#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
গল্প: বিস্মৃতির অন্তরালে পর্ব-১৬
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি
পথিমধ্যে আমাদের আর কোনো কথা হলো না। রাহাত ভাই পুরো রাস্তা চুপচাপ ছিলেন। তারপর বাসার কাছাকাছি আসতেই রিকশা থেকে নেমে গেলাম আমরা। রাহাত ভাই তখন বললেন, ‘স্মৃতি, তুমি একটু দাঁড়াও । আমি আসছি।’
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। আইসক্রিম নিয়ে এসেই বললেন, ‘চলো এবার।’
বাসায় ঢুকতেই কল্প দৌড়ে এসে রাহাত ভাইয়ের কোলে উঠে পড়ল। বলল, ‘পাপা আমার জন্য চক্কেত এনেছ?’
আমি মৃদু হাসলাম। কারণ কল্প সব শব্দই বলতে পারে দুটো শব্দ ছাড়া। চকলেটকে বলে চক্কেত আর সত্যিকে বলে তত্তি।
রাহাত ভাই গল্পকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, ‘আবার চকলেট? প্রিন্সরা তো চকলেট খুব বেশি খায় না! তুমি তো আমাদের প্রিন্স। তাহলে এত চকলেট খাও কেন?’
‘পাপা, প্রিন্সরা চক্কেত খায় তো। তুমি দেখ না টিভিতে কিউট কিউট বাচ্চাগুলো চক্কেত খায় । টিভিতে তো দেখি পাপা।’ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাম্মি পাপাকে বলো তো, প্রিন্সরাও চক্কেত খায়।’
আমি হেসে বললাম, ‘খায় । তবে কম। তুমি কিন্তু বেশি খাও। তোমার দাঁত কিন্তু পোকা খেয়ে ফেলবে! তখন ফোকলা দাঁতে হাসতে হবে। দেখতে একদম ভালো লাগবে না।’
কল্প মুখ কুঁচকে প্রশ্ন করল, ‘আমাকে প্রিন্স চার্মিং বলবে না কেউ তখন?’ ঠোঁট উল্টে আদুরে ভঙ্গিতে আবার বলল, ‘বলো না মাম্মি, আমাকে তখন প্রিন্স হ্যারির মতো চার্মিং লাগবে না?’
আমি কল্পের কথায় একদম চমকে গেলাম। অতীতকে ভুলতে চেয়েও পারি না। বর্তমানও আমাকে আবার টেনে নিয়ে যায় অতীতের গহ্বরে। আর শক্ত শিকল দিয়ে আটকে রাখতে চায়। তারপরেও নিজেকে সামলে নিলাম। আজ অল্প সময়েই নিজেকে সামলাতে পেরেছি। হয়তো ডাক্তার আরমানের কনসাল্টের ফল এটা।
আমি কল্পের কাছে গিয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম,’একদম বলবে না। তখন তো আমাদের প্রিন্সের চার্মই থাকবে না।’
‘তত্তি?’আমার কাঁধ ঝাঁকিয়ে কল্প আবার বলল, ‘মাম্মি তত্তি করে বলো না?’
আমি কল্পের গালে টুক করে একটা চুমু খেয়ে বললাম, ‘সত্যি বলছি তো সোনামণি আমার। একদম সত্যি কথা বলছি। দাদুকে জিজ্ঞেস করো।’
মৌন হাসতে হাসতে বলল, ‘আহারে! কল্প পিচ্চির কত্ত শখ প্রিন্স হ্যারি হবার!’ এটুকু বলেই সে আবার হাসতে লাগল।
কল্প রাগ করে বলল, ‘দাদু ফুফুকে বলো আমাকে এসব না বলতে। আমি কিন্তু রাগ করব!’
খালামণি মৌনতার পিঠে একটা আলতো চাপড় মেরে একটা মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, ‘এই মৌন! তোকে না কতবার বলেছি আমার দাদু ভাইকে নিয়ে হাসাহাসি করবি না।’
মৌন হাসতে হাসতে আবার বলল, ‘একদম ঠিক বলেছি মা। আমি যখন কল্পকে বলি ফুফু ডাকবি না। মৌন ডাকবি। তখন তো ও আরো বেশি করে ফুফু ডাকে। তাই আমি ও ওকে বলব।’
‘দেখেছ দাদু! ফুফু আবারো বলছে।’ কল্প হাত নেড়ে নেড়ে খালামণিকে বিচার দিতে লাগল।
খালামণি আবারো বললেন, ‘এই তো আমার দাদু ভাই ফুফুকে বকে দিয়েছি। আর বলবে না।
এবার কল্প বেশ হাসতে লাগল। আমাকে বলল, ‘মাম্মি দেখ না , মনে হচ্ছে ফুফু এখনি কান্না করে দিবে। হা হা হা।’
রাহাত ভাই বললেন, ‘আচ্ছা চলো আমরা সবাই মিলে এখন আইসক্রিম খাব। পাপা তোমার জন্য আইসক্রিম এনেছি। ভ্যানিলা আইসক্রিম তুমি বেশি পছন্দ করো না?’
‘হ্যাঁ, পাপা । খুব পছন্দ করি। ফুফুকে দেব না। ঠিক আছে পাপা?’
রাহাত ভাই কল্পের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললেন, ‘একদম ঠিক নেই। সবাই একসাথে খাব বলেছি না?’
‘তাহলে ফুফুও খাবে?’ কল্প আদুরে ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল।
‘অবশ্যই । ফুফু না খেলে তোমার খারাপ লাগবে না?’ রাহাত ভাই পাল্টা প্রশ্ন করলেন।
কল্প কপালে একটা আঙ্গুল ঠেকিয়ে কী যেন ভাবল! তারপর বলল, ‘হ্যাঁ, পাপা। খুব খারাপ লাগবে। মাম্মি তো বলেছে একা একা খাবার খেয়ে খাবারের মজা পাওয়া গেলে তৃপ্তি পাওয়া যায় না।’
মৌন হাত জোড় করে প্রজাদের মতো কল্পকে সম্মান দিয়ে বলল, ‘ওহ্! তাহলে প্রিন্স কল্প আমার প্রতি এতক্ষণে সদয় হয়েছেন!
‘স্যরি ফুফু!’ কল্প লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল।
‘আবার ফুফু?’
‘স্যরি, মৌন ফুফু।’
‘যেই সেই ফুফু তো ডাকছিসই!’ মৌন হতাশ কণ্ঠে বলল।
‘তোমাকে ফুফু ডাকে বেশি সুন্দর লাগে। তাই ডাকি।’ হাসতে হাসতে বলল, কল্প ।
মৌন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ঠিক আছে মহাশয় । আপনার যা খুশি আপনি তাই ডাকবেন আমাকে। এটা আমি বুঝে গিয়েছি। এবার অন্ততপক্ষে আমাকে আইসক্রিম খেতে দিন।’
মৌন আর কল্পের কথা শুনে আমরা সবাই হেসে ফেললাম ।
_______________
বিকেলের দিকে বারান্দায় বসে ছিলাম। বারান্দায় বেশ কিছু ফুলের গাছ লাগানো আছে। কিছু গাছ একদম শুকিয়ে মরে যাবার অবস্থা। গাছগুলো মৌন লাগিয়েছে। এখন তার পড়াশুনার চাপ থাকাতে পানি দেয়া হচ্ছে না। আমি নিজেও এখন আর গাছের যত্ন নিই না। বেশকিছু ক্যাকটাস একদম শুকিয়ে গেছে। আমি পানি দেয়ার স্প্রেটাতে পানি ভরে নিয়ে কিছুটা শুকিয়ে যাওয়া গাছগুলোতে স্প্রে করতে লাগলাম।
ফোনের ক্রিং ক্রিং আওয়াজ শুনতে পেয়ে আমি স্প্রেটা গ্রিলে ঝুলিয়ে রেখে রুমে ঢুকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে নাম্বারটা দেখেই চরম অবাক হলাম। আমার হাত কাঁপছে । পুরো শরীরটাই কাঁপতে শুরু করেছে। আমি বাজতে থাকা মোবাইলের স্ক্রিনের নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এক সময় কলটা কেটে গেল। আমি মোবাইল হাতে নিয়ে ধুপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। ভাবছিলাম , কেন কল করেছে এতদিন পর? কেন? আমার খোঁজ নিতে? অবশ্যই না! তাহলে কেন?
আমার ভাবনাকে ছিন্ন করে দিল আবার মোবাইলের ক্রিং ক্রিং আওয়াজটা। একই নাম্বার! আমি কাঁপা কাঁপা হাতে মোবাইলটা রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে এক বিষাদময় কণ্ঠ ভেসে এলো।
‘ইচ্ছে করেই রিসিভ করিসনি এতক্ষণ । তাই না?’
আমি বাকরুদ্ধ । কেন যেন মুখ থেকে আওয়াজ বের করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছে সব আওয়াজ, সব শব্দ, সব আর্তনাদ একসাথে চুক্তি করে পালিয়েছে কোনো এক জনমানবহীন অরণ্যে।
‘কি কথা বলছিস না কেন? ফুফুকে একদম ভুলে গিয়েছিস। তাই না? এখন আর মনে পড়ে না আমাদের ?’ ফুফুর কণ্ঠে স্পষ্ট বিষাদের ছোঁয়া।
আমি এবারও কিছু বলতে পারলাম না।
ফুফু আবার বললেন, ‘জানিস, নেহা সারাদিন তোর কথা বলে। কল্পটার কথা বলতে থাকে। ও দেখতে কেমন হয়েছে তা বলে। একটা অ্যালবামও বানিয়ে ফেলেছে। সেখানে শুধু তোদের ছবি। সেদিন দেখলাম কল্পের ছবি। একদম প্রিন্সের মতো হয়েছে দেখতে।’
আমি কোনোরকমে বললাম, ‘কেন ফোন করেছ ফুফু?’
‘কল্পকে নিয়ে একবার আয় না বাসায় । খুব দেখতে ইচ্ছে করছে আমার দাদু ভাইটাকে।’ ফুফুর কণ্ঠে অনুনয়।
‘আমি চাই না কল্প ও বাসায় যাক। তুমি এসে দেখে যেতে পারো। এতে আমার কোনো আপত্তি থাকবে না।’ আমি কঠিন গলায় বললাম।
‘এখনও রেগে আছিস? এতদিন পরেও? একটু স্বাভাবিক হওয়া যায় না?’ আক্ষেপ যেন ঝরে পড়ছিল ফুফুর কণ্ঠে ।
‘সবকিছু ভুলে যাওয়া এত সহজ নয় ফুফু। তোমরা হয়তো ভুলে গিয়ে সুখে আছ! আমি ভুলতেও পারি না সুখেও থাকতে পারিনা। আমার অতীত আমাকে সব সময় তাড়া করে বেড়ায়।’ আমার দম আটকে যাবার অবস্থা। নিঃশ্বাস বন্ধ করেই যেন কথাগুলো বললাম ফুফুকে। তারপর সাথে সাথেই কলটা কেটে দিলাম।
চলবে…ইন শা আল্লাহ্
আগের পর্বের লিংক:
https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/957945594636160/