কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-১৩

0
262

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১৩ (ক)

নাশতা শেষ করেই অর্ণব অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। মনে মনে ঠিক করে নিলো আজ আর দুপুরে খেতে বাড়িতে আসবে না। অন্তরাত্মা আগেই জানান দিয়েছে মন আগাচ্ছে ভুল পথে। ছোট্ট একটা জীবন তাতে অনেক কিছু আছে করার মত। জেনেশুনে ভুলে জড়িয়ে গেলে অনেকগুলো কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। দরকার কি এমন ভু্ল করার! নুপুর নিশ্চয়ই দুপুরের পর চলে যাবে ততক্ষণ বাড়িঘর ভুলে থাকলেই চলবে৷ অন্যান্য দিনও তো এমন হয় কাজের চাপে বাড়িতে যায় না আজও না হয় তেমনই দিন ভেবে নেবে। অফিসে এসেই প্রথমে চেক করলো ইমেইলগুলো। বরাবরের মতই হতাশ হতে হলো অর্ণবকে লোন সংক্রান্ত কোন বার্তা নেই।
_____________

এই রোদ এই বৃষ্টি যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে মেঘ আর সূর্য। নুপুরের চমৎকার সকালের এক ভাগ নষ্ট করেছিলো জাকিরের ঔদ্ধত্যপূর্ণ কিছু কথা আর এক ভাগ মিষ্টি করেছিল অর্ণবের ছোট একটা ধন্যবাদ। আদৌও ছোট নয় সেটা নুপুরের কাছে। নাশতা নিজের ঘরে বসে করতে চেয়েও করতে পারেনি অর্ণব। নিচ থেকে দাদী ধমকে উঠে বলেছিলেন, কই দিব নাশতা নিচে আয় তুই।

দাদীর তো অজানা কি চলে ওই গোমরামুখো নাতির অন্তরে আর উড়ুক্কু প্রজাপতির ন্যায় উড়তে থাকা নুপুরের মনে। নুপুরের নিক্কণ তোলা ধ্বনির মতই তো ছন্দ তুলে চলে ওই শ্যামাবতী। অর্ণব নিচে এসেছিল একেবারে তৈরি হয়েই। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট আর এই প্রথম গলায় টাই পরতে দেখেছে নুপুর জল্লাদমুখো মানুষটাকে। কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে বড় আলগোছে ঠোঁটের ডগায় আওয়াজ তুলল, মাশাআল্লাহ! পরেই আবার বলল, নাউজুবিল্লাহ! খুব কাছেই ছিল অর্ণব তাই শব্দদুটো শুনতেই চোখে চোখ রেখেছিল নুপুরের। আধপাগল, ক্ষ্যাপাটে বড় এই মেয়েটা। সে চোখ নামিয়ে নাশতায় মনোযোগ দিল। মিনিট পাঁচেকেই নাশতা সেরে কোন রকমে ত্যাগ করতে চাইলো বাড়ির সীমানা। তারপরও তাড়াহুড়োর মাঝে মনে পড়ে গেল জন্মদিনের সেই উপহারের কথা।বলতে নেই, অর্ণব চেষ্টা করেছিল উপহারখানা ফেলে দিতে কিন্তু মন মানলো না। হাতে নিয়ে বার কয়েক সেটাকে দেখে ভালো লেগেছিল৷ ঘড়ি ছাড়া কখনোই হাতে অন্যকিছু পরে না সে তবুও কলেজ আর ভার্সিটিতে অনেকেই বলেছে তার হাতে শিকল কিংবা চওড়া ধরণের দেখতে ব্রেসলেট বেশ মানাবে। রিদওয়ানও একবার মালায়শিয়া থেকে এনে দিয়েছিল একটা চমৎকার জিনিস তবুও পরেনি অর্ণব অথচ এই ছোট্ট সাধারণ উপহারটা পরার সাধ জেগেছিল তার। স্বভাববিরুদ্ধ বলেই কিনা কে জানে তুলে রেখে দিয়েছে সেটা। তবুও পছন্দ তো হয়েছিল! তাই সে বাড়ি থেকে বেরুবার পথে পেছন ফিরে বলল, ধন্যবাদ।

নুপুর কথাটা শুনে বোকার মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো অর্ণবের যাওয়ার পথে। ধন্যবাদ কেন দিলো! যে তাড়াহুড়োয় বেরিয়ে গেল লোকটা প্রশ্ন করার সুযোগই পেল না। তারপর হঠাৎ, একেবারে আকষ্মিক মনে হলো, লোকটা কি সেই বার্থডে গিফটের জন্য ধন্যবাদ দিলো! নুপুরের বুঝতে সমস্যা হয়নি ওই জল্লাদমশাই তাকে ইগনোর করতেই অত দ্রুত বাড়ি ছেড়েছে। তারমানে কি তার উপস্থিতির মূল্য আছে লোকটার জীবনে? ব্যাপারটা আনন্দের! সত্যিই ভীষণ মুগ্ধ হয়েছে নুপুর। তারমতো কাল কাঞ্চনও একজন সুদর্শন পুরুষের ভয়ের কারণ হতে পারে! ভাবতে ভাবতেই ফিক করে হেসে উঠেছিল সে। দাদীর চোখ এড়ায়নি সে হাসি তিনিও যেন আগাম কোন সংকেত পেয়ে গেলেন। অর্ণবের আনা মাছ আর আমের দিকে তাকিয়ে জোরে হাঁক ছাড়লেন, বুবুরা এইদিকে আসো একটু।

‘বুবুরা’ শব্দটা শুনে ভাল লাগল অর্নিতার। দাদী নুপুরকে আপন ভেবে ডাকছে বলে সত্যিই আনন্দ হলো অর্নিতার। তার ধারণা, বান্ধবী তার ভাইকে পছন্দ করে এখন মনে হচ্ছে দাদীও খুব পছন্দ করেছে। আকাশকুসুম ভাবনা কখনো অর্নিতার মনে আসে না কিন্তু আজ এ ক্ষণে নুপুর আর ভাইকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে। দু’জনের মাঝে যদি কিছু হয় তবে সে খুশিই হবে খুব। তার ভাই, নুপুর আর সে তিনজনই যেন একই স্রোতে ভাসতে থাকা ভাঙা নৌকা। নিজেরটা তো তার জানা হয়েই গেছে তাকে ভেসে গিয়ে বসত গাড়তে হবে মেজো খালামনির ডেরায়। কিন্তু ভাইটার কি হবে! দাদীর বয়স হয়েছে সেও এখন বাড়িতে কাউকে কাছে চায়। সেই চাওয়া বড় আপন কারো সঙ্গ। সবাই কি আপন হতে পারে বা পারবে? দাদীর ডাক আবারও কানে আসতেই সে এগিয়ে গেল দাদীর কাছে। দাদী মাছ আর আম দেখিয়ে বললেন, আজকে এইগুলান তোমরা কাটবা পারবা না!

অর্নিতা কিছু বলার আগেই নুপুর বলে উঠলো, শুধু কাটবো কেন রান্নাও করব।

-তুই ইলিশ রাঁধতে পারিস!
অর্নিতা চোখ রাঙালো বান্ধবীকে।

-পারি না বলে চেষ্টাও করব না নাকি?

টেবিলে সাজানো নাশতা দাদী বসে আছে। পাশেই নুপুর নিজ হাতে দাদীর প্লেটে রুটি তুলে দিচ্ছে। অর্নিতাও অপর পাশের চেয়ার টেনে বসে পড়লো। নাশতার পর্ব শেষ করতেই দাদী নিজে ঠিক করে দিলেন রান্না আজ অর্নিতা করবে। কথায় কথায় দাদী আর নুপুর মিলে ক্ষেপালোও তাকে বেশ শিবলী ভাইয়ের নাম করে। রুজিনা খালা মাছ নিজেই কেটে দিলে নুপুর যেচে মাছ ভাজলো সাথে মুরগির মাংসটাও রাঁধলো। অর্নিতা ভুনা খিচুড়ি রাঁধলো আর সবটাই দাদী রান্নাঘরে বসে শিখিয়ে দিলেন। রান্নার পাট চুকাতেই ঘড়িতে বাজলো বারোটার বেশি। অর্ণবের আনা আমের ব্যাগে চোখ পড়তেই নুপুর দাদীকে বলল, আম দিয়ে কি আচার হবে দাদী?

-হু,

-টক নাকি মিষ্টি হবে?

-আমি আর অর্ণব আলুর ভর্তা আচারের তেল ছাড়া খাইতে পারি না। এইজন্য টক আচার করমু আর রায়নার বড় পোলাডা আমার বানানি মিষ্টি আচার পছন্দ করে অনেক। ওর লাইগা এক বৈয়াম খোসাওয়ালা মিষ্টি আচারও বানামু ভাবছি।

নুপুর অবাক হয়ে তাকালো অর্নিতার দাদীর দিকে। বরাবরই অর্নি তার এই দাদীর খুব প্রশংসা করে। কথায় কথায় অনেকবার বলেছিল দাদী সবার খাবারের পছন্দটা একটু বেশিই খেয়াল রাখেন। সত্তর পেরোনো এই মানুষটা বিভিন্ন রোগে কাহিল হয়ে চলতে ফিরতে কষ্টবোধ করেন তবুও মাঝেমধ্যে নাকি নাতি-নাতনির জন্য রান্নাঘরে ঢোকেন। শীতের মৌসুমে পিঠাপুলি বেশি না হোক কম করে হলেও নিজ হাতে তৈরি করেন অর্ণব -অর্নিতার জন্য। নুপুরের মন খারাপ হয় ভাবতে গিয়ে। তার মা নেই সেই ছোট্ট থেকেই। বাবার দ্বিতীয় বিয়ের জন্য নানা বাড়ির মানুষরাও এখন আর খোঁজ নেয় না তেমন। নুপুরের জীবনে আদর-আহ্লাদ শুধু এক বাবাই করেন। কিন্তু মায়ের মত কিংবা দাদী, ফুপু অথবা খালার মত কোন স্নেহের পরশ তার জীবনে আসেইনি কোনদিন৷ অর্ণব অর্নিতা নাকি ছোট থেকেই মা-বাবার সঙ্গ পায়নি কিন্তু তবুও যেন মা-বাবার ভালোবাসার অভাবটাও হয়নি তাদের। সে ভেতরের চাপা শূন্যতাকে দীর্ঘশ্বাসের সাথে বের করে দিতে চায়। মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে অর্নিতার দাদীকে বলল, আমি আমগুলো কেটে দেই দাদী?

– না গো বুবু। দাওয়াত কইরা আনছি আর কাজই করাইতাছি তখন থাইকা। এইবার গিয়া জিরাও তুমি৷ আমি গোছল দিমু, নামাজ পড়মু তারপর তোমাগো নিয়া খাবার খামু।

-আপনি গোসল আর নামাজ শেষ করে আসেন দাদী ততক্ষণে আমি এগুলো কেটে রাখি। বলেন তো কিভাবে কাটতে হবে?

জোর করেই নুপুর বসে পড়লো আম কাটতে। তা দেখে অর্নিও বসলো তার পাশে। রুজিনা খালা দুজনকে বারণ করলেও কেউ শুনলো না সে কথা। দাদীর গোসল আর নামাজ শেষ হওয়ার আগেই দু বান্ধবী মিলে হাসি ঠাট্টায় কেজি পাঁচেক আম কেটে নিলো। নুপুর মুখ হাত ধুয়ে চুল আঁচড়ে নিজেকে কিছুটা পরিপাটি করে নিতেই অর্নিতা গেল গোসল করতে।

____________

-মে আই কাম ইন স্যার!

-ইয়েস…

ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিতেই রিদওয়ান ঢুকলো বাবার কেবিনে। সকাল আটটায় এসে নিজের ডেস্কে বসেছিল সে। তারপর ঠিক দেড়টায় বাবার কেবিনে নক করলো। বাশার সাহেব তখন সবে কাজ এড়িয়ে লাঞ্চের কথা ভাবছিলেন। হুট করে গায়েব হওয়া ছেলেটা আজ অফিস টাইমের আগেই নাকি অফিসে ঢুকেছে স্পেয়ার চাবি নিয়ে সে কথা তিনি জানতে পেরেছেন সকালেই। ইচ্ছে করেই এ নিয়ে নিজে থেকে তিনি কোন কথা বলেননি তবেই অবশ্যই অপেক্ষায় ছিলেন। বাউণ্ডুলে ছেলেটা কখন কি করে আর কেন করে তা তিনি জানেন না স্বয়ং ছেলে নিজেই জানেন না। তাই তিনি ধৈর্য্য রেখেছেন কোন দুঃসংবাদ পাওয়ার। সারা সকাল পেরিয়ে দুপুর হতেই আতঙ্ক বাড়ছিলো যেন। তাই ছেলে এসে ঘরে ঢুকতেই তিনি শান্ত স্বরে জানতে চাইলেন ছেলের আসার কারণ। রিদওয়ান হাতে একটা নীলরঙা ফাইল এনেছিলো সেটা এগিয়ে দিলো বাবার দিকে।

-কি এটা?

-নতুন প্রজেক্টের ফাইল। আর…..
সাদা একটা খাম এগিয়ে দিয়ে রিদওয়ান এবার কথা সম্পূর্ণ করল, আমার রেজিগনেশন লেটার।

কাঁচ-ঘেরা অফিস রুমটায় কিছু সময় চলল পিনপতন নীরবতা তারপরই এক রকম বজ্র হুংকার ছাড়লেন, আর ইউ কিডিং উইদ মি!

-নো স্যার।

-ইয়েস ইট’স…

-নো স্যার আ’ম ন’ট জোকিং উইদ ইউ।

বাশার শেখ অনেক বেশিই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু উচ্চরক্তচাপ আছে বলেই তিনি নিজেকে সবসময় সকল ব্যাপারেই স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেন এবং যথেষ্ট সফলও হয়েছেন এ পর্যন্ত। কিন্তু আজকের বিষয়টা একদমই ভিন্ন। মাত্রই সপ্তাহ দুই আগে খুব ভরসা করে বড় ছেলেকে দেশের সবচেয়ে খ্যাত এক কোম্পানির সাথে নতুন চুক্তির কাজটা হাতে কলমে শিখিয়ে পড়িয়ে ধরিয়ে দিয়েছেন। এখন এই মুহূর্তে ছেলের মুখে সেই প্রজেক্টে কাজ না করতে চাওয়ার কথা শুনে নার্ভে ভীষণ চাপ অনুভব করলেন। অকস্মাৎ এমন কিছু হলে জীবনের সবচেয়ে বৃহৎ অঙ্কের মা’রটা তাঁকে এখানেই খেতে হবে। রিদওয়ান বাবার চোখ, মুখের অস্বাভাবিক পরিবর্তন আর শরীর ভিজে উঠা দেখে ভয় পেয়ে গেল। না চাইতেও মনে ভয় ধরে গেল, বাবা কি স্ট্রোক করল!

_________

রিমন লাঞ্চে আওয়ারের আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছিল আজ। সন্ন্যাস বাবাজী যে নিজে থেকে কিছু করবে না তা মনে হতেই সে নিজ দায়িত্বে শিবলীর ভিডিও আর ছবিগুলো নিজেই এক বন্ধুর মাধ্যমে অর্ণবকে পাঠাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো কিন্তু তার আগে রূপা মেয়েটার সাথে কথা বলা জরুরি। শিবলী ভাই কি রূপার সাথে টাইমপাস করছে নাকি অর্নিতাকেই ধোঁকা দিবে সবটা খতিয়ে না দেখে কিছু করা বোকামি হতে পারে ভেবেই রিমন আজ দিনের বাকিটা সময় অফিস ছেড়ে বন্ধুদের কাছে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও বুঝি তার মন্ত্রনা ভেস্তে দোওয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছিল! কোন কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই তাকে আগাতে হলো হাসপাতালের দিকে।

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১৩(খ)

দুপুর থেকে হাসপাতালের বদ্ধ কেবিনে থম মেরে বসে আছে রিদওয়ান। তার বাবাকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে বলে এখনো ঘুমে তিনি৷ রিমন একটু আগেই বেরিয়েছে বাড়িতে যাবে বলে। এখন বাড়ি গিয়ে খুব সাবধানে মাকে জানাতে হবে বাবার কথা। খুব কৌশলে বোঝাতে হবে একটি রাত বাবাকে হাসপাতালে রাখা জরুরি। সৌভাগ্যক্রমে বাবার বুকে ব্যথা হলেও হার্ট অ্যাটাক হয়নি। এক মুহূর্তের জন্য রিদওয়ানের মনে হয়েছিল বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছেন কিন্তু সকল পরীক্ষা নিরিক্ষার মাধ্যমে জানা গেল রক্ষা করেছে আল্লাহ্ আজ তবে অতিরিক্ত চিন্তান্বিত অবস্থা হলে পরের বার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হতে পারে৷ উচ্চ রক্তচাপের সমস্যাটা তো বাবার বহু পুরনো তাই ভয়টা নেহাৎ কম নয়। দুপুরে রিদওয়ানের অফিস ছেড়ে যাওয়া এবং কয়েক কোটি টাকার একটা ডিল নষ্ট হওয়ার আতঙ্কেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বাশার শেখ। মূলত এবারের কাজের সকল প্রকার প্রস্তুতি তিনি রিদওয়ানকে দিয়ে করিয়েছেন। প্রেজেন্টেশনটা যখন রিদওয়ান তৈরি করেছে তখন অল্প সময়ে অন্য হাতে যাওয়া মানেই সবটা ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা নব্বই শতাংশ। রিদওয়ান বাবার অবস্থা খারাপ হচ্ছে টের পেতেই দ্রুত হাসপাতালে আনে বাবাকে। রিমনকেও ফোন করে জানিয়ে দেয় আসার কথা কিন্তু বাড়িতে মা, বোনকে জানানোর সাহসটা আর হলো না তার। ডাক্তার বলেছেন রাতটা অবজারভেশনে রেখে কাল স্বাস্থ্যের উন্নতি হলেই ডিসচার্জ করবেন৷ তাই বাধ্য হয়েই এবার বাড়িতে জানাতে গেল রিমন সেই সাথে মাকেও নিয়ে আসবে সঙ্গে করে। রিদওয়ানের মাথার ভেতরটা সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে আছে একদম। কি করতে চাইলো আর কি হয়ে গেল! সে তো কারো ক্ষতি চায় না, কারো দুঃখ, কারো মনোমালিন্যতাও চায় না। জীবনে সকল চাওয়া পাওয়ার গলা টিপে অনেক আগেই সে নিজেকে করতে চাইছিলো বাবার হাতের পুতুল। শেষ পর্যন্ত পারলো কই! একটা মেয়ের প্রেমে পাগল প্রায় হয়ে সে ভাঙতে চাইছিলো বাবার তৈরি লৌহ দেয়াল এখানেও এসে বাবার জীবনহানির কারণ হওয়ার পথে। ইশ, ভাবনায় ডুবে প্রহসন করে ফেলছে সে। ওই মেয়েটার কথা কেন ভাবতে গেল রিদওয়ান নিজেই নিজেকে শুধায়। সকালে নাশতা করা হয়নি ঠিকঠাক তারপর সারা দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল। পেটে এক ফোঁটা পানিও পড়েনি তার। রিমন যাওয়ার আগে হসপিটাল ক্যান্টিন থেকে ওয়াটার বোতল আর চিকেন রোল কিনে রেখে গেছে৷ খিদে পেটে এখন সেদিকে দৃষ্টি যেতেই খিদে আরও বেড়ে গেল তার।
__________

দুপুর থেকে সাতটা মেসেজ পেল অর্ণব নুপুরের নম্বর থেকে। বারণ ছিল সেই কবেবার মেয়েটা শুনলো না। অনেকদিন কোন কল, মেসেজ কিছুই দেয়নি আজ হঠাৎ করে এতগুলো মেসেজ একসাথে দেয়ায় একটু অবাক হলেও সেগুলো দেখার আগ্রহ বোধ করলো না হতে পারে আগ্রহটাকে সে চাপা দিলো। বহুদিনের গড়ে তোলা প্রতিরোধ তার কোন মেয়ের মায়ায় আটকাবে না সে৷ কিন্তু এই শ্যামাকন্যা বড্ড পাজি। আঠার মত লেগে আছে অদৃশ্য সত্তা নিয়ে৷ মেসেজগুলো না পড়লেও সে আর কাজে মন দিতে পারছে না ঠিকঠাক। দুপুরে সত্যিই সে খাবার খেতে বাড়ি যায়নি তাই দাদী একবার ফোন করে বকাঝকা করেছিলো। তারপর আর কোন কল আসেনি কিন্তু এখন এই মেসেজ তার কাজের দিক থেকে মনকে সরিয়ে দিচ্ছে। হাতের সামনে নতুন কাঁচামালের হিসেব অথচ চোখ বারবার আটকে যাচ্ছে ফোনের ওপর। কি লিখেছে মেসেজে সে? এবার আর মন মানলো না। কাজ রেখে ফোনটাই হাতে তুলল অর্ণব।

– খাওয়ার পর অবশ্যই প্রশংসা করবেন।

প্রথম বার্তা এইটুকুই। অর্ণবের প্রথমে বুঝতে সমস্যা হলো কি খাবে আর কিসের প্রশংসা করবে! পরে সে এই খুদে বার্তা আসার সময়টা দেখলো দুপুর একটা বারো মিনিট। আন্দাজ করে নিলো আজ বাড়িতে নুপুর নিশ্চয়ই রান্না করেছে রুজিনা খালার সাথে। পরবর্তী বার্তাটা ছিলো এমন, ‘এত লেট!’

অর্ণবের মনে হলো তার ঘরের একজন তাকে বকা দিচ্ছে বাড়ি ফেরেনি বলে। এই বার্তার সময়টা ছিল দুইটা পঁয়তাল্লিশ। এরপরের বার্তাগুলো একটু আগে মানে বিকেলের শেষ মুহূর্তে এসেছে একসাথে। প্রত্যেকটাতেই শুরুর শব্দ ‘স্যরি।’ খারাপ লাগল এবার তার। মেয়েটা আন্দাজ করে নিয়েছে তার উপস্থিতির জন্যই অর্ণব বাড়ি ফেরেনি। মেয়েটাকে ইগনোর করতে গিয়ে তাকে কেমন গিল্ট করে দিলো এটা বোধহয় ঠিক হয়নি। অনুভূতির ওপর কারো হাত নেই তবুও মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে তাকে প্রতিরোধ করতে চায়। বড় যন্ত্রণা এসে ধরলো তাকে অসময়ে। হাতের কাজ আর আগানো সম্ভব নয়। ফাইলগুলো আর কম্পিউটারের ডিটেইলগুলো পিডিএফ করে দ্রুত সেন্ড করলো ল্যাপটপে। যা কাজ আছে আজ বাড়িতে বসে করতে হবে এই মুহূর্তে মন টানছে বাড়িতে। অফিস থেকে বেরিয়ে খুব একটা সময় লাগেনি অর্ণব পৌঁছে গেল বাড়িতে। দিনের আলো পশ্চিমে ডুবছে মুহূর্ত মাথার ওপর আকাশটাতে মেঘ ছাওয়া। অর্নিতা হাতটা ধরে নুপুরের সাথে গেইট পর্যন্ত চলে এসেছে আর সদর দরজায় রুজিনা খালার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন দাদী। বাড়ি এসে এমন একটা দৃশ্য দেখবে বলে আশা করেনি অর্ণব পরক্ষণেই নিজেকে প্রবোধ দিলো তবে কি সে আশা করেছিল মেয়েটা আজীবন থেকে যাবে!

-ওহ ভাইয়া এসেছো ভালো হয়েছে।

-কেন কি হয়েছে?
নুপুরের দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা করলো সে। সদা চঞ্চল আচরণ করা মেয়েটা কেমন মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে ভাল লাগল না অর্ণবের।

-ওর বাড়ি ফিরতে হবে কিন্তু আঙ্কেল একটু ব্যস্ত আছেন তাই বাজার পর্যন্ত একা যেতে হবে।

– চলেই যদি যাবে তো বিকেলে যেতে পারেনি?

বিড়বিড় করেই বলল সে কিন্তু অর্নিতা শুনলো ভাইয়ের অস্পষ্ট বাক্যটা।

-কিছু বললে ভাইয়া?

– না, তুই বল কি বলতে চাইছিলি?

-ওকে একটু বাজার অব্দি এগিয়ে দিলে ভাল হয়। আঙ্কেল ততক্ষণে ফ্রী হয়ে চলে আসবেন।

অর্নিতার কথা শুনে নুপুর আঙ্গুল টেনে ধরলো বান্ধবীর। বোঝাতে চাইলো থেমে যা আমি একাই যেতে পারব। অর্নি বোঝেনি পুরো কথাই সে শেষ করেছে। পেছন থেকে দাদীও বললেন, দাদাভাই একটু দিয়া আসো অরে। আমিই জোর করে রাখতে গিয়া সন্ধ্যা করছি। মাইয়া মানুষ একলা ছাড়ন মুশকিল।

‘এ্যাহ্ আসছে মেয়ে মানুষ দাদী তো জানে না এই মেয়ে একাই দুনিয়া ভেজে খায়।’ মনে মনে এমনটা বললেও মুখে বলল, ‘তুমি এসো। আর তোরা ভেতরে যা।’

নুপুরকে নিয়ে গেইট পেরিয়ে যেতেই অর্নিতা বাড়ির ভেতরে চলে গেল। অর্ণব কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে রিকশা ডেকে নুপুরকে ইশারা করলো উঠে বসতে। নুপুর উঠে পড়লো রিকশায় আর একটু চেপে অপরজনের জন্য জায়গা রেখে তাকাতেই দেখলো অর্ণব চলে গেল পেছনের দিকে।

-এ্যাই…..

পুরো কথা বলার আগেই নুপুর খেয়াল করলো মানুষটা অন্য এক রিকশায় উঠেছে। না চাইতেও খুব মন খারাপ হয়ে গেল তার। সে কি চাইছিলো লোকটা তার পাশে বসুক! মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল আজ দুপুরে অর্ণব বাড়ি আসেনি খেতে এমনকি তার দেয়া মেসেজগুলোর কোন জবাবও দেয়নি। বলা যায়, সম্পূর্ণরূপে অবহেলা করেছে এমন একজনের জন্য তার মন খারাপ হচ্ছে? ধিক্ নুপুর তোমার ওপর ধিক্! চোখজোড়া আপনাতেই জলে ভরে গেল।রিকশা গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই হাতের ব্যাগটা থেকে ফোন বের করে সে বাবাকে জিজ্ঞেস করলো কোথায় আছে? নাজিম সাহেব সবেই এসে পৌছেছেন বাজারে মেয়েকে বলে দিলেন ঠিক কোথায় এসে নামবে৷ নুপুরও রিকশাওয়ালাকে বলল নির্দিষ্ট জায়গার কথা। অর্ণবের রিকশাও সামনের রিকশা অনুসরণ করলো। নুপুর রিকশা থেকে নেমে সামনেই পেল বাবাকে।

-একাই এসেছিস? বললাম না আমি আসছি ঠিকানা বল।
চিন্তিত নাজিম সাহেব মেয়েকে রাগ দেখাতে চাইলেন। নুপুরও বলে উঠলো, ‘ একা আসিনি অর্নিতার ভাইয়া এসেছে।’

নুপুরের কথার মাঝেই অর্ণব পেছনের রিকশা থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে পাশে। দু রিকশার ভাড়া দিয়ে এগিয়ে এসে সালাম দিলো নাজিম সাহেবকে।

-ইনি অর্ণব… ভাইয়া অর্নিতার ভাই।

নাজিম সাহেব অবাক হলেন আবার বোধহয় খুশিও হলেন। ছেলেটি দারুণ তো! অন্যান্য ছেলেদের দেখা যায় বোনের বান্ধবী, নিজের বান্ধবী কিংবা আত্মীয়মহলের মেয়েদের সাথে সুযোগ পেলে একসাথে বসে পড়ে অথচ ছেলেটি কি সুন্দর করে আলাদা রিকশায় চড়লো। অর্ণবের এ আচরণ দেখে শুধু নাজিম সাহেব নয় নুপুরও অবাক হয়েছিল তবে তার মুগ্ধতার পরিমাণটাই বোধহয় বেশি। পছন্দের মানুষটির ব্যক্তিত্ব চমৎকার হলে মন এমনিতেই পুলকিত হয় নুপুরেরও হচ্ছে। কিন্তু মানুষটা বড্ড গোমরামুখো। এমন মানুষের প্রেমে পড়াটাই যে অন্যায় এ কথা ভুলে গেলে চলবে না এই বলে নুপুর নিজেকে শাসায়।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে