেলো? কি করবে, তা নিয়ে মিহির জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লো। ওই ছলছল চোখদুটো যেন তাকে তীব্র নিন্দা জানিয়ে গেলো। ক্ষমা চাওয়ার শক্তিটুকু মনে জাগ্রত হতে পারলো না নিন্দাচ্ছল দৃষ্টির কারণে। তারিকুল ভাই নিজেও অপরাধ বোধ করে মৃত ছানাটি ময়লায় ফেলে দিয়ে এলেন। এক টুকরো আফসোস পুষে পুনরায় গাড়িতে উঠলেন। তারই বা দোষ কি? গতি কম রেখে অতি সাবধানেই তো গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলো। নিয়তি মন্দা হলে কর্মে আর অভিযোগ কিসে? হতাশা নিয়ে মিহির নিজেও গাড়িতে উঠে বসেছে। তারিকুল ভাই জিজ্ঞেস করে,
“আমি তো ইচ্ছে করে দুর্ঘটনা ঘটাইনি, মিহির। দেখলামই না কোন দিকে হঠাৎ ছুটে এসেছে।”
মলিনতার নিশ্বাস ছেলে মিহির বলে,
“বাদ দাও। বাসায় চলো।”
একটু নিরবতায় থেকে পরক্ষণেই আবার বলে,
“তারিকুল ভাই, একটা বিড়াল ছানা ধরে মেয়েটাকে দিয়ে এলে হয় না?”
“যেটা গেছে, সেটা তো আর পাওয়া হবে না। তবে তুমি বললে ধরে এনে দিতে পারি দুয়েকটা। বাড়ির আনাচে-কানাচেতেই না কত ঘুরে বেড়ায়।”
“দিয়ো একটা।”
সন্ধ্যার পরেই তারিকুল ভাই এক বিড়াল ছানা নিয়ে হাজির হয়েছে দুয়ারে। মিহির দরজা খুলতেই তিনি ছানাটি সামনে ধরে বলেন,
“ধরে ফেলেছি একটা। আমাদের ঘরে অতিরিক্ত জ্বালায়। ভাবলাম এর একটা বিহিত হয়ে যাক এবার।”
মিহির খুশি হলো না মোটেও। একে তো বিড়ালের রঙ কালো কুচকুচে। আবারও নাকি জ্বালাময়ী! একে দেখলে আদর নিগড়িত হবে তো দূর, উল্টো ভয় পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অথচ সেই ছানাটা দেখতে কি সুন্দর ছিলো। দেহের অধিকাংশ রঙ সাদা ধবধবে, মাথা ও পিঠের দিকে কিঞ্চিৎ কালো ছিলো সম্ভবত। অন্যথায় দেখতে মায়াবী লাগছিল মৃত ছানাকেই। এটা দেখলো হিংস্র এবং নোংরাই মনে হচ্ছে। ঘিনঘিন ভাব এসে গেছ যেন মিহিরেরই। তাই বললো,
“তোমার বাসায় যে জ্বালাতন করে, অন্যের বাসায় গিয়ে কি শান্তি বিনিময় করবে সে? ওটা কি সুন্দর ছিলো, আর এটা কি ধরে এনেছো তুমি?”
“কেন, ভালোই তো। এক রঙা।”
“লাগবে না। ছেড়ে দাও এটা।”
“সাদা থেকে ধরে আনবো একটা? সাইজে আরও বড় হবে।”
“লাগবেই না। বাদ দাও।”
“ঠিক আছে।”
তারিকুল ফিরে গেলো বিড়াল ছানা নিয়ে। মিহির নিশ্বাসে মলিনতা ঝেড়ে রিপ্তিকে বিড়াল ফেরানোর ব্যাপারে ভাবা বন্ধ করে দিলো। সময় সুযোগে একবার নাহয় ক্ষমা চেয়ে নিবে। এক্সিডেন্ট তো আর ইচ্ছাকৃত ঘটেনি। বেশ কয়েকদিন গেলো, সেই সময় সুযোগ আসেনি। মিহির সুযোগ পেতে মরিয়াও হয়ে উঠেনি। কর্মব্যস্ততায় সেসব ভুলেই গেছে রীতিমতো। এরইমধ্যে দূর সম্পর্কের এক ফুপাতো বোনের সমন্ধ হাজির হলো বাড়িতে। বাবার চাচাতো বোন খুশু ফুপুর মাধ্যমে। উনারই বোনের মেয়ে পাত্রী৷ খুশু ফুপুকে চিনলেও মিহির অবশ্য পাত্রীদের মধ্যে চিনে না কাউকে। খুশু ফুপুকে চেনা আছে পাড়াপড়শি এলাকায় বসবাস বলে। পৈতৃক ভিটায় বাড়ি করে বসবাস করছেন তিনি। ছোট থেকেই আসতে যেতে দেখার সূত্রে চেনা। জিনিয়া তাবাসসুমেরও খুব একটা আসাযাওয়ার পরিচয় নেই পাত্রীর পরিবারে। তবে এমনিতে জানেন, তাদের আত্মীয় হয়। দেখাসাক্ষাতেও চেনাজানা আছে টুকটাক পাত্রীর মাকে। যদিও ছেলেমেয়েদের চেনেন না তিনি। তবে খুশুর মাধ্যমে মেয়ের ছবিও এলো বাড়ি পর্যন্ত। তিনি ঝেঁকে ধরলেন যেন রূপবতী মেয়েটাকে বউ করে ঘরে তুলে আনার জন্য। ভগিনীর মেয়ে সম্পর্কে গুনগানও কম গাইলেন না জিনিয়া তাবাসসুমের সামনে। কিন্তু আত্মীয়ের মধ্যে আত্মীয় গড়তে মিহিরের বড্ড অনীহা। তারা দেখতে যাওয়ার জোর ধরছেন না বলে মেয়েকেই খুশুর বাড়িতে এনে দেখালেন খুশু ফুপু। তিনি মোটেও মিথ্যে বলেননি। মেয়ে অনেক ফরসা, কিন্তু মিহিরের চোখকে আকৃষ্ট করতে পারলো না এই রূপ। অপছন্দ বলেই মায়ের কর্ণধারে বার্তা প্রেরণ করলো মিহির। এতোটাও ফরসা তার ভালো লাগে না। আরও একটা ত্রুটি প্রকাশ হয় জিনিয়া তাবাসসুমের চোখে। মেয়ে খাটো গড়নের। তুলনামূলক আরেকটু লম্বাটে মেয়ে প্রত্যাশা করেন তিনি। ছেলের সাথে ভালো মানিয়ে যায়, এমন। তাছাড়া ছেলে তো বলেই দিলো মেয়ে পছন্দ না। তাই বাদ দিতে হলো সেদিকে এগিয়ে যাওয়া। নানান অজুহাতে খুশুকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টায় কাটিয়ে নিলেন সেদিকে ঝুঁকানোর পথ।
ব্যস্ততার ফাঁকে মিহির একদা অবসর পেয়ে সকালে বাজারের দিকে যাচ্ছিলো আবারও। পথে হঠাৎ রিপ্তির দেখা পাওয়া গেলো। সাথে স্কুল ড্রেস পরনে ছোট ভাইটাও আছে। এই মেয়েটাকে সে ভুলেই গিয়েছিলো একেবারে। একদমই মনে পড়েনি ধমক দেওয়ার কয়েক ঘন্টা পরেও। কিংবা সেদিন এক্সিডেন্ট ঘটানোর পরেও! কিন্তু দেখতেই মনে পড়লো, সেদিন রাস্তায় মেয়েটাকে ধমক দিয়েছিলো সে। মেয়েটা কষ্ট পেয়েছিলো, ডায়েরির কাগজ ছিঁড়ে ফেলেছিলো, হাতে একটা কি যেন নিয়ে এসেছিলো ওটাও মুচড়ে দিয়েছিলো। তাকে অহংকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো মুখের উপর। একটু পাগলাটে আচরণ করেছিলো। এরপর দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পোষা প্রাণীর প্রাণ হনন করলো। মেয়েটা একদমই পাগলামো করলো না এ নিয়ে। নিস্তব্ধ চোখে ঘৃণা নিংড়ে ফেলে নিশ্চুপ ফিরে গেলো যেন ব্যর্থতাকে পায়ের আঙুলের ডগায় গেঁথে। কি ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিলো সেই বিষাদিত চোখের কোটর, যা মুহুর্তেই মিহিরের চোখে ভেসে উঠলো আবার। তারপর আর দেখা হয়নি এ পর্যন্ত। আজকে দেখা হতেই রিপ্তির নজরও তার দিকে পড়েছিলো। দুজন রাস্তার দুপাশে। রিপ্তি আজ আর ছুটে আসেনি একটা অটোগ্রাফ নিতে। মুখভঙ্গিটাও যেন পাল্টে গেলো মিহিরকে দেখা মাত্র। ভ্রুর কোণে ভাজ রেখে একদলা অভিমানের ছাপ ফেলেছে ওই মুখাবয়বে। চোখ সরিয়ে নিয়েছে অন্যদিকে। আজ মনের অবস্থা স্বাভাবিক থাকায় মিহিরের ভাবনাটুকুও সরল গতিতে চলতে লাগলো রিপ্তির প্রতিক্রিয়ার উপর। নিজ পথে হাঁটতে হাঁটতেই মনে পড়লো, এই মেয়েটা একদিন বলেছিলো বাড়ির সামনে আবার দেখা হলে তাকে বাড়িতে টেনে নিয়ে যাবে। মিহির একটু এগিয়ে যাওয়ার পরই ওই বাড়িটার দিকে তাকালো। হ্যাঁ, এই বাড়ির সামনেই তো সেদিন দেখেছিলো। এটাই হয়তো তাদের বাড়ি। কিন্তু আজ টেনে নিতে যে এলো না! মেয়েটার অভিমান তৈরি হয়েছে তার বিপরীতে। সেদিন ধমক দেওয়াটা বোধহয় উচিত হয়নি। নিজের মনখারাপের প্রভাব পড়েছে তার উপর। যদিও একটু বেয়াদবি মেয়েটাও করেছিলো, কিন্তু সে তো কিছুটা অবগত ছিলো তার পূর্বে করা আচরণে। মেয়েটার আচার-আচরণ একটু ভিন্নরকমই। আবেগে আপ্লূত স্বভাবের মেয়ে। ধমক না দিয়েও ইগনোর করা যেতো। পিচ্চি ভক্তটা এখন তাকে দেখে মুখ ফুলিয়ে রাখে, এটা কিছু হলো! ভেবে ভেবে হাসতে গিয়েও যেন হাসা হলো না। শখের বিড়াল ছানাটা শেষ করে দিয়েছে সে! নাকি সেজন্যই এমন মুখ ফিরিয়ে নিলো? কিছু শাকসবজি আর মাছমাংস কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরলো মিহির। পরদিনও অফিসে যাওয়ার তাড়া না থাকায় সকালে নামাজ আদায়ের পর হাঁটতে বেরিয়েছে। এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। মেইন রোডের দিকেই হেঁটেছে তারা। নাস্তার জন্য বাড়ি থেকে মা কল করছিলেন বারবার। সাথের জনকে বিদায় দিয়ে মিহির বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে ছোট রাস্তায় পা রাখতেই ওই রিপ্তি মেয়েটাকে আসতে দেখলো এদিকে। তাই আর অগ্রসর হলো না। যেখানে রিপ্তি গাড়ির জন্য দাঁড়ায়, পিছিয়ে এসে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো মিহির। মেয়েটাকে আজ নাহয় ছোট করে একটা স্যরি বলে নেওয়া যাক। তাকে বিশেষ পছন্দ করে বলেই তো পাগলামি করে। এভাবে কারো মন ভেঙে দেওয়া অনুচিত। স্বাভাবিক মনোভাবে এ পর্যন্ত এলেও তাকে দেখার পরই রিপ্তির মুখভঙ্গি বদলে গেলো আবারও। গোমড়ামুখো হয়ে গেছে মুহুর্তেই। সে নির্দিষ্ট জায়গায় আর এলো না। বড় এবং ছোট রাস্তার সন্ধিস্থলের কর্ণারেই দাঁড়িয়ে আছে। রিপ্তিকে নির্দিষ্ট স্থানে এগোতে না দেখে মিহির সেখানেই এগিয়ে যায়। কাছে থেকে তার মুখভঙ্গি দেখে মৃদু হাসার চেষ্টা করলো। আজকের হাসি একটু অন্যরকম ভালো লাগা থেকে। মেয়েটার অভিমান গড়া মুখটা যেন তার ভালোই লাগলো। ভালো লাগার রেশটুকু ধারণ করেই মিহির জিজ্ঞেস করে,
“অটোগ্রাফ লাগবে?”

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে