কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-২০

0
279

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২০ (ক)

প্লেনে চড়ে প্রথমেই রিদওয়ান কল করলো অর্নিতাকে। অন্যান্য স্বামীদের মত করেই সেও তার স্ত্রীকে জানিয়ে দিলো সিটে বসে গেছে। পৌঁছেই আবার ফোন করবে বলেও জানিয়ে কল কাটলো। ফোন রেখে অর্নিতা গেল দাদীর ঘরে। নুপুর এসে অব্ধি সে ঘরে বসেই গল্পে মেতেছে। অর্নিতা ভেবে পায় না এত কি কথা পায় তারা বলার জন্য!

– তুই গোসল করে আমার জামা পরে নে নুপুর।

দাদীর পাশে বসে পান চিবুচ্ছে নুপুর। হাতে তর্জনীতে আছে একটুখানি চুন৷ বয়স্কদের মতই পান চিবুতে চিবুতে আঙ্গুল মুখে পুরে একটু একটু চুনও খাচ্ছে সাথে৷ ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ছে পানের পিক৷ অর্নিতা তাকে ভালো করে দেখেই হি হি করে হেসে উঠলো৷ এই মেয়ে পান খাওয়ার খায়েশ মেটাতে গিয়ে চুনসাদা কলেজ ড্রেসের বুকের কাছটা রাঙিয়ে ফেলেছে একদম। অর্নিতা হাসতে হাসতেই আবার বলল, ‘চল গোসল করবি আর আঙ্কেলকে ফোন করে বলেছিস না তুই এখানে আছিস?’

-এই নারে ভুলে গেছি একদম৷

-ইডিয়েট!

-আচ্ছা দাদী আজকের মত পানবিলাস এতটুকুই থাক। অর্নি চল তোর ঘরে।

নুপুর ছুটলো অর্নির ঘরে৷ প্রথমেই বাবাকে কল করে বলল একটু কাজে সে অর্নিতাদের বাড়ি এসেছে। এখান থেকেই টিউশনিতে চলে যাবে। নাজিম সাহেব তাকে নিতে আসবে বলতেই সে তড়িঘড়ি বলল বাবাকে আসতে হবে না নিজেই যেতে পারবে এখন কয়েকবার তো এলো এ পথে। বাবার মন মানতে না চাইলেও কন্যার জোর করায় বললেন, ঠিক আছে সাবধানে আসিস। গোসল সেরে অর্নিতার জামা গায়ে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে খাটে বসলো নুপুর। গায়ের কোট খুলে হাতে নিয়ে ফোন চাপতে চাপতে দরজা পেরিয়ে এগোচ্ছিলো অর্ণব। চোখে কিছু লাগল কি! অর্নিকে তো খাবার টেবিল গোছাতে দেখেছে তবে এ ঘরে কে? আবারও পা দুটো পিছিয়ে ঘাড় কাত করে চাইলো সে। এক পশলা বৃষ্টি শেষের শীতল হাওয়া বইলো যেন করিডোরে। স্নিগ্ধ, কোমল শ্যামা সেই মুখটা তোলপাড় করলো পাথর বুকটাতে। কালই তো মনকে শাসিয়েছিল আর যেন এই মেয়ের নামে অস্থির যেন না হয় সে। অবাধ্য মন শুনলো কই! থেমে যাওয়া পা টেনে ঢুকেই পড়লো এ ঘরটাতে। পায়ের শব্দে নুপুর চোখ তুলেই বিষ্মিত হলো খুব। অর্ণব এখানে কেন?

-আপনি?

প্রশ্নটা করেই নুপুর গলায় পেঁচানো ওড়ানাটা টেনে আরেকটু ছড়িয়ে নিলো।

অর্ণব কিছু বলল না শুধু তাকিয়ে থাকলো মেয়েটির মুখে জমা বিন্দু বিন্দু জলকণায়। অনুজ্জ্বল ত্বকেও জলের ফোঁটা চকচকে লাগছে। এতদিন সে ভাবতো শুধুই ফর্সা ত্বকে এই জলবিন্দু মুক্তোর মত সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। আজ ধারণায় বদল এসে গেল। হাত বাড়িয়ে নুপুরের কপাল ছুঁয়ে এক ফোঁটা জল সরিয়ে আনমনেই বলে উঠলো, ‘এত স্নিগ্ধতা কেন!’

-জ্বী!

হুঁশ ফিরল অর্ণবের। এত বেমালুম হয়ে এগিয়ে চলল সে কতোটা কাছে। আজকাল খুব বেশিই ভুল হয়ে যাচ্ছে। মনটারই সব দোষ জেনেশুনে বারবার ভুলের পথে এগিয়ে চলছে তার। আর এক পলও এখানে ব্যয় করা ঠিক হবে না ভেবেই উল্টো পায়ে ঘর ছেড়ে চলে গেল সে। নুপুরকে রেখে গেল এক আকাশ বিষ্ময়ে।

দুপুরের খাবারে একসাথে বসেছে নুপুর, অর্নিতা আর রিদওয়ান। রুজিনা খালা নিজের খাবার নিয়ে চলে গেছে দাদীর ঘরে একসাথে খাবেন তারা। খাওয়ার মাঝেই অর্নিতা জিজ্ঞেস করল, তুমি কি এখনই অফিসে যাবে ভাইয়া?

-কেন?

– তিনটার পর গেলে নুপুরকেও সাথে নিয়ে যেতে!

বোনের কথা শুনে অর্ণব হাত ঘড়িতে সময় দেখলো। তিনটা বাজতে এখনো পনেরো মিনিট বাকি। ইচ্ছে ছিল একটা কাজে একটু পরই তেজগাঁও যাবে। অর্নিতার কথা শুনে ইচ্ছে করেই সময় পেছালো বলল, ‘সাড়ে তিনটায় বের হব।’

-আচ্ছা। ভালো হলো রে নুপুর….

কথার মাঝেই অর্নিতার ফোন বাজলো। স্ক্রীণে খালামনির নাম দেখেই সে ফোন হাতে উঠে গেল বসার ঘরের দিকে। টেবিলে রইলো অর্ণব – নুপুর। ভাতের থালায় আঙ্গুল নড়ছে এলোমেলো অথচ একটা দানাও আর মুখে তুলতে পারছে না নুপুর। অর্ণব অতি দ্রুত খায় বলেই তার খাওয়া শেষ। বসা থেকে ওঠার আগে একটিবার তাকালো মেয়েটির দিকে। কাঁপা হাত, এলোমেলো দৃষ্টি আর জড়তার মহাসমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে যেন!

-ফোনে তো খই ফুটে মুখে সামনে এলে এমন ভেজা দরবেশ কেন হও?

কথাটা বললেও জবাবের অপেক্ষা না করেই চলে গেছে অর্ণব৷ মুখ হা হয়ে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে নুপুর। ব্যাটা জল্লাদ কি তাকে অপমান করে গেল! রিদওয়ান ভাই অযথাই তাকে এখানে ফেলে গেল জল্লাদের মুখে। তিনি তো আর জানেন না এ ব্যাটা তাকে পৌঁছে দেবে ঠিকই কিন্তু নিজের বাইক কিংবা এক রিকশায় বসে না। তাকে নিশ্চিত অন্য এক রিকশায় বসিয়ে প্রস্থান করাবে।

রিদওয়ান যখন দ্বিতীয়বার ফোন করলো তখন নুপুরের কলেজ ছুটিই হয়ে গেছে। কলেজ গেইটে দেখা হতেই রিদওয়ান প্রথমেই তাকে এক গাদা চকলেট দিয়েছে। চকলেট, আইসক্রিম পাগল মেয়ে চকলেট পেয়েই খুশিতে ঝুমঝুম করছিলো। তার খুশির ওপর লজ্জা ছিটিয়ে রিদওয়ান আকস্মিক বলে উঠলো, ‘ এখন চকলেট নাও বিকেলে রাজপুত্তুরের বাইকে চড়বে।’

– রাজপুত্তুর!
দুই বান্ধবী একসাথেই মুখ খুলেছিলো।

-তোর জানতে হবে না।

অর্নিকে কথাটা বলেই রিদওয়ান একটু এগিয়ে নুপুরের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে দিল, ‘অর্ণব কোনো রাজপুত্তুরের চেয়ে কম কিসে!’

কথাটা ভুল নয় ; নুপুরের চোখে সাত সাগর তেরো নদী পার হয়ে আসা সফেদ ঘোড়ায় চড়া রাজপুত্রই অর্ণব৷ সে নানী,দাদীর সঙ্গ পায়নি মজার ছলে কেউ কখনো এমন রাজার ছেলের গল্পও করেনি। তবুও সে কৈশোরের শুরু থেকেই কল্পনায় সাজায় তার জীবনসঙ্গীকে রাজপুত্রের বেশে। অর্ণবকে দেখার পর থেকেই সেই কল্পনায় রাজপুত্রের রূপ আশির দশকের জল্লাদের মতই গোঁফওয়ালা। কিন্তু রিদওয়ান ভাই এমন কেন বলল তাকে!

রিদওয়ান চলে যাবার পর অর্নিতা অনেকবার জানতে চেয়েছে কি বলল অমন ফিসফিসিয়ে? নুপুর মুখ খোলেনি লজ্জায় রাঙা হয়েছে শুধুই। কিন্তু এখন অর্ণবের কথা শুনে লজ্জা উবে রাগ হচ্ছে। যাবে না সে এমন ভেড়ার ছানার সাথে। ভেড়াই একটা যখনই মুখ খোলে রুক্ষ সুক্ষ গলা শোনায়। অর্নিতার ফোনালাপ শেষ হয়েছে মাত্রই। বিয়ের দিনের পর থেকেই রোজ কল আসে খালামনির। আগেও আসতো তবে এখন আলাপে ভিন্নতা এসেছে অনেক। আগে শুধুই অর্নিতার খোঁজ নিতো, কখন ও বাড়ি ফিরবে কৈফিয়ত চাইতো এখন সেসবের পরিবর্তে সকল কথা রিদওয়ান কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। ছেলেটা কল করলো কিনা, দুজনাতে ভাব ভালোবাসা হবে এমন কোন গল্পই যেন খালামনির একান্ত আলোচনার বিষয়। আর প্রত্যেক মুহূর্তের একটাই চাওয়া সময় কাটুক ঘোড়ার খুঁড়ে টগবগিয়ে । পরীক্ষা শেষ হলেই বউ ঘরে তুলবেন তিনি সে অপেক্ষাতেই এখন দিন গুণছেন। অর্নিতাও কল কেটে আর খেতে বসলো না। খাওয়ার ইচ্ছে মজে গেছে এখন। টেবিল গুছিয়ে দোতলায় উঠে নুপুরকে নিয়ে বসলো অল্প সময়। চোখের পলকেই সাড়ে তিনটা বেজে গেল। অর্ণব নিজের ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই নুপুর বেরিয়ে পড়লো তৈরি হয়ে। দাদী আর অর্নিতার কাছে বিদায় নিয়ে গেইটের কাছে পৌছুতেই অর্ণবও এলো। রিকশা ডেকে নুপুরকে বসতে ইশারা করে দাঁড়িয়ে রইলো সে। তা দেখেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বসলো নুপুর। এরপর….. খুব আচমকা তাকে ভড়কে দিয়ে তার পাশেই অর্ণব বশে পড়লো। শিরশিরে মৃদু বাতাস কাঁপিয়ে দিয়ে গেল নুপুরকে। এ কি স্বপ্ন নাকি সত্যি!

_____________

সময়ের জন্য অপেক্ষা চলে না। অপেক্ষায় সময় থমকেও যায় না কারো। রিদওয়ান ঢাকা থেকে চলে যেতেই বাশার শেখ নিজেও গেলেন সেখানে। রাঙামাটির পাহাড় ঘেঁষে এক খন্ড জমি কিনলেন তিনি। রিদওয়ান আর রিমন দুজনেরই অজানা ছিলো বাবার পরিকল্পনা। এদিকে রিদওয়ানেরও নিজ ভবিষ্যৎ নিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা বাবার অজানা। তিনি পুত্রকে আটকাতে চাইছিলেন পাহাড় খন্ডে পুত্র আগেই নিজের অবস্থান ঠিক করেছিলো পর্তুগালের এক শহরে। শেখ পরিবারে হঠাৎ করেই নেমে এলো এক তোলপাড় করা দূর্যোগ। বাবা ছেলেতে শুরু হলো স্নায়ুযুদ্ধ। ততদিনে অর্নিতারও ফাইনাল পরীক্ষা শুরু। রিদওয়ান বাড়িতে একমাত্র মায়ের সাথেই কথা বলতো নিজের সকল পরিকল্পনার। চট্টগ্রামে ঠিক সাত দিন থেকেই ঢাকায় ফিরেছিলো সে। ইচ্ছে থাকলেও একবারও যায়নি অর্নিতার কাছে। রোজ রোজ হাতে গুনে অল্প একটু সময় অর্নিতার সাথে ফোনালাপ করে তারই মাঝে জানিয়ে দেয় তার বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। অর্নিতা অনুভব করতে পারে রিদওয়ানের অপারগতা। শুধুমাত্র অর্নিতা যেন সংসারে বাঁধা না পরে সেজন্যই তার এই বিদেশ বিভূঁইয়ের সিদ্ধান্ত। বাশার শেখের কান অবধি এ খবর পৌঁছুতেই তিনি দেখা করেন অর্নিতার সাথে। সবসময়ই কোমল সুরে কথা বলা খালুজান সেদিন সর্বোচ্চ রূঢ় আচরণেই কথা শুনিয়ে যান অনেকগুলো। বাড়ির কেউ জানতেই পারলো না সে কথা। অর্নিতার শেষ পরীক্ষার দিনই ফ্লাইট ডেট পরে রিদওয়ানের। যাওয়ার সময় বাবা-মা, ভাই-বোন, আর অর্ণবকে দেখতে পেলেও অর্ধাঙ্গিনীর দেখা মেলে না শেষ মুহূর্তে। বুকের ভেতর হু হু করে জেগে উঠা কান্না বুকের ভেতরই চাপা পড়ে রিদওয়ানের। অর্নিতারও হয় একইদশা। বলতে নেই, গত মাস ছয়েকেই একটু একটু করে তাদের সম্পর্ক কাছের হয়েছিলো অনেকটা। ভালো বাসাবাসি দু পক্ষের না হলেও ভালো লাগার শুরুটা হয়েই গিয়েছিল অর্নিতা। রিদওয়ান তাতেই যেন তৃপ্ত হয়েছে। তবুও অপেক্ষা তার এই ভালো লাগার শেষটা যেন ভালোবসাই হয়।

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২০(খ)

‘মুখ নেই তোর…. গাধা! ভালোবাসি মুখে বলতে সমস্যা কোথায়?’

ধমকের সুরেই বলছে রিদওয়ান এদিকে লজ্জায় কখনো ওড়না মুখে পুরছে, কখনো নখ কামড়াচ্ছে আবার বইয়ের পাতা টেনে ছিঁড়ে ফেলছে। ফোনের দু প্রান্তে দুজনের অবস্থা দেখলে এ মুহূর্তে যে কেউ বলেই ফেলবে দুটোর মাথায় গন্ডগোল আছে বিরাট মাপের গন্ডগোল। রিদওয়ান যাওয়ার পর থেকেই তাদের ফোনালাপ বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। আজকাল অর্নিতাকে পড়ার টেবিল আর বিছানা ছাড়া সচরাচর কোথাও পাওয়া যায় না অবশ্যই পাশে ফোন থাকবে। রিদওয়ান যেতে যেতে অর্নিকে শাসিয়ে গিয়েছিল, ‘বউ ফেলে বিদেশ যচ্ছি বড় মাপের ত্যাগ স্বীকার করে। তোর মেডিকেল চান্স যেন মিস না হয় মনে রাখিস, চান্স মিস হলে আমার এই ত্যাগের প্রতিদানে বছরে বছরে বাচ্চার মা হতে হবে।’

রিদওয়ানের এই নির্লজ্জ কথাবার্তায় অর্নিতার নিঃশ্বাস আটকে আসা অবস্থা। প্রথম প্রথম একটু আধটু এমন বললেও পরে একেবারেই লাগামহীন হয়ে পড়েছে সে। অর্নিতারও লাজ কমেছে কিছুটা। আজকাল সে সহসাই অপ্রস্তুত হয় না। এই তো কদিন আগেই সে পড়া রেখে নুপুরদের বাড়ি গেল প্রথমবার। অল্প সময়েই ফিরবে বলেও একরাত পার করে ফিরলো। সে রাতে ঝড়বৃষ্টি থাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল নুপুরদের। ওয়াইফাই কানেকশন নেই উপরন্তু, অর্নিতার ফোন চার্জ নেই বন্ধ পড়েছে । রিদওয়ানের কাছে নুপুরের নম্বর নেই আর মাথায়ও এলো না অর্ণবের কাছ থেকে নেওয়ার। সব মিলিয়ে একটা দিন-রাত আর কথা হলো না দুজনার। পরের দিন বাড়ি ফিরতেই দাদী থেকে শুরু করে বৃষ্টি আপু পর্যন্ত প্রত্যেকের কাছেই শুনতে হলো, ‘অর্নিতা তোর জামাই পাগল পাবনা পাঠা।’

অর্নিতার সাথে যোগাযোগ না করতে পেরে অর্ণব আর তার আব্বু ছাড়া বাকি সকলকেই সে ফোন করে করে বউকে চাই বলে পাগল করে দিয়েছেে। সেদিন সকল লজ্জা কাটিয়ে সেই প্রথম ধমকে উঠেছিল সে, ‘এ্যাই তোমাকে বিদেশে কে যেতে বলেছে, হ্যাঁ! বউ কি চুরি হয়ে গেছে? একটা দিন কথা না হওয়াতে এমন করতে হবে? লোকে কি ভাববে এসব দেখলে দুনিয়ায় আর কারো বউ নেই নাকি৷’

কে কি ভাবলো সে নিয়ে রিদওয়ানের মাথাব্যথা নেই। তার এক কথা, ‘আমার বউ নিয়ে আমি অস্থির হবো না তা কি হয়! কত সাধের বউ আমার।’

এরপর সত্যিই আর মুখ খোলার জো নেই অর্নিতার৷ তবুও রোজ কপট রাগের ভাণ করে। চোখের পলকে যখন মাস কতক পেরিয়ে অর্নিতার পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলো সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিলো আরেক পরীক্ষার পড়া। মেডিকেলে চান্স পেতেই হবে রিদওয়ান জোর খাটিয়ে কথাটা বললেও মনে মনে সে ভেবেই নিয়েছে সরকারিতে চান্স না হলে সে টাকা ঢালবে খুব৷ বেসরকারিতেই না হয় পড়বে তার বউ। এ নিয়েও তার বেড়েছে ব্যস্ততা। অর্নিতা পড়ায় ব্যস্ত রিদওয়ান কাজে। পর্তুগালের লিসবনে গিয়েছিলো সে এক বন্ধুর মাধ্যমে কাজ পেয়ে। কাজটা ছিলো কোন এক রেস্টুরেন্টের। পার্ট টাইম জব পেয়ে গেলেও পরবর্তীতে আরও অনেক খোঁজ নিয়ে সে যুক্ত হয়েছে কার কোম্পানিতে। প্রথম প্রথম পর্তুগিজ না জানার ফলেই রেস্টুরেন্ট জবটাতে ভীষণ ঝামেলা পোহাতে হতো৷ দ্বিতীয় জবটার সময় কিছুটা শেখা হয়ে গেছে সে দেশীয় ভাষা তারওপর সেখানে ইংলিশটাই বেশি কাজে দিয়েছিল। দুজনের দু দিককার পরিশ্রম একটাই স্বপ্নের পেছনে ঢালছিলো তারা। বিদেশে এসে মা, ভাই, বোনের সাথে সম্পর্ক ঠিক থাকলেও সম্পর্কের সুতো ঢিল হয়ে গেছে বাবার সাথে। বাশার শেখ খোঁজ নেন না বড় ছেলের আর ছেলেও সরাসরি নেয় না বাবার খোঁজ। তবুও ভালো কাটছে জীবন ছন্নছাড়া রিদওয়ানের। আপাতত তার অপেক্ষা শুধু অর্নির ভর্তি পরীক্ষার ফল জানার।

________

সময়গুলো খুব ফ্যাকাশে কাটছে নুপুরের। ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার আগে থেকেই যোগাযোগ কমে এসেছে অর্নিতার সাথে। না চাইতেও বান্ধবীকে স্পেস দিতে হচ্ছে এই যেন বড় দুঃখ তার। আজকাল তো কোন বাহানাতে অর্ণবকেও দেখার সুযোগ নেই। সকালে নাশতা সেরে কিছুক্ষণ নিজের ঘরেই এটা সেটা নিয়ে। দশটার পর টিভি খুলে বসে বিখ্যাত সব জলসা আর জি বাংলার সিরিয়াল দেখতে। জীবনে সবচেয়ে অপছন্দের কাজটাই ছিলো তার বাংলাদেশের নারীদের অতি প্রিয় সব সাংসারিক কূটনীতি সমৃদ্ধ সিরিয়ালগুলো অথচ পড়াশোনার বিরতিতে ছোট মায়ের সঙ্গ তাকে সেসবই দেখার অভ্যাস গড়ে দিয়েছে। প্রায় এগারোটা পর্যন্ত এসবে সময় ব্যয় করে আস্তে ধীরে বাথরুমে ঢোকে সে। গোসল, নামাজ আর খাওয়ার পর এক ঘন্টার ভাতঘুম শেষে সাড়ে তিনটায় বের হয় টিউশনিতে। চারটা থেকে টিউশনি তার স্থানও বাড়ি থেকে রিকশায় দশ মিনিটের রাস্তা। তবুও সে আগেই বেরিয়ে হাঁটতে হাটতে এগিয়ে চলে পথটুকু৷ আজকাল সময় খরচের জন্যই যেন তার এই পায়ে চলা পরিশ্রম। মন খারাপ হয় অর্ণবকে ভেবে সেই মন খারাপটুকুকেও যেন চলতি পথে টানতে টানতে ক্লান্ত করে দিতে চায়৷ পাষাণ সেই জল্লাদকে মনে করে লাভ কি তার! সে ব্যক্তি জানে তো তার মনের ঘরের তান্ডব চলে লোকটার। অথচ কি অনায়েসেই না তাকে এড়িয়ে চলে মানুষটা! সেদিন তো তার জন্মদিন বলেই এসেছিলো অর্নিতা তাদের বাড়িতে। নুপুর ভেবেছিলো লোকটার কানে পৌছুবে তার জন্মদিনের কথা আর তা জেনে নিশ্চয়ই একটিবার শুভেচ্ছা জানাবে৷ কিন্তু লোকটা সব জেনেও উইশ করেনি এমনকি অর্নিতাকে দিতে এসে তাদের গেইটের বাহিরেই দাঁড়িয়ে ছিল। নুপুরের বাবা কত করে বলল, ভেতরে এসো একটু বসে যাও। শুনলো না সে কথাটা। সেদিনের কথা ভাবতে ভাবতেই নুপুর পৌছে গেল ছাত্রের বাড়ির দরজায়৷ এমনই হয় তার আজকাল। লোকটার কথা ভাবতে ভাবতে কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে যায় টেরই পায় না। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বাড়ির ভেতর ঢুকে যায় নুপুর। তাকে ভেতরে ঢুকতে দেখেই উল্টো দিকে পা বাড়ায় অর্ণব৷ হ্যাঁ অর্ণব রোজই এমন করে। কবে থেকে ঠিক মনে পড়ে না তার সে আনমনেই এসে দাঁড়ায় এ পাড়ার মোড়ে৷ যেদিন প্রথম সে নুপুরকে পাশে বসিয়ে পৌঁছে দিয়ে গেল তার ছাত্রের বাড়িতে সেদিনের পর হঠাৎ করেই সে এসে উপস্থিত হয় এখানটায়। রোজ ঠিক এ সময়েই তার অবচেতন মন অপেক্ষা করে এই মেয়েটিকে এক পলক দেখার জন্য। তোলপাড় করা বুকের ভেতর টিমটিমে এক আলো হয়ে ধরা দিচ্ছে মেয়েটা তাকে৷ মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় এগিয়ে এসে আদেশ করে, চলো তো আমার সাথে৷ একটা দুপুর কাটিয়ে নেবো নিরালায় কোন নির্জনতায়। পরমুহূর্তেই মনে হয় এ অন্যায় সে কি করে করবে! বহুদিন ধরেই খালুজান তার প্রতি বিরূপ আচরণ করছেন৷ ভয় হয় অর্নিতাকে নিয়ে তিনি বোধহয় রিদওয়ানের বিয়েটা নিয়ে খুশি নন৷ তারওপর বৃষ্টির আচরণ তাকে ভীত করছে অনেক বেশি। জটিল জীবনটাকে কিছুতেই সরল সমীকরণে আনা যাচ্ছে না বলেই আরও বেশি করে লুকিয়ে রাখছে নিজের অনুভূতিকে। নুপুর মিষ্টি একটা মেয়ে, প্রাণচঞ্চল আর ভালো একটা মেয়ে সে ভালো থাকুক তার জগতে৷ অর্ণবের জীবনের প্যাচ লাগা জালের ভেতর আটকে গেলে তাকে ছটফটিয়ে দম ত্যাগ করতে হবে এমনটা ভেবেই আরও আড়াল হয়ে যায় অর্ণব৷ নিজের মতই সবটা ভেবে ভেবে আর এগোয় না সে কিন্তু আজ ঠিক ধরা খেয়ে গেল৷ অর্ণব ভেবেছিলো নুপুর তাকে দেখেনি। সেও এবার জায়গাটা ত্যাগ করার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে ভেসে এলো চেনা স্বর, ‘পুরুষ মানুষ কাপুরুষ হয় জানতাম তাই বলে এতোটা আজ বুঝতে পারলাম।’

-মানে!

-রোজই মনে হতো কেউ বুঝি নজর রাখছে৷ আম হাতেনাতে চোর ধরেই ফেললাম।

ফূর্তির সঙ্গেই বলছে নুপুর। অর্ণব কপাল কুঁচকে দাঁতে ঠোঁট চেপে নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে নুপুরের দিকে তাকিয়ে।

-এভাবে তাকাচ্ছেন কেন?

-বোকার হদ্দ দেখলে আর কেমন করে তাকানো যায়?

-এহ, ধরা খেয়ে এখন ড্রামা করছেন। আপনি সবসময়ি আসেন আমি টের পাই৷ কি দেখেন রোজ!

শেষের কথাটা বড় আকুলতা মিশিয়ে বলল নুপুর। অর্ণবের খারাপ লাগছে মুখের ওপর মিথ্যে বলতে তবুও বলতে হবে।

-একটা কাজে এসেছিলাম। ব্যাপারটা কাকতালীয় তাই যেচে কোন ভুল ধারণ পুষে ফেলো না।

-কাকতালীয়!

-হ্যাঁ

-বুকে হাত রেখে বলুন তো।

– তুমি না টিউশনিতে এসেছিলে এখানে দাঁড়িয়ে বকবক করছো কেন?

-যাচ্ছি। হুহ…. ঢং দেখলে আর বাঁচি না। লুকিয়েই রাখেন নিজের আবেগ৷ একদিন আমার জন্য ঠিক কাঁদাবো আপনাকে ব্যাটা জল্লাদ। কিছু না কিছু তো ফিল করিসই বললে কি হয়! নাকি আমি কালো বলে অবহেলা করছিস?…… বিড়বিড় করতে করতেই চলে গেল নুপুর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্ণবও চলে গেল জায়গাটা ছেড়ে। সত্যিই সে ফিল করে নুপুরকে, ফিল করে সেই আবছা ভোরে দেখা শ্যামা কন্যার তেল চিটচিটে মুখের মায়াকে। ফিল করে সেই ভেজা চুলের স্নিগ্ধতায় ডোবা মেয়েটিকে কিন্তু ভাগ্য! তার ভাগ্য যে বড্ড দূর্ভাগা। ঠিকই বলে গেল মেয়েটা কাঁদতে হবে তাকে এই মেয়েটির জন্য যদি নিজেকে এখনই না সামলায়। যত দিন গড়াবে হদয়ের দূর্বলতা ততোই হবে গাঢ়।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে