#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_০৩
#নুর_নবী_হাসান_অধির
বাবার কান্না দেখে পীরও বাবার সাথে কান্না করে দিল৷ পলক হোসাইনের কান্না সহ্য হচ্ছো না আয়েশা বেগমের৷ উনার কাছে কুমিরের কান্না মনে হচ্ছে৷ পরীর হাত ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসল৷ কড়া গলায় জবাব দিলেন,
“গ্রামে আপনার কোন জায়গা নেই৷ এখনই গ্রাম থেকে চলে যান৷ আপনার জীবনে পারুল, পরী বা আশেয়ার কোন অস্তিত্ব নেই৷ সবাই মৃত।”
পলক হোসাইন নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওঠে দাঁড়াল৷ তীব্র কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে৷ ওষ্ঠদ্বয় কথা বলার জন্য কাঁপছে৷ কিন্তু কথাগুলো গলায় দলা পেকে প্যাচিয়ে যাচ্ছে৷ তবুও কাঁপা কাঁপা ভেজা গলায় বলল,
“তুমি এতো পাষাণ হলে কিভাবে? কেন বুঝ না? আমি তোমাদের আজও সেই আগের মতোই ভালোবাসি৷ আমার ভালোবাসায় একটুও কমতি নেই৷”
আয়েশা বেগম রাগী গলায় বলেন,
“মুখে লাগাম দেন৷ আপনার মুখে ভালোবাসার কথা শোভা পাইনা৷ আপনার ভালোবাসা সেদিন কোথায় ছিল, যখন স্ত্রী সন্তান ভুলে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন৷ যখন নর পশুরা মেয়েকে ছিঁড়ে খেয়েছিল তখন কোথায় ছিল আপনার ভালোবাসা? কোনদিন পালন করেছেন বাবার দায়িত্ব। আজ হঠাৎ পিতৃত্ববোধ ফুটে ওঠেছে৷ আপনাকে যদি আমার চোখের সামনে দেখি মা, মেয়ে বিষ খেয়ে মা’রা যাব।”
আয়েশা বেগম পরীকে টানতে টানতে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যান৷ আর পিছুটান নয়, নিজেকে ভালোবাসায় ঢুবাতে চাননা৷ পরীকে নিয়েই গোটা পৃথিবী সাজাতে চান৷ পলক হোসাইন পিছন পিছন আসেন৷ এসে দেখতে পায় ভিতর থেকে কপাট লাগানো৷ পলক হোসাইন কপাট বন্ধ পেয়ে সেখানেই বসে পড়ল৷ ভেজা গলায় বলল,
“পরী, মা পরী দরজা খোল৷ তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে৷ মা দরজা খোল৷”
পরী জবাব দেওয়ার আগে আয়েশা বেগম রাগী গলায় জবাব দিলেন,
“আমার মেয়ের সাথে আপনার কোন কথা নেই৷ আমার দেহে শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত পরীকে আগলে রাখব৷ নর পশুরা পরীকে ছুঁতেও পারবে না৷”
“পারুলের কি হয়েছিল? কেন বার বার নর পশু বলে যাচ্ছে? তার সাথে কি হয়েছিল৷”
আয়েশা বেগম দরজা খুলে বলেন,
“পারুলের কিছু হয়নি৷ আমার নিষ্পাপ মেয়েকে তারা বাঁচতে দেয়নি৷ আমি সেসব ধ’র্ষনকারীদের বাঁচতে দিব না৷”
চোখের জল মুছে বলল,
“আরিয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে আপনাদের থাকার অনুমতি দিলাম৷ কাল যথাসময়ে ঢাকায় চলে যাবেন৷”
__________
আসিফ কিছুতেই অপমানের কথা ভুলতে পারছে না৷ যেভাবেই হোক পরীকে তার লাগবে৷ এক রাতের জন্য হলেও পরীকে চাই। পরীর সেই ডাগর আঁখি। ঘন পাপড়িতে মধুর চাহনি৷ যেকোন ছেলেকে নিজের দিকে আসক্ত করতে পারবে৷ আসিফ তার বাবা আইয়ুব আলী ওরফে গ্রাম পঞ্চায়েতের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“বাবা আমি পরীকে বিয়ে করতে চাই৷ পরীকে ছড়া আমি বাঁচব না৷ আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি৷”
ছেলের কথায় গ্রাম পঞ্চায়েতের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। পরীকে বিয়ে করালে মোটা অঙ্কের যৌতুক পাবে না৷ আসিফের গালে থাপ্পড় বসিয়ে বলল,
“পরীকে বিয়ে করলে কোন যৌতুক পাবি না৷ পাশের গ্রামের মোড়ল সাহেবের মেয়ের সাথে তোর বিয়ে ঠিক করেছি৷ মোড়ল সাহেবের মেয়ের সাথেই তোর বিয়ে হবে৷ মোড়ল সাহেবের অনেক জমিজমা। যৌতুকে অনেক টাকা দিবে।”
বাবার অবাধ্য হয়ে বলল,
“আমি পরী ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব না৷ বিয়ে করলে পরীকেই করব৷ দরকার পড়লে বিয়ের পরের দিনই পরীকে নিষিদ্ধ পল্লীতে বিক্রি করে দিব৷ তবুও পরীকেই বিয়ে করব৷”
ছেলের কথায় আইয়ুব আলীর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি উঁকি দিল৷ ঠোঁটের কোণে পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠে।
_________
ঢাকা যাওয়ার অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঢাকার উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করতে হচ্ছে৷ পরী মন খারাপ করে বসে আছে৷ কিছুদিন থাকার জন্য পলক হোসাইন মেয়েকে কিছু বলেও লাভ হয়নি৷ বাড়ি থেকে বের হবার আগ মুহুর্তে গ্রাম পঞ্চায়েত এসে উপস্থিত। পলক হোসাইন সম্মানের সহিত সালাম দিলেন৷ আয়েশা বেগম শাড়ীর আঁচল ঠিক করে সামনে এসে সবাইকে বসতে বলেন৷ আইয়ুব আলী বলেন,
“বিচলিত হওয়ার কিছু নেই৷ আমি তোমাদের বাড়িতে একটা কাজে এসেছি৷ যদি জানতাম পলক হোসাইন ঢাকা থেকে এসেছে তাহলে রাতেই দেখা করতে আসতাম৷”
আরও কিছু বলতে চেয়েছিল৷ আয়েশা বেগম গ্রাম পঞ্চায়েত মশাইকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,
“পঞ্চায়েত মশাই ঘুরিয়ে কথা না বলে সরাসরি কাজের কথা বলেন৷ এতো বাজার করে কেন নিয়ে এসেছেন?”
গ্রাম পঞ্চায়েত পানের পিক ফেলে বলল,
“ঘুরিয়ে কথা বলতে আমিও পছন্দ করিনা৷ বাজার করে নিয়ে আসছি নতুন আত্মীয় করার জন্য৷ পরীকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে৷ আসিফের বউ করে আমার বাড়িতে তুলতে চাই৷”
আয়েশা বেগম কিছু বলতে নিলে গ্রাম পঞ্চায়েত হাত তুলে থামিয়ে দেন৷ তিনি পুনরায় বলেন,
“আমার কথা শেষ হওয়ার কর কথা বল৷ পরী আমার বাড়িতে রাজরানীর মতো থাকবে৷ কোন কাজই করতে হবে না৷ অন্দরমহলে কাজের লোকের অভাব নেই৷ তোমার মেয়ে সুখেই থাকবে৷ তোমার কথা থাকলে বলতে পার? পলক হোসাইন কি বলে? বাবা যেহেতু বাড়িতেই আছে৷”
আয়েশা বেগম কড়া গলায় জবাব দিলেন,
“এখন আমি পরীকে বিয়ে দিব না৷ পরীর লেখাপড়া শেষ হয়নি৷ পরীকে মানুষের মতো মানুষ করব৷ আনন্দপুর তার জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হবে৷ তাকে দেখে অনেকে উৎসাহিত হয়ে পড়াশোনা করবে৷”
গ্রাম পঞ্চায়েত মশাই ছেলে আসিফের দিকে রাগী চোখে তাকালেন৷ এখন অব্দি উনার কথার কেউ অমান্য করতে পারেনি৷ মিথ্যা হাসি দিয়ে বলল,
“মাশাল্লাহ! পরী বিয়ের পর পড়তে চাইলে পড়বে৷ আমরা কোন বাঁধা দিব না৷”
পঞ্চায়েতের কথা সহজ মনে হচ্ছে না৷ তিনি চাননা কোন মেয়ে লেখাপড়া করুন৷ উনার উক্তিতে মেয়েরা ভোগের সামগ্রি৷ তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা বলতে কিছু থাকতে পারে না৷ আয়েশা বেগমের সন্দেহ হওয়ায় কড়া গলায় জবাব দিলেন,
“অনেক হয়েছে পঞ্চায়েত মশাই। আমার মেয়েকে আপনার লাফাঙ্গা ছেলের সাথে বিয়ে দিব না৷ তার কোন যোগ্যতা নেই আমার মেয়েকে বিয়ে করার৷ লেখাপড়ার জন্য দেশের বাহিরে পাঠিয়েছিলেন৷ কিন্তু লেখাপড়া শেষ করতে পারেনি। এমন ছেলের সাথে আমি পরীকে বিয়ে দিব না৷”
পঞ্চায়েত মশাই কথাগুলো হজম করে নিলেন৷ উনাকে এভাবে অপমান করবে বুঝতে পারেনি৷ এতোগুলাে কাজের লোকের সামনে মেনে নিত পারল না৷ অন্তরে বিষ রেখে মুচকি হাসি দিয়ে হুমকিস্বরূপ বলেন
“আপনাকে কিছুদিন ভাবার সময় দেওয়া হলো৷ ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত জানাবেন৷”
দাঁতের চিবুকে পান দিয়ে বলেন,
“কোন সিদ্ধান্ত নয়৷ পরীই হবে আসিফের বউ৷ সময় মতো তাদের বিয়ে হবে। সে নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবে না৷”
এক প্রকার হুমকি দিয়ে পঞ্চায়েত মশাই চলে যান৷ পলক হোসাইন বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলেন,
“পরীকে বিয়ে দিতে সমস্যা কি? পরী বিয়ের বয়স হয়েছে৷ সেখানে পরীকে বিয়েতে দিলে অনেক সুখেই থাকবে৷ তাদের টাকা পয়সার অভাব নেই৷”
“আমার মেয়েকে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না৷ টাকা পয়সা সুখ এনে দিতে পারে না৷ আপনি তো বড় চাকরি করেন৷ ঢাকায় গাড়ি বাড়ি আছে৷ টাকা পয়সা আমাকে সুখ এনে দিয়েছে৷ যুদ্ধের সময় আপনার জীবন বাঁচিয়েছিলাম বলে বিয়ে করেছিলেন৷ যখন পরী গর্ভে আসেন৷ তখন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন৷ এখন দায়িত্ব দেখাতে এসেছেন৷ পরীর জন্য তার মা আছে৷ শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত পরীর পাশে থাকব৷”
আয়েশা বেগমের খোঁচা দেওয়া কথা একদম অপছন্দ পলক হোসাইনের৷ সে সময় পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে ঢাকায় যেতে হয়েছিল৷ ৭৪ এর অভাব অনটনের কথা চিন্তা করেই এসব করতে হয়েছিল৷ ভাবতেই গা শিহরিত হয়ে উঠে।
বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের মার্চে শুরু হয়ে সেই বছরেরই ডিসেম্বরের দিকে গিয়ে শেষ হয় দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল। সরকারী হিসাব অনুসারে ২৭,০০০ মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। বেসরকারি হিসেবে অনুমানিক ১,০০,০০০ থেকে ৪,৫০,০০০ জন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মৃত্যুবরণ করে। এই দুর্ভিক্ষকে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক হিসেবে গন্য করা হয়।
তখন পরিবারের কথা চিন্তা করেই পলক হোসাইন ঢাকায় যাত্রা শুরু করেন৷ ঢাকার মাঝেও দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে৷ চারিদিকে হাহাকার। খেতে না পাওয়ার কষ্ট। পথে দ্বিতীয় স্ত্রী তথা আশালতার সাথে দেখা হয়৷ আশালতা ধনী পরিবারের মেয়ে থাকায় মিথ্যা পরিচয় নিয়ে আশালতাকে বিয়ে করেন৷ সেখান থেকেই আশালতা তার দ্বিতীয় স্ত্রী। সে পরিবারেরও রয়েছে ছোট্ট এক রাজকুমার আরিয়ান৷
_________
সময় ও স্রোত কারোর জন্য অপেক্ষা করে না৷ চোখের পলকে শীত বসন্ত চলে গেছে৷ গ্রীষ্মের প্রখর তাপের মধ্যে দিয়ে বাড়িতে ফিরে আয়েশা বেগম৷ বাড়িতে প্রবেশ করতেই ঢাক ঢোলের আওয়াজ কানে আসে৷ পঞ্চায়েত মশাইয়ের পাশে বসে আছে পরী৷ আয়েশা বেগম বাড়িতে প্রবেশ করতেই ঢাক ঢোলের আওয়াজ বন্ধ করে৷ পঞ্চায়েত মশাই সামনে এগিয়ে এসে বলেন,
“আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম৷ পরশু পরীকে আমার বাড়ির বউ করে নিয়ে যাব৷ দুই দিন পরীকে দেখে রাখবেন৷ আমার কথার অন্যতা হবে না৷”
পঞ্চায়েতের কথা শুনে আয়েশা বেগমের ভীষণ রাগ হয়৷ আয়েশা বেগমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাড়ি থেকে চলে যান৷ পরী মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। দুই হাতে মেয়েকে আগলে নেন৷ দু’চোখের জল বাঁধ মানছে না৷ অশ্রুপাত হয়েই যাচ্ছে৷ কাঁপা কাঁপা ভেজা গলায় বলল,
“মা, আমি আসিফকে বিয়ে করব না৷ আমি কিছুতেই আসিফকে বিয়ে করব না৷ তার চরিত্রের ঠিক নেই৷ সে অনেক মেয়ের সাথে….।”
আয়েশা বেগম পরীর মাথায় হাত ভুলিয়ে সান্ত্বনা দিল৷ পরীকে আভয় বানী দিয়ে বলল,
“তোর সাথে আসিফের বিয়ে হবে না৷ তুই বিয়েতে শুধু নাম মাত্র রাজি হয়ে যাহ৷ বাকীটা আমি দেখে নিব।”
পরী চকিত হয়ে বলল,
“বিয়েতে রাজি হব মানে? বিয়ে হতে দিবে না আবার বিয়েতে রাজি হতে বলছো৷ বিয়েতে রাজি হওয়া মানে আসিফের সাথে সংসার করা৷”
আয়েশা বেগম মুচকি হেসে বলেন,
“রহস্য৷ কোন ভাবেই আসিফের সাথে তোর বিয়ে হবে না৷ তুই শুধু আমার কথা মেনে চল।”
“কিসেেেেেেসসসরররর রহস্য…!”
চলবে………