কে বাঁশি বাজায় রে পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0
451

#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_১৪ ( অন্তিম পর্ব)
#নুর_নবী_হাসান_অধির

শ্যামল দুইজন মেয়েকে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে৷ শ্যামল এমন কাজ করতে পারে কখনও ভাবতে পারে নি৷ আয়েশা বেগম পরিস্থিতি থেকে নিজেকে আড়াল করতে লন্ঠনের আলো নিভিয়ে দিলেন৷ ধীর গতিতে নদীর তীরে পৌঁছে যান৷ তারপর শ্যামলকে অনুসরণ করে পিছন পিছন যান৷ নিজেকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সাথে রাখতে রামদা নিতে ভুলেননি৷ জ্যােংসার আলোয় যদিও সবকিছু দেখা যায়৷ বড় গাছের ছায়ার নিয়ে দাঁড়ালে দূর থেকে কিছু দেখা যায়না৷

শ্যামল মেয়ে দুইজনকে তাঁদের বাড়ির পিছনের দিকে নিয়ে আসল৷ এদিকে যে রাস্তা আছে আগে জানত না৷ সবাই বাড়ির সামনের রাস্তায় জানে৷ ঝুপঝাপে ভরপুর এই জায়গায়। যে কেউ দেখে মনে করবে পরিত্যক্ত ভবন৷

বিদ্যুতের ব্যবস্থা না থাকায় চারদিকে লন্ঠন জ্বালিয়ে রেখেছে৷ তার একটু পরই জেনারেটরের মাধ্যমে ইলেক্ট্রিসিটির ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ আয়েশা বেগম চারদিকে তাকিয়ে দেখতে পান জায়গাটিতপ (১০-১২) জন লোক আছে৷ অপারেশন থিয়েটারের মতো ব্যবস্থা আছে৷ অঙ্গ জীবিত বা সুরক্ষা রাখার জন্য বিভিন্ন ক্যামিকেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ শ্যামল সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আজ কোন কাজ করতে ভালো লাগছে না৷ তোদের চাহিদা মেটানোর জন্য মেয়ে দু’জনকে নিয়ে আসছি৷ আর বেঁধে রাখা শালাদের হাই পাওয়ারের ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রাখ৷ কাল সবার অর্গান বের করে শহরে নিয়ে যাব৷”

শ্যামল আর কথা বাড়াল না। সেখান থেকে বেরিয়ে আসে৷ আয়েশা বেগম নিজেকে আড়াল করতে ঝুপের নিচে লুকিয়ে পড়েন৷ তারপর একে একে বেরিয়ে আসে আইয়ুব আলী, আরিফ সাথে কয়েকজন প্রহরী। আয়েশা বেগমের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়৷ এদেরকে বাঁচানোর জন্য একটা দিনের সময় আছে৷ কিন্তু আজ ছাড়া বাঁচানো যাবে না৷ রাতের শেষ প্রহর চলছে৷ দুই ঘন্টা পরই আজান দিবে৷ তারমানে হাতে দুই ঘন্টা সময় আছে৷ আয়েশা বেগম আর ভাবতে পারছেন না৷ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন৷ তখনই মনে পড়ে যায় ইউসুফ, জুয়েল, শামীমের কথা৷ তারা গ্রামেই আছে ভিন্ন পরিচয়ে৷ শুধুমাত্র আয়েশা বেগম তাদের চিনে এবং রেগুলার তাদের কিছু না কিছু ট্র্যানিং দিয়ে যাচ্ছিল৷ আজ তাদের পরীক্ষা দেওয়ার পালা৷ আয়েশা বেগম দৌড়ে তাদের তিনজনের বাড়িতে যান৷ গভীর রাতে তাদের ঢেকে তুললেন৷ ইউসুফ চোখ ঢলতে ঢলতে বলল,

“কি হয়েছে ম্যাডাম! এতো রাতে আমাদের ডাক পড়ল যে৷”

আয়েশা বেগম উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

“এখন এসব বলার সময় নয়৷ আমাদের কিছু মানুষকে বাঁচাতে হবে৷ আজ আমাদের জীবনের ঝুঁকি নিতে হবে৷ যাওয়ার পথে তোমাদের সব বলা হবে৷”

তিন জোড়া চোখ রাতের জ্যােংসার আলোয় আয়েশা বেগমের প্রতিফলিত ছায়াকে অনুসরণ করে যাচ্ছে৷ পথিমধ্যে আয়েশা বেগম তাদের সব ঘটনা খুলে বলেন৷ সকলে চকিত হয়ে যায়৷ কখনও ভাবতে পারেনি এসব কাজ শ্যামল করতে পারে৷ শ্যামলকে প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজে পড়ানো হয়েছে৷ শ্যামলের নির্দেশনায় এসব কাজ হয়৷ কেউ কখন বুঝতে পারেনি এমন হবে৷

চুপি চুপি চারটি প্রাণ পরিত্যক্ত বাড়িতে প্রবেশ করে৷ জেনারেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু লুন্ঠন জ্বলছে৷ প্রথমে আয়েশা বেগম তারপর তিন জোড়া চোখ অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছে৷ সাবধানে প্রতিটি পা ফেলা হচ্ছে৷ প্রথমে অপারেশন থিয়েটার রুমে তারা প্রবেশ করে৷ ক্যামিকেল দিয়ে প্রতিটি অর্গানকে জীবিত রেখেছে৷ আয়েশা বেগম ফিসফিস করে বলল,

“তোমরা কোনদিন কাউকে খুন করেছো।”

খুনের কথা শুনে সকলের ঠোঁট শুকিয়ে যায়৷ ভয়ে চুপসে যায় সবাই৷ কঠিন গলায় বলল,

“আজ যদি তোমার মা, বাবাকে এভাবে হত্যা করা হতো তুমি তাদের ছেড়ে দিতে৷ তোমরা কি কাপুরুষের মতো বসে থাকতে? এগুলো মনে কর তোমার মা বাবার লাশ৷”

তবুও চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। আয়েশা বেগম সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“দেখ কিভাবে খুন করতে হয়?”

আয়েশা বেগম ঘুমন্ত আইয়ুব আলীর একজন লোকের মুখ বেঁধে ফেলে৷ রামদা দিয়ে এক টানে গলা কেটে ফেলে। রক্তের ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে৷ আয়েশা বেগম অগ্নি চোখে তাকিয়ে বলল,

“সবাই হাত পা বেঁধে ফেলে এভাবে গলা কেটে ফেল৷”

ইউসুফ, জুয়েল দু’জনে একে একে সবাইকে মেরে ফেলল৷ কিন্তু শামীম কিছুতেই পারছে না৷ সে একজনের হাত পা বেঁধে রেখেছে৷ নিজেকে বাঁচানোর জন্য ছটফট করছে৷ সমস্ত ঘরে রক্তের বন্যা৷ আয়েশা বেগম শামীমের হাত ধরে লোকটার গলা কেটে ফেলে৷ রক্ত ছিটকে শামীমের গায়ে যেতেই শামীম চিৎকার করে উঠে৷ আয়েশা বেগম সাথে সাথে শামীমের মুখ চেপে ধরে বলল,

“কোন আওয়াজ নয়৷ হাতে সময় নেই৷ আযান পড়ে যাচ্ছে৷ এখন শুভ সময়৷ সবাইকে বাঁচাতে হবে৷ কাঁধে করে সবাইকে নদীর পাড়ে নিতে হবে৷”

সবার পকেট হাতিয়ে কয়েদখানার চাবি খুঁজে পেয়েছে৷ মেয়ে দু’টোকে ধর্ষণ করে উলঙ্গ অবস্থা রেখেছে৷ তাদের দিকে কাপড় এগিয়ে দিয়ে বলল,

“তাড়াতাড়ি পড়ে এখান থেকে বের হও৷ কোন কথা নয়৷”

ছয় জন ছেলেকে ঘুমের মেডিসিন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে৷ ইউসুফ, জুয়েল,শামীম কাঁধে করে তাদের নদীর ধারে নিয়ে আসে৷ আয়েশা বেগম সবাইকে নিয়ে দ্রুত গতিতে নিজের বাড়ির ঘাটে চলে যায়৷ ইশারায় সবাইকে নদীতে ফেলতে বলেন৷ নদীতে ফেলার পর সবার জ্ঞান ফিরে আসে৷
________

চারদিকে আযানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে৷ ছেলেরা আয়েশা বেগমের লাহাড়ি ঘরে আছে৷ মেয়ে দু’জন আয়েশা বেগমের সাথে আছে৷ আয়েশা বেগম তাদের দু’জনকে বুঝিয়ে বলে,
“এসব কথা যেন কোন কান পক্ষিও টেওর না পায়। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও৷”

তারা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল৷ চিন্তামুক্ত হতে পারলেন না৷ কঠিন গলায় বলল,

“কেউ জানতে পারলে তোমাদের কোন ক্ষতি করব না৷ তোমাদের মা বাবাকে খুন করে ফেলব৷ মা বাবার ভালো চাইলে সব ভুলে যায়৷ আর মলম গায়ে মাখিয়ে নাও৷”

কথায় কাজ দিয়েছে৷ চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। যুদ্ধে জয় লাভ করার মূল হাতিয়ার হলো ভয় এবং তার দুর্বলতা। মেয়েদের সবথেকে দূর্বলতা হলো তাদের মা বাবা৷ তাদের জন্য সবই করতে পারে৷
___________

পরী বনানী থানায় তার বাবাকে দেখতে এসেছেন৷ আশালতা পলকের উপর টাকা চুরির অভিযোগ নিয়ে এসেছে৷ একটু পর পলক হোসাইনকে কোর্টে চালান করা হবে৷ পরীকে দেখেই মাথা নিচু করে ফেলল৷ তাচ্ছিল্যের সাথে পরী বলল,

“কাউকে কষ্ট দিয়ে কেউ সুখী হতে পারে না৷ যার জন্য সবকিছু ছেড়ে দিলেন আজ সেই আপনাকে চোরের অপবাদ দিল৷ জানেন আজ নিজেকে সব থেকে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে৷ মা এই বিষয়টা জানলে অনেক খুশী হবে৷”

পলক হোসাইন চোখ তুলে তাকানোর সাহস পাচ্ছেন না৷ চোখ থেকে অঝোরে অশ্রুকণা ঝরে যাচ্ছে৷ পরী বুকে পাথর চেপে বলল,

“আপনার জন্য এ শাস্তি পাপ্য ছিল৷ আমার মাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমি আপনাকে শাস্তি দিতাম৷ কিন্তু বাবা হওয়ার জন্য পারিনি৷”

পরী দাঁড়াতে পারল না৷ দ্রুত গতিতে বেরিয়ে আসল৷ সমাপ্তি পিছন থেকে ঢেকেও আটকাতে পারল না৷ দৌড়ে ছোট মায়ের বাড়িতে উপস্থিত হলো৷ হাতজোড় করে বলল,

“ছোট মা বাবাকে ছাড়িয়ে আনেন৷ বাবার হয়ে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। উনি তো আপনারও স্বামী হয়৷ আরিয়ানের বাবা হয়৷”

আশালতা রাগ নিয়ে বলল,

“তোর বাবা ২০ লক্ষ টাকার হিসাব দিতে পারেনি৷ আমার টাকা চুরি করে তোদের ভালো করবে৷ আমি থাকতে কোনদিন হতে দিব না৷”

পরীকে কিছু বলতে না দিল না৷ গার্ড দিয়ে পরীকে বের করে দিল৷ পরী যেতে যেতে বলল,

“তোর শাস্তি আমি দিব৷ আমার হাতের থাপ্পড় খাওয়ার জন্য বেঁচে আছিস এখন৷ খুন করে ফেলব কোন প্রমাণ রাখব না৷”
______________

পরিত্যক্ত ভবনে ঢুকেই তিনজনের মাথায় হাত। ফ্লোরে রক্তের ছাপ পড়ে আছে৷ রক্ত জমে তরল জেলির মতো হয়ে গেছে৷ শ্যামল চিৎকার করে বলল,

“এই কাজটা কে করেছে আমি তাকে কিছুতেই ছাড়ব না৷”

শ্যামল কিছু বলতে পারল না৷ তার আগেই মাটিতে লুটে পড়ল৷ দূর থেকে বিষাক্ত তীর তাক করা হয়েছিল। সেই বিষাক্ত তীর শ্যামলের গায়ে লাগে৷ সাথে সাথে আইয়ুব আলী, আরিফ মাটিতে লুটে পড়ে৷ এই বিষের প্রভাব বেশিক্ষণ থাকবে না৷ সর্বোচ্চ দুই ঘন্টা থাকবে৷ কবিরাজের কাছ থেকে এই বিষ নেওয়া হয়েছে৷ তিনি বিশেষ লতাপাতা দিয়ে তৈরি করেছেন৷ সবাইকে সেখানে বেঁধে ফেলা হলো৷ মুখে স্কচটেপ। জ্ঞান ফিরলে আয়েশা বেগমকে দেখে চমকে উঠে। ছুটার জন্য ছটফট করছে৷ আয়েশা বেগম বলেন,

“কোন লাভ হবে না৷ তোদের একটা কথা বলি৷ আসিফকে কে খুন করেছে, জানিস? তোদের প্রাণপ্রিয় আসিফকে আমি খুন করেছি৷ আমার পারুলকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিছিল৷ আমি আসিফকে কেঁড়ে নিছি৷ এখন তোদের প্রাণ কেঁড়ে নিব৷”

ইউসুফ হিংসাত্মক কন্ঠে বলল,

“এদের উপর আমি আগে গরম তেল ঢালব৷ আমার উপর গরম তেল ঢালছিল৷ আজ বুঝাব কেমন লাগে৷”

ইউসুফ কারো কথা না শুনেই আরিফের গায়ে গরম তেল ছুঁড়ে দেয়৷ বাদ পড়েনি শ্যামল, আইয়ুব আলী। ঝলছে যায় তাদের সমস্ত দেহ৷ আয়েশা বেগম শামীম ও জুয়েলকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“তোমাদের কোন রাগ থাকলে মিটাতে পার৷ আর শামীম তোমার বোনকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছিল আরিফ৷”

শামীম হাতে ছুরি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে৷ চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে৷ মুখ বাঁধা থাকায় প্রকাশ করতে পারছে না৷ মুক্তি পাওয়ার জন্য ছটফট করছে৷ শামীম আরিফের যৌনাঙ্গে লাথি দিয়ে বলল,

“আরও করবি মা, বোনদের সম্মান হরণ৷ তোদের মতো অত্যাচারীদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই৷”

শামীম পাগলের মতো আঘাত করতে থাকে আরিফকে৷ ঘটনাস্থলে আরিফ সেখানেই মারা যায়৷ শামীম চিৎকার করে বলল,

“আজ আমি যুদ্ধে জয়লাভ করেছি৷”

ইউসুফ জুয়েল একই ভাবে আইয়ুব আলী ও শ্যামলকে হত্যা করে৷
______________

আয়েশা বেগম পুলিশের কাছে সব স্বীকার করে৷ সকল দায় ভার নিজের কাঁধে নেন৷ এখানে ইউসুফ, জুয়েল, শামীমকে জড়াননি৷ শক্তি কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পাইনা পুলিশ৷ আয়েশা বেগম নিজেই দোষ স্বীকার করার ফলে সাত বছরের জেল হয়৷

২০০১ সালের ১৪ জানুয়ারি আয়েশা বেগম জেল থেকে মুক্তি পান৷ ফিরে আসেন নিজের প্রাণপ্রিয় ভূমি আনন্দপুরে৷ কাঁধে তুলে নেন স্কুলের দায়িত্ব। এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে৷ গ্রামে রাস্তাঘাটের অনেক উন্নতি হয়েছে৷ কিন্তু পলক হোসাইনকে দেখে বলেন,

“তোমার কোন জায়গায় নেই আমার বাড়িতে৷ তুমি আশালতার কাছে ফিরে যাও৷ বাকী জীবন আমি এই গ্রামের মাটিতেই কাটিয়ে দিব৷ তোমার কোনদিন জায়গা হবে না৷ ভালোবাসার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করে আমায় খুন করলে এতো কষ্ট হতো না৷”

পরীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলেন,

“কখনও অন্যায়ের কাছে মাথানত করবি না৷”

সমাপ্ত……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে