গল্প: বিস্মৃতির অন্তরালে পর্ব – ১১

0
983

#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
গল্প: বিস্মৃতির অন্তরালে পর্ব – ১১
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি

সেদিনের পর থেকে নিশান ভাইকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলাম। আমাকে সামনে পেলেই শেষ করে দিবে। আর পড়াশুনার অজুহাতে তাকে এভয়েড করা আমার জন্য আরো অনেক সহজ হয়ে গেল। ছাদে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। মাঝে মাঝে নেহা আমার রুমে এসে খুব জোর করে ছাদে যাওয়ার জন্য । আবার মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে কেন আলাদা আলাদাই খাবার খেয়ে ফেলি। আমি তখন একটাই কথা বলি । পড়াশুনার খুব চাপ। তাই তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেললে তাড়াতাড়ি ডাইজেস্ট হবে। আর পরীক্ষার সময় ডাইজেস্টে সমস্যা হলে তো অসুবিধা হবে পড়া কমপ্লিট করতে। এভাবে ভুজুংভাজুং বলেই নেহাকে এক প্রকার বিদায় করতাম।

ভর্তি পরীক্ষার আগের দিন ফুফু আমার রুমে এলেন। আমাকে বললেন যে নিশান ভাই আমাকে পরীক্ষার সেন্টারে নিয়ে যাবে । আমার তখন প্রচণ্ড তেষ্টা পেল। ভাবলাম এবার কীভাবে এড়াব এই মি. চুল প্রিয়কে। আমি দ্রুত গিয়ে আমার রুমের টেবিলের উপর রাখা পানির জগ থেকে একগ্লাস পানি ঢেলে এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেললাম। ফুফু বললেন,’ ইজ এনিথিং রং, স্মৃতি?’

আমি ঢোক গিলে দ্রুত উত্তর দিলাম,’ নো , এভরিথিং ইজ এবসোলিউটলি ওকে।’

‘বাট ইউ লুক সিক।’ ফুফু উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন।

‘নো, আ’ম ফাইন। ভেরি ফাইন।’ আমি থতমত খেয়েই বললাম।

‘টেক কেয়ার ইউরসেল্ফ। খারাপ লাগলে বলবি কিন্তু । তখন আমার ভাই আমাকে কথা শুনাবে।’ ফুফু হাসতে হাসতেই বললেন।

‘ওকে।’ আমি ঠোঁট টেনে জোরপূর্বক হাসি হাসলাম।

ভর্তি পরীক্ষার দিন আমার এই অযুহাত আর চলল না। আমাকে নিশান ভাইয়ের সামনে পড়তেই হলো। তবে আমি যথাসম্ভব তার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে নিশান ভাই আমার কাছে এসে বলল,’ তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে আয়। জ্যামে পড়লে দেরি হয়ে যাবে।’

আমি খুব অবাক হলাম। মানুষটাকে আমি একদম বুঝতে পারি না। আমি তার কথায় তার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালাম। তার চোখে এখন কোনো ক্রোধ নেই, নেই কোনো রাগ। আমি তার চোখের দিকে ভূতগ্রস্তের মতো তাকিয়ে থেকে শুধু মাথা নাড়লাম।

নিশান ভাই আমাকে আবার তাগাদা দিয়ে বলল,’ নাশতা খেয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয়। দেরি হয়ে যাবে তো।’

আমি একেবারে বাধ্য মেয়ের মতো রেডি হলাম। ফুফু আমার সাথে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু নিশান ভাই বলল যাওয়ার দরকার নেই। অযথা এত মানুষ গিয়ে কী লাভ! নিশান ভাই ড্রাইভিং সিটে বসে আমাকে ইশারায় বলল সিট বেল্ট বাঁধার জন্য। আমি একে তো পরীক্ষার টেনশন তার উপর নিশান ভাই আজ এত স্বাভাবিক আচরণ করছে। সব মিলেয়ে দারুণ টেনশনে ছিলাম। তাই সিটবেল্ট বাঁধার দিকে আমার কোনো খেয়ালই ছিল না। সিটবেল্ট বাঁধতে গিয়ে দেখছি হাত কাঁপছে, সিটবেল্ট টানছি কিন্তু মনে হলো ওই মুহূর্তে আমার মতো দুর্বল বোধহয় আর কেউ নেই। আমাকে সিটবেল্ট নিয়ে টানাটানি করতে দেখে নিশান ভাই কাছে এসে সিটবেল্টটা বেঁধে দিল। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল তার কাছে আসাতে। সিটবেল্ট বাঁধা শেষে সে বলল,’শুধু কথাই শিখেছিস। কোনো কাজ করতে শিখিস নাই।’

আমি ত্যাড়া চোখে তাকালাম জনাব চটাং পটাং এর দিকে । নিশান ভাই আবার বলল,’সোজাসুজিই তাকাতে পারিস আমার দিকে। আমি কিছু মনে করব না। পাশে এরকম একটা হ্যান্ডসাম আর ড্যাশিং ছেলে থাকলে যে কারো তাকানোর ইচ্ছে জাগতে পারে। তোরও ইচ্ছে করছে যখন তুইও তাকাতে পারিস। এ আর নতুন কি!’

‘হুহ! নিজেকে কী মনে করে কে জানে!’ আমি বিড়বিড় করে বললাম।

‘কিছু বলেছিস?’ নিশান ভাই আমার দিকে ত্যেড়ছাভাবে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।

‘কিছুই বলিনি। তোমাকে কিছু বলার জন্য আমার বয়েই গেছে।হুহ!’

‘নাহ! আমি শুনেছি। তুই কিছুতো বলেছিস।’

‘শুনলে আবার জিজ্ঞেস করছ কেন?’

‘তুই কি বলবি?’

‘এত যখন শোনার ইচ্ছা তখন বলেই ফেলি। নিজেকে কি প্রিন্স হ্যারি ভাবো?’ আমি ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলাম।

‘প্রিন্স হ্যারি ভাবব কেন?’ নিশান ভাই শার্টের করার উঁচিয়ে জোর গলায় বলল,’আমি আমিই।আমি হচ্ছি প্রিন্স নিশান। ওসব হ্যারির ধার এই নিশান ধারে না। বুঝলি?’

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম নিশান ভাইয়ের দিকে। নিজেকে কি ভাবে সে!

‘মুখ বন্ধ কর। মাছি ঢুকে যাবে। এমনভাবে তাকাস কেন? মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই আমাকে গিলে খাবি। তাছাড়া এভাবে তাকালে আমার আবার তোর নজর লেগে যাবে । ভদ্রভাবে তাকাবি। যাতে নজর লাগার কোনো সম্ভাবনাই না থাকে।’ আমি বিস্মিত হয়ে তার কথা শুনছি। একটু থেমে সে আবার বলল,’অবশ্য তোর কী দোষ দেব বল! আমি দেখতেই এতটা চার্মিং।’

আমার নিজের অজান্তেই মুখটা খানিক হা হয়ে গিয়েছিল আমি বুঝতেই পারিনি। এত্ত অপমান! আমি এর দিকে আর তাকাবই না। কোনোভাবেই না। তাই আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকলাম।

সেন্টারে আসার পর আমার কেন যেন একটু ভয় ভয় লাগছিল। মনে হচ্ছিল আমি কাঁপছি। প্রিপারেশন ভালো থাকলেও আমার এই কাঁপাকাঁপি থেকে রেহাই নেই। হঠাৎ নিশান ভাই আমার ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,’এত নার্ভাস হচ্ছিস কেন? তুই পারবি। নিজের উপর বিশ্বাস রাখ।’

আমি নিশান ভাইয়ের গভীর কালো চোখের দিকে তাকালাম। এক অবিমিশ্র ভরসার আশ্বাস দেখলাম সেখানে। নিশান ভাই আবার বলল,’কি? ভরসা নেই নিজের উপর?’

আমি শুধু মাথা নাড়লাম। কোনো কথাই মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল না। এ কোন নিশানকে দেখছি আমি। একে কেন আমি কোনোভাবেই বুঝতে পারি না। কোনটা তার আসল রূপ আর কোনটা নকল। আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না। এতগুলো রূপও কি একজন মানুষের থাকে! যদি না থাকে তবে কোনটা নিশান ভাইয়ের আসল রূপ! কোনটা! আমি সত্যিই কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি।

পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে বার্ডস আই ভিউতে চারদিকে তাকালাম। নিশান ভাইকে কোথাও দেখছি না । আমাকে রেখে কি চলে গেছে তাহলে? আমি চারদিকে খুঁজছি কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলাম না। আমার খুব ভয় লাগতে শুরু করল। কারণ আমি এখনো ঢাকা শহরের তেমন কিছুই চিনি না। হঠাৎ নিজের নাম ধরে কাউকে ডাকতে শুনে আমি ঘুরে দাঁড়াতেই ইমরানকে দেখতে পেলাম। ইমরান কাছে আসতেই বলল,’পরীক্ষা কেমন দিলি?’

‘ভালোই। তোর কেমন হলো?’

‘ভালো হয়েছে । তুলিকে দেখেছিস?’

‘নাহ্! এত্ত ভীরের মধ্যে খুঁজে পাওয়াটাই বিশাল ব্যাপার।’

‘তা যা বলেছিস।’

হঠাৎ একটা কর্কশ শব্দ কানে আসতেই আমি ঘাড় ঘুরে তাকালাম। দেখলাম নিশান ভাই দাঁড়িয়ে আছে । তার হাতে ভ্যানিলা আইসক্রিম। বলছে,’ধর। এটা খেয়ে নে। ভালো লাগবে।’

ইমরান বলল,’ভাইয়া কেমন আছেন?’

নিলান নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,’ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? পরীক্ষা ভালো হয়েছে?’

ইমরানকে উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়েই নিশান ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলল,’তুই কি এখানে স্ট্যাচু অব লিবার্টি হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে প্রদর্শনী করবি?’

আমি অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে। অবিশ্বাসের সুরে বললাম,’আমি প্রদর্শনী করছি?’

‘দেখ। আমি তোর মতো বেকার না। আমার অনেক কাজ আছে। তোর জন্য আমার এমনিতেই আজ অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে।’ এটুকু বলেই সে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো।

টেনে আনার সময় আমার হাত থেকে আইসক্রিম পড়ে গেল। আমি মুখ ভার করেই গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। নিশান ভাই আবার একটা আইসক্রিম নিয়ে এলো।

আমার দিকে আইসক্রিম বাড়িয়ে দিতেই আমি বললাম,’আমি খাব না। খাব না তোমার আইসক্রিম । তুমি খাও।’এই বলে আমি গাড়িতে উঠে বসলাম । নিশান ভাই গাড়িতে উঠেই আইসক্রিম আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,’এটা শেষ না করা পর্যন্ত গাড়ির চাকা আজ চলবে না।’

অগত্যা আমাকে খেতেই হলো। তারপর গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল,’এবার বল, পরীক্ষা কেমন দিলি?’

‘বলব না। তোমাকে আমি কিচ্ছু বলব না। তুমি একটা পচা, বজ্জাত ছেলে। তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে । আমার সাথে কথা বলতে হবে না। তোর সাথে কথা বলার জন্য কি আমি মরে যাচ্ছি?’

‘আমিও কি মরে যাচ্ছি?’

‘আচ্ছা ঠিক আছে । আজ থেকে আমার সামনে আসবি না। আসলে কিন্তু তোর খবর আছে।’ এটুকু বলেই নিশান ভাই গাড়ি স্টার্ট করল।

চলবে…ইন শা আল্লাহ্

আগের পর্বের লিংক:

https://m.facebook.com/groups/884724498624937?view=permalink&id=949043535526366

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে