#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১৯ (ক)
মাথার ওপর এক ফালি চাঁদ, সামনে শান্ত তটিনী আর পাশে একান্ত ব্যক্তিগত চন্দ্রিমা। আঁধার ঘেরা শান্ত এই নদীর পাড়ে এক খন্ড সুখ পাশে নিয়ে বসে আছে ভাবতেই রিদওয়ানের অন্তর পুলকিত হয়। থেকে থেকে বাতাসের ঝাপটা গায়ে লাগে সেই সাথে নাকে এসে লাগছে অর্নিতার গায়ের সুবাস। আধখাওয়া চাঁদের শুভ্র আলোয় নদীর পানি চিকচিক করছে। ঝিরিঝিরি বাতাসে গায়ের পাতলা শাড়ি ভেদ করে খুঁচিয়ে দিচ্ছে পশমের গোড়ায়। দাদীর সাজিয়ে দেওয়া বেশে রিসোর্টে এলেও তা একটু আগেই বদলে নিয়েছে অর্নিতা। গায়ে জড়িয়েছে রিদওয়ানের দেওয়া পাতলা হ্যান্ডপেইন্টেড সুতির শাড়ি আর চিকন এক গাছি স্টিলের চুড়ি। রিদওয়ান চট্টগ্রামে নিজস্ব গাড়ি নিয়ে যায়নি বলে বাড়ি থেকে উবারে গাজীপুর এসে নামে ঠিক রিসোর্টের সামনে। আগে থেকে বুকিং না থাকায় প্রথমেই তাই থাকার ব্যবস্থা করে অর্নিকে তাদের নির্দিষ্ট কক্ষে বসিয়ে দেয়। আকাশ তখন সন্ধ্যের আয়োজনে রাঙা গৌধূলিকে বিদায় জানাতে তৎপর। অর্নি বসে বসে দেখছিলো কক্ষের ভেতরটা। রিদওয়ান তার দৃষ্টি খেয়াল করে বলল, ‘ ওপাশের দরজাটা খুলে সামনে যা দারুণ জায়গা ওপাশটায়।’
অর্নিতা নিঃশব্দে তাই করলো। দরজা খুলতেই আবছা আঁধার ছাপিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকলো অবাধ্য হাওয়ার দল। চক্ষু মেলে সামনে লক্ষ্য করতেই চোখে পড়লো কাঠের সরু পথ যার শেষ টলটলে জলের ধারার সূচনাতে। সহজ করে বলায় যায় বেলকোনির মত অংশটা শেষ হয়েছে জলের শুরুটা যেখানে। লেকের মত লম্বা সে পুকুরটাতে পাশাপাশি অনেকগুলো বেলকোনিসহ কক্ষ। প্রতিটাই বোধহয় অর্নিতাদের রুমের মত বড়সড় একটি কাঠের ফ্ল্যাট। দরজা খুলতেই চমৎকার একটি বসার ঘর তার পেছনেই একটা বেডরুম, লাগোয়া বাথরুম আর এই বেলকোনিটা। মজার ব্যাপার হলো এখানে কোন কিচেন নেই। খাবারের দিকটা সম্পূর্ণ কতৃপক্ষের হোটেল ম্যানেজমেন্টেই দেখা হচ্ছে। রিদওয়ানের এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। একটি মাত্র রাত আছে তার হাতে এরপর আবার তাকে ফিরতে হবে চট্টগ্রামের সেই পাহাড় কাটা ঝোপে জঙ্গলে। আব্বুর পরিকল্পনা সে জানে না তবে এইটুকু তার বোঝা হয়ে গেছে, আব্বু খুশি নয় তার বিয়েতে। তাইতো সে আজ কাউকে না জানিয়েই ছুটে এসেছে প্রিয় চন্দ্রিমাকে একটুখানি কাছ থেকে দেখতে। ভাগ্যিস, দাদী অনুমতি দিয়েছেন নইলে অর্ণব পর্যন্ত অনুমতির আবেদন তার পক্ষে অসম্ভব হতো। হাতে সময় কম আর সুন্দর মুহূর্তটা ফুরিয়ে না যায় তা ভেবেই সে নিজের ব্যাগ থেকে শপিং ব্যাগটা বের করে এগিয়ে দেয় অর্নিকে।
– হুট করে আসা তো তেমন কিছু আনতে পারিনি তোর জন্য। দ্যাখ তো এটা পছন্দ হয় কিনা!
অর্নিতা হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় ব্যাগটা। আলতো হাতে খুলে দেখতে পায় শুভ্ররঙা শাড়ি আর সাথেই দু মুঠো চুড়ি। ভারী পছন্দ হয় শাড়িখানা তা যেন অর্নিতার চোখ দেখেই বুঝে নেয় রিদওয়ান। সেও সুযোগ পেয়ে আদেশ করে, ‘অত ভারী শাড়ি পরে কতক্ষণ থাকবি৷ ওটা বদলে এটা পরে আয় আমি বাইরে যাচ্ছি খাবারের অর্ডার করতে।’
রিদওয়ান রুম থেকে বের হতে গিয়েও ফিরে আসে আবার, ‘খাবার কি রুমে খাবি না বাইরে?’
– যেখানে বলবেন….
গাড়িতে বসার পর থেকে এ পর্যন্ত সময়ের মাঝে এই প্রথম কথা বলল অর্নিতা। রিদওয়ান বেরিয়ে যেতেই সে ঝটপট শাড়ি বদলে নেয়। রিদওয়ান ফিরে এসে দেখলো শাড়ি গহনায় এখনো পুচকে মেয়েরাকে পাক্কা বিবাহিত রমনীই লাগছে। হঠাৎই তার মনে হলো অপরিচিত পরিবেশে এত স্বর্ণালংকার রিস্কি না হয়ে যায়। হালকা পাতলা বলেও প্রায় ভরি তিনের বেশি স্বর্ণ আছে মেয়েটার গায়ে। চুড়ি দুটি, এক জোড়া দুল আর মোটা চেইন এসব দেখেই সে আবার বলল, চাইলে ওগুলো খুলে রাখতে পারিস।
রিদওয়ানের দৃষ্টি অনুসরণীয় করে অর্নিতা নিজের গলায় হাত দিল। ভালো হলো তারও ইচ্ছে করছিল না এমন বালা, দুল পরে চলতে তবে গলারটা মন্দ লাগছিলো না। সে একে একে প্রথমে চুড়ি তারপর দুল খুলে গলায় হাত দিতেই রিদওয়ান বারণ করল।
-ওটা থাক চল বাইরে যাব।
এরপরই দু জনে চলে এসেছে রিসোর্টের উল্টো দিকে নদীর কিনারায়। কেটে গেছে অনেকটা সময় এরই মাঝে একবার উঠেছিল দুজনেই৷ কফি খেয়ে আবারও ফিরে এসে বসে আছে একই জায়গায় পাশাপাশি, কাছাকাছি। অর্নিতার কাছে এ শুধুই বিয়ের পরের একটি বিশেষ সাক্ষাৎ যা রিদওয়ানের কাছে মোটেই নয়। সে এখানে এমন প্রকৃতির সম্মুখে আজ মনের মানুষটিকে নিয়ে আসার পেছনে লুকায়িত আছে বিশেষ কিছু কারণ। অনেক তো হলো সময় নেয়া এবার ভণিতায় না গিয়ে কথাটুকু সেরে নেওয়ার তাগিদ অনুভব করল। আঁধারের মাঝেই ঘাড় ফিরিয়ে অর্নিতাকে একবার দেখে নিয়ে বলা শুরু করল, ‘আমার কিছু কথা ছিল অর্নি৷ তোকে আজ মূলত সেই কথাগুলো বলতেই এখানে নিয়ে আসা।’
শো শো বাতাস আর নদীর শান্ত সুরের কলকল ধ্বনিতে বেয়ে চলা এরই মাঝে অতি পরিচিত কণ্ঠের ঝংকার তোলা বাক্য কেমন শিউরে দিলো অর্নিতার গা। ক্ষণে ক্ষণে এক ভালো লাগার কাঁপন অনেকক্ষণ ধরেই তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল নতুন অনুভূতিতে। এবার যেন কাঁপন থেকে আতঙ্কিত বরফখণ্ডে পরিণত করলো। কি এমন বলার ছিল যার জন্য এই অদূর নির্জনতার ছাউনিতে আসা হলো! বেশি সময় সে ভাবার সুযোগ পেলো না রিদওয়ান এরই মাঝে বলতে শুরু করলো, বরাবরই জেনে এসেছি তুই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখিস। আমিসহ বাড়ির প্রায় প্রত্যেকেই জানে সে কথা। তোর বিয়ে নিয়ে কখনো আগ্রহ চোখে পড়েনি কারো অনেস্টলি স্পিকিং, আমি নিজেও অনেক অনেকবার লক্ষ্য করেছি তোকে নিজ স্বার্থেই হয়ত। শিবলী ভাইয়ের সাথে বিয়ে নিয়ে কখনোই তোকে খোশমেজাজে কথা বলতে দেখিনি৷ এমনকি আংটিবদল, আদারস ফাংশনে তোদের দেখা সাক্ষাতেও বিন্ন কিছু চোখে পড়েনি তবে তোর সকল আনন্দ উল্লাস আর আগ্রহের দিক শুধুই তোর পড়াশোনায় দেখেছি আমরা। সেই সুবাদেই তোর স্বপ্ন জানি৷ আর…. ‘
থেমে গেল রিদওয়ান। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে পুনরায় বলতে লাগল, ‘তোর বয়সও কম আর আমিও প্রতিষ্ঠিত নই৷ প্রতিষ্ঠিত বলতে অনেক টাকা পয়সা বোঝাচ্ছি না৷ আমার আসলে নির্দিষ্ট কোন পারমানেন্ট কাজকর্ম এখনো হয়ে উঠেনি। তাই পরিবার চাইলেও আমি তোকে এখনই বাড়িতে নিতে চাইছি না এতে কি তোর কোন আপত্তি আছে?’
রিদওয়ানের প্রশ্নের জবাব কি হওয়া দরকার বুঝতে পারলো না অর্নিতা। তবুও তার হ্যাঁ তে হ্যাঁ হওয়া জরুরি ভেবেই ধীরকণ্ঠে বলল, ‘না’
-জোরে বল।
-না আপত্তি নেই।
-হু থাকার কথাও না। আমিও তো তোর জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত।
এ কথাটা অর্নিতার কানে খুব বাজলো। বিয়ে নিয়ে যেখানে কোন আবেগটাই ছিল না সেখানে কাঙ্ক্ষিত, অনাকাঙ্ক্ষিতের কথা আসে কি করে!
-আমি তোকে তোর প্রয়োজনের পুরো সময়টা দিতে চাই। বিয়ে মানেই বন্ধন, সংসার এসব থিওরিতে আমি বিশ্বাসী না। আমার তোকে ঘিরে অনুভূতির কথা বোধহয় তোর অজানা নয় তাই আমার জীবনে তোকে পাওয়াটা কতো বড় পাওয়া তুই আন্দাজ করতেই পারিস। ঠিক এ কারণেই আমি আজ তোকে পরিষ্কার করে জানিয়ে দিতে চাই আমি তোকে তোর প্রয়োজনের পুরো সময়টা দিয়ে যাব যেটুকু তোর স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রয়োজন। তোর কাছে থাকলে, আশেপাশে থাকলে তা আমি কখনোই পারব না। নিজেকে আটকে রাখার মত মহাপুরুষ আমি নই। এজন্য আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি দেশের বাইরে চলে যাব আর তা অতিশিগ্রই।
চমকে উঠে অর্নি; রিদওয়ান ভাই বিদেশে চলে যাবে!
– আগেই কিছু ভাবিস না। আমি চলে যাব বলেছি আবার ফিরেও আসব। তোর স্বপ্নপূরণের জন্যই আমার এই দূরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তারমানে এই না তুই ততদিন মুক্ত পাখির মত উড়তে থাকবি। ডানা অবশ্যই মেলবি তবে তার গন্ডি আমার বাইরে যেন না হয়। কাল থেকে তুই ঠিক আগের মতই থাকবি, পড়াশোনা যেমন করতি তেমনই করবি আর… মনে মনে তোর জীবনে আমার জন্য নির্দিষ্ট একটা জায়গা তৈরি করবি৷ তোর জন্য আমি সব করব তুই শুধু আমার জন্য ওইটুকুই করিস। আমার নামের জায়গায় ভুল করেও যেন অন্য কেউ ঠাঁই না পায়।
শীতল কণ্ঠে যেন কঠিন কোন থ্রেট দিয়ে দিলো রিদওয়ান। কথা শেষ করেই তারা ফিরে গেল রাতের খাবার খেতে। খাওয়া শেষে দুজনে রুমে ফিরলেও রিদওয়ান বসে রইলো বসার ঘরের ডিভানটাতে। অর্নিতা ততক্ষণে বেডরুমে ঢুকে গা এলিয়েছে বিছানায়। কারোই দু চোখের পাতায় ঘুমের রেশ মাত্র নেই৷ যেন সবেই তারা ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। তোলপাড় করা ভেতর- বাহির নিয়ে ছটফটায় দু পাশে দুজন৷
__________________
বহুদিন পর আজ বেশ রাত করেই বাড়ি ফিরলো অর্ণব৷ সারা বিকেল, সন্ধ্যা সাভারের সেই ছোট্ট গ্রামটাতে কাটিয়ে সে নিজ শহরে ফিরেছিল রাত আটটারও পর। ইচ্ছে হয়নি বাড়ি ফিরতে তাই এদিক সেদিক আরও কিছুক্ষণ কাটিয়ে সে রাস্তার পাশে এক চায়ের দোকানে বসে কল দিয়েছিল দাদীকে। প্রথমে রেগে বকাবকি করলেও পরে বেশ শান্ত গলায় বলল রিদওয়ান এসেছিল। তারা ঘুরতে যাবে আজ আর ফিরবে না তাই অনুমতি নেওয়ার জন্যই দাদীকে দিয়ে কল করিয়েছিল ছেলেটা। অর্ণব জানিয়ে দিলো দাদীর অনুমতিই তো যথেষ্ট সে কি বলবে আর। দাদীর সাথে কথা শেষে খালামনিকে কল দিলে তিনিও জানালেন একই ইস্যু ব্যস আর কোন কথা নেই তবে৷ এরপর যখন চোখে পড়লো নুপুরের ছোট্ট একটি মেসেজ, ‘আপনি ঠিক আছেন? না মানে হঠাৎ নিজেই কল দিলেন যে!’
মেয়েটা কি ভাবে সে ঠিক নেই বলে তাকে কল করেছে? আশ্চর্য! আগে কি কখনও সে ঠিক না থাকলে কল করতো নুপুরকে? ইচ্ছে করছিল কল দিয়ে সে প্রশ্ন করবে মেয়েটা এমন কেন ভাবলো? নাহ, অর্ণব কল করলো না তাকে। এমন করে ছোট ছোট কথাবার্তাই একসময় লম্বা হয়ে উঠবে। দরকার কি যেচে পড়ে কাউকে এভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে ফেলার! অর্ণব আর ভাবতে চাইলো না তাকে নিয়ে। বাড়ি ফিরে সোজা ঢুকলো নিজের ঘরে৷ দাদী আজ অপেক্ষায় নেই তার সাথে খাওয়ার জন্য৷ অর্নিটাও নেই বাড়িতে ক’দিন পর হয়তো একেবারের জন্যই থাকবে না আর৷ গায়ের পোশাক বদলে নিয়ে সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে গেল বারান্দায়। আজ রাতে তার খিদে পাবে না, শুধুই থাকবে সিগারেটের তৃষ্ণা। মাথার ভেতর চলতে থাকবে অজস্র পরিকল্পনা আর হাতে জ্বলবে সিগারেট। কালকের ভোর হবে নতুন করে নতুন দিনের সূচনা নিয়ে। এতদিনের এঁকে রাখা ছক আবার নতুন করে সাজাতে হবে তাকে।
চলবে
#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১৯(খ)
রাতটা কাটলো দু ঘরে দুজনার। অর্নিতা হয়ত উদগ্রীব ছিল এই ভেবে মানুষটা নিশ্চয়ই পাশেই থাকবে রাতভর। স্বামীসুলভ আচরণ সে চায় না রিদওয়ান করলেও সে নিতে পারতো না। কিন্তু এত বেশি নির্লিপ্ততা সে আশা করেনি। অনেকটা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে পরেই ঘুমিয়েছে সে। রিদওয়ান বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারেনি। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা জার্নি, আধ ঘন্টার রেস্ট তাও কিনা সোফায় বসে এরপর আবারও ঢাকা টু গাজীপুর জার্নি। তারপরের সময়টা নদীর পাড়ে বসেই কেটেছে। সব মিলিয়ে শরীরটা খুব করে বিছানা চাইছিলো বলেই বোধহয় সে আরও আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ভোরের আলো ফুরতেই আবার সে ঘুম তার দেহের ব্যথায় পগারপার। বড্ড ভুল হয়েছে ডিভানে ঘুমানোটা। আসলে অর্নিতাকে সে ভালো যতই বাসুক হুট করেই পাওয়া অধিকারটা কেন জানি মন মানতে চাইছে না। হতে পারে অর্নিতার নির্বিকার আচরণ তাকে অপ্রস্তুত করছে ভেতরে ভেতরে। তাইতো সুযোগ থাকার পরও ও ঘরে একই বিছানায় থকতে ভীষন ইতস্তত বোধ করছিল। কিন্তু এখন আর শরীর ঠিক নেই। যাওয়ার আগে একটু ঘুম তৃপ্তির না হলে ফেরার পথে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ফোনে সময় দেখে নির্দিষ্ট একটা সময়ের এলার্ম লাগিয়ে চলে গেল বেডরুমে। ভোরের ফ্যাকাশে আলো বেলকোনির পর্দা ভেদ করে ঘরটাকে করেছে কুয়াশায়ময় ঘোলাটে ফর্সা৷ বিছানার দিকে এগুতেই চোখে পড়লো এলোমেলো শাড়ি গায়ে ঘুমন্ত অর্নিতা, বালিশের পাশেই তার আয়াতাকার চশমা সেই সাথে মুঠোফোনটা। নিঃশব্দে বিছানায় উঠে প্রথমেই মোবাইল আর চশমাটা সরিয়ে রাখলো রিদওয়ান সাইড টেবিলে। নিজের ফোনটাও রেখে দিলো সেখানে। গায়ের টি শার্টটা খুলবে না খুলবে না করেও খুলেই ফেলল। অভ্যাস তার বরাবরই উদোম গায়ে ঘুমানোর। আজ অর্নিতার জন্যই খুলতে চাইছিলো না পরমুহূর্তেই মনে হলো এই মেয়েটির সামনে সাধু সাজার মানেই হয় না। এই প্রথম নয় একই বাড়িতে থাকার সুবাদে সে আগেও অর্নিতার সামনে উদলা গায়ে পড়েছে। বালিশে মাথা এলিয়ে চোখ বুঁজতেই টের পেল তার ভেতরে ভেতরে কিছু হচ্ছে। কি হচ্ছে কেন হচ্ছিলো জানে না শুধুই টের পাচ্ছে পাশের মানুষটির উষ্ণতা তাকে আকর্ষণ করছে তীব্রভাবে।কয়েক মিনিট দম আটকেই যেন গড়াগড়ি খেল বিছানায় তবুও ক্লান্ত চোখ জোড়ায় ঘুম নামলো না৷ আসার কি কথা! শত জন্মের একটি চাওয়া যখন পাওয়া হয়েও হয় না তখন তনুমন শান্ত হয় কেমন করে! ঝট করে চোখ খুলে ফেলল রিদওয়ান৷ অপলক তাকিয়ে রইলো হৃদয়পটে বসত করা মানবীর দিকে। কিছু সময় কেটে গেল নিষ্পলক দৃষ্টি ফেলে। ততক্ষণে আবছা আঁধারও হারিয়ে গেছে উজ্জ্বল দিনের সূচনায়। বড় করে শ্বাস টেনেই ধীরস্থির এগিয়ে এলো রিদওয়ান একেবারে অর্নিতার মুখের কাছে। বড্ড আলতো আর স্নেহের মাঝে ভালোবাসার আঁশ মিলিয়ে তপ্ত চুমু এঁকে দিলো অর্নিতার কপালে। নিজেকে আর এখানে রাখলে সে ক্রমেই নিয়ন্ত্রণ হারাবে বুঝতে পেরে বিছানা থেকে নেমে গেল। পাশেই রাখা টি শার্ট গায়ে জড়িয়ে নিজের ফোনটা তুলেই বেরিয়ে পড়লো কক্ষ থেকে। বাইরে থেকে লক করে চাবি সঙ্গে করেই সে রিসেপশনে গেল। এত ভোরে কেউ থাকবে কি থাকবে না সংশয় নিয়েই গেল। ভাগ্য প্রসন্ন পেয়ে গেল রিসেপশনিস্ট সাথে দুজন রিসোর্টেরই কর্মী। রিদওয়ান বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই ধড়ফড় করে উঠে বসলো অর্নিতা। বুক ওঠানামা করছে তীব্র বেগে সেই সাথে কাঁপছে পুরো দেহই। মানুষটা এমন কেন! এত কাছে এসে কেমন এলোমেলো করে দিলো তাকে। এইটুকুনি স্পর্শেই তার এত বেহালদশা কেন বুঝে পায় না অর্নিতা। স্বামী-স্ত্রীর অন্তরঙ্গতা কি খুব ভয়ানক কিছু! তার মন তো এমনই বলছে অন্তত এই মুহূর্তে নিজের অবস্থায় তাই মনে হচ্ছে।
________
-খালি রুম পাওয়া যাবে?
রিদওয়ানের আকস্মিক প্রশ্নে অবাক হলো তিনজনই৷ এরা বোধহয় তিনজনই জানে রিদওয়ান তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছে এখানে। সে বুঝতে পারলো সামনের মানুষগুলোর বিষ্ময়ের কারণ তাই নিজের মতই বলল আবার, ‘ ওয়াইফের সাথে মনোমালিন্যতা হয়েছে। দু তিনটা তাই আলাদা ঘুম দেব ভাবছি।’
এবার ঠোঁট চেপে হাসলো তিনজনই। রিসেপশনিস্ট ছেলেটা তার কম্পিউটারে নজর ফেলে কিছু চেক করলো।
-রুম একটা বুকড কিন্তু গেস্টরা আসবেন দুপুরে। আপনি চাইলে সেটা নিতপ পারেন তবে বারোটার মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে।
-ব্যাটার! চাবি….
ওয়ালেট বের করে হাফ ডে পেমেন্ট করে চাবি নিয়ে গেল রিদওয়ান। টানা তিনটি ঘন্টা ঘুমিয়ে সাড়ে দশটায় ঘুম ভাঙলো তার বাবার ফোনকল পেয়ে। বুঝতে সময় লাগলো সে কোথায় আছে পরমুহূর্তেই মনে পড়লো সব। কল রিসিভ না করে প্রথমেই গেল অর্নিতার কাছে। গেট লক! মনে পড়লো নিজেই করেছিল। আহ, এত বেলা হলো অর্নিতা নিশ্চয়ই জেগে গেছে। ভয় পাচ্ছে না তো সে আবার? খিদেও লেগেছে নিশ্চয়ই। অস্থির হয়ে এক হাতে মাথার চুল টানতে টানতে অন্যহাতে লক খুলে ঘরে প্রবেশ করল রিদওয়ান। দ্রুত পায়ে বেডরুমে ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল অর্নিতা ঘুমাচ্ছে এখনো। আবার খেয়াল হলো মেয়েটার অবস্থান দেখে। শাড়ি, চুল পরিপাটি এমনকি মুখটাও একদম স্নিগ্ধ, সতেজ। তবে কি সে ঘুম থেকে আগেই উঠে তৈরি হয়ে আছে? রিদওয়ান একেবারে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে হাত রাখলো অর্নিতার মাথায়।
-এ্যাই অর্নি উঠে পড়। নাশতা করবি না!
মাত্রই চোখ লেগেছিল তার। রিদওয়ানের ডাক শুনে চোখে ঘষে তাকালো। কাত হয়ে শোয়া ছিল এবার উঠে বসলো।
-অনেকক্ষণ আগেই উঠেছিলি?
-নাহ একটু আগেই৷
-ভয় পেয়েছিলি? কল করিসনি কেন আমাকে?
-ভয় পাইনি৷
– আচ্ছা একটু অপেক্ষা কর আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। নাশতা সেরে রওনা দেব কেমন!.
অর্নিতা ঘাড় কাত করে সায় দিলো। মিনিট বিশেকের মাঝেই দুজন পুরোপুরি গুছিয়ে বেরিয়ে গেল রিসোর্ট থেকে। নাশতার জন্য রিদওয়ান খুঁজে বেছে নিয়ে গেল গাজীপুরের খুব নামী এক হোটেলে। খাসীর মাংস, পরোটা, আর কষা হাসের মাংসে শেষ হলো নাশতা। অর্নিতা তেমন কিছুই খেতে পারেনি। রিদওয়ান তা লক্ষ্য করেই অর্নিতার জন্য পরোটা, ডিম ভাজা পার্সেল নিলো। ট্যাক্সি নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হতেই আবারও কল এলো বাবার নম্বর থেকে। এবার কিছুটা আতঙ্কিত হয়েই সে কলটা ধরলো৷ মিনিট তিনেকের কনভার্সেশনে অর্নিতা বুঝে গেল রিদওয়ানকে ফিরতে হবে বিকেলের আগে। তবে চুপ করে রইলো শোনার জন্য রিদওয়ান কি বলে।
– তোর ফোন থেকে নুপুরকে কল করতো।
-জ্বী!
-জ্বী কি? যা বলেছি কর।
অর্নিতা বিষ্ময়ে হা হয়ে কল করলো নুপুরকে। কল রিসিভ হওয়ার আগেই রিদওয়ান ফোনটা নিয়ে নিজের কানে ধরলো। ওপাশ থেকে জবাব পেতেই সে বলে উঠলো, ‘শালিকা আমি রিদওয়ান৷ একটা কাজ করতে পারবেন?’
নুপুরও বোধহয় অর্নিতার মত বিষ্মিত সেও কোন কথা বলছে না। রিদওয়ান ব্যাপারটা আন্দাজ করে নিজের মতই বলে গেল, ‘কলেজে আছেন নিশ্চয়ই। একটার মধ্যে কলেজ গেইটের সামনে আপনার বান্ধবীকে নিয়ে আসছি আপনি তাকে একটু তার বাড়ি পৌঁছে দেবেন৷ বাকি কথা সামনেই বলবো শুধু ফোনটা রিসিভ করবেন পরবর্তী কল পেলে।’
দু প্রান্তে দু বান্ধবীই হা হয়ে বসে আছে। রিদওয়ানের কথার বোধগম্য হলো ঠিক কলেজের সামনে পৌঁছেই।
____________
চলবে