#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_০২
#নুর_নবী_হাসান_অধির
ধ’র্ষকদের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তারা পৃথিবীতে বিরাজ করলে অবুঝ নিষ্পাপ মেয়েদের মনে সাহসের সঞ্চার হবে না। জীবনে উন্নতি করতে সাহস করবে না৷
ফিরোজ মিয়ার অবস্থা দেখে সবাই কেঁপে উঠেছে৷ এতোটা নিষ্ঠুরভাবে কে হ’ত্যা করতে পারে? তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ বিভিন্ন অংশে কাটা হয়েছে৷ হাতের প্রতিটি আঙ্গুলের নখ উপড়ে ফেলা হয়েছে, পা দু’টো দেহ থেকে আলাদা৷ দেহ থেকে গর্দান আলাদা৷ তাছাড়া দেহের সমস্ত অংশ কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। পরী আয়েশা বেগমের হাত ধরে নিশ্চুপ অন্যত্র দাঁড়িয়ে আছে৷ আজ পরীর মনে কোন ভয় হচ্ছে না৷ মনের মাঝে রঙিন প্রজাপতি নৃত্য করছে৷ মনে মনে আল্লাহকে শুকরিয়া জানাল৷ গ্রামের লোকজন ফিরোজকে ধরার সাহস পাচ্ছে না৷ ফিরোজের জন্য জানাযা নামাজ হলো না৷ কিছু লোক নদীর তীরে গর্ত করে মাটি চাপা দিল৷ ফিরোজের অবস্থা দেখে বাকী দুষ্টু লোকগুলো সাবধান হয়ে যায়৷
হেমন্তের শেষের না হতেই চারদিকে শীতের আমেজের অনুষঙ্গ দেখা দিয়েছে। পানি কমে যাওয়ায় নদীর তলানী দেখা যাচ্ছে৷ চিক চিক করছে বালী৷ ঝড়ে যাচ্ছে গাছ থেকে পাতাগুলো। শুষ্ক আবহাওয়ায় পানির অভাবে গাছের পাতা নিজের অস্বস্তি টিকিয়ে রাখতে পারে না৷ পরী নদী থেকে চিংড়ি মাছ ধরে এনে বলল,
“মা, আজ লাউ রান্না কর৷ গাছের কচি লাউ চিংড়ি মাছ দিয়ে রান্না করলে অনেক স্বাদ লাগে৷”
আয়েশা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন৷ পরীর জীর্ণ শরীরটা খাবারের প্রতি একটু বেশিই লোভ৷ প্রচুর খাবার খাওয়ার পরও জীর্ণ হয়েই গেল৷ স্বাস্থ্যের কোন উন্নতি নেই৷ অবশ্য মায়ের কাছে প্রতিটি সন্তানই স্বাস্থ্যবান৷ কিন্তু পাড়ার দাদী কাকিমারা চিকনা বলে ক্ষেপায়৷ অবুঝ পরীও তাদের কথায় কান দিবে৷ মায়ের মুখের মুচকি হাসি দেখেই পরী দৌড়ে লাউ নিয়ে আসে৷ খাবারের সময় পরী বলল,
“তোমার হাতের রান্না একদম অমৃত৷ যে একবার খাবে সে কখনও ভুলবে না৷”
“খাবারের সময় কথা বলতে নেই৷ চুপচাপ খাবার খেয়ে নে।”
“মা, তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম৷ তুমি অনুমতি দিলে কথা বলব৷”
আয়েশা বেগম সরু চোখ করে মেয়ের দিকে তাকাল৷ ব্রো প্রসারিত করে বলল,
“কি কথা? আজ কাল সব কথাই ভুলে যাস৷ আর অনুমতি নেওয়া কবে থেকে শিখলি?”
পরী আমতা আমতা করে বলল,
“আসলে আব্বা চিঠি লিখেছেন৷ শীতে গ্রামের বাড়িতে আসবেন৷ সাথে… ”
পরী কথাটা শেষ করতে পারল না৷ কঠিন কন্ঠে জবাব দিলেন,
“থাক এসব কথা আমায় বলতে হবে না৷ আসলে আসবে, না আসলে নেই৷ উনার জন্য আমি থেমে নেই৷ আমি প্রকৃতির নিয়মে আপন গতিতেই চলব৷”
আয়েশা বেগম দ্রুত খাবার শেষ করে উঠে পড়ল৷ চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল৷ আড়াল করতে চাইলেও পরীর চোখ ফাঁকি দিতে পারল না৷ পরী মনে মনে বলল,
“আমার কাছ থেকে আড়াল করে লাভ নেই৷ তুমিও অনেক ভালোবাসাে৷ শুধু মান অভিমান, রাগের জন্য এমন কর৷”
_________
আয়েশা বেগমের ক্লাসে যেতে আজ একটু দেরি হয়ে যায়৷ ক্লাস রুমে যাওয়ার আগে রুম থেকে গন্ডগোল শোনা যায়৷ রুমে ঢুকতেই সবাই সম্মান জানালেন৷ তিনি সবার দিকে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন? ❝শিক্ষা কি?❞ একে একে অনেক ছাত্রকে প্রশ্নটা করা হলো৷ কেউ তেমন গুছিয়ে সুন্দর উত্তর দিতে পারলেন না৷ আয়েশা বেগম বলে উঠলেন,
“শিক্ষা হলো জ্ঞানলাভের একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া এবং ব্যক্তির সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। শিক্ষা প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেওয়া হয় এবং তাকে সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য যে সব দক্ষতা প্রয়োজন সেগুলি অর্জনে সহায়তা করা হয়। সাধারণ অর্থে দক্ষতা বা জ্ঞান অর্জনই হলো শিক্ষা।
সক্রেটিসের ভাষায়, “শিক্ষা হলো মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ।” এরিস্টটল বলেন, “সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হলো শিক্ষা।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, “শিক্ষা হলো তাই, যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না; বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকেও গড়ে তোলে।”
আমরা এখানে সবাই জ্ঞান লাভের জন্য এসেছি৷ শিক্ষা আমাদের মনের অন্ধকার দূর করে৷ আমাদের সম্মানের উচ্চতর শিখরে পৌঁছে দেয়৷ কিন্তু আমরা নিজেরাই সে শিক্ষাকে অবহেলা করছি৷ যেমন ধর, ‘আমি একটু দেরি করে রুমে ঢুকতেই তোমরা উচ্চ স্বরে কথা বলতে শুরু কর। পাশে ক্লাস নিতে সমস্যা হচ্ছে৷ নিজে কিছু শিখা নয়৷ অন্যকে শিখার মাঝেই মানুষের শিক্ষার গুণাবলি ফুটে উঠে৷ আজ থেকে কোন শিক্ষক রুমে দেরি করে প্রবেশ করলে বই খুলে পড়া রিভিসন দিবে৷ এখানে সবাই কষ্ট করে পড়তে আসো৷
আয়েশা বেগমের কথাগুলো সকল ছাত্রছাত্রী মনোযোগ সহকারে শুনল৷ স্কুল শেষ করে বাড়িতে চলে আসেন৷
________
গ্রাম পঞ্চায়েত মশাই লাঠি খেলার আয়োজন করেছেন৷ সাধারণত তিনি শীতের সময় এমন খেলার আয়োজন করেন৷ উনার ধারনা এই মৌসুমে খেললে মন চাঙ্গা থাকে৷ গ্রামের দামাল ছেলেরা খেলায় অংশ গ্রহণ করেছে৷ গ্রামে আয়েশা বেগম একজন সম্মানিত ব্যক্তি বলে তিনিও এখানে এসেছেন৷ পরীকে লাঠি খেলায় অংশগ্রহণ করার জন্য অনেক জোর করা হয়৷ কিন্তু কিছুতেই পরী লাঠি খেলায় অংশগ্রহণ করবে না৷ যার জন্য আয়েশা বেগম একাই চলে এসেছে৷
রেফারির বাঁশি ফুঁ দিলেই খেলা শুরু হয়ে যাবে৷ এমন সময় মুখে ওড়না প্যাচিয়ে খেলায় উপস্থিত হয় পরী৷ গ্রাম পঞ্চায়েতের সামনে দাঁড়িয়ে মিহি কন্ঠে বলল,
“পঞ্চায়েত মশাই আমিও খেলায় অংশগ্রহণ করতে চাই৷”
পরীর কথায় গ্রাম পঞ্চায়েত কিছুটা রেগে যান৷ তিনি রাগান্বিত কঠিন গলায় বললেন,
“মেয়ে মানুষ হয়ে লাঠি খেলতে চাও৷ এগুলো ছেলেদের খেলা৷ লজ্জা করে না এসব কথা বলতে৷”
“কোন কাজ ছেলে মেয়ে ভাগাভাগি করে হয়না৷ আপনার ছেলে আমার কাছে হেরে যাবে বিধায় আমার খেলতে মানা করছেন৷”
পরীর কথা শুনে পঞ্চায়েত মশাই বসা থেকে দাঁড়িয়ে যান৷ সিংহের মতো গর্জন দিয়ে বলেন,
“তোমার কিছু ধারণা আছে! তুমি কার সাথে কথা বলছো৷ আমি চাইলে এখনই তোমাকে গ্রাম থেকে বের করে দিতে পারি৷”
পরী এবার নিজের ক্ষোভ নিয়ে রাগী স্বরে বলল,
“ক্ষমতার দাপট চিরকাল থাকে না৷ আপনার ক্ষমতা থাকলে আমাকে খেলার সুযোগ দেন। আমি খেলায় হেরে গেলে নিজেই আনন্দপুর থেকে চলে যাব৷ আর আমার যদি খেলায় সুয়োগ না দেন আপনি হেরে গেছেন।”
পরীর সাথে কিছু লোক সুর মেলায়৷ গ্রাম পঞ্চায়েত মশাই বাধ্য হয়ে পরীকে খেলার অনুমতি দেন৷ পরীকে কেউ চিনতে না পারলেও আয়েশা বেগম চিনে নিয়েছেন৷ পরী মায়ের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় আভয় বানী দিল৷ পরী আর গ্রাম পঞ্চায়েতের ছেলে আসিফের খেলা শুরু হলো৷ আর অন্যরা খেলা থেকে বিরত রইল৷ হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে৷ আয়েশা বেগম আল্লাহর কাছে পরীর জন্য দোয়া করছেন৷ গ্রামের লোকজন আসিফ আসিফ বলে উৎসাহ দিচ্ছে৷ প্রায় ২ ঘন্টা খেলা হয়৷ পরীর কাছে পরাজিত হয় আসিফ৷ পরী মুখের ওড়না সরিয়ে বলল,
“পঞ্চায়েত মশাই আমাদের আর ছোট নজরে দেখবেন না৷ মা, মেয়ে থাকি বলে দুর্বল ভাববেন না৷ কখন সিংহের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ব বুঝতে পারবেন না৷ তাই মানুষ দিয়ে আমাদের অত্যাচার করা বন্ধ করেন৷”
আয়েশা বেগম স্কুল শিক্ষিকা বলে অনেকে মেনে নিতে পারে না৷ বিভিন্ন ভাবে তাদের অত্যাচার করে৷ ফসলের জমি নষ্ট করে৷ পঞ্চায়েত মশাই কিছু বলতে যাবে আবারও পরী বলে উঠল,
“আপনার ছোট ছেলেকে সাবধান হতে বলবেন৷ আমার পথ আটকিয়ে ছিল দুইদিন৷ মাকে না জানিয়ে আপনাকে বিচার দিছিলাম৷ কিন্তু কোন বিচার করেননি৷ এরপর নিজেই শাস্তি দিব৷”
আয়েশা বেগম মেয়ের বাঘীনি রুপ দেখে মুগ্ধ। তিনি চেয়েছিলেন পরী প্রতিবাদী মেয়ে হয়ে উঠুক৷ মেয়ের বিজয় দেখে চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। পরী আরও সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“যে মেয়েরা লাঠি খেলা শিখতে চাও আমাদের বাড়িতে চলে আসবে৷ আমি তোমাদের লাঠি খেলা শিখাব৷”
________
কিছুদিন পরই পরীর এসএসসি পরীক্ষা। পরীকে এখন আর স্কুলে যেতে হয়না৷ আয়েশা বেগম স্কুলে চলে গেছেন৷ শীতের দুপুরে সোনালী রোদের আলোয় নদীর ঘাটে বসে আছে পরী৷ সেই কবে বাবা চিঠি লিখলছিল? এখনও আসছে না কেন! আনমনে বসে বসে এগুলো ভাবছে৷ সেখান দিয়ে যাচ্ছিল আসিফ আর তুহিন৷ পরীকে দেখে তারা দাঁড়িয়ে পড়ে৷ আসিফ পরীর গা ঘেঁষে বসতেই পরী উঠে দাঁড়াল। আসিফ বাজে দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“পরী তোকে আমার খুব ভাল্লাগে৷ তোর যে তেজ, তোর সাথে রাত কাটাতে ভালোই লাগবে৷ লোক পাঠালে চলে আসিস৷ না আসলে জোর করে তুলে নিয়ে যাব৷”
পরী কষিয়ে আসিফের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল৷ চোখ বড় বড় করে বলল,
“আমাকে ছোঁয়ার অধিকার তোর নেই৷ তোর বাবা গ্রাম পঞ্চায়েত বলে তোকে আমি মেনে চলব! এটা আশির দশক৷ তোর জমিদারি চলবে না৷”
আসিফ পরীর দিকে এগিয়ে আসতেই পরী আরও একটা থাপ্পড় বসিয়ে বলল,
“যেখানে আসিস সেখানেই দাঁড়িয়ে থাক৷ আমি অন্য মেয়েদের মতো তোর কাছে সম্মান ভিলিয়ে দিব না৷ ফিরোজের মতো অবস্থা হতে পারে৷ ধ’র্ষকদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই৷ তোর বিষয়ে বান্ধবীদের কাছ থেকে জেনেছি৷ ফিরোজকে যে হত্যা করেছে তার কাছে তোর কু কর্মের খবর যেতে দেরি লাগবে না৷ সাবধান হয়ে যায়৷”
পরী হন হন করে বাড়িতে চলে আসে৷
_________
পলক হোসাইন বাড়ির গেইটে আসতেই পরী দৌড়ে জড়িয়ে ধরে৷ প্রতিটি বাবার কাছে মেয়ে তার রাজ্যের রাজকুমারী। তেমনই মেয়ের কাছে বাবার তার রাজ্যের রাজা৷ জড়িয়ে ধরেই কান্না করে দেয়৷ বছরে এক, দুই বার গ্রামে আসে৷ তখন পারুল, পরীর জীবনে স্বর্গীয় সুখ নেমে আসে৷ এবার পলক হোসাইন একা আসেনি৷ সাথে দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার ছেলে এসেছে৷ পরী তার সৎ মাকে দেখে মুহুর্তের মাঝেই সকল সুখ তেপান্তরে পালিয়ে যায়৷ আয়েশা বেগম আসতেই আরিয়ান বড় মা বলে দৌড়ে গেল৷ পলক হোসাইন এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
“পারুল কোথায়? তাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না যে৷”
পারুলের নাম নিতেই আয়েশা বেগম ও পরীর মুখ কালো হয়ে যায়৷ আয়েশা বেগম শাড়ীর আঁচল টেনে কান্না করে দিল৷ পলক হোসাইন আয়েশা বেগমের কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকি দিয়ে বলল,
“আমার পারুল কই? তুমি এভাবে কান্না করছো কেন? পারুলের কি হয়েছে?”
আয়েশা বেগম রাগী গলায় বললেন,
“এখন আপনার মনে পিতৃ স্নেহ জেগে উঠেছে৷ যখন পারুল ছটফট করছিল তখন কই ছিল আপনার ভালোবাসা?”
পলক হোসাইন হাতের মুষ্টি বদ্ধ করে বলল,
“পারুলের কি হয়েছে? কেউ আমায় দয়া করে বলবে?”
আয়েশা বেগম সবাইকে বাড়ির পিছনে নিয়ে আসে৷ আঙ্গুল দিয়ে পারুলের কবর দেখিয়ে বললেন,
“ঐ যে পারুল৷ মনের সুখে ঘুমাচ্ছে৷ আমাদের ছেড়ে বহুদূরে চলে গেছে৷”
পলক হোসাইন ধপাস করে মাটিতে পড়ল৷ মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল৷ পুরানো স্মৃতি সাড়া দিল মস্তিষ্কের নিউরনে৷ চোখ থেকে অঝোরে ঝড়ে যাচ্ছে অশ্রুকণা। আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল,
“পারুল মা আমার! পারুল!”
চলবে….