গল্প: বিস্মৃতির অন্তরালে পর্ব-১২

0
1014

#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
গল্প: বিস্মৃতির অন্তরালে পর্ব-১২
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি

‘স্মৃতি, কল্প কাঁদছে । তুমি কি শুনতে পাচ্ছ না?’

রাহাত ভাইয়ের গম্ভীর কণ্ঠ শুনে আমি আমার হাতের ডায়েরি বন্ধ করে চোখ মুছে তার দিকে ফিরে তাকালাম। শান্ত চোখ দুটো দিয়ে তাকিয়ে আছে রাহাত ভাই আমার দিকে। আমি প্রত্যুত্তরে কিছুই বললাম না। ছুটে গেলাম কল্পের কাছে।

‘আম্মু, আমাকে তক্কেত দাও। পাপা দিত্তে না।’ আমাকে দেখেই কল্প চোখ কচলাতে কচলাতে কান্নার স্বরে বলল।

আমি কাছে যেতেই কল্প আরও বেশি কান্না জুড়ে দিল। আমি কল্পকে কোলে নিয়ে বললাম, ‘কাঁদে না, আমার সোনামণি। ভালো ছেলেরা একদম কান্না করে না। খারাপ ছেলেরা কান্না করে।’ আমি একটু থেমে কল্পের দিকে খেয়াল করলাম সে রাহাত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর আমি রাহাত ভাইয়ের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘ আচ্ছা বলেন তো আমাদের কল্প কি গুড বয় নাকি ব্যাড বয়?’

কল্প দুহাত নাড়তে নাড়তে হেসে বলল, ‘ আমি মাম্মি’স গুড বয়। পাপা ইজ ব্যাড।’

আমি বললাম, ‘এরকম বলতে নেই কল্প সোনা। পাপা ব্যাড নয় । পাপাও তোমার মতো গুড। না, পাপা শুধু গুড নয় পাপা বেস্ট। তাই তোমার দাঁতগুলো যাতে পোকায় না খায় তার জন্য পাপা তোমাকে চকলেট কম খেতে বলে।’

কল্প আমার দিকে উৎসাহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘তত্তি?’

‘হ্যাঁ, একদম সত্যি।’ আমি হেসে কল্পকে জড়িয়ে ধরলাম। কল্প টুক করে আমার গালে একটা চুমু খেল তারপর রাহাত ভাইকে ডেকে বলল, ‘ পাপা এদিকে আতো।’

রাহাত ভাই আমার আর কল্পের কাছে এলেন। কাছে আসতেই কল্প বলল, ‘আরও কাছে আতো না।’

কাছে আসতেই কল্প রাহাত ভাইয়ের গালেও একটা চুমু খেলো । তারপর হাসতে হাসতে বলল, ‘ পাপা মিত্তি। পাপা মিত্তি মাম্মির মতো।’ এটা বলেই সে হাত তালি দিতে লাগল।

আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম কল্পের হাসিমাখা মুখের দিকে। রাহাত ভাইকে অনেক ভালোবাসে আমার কল্প। আর ভালোবাসবে নাইবা কেন! ছোট থেকেই রাহাত ভাই-ই ওকে দেখেশুনে রেখেছে। ওর সমস্ত খেয়াল রেখেছে।
রাহাত ভাই আমার দিকেই তাকিয়ে আছে তা আমি বেশ বুঝতে পারছি। তার চোখ দুটো খুশিতে চকচক করছিল একটু আগে। যখনই কল্প তাকে কিছু বলে তার চোখে আমি আনন্দের ঝিলিক দেখতে পাই।

‘আমার দাদু ভাই কোথায়? আজকে সারাদিন তো দাদুর কাছে আসলোই না!’

খালামণি হন্তদন্ত হয়ে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। কল্প আমার বুকে মুখ লুকাল। চুপিচুপি বলল, ‘মাম্মি, দাদুকে কিচ্ছু বলবে না।’

খালামণি রাহাত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ এই রাহাত, আমার কল্প সোনা কই?’

রাহাত ভাই বললেন, ‘আমি কী করে বলব আম্মু! দেখ তোমার আদরের কল্প কোথায় লুকিয়ে আছে!’

রাহাত ভাইয়ের কথা শুনেই কল্প খিল খিল করে হেসে উঠল। বলল, ‘ দাদু খুঁজে পায় না। কী মজা! কী মজা!’

এটা বলেই সে আবারও হাততালি দিতে থাকল। খালামণি এসে আমার কোল থেকে কল্পকে নিয়ে গেলেন। আমি এবার আবার আমার রুমে গিয়ে রাহাত ভাইয়ের অফিসের কাপড় চোপড় রেডি করে দিচ্ছিলাম।

‘তোমার কি আমার সাথে কথা বলার সময় হবে?’

আমি অবাক হয়ে তাকালাম রাহাত ভাইয়ের দিকে। বললাম, ‘ কেন হবে না? বলুন কী বলবেন?’

রাহাত ভাইয়ের চোখ দুটো বিষণ্ণ দেখাল। যেন অনেক না বলা কথা জমিয়ে রেখেছেন সেখানে। ধীর পায়ে হেঁটে আমার খুব কাছে এসে দাঁড়ালেন। তারপর আমার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অনুনয়ের স্বরে বললেন, ‘ তুমি কি আমার সাথে একটু স্বাভাবিক হতে পারো না?’

আমি তার হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়াতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমি যত চেষ্টা করি রাহাত ভাই আরো শক্ত করে আমার দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলেন। শেষমেশ আমি হাল ছেড়ে দিলাম। রাহাত ভাই আবার বললেন, ‘ কথা বলছ না কেন, স্মৃতি?’ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলল, ‘কারো জন্য কি কারো জীবন থেমে থাকে? বলো?’

আমার দু’চোখ অশ্রুতে টলমল করছে। চোখের দেয়ালের উপর অথৈ জল গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায় আমি তা বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি কারও সামনে কান্না করতে পারি না। আমি আবার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। আবারও ব্যর্থ হলাম। ম্লান কণ্ঠে বললাম, ‘হাত ছাড়েন।’

রাহাত ভাই আমার হাত আরও শক্ত করে ধরে বললেন, ‘ তুমি আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাও কেন সব সময়?’

‘আমার কাছে আপনার প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।’

‘আর কতদিন এভাবে নিজেকে কষ্ট দিবে বলো? তুমি কি বোঝ না আমিও কষ্ট পাই?’

এবার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু রাহাত ভাই তা নিজের হাতের তালুতে নিয়ে ফেললেন। আমি ধরা গলায় বললাম, ‘ আমি আপনার কাছে ঋণী রাহাত ভাই। কিন্তু আমি চাইলেও পারি না স্বাভাবিক হতে। আমার জীবনে এখন আর কোনোকিছুই স্বাভাবিক নেই।’

‘স্মৃতি, একবার চেষ্টা তো করো। আমাকে কি কোনো সুযোগ দেয়া যায় না? আমি কি এতটাই অযোগ্য।’ রাহাত ভাইয়ের কণ্ঠে হতাশা।

আমি অধৈর্য গলায় বললাম, ‘আপনি অযোগ্য নন। আমিই আপনার অযোগ্য। আমি তো আপনাকে বারবার বলেছিলাম আমাকে আপনার জীবনের সাথে না জড়াতে । আপনি তো তখন শুনলেন না।’

‘তোমার কথা শোনার মতো কি তখন কোনো পরিস্থিতি ছিল?’

‘আপনি না শুনলেই তো হতো।’

‘আমাকে কি এতটা নিষ্টুর মনে হয় তোমার?’

‘সেটাই তো আপনি নিষ্ঠুর নন। তাই তো আমার উপর করুণা করছেন। কেন? আমি কি আপনার করুণা চেয়েছি?’

‘তুমি কি কিছুই বোঝ না, স্মৃতি? নাকি বুঝতে চাও না?’

‘এখানে তো না বুঝার কিছু নেই। আপনি যে করুণা করছেন তা আমি কেন, সবাই বোঝে। সবাই বলেও বেড়ায়। আমি হয়তো মেন্টালি আর ফিজিক্যালি দুর্বল ছিলাম। কিন্তু অতটুকু বুঝার ক্ষমতা আমার ছিল, রাহাত ভাই।’

‘তুমি সব বুঝ, সব শুনতে পাও। শুধু আমাকেই বুঝ না। না কখনো বুঝার চেষ্টা করেছ!’ রাহাত ভাইয়ের কণ্ঠে গভীর আক্ষেপ ।

‘আমি কিছুই জানি না রাহাত ভাই। কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘কারও জন্য কারও জীবন থেমে থাকে না। জীবন চলতেই থাকে তার নিজস্ব গতিতে। এতগুলো বছরেও তুমি না আমাকে মেনে নিতে পারছ না নিজে স্বাভাবিক হতে পারছ।’ এটুকু বলেই রাহাত ভাই আবার বললেন, ‘ আচ্ছা আমার কথা না হয় বাদ দিলাম। কিন্তু কল্প! কল্পের জন্য তো এবার তোমাকে আগের মতো প্রাণোচ্ছল হতে হবে। তাই না? কল্প এখন বড় হচ্ছে । ও বুঝতে শিখছে। সে কি বুঝবে না এসব? সে যদি কখনো প্রশ্ন করে বসে এসব নিয়ে তখন কী করবে তুমি , স্মৃতি? বলো আমাকে।’

আমি রাহাত ভাইয়ের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, ‘ আমি কিচ্ছু জানি না। কিচ্ছু না। প্লিজ আমাকে একটু একা থাকতে দিন। আমি একা থাকতে চাই, প্লিজ ।’

‘ঠিক আছে। একা থাকতে চাও তো? থাকো একা।’ রাহাত ভাই রাগ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাবার সময় দরজাটা খুব জোরে আওয়াজ করে বন্ধ করে গেলেন।

এই মানুষটাকে আমি কখনো রাগান্বিত হতে দেখিনি। খুব সহজে সে রাগান্বিত হয় না। অথচ আজ আমি তার মেজাজ খারাপ করে দিলাম। আমিই বা কী করব! আমি চেষ্টা করেও পারি না। স্মৃতিগুলো আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। কি ঘুম কি জাগরণ সব সময় অতীত আমাকে অশান্ত করে তোলে। আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু করে দেয় । আমি চাইলেও যে পারছি না স্বাভাবিক হতে। আমি অপারগ। এই স্মৃতি অপারগ!

চলবে…ইন শা আল্লাহ্

আগের পর্বের লিংক:

https://m.facebook.com/groups/884724498624937?view=permalink&id=950415062055880

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে