কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-০১

0
497

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#সূচনা_পর্ব
-রূবাইবা মেহউইশ

‘দুইটা বাচ্চা রেখে এই বিয়েটা করিস না ময়না। তোর ছেলে মেয়ে দুটো অনাথ হয়ে যাবে।’

অশ্রুসজল চোখে আকুল আবেদন বড় বোন রায়নার। ময়না সে কথায় পাত্তা দিলো না। একটু পরই তামিম আসবে তার বন্ধুকে নিয়ে। দেখা সাক্ষাৎ আগেই হয়েছে আজ শুধু বিয়েটা হবে। এই মুহূর্তে বড় আপার কান্না দেখে আবেগে মত পাল্টানো সম্ভব না।

‘উফ্ বড় আপা চুপ করো তো। তোমার যদি বেশিই দরদ লাগে তো নিয়ে যাও বাবুদের দেখি কতদিন রাখতে পারো!’

বিরক্তির রেশ ময়নার গলায়। এরই মধ্যে আবারও বলল, ‘পারলে তামিমদের সামনে আমাকে মোনা ডেকো আর না পারলে নামটাই উচ্চারণ কোরো না।’

বোনের মুখের কঠোর অভিব্যক্তি তাজ্জব করে দিল রায়নাকে। সাত বছরের ছোট বোন ময়না স্বভাবে চঞ্চল ছিল সর্বদা কিন্তু এতোটা ঔদ্ধত্য কবে হলো!

সন্ধ্যে নাগাদ ময়না আর তামিমের বিয়ে হয়ে গেল ঘরের সদস্যদের সাক্ষী রেখে। সাক্ষী ছিল ময়নার দুই সন্তান অর্ণব আর অর্নিতাও। তিন বছরের অর্নিতার বোধগম্য হয়নি মায়ের বিয়ে কিন্তু এগারো বছরের অর্ণবের মনে দাগ পড়লো আজন্মকালের মত। ঘরোয়া এবং দ্বিতীয় বিয়ে বলেই বিদায় পর্বও আয়োজন করে হয়নি। নিঃশব্দে প্রস্থান করেছে ময়না মেয়েটাকে নিয়ে ছেলেটাকে ফেলে গেছে বাপের বাড়িতে অবহেলা আর অনাদরের ছত্রছায়ায়।
______________

চৌদ্দ বছর পরের এক সকাল; মাথার ওপর উত্তপ্ত রোদ। ফল পাকা মৌসুমে হলদে ফর্সা মুখটায় চশমার পেছনে চোখের নিচ, নাকের ডগা আর চিবুকে ঘামের স্বচ্ছদানার রাজত্ব অনেকটা মুক্তোদানার মতন। দ্বিতীয় বছরের প্রথম সেমিস্টারের শেষ পরীক্ষা হলো আজ অর্নিতার। ভর দুপুরে কলেজ গেইটে দাঁড়িয়ে থেকে রিকশার অপেক্ষা বড্ড কষ্টদায়ক। করার আর কিছুই নেই তবুও রিমন ভাই ফ্রী থাকলে বলা যেত গাড়ির কথা। মনে মনে এ কথা ভাবতেই পাশে এসে দাঁড়ালো নুপুর৷

‘রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছিস? চল আমার সাথে স্কুটিতে করে নামিয়ে দেব।’

‘একদম না। কাল কিনে আজই প্রথম চালিয়ে এসেছিস তাও আবার হাত-পা ছুলে! আমার অত মরার শখ নাই তুই একাই যা।’

-ভয় পাস না জানু এখন কিচ্ছু হবে না। তখন তো তোর ভা…. নুপুর কথা শেষ করতে পারলো না। হুট করেই একটা গাড়ি এসে থেমেছে তাদের সামনে। অর্নিতা দেখলো গাড়িতে রিদওয়ান ভাই আর তার ভাইয়া এসেছে। নুপুরও দেখলো তাদের দুজনকে তাতেই তার কণ্ঠ রোধ হলো। উত্তপ্ত দুপুর আচমকাই আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হয়ে ঝলসে দিলো যেন নুপুরকে। সে আর একটি কথাও না বলে চুপচাপ স্কুটিতে গিয়ে বসলো। নুপুরের পলায়ন আন্দাজ করতেই রিদওয়ান ডাকলো, এ্যাই পিচ্চি চলে যাচ্ছ কেন?

নুপুর জবাব দিলো না উল্টো স্কুটি ছুটিয়ে পালাল সে। অর্নিতা বলল, ‘ও তোমাদের ভয় পায় রিদওয়ান ভাই।’

-কেন? রিদওয়ানের প্রশ্ন। অর্নিতা জবাব দেওয়ার আগেই অর্ণব বলল, ‘গাড়িতে ওঠ অর্নি মার্কেটে যাব।’

অর্নিতাও চুপচাপ উঠে বসলো গাড়িতে। অর্নিতা, অর্ণব দু ভাই বোনই অনেকটা চুপচাপ স্বভাবের তাই হয়ত দুজনে আর কোন কথা বলল না। রিদওয়ান যে খুব কথা বলে তেমনও নয় তবে তার এই দুই খালাতো ভাই,বোনের চেয়ে ভাল কথা বলে। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতেই রিদওয়ান আবার কথা বলল, ‘ অর্ণব আজ কিন্তু বাড়ি যাবি আমাদের সাথে। আম্মু জানে তুই আমার সাথে আছিস।’

অর্ণবের দৃষ্টি জানালার কাঁচ গলে পথের দিকে স্থির। সাঁই সাঁই করে পিছে চলে যাচ্ছে পথ আর পথের পথিকেরা তারা এগিয়ে যাচ্ছে সামনে এমন দৃশ্যে ভাবুক হয়ে আছে সে। রিদওয়ান জবাবের অপেক্ষা করে না সে তার মতই আবারও বলে চলে, ‘শিবলী ভাই ফোন করেছিল কথা বলতে চায় তোর সাথে।’

এ কথার পর মুখ ফেরালো অর্ণব। সে জানে শিবলী আর মেজো খালা কেন ফোন করছেন কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের প্রস্তাব মেনে নেওয়া মুশকিল। তাই ইচ্ছে করেই তাদের ফোনকল এড়িয়ে চলছে তাই বোধহয় তারা বড় খালাকে ধরেছে এবার। ঘাড় ফিরিয়ে একবার পেছনের সিটে বসা বোনটিকে দেখলো। গত মাসে আঠারোয় পা দিয়েছে এখনো কলেজ শেষ হয়নি আর এই মুহূর্তে বিয়ে! নাহ আর ভাবতে পারে না সে। গাড়ি এসে থেমেছে মৌচাক একটি মোবাইল শো রুমের সামনে। রিদওয়ান তার পরিচিত শো-রুমে নিয়ে এসেছে বলে অল্প সময়েই চমৎকার একটি হ্যান্ডসেট ডিসকাউন্টে পেয়ে গেল। অর্নির নিজস্ব কোন এন্ড্রয়েড ফোন ছিল না এতদিন৷ অর্ণব আর খালামনি দুজনেই চাইতো না অল্প বয়সে ফোন থাকুক অর্নির হাতে। প্রয়োজনে বাটন ফোন আছে আর অন্যান্য কাজে খালামনি, বৃষ্টি আপার ফোনই চলে। কিন্তু আজকাল কোচিংয়ের ক্লাস রুটিন, বিভিন্ন পড়ার অংশ মেসেজে শেয়ার করেন টিচাররা তাই অর্ণব এবার নিজে থেকে তাগিদ পেলো। কতবার আর খালামনি, বৃষ্টিকে জ্বা/লাবে! কিন্তু অর্নিতার জানা ছিলো না আজকের এই সারপ্রাইজ এর কথা অথচ মেয়েটা এখন জেনে অবাক হয়নি। রিদওয়ান নিজেই ফোন পছন্দ করে দিয়েছে দামটা অর্ণব মেটালো। ফোন হাতে পেয়ে অর্নি কোন উচ্চবাচ্য করলো না এমনকি ভাইকে ধন্যবাদটাও দিলো না তা দেখে রিদওয়ান চটাস করে একটা থাপ্পড় বসালো অর্নির মাথায়।

‘বেয়াদব! ভাই যে একটা সারপ্রাইজ দিলো থ্যাংকস দিলি না কেন?’

‘থ্যাংকস’

-আজব! জোরেই বলল রিদওয়ান ।
___________

-এ্যাই বৃষ্টি টেবিল গোছা জলদি অর্ণব আবার কারখানায় যাবে।

রায়না বেগম গোসলে ঢুকতে ঢুকতে মেয়েকে বলে গেলেন খাবার বাড়তে। অর্নিতা ফিরেই বৃষ্টির রুমে গোসলে গেছে। অর্ণবের আপাতত কিছু করার নেই বলে ড্রয়িংরুমেই বসে রইলো। সেখান থেকেই চোখে পড়লো বৃষ্টির তাড়াহুড়ায় টেবিলে খাবার বাড়া।

‘এত তাড়া কিসের তোর?’

-কই নাতো অর্ণব ভাই।

-তবে এমন ছুটোছুটি করে খাবার বাড়ছিস কেন?

-কই নাতো!

একই জবাবে বিরক্ত হলো অর্ণব৷ কিন্তু আর কিছুই বলতে ইচ্ছে করলো না তার। অর্ণব জানে এ বাড়িতে তার উপস্থিতি বৃষ্টিকে এলোমেলো করে দেয়। অবুঝ নয় সে তাই ইচ্ছে করেই খালার বাড়ির সীমানায় খুব একটা পা রাখে না সে। নেহায়েতই বোনটাকে এ বাড়ি রাখায় কৃতজ্ঞতায় মাসে দু একবার হাজির হয়। বোনের খরচটা জবরদস্তি খালার হাতে গুঁজে দেয়।

টেবিলে খাবার সাজানো হতেই বৃষ্টি রান্নাঘরে ঢুকে গেল। সেখান থেকে আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে মন ভরে দেখা যাবে প্রিয় মুখটাকে। বৃষ্টির সে চিন্তা মুহূর্তেই উবে গেল চোখের সামনে মাকে দেখে।

– এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছিস?

-আম্মু আজকে খাবারে কোন মিষ্টি আইটেম নাই আমি একটু সেমাই রাঁধি?

রায়না বেগম বোকার মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে৷ তারপর বিরক্তি নিয়ে বললেন, এই ভর দুপুরে ভাত রেখে তোর সেমাই কে খাবে!

আবেগি মনের আবেগের চাওয়া অর্ণব ভাইকে নিজের তৈরি কিছু একটা খাওয়াবে কিন্তু এ কথা মাকে কি করে বলবে! রায়না বেগমও বুঝি মেয়ের খায়েশ বুঝে গেলেন তাই নিজেই আবার বললেন, রেঁধে ফ্যাল দেখি অর্ণবটা খায় কিনা!

চৈত্র্যের খর দুপুরটা অকস্মাৎ হিমালয়ের শীতল, স্নিগ্ধ বেলায় পরিবর্তিত হলো যেন বৃষ্টির কাছে। ঝটপট হাত চালিয়ে তৈরি করে নিলো সেমাইটুকু৷ ততক্ষণে ডাইনিং টেবিলে খাওয়ার পর্ব অনেকটাই এগিয়ে গেছে। রিদওয়ান বাড়ি এসেও দুপুরের খাবারে থাকতে পারেনি অফিসের জন্য৷ জরুরি বার্তা পেয়ে অর্ণবদের পৌঁছে দিয়েই সে চলে গেছে৷ রিমন আর খালুও নিজ কাজে বাড়ির বাইরে তাই অর্ণবকে খালামনি আর অর্নিতার সাথেই খেতে হলো। বৃষ্টিকেও ডাকতে ভোলেনি কিন্তু মেয়েটা তো অর্ণবকে দেখে সেই যে হাওয়ায় ভাসছে এখনো তেমনই৷ সেমাইয়ের ওপর কাজু, কিশমিশ ছড়িয়ে গরম দুধ ঢেলে চটপট হাতে ডাইনিংয়ে এলো সে। অর্ণবের সামনে বাটি রাখতেই খালামনি বলল, খেয়ে দ্যাখ সেমাইটা।

-আচ্ছা।

এক চামচ সেমাই মুখে তুলে অর্ণব খালামনির দিকে তাকালো। বৃষ্টি তখনো তার চেয়ারের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে।

– ‘সেমাই ভাল হয়েছে।’ এই একটা বাক্য শুনতেই কিনা কে জানে অধীর আগ্রহে কর্ণদ্বয় বড় সজাগ বৃষ্টির কিন্তু না মন্দ ভাগ্য তার। অর্ণব ভাই সেমাইটা শেষ করলেও প্রশংসনীয় একটি শব্দও বললেন না। চোখের কোণে বিষাদ জমাট বাঁধলো বৃষ্টির। চুপচাপ সরে গেল ডাইনিং স্পেস থেকে। অর্ণব তা টের পেতেই খালার দিকে তাকালো, ‘শিবলী ভাই নাকি কথা বলতে চায়?’

অর্নিতার খাওয়া শেষ। ভাইয়া আর খালামনি এখন কি নিয়ে কথা বলবে তা বুঝতে পেরে সেও বসা থেকে উঠে এঁটো প্লেট বাটি নিয়ে কিচেনে গেল। এখন আর তার কোন কাজ নেই এখানে।

রায়না বেগম ভাগ্নের কথা শুনে প্রস্তুতি নিলেন মেজো বোনের বার্তাটা ঠিকঠাক উপস্থাপন করতে।

– শিবলী আর তোর মেজো খালামনি দুজনেই লাগাতার ফোন করছেন অর্ণব। তারা বিয়ের ব্যাপারে এবার আগাতে চায়। পি এইচ ডি করতে যাবে ছেলেটা তাই শায়না তাকে একা দিতে চায় না। আর বিয়ে যেহেতু আমরা আগেই মোটামুটি ঠিক করে রেখেছি তখন দেরি করে লাভ কি!

অর্ণব খালামনির কথা শুনে রাগ করলো না তবে মেজো খালার প্রতি ভীষণ অসন্তুষ্ট হলো। কারণ, এই বিয়ে নিয়ে কথা শুরু থেকে খালামনিই নিজেই এগিয়ে চলছে। নিজেদের মানুষ বলে অর্ণব কিংবা বড় খালামনি কেউই খুব একটা আপত্তি তোলেনি তবুও অর্ণবের পক্ষ থেকে জবাব ছিলো, অর্নির কলেজ শেষ হওয়ার আগে বিয়ে হবে না। অথচ এখন তারা তাড়া দেখাচ্ছে! অর্ণব ঠিক করলো মেজো খালার সাথে সরাসরি কথা বলবে এবার। রায়নাকে সে কথা জানাতে তিনিও বললেন, ‘ঠিক আছে এই শুক্রবার শায়নাদের আসতে বলি তুইও আসিস।’

-আচ্ছা খালা মনি আমি এখন যাই কাজ আছে একটু।

‘হু’

-অর্নি!

অর্ণব বোনকে ডেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আর সবটাই দোতলার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দেখলো বৃষ্টি। কত পাষাণ এই মানুষটা ভেবে পায় না সে। বোঝে তো সবই তবুও কেন এত অবহেলা করে তাকে? সেকি একটুও ভালো নয় দেখতে? অক্ষিযুগল জল ছলছল বুকের ভেতরটাও ফেঁপে উঠলো। সেই কবে মন ডুবেছিল অর্ণব ভাইয়ে এখন সে মন ডুবে ডুবে মরণের দোরগোড়ায় তবুও মায়া হয় না মানুষটার একটু৷

সারাদিনের কর্ম ব্যস্ততায় ছোট দাদীর খোঁজ নেওয়া হয়নি অর্ণবের। তাই তার ছোট্ট অফিসটায় ফিরেই সে দাদীকে কল দিতে ফোন বের করল পকেট থেকে। স্ক্রীণে কন্টাক্ট বের করার আগেই তার ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রীণে ভেসে ওঠা নম্বরটা অর্ধপরিচিত। আজ প্রায় সপ্তাহখানেক থেকে কল আসছে এই নম্বর থেকে অথচ রিসিভ করে হ্যালো বলার কয়েক সেকেন্ডেই কেটে যায়। প্রথম প্রথম ধারণা ছিল তার মা বোধহয় কল দেয় কিন্তু কথা বলার সাহস পায় না। দু দিন হয় ধারণা পাল্টেছে গত পরশু যখন হ্যালোর জবাবে কোন মেয়ের কাশির শব্দ শুনলো। আন্দাজ করে ফেলল কোন চেনা মেয়ে করছে কাজটা। কিন্তু কে!

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#সূচনা_পর্ব
-রূবাইবা মেহউইশ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে