ক্যালেন্ডার! পর্ব: ১৮!

0
627

গল্প: ক্যালেন্ডার!
পর্ব: ১৮!
লেখক: তানভীর তুহিন!

রাত প্রায় পৌনে বারোটা বাজে। আলমারির সাথে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে হাটুতে মুখ গুজে অঝোরে কাদছে মিছিল। মিছিল নিজেকে খুব শক্ত মনে করতো কিন্তু মাত্র একদিনের মুবিনহীনতায় সে বুঝে গেছে যে সে যতই শক্ত হোক না কেনো মুবিনের জন্য তার মন তুলোর মতো নরম। আর সে তুলোর মতো মন আজ মুবিনহীনতার বেতাল হাওয়ায় বেসামাল। এতো কান্না যে কোত্থেকে চলে এলো তা মিছিল জানে না, তবে সে প্রচুর কাদছে। কেদে সব ভাসিয়ে দিচ্ছে প্রায়। তার আফসোস একটাই সে এই কান্নাটাকে পুরোপুরি বের করার জন্য চিৎকার দিতে পারছে না।

দরজা ধাক্কানোর শব্দ শুনতে পায় মিছিল। হাটু থেকে মুখ তুলতেই বাবার ডাক কানে আসে মিছিলের। মিছিল চোখ দুটো পটু হাতে মুছে নেয়, সে চায় না তার এই চোখের পানি দেখে তার বাবা চিন্তিত হয়ে পড়ুক। চোখের চারপাশ থেকে চোখের পানির অস্তিত্ব নির্মুল করে গিয়ে দরজা খুলে দেয় মিছিল। দরজা খুলতেই মিছিলের বাবা বলে, ” আমি একটু বের হচ্ছি আসতে এক-দেড় ঘন্টা লাগবে। তুই ঘুমিয়ে পড়িস না, এসে একসাথে খাবো! ”
মিছিল কন্ঠে স্বাভাবিকতা মিশিয়ে মৃদু হেসে বলে, ” কোথায় যাচ্ছো? ”
– ” এসে বলবো। ”
– ” আচ্ছা! ”

ঘড়ির কাটায় রাত ১১ টা ৫২ মিনিট। মিছিলের ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে, স্ক্রিনে ভেসে ওঠে শাওনের নাম। মিছিল ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হাপানো স্বরে শাওন বলে, ” মিছিল আমি তোর বাসার নিচে। মুবিনের খোজ পেয়েছি, তাড়াতাড়ি আয়। ওর অবস্থা খুবই খারাপ! ”

মুবিনের খোজ পাওয়া গেছে কথাটা শুনতেই মিছিলের মনটা হেসে ওঠে, কিন্তু যখনই শোনে মুবিনের অবস্থা খুবই খারাপ বুকটা যেনো মাঝ বরাবর ছিড় ধরে যায়। মিছিল কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই ফোন কেটে দেয় শাওন, মিছিল কান্নায় ভেঙে পড়ে। কয়েকমুহূর্ত কেদেই উঠে পড়ে মিছিল। তার এভাবে বসে বসে কাদলে হবে না, মুবিনের কাছে যেতে হবে তাকে। মিছিল গলায় ওড়না পেচিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। লিফট দিয়ে নিচে নামছে মিছিল। বদ্ধ এই ছোট কামড়াটায় স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে নিজের বেসামাল নিঃশ্বাস এবং হৃদযন্ত্রের শব্দ। ব্যাখ্যাব্যার্থ এক যন্ত্রনায় বারবার কুকড়ে উঠছে মিছিলের ভেতরটা।

গেটের বাইরে বের হতেই চোখের সামনে সব ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখতে পায় মিছিল। এমন তো কোনোদিন থাকেনা, রাতে তো ল্যাম্পপোস্ট এর আলো থাকে এখানে। মিছিল আরেকটু সামনে এগিয়ে আসে। সে এখন আবাসিকের রাস্তার মাঝবরাবর দাঁড়িয়ে, এই মাঝারি আকারের রাস্তায় শুধু আবাসিক নিবাসীদের গাড়িই চলাচল করে। শাওন এখানে থাকলে তো গাড়ির লাইট জ্বলতো, কিন্তু সবটাই তো অন্ধকার। মিছিল একবার শাওন বলে ডাক দেয়। কোনো সাড়াশব্দ নেই আশেপাশে। মিছিল আরেকবার ডাক দেয় এবারও সবটা সাড়াশব্দহীন। এবার মিছিলের ভয়ে ধরে যায়। একেতো এই পরিস্থিতি তারউপরে এই থমথমে পরিবেশ। আস্তে আস্তে মিছিলের ভয়ের মাত্রা বাড়ছে। হঠাৎ করে চারপাশ আলোয় ভরে ওঠে, প্রথমে জ্বলে ওঠে মাথার উপরের মরিচবাতিগুলো। চমকে ওঠে মিছিল, বিকেলবেলাও সে যখন বাসায় ঢুকছিলো তখন এসব তার চোখে পড়েনি। বিকেলবেলা এসব ছিলো কী ছিলো না তা নিশ্চিত না মিছিল। কারন তখন তার মাথায় দুশ্চিন্তার সমুদ্র ছিলো। দুম করেই মিছিলের ঠিক সামনের ল্যাম্পপোস্ট টা জ্বলে ওঠে। ল্যাম্পপোস্ট এর আলোয় এক স্পষ্ট মুখ এবং চেনা অবয়ব দেখতে পায় মিছিল। মুবিন!?

ল্যাম্পপোস্টের ঠিক নিচে কী মুবিন দাঁড়িয়ে আছে? না অন্যকেউ? নিশ্চিত হবার জন্য ছোট ছোট পায়ে সামনে এগিয়ে যায় মিছিল। হ্যা এটা মুবিনই!

মুবিনের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে মিছিল। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মুবিনের চোখদুটোর দিকে, চোখে তার বহুপ্রশ্নের দাগ। মুবিনও তাকিয়ে আছে তার জাদুকন্যার দিকে। তবে মুবিনের চোখে কোনো প্রশ্ন, উত্তরের দাগ নেই। মুবিনকে এভাবে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হবার চরম পর্যায়ে পৌছে যায় মিছিল। মুবিন কোথায় ছিলো? শাওন যে বললো মুবিনের নাকি কী অবস্থা খারাপ? তাহলে কী তার সামনে এটা ভ্রম? সে কী একবার ছুয়ে দেখবে সামনে থাকা মুবিনকে? এই ভাবনাগুলো যখন ছুটোছুটি করছিলো মিছিলের মাথায় তখনই একটা তীক্ষ্ণ হুইসেল এর আওয়াজ শুনতে পায় মিছিল। সাথে সাথে আবার চোখের সামনের দৃশ্যপট ঘুটঘুটে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। মিছিল হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার সাথে কী হচ্ছে এসব? সে কী ঘুমিয়ে আছে? এসব কী তার স্বপ্ন? আর কোনো প্রশ্ন এসে মিছিলের মাথায় দানাবাধবে তার আগেই সামনে থাকা ল্যাম্পপোস্টের লাইট জ্বলে ওঠে। মিছিলের চোখটা একটু বড় হয়ে যায় হঠাৎ আলোর প্রভাবে। আলো ফিরতেই মিছিল আবিষ্কার করে মুবিনকে। মুবিন হাটুগেড়ে বসে একগুচ্ছ গোলাপ উচিয়ে ধরে রেখেছে। মিছিল মুবিনের দিকে তাকাতেই মুবিন মায়ামাখা হাসি হেসে স্নিগ্ধ কন্ঠে বলে, ” শুভ জন্মদিন মিছিল মনি, হ্যাপি বার্থডে মাই ড্রিম প্ল্যানেট! ”

আজ কী সত্যিই মিছিলের জন্মদিন? কয়েকমুহূর্ত চেষ্টা করেও আজকের তারিখটা মনে করতে পারেনা মিছিল। তারিখ মনে করায় ব্যার্থ হয়ে নিচে ঝুকে গোলাপগুচ্ছটা হাতে নেয় মিছিল। গোলাপগুলো মিথ্যে না, তাহলে এটা তার ভ্রম নয়। মিছিল হাতবাড়িয়ে মুবিনের গাল স্পর্ষ করে এটা বোঝার জন্য যে এটা আদৌ মুবিন কিনা। মুবিন ভ্রু নাচায় মিছিলের কান্ড দেখে। মিছিল একমুহুর্তও দেরী না করে বসে শক্ত করে মুবিনকে জড়িয়ে ধরে কেদে দেয়। মুবিন মিছিলের পিঠে হাত রেখে বলে, ” বার্থডে উইশ করলাম থ্যাংকস না বলে। কান্না শোনাচ্ছো? ”

মিছিলের কান্না থামে না। কান্নার শব্দ আরো খানিক বেড়ে যায়। মুবিন আর কিছু না বলে মিছিলের পিঠে ছোট ছোট চাপড় মারতে থাকে। মিছিল মাথা উঠিয়ে কোনোমতে কান্না থামিয়ে মুবিনকে জিজ্ঞেস করে, ” কোথায় ছিলে সারাদিন? ”
মুবিন একটু চওড়া হেসে বলে, ” লুকিয়ে ছিলাম যাতে তুমি চিন্তা করে করে পেরেশান হয়ে ওঠো। আর আমি রাতে এসে তোমায় বার্থডে সারপ্রাইজ দিতে পারি! ”
কথাটা বলে শেষ করার পরমুহুর্তেই মুবিন নিজের গালে কিঞ্চিৎ ঝিনঝিন অনুভব করে এবং কানে ঠাসস! একটা শব্দ শোনে। এইমাত্র মিছিল কী তার গালে থাপ্পড় মারলো? মুবিন গালে হাত দিয়ে জিজ্ঞাসাসুচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিছিলের দিকে। মিছিল মুবিনের জিজ্ঞাসা ঘোচাতে চেচিয়ে বলে, ” আমি তোর কাছ থেকে বার্থডে সারপ্রাইজ চাইছিলাম? না আমি বলছিলাম যে বার্থডেতে আমায় সারপ্রাইজড করিস? ” কান্নায় কথা আটকে যায় মিছিলের। মুবিন এখোনো বোকাভাবে স্থিরদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মিছিলের দিকে।

মিছিলে কিছু মুহুর্ত চুপ থেকে নিজের কন্ঠ স্বাভাবিক করে বলে, ” তুই জানিস সারাটাদিন কীভাবে কাটছে আমার? কতশত আজেবাজে চিন্তা আসছিলো মাথায়। একবারও মনে হয় নাই যে এটা মাত্রাতিরিক্ত ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে? এটা কোনধরনের বার্থডে সারপ্রাইজ? সারাটাদিন নরকযন্ত্রণা দিয়ে কিরকম বার্থডে সারপ্রাইজ এটা? ” আবার কান্নার কারনে কথা আটকে যায় মিছিলের। মুবিনও চুপচাপ তাকিয়ে থাকে মিছিলের দিকে। মুগ্ধে মুগ্ধে মুগ্ধান্বিত হয়ে গেছে মুবিন। মিছিল যে এতো অল্পসময়ে তার প্রতি এতোটা দুর্বল হয়ে পড়বে সেটা মুবিনের কল্পনাতীত ছিলো। মুবিন মিছিলের যায়গায় থাকলে এভাবেই রিয়েক্ট করতো তাই মুবিন চুপচাপ থেকে মিছিলকে হালকা করার জন্য মিছিলকে বলতে দেয়। মুবিন ভাবে মিছিল হয়তো এবারও কিছুক্ষন থেমে থেকে তারপর বকাবকি শুরু করবে, কিন্তু মিছিল এবার কিছু না বলেই উঠে দাঁড়িয়ে যায়। যেই মিছিল পেছন ফিরে হাটা ধরবে তখনই মুবিন দাঁড়িয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মিছিলকে। মিছিল ছোটার জন্য চেষ্টা চালাতে থাকে, মুবিন সেদিকে খেয়াল না করে বলে, ” বুঝিনি এতোটা দুশ্চিন্তা করবে। এতো ভালোবেসে ফেললা কীভাবে? ”
– ” তুই ছাড় আমি বাসায় যাবো! ”
– ” যা গেছে তা গেছে। আমি সত্যিই বুঝিনি তোমার এতো খারাপ অবস্থা হবে। জানলে অন্যকোনো সারপ্রাইজ প্ল্যান করতাম। আসলে আমি ঐ দিন ইচ্ছেকরেই সীনক্রিয়েট করেছিলাম যাতে তোমার সাথে আমার ঝগড়া হয়। আর আমি এই কাহিনিটা করতে পারি। তুমি যদি ঐদিন আই লাভ ইউ টু বলেও দিতা তাহলেও আমি অন্য কোনো ইস্যু নিয়ে সিনক্রিয়েট করতাম। কারন আমি আজকের জন্য এই সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছিলাম তাই। সরি বুঝিনি এভাবে কষ্ট পাবে, জানলে করতাম না। তোমার বার্থডে বলে কথা, সরি বাদ দাও। ”
মুবিনের কথায় মিছিল নরম হয়ে যায়। হাত-পা ছোড়াছুড়ি না করে স্থির হয়ে যায় মিছিল। মিছিলকে শান্ত দেখে মুবিন মিছিলকে ওর দিকে ঘুরিয়ে নেয়। মুবিন মিছিলের কপালে চুমু খেয়ে বলে, ” হ্যাপি বার্থডে! ”
মিছিল কিছু না বলে চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। মিছিলকে চুপ থাকতে দেখে মুবিন বলে, ” বুঝলাম সারাদিন যেটা করেছি সেটা ঠিক করিনি। অন্যায় করেছি, মানলাম সারপ্রাইজ ও পছন্দ হয়নি। তাই বলে এভাবে চুপ থাকবা? কিছু তো বলো! ”

মিছিল আরো কিছু মুহুর্ত নিরব থেকে নিচের দিকে তাকিয়েই বলে, ” সারপ্রাইজ পছন্দ হয়েছে, সারাদিন এর কার্যকলাপ পছন্দ হয়নি! ”
– ” জানিতো এটা, অন্যকিছু বলো। ”
মিছিল মাথা তুলে মুবিনের চোখে চোখ রেখে বলে, ” আমায় লাইফে প্রথম কেউ বাবার আগে বার্থডে উইশ করলো। এই অবধি প্রত্যেকটা বার্থডেতে বাবা’ই সবার আগে উইশ করে এসেছে। তুমিই প্রথম যে বাবার আগে কোনো বার্থডেতে আমায় উইশ করলা! ”
মুবিন মৃদুহেসে মিছিলের গাল টেনে বলে, ” অভ্যাস করে নাও। তোমার এই জন্মদিন থেকে আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমার সব জন্মদিনে প্রথম আমিই তোমায় শুভ জন্মদিন বলবো! ”
মিছিল চুপচাপ তাকিয়ে আছে মুবিনের পানে। সে আর কত মুগ্ধ হবে এই ছেলের প্রতি? মুগ্ধতার সীমা তো সে বহু আগেই লঙ্ঘন করে ফেলেছে।
মুবিন বলে, ” আই লাভ….” মুবিন কথা শেষ করার আগেই মিছিল আই লাভ ইউ টু বলে মুবিনকে জড়িয়ে ধরে।

চলবে!
#thetanvirtuhin

প্রিয় গল্পপ্রেমিরা যুক্ত হয়ে যান পরিবারে!♥
” Tanvir’s Writings “

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে