#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_২৮
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
শীতল হাওয়া এসে মুনতাসিমের শরীর স্পর্শ করে যাচ্ছে। শরীরে শীতের কাপড় না থাকায় কেঁপে কেঁপে উঠছে মুনতাসিম। চারদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে। বুকের মধ্যে অশান্ত নদীর মতো উথাল-পাতাল করছে। মাঠের পাশে নদীটা কেমন থম মেরে গিয়েছে। মুনতাসিমের অবস্থা দেখে তাইয়ানের ভিষণ খারাপ লাগছে। তবুও প্রকাশ করতে পারছে না। মুনতাসিমকে কোনো কথা বলা মানে, নিজের ক্ষতি নিজে করা৷ মুনতাসিম রেগে যদি তাকে দূর সরিয়ে দেয়। তখন সে কিভাবে মুনতাসিমকে আগলে রাখবে। মানুষ টা সামনে বড় ধরনের একটা ধাক্কা খাবে। কথা গুলো ভাবতেই তাইয়ানের বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। সে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মুনতাসিমকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–আপনার কি ম্যাডামের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে স্যার? আপনি ম্যাডামকে ম্যাসেজ দিয়ে নিচে আসতে বলুন। আপনি মেসেজ করলে ম্যাডাম নিশ্চই আপনার কাছে আসবে।
–কথা বলতে ইচ্ছে করলে-ও মেসেজ দিতে ইচ্ছে করছে না। আত্মসম্মান বলেও একটা ব্যপার আছে।
–আপনি অনেক শক্ত মনের মানুষ স্যার। আমি হলে জীবনে ও পারতাম না।
–এই যে আমি নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে বিলীন হয়ে যাচ্ছি। সে কথা আমি কাকে বলবো? মুনতাসিমের কথায় তাইয়ান বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। মানুষটা কথা বলে না বলে না। আবার যখন বলতে শুরু করে। জবাব দেওয়ার এতটুকু জায়গা থাকে না। তাইয়ান নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মুনতাসিম তা দেখে মুচকি হেসে বলল,
–এত অল্পতে ভেঙে পড়লে চলবে। তুমি যাকে ভালোবাসো সে তো আরো গভীর জলের মাছ। তোমার দুর্বলতার কথা জানলে, তোমাকে এক নিমিষেই চূর্ণবিচূর্ণ করে দিবে। এমন দুর্বল মানুষ আমার চাই না তাইয়ান। আমার মনে হয় আমার থেকে তোমার দূরে যাওয়া উচিৎ। তুমি না পারবে ভালোবাসাকে আঘাত করতে আর না পারবে আমাকে আঘাত করতে। তোমার এখন একটা নিরপেক্ষ স্থানে যাওয়া দরকার। মুনতাসিমের কথায় তাইয়ানের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। সে বিস্ময় নয়নে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তার মানে মুনতাসিম সবকিছুই জানে, আর সে ভেবেছে কিছুই জানে না। মুনতাসিম তাকে এমনি এমনি বোকা বলে না। সেই আসলেই বোকা। মুনতাসিম আসলেই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সেজন্যই মানুষ তাকে এতটা ভালোবাসে। সে মনকে পাথরের ন্যায় কঠিন করে নিল। কণ্ঠে কাঠিন্যতা বজায় রেখে বলল,
–আমি পৃথিবীর সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে আপনার পাশে থাকতে চাই স্যার। আমার ভালোবাসার থেকে আপনি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আপনার পাশে থেকে আমার লা’শ বের হয়ে যাবে। তবুও আমি জীবিত থাকা অবস্থায় আপনার থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও দূরত্ব তৈরি করব না। মুনতাসিমের অধরের কোণে আগের ন্যায় হাসি বিরাজ করছে। মুনতাসিম এভাবে হাসলে তাইয়ানের কেন জানি ভিষণ ভয় লাগে। সে খারাপ কিছুর আভাস উপলব্ধি করতে পারছে। কেউ যে হাসির মধ্যে দিয়েও কারো অন্তর আত্মা কাঁপিয়ে তুলতে পারে। সেটা মুনতাসিমকে না দেখলে সে জানতেই পারত না।
–আমার কক্ষটা পরিষ্কার করতে বলো তাইয়ান। আমি আজকে এখানেই থাকব। আর মেহেভীন যেন কোনো অবস্থাতেই আমার গৃহের সামনে আসতে না পারে। সে দিকে খেয়াল। সে আসতে চাইলে তাকে যেন দূরেই বিদায় করে দেওয়া হয়। একটু পুড়ে দেখুক পুড়তে কতটা আনন্দ লাগে। তাইয়ানের কথা বলার সাহস হলো না। সে কিছু গার্ডদের ডেকে বাড়িটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিতে বলল।
চন্দ্র তার আলো ধরনীর বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে। চারদিক করে তুলেছে মনোমুগ্ধকর। হিম শীতল হাওয়া বইছে। মেহেভীন জানালা লাগানোর জন্য, জানালার কাছে আসতেই কিছু সময়ের জন্য থমকে গেল। মানুষটা তবে ফিরল তার চেনা নীড়ে। কত গুলো দিন ধরে ফোন করেছে সে। তার কর্ণে একটি বাক্যই এসেছে। মেহেভীন কিছুক্ষণ নিষ্পলক চাহনিতে বাসার দিকে চেয়ে থাকলো। অনুভূতিরা আনন্দে মেতে উঠল। এবার সে মানুষটার রাগ ভাঙিয়েই ছাড়বে। মনের শহরে আনন্দের মিছিল শুরু হয়ে গিয়েছে। মেহেভীন জানালা লাগিয়ে শরীর চাদর মুড়িয়ে বাসার বাহিরে আসলো। তাইয়ান জানালার কাছে মেহেভীনকে দেখেছিল। সে দ্রুত কক্ষ থেকে বের হয়ে মেহেভীনের গৃহের সামনে আসলো। তাইয়ানকে দেখে মেহেভীন অবাক হলো! মেহেভীন কিছু বলার আগেই তাইয়ান বলল,
–আপনি এখন স্যারের কাছে যাবেন না ম্যাডাম। স্যার আপনার ওপরে ভিষণ ভাবে রেগে আছে। স্যারের রাগটা পড়ুক। তারপর না হয় স্যারের সাথে দেখা করবেন।
–আমি বেশি সময় নিব না। তার সাথে কিছু কথা বলেই চলে আসব।
–স্যরি ম্যাডাম বেয়াদবি মাফ করবেন। স্যারের কড়া নির্দেশ আছে। আপনাকে যেন স্যারের গৃহের দরজা
তেও আসতে দেওয়া না হয়। আমরা আপনাকে ওদিকে যেতে এলাও করব না। মেহেভীন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। ভেতরটা জ্বলতে শুরু করে দিয়েছে। মানুষ টাকে সে কতটা বাজে ভাবে পুড়িয়েছে। আজ যখন নিজের বেলা এসেছে। তখনই গভীর ভাবে যন্ত্রনাটা অনুভব করতে পারছে। অনুভূতি দিয়ে যন্ত্রনা গুলোকে খুব কাছ থেকে স্পর্শ করতে পারছে। কথা গুলো কণ্ঠলানিতে এসে আঁটকে গিয়েছে। তাইয়ানের সাহস হলো না মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করার৷ দু’জন মানুষ দু’জনকে এতটা ভালোবাসার পরে-ও তাদের মাঝে এক আকাশ সমান দূরত্ব। ভালো নেই কেউ। তবুও যেন হার না মানার খেলায় মেতে উঠেছে। ভালোবাসার ভিত হচ্ছে বিশ্বাস। সেটা যদি দুর্বল থাকে সেটা শক্ত করার জন্য হলে-ও পুড়তে হবে। তাইয়ান বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। মেহেভীন একবার দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করল। বুক ভরা হাহাকার নিয়ে নিজের গৃহে ফিরে গেল।
তাইয়ান চুপিসারে গৃহে প্রবেশ করল। মুনতাসিম যেন টের না সেজন্য সোজা নিজের কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো। কথায় থাকে না। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। মুনতাসিম তাইয়ানের বিছানায় বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছে। তাইয়ানকে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–ঘরের কথা পরকে বলা আমি পছন্দ করি না। প্রথম বার ভুল করেছ। মাফ করে দিলাম। এমন ভুল যেন দ্বিতীয় বার না করা হয়। সমস্ত তথ্য প্রমাণ জোগাড় করেছ?
–জি স্যার।
–আর সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সমস্ত ভিডিও মুছে ফেলা হয়েছে তো? এক চুল পরিমাণ সেই ঘটনা নিয়ে কোনো বর্ণনা নেই তো।
–কোথাও নেই স্যার সব জায়গা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। এখন যদি কারো ফোনে সেভ থাকে। তবে সেটা থাকলে থাকতে পারে। কিন্তু সে-সব ভিডিও যদি কেউ প্রচার করার চেষ্টা করে। তাহলে তার জেল হয়ে যাবে। কারো ফোনে কোনো ভিডিও থাকলে, সেটা প্রশাসনের চোখে পড়লে কঠিন শাস্তি পেতে হবে তাকে। তাই কাজেই এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই।
–তোমাকে কে বলল আমি দুশ্চিন্তা করছি?
–স্যরি স্যার।
–কালকে যেন টপ নিউজে থাকে সেদিনের অধিকাংশ ঘটনাই সব মিথ্যা। আশা করি আমাকে বেশি কিছু বলতে হবে না। সকাল সকাল যেন খবরটা দেখতে পারি। ঘরের লোককে আমি বাসায় গিয়ে দেখে নিব। মুনতাসিমের কথায় তাইয়ানের মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। সে মলিন মুখশ্রী করে মুনতাসিমকে সম্মতি জানালো। মুনতাসিমের মন মতো কাজ হয়ে যাবে। আজকে মুনতাসিমের নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। বুকের মধ্যে বসে থাকা ভারি পাথরটা মুহুর্তের মধ্যে নেমে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাইয়ানের কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল সে।
রজনীর আঁধার কেটে গিয়ে প্রভাতের আলো ধরনীকে করেছে আলোকিত। চারদিক কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। শীত কাল মেহেভীনের ভিষণ প্রিয়। যেখানে মানুষ শীতের ভয়ে কম্বলের নিচে থেকে বের হতে ভয় পায়। সেখানে মেহেভীন রোজ সকালে ঘাসের ডগায় জমে থাকার শিশির বিন্দু গুলো ছুঁয়ে দেখে। মাঝেমধ্যে জুতা খুলে ভিজিয়ে নেয় দু’টি চরণ। আজকেও বের হয়েছিল মেহেভীন। কিছুদূর যেতেই রাস্তার মাঝখানে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। মানুষটা দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছে। মানুষটাকে চিনতে এতটুকুও সময় নিল না মেহেভীন। ধীর গতিতে মুনতাসিমের কাছে এগিয়ে গেল। কোমল কণ্ঠে বলল,
–কেমন আছেন?
–মানুষ মনে আঘাত করে শরীরের খবর নেয়। এত সুন্দর অভিনয় মানুষের দ্বারাই সম্ভব।
–মুনতাসিম।
–ডোন্ট কল মি মুনতাসিম অ্যাট অল। জাস্ট কল মি স্যার। উইল রিমেম্বার। মুনতাসিমের কথায় স্তব্ধ হয়ে গেল মেহেভীন। বুকের মধ্যখানে ভিষণ যন্ত্রনা হচ্ছে। মেহেভীনকে উপেক্ষা করে মুনতাসিম গৃহের দিকে চলে গেল। মেহেভীন পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। মানুষটা যে তার সাথে কথাই বলতে চাইছে না। সে কিভাবে মানুষ টার রাগ ভাঙাতে সক্ষম হবে।
মুনতাসিমের মনটা মুহুর্তের মধ্যে বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। প্রিয় মানুষ গুলো কি জানে না। তাদের আঘাত করার পরে ওপর প্রান্তের মানুষ আঘাত করা মানুষটার থেকে বেশি পুড়ে। তাহলে জেনে শুনে কেন সামনে আসে? এই যে সে মেহেভীন কে আঘাত করল। মেহেভীনকে পোড়াতে চাইল। এখন সে মেহেভীনের থেকে দশগুণ পুড়ছে। সে মানুষ টাকে যতটা আঘাত করল। সেই কথা মনে হতেই ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। মুনতাসিম গাছের কাছে থাকা বেঞ্চে বসলো।
“বুঝেছেন ম্যাডাম। আপনাকে ভালোবেসে আপনার কাছেই সস্তা হয়ে গেলাম। আপনাকে বেশি দাম দিতে গিয়ে নিজের দামই কমিয়ে ফেললাম। আমার মান অভিমান, রাগ কখনো আপনার হৃদয় স্পর্শ করেনি। তাই রাগ ভাঙাতে আসলেন না। আপনি হয়তো বুঝেই গিয়েছেন। আমি আপনাকে কোনোদিনই ছাড়ব না। আমি এতটা সস্তা আপনার কাছে হতে চাইনি। আমি চাইনি আপনার কাছে সহজলভ্য হয়ে যেতে। আমি আপনাকে একটু বেশিই ভালোবেসেছি। তাই এতটুকু শাস্তি আমার প্রাপ্য ছিল। আপনি তো আমায় কোনোদিনই ভালোবাসেননি। দোষ তো আমারই আমি আপনাকে ভালোবেসেছি। পুড়তে হলে আমি পুড়ব। জানেন ম্যাডাম বেশি ভালোবেসে ফেলার মতো বড়ো দোষ আর নেই। মুনতাসিমের ভাবনার মাঝেই তাইয়ান বলল,
–স্যার গাড়ি বের করেছি। আমাদের ফিরতে হবে। মুনতাসিম বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে গাড়িতে উঠে বসলো। এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে বোধহয় নির্লজ্জ তার পরিচয় দিয়ে বসবে। ছুটে যাবে মেহেভীনের কাছে। নিজেকে এতটা সস্তা বানানো ঠিক হবে না। মেহেভীনের উপলব্ধি করা উচিৎ। সে মুনতাসিমকে কি ভাবে আর মুনতাসিম আসলে কি। কথা গুলো ভাবছিল মুনতাসিম। গাড়ি ছুটে চলেছে তার নিজ গন্তব্যে। শীতের সকাল হওয়ায় গাড়িঘোড়া তেমন নেই। সবাই নিদ্রা দেশে তলিয়ে আছে।
ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে আটটা বাজে রুপা কাজ শেষ করে সিরিয়াল দেখতে বসেছিল। তার পছন্দের সিরিয়াল শুরু হতে দেরি আছে। তাই সে গানের চ্যানেল খু্ঁজছিল তখনই খবরের চ্যানেলে এসে আঁটকে যায়। খবর দেখে রুপার আঁখিযুগল আপনা-আপনি বড়ো বড়ো হয়ে গেল। সে দ্রুত মেহেভীনকে ডেকে নিয়ে আসলো। মেহেভীন খবর শুনে মলিন হাসলো। এমনটা হবার কথাই ছিল। সে আগেই বুঝেছিল জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুলটা সে করেছে।
–রুপা তোর ফোনটা একটু দে তো। রুপা নিজের কক্ষ থেকে ফোনটা নিয়ে এসে মেহেভীনের হাতে দিল। মেহেভীন রুপার ফোনটা নিয়ে নিজের কক্ষে চলে গেল। মুনতাসিমের নাম্বার বের করে ফোল দিল। দু’বার ফোন বেজে কেটে গেল। তৃতীয় বারের বেলায় মুনতাসিম বিরক্ত হয়ে ফোন তুলল।
–অনুগ্রহ করে ফোন কাটবেন না স্যার। আমি আপনার সাথে কয়টা কথা বলেই রেখে দিব। কথা দিচ্ছি এতটুকু বিরক্ত করব না। মুনতাসিমের মুখশ্রীতে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল। বুকের মধ্যে উথাল-পাতাল করেছে। এমন একটা মুহুর্তের জন্য কতই না ছটফট করেছে সে। অথচ আজ সে দিনটি চলে আসলো। কিন্তু মুনতাসিমের কথা বলার উপায় নেই। মুনতাসিম কঠিন গলায় বলল,
–আপনার মতো ভালো মেয়ের আমার মতো চরিত্রহীন পুরুষের সাথে কথা বলা মানায় না। তাছাড়া আমার এত সময় নেই অযথা সময় নষ্ট করার। আপনার কাছে নিজেকে বেশি সস্তা বানিয়ে ফেলছিলাম। সেজন্য এতদিন আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে গিয়েছেন। আজ থেকে প্রতিটি মুহুর্তে আপনাকে বোঝাব। আমি আসলে কি ছিলাম। আমাকে ভাঙার মতো সাধ্য সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারো নেই। যে আমাকে ভাঙবে। তার কাছে আমি স্বেচ্ছায় টুকরো হয়ে যাই। আমার মতো খারাপ মানুষ দূরত্ব যদি আপনায় ভালো রাখে, সুখে রাখে। তাহলে এই দূরত্ব আকাশ পাতাল সমান হোক। তবুও আমার আপনার সুখ হোক। এমনিতেই আপনার পেছনে অনেক সময় অপচয় করে ফেলছি। আমার সময় এত বেশি হয়নি। যে যার তার পেছনে অপচয় করব। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম কল কেটে দিল। মেহেভীন আবার ফোন দেওয়ার চেষ্টা করল। তবে এবার ফোন বন্ধ দেখালো। মানসিক আঘাতের চিহ্ন থাকে না বলেই দুই প্রান্তের মানুষ আঘাত লুকিয়ে হাসছে। কিন্তু ভেতরটা যে পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছে। মানুষ কি সে খবর রাখে?
চলবে…..
#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_২৯
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
শীতের মাঝে-ও পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। চারদিকে মেহেভীনের নামে কানাঘুষা শুরু হয়ে গিয়েছে। খবরের কাগজে বড় বড় করে মেহেভীনকে নিয়ে লিখা হয়েছে। মেহেভীনের নামে দুই কোটি টাকা ঘুষ খাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অন্যান্য জায়গায় খবরটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলে-ও মেহেভীনদের এলাকা এখন গরম। কটু কথা শোনাতে এক চুল পরিমাণ ছাড়ছে না কেউ। রাইমা বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। তার মেয়ে এমন জঘন্যতম কাজ করতেই পারে না৷ ফরিদ রহমান পাশেই বসে ছিল। রাইমা বেগমকে কথা শোনানোর দারুণ একটা রাস্তার সন্ধান মিলেছে। এই সুযোগ তো তিনি কিছুতেই হাত ছাড়া করবেন না। সে তাচ্ছিল্য করে বলল,
–তোমার মেয়ে এতদিন এই ঘুষের টাকায় গরম দেখাতো। রাইমা আমাকে আজ একটা সত্যি কথা বলো তো। এই মেয়ে আদৌও আমার মেয়ে তো নাকি অন্য কারো? আমার সন্দেহ হয় জানো।
–মুখ সামলে কথা বলবে। তুমি কিন্তু দিনদিন ধৈর্যের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছ। আমার হাতেই তুমি খু’ন হবে বলে দিলাম।
–পুরোনো প্রেম বুঝি জেগে উঠেছে। মেয়ের কাছে পুরোনো প্রেমিক আসে। সে খবর পেয়ে মেয়েকে হাতে রাখছো। তুমি কি ভেবেছো। আমি এসব কথা বুঝি না। কে কোন মতলবে কোন পয়েন্টে হাঁটছে। সে-সব খবর আমার হাতে আছে। যার আশায় আমাকে ছাড়ার চিন্তা করছো। আমি তাকেই ধরনীর বুক থেকে গায়েব করে দিব। নিজে তো নষ্ট ছিলে মেয়ে টাকে ও নষ্ট বানিয়ে ফেলছো। নষ্ট মায়ের নষ্ট মেয়ে তৈরি হয়েছে। কথা গুলো বলেই দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। রাইমা বেগম শীতল দৃষ্টিতে ফরিদ রহমানের যাওয়ার দিকে চেয়ে আছে। দৃষ্টি যেন মনের কথা বলে দিচ্ছে। সামনে ভয়ংকর কিছু হতে চলছে। শান্ত নদীর মতো স্থীর হয়ে গেল রাইমা বেগম। কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে মেয়েকে ফোন দিলেন। মেহেভীন উত্তেজিত হয়ে বলছে,
–আমি এমন জঘন্যতম কাজ করিনি আম্মু। সবাই আমাকে অবিশ্বাস করছে। তুমি অন্তত আমাকে বিশ্বাস করো।
–আমি জানি আমার মেয়ে কেমন। তুমি উত্তেজিত হোস না। ঠান্ডা মাথায় ভাবতে থাক কে তোর নামে এমন অভিযোগ করতে পারে। আমার থেকে তোর শ্রবণ শক্তি প্রখর। তুই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুনরায় স্মরন কর। তাহলেই নিজের উত্তর পেয়ে যাবি।
–আমার একজনকে সন্দেহ হয় আম্মু। আমি অবশ্যই তার সাথে দেখা করব। কিন্তু আমার মান সন্মান যে সব নষ্ট হয়ে গেল। আল্লাহ সব সময় আমার সাথেই কেন এমন করেন। আমি কি খুব বেশি পাপ করে ফেলছি?
–এসব কথা বলতে হয় না। আল্লাহ তায়ালা আমাদের দুঃখ কষ্ট দিয়ে পরীক্ষা করেন। কখনো আল্লাহ তায়ালার ওপরে নিরাশ হবি না। তার ওপরে ভরসা রাখ। সে তোর থেকে যতটুকু কেঁড়ে নিবে। তার থেকে দ্বিগুন ফিরিয়ে দিবে অপেক্ষা শুধু সময়ের। তোর বাবা ফোন দিলে একদম ধরবি না। নিজের কাজে মনযোগ দে। আমি তোর ওপরে আশা রাখছি। তুমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারবি। রাইমা বেগম মেয়েকে ভরসা দিয়ে ফোন রেখে দিলেন। মেহেভীন গভীর চিন্তা মগ্ন হয়ে উঠল। কে তার সাথে এমন কাজ করতে পারে। সেটাই তার ভাবনাতে আসছে না। তখনই তার খেয়াল আসলো ইউএনও সাহেবের সাথে তার একটু কথা কাটাকাটি হয়েছিল। সে বলেছিল মেহেভীনকে দেখে নিবে। মেহেভীনকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করবে। তবে সে-ই কি কিছু করল। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া তো এমনি এমনি অভিযোগ উঠবে না। সবকিছু মাথার ওপরে দিয়ে যাচ্ছে মেহেভীনের। সে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। ঠান্ডা মস্তিষ্কে ভাবতে হবে। এভাবে ঘাবড়ে গেলে চলবে না। সমস্যা যখন এসেছে সমস্যার সমাধান তাকেই করতে হবে। সে মনস্থির করে নিল বিকালে ইউএনও সাহেবের সাথে দেখা করতে যাবে।
গোধুলি আলোয় ধরনীর সৌন্দর্য দ্বিগুন বেড়ে গিয়েছে। এই মনোমুগ্ধকর কর পরিবেশ কেউ উপভোগ করতে ব্যস্ত। কেউ বা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য ছুটে চলেছে শহরের অলিতে-গলিতে। চারদিকে এত মানুষ তবুও মেহেভীনের নিজেকে ভিষণ একা মনে হচ্ছে। সবকিছু থেকে-ও সে আজ শূন্য। ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ভিষণ। এই মুহুর্তে কারো একটু সঙ্গ ভিষণ ভাবে প্রয়োজন তার। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে ইউএনও সাহেবর গৃহের সামনে চলে আসলো। গাড়ি থেকে নেমে দরজায় কলিং বেলে চাল দিল। একটা মেয়ে এসে দরজা খুলে দিল। মেয়েটি নরম কণ্ঠে বলল,
–কাকে চাই? মেহেভীন নিজের পরিচয় দিল। তারপর মেয়েটি মেহেভীনকে বসিয়ে রেখে উপরে চলে গেল। একটু পরেই রেহান আঁখিযুগল ডলতে ডলতে ড্রয়িং রুমে আসলো। সবে মাত্র বাসায় এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল। তখনই কাজের মেয়ের ডাক শুনে বিরক্ত হয় সে। কিন্তু যখন মেহেভীনের নাম শুনে, তখনই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। শরীরে কাপড় পরিধান করেই নিচে আসলো। হাসোজ্জল মুখশ্রী করে মেহেভীনের সামনে বসলো।
–আকাশের চাঁদ টা আমার গৃহে তার চরণ ফেলল। আমার গৃহেটা পবিত্র হয়ে গেল। এত সুন্দর ফুল যদি সারাজীবন আমার গৃহে বাস করত। তাহলে আমার জীবনটা সার্থক হয়ে যেত। তা কি মনে করে সুন্দরী রমনী আমার গৃহে পদচারণ করল। মেহেভীন ঘৃণা ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল রেহানের দিকে। মেহেভীন শান্ত কণ্ঠে বলল,
–আপনি আমার সাথে এমনটা না করলে-ও পারতেন স্যার। মেহেভীনের কথায় রেহান বিস্ময় নয়নে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেহেভীনের বলা একটি বাক্যও তার বোধগম্য হলো না। সে চিন্তিত হয়ে মেহেভীনকে প্রশ্ন করল,
–আমি কি করেছি তোমার সাথে?
–ব্যক্তিগত সমস্যা ব্যক্তিগতই রাখা ভালো ছিল। হিংসা মানুষকে ধংস করে দেয়। সাথে নষ্ট করে দেয় মানুষের মনকে। আপনি আমার এত বড় ক্ষতি না করলেও পারতেন। এবার রেহান বুঝল মেহেভীন কিসের কথা বলছে। তার মুখশ্রীতে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল। সে বিরক্তিকর মুখশ্রী করে বলল,
–আগেই বলেছিলাম। আমার সাথে লাগতে এসো না৷ ফলাফল ভালো হবে না। কিন্তু তোমার কাছে মন্ত্রী সাহেবের টেস্ট বেশি ভালো লাগে। একটা বার আমায় টেস্ট করে দেখতে পারতে। মন্ত্রী সাহেবের থেকে আমার টেস্ট ভালো ছিল৷ হীরা ফেলে কয়লার পেছনে ছুটলে এমনই হয়। রেহানের কথায় মেহেভীনের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। সে ক্রোধে দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আছে। এর আগেও রেহান তাকে নোংরা নোংরা কথা বলেছে। মেহেভীন সেগুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। রেহান দিন দিন তার সীমা অতিক্রম করে ফেলছে। মেহেভীন শীতল কণ্ঠে বলল,
–আপনি আমার বিরুদ্ধ করা অভিযোগ গুলো তুলে নিন।
–তুমি আমার হয়ে যাও। শুধু অভিযোগ কেন তোমাকেও তুলে নিয়ে আসব। মেহেভীনের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে উঠে দাঁড়াল। রাগান্বিত হয়ে চিৎকার করে বলল,
–আমি যদি ফেঁসে যাই স্যার। তাহলে আপনাকেও আমি ফাঁসিয়ে দিব। জেলের ভাত আমি একা কেনো আপনাকেও খাওয়াব। কথা গুলোই বলেই মেহেভীন বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে মেহেভীন গৃহ ত্যাগ করল। মেহেভীন চলে যেতেই দু’জন আগন্তুক বের হয়ে আসলো। তিনজনের মুখশ্রীতে রহস্যময় হাসি। রেহান দু’জনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–শান্ত মস্তিষ্কে মেয়েটা আমাকে হুমকি দিয়ে গেল। এখন মেয়ে টাকে আমার কি করা উচিৎ? একজন আগন্তুক বলল,
–মে’রে দিন শা’লী’কে বহুত জ্বালিয়েছে। এবার ওর ম’রা’র সময় এসে গিয়েছে। সামান্য একটা মেয়ের হুমকিতে ভয় পেয়ে গেলেন ইউএনও সাহেব।
–আমাকে জ্ঞান না দিয়ে তুমি তোমার চিন্তা করো। ধরা পড়ে গেলে বাঁচতে পারবে তো।
–আমাকে ধরা এত সহজ নয়। দ্বিতীয় আগন্তুক বলল,
–নিজেকে নিয়ে এতটা গর্ব করা উচিৎ নয়। আমার মনে হয় তোমার এখন যাওয়া উচিৎ। নয়তো তুমি ধরা পড়ে যাবে। দ্বিতীয় আগন্তুকের কথায় সায় মেলালো রেহান। প্রথম আগন্তুক বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে গৃহ ত্যাগ করল। প্রথম আগন্তুক চলে যেতেই দ্বিতীয় আগন্তুক বলল,
–ওকে সরিয়ে না দিলে আমরা ধরা পড়ে যাব। মেহেভীনের সাথে ওকে ও আমরা গায়েব করে দেই স্যার? রেহান কিছুটা চিন্তিত হয়ে বলল,
–এখানো সময় হয়নি ওকে শেষ করে দেওয়ার। ওর থেকে এখনো আরো তথ্য নেওয়া বাকি আছে। তুমি এখন আসতে পারো। আমি তোমাদের আবার পরে ডেকে নিব। রেহানের কথায় দ্বিতীয় আগন্তুক গৃহ ত্যাগ করল।
বেলকনির গ্রীল ভেদ করে শীতল হাওয়া এসে মুনতাসিমের শরীর স্পর্শ করে যাচ্ছে। পরম আদুরে ভাবে শীতল আলিঙ্গনে কাঁপিয়ে তুলছে সমস্ত দেহ। নিজেকে এলোমেলো রাখতেই বেশি ভালোবাসে সে। তাইয়ান কফির মগ হাতে নিয়ে মুনতাসিমের কক্ষে আসলো। কক্ষে না পেয়ে বেলকনিতে আসলো মুনতাসিমের হাতে কফির মগটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
–স্যার ম্যাডামের বিষয়ে কিছু শুনেছেন?
–এসব বিষয়ে খবর রাখা কি আমার কাজ তাইয়ান?
–স্যরি স্যার আসলে ম্যাডামের নামে ঘু’ষ খাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
–তো আমি কি করব তাইয়ান?
–এই সময়টা আপনি ম্যাডামের পাশে থাকলে ম্যাডাম মনে জোড় পেতো।
–তোমার ম্যাডামের পাশে থাকাই কি আমার কাজ? আমার আর কোনো কাজ নেই? তুমি যাও আমি একা থাকতে চাই। বাসার সবাইকে ড্রয়িং রুমে আসতে বলো। আমার সবার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। মুনতাসিমের কথা শেষ হবার সাথে সাথে তাইয়ান অনুমতি নিয়ে বিদায় নিল। মুনতাসিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেহেভীনের সাথে বোধহয় আকাশ টারও মন খারাপ। কালো মেঘে ঢেকে আছে আকাশটা। অন্য দিন চন্দ্রের আলোয় আলোকিত করে আঁধারে ঘেরা ধরনীকে। মুনতাসিম কফি খাওয়া শেষ করে নিচে আসলো। সবাই মুনতাসিমের জন্য অপেক্ষা করছিল। মুনতাসিম আসতেই পুরো পরিবেশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মুনতাসিম এসে সোফায় বসলো। তার ফুপিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–এবার বলুন ছেলে হিসেবে আমাকে আপনার কেমন লাগে? মুনতাসিমের কথায় সুফিয়া চৌধুরীর মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। সে মুখশ্রী কালো করে বলল,
–তুই হচ্ছিস চাঁদ। আর চাঁদ হয়ে বামুনে হাত দেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। আমি আমার ভুল স্বীকার করছি। আমার ক্ষমা করে দে বাজান। আমি আর কখনো এমন জঘন্যতম অপরাধ করব না। কি করব বল। আমি তো একজন মা। আর একজন মা কখনো তার মেয়ের চোখের পানি সহ্য করতে পারবে না। আমিও মেয়ের জন্য নিকৃষ্ট মন মানসিকতার পরিচয় দিয়েছি৷ আমার মেয়ে তোকে চাইলেই তো হবে না। তোকে ও আমার মেয়েকে চাইতে হবে। এটা আমি ভালো মতোই বুঝে গিয়েছি। তুই যদি না চাস আমরা এ বাড়িতে থাকি। তাহলে কালকেই এ বাড়ি ত্যাগ করব।
–আপনি আমার ফুপি জন্য এখনো কথা বলতে পারছেন। এমন ভুল দ্বিতীয় বার হলে ভুল যাব আপনি আমার ফুপি। জ্যা’ন্ত পুঁ’তে ফেলব একদম। আমার চরিত্রে দাগ লাগানোর অধিকার আমি আপনাদের দেইনি। আর আপনাদের পেছনে যে কলকাঠি নাড়ছে। আমি তাকে-ও সাবধান করে দিচ্ছি। মুনতাসিমকে যেন সে এতটা দুর্বল না ভাবে। কে কোথায় যাচ্ছে কার সাথে মিশে আমাকে মা’রা’র পরিকল্পনা করছে। সবকিছু মুনতাসিমের মস্তিস্কে নোট করা আছে। আমার রক্ত বলে সে পার পেয়ে যাবে। এমনটা ভাবার দরকার নেই। আজ আমি শান্ত আছি। আমাকে শান্ত থাকতে দিন। আমি যেদিন ধরব। সেদিন কেউ বাঁচতে পারবে না বলে দিলাম। কথায় আছে না। চোরের দশ দিন আর সাধুর একদিন। ভালোবাসি বলে আমাকে এত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার কারন নেই। ভালো যেমন বাসতে পারি। ঠিক তেমনই ঘৃণা করে রক্তাক্ত করে দিতে-ও জানি। ঠান্ডা মাথায় সাবধান করে গেলাম। আমার সাথে গেম খেলতে হলে পাকাপোক্ত খেলোয়াড় হতে হবে। গোবর ভরা মাথা নিয়ে মুনতাসিমকে শেষ করা যাবে না। কথা গুলো বলেই স্থান ত্যাগ করল। পুরো পরিবেশে নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরলো। একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। মুনতাসিম কাকে হুমকি দিয়ে গেল। এখানে সবাই পরিবারের আপন জন। আপন মানুষ কি কখনো মুনতাসিমের ক্ষতি করতে পারে। হ্যাঁ পারে তাইয়ানের মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করলে, যে কেউ সহজেই ধরে ফেলতে পারবে। তাইয়ান মুনতাসিমের বলা কথা গুলো বুঝতে পেরেছে৷ সেজন্যই বোধহয় তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বেড়েছে। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। সমস্ত মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। মনটা হাহাকার করে উঠছে।
চলবে…..
#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৩০
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
অন্ধকারের আচ্ছন্ন চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষ। ষড়যন্ত্রের শিকার যেন হচ্ছে ঘরের প্রতিটি দেওয়াল। না পারছে স্বৈরাচারী সব ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিতে আর না পারছে সহ্য করতে। তাদের নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্র দেখে প্রকৃতিও তাদের থেকে ঘৃণায় দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়েছে। সেজন্য প্রভাতের আলোও তাদের স্পর্শ করছে না। অন্ধকার ঘরের মধ্যে নিজেদের আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত। থমকে রয়েছে ভোরের সকাল শরীর বিন্দু ঘাসের ডগায় জমতে ব্যস্ত। পাখিরা মগডালে বসে তার সুর তুলতে ব্যস্ত। কম্বলের উষ্ণতায় অলসতা ধরেছে বেশ। এই কনকনে ঠান্ডার মধ্যে ষড়যন্ত্রের বৈঠক বসেছে। পুরুষালী গম্ভীর কণ্ঠ স্বর ভেসে এল।
–এভাবে আর কতদিন মুখ লুকিয়ে থাকব? আমাকে হুকুম কেন দিচ্ছেন না! আমি আপনার কথা মতো বসে থাকতে পারব না৷ ঐ মুনতাসিম আমার পুরো জীবন নষ্ট করে দিয়েছে। আমি তাকে ধংস করে দিয়ে ক্ষান্ত হব। যুবকের রক্তে রক্তে যেন প্রতিশোধের নেশা ঘুরে বেড়াচ্ছে। জমে যাওয়া হিম শীতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা তৈরি হয়েছে। ক্রোধে মস্তিষ্ক টগবগ করছে। দেহের সমস্ত রক্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ললাটের দু’টি রগ ফুলে উঠেছে। ভাইয়ের এমন চেহারার সাথে পরিচিত রমনী। সে আদুরে ভাবে ভাইয়ের কাধে হাত রাখল।
–তুমি তীরে এসে নৌকা ডুবিয়ে দিতে পারো না ভাইয়া। মুনতাসিম আমাকে ধরে ফেলছে। ঐ বাড়িতে থাকা আমার জন্য কতটা বিপদজনক সেটা তুমি আন্দাজ করতে পারছ? আমার এক একটা দিন আতঙ্ক নিয়ে বাঁচতে হয়। এই মনে হয় মুনতাসিম মৃত্যু নিয়ে আমার সামনে হাজির হবে৷ সে শান্ত মস্তিষ্কের মানুষ তোমার থেকে দ্বিগুন ক্রোধ তার৷ সে তোমার মতো কথায় কথায় জ্বলে উঠে না। মানুষকে কিভাবে কথার যন্ত্রনায় রক্তাক্ত করে দিতে হয়৷ সেটা মুনতাসিমের থেকে শিখতে পারো না। বোনের কথায় জ্বলে উঠল যুবক। দুই ভাই বোনের বিতর্ক দেখে বেশ বিরক্ত জাফর ইকবাল। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,
–আমি তোমাদের ফালতু ড্রামা দেখার জন্য কনকনে ঠান্ডার মধ্যে আয়শী নিদ্র থেকে বেড়িয়ে আসিনি। আমার এত বছরের সাধ্য সাধনার ফল সব মুনতাসিম নিয়ে গেছে। আমার ভেতরটায় কি হচ্ছে তোমরা একবার ভেবছ? প্রতিশোধ আগুনে আমি শতবার মৃ’ত্যু বরন করি। মুনতাসিম কে চাইলেই মা’রা যায়। তাকে মা’রা’র পরে যদি ধরা পড়ে যাই। সে হ’ত্যা’র কোনো মূল্য থাকবে না। তাকে মারতে হলে এমন ভাবে মারতে হবে। যেন সাপও না ম’রে আর লাঠিও না ভাঙে৷ জাফর ইকবালের কথায় রক্তিম চোখে জাফর ইকবালের দিকে দৃষ্টিপাত করল যুবক। সে বজ্র কণ্ঠে বলল,
–আমি ধরা পড়ে গেলে যাব। তবুও মুনতাসিমের মৃত্যু আমি দেখতে চাই। প্রতিটি সেকেন্ড আমি যেমন যন্ত্রনায় ছটফট করি। তার থেকে দ্বিগুন যন্ত্রণা দিয়ে আমি মুনতাসিমকে মারব। সে বাঁচার জন্য ছটফট করবে পাশে কাউকে চাইবে। পানির জন্য আহাজারি করবে৷ কিন্তু সে কিছু পাবে না কিছু না। আমার থেকে আমার ভালোবাসার মানুষকে করেছে আলাদা। একটা জঙ্গল আমার কাঁধে দিয়েছিল ঝুলিয়ে, আমি সেই জঙ্গলকে খু’ন করে লা’শে’র ফ্রিজিং ড্রয়ারে রেখে আসছি। আমার মন যখন থেমে যায়। তখন আমি গিয়ে তার কুৎসিত মুখশ্রী দেখে আসি ভেতরে দমে যাওয়া আগুন টা আবার দাউদাউ করে জ্বলে উঠে। ভাইয়ের কথায় রমনীর অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। তার চেনা ভাইটা কিভাবে অপরিচিত হয়ে গেল। সবকিছুর জন্য তার মুনতাসিমকে দায়ী মনে হয়। সে যদি তার ভাইয়ের ভুল গুলো মাফ করে দিয়ে, একটা সুখী পরিবার উপহার দিতে পারতো। তাহলে আজ চৌধুরী ভবন হয়ে উঠল আনন্দের রাজত্ব। সেখানে সুখ আর শান্তি বসবাস করতো। রমনীর ভাবনার মাঝেই জাফর ইকবাল বলল,
–তুমি তো চৌধুরী বাড়িতে থাকো তোমাকেই কাজটা করতে হবে। যদি-ও বাসার চারপাশে সিসি ক্যামেরার অভাব নেই। তবুও তোমাকে একটা রিস্ক নিতেই হবে। তুমি যেদিন কাজটা করবে সিসি ক্যামেরা গুলো অফ করে দেওয়ার চেষ্টা করবে। মুনতাসিমের গাড়ির ব্রেক অকেজো করে দিবে। আর না হলে যেদিন মুনতাসিম কম গার্ড নিয়ে বের হবে। সেদিন আমাকে ইনফর্ম করবে বাকিটা আমি বুঝে নিব। জাফর ইকবালের কথা শেষ হবার সাথে সাথে যুবক বলল,
–তাহলে আমি কি করব?
–ভোটের আগে যেমন আড়াল থেকে মা’রা’র চেষ্টা করেছ। কিন্তু মা’র’তে ও পারোনি আবার তোমায় ধরতেও পারেনি। জাফর ইকবালের কথায় রমনী তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলল,
–এই জন্যই বোধহয় জনগণ আপনাকে ভোট প্রদান করা ছেড়ে দিয়েছে। মস্তক ভর্তি ক্রিমিনালি বুদ্ধি থাকলে-ও কাছের মানুষদের সাথে যুদ্ধ করার ক্ষমতা আপনার নেই। সে সবকিছু জানে জেনেও চুপ আছে। পরিবারের লোক বলে সুযোগ দিচ্ছে নিজেকে শুধরে নেওয়ার এখানেই আপনার আর তার মধ্যে পার্থক্য। এতটুকু বাচ্চা মেয়ে তাকে শান্ত মস্তিষ্কে অপমান করে দিল। এটা তার সহ্য হলো না সে রাগান্বিত হয়ে বলল,
–আমাকে একদম জ্ঞান দিতে আসবে না। তোমার বহুত আগে ধমনীর বুকে এসেছি৷ বুদ্ধি হওয়া বয়স থেকে মানুষ চিনতে শিখেছি। মুনতাসিমকে নিয়ে এতটা গলাবাজি করো না। কখন ছোবল দিয়ে বসবে তা গুনাক্ষরে ও টের পাবে না। দরকার পড়লে ভাতের সাথে বি’ষ মিশিয়ে দাও। এত সহজে কেউ ধরতে পারবে না। বাহিরের লোকের সাথে লড়াই করা যায়। কিন্তু ঘরের লোক শত্রুতা শুরু করলে মৃত্যু অনিবার্য। জাফর ইকবালের কথা কর্ণকুহরে আসতেই যুবক টি ক্রোধে কক্ষ ত্যাগ করল। সময় অতিক্রম হতে শুরু করেছে। সে-ও বিদায় জানিয়ে গৃহের উদ্দেশ্য রওনা দিল।
মেহেভীন এত বুদ্ধি খাটিয়ে ও সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারল না। মাথায় হাত দিয়ে নিজের কক্ষে বসে ছিল মেহেভীন। মস্তিষ্কের সাথে থেমে গিয়েছে সমস্ত শরীর বুদ্ধি গুলো সব লোপ পেয়েছে। চিন্তা গুলো অকেজো হয়ে গিয়েছে। মস্তক টা হালকা হতে চাইছে। মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠল। রুপা কাজের জন্য বাহিরে গিয়েছে। মেহেভীন উঠে এসে নিয়েই দরজা খুলে দিল। মেহেভীনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক টি নিজের পরিচয় মেহেভীনকে দিল। সে মেহেভীনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–আপনার কেসের তদন্তের দায়িত্ব যেহেতু আমি পেয়েছি। আশা রাখছি আপনি আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে আসবেন না। আমি আপনার পুরো বাড়ি তল্লাসি করতে চাই। নেহালের কথা শুনে মেহেভীন সরে দাঁড়াল। নেহাল পুরো বাড়ি তল্লাসি করল। সে বাড়ির মধ্যে সন্দেহজনক কিছুই পেল। সে মেহেভীনের সামনে আসলো। গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
–আপনি কি আসলেই অপরাধটা করেছেন?
–আমি করিনি।
–যদি করে থাকেন আমার কাছে স্বীকার করতে পারেন। আমি আপনার শাস্তি কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।
–যে কাজ আমি করিনি। আমি কেন সে কাজের মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিব?
–আপনি যা বলছেন বুঝে শুনে বলছেন তো?
–আমি মিথ্যা কথা বলি না।
–আপনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণও করতে পারেননি। এর জন্য আপনার কিন্তু জেল হবে।
–জেল হলে হবে। তবুও আমি মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিব না।
–আমার কাজ হয়ে গিয়েছে আমি আসছি। কথা গুলো বলেই নেহাল গৃহ ত্যাগ করল৷ মেহেভীন নেহালের যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। ভেতরটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করেছে। মিথ্যার বোঝা এতটা ভারি হয় কেন? দম বন্ধ হয়ে আসছে তার এমন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় সে আগে কখনো পড়েনি। বাবার কথা স্মরন করে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। এই সময় টাতে তার পাশে থেকে তাকে আগালে রাখতে পারতো। নিজের ভাবনাকে নিজেই ধিক্কার জানালো মেহেভীন। পরের দিনই মেহেভীনকে থানায় নিয়ে আসা হয়। অন্ধকার জেলের মধ্যে বসে অশ্রুকণা গুলো যেন বাঁধ মানছে না। সে নিঃশব্দে অশ্রু বিবর্জন দিচ্ছে। ভেতর থেকে একটা বাক্যই আসছে। আমার কেউ নেই। নিশ্চই নিঃশব্দে কান্না ভিষণ ভয়ংকর মানুষের দুঃখ কষ্ট গুলো যখন শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। দুঃখ গুলোর ভাগ নেওয়ার মতো কেউ থাকে না। পাশে এসে বসে বলে না এত চিন্তা কিসের আমি তো আছি। পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে নিজেকে সামলানো আর নিজেকে বোঝানো। যেটা মেহেভীনের নিজের সাথে করে যাচ্ছে। দুঃখের বোঝা ভারি হয়ে গেলেই মানুষ নিঃশব্দে কান্না করে। মেহেভীন সেটা হারে হারে উপলব্ধি করতে পারছে।
দু’টো দিন কে’টে গিয়েছে মেহেভীন জেলার অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দী হয়ে আছে। কেউ আসেনি মেহেভীনের খোঁজ নিতে। রুপা এসেছিল খাবার নিয়ে তাকে বেশিক্ষণ থাকতে দেওয়া হয়নি৷ মেহেভীনের মা মেয়ের জন্য পাগল প্রায় ফরিদ রহমান রাইমা বেগমকে দু’দিন ধরে ঘর বন্দী করে রেখেছে। সে চাইলেও আসতে পারছে না। ভেতরটা তার জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। ক্রোধে বশিভূত হয়ে গা’লি দিতেও দু’বার ভাবেনি। মায়ের দোয়া ধরনীর সমস্ত বিপদকে গ্রাস করে ফেলে। রাইমা মেয়ের জন্য অনবরত দোয়া করেই যাচ্ছেন।
দুই হাঁটু ভাজ করে মেহেভীন বসেছিল। তখনই পরিচিত কণ্ঠ স্বর কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল। মানুষটাকে দেখে ভেতরটা উথাল-পাতাল শুরু করে দিয়েছে। মুহুর্তের মধ্যে মনটা নিস্তেজ হয়ে গেল। সে ধীর গতিতে উঠে এসে মুনতাসিমের সামনে দাঁড়াল। মুনতাসিম সহজ সরল প্রশ্ন করল,
–কেমন আছেন? মেহেভীন মুনতাসিমের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিস্তেজ কণ্ঠে বলল,
–আমাকে এই অবস্থায় দেখে আনন্দ লাগছে না আপনার? কত অপবাদ, কত আপমান, কতই না দুঃখ দিয়েছি আপনাকে। আমি পাপ করেছিলাম আল্লাহ তায়ালা আমার পাপে শাস্তি দিচ্ছে। আমার করুন অবস্থা দেখে এই অধমের প্রতি দয়া জাগল বুঝি? মেহেভীনের কথায় মুনতাসিম হাসলো। সেই হাসিটা মেহভীনের হৃদয়টা রক্তাক্ত করে দিল। এই হাসি মুখটার হাসি সে কেঁড়ে নিয়েছে। মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই মুনতাসিম বলতে শুরু করল।
–আমি কখনোই আজ অব্দি আমার জন্য কাউকে নিজের সবটুকু বিলিয়ে দিতে দেখিনি। কাউকে বলতে শুনিনি আপনি আমার চোখে সবচেয়ে সুন্দর একটা মানুষ। আপনার থেকে সুন্দর মানুষ আমি কাউকে দেখিনি। আমি আজীবন তিরস্কার নিয়েই বেড়ে উঠেছি। স্পেশাল হবার জন্য আমার মধ্যে কোনোকিছুই ছিল না। আমার যা কিছু আছে সেটুকু দিয়েই সবাইকে স্পেশাল বানানোর চেষ্টা করি। আমার জন্য কেন জানি এতটুকুও কেউ করে না। মুনতাসিমের কথায় বাকরূদ্ধ হয়ে গেল মেহেভীন। অপরাধীর ন্যায় মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেহেভীনের মলিন মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে মুনতাসিমের ভেতরটা রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এই মায়াবী মুখশ্রীতে শুধু হাসি মানায় কান্না নয়। মেয়েটা কি জানে না তার এক একটি অশ্রুবিন্দু মুনতাসিমের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বাড়িয়ে তুলছে। দু’জনের মাঝে পিনপতন নীরবতা চলছে। মুনতাসিমকে দ্রুত কথা বলতে বলা হয়েছে। মেয়ে টার সামনে একদম দুর্বল হওয়া চলবে না। সে একটু গম্ভীর ভাব ধরে ফিসফিসিয়ে বলল,
–ঘুষ খেয়েছেন ভালো কথা এত অল্প টাকা কেউ খায়! একটু বেশি করে খেতে পারতেন৷ একা একা ঘুষ খেলে এমনই হয়৷ আমাকে যদি ভাগ দিতেন তাহলে আজ আপনার এই দিন দেখতে হতো না। ভাববেন না আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি৷ আমার এক বন্ধুকে এখানে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। তার জামিন করাতেই এখানে এসেছি৷ আপনাকে কিন্তু এখানে বেশ মানাচ্ছে। কথা গুলো বলেই চলে গেল মুনতাসিম। পেছনে ফেলে গেল চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া মেহেভীনকে। মুনতাসিমের কাছে সে ভালো কিছু আশা করেছিল৷ কিন্তু মানুষটা তাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে গেল। কণ্ঠ নালি দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল মেহেভীন। তাকে মানসিক ভাবে অসুস্থ করে দিয়ে চলে গেল মানুষটা। মানসিক ভাবে শান্তি না পেলে মানুষ দিন দিন পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে যায়। যে অসুস্থতার দুর্বলতা নিজে ছাড়া অন্য কেউ অনুভব করার ক্ষমতা রাখে না। মেহেভীন দেখল একজন হাসিখুশি মানুষ একটি ছেলের হাত ধরে বের হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মানুষটা যে তার জান ফেলে রেখে যাচ্ছে। ভেতরটায় যে রক্তক্ষরণ বয়ে যাচ্ছে। হাহাকার করে উঠছে বুকটা, মানুষটা দিন-রাত যন্ত্রনায় ছটফট করছে। সেটা মেহেভীন দেখল না। তা কালো মেঘের ন্যায় আড়ালে ঢেকে গেল।
চলবে…..