#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৩৪
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
খুলবে না জানালা ফিরবে না রমনী। হবে না খোলা জানালার দক্ষিণে প্রনয়নের আদান-প্রদান। পড়ে থাকবে বাড়ি বন্ধ হবে জানালা। ফিরবে না সেই মধুর কিছু মুহূর্ত। ধুলাবালির মতো শহরে বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে কিছু স্মৃতি। এত স্নিগ্ধ অনুভূতি রেখে যাওয়া এই বাড়িটা যে ভিষণ পোড়াবে। কাউকে দেখার জন্য আঁখিযুগল খোলা জানালার দক্ষিণে দৃষ্টিপাত করবে না। কেউ দুষ্টু হেসে বলবে না এভাবে তাকাবেন না ম্যাডাম প্রেমে পড়ে যাবেন। শহরের ধুলাবালির সাথেও প্রনয়নের আদান-প্রদান হয়েছে। সেজন্য এই শহরের প্রতি এত টান এত মোহ এতা মায়া! যেতে মন সায় দেয় না তবুও কিছু তিক্ত অনুভূতি নিয়ে যেতে হয়৷ বুক ভরা চাপা কষ্ট নিয়ে মেহেভীন গৃহ ত্যাগ করল। অনুভূতিরা আজ শূন্যহীন হয়ে গিয়েছে। শব্দগুলো যেন আজ বাক হারা। বিষন্ন রজনীর সাথে বিষাদের ছেয়ে গিয়েছে মন। বিষাদিনী কি জানে তার বিষাদগ্রস্ত মন কারো হৃদয়ে অস্থিরতার ঝড় তুলে দেয়। অশান্ত সমুদ্রের মতো ভেতরটা উথাল পাথাল করতে থাকে মন গহীনে। কিছু তিক্ত অনুভূতি আর বুকভরা বিষাদ নিয়ে শহর ত্যাগ করল মেহেভীন।
তাহিয়া ড্রয়িং রুমে বসেছিল তখনই নজর কারা রমনী প্রবেশ করে চৌধুরী বাড়িতে। তাহিয়া ভ্রুযুগল কুঁচকে রমনীর দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। দুধে আলতা গায়ের রঙের সাথে কালো রঙের শাড়ি যেন নিজ দায়িত্ব রমনীর সৌন্দর্যের বর্ণনা দিচ্ছে। রিনি তাহিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–এটা রিয়াদ আংকেলের বাড়ি? তাহিয়া উৎসুক হয়ে গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল,
–জি।
–আমি রিনি আমি আমার বাবা আংকেলের বন্ধু। আংকেল আমাকে এখানে আসতে বলেছে। আপনি একটু আংকেলকে ডেকে দিবেন। তখনই রিয়াদ চৌধুরী হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ দাঁড়ে এসে হাজির হন। মুখশ্রীতে চিৎকার হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,
–মামনি তুমি এসে গিয়েছ? আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। একটু বাগানের দিকে গিয়েছিলাম। সেজন্য তোমার সাথে দেখা হয়নি। তোমার আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো মামনি?
–আমার আসতে কোনো সমস্যা হয়নি আংকেল। আমি প্রচুর ক্লান্ত আমাকে আমার কক্ষটা দেখিয়ে দিন। আমি একটু বিশ্রাম করতে চাই। রিয়াদ চৌধুরী গার্ডকে ডেকে রিনিকে নিয়ে যেতে বলল। রিনি নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে কক্ষের দিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে হালকা খাবার খাওয়ার জন্য আসলো। তখনও তাহিয়া বসে বসে নখ ঘষছিল। রিনিকে আড়চোখে পরখ করে নিল। রিনি এসে তাহিয়ার পাশে বসলো। কিছুটা অহংকার নিয়েই বলল,
–বাড়িতে এত সুন্দর সুন্দর মেয়ে থাকতেও বাহির থেকে মেয়ে নিয়ে আসা হয়, চৌধুরীর ছেলের মন জয় করার জন্য! রিনির কথায় জ্বলে উঠল তাহিয়া। রাগান্বিত হয়ে বলল,
–তুমি কি কথা গুলো আমাকে বললে রিনি আপু?
–তোমাকেই তো বললাম। জাল পেপার বানিয়েও তো মুনতাসিমকে নিজের আয়ত্ত করতে পারলে না। এই রুপ দিয়ে কি করবে? বিদেশে গিয়ে সাদা বিলাতী ধরে নাও।
–তুমি মনে হয় খুব পারবে মুনতাসিম ভাইয়াকে বশ করতে?
–আমার কাছে এটা কোনো বিষয়ই না। আমি যে পথ ধরে হেঁটে যাই। সেই পথের ধুলাবালি গুলোও আমার প্রেম পড়তে বাধ্য হয়। আর মুনতাসিম তো সাধারণ একজন মানুষ মাত্র। রিনির কথায় তাহিয়ার অধরের কোণে হাসি ফুটে উঠল। দীর্ঘ দিন পর তার প্রাণ খুলে হাসতে ইচ্ছে করছে। তবুও সে নিজেকে দমিয়ে নিল। মনে মনে তাচ্ছিল্য করে বলল, ‘একবার যাও মুনতাসিম ভাইয়ের কাছে তারপরে বুঝবে। মুনতাসিম ভাই কি জিনিস। মুনতাসিম ভাইকে ভালোবাসার মতো অপরাধ করেছিলাম। ভালোবাসার উপহার স্বরুপ পেয়েছি যন্ত্রনা আর আঘাত। দীর্ঘ দেড় মাস আমাকে হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকতে হয়েছে। ভাইয়াকে ভোলোর জন্য কত নির্ঘুম রজনী আমি পার করেছি। চাইলেই কি এত বছর ধরে মনের মধ্যে রাখা মানুষটাকে ভোলা যায়! আঁখিযুগলের কোণে অশ্রুকণা এসে হানা দিল। মুখশ্রীতে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল,
–তুমি মুনতাসিম ভাইয়াকে বশ করতে পারলে, আমি তোমার কথা মতো বিদেশি বিলাতী ধরে বিয়ে করে নিব। আমার থেকে তোমার রুপ কমই আছে। যেখানে আমার মতো মেয়েকে মুনতাসিম ভাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। সেখানে তুমি কোন কালনাগিনী। কথা গুলো বলেই শব্দ করে হেসে উঠল। রিনি রক্তিম চোখে তাহিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে।
–তোমার যোগ্যতা যেখানে মুনতাসিম তোমাকে সেখানেই বসিয়ে দিয়েছে। আমি আমার যোগ্যতা তোমাকে দেখিয়ে দিব। এই যে আমি এখন তোমার পাশে বসে আছি। একটু পরে আমার স্থান হবে মুনতাসিমের কক্ষে। মুনতাসিম নিজে আমায় আপন করে নিবে। আমাকে ছাড়া সে এক মুহূর্তে চলতে পারবে না। তুমি শুধু অপেক্ষা করো আর আমার কেরামতি দেখো। তাহিয়া বুঝল রিয়াদ চৌধুরী রিনিকে সবকিছু বুঝিয়েই নিয়ে এসেছে। তাহিয়া মলিন গলায় বলল,
–মুনতাসিম ভাইয়া এক নারীরে আসক্ত। এক নারীতে আসক্ত পুরুষ গুলো ভিষণ ভয়ংকর রকমের সুন্দর হয় জানো তো। যেমন তাদের ভালোবাসার প্রখরতা বেশি হয়। তেমনই নিজের প্রিয় মানুষকে আপন করে পাবার আকুলতা টাও দৃঢ় হয়। তোমার মতো রাস্তার মেয়েকে মুনতাসিম ভাই তার জুতা পরিষ্কার করার জন্যও রাখবে না। রিনি নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। রাগান্বিত হয়ে তাহিয়ার গালে প্রহার করতে যাবে। তখনই তাহিয়া হাত ধরে ফেলে। দু’জনকে এমন অবস্থায় দেখে চমকে উঠল রিয়াদ চৌধুরী! রিনির পছন্দের খাবার কেনার জন্য বাহিরে গিয়েছিল তিনি। রিনি রিয়াদ চৌধুরীকে দেখে কৃত্রিম কান্না দেখিয়ে বলল,
–আংকেল জানেন এই মেয়েটা আমাকে রাস্তার মেয়ে বলছে। রিয়াদ চৌধুরী গম্ভীর দৃষ্টিতে তাহিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তাহিয়ার মুখশ্রীতে কোনো অনুশোচনার ছাপ নেই। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিনির বলা শেষ হলে তাহিয়া চিৎকার করে বলল,
–আপনার বন্ধু মেয়ে যদি আমাকে বিদেশি বিলাতী ধরে বিয়ে করতে বলে, তাহলে আমি কেন তাকে রাস্তার মেয়ে বলতে পারব না? একমাত্র রাস্তার মেয়ের মুখেই এমন বিশ্রী বাক্য উচ্চারিত হতে পারে। আমি নিজের প্রিয়তমকে পাবার জন্য জালিয়াতি করেছি। কিন্তু কাউকে এমন বিশ্রী ভাষা প্রয়োগ করিনি মামা। এবার তার হয়ে যদি আপনি আমাকে কথা শোনাতে আসেন। তাহলে আমি মাকে বলব কালই যেন এ বাড়ি ছাড়েন তিনি। কথা গুলো বলে দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল তাহিয়া। রিয়াদ চৌধুরী রিনিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–তুমি তাহিয়াকে সত্যি এসব বলেছ?
–আপনার কি মনে হয় আংকেল? আমি এসব বিশ্রী ভাষা ব্যবহার করতে পারি!
–আমি তোমার অবস্থা বুঝতে পেরেছি। তুমি কষ্ট পেও না আমি কালকে তাহিয়াকে বুঝিয়ে বলব। সে যেন আর তোমার সাথে বাজে ব্যবহার না করে, তাকে দিয়ে তোমার কাছে মাফ চাইয়ে নিব। কথা গুলো বলেই রিনিকে খাবার জন্য টেবিলে নিয়ে গেল। অদ্ভুত বিষয় রিনি গৃহে প্রবেশ করেছে অনেকক্ষণ যাবৎ। কেউ তার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলো না। এতে অপমানে রিনির মুখশ্রী চুপসে গেল।
মুনতাসিমের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেল। ধমনীর বুকে মানসিক শান্তির ওপরে কিছু নেই। মানসিক শান্তি থাকলে পুরো দুনিয়ায় শান্তি থাকে। মুনতাসিমের সমস্ত শরীরে অনুভূতিরা আনন্দে মিছিল করছে। মনের শহরের অলিতে-গলিতে গর্জন করে বলছে। এবার নিজের প্রেয়সীকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে ফেলার সময় এসে গিয়েছে। যে চাদর সরানো ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারো নেই। কিন্তু কিছু তিক্ততা খারাপ লাগলেও ভয়ংকর রকমের সত্যি। রজনী কি মুনতাসিমকে বলেনি? এই হাসি এই আনন্দ তোমার জন্য নয়। তোমাকে কেবল দুঃখ দেওয়ার জন্য আপন মানুষরা ভালোবেসেছে। সে আনন্দ নিয়ে বাসায় ফিরেছিল। সে কি জেনেছিল তা মুহুর্তে মধ্যে বিষাদে রুপ নিবে। নিজের কক্ষে প্রবেশ করতেই চারদিকে আঁধারে আচ্ছন্ন দেখে মস্তিস্ক টগবগ করে উঠল। তার বিনা অনুমতিতে কে তার কক্ষ প্রবেশ করেছে? কার এত বড় স্পর্ধা মুনতাসিমের কক্ষে প্রবেশ করার দুঃসাহস দেখিয়েছে! তার বাবা আসলে তো কখনো আলো নেভায় না। কক্ষে প্রবেশ করতেই একজোড়া কোমল হাত মুনতাসিমের গলা জড়িয়ে ধরল। মুনতাসিম বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেল। তার কক্ষে কোনো নারী প্রবেশ করেছে। কে সে যে তার কক্ষে আসার অনুমতি পেল? মুনতাসিমের ভাবনার মানেই রমনীকে ভয়ংকর রকমের কাজ করে বসলো। সে মুনতাসিমের গালে চুমু খেয়েছে। মুনতাসিম যেন এবার নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গেল। সে দ্রুত ফোনের আলো জ্বালিয়ে কক্ষের আলো জ্বালালো। নববধূর মতো রুপ নিয়েছে রিনি। মুনতাসিমের জায়গান অন্য কোনো পুরুষ থাকলে, রিনিতেই আঁটকে যেত। রিনির প্রেম পড়েনি এমন পুরুষ খুব কমই আছে। রিনির মুখশ্রীতে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে। মুনতাসিনের আঁখিযুগলে দৃষ্টিপাত করার সাহস হচ্ছে না। লজ্জা মস্তক নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুনতাসিম শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে রিনির গালে ক’ষে থা’প্প’ড় বসিয়ে দিল। সাথে সাথে রিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। রিনির কর্ন দিয়ে উত্তপ্ত ধোঁয়া বের হচ্ছে। সমস্ত ধরনী অন্ধকার হয়ে আসছে তার কাছে। মুনতাসিমের রক্তাক্ত আঁখিযুগলের দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়তেই অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল তার। ভয়ে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। মুনতাসিম হুংকার ছেড়ে সবাইকে ডাকলো। এতক্ষণ কারো সাড়াশব্দ ছিল না। মুনতাসিমের এক ডাকেই নিস্তব্ধ বাড়িটা মুহূর্তের জাগ্রত হয়ে গেল। কাল বৈশাখী ঝড়ের গতিতে সবাই মুনতাসিমের কক্ষে এসে হাজির হলো। সবাইকে দেখে মুনতাসিম বজ্র কণ্ঠে বলল,
–এই মেয়ে কে? এই মেয়ের এত সাহস হলো কি করে আমার বাড়িতে এসে আমার কক্ষে প্রবেশ করে, আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার! এই মেয়েকে এত সাহস কে দিয়েছে আমি জানতে চাই? মুনতাসিমের হুংকারে কেঁপে উঠল চৌধুরী বাড়ির প্রতি দেওয়াল। ভয়ে সবাই জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাহিয়া মুখ চেপে হাসছে এই মুহূর্তটার জন্যই সে অপেক্ষা করছিল। সবার মুখশ্রীতে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। মেয়ে টাকে মেরে না ফেলে আবার মুনতাসিম। রিনি লজ্জায় মাটির সাথে মিশে থাকলো। সে মুনতাসিমকে যতটা সহজ ভেবেছিল মুনতাসিম যে তার বিপরীত চিত্র হবে। সেটা রিনির ভাবনার বাহিরে ছিল। রিনিকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে, রিয়াদ চৌধুরী অস্থির হয়ে তাকে তুলে দাঁড় করালো। রাগান্বিত হয়ে বলল,
–তুমি কোন সাহসে ওর গায়ে হাত তুললে?
–ও কোন সাহস আমার কক্ষে এল? ওর এত বড় কলিজা কে দিয়েছে? আমার কক্ষে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে চুমুর খাওয়ার! আজকে আমি ওর কলিজা টেনে বের করে দেখব। তার কলিজা ছিঁ’ড়ে এনে ভেজে কু’কু’র’কে দিয়ে খাওয়াব।
–মুনতাসিম সাবধানে কথা বলো। আমি তোমার বাবা সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কন্ঠস্বর নিম্ন করে কথা বলো!
–যেখানে আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সেখানে আমি চুপ থাকব। আপনি এই কথা বলছেন। এই মেয়েকে এখানো খু’ন না করে বাঁচিয়ে রেখেছি। এটাই তো তার ভাগ্য ভালো। আমার সামনে থেকে একে নিয়ে যান না হলে আপনার সামনেই খু’ন করে ফেলব।
–দু’দিন পরে যে মেয়ে তোমার অর্ধাঙ্গিনী হবে। তাকে সন্মান দিয়ে কথা বলো। রিনিকে নিয়ে আর একটা বাজে মন্তব্য করলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। এত সুন্দর একটা মেয়ে কিসের কমতি আছে তার কাছে!
–আমার মনের রাণী ছাড়া সব নারী আমার কাছে বিষাক্ত। আমি মেহেভীনকে ভালোবাসি। আমি বিয়ে করলে মেহেভীন কেই করব৷ আমি মেহেভীনের না তো কারো না। মুনতাসিমের একটা বাক্যে পুরো পরিবেশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। যে ছেলে বিয়ের কথা বললেই লজ্জা পেত। সেই ছেলে বিয়ে ভালোবাসার কথা বলছে! তবে আঘাতটা কি একটু বেশিই করা হয়ে গেল? রিয়াদ চৌধুরী নিজেকে দমিয়ে রাখলেন না। মুনতাসিমের থেকে দ্বিগুন গর্জন করে বলল,
–আমার বাড়ির বউ হিসেবে আমি রিনি কেই মেনে নিব। রিনি ছাড়া অন্য কাউকে আমার বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নিব না। আর মেহেভীনকে তো একদমই নয়। কারন আমি মেহেভীনকে পছন্দ করি না।
–কেন মেহেভীনকে পছন্দ করেন না? কিসের কমতি আছে মেহেভীনের মধ্যে।
–তাকে অপছন্দ করার কোনো কারন নেই। তাকে একটা কারনেই পছন্দ করি না। কারন সে তোমাকে কষ্ট দিয়েছে। নিজের বুকে পাথর চাপা রেখেছি। তবু ও তোমায় কষ্ট পেতে দেয়নি। সেই ছেলেকে দু’দিনের একটা মেয়ে এসে এক টার পর একটা আঘাত করে যাবে। আমি সেটা বাবা হয়ে সহ্য করব। তোমার চরিত্র নিয়ে এত ভয় সে-ও তো তোমায় চরিত্রহীন প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে। তাহিয়া, রিনি যদি ছাড়া না পায় তবে সে পেল কি করে?
–আপনি আমার কষ্টের কথা বলছেন আব্বা। সেটা তো আপনি নিজেও দ্বিতীয় বিয়ে করে আমাকে দিয়েছেন৷ চরিত্রহীন প্রমাণ করার চেষ্টা আপনিও করলেন। আপনি ছাড়া পেলে সে কেন পাবে না? সবাই আমার এত ভালো চাইলো। ভালো চাইতে চাইতে আমার ভালো থাকাই কেড়ে নিল। রিয়াদ চৌধুরী নিস্তব্ধ হয়ে গেল মুখশ্রী থেকে বাক্য গুলো হারিয়ে গিয়েছে। মস্তিষ্ক ঝিম মেরে গিয়েছে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি ক্ষয় হচ্ছে এক মুহুর্তে বিলম্ব করল না। দ্রুত রিনিকে নিয়ে কোনো রকমে কক্ষ ত্যাগ করল। ধীরে ধীরে কক্ষ একদম ফাঁকা হয়ে গেল। মুনতাসিম দেওয়ালে হাত ঠেকিয়ে ফ্লোরের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। শরীরের মধ্যে ভিষণ খারাপ লাগছে। আঁখিযুগল অস্বাভাবিক ভাবে রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। নির্ঘুম রজনী আর নিস্তব্ধ কক্ষ মুনতাসিমের হাহাকারের সাক্ষী হয়ে রইল।
চলবে…..
#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৩৫
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
মনের সাড়া মস্তিষ্কের পিছুটান এ কেমন লড়াই! জীর্ণ ক্ষত হৃদে বাস্তবতার যুদ্ধে আমি ভিষণ অসহায়। বিষাদে ছেয়ে গিয়েছে মনের আনাচে-কানাচেতে। রিয়াদ চৌধুরী রজনীর মধ্যে প্রহরে ভিষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে খবর কর্ণকুহরে আসতেই সমস্ত মন মস্তিষ্ক তিক্ত হয়ে উঠল। অপরাধবোধ ভেতর টা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সে বাবার কাছে মুখশ্রী দেখাবে কি করে? কালকের কথা স্মরন করতেই বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠল। সে বাবাকে কখনোই আঘাত করতে চায়নি। বাবার অসহায়ত্ব মাখা মুখশ্রী আঁখিযুগলের সামনে বারবার ভেসে উঠছে। ভেতরে অসহনীয় জ্বালাপোড়া করছে। সে মনস্থির করে নিল বাবাকে কষ্ট নিয়ে নিজের সুখ চাইবে না। সবাই তো পূর্ণতা খোঁজে সে না হাহাকার খুঁজে নিবে। মুনতাসিম নিজেকে শক্ত করে নিল। এতটা শক্ত হয়ে নিল যেন বাহির থেকে বোঝা না যায়। এই মানুষ টাই ভেতর থেকে একদম চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। মুনতাসিম তার বাবার কক্ষে এসে বসলো। রিয়াদ চৌধুরী হাতে তখনও স্যালাইন চলছে। বাবাকে এমন অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখে যন্ত্রনা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। অস্বাভাবিক ভাবে ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। মুনতাসিম গম্ভীর দৃষ্টিতে সাহেলা চৌধুরীর দিকে দৃষ্টিপাত করল। সাহেলা চৌধুরী বিলম্ব করল না মুখশ্রীতে আঁধার নিয়ে এসে কক্ষ ত্যাগ করল। রিয়াদ চৌধুরী ললাটের ওপরে এক হাতে রেখে স্থির হয়ে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছেন। মুনতাসিম মলিন গলায় বলল,
–স্যরি আব্বা আমি আপনাকে আঘাত করতে চাইনি। আপনি তো জানেন রাগের মাথায় আমি নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকি না। আপনি ছোট বেলা থেকে আমার কত-শত ভুল মাফ করে দিয়েছেন। শেষ বারের মতো আমাকে মাফ করা যায় না আব্বা। আপনাকে দুঃখ দিয়ে যে আমি শান্তি পাচ্ছি না। প্রতিটি মুহুর্তে জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। আপনি চিন্তা করে নিজের ক্ষতি করবেন না। এই ধরনীর বুকে আপন বলতে আমার আপনিই আছেন। আপনার কিছু হয়ে গেলে আমি নিঃস্ব হয়ে যাব আব্বা। আমাকে শাস্তি দিন মা’রু’ন তবুও নিজেকে কষ্ট দিবেন না। আপনার কষ্ট আমাকে ভিষণ বাজে ভাবে পোড়ায়। আপনাকে কষ্ট দিয়ে সুখ কিনতে চাইনা আব্বা। আমি শুধু চাই আপনি ভালো থাকেন সুস্থ থাকেন। আপনার ভালো থাকার জন্য যা করতে বলবেন। আমি সবকিছু কিছু করতে রাজি আছি। আপনি শুধু আমাকে ক্ষমা করে দিন। রিয়াদ চৌধুরী আগের ন্যায় স্থির হয়ে আছেন। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–মেহেভীনকে ভুলে যেতে হবে। যদি পারো তবেই আমায় আব্বা ডেকো, না হলে তোমার মুখে যেন আব্বা ডাক না শুনি।
–ভুলে যাব আব্বা খুব শীঘ্রই ভুলে যাব। আর কখনো আপনার কষ্টের কারন হয়ে দাঁড়াব না। তবুও আপনি চিন্তা করে নিজেকে অসুস্থ করে ফেলবেন না৷ কথা গুলো বলার সময় মুনতাসিমের মনে হলো কেউ তার ভেতরটা রক্তাক্ত করে দিয়ে যাচ্ছে । ভালোবাসায় এতটা যন্ত্রনা কেন? ভালোবাসার মানুষকে ভুলে যেতে হবে কথা গুলো বলতেও যে দম বন্ধ হয়ে আসছে। বুকের বা পাশে চিনচিন করে ব্যথা করছে। হাহাকার বয়ে যাচ্ছে মনের শহরের অলিতে-গলিতে। ভাগ্যে যদি না-ই বা থাকবে তবে দেখা হয়েছিল কেন তার সাথে! মৃত মানুষ হারানোর চেয়ে জীবিত মানুষ হারানোর যন্ত্রণা বেশি। সে যে বলল মেহেভীনকে ভুলে যাবে। মেহেভীনকে কি ভোলা তার জন্য এতটাই সহজ হবে? তার অস্তিত্বের সাথে মিশে গিয়েছে মেহেভীন। নিজের অস্তিত্বকে ভুলে যাওয়া যায়! বুকভাঙা আর্তনাদ নিয়ে বাবার কক্ষ ত্যাগ করল মুনতাসিম। যে বাবা সারাজীবন দুঃখ কিনে তাকে সুখ দিয়েছে। সেই বাবাকে কষ্ট দিয়ে সে সারাজীবন কিভাবে সুখী হবে? এক জীবনে সব পেয়ে গেলে আক্ষেপ করবে কি নিয়ে? সে না হয় প্রিয় মানুষকে না পাওয়ার আক্ষেপ করে জীবন পার করে দিবে।
মুনতাসিম চলে যেতেই সাহেলা চৌধুরী রাগান্বিত হয়ে কক্ষে প্রবেশ করল। মুখশ্রীতে তার বিরক্তি ফুটে উঠেছে। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,
–এটা আপনি কি করলেন? আপনি ছেলেটার ভালো চাইতে গিয়ে খারাপ করে ফেলছেন। আপনি শুধু নিজের ভালোর কথাই ভেবে গেলেন। বাবা হয়েও ছেলের মনের খবর টা রাখলেন না। এভাবে নিজ হাতে ছেলেকে শেষ করে দিচ্ছেন। দু’দিন পরে ছেলের লা’শ সামনে দিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিতে হবে। সাহেলার কথায় অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল রিয়াদ চৌধুরী। ক্রোধে চোয়াল শক্ত হয়ে এল তার। সে রাগান্বিত হয়ে সাহেলা বলে হুংকার ছাড়ল। সাহেলা তেজী কন্ঠে বলল,
–আপনার ছেলের এক কথায় আপনার সব মুখের কথা হারিয়ে গেল। আল্লাহ তায়ালা দারুন একটা জিনিস তৈরি করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। কথায় থাকে না আমরা থাকতে মূল্য বুঝি না। কিন্তু হারিয়ে গেলে সেটা খুঁজি তখন বুঝে ও লাভ হয় না। কারন ততক্ষণে মানুষটা চিরতরে আমাদের জীবন থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। আমি তার সৎ মা হয়ে বলছি মুনতাসিম একটা জিনিয়াস। যাকে আল্লাহ নিখুঁত ভাবে তৈরি করেছে। যার মনে না আছে হিংসা আর আছে প্রতিশোধের নেশা। সে এমনটা একটা মানুষ যাকে দেখলে রাস্তার ধুলাবালি গুলোও তাকে ভালোবেসে ফেলে। তার ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতিও তাকে সন্মান জানায়। সে আপনাকে দ্বিতীয় বিয়ের খোঁটা দিয়েছে। এতেই আপনার বাবার ভালোবাসা উবে গেল। একটা বার ভাবলেন না যে ছেলের মা মারা গিয়েছে। সেই ছেলেকে সবকিছু মানিয়ে নেওয়ার জন্য কিছু সময় দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। ছেলে বড় হচ্ছিল নিজেই সংসারে মায়ের অভাবটা বুঝে যেত। কিন্তু আপনি তাকে সময় দেননি। তার মা মারা যাবার পরপরই আমাকে করেছেন বিয়ে! একটা বার ভাবলেন না আমি আপনার সন্তানকে আদৌও ভালোবাসব কি না। যে মেয়ের নিজের সন্তান হয়নি। সেই মেয়ে কিভাবে অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তান মনে করে ভালোবাসবে? মুনতাসিমই বা নতুন মানুষকে কিভাবে গ্রহণ করবে। মেহেভীনের কথা বলছেন। প্রাচীন কাল থেকে মেয়েদের বদনাম একটু বেশিই। যে মেয়েটা আপনার ছেলের জন্য নিজের জন্মদাতা পিতার কাছে র’ক্ষি’তা উপাধি পেল। জেনেশুনে বিবাহিত পুরুষের ঘর ভাঙে আরো কত-শত আঘাত পেল তার বাবার কাছে থেকে। দোষ না করে-ও দোষী হয়েছে মেয়েটা। কিন্তু যার জন্য আপনার ছেলেকে মেয়েটা এতটা কষ্ট দিল। সেই তাহিয়ার কোনো বিচার আপনি করলেন না! পারিবারিক সমস্যাটা না খুব গোপন একটা অসুখ। সেই অসুখে যারা পড়েছে তারা জানে মৃত্যু কতটা সহজ তাদের কাছে। একদিকে পারিবারিক সমস্যা আরেক দিকে প্রিয় মানুষের প্রতারণা। মেয়েটা ভেতর থেকে ভেঙেচুরে গিয়েছিল। সহ্য ক্ষমতা কমে গিয়েছিল দু’টো পরিস্থিতি একসাথে নিতে পারেনি। যার ফল স্বরূপ জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করে ফেলল। সে ছেলে হলে সাতগুন মাফ হয়ে যেত কিন্তু সে মেয়ে তার ক্ষমা নেই মানে কোনো ক্ষমা নেই। ভাববেন না আমি মুনতাসিমকে ভালোবেসে কথা গুলো বলেছি। আমি একজন মা আর মেয়ে হয়ে কথা গুলো বললাম। আজ মুনতাসিমের জায়গায় আমার ছেলে-মেয়ে থাকলে আমি যুদ্ধ করে শুরু করে দিতাম। সে আমার ছেলে নয় বলেই মুখে কথা গুলো বললাম। আর একটা মেয়ে সমাজের কাছে কতটা বিষাক্ত সেটা তুলে ধরলাম। আপনার ছেলেকে কষ্ট দিয়ে মেয়েটা যে ভালো আছে। এমনটা কিন্তু নয় আপনার ছেলের থেকে দশগুন মেয়েটা পুড়ছে। আপনার হাতে যদি সময় থাকে খোঁজ নিয়ে দেখবেন। কথা গুলো বলে থামলেন সাহেলা চৌধুরী। রিয়াদ চৌধুরী তখনো নিরুত্তর রইল। সাহেলা চৌধুরী কথা গুলো যেন কর্ণগোচর করেননি। সাহেলা চৌধুরী বিরক্ত হয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেলন। রিয়াদ চৌধুরী বুক ভারি করা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
শব্দরা আজ বাক্য হারিয়েছে। সুখরা হারিয়ে দুঃখে পরিনত হয়েছে। কথা বলার মেয়েটা চুপ থাকা শিখে গিয়েছে। হাসি গুলো আজ মলিনতায় ঢেকে গিয়েছে। ছন্দরা আজ সুর হারিয়েছে। চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষে বসে আছে মেহেভীন। এই প্রথম বাড়ি আসলো কিন্তু বাড়িতে বাবা নেই। বাবা ছাড়া পুরো বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার জীবন টা তো এমন হবার কথা ছিল না। তবে জীবন কেন তাকে বিষাদের মোড়ে নিয়ে এসে দাঁড়া করালো! মেয়ের নিরবতা রাইমা বেগমকে ভিষণ কষ্ট দিচ্ছে। সে মেহেভীনের মাথায় তেল দিয়ে খাবার নিয়ে আসতে গিয়েছে। শান্ত নদীর ন্যায় মেয়েটা তার শান্ত হয়ে গিয়েছে। কথায় কথায় আর ঝগড়া করছে না। মুখে মুখে তর্ক করছে না কথা বলা মানুষ যখন চুপ হয়ে যায়। তখন সহ্য ক্ষমতা ভেতর থেকে ক্ষয় হয়ে আসে। মেহেভীনের অবস্থা দেখে রাইমা বেগম ভেতর থেকে শক্তি হারাচ্ছে। মেহেভীনের সামনে এক লোকমা খাবার মুখের সামনে ধরে বলল,
–মুনতাসিম এসেছিল। এবার মেহেভীন মলিন দৃষ্টিতে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করল। রাইমা বেগম শান্ত কণ্ঠে বলল,
–তোকে বিয়ে করতে চায়। আমি বলেছি তাকে আমার পছন্দ সে পরিবার নিয়ে আসলে তবেই বিয়ে দিব। আমি কি ভুল কিছু বলে ফেলছি মেহেভীন?
–আমি এখন বিয়ে করতে চাই না মা। আমার একটু সময়ের প্রয়োজন। দিন দিন তুমি এতটা পাষাণ হয়ে যাচ্ছে কিভাবে? এই সময়ে বিয়ের কথা চিন্তা করলে!
–সবাই যদি ভেঙে পড়ে শক্তি যোগাবে কে? মায়েদের নিজের কথা ভাবার সময় নেই। তারা শুধু চায় তাদের সন্তান কিভাবে ভালো থাকবে। আজ তোর বাবা চলে গিয়েছে। কাল যদি আমি চলে যাই তখন তোর কি হবে? আমি কার ভরসায় তোকে রেখে যাব? এই দুনিয়া ভিষণ নিষ্ঠুর রে মেহেভীন। একজন শক্ত পুরুষ ছাড়া মেয়েরা বরাবরই অসহায় কথাটা তিক্ত হলে-ও বাস্তব সত্য।
–বাবার খু’নি কে সামনে না আসা পর্যন্ত বিয়ে করব না। আমাকে এতটুকু সময় দাও। তোমাকে ছাড়া নিঃস্ব হয়ে যাব। পাষাণের মতো কথা বলা বন্ধ করো মা। তোমার মেয়ে এতটাও দুর্বল নয় সে নিজের টা নিজে ঠিক করে খেতে পারবে। রাইমা বেগম কিছু বলার আগেই রহমান আর আরিয়ান প্রবেশ করল কক্ষের মধ্যে। মেহেভীনকে দেখে চমৎকার হাসি উপহার দিলেন। রহমান হাসোজ্জল মুখশ্রী করে বলল,
–খাওয়ার সময় এসে বিরক্ত করলাম?
–আপনারা নিজের মানুষ খাওয়ার সময় কি আর অসময়েই কি যখন ইচ্ছে তখন আসবেন। রাইমা বেগমের কথায় হাসলেন রহমান। সে কোমল কণ্ঠে বলল,
–মেহেভীন রাতে এসেছে?
–জি, থানা থেকে কোনো খবর পেলেন ভাই?
–না কোনো খবর পাইনি। তারা একটা খন্ড ও উদ্ধার করতে পারেনি। কথা গুলো কর্ণকুহরে আসতেই মা-মেয়ের মুখশ্রী মলিন হয়ে আসলো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রহমান বলল,
–যে কথা বলতে আসলাম। ফরিদের শেষ ইচ্ছে ছিল মেহেভীনের সাথে আরিয়ানের বিয়ে দিবে। এখন তোমাদের বাসায় একটা ছেলের প্রয়োজন আছে। নিজের বাসায় ছেলে রেখে বাহিরে যাওয়ার চিন্তা করছ না নিশ্চই। তুমি অনুমতি দিলে ঘরোয়া ভাবে বিয়ের কাজটা শেষ করে রাখতে পারি। কেসের তদন্ত শেষ হলে তুলে নেওয়ার অনুষ্ঠান করব। রাইমা বেগম জ্বলে উঠলেন। রাগান্বিত হয়ে বলল,
–আপনার ছেলে আমার মেয়েকে বেচে দিতে চেয়েছিল। জেনেশুনে এমন ছেলের সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে কখনোই দিব না। আপনার ছেলে স্বার্থের জন্য বিয়ের পরে আমার মেয়েকে বেচে দিতে দু’বারও ভাববে না। এমন নিকৃষ্ট ছেলের হাতে আমি আমার মেয়ে দিব না। আপনি না ভালো মানুষ ভিষণ ধর্ম ভিরু মানুষ। আপনি কোন বিবেকে এমন কথা বলতে পারলেন!
–আমি ভালো মানুষ জন্যই তোমাদের এখানে রেখেছি। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে তোমাদের উচ্ছেদ করে দিতো। মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে বলল,
–আপনারা এমন ভাবে কথা বলছেন। যেন আমাদের উচ্ছেদ করে দেওয়া খুব সহজ কাজ! আপনি বলবেন আর আমরা আপনাদের ভয়ে পালিয়ে যাব!
–বেশি কথা বলিস না মেহেভীন ফলাফল খারাপ হয়ে যাবে।
–আপনি কি ফলাফল খারাপ করবেন। আপনার ভালো মানুষির মুখোশ টেনে ছিঁড়ব আমি। আরিয়ান রাগান্বিত হয়ে মেহেভীনকে থা’প্প’ড় দিতে যাবে। তখনই মেহেভীন আরিয়ানের পু’রু’ষা’ঙ্গে লাথি মারে। এই জা’নো’য়া’রটা এই অঙ্গের জন্যই নিজেকে শক্তিশালী মনে করে। সেই শক্তি টাই যদি না থাকে, তাহলে কিভাবে শক্তির অপর প্রয়োগ করবে। আরিয়াম ব্যথায় কুঁকড়িয়ে উঠল। আগের থেকে দ্বিগুন ভয়ংকর হয়ে এগিয়ে আসতে চাইলে, রহমান ছেলেকে থামিয়ে দেয়। রাগান্বিত হয়ে বলে,
–ভালো কথায় সমাধানে আসতে চেয়েছিলাম। আরিয়ানের গায়ে হাত তুলে কাজটা ঠিক করলি না। আমি তোদের ছাড় দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন ব্যাপার টা তোরা ঘোলাটে করে ফেলছিস। আমার জমির সম্পূর্ণ ভাগ আমি নিব। তোদের মা-মেয়েকে ভাতের সাথে বি’ষ দিয়ে মে’রে দিব। কেউ টেরও পাবে না। সাধারণ মৃত্যু বলে চালিয়ে দিব জানিস তো সমাজের মানুষ আমায় কতটা ভালোবাসে। রাইমা বেগম রহমানের মুখশ্রীতে এক দলা থুতু নিক্ষেপ করল। ঘৃণায় পুরো শরীর রি রি করছে। রহমান রাগান্বিত হয়ে রাইমা বেগমের চুলে মুঠি শক্ত করে ধরলেন। রাইমা বেগম ব্যথায় কুঁকড়িয়ে উঠলেন। মেহেভীনের ভেতরে অদ্ভুত ভাবে শক্তি কাজ করতে শুরু করল৷ সে ঘরের কোণে রাখা বাঁশটা নিয়ে এসে রহমানের হাতে পরপর চারটা বাড়ি মা’র’লো। রহমান ব্যথায় হাত সরিয়ে নিল। মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে বলল,
–তোরা যাবি নাকি তোদের দু’টোকে এখানেই পুঁ’তে ফেলব। মানুষ ডাকব ডেকে তোদের ভালো মানুষের মুখোশ খুলব। বাবা নেই বলে যা ইচ্ছে খুশি করবি? আর আমরা অসহায় নারীর মতো সবকিছু মুখ বুঁজে সহ্য করে নিব। আমাদের এতটা দুর্বল ভাবার কিছু নেই। আমাদের জমি আমরা কত ফকিরকে দান করেছি। তোর মতো ফকিরকেও না কিছুটা জমি দান করব। এতে আমার জমি কবে যাবে না আমাদের আয়য়ের বরকত আল্লাহ তায়ালা নিজে বাড়িয়ে দিবেন। আরিয়ান রাগান্বিত হয়ে মেহেভীন গলা চেপে ধরলো। রাইমা বেগম আরিযানকে প্রহার করতে যাবে। তখনই রহমান রাইমা বেগমের মুখ চেপে ধরলো।
চলবে…..
#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৩৬
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
পুরুষালি শক্তির সাথে পেরে ওঠা এতটাই সহজ! মেহেভীনকে খুব শক্ত করে ধরা হয়েছে। মেহেভীনের সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসতে শুরু করেছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। মেহেভীন পা দিয়ে আরিয়ানের পায়ে শত-শত প্রহার করেই যাচ্ছে। আরিয়ান আগের থেকে দ্বিগুন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। মেহেভীনের করুন অবস্থা দেখে রাইমা বেগম কনুই দিয়ে রহমানের পেটে প্রহার করল। সাময়িক সময়ের জন্য হাতের বাঁধন আগলা হতেই রাইমা বেগম রহমানকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। মাটি থেকে বাঁশটা তুলে আরিয়ানের মাথায় চার-পাঁচটা বাড়ি বসিয়ে দিল। ছয় বারের বেলায় আরিয়ান বাঁশটা ধরে ফেলল। সে মেহেভীনকে ছেড়ে রাইমা বেগমকে ধরতে যাবে তখনই মেহেভীন আরিয়ানকে পা বাঁধিয়ে ফেলে দিল। মেহেভীন ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়লো। রাইমা বেগমের হাত থেকে বাঁশ নিয়ে উন্মাদের মতো আরিয়ানকে প্রহার করতে লাগলো। আরিয়ানের মস্তক বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সমস্ত শরীর নিস্তেজ হয়ে আসতে শুরু করেছে। আঁখিযুগল ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। এভাবে মারতে থাকলে ছেলেটা মা’রা যাবে রাইমা বেগম মেহেভীনকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে মেয়েটা আজ তার দ্বিগুন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। মেহেভীন আরিয়ানকে ফেলে রহমানের দিকে এগিয়ে গেল। বজ্রকণ্ঠে বলল,
–এই নোংরা হাত দিয়ে আমার মাকে স্পর্শ করেছিস। তোর এই নোংরা হাতের অবস্থা আমি কি করি দেখ। কথা গুলো বলেই নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে রহমানের হাতে প্রহার করল। সাথে সাথে রহমাম হৃদয়বিদারক চিৎকার দিয়ে উঠল। আরিয়ান জ্ঞান হারিয়েছে। রহমানের চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে এল। আরিয়ান আর রহমানকে এই অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে সবাই কানাঘুষা শুরু করে দিল। প্রাপ্তি মা প্রানপ্রিয় স্বামী আর ছেলের করুন অবস্থা দেখে উচ্চ স্বরে কান্না করতে লাগলো। মেহেভীন আর রাইমা বেগমকে অকথ্য ভাষায় গা’লা’গা’লি করতে লাগলো। কয়েকজন প্রতিবেশীর সাহায্য নিয়ে আরিয়ান আর রহমানকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। এতক্ষণে দমিয়ে রাখা সব দুর্বলতা সামনে চলে আসলো। বাড়ি ফাঁকা হতেই মেহেভীন ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো। মেহেভীনের নাক দিয়ে গ’ল’গ’ল করে রক্ত পড়ছে। তা দেখে রাইমা বেগমের বুকটা কেঁপে উঠল। ছোট বেলা থেকেই মেহেভীনের এই অসুখটা আছে। অতিরক্তি রৌদ্রে গেলে বা মাথায় বেশি চাপ লাগলেই অস্বাভাবিক ভাবে মেহেভীনের নাক দিয়ে রক্ত পড়ে। আশেপাশে কেউ নেই, যে তার সাহায্য নিয়ে মেহেভীনকে নিয়ে হাসপাতালে যাবে। রাইমা বেগম ফরিদের বন্ধুকে ফোন করল কিন্তু ফরিদের বন্ধু ফোন তুলছে না। সে হয়তো রুগী দেখায় ব্যস্ত আছে। রাইমা বেগম দিশেহারা হয়ে পড়লেন। সে মেহেভীন বিছানায় শুয়ে দিয়ে বাসায় তালা লাগিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্য বের হয়ে গেল। বাসা থেকে দশ মিনিট লাগে হাসপাতালে যেতে। রাইমা বেগম চল্লিশ মিনিট পর ফরিদের বন্ধুকে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরল। সে মেহেভীনের অসুখ সম্পর্কে অবগত আছে। তাই এসেই চিকিৎসা শুরু করে দিলেন।
–ভাবি মেহেভীনের শরীর তো ভিষণ দুর্বল। বেশ কিছু দিন ধরে খাওয়ার অনিয়ম করছে। আপনার মেয়ে এত কিসের চিন্তা করে? এতটুকু মেয়ে চিন্তা করে করে নিজেকে ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে। আমি কয়টা ঔষধ লিখে দিয়েছি। আপনি ঔষধ গুলো আনিয়ে নিবেন। আর পারলে মেহেভীন কে স্যালাইন করিয়ে নিবেন। তাহলে যদি মেয়েটার দুর্বলতা একটু কমে খাবারের অনিয়ম একদম চলবে না। আর মেহেভীনের মাথায় আঘাত লাগতে দিবেন না। এভাবে শরীর থেকে রক্ত ক্ষয় হলে যেকোনো সময় মৃত্যু হতে পারে। কথা গুলো বলেই ফরিদের বন্ধু চলে গেল। রাইমা বেগম নেতিয়ে যাওয়া শরীরে মেয়ের পাশে বসলো। রবিন নামের এক ছেলেকে ফোন দিয়ে জানালো। সে যেন এসে মেহেভীনকে স্যালাইন লাগিয়ে দিয়ে যায়।
এমন ভাবে আপনাকে চাইলাম! নিয়তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, আমার সমস্ত পার্থনার উর্ধে গিয়ে যেন আপনাকে চাওয়া মৃত্যুর মতোই সুন্দর। থাকুক না কিছু ভালোবাসার অপূর্ণতা! সব ভালোবাসা পূর্ণতা পেলে জীবনের সকল স্বাদ ফুরিয়ে যাবে, ইচ্ছেদের মৃত্যু হবে। কথা গুলো ভাবতে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছিল মুনতাসিমের। স্নিগ্ধ আঁখিযুগল মেহেভীনের ছবির দিকে বিদ্যমান। কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই ফোনটা অফ করে দিল। সে জানে এই স্পর্শটা কার ছোট ছেলে থেকে এই স্পর্শটা তাকে আদর ভালোবাসা দিয়ে এসেছে। মুনতাসিম বাহিরের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল,
–কিছু বলবেন আব্বা?
–তুমি আমার এক কথায় নিজের ভালোবাসার মানুষকে ভুলে যেতে রাজি হলে!
–আল্লাহ তায়ালা মুখ দিয়েছে বলার জন্য মুখ কি আর চুপ থাকবে আব্বা। মুখ চুপ থাকবে না তবে মন থেমে যেতে পারে। মাঝেমধ্যে হাহাকার করে উঠবে। মানুষ তো ভেতরের খবর জানবে না। ভেতরটা বোঝার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারো নেই। আমি আপনাকে বলেছি মেহেভীনকে ভুলে যাব। আমি তো একবারও বলিনি আপনার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করব। আপনাকে কষ্ট দিয়ে চাইলেই আমি মেহেভীনকে বিয়ে করে সুখে সংসার করতে পারব৷ কিন্তু পরপারে যখন আপনি আমার কাছে হিসাব চাইবেন। তখন আমি কি জবাব দিব? দীর্ঘশ্বাস বলেও একটা ব্যাপার আছে। আমি চাই না আমার প্রতিটি সুখ আপনার দীর্ঘশ্বাসের কারন হোক। আমি এই জীবনে বিয়ে করব না। আপনি আমায় অনুগ্রহ করে বিয়ের কথা বলবেন না। আমি আপনার সিদ্ধান্তকে সন্মান জানিয়েছি। আমি আশা রাখছি আপনিও আমার সিদ্ধান্তকে সন্মান জানাবেন। অপূর্ণতার জীবনে পূর্ণতার ক্ষুধা মানুষকে বাঁচতে শেখায়। আমি না হয় পরিবারের পূর্ণতা দেখেই বাকি জীবন পার করে দিব। ছেলের অভিমানের ভাষা বুঝতে সময় নিল না রিয়াদ চৌধুরী। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–আর আক্ষেপ?
–আমার আক্ষেপ থাকবে কেন? আমি তো স্ট্রং। আমি আবার মানুষ নাকি! আমি তো রোবট, আমার আবার কিসের ফিলিংস? কথা গুলো বলে বিলম্ব করল না। কক্ষ ছেড়ে বের হয়ে গেল। রিয়াদ চৌধুরী হতাশ হয়ে বেলকনির গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো।
রজনীর আঁধার নিজ নিয়মে ধরনীকে গ্রাস করে ফেলছে। চারদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। মেহেভীনের সাথে যেন পরিবেশও মন খারাপ করেছে। কেমন বিষাদের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে আছে। শরীরের সমস্ত শক্তি ক্ষয় হয়ে কখন যে নিদ্রা দেশে তলিয়ে গিয়েছিল। সে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। মেহেভীন দশ মিনিট হলো সজাগ হয়েছে। মায়ের ক্লান্ত মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে আর ডাকতে ইচ্ছে করেনি। আঁখিযুগল স্থীর হয়ে আছে উপরের দিকে অশ্রুগুলো শুকিয়ে গিয়েছে। রাইমা বেগম সজাগ হয়ে মেয়েকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
–তুই উঠে পড়েছিস?
–জা’নো’য়া’র গুলো কোথায় মা? এখনো বাহিরে আছে নাকি পুলিশ আদর করতে করতে নিয়ে গিয়েছে?
–হাসপাতালে আছে ওদের অবস্থা খুব একটা ভালো না। আমি চিন্তা করছি ওরা সুস্থ হলে আমাদের কি অবস্থা হবে? এই জন্যই তোকে বলেছি তুই বিয়ে কর। তুই বিয়ে করলে আমাদের মাথার ওপরে বিশাল ছাদ তৈরি হয়ে। আমাদের পায়ের তলার মাটি শক্ত হবে। কেউ আমাদের ক্ষতি করতে আসার আগে দশবার ভাববে।
–এখনো ম’রে’নি ওরা?
–আমি তোকে কিছু বলছি শুনতে পারসনি? তোকে ঔষধ খেতে হবে। আমি খাবার তৈরি করে নিয়ে আসছি।
–তুমি নিজেও অসুস্থ মা ডক্টর দেখিয়েছো?
–তোর আলিম আংকেল এসেছিল। ঔষধ দিয়ে গিয়েছে খেয়েছি।
–মিথ্যা কেন বলছ? রাইমা বেগম উত্তর দিলেন না। উঠে রান্না ঘরে চলে গেলন। মেহেভীন হালকা করে উঠে বসলো। আশেপাশে দৃষ্টিপাত করে ফোনটা খোঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু কোথাও ফোনের দেখা মিলছে না। সে বুঝল তার মা সরিয়েছে। হাতের স্যালাইন প্রায় শেষ হয়েই আসছে। সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মেহেভীন।
সাহেলা চৌধুরী মাশরাফিের পাশে বসেছিল। তখনই রিয়াদ চৌধুরী আছেন। রিয়াদ চৌধুরীকে দেখে মুখশ্রী কুঁচকে ফেলে সাহেলা চৌধুরী। রিয়াদ চৌধুরী দরজার কাছে থেকেই বলল,
–আমার সাথে একটু আসো তো।
–কোথায় যাবেন?
–আমার সাথে গেলেই দেখবে পাবে। কথা গুলো বলেই সাহেলা চৌধুরী নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। স্বামীর এহেন কর্মে বিস্ময় হয়ে গেলেন সাহেলা চৌধুরী। মেহেভীনের মা মেহেভীনকে খাইয়ে নিজেও খেয়ে নিল। অদ্ভুত ভাবে ভেতরে ভয় কাজ করছে তার। সে নিজের জীবনের পরোয়া করে না। কিন্তু মেহেভীন তার কিছু হয়ে গেলে মেহেভীনের কি হবে? রাইমা বেগমের ভাবনার মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠল। মেহেভীন মলিন কণ্ঠে বলল,
–দরজা খুলো না মা আর কাউকে বিশ্বাস করি না। এরা আসবে আর আমাদের অবস্থা দেখে মজা নিবে। রাইমা বেগম মেয়ের কথায় সম্মতি জানালো। কিন্তু তাদের বিরক্ত করতে কলিং বেল বেজেই চলেছে। রাইমা বেগম মনে সাহস নিয়ে দরজা খুলতে গেল। দরজা খুলে ভিষণ অবাক হয়ে গেল! রিয়াদ চৌধুরী হাসোজ্জল মুখশ্রী করে বলল,
–ভেতরে আসতে বলবেন না। রাইমা বেগম লজ্জায় পড়ে গেল। সে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল,
–ভেতরে আসুন অসময়ে আপনাদের উপস্থিতি আশা করিনি। তাই একটু অবাক হয়েছিলাম।
–মেহেভীন কোথায়? রিয়াদ চৌধুরীর কথায় রাইমা বেগমের মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। রাইমা বেগমকে নিস্তব্ধ থাকতে দেখে, রিয়াদ চৌধুরী উৎসুক দৃষ্টিতে রাইমা বেগমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তখনই মেহেভীন ধীর কণ্ঠে বলল, কে এসেছে মা? রিয়াদ চৌধুরী নিজের সাথে নিয়ে আসা জিনিস গুলো রাইমা বেগমের দিকে এগিয়ে দিল। রাইমা বেগম ভদ্রতা সুলভ সেগুলো হাতে নিল। রিয়াদ চৌধুরী মেহেভীনের কক্ষে দিকে অগ্রসর হলো। মেহেভীনের কক্ষে এসে মেহেভীন কে এমন অবস্থায় দেখে মনের অজান্তেই বুকটা হুঁ হুঁ উঠল। রিয়াদ চৌধুরীকে দেখে মেহেভীন সালাম দিল। সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। তাড়াহুড়ো করে উঠে বসতে গিয়ে হাতে টান লাগলেই মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে উঠল। রিয়াদ চৌধুরী নরম কণ্ঠে বলল,
–এতটা ব্যস্ত হতে হবে না মা। তুমি কি অসুস্থ? মেহেভীনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রাইমা বেগম বলল,
–জি, মেয়েটা আমার একটু অসুস্থ আপনারা দাঁড়িয়ে থাকবেন না বসুন। রিয়াদ চৌধুরী আর সাহেলা চৌধুরী সোফায় গিয়ে বসলো। রাইমা বেগম নাশতা নিয়ে আসতে চলে গেল। একটু পরে নাশতা হাতে ফিরল। রিয়াদ চৌধুরী হেয়ালি না করে বলল,
–আপনার বাড়ি আলা কোথায়?
–নেই ঢাকায় গিয়েছে আসতে দেরি হবে। আসলে ভিষণ আমার মা অনেক অসুস্থ হয়ে গিয়েছে। সেখানে তাকে দেখার মতো কেউ নেই। তাই মেহেভীনের বাবা একমাস থাকবে। মায়ের মুখে প্রথম মিথ্যা কথা শুনে মেহেভীনের আঁখিযুগল বড় বড় হয়ে গেল।
–আমি একটা প্রস্তাব নিয়ে আসছিলাম। মেহেভীনকে আমার বাড়ির বউ করে নিয়ে যেতে চাই। আপনাদের অনুমতি থাকলে তবেই সামনের দিকে আগাব। এমন কথায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো মেহেভীন। বিষন্ন মুখশ্রীতে লজ্জার আভাস দেখা গেল। রাইমা বেগম বললেন,
–আপনি তো হীরার জন্য আমার মেয়েকে চেয়েছেন। আমাদের নাকচ করার কোনো ক্ষমতা আছে?
–আমরা একই এলাকায় থাকি আলাদা করে খোঁজ খবর নেওয়ার বিষয়টি থাকছে না। তবে কি আমরা বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে পারি?
–অবশ্যই পারেন।
–মেহেভীনের বাবা না থাকলে কিভাবে আগাব? রিয়াদ চৌধুরীর কথায় কথা গুলো গলায় আটকে আসছে রাইমা বেগমের। এক মুখে এত মিথ্যা করা বলা যায়! তবে মেয়ের ভালোর জন্য এতটুকু মিথ্যা তো বলাই লাগবে।
–আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনাকে নাকচ করার ক্ষমতা মেহেভীনের বাবার হবে না। আমি মেহেভীনের বাবাকে সবকিছু বলব।
–আমি নিজেও মেহেভীনের বাবার সাথে কথা বলে নিব। সামনের সপ্তাহে বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ করতে চাইছি। আমার ছেলের বিয়ে তো আর যেমন-তেমন ভাবে দেওয়া যায় না। এই সপ্তাহ সবকিছু আয়োজন করার জন্য নিলাম। আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না তো আবার? মেহেভীন কিছু বলতে যাবে। তখনই রাইমা বেগম আঁখিযুলের ইশারায় বোঝায় ভুলভাল কিছু বললে সে মায়ের ম’রা মুখ দেখবে। মেহেভীন গম্ভীর মুখশ্রী করে বসে রইল। রিয়াদ চৌধুরী মেহেভীনের কাছে এসে বলল,
–দেখি মা তোমার হাতটা এগিয়ে দাও তো। মেহেভীন ভদ্রতা বজায় রাখতেই হাত এগিয়ে দিল। রিয়াদ চৌধুরী ডায়মন্ডের একটা আংটি মেহেভীনের হাতে পড়িয়ে দিল। পকেট থেকে নাকফুল বের করে সাহেলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
–এটা তুমি পড়িয়ে দাও। সাহেলার মুখভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে না। সে বিরক্ত হয়ে কাজটা করছে নাকি খুশি হয়ে। মেহেভীনের নাকের ফুলটা খুলে নতুন নাক ফুলটা পড়িয়ে দিল। রিয়াদ চৌধুরী ধীর কণ্ঠে বলল,
–এই নাক ফুলটা মুনতাসিমের মায়ের মুনতাসিম ছোট বেলায় বলেছিল, মা তুমি আমার বউকে তোমার এই নাক ফুলটা দিয়ে দিবে। সে ছোট ছিল না বুঝে কথাটা বলেছিল, বলার কিছু দিনের মাথায় হয়তো ভুলেও গিয়েছিল। কিন্তু মুনতাসিমের মা ছেলের কথা হৃদয়ে গেঁথে রেখেছিল। মৃত্যুর আগে বলেছিল তার ছেলের বউকে যেন এই নাক ফুল দিয়েই চৌধুরী বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এই নাক ফুলের মধ্যে অনেক দোয়া আর ভালোবাসা জড়িয়ে আছে মা। আশা রাখছি আমার ছেলেকে আঘাত করার মতো কোনো কাজ তুমি করবে না। আমার ছেলেটা আমার হৃদয়ের মণি তার এক বিন্দু কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না। মেহেভীন কি বলবে বা তার কি বলা উচিৎ বুঝতে পারল না। সে নিরুত্তর রইল।
চলবে…..