#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#সূচনা_পর্ব
#নুর_নবী_হাসান_অধির
পারুল গলায় দড়ি দিয়ে বড় বটগাছে ঝুলে আছে৷ নদীর তীরে বটগাছটা অনেকটা জায়গা জুড়ে দখল করে রেখেছে৷ গ্রীষ্মের দুপুরে মায়ের মতো ছায়া দিয়ে কৃষকদের বুকে আগলে রাখে৷ পারুলের জামাটা বিভিন্ন জায়গায় ছেঁড়া। দেখে মনে হচ্ছে কোন পশু আক্রমণ করেছে৷ পাড়ার ছেলেরা দড়ি কেটে পারুলের লা’শ নামাল৷ পারুলের মা, বোন মেয়ের এমন অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছে৷ কারো বুঝতে বাকী রইল না, একদল ক্ষুধার্ত পশু পারুলের সম্মান নষ্ট করেছে৷
পারুলের মা ভেজা গলায় চিৎকার করে বললেন,
“হ্যাঁ আল্লাহ! আমি তোমার দরবারে বিচার দিলাম৷ আমার মেয়েকে যারা পৃথিবীতে বাঁচতে দিল না৷ তুমি তাদের তুলে নাও৷ তুমি দুঃখীনি অসহায় মায়ের দোয়া কবুল কর৷”
লোকমুখে অনেক কথা শুনা যাচ্ছে৷ কেউ কেউ বলছে মেয়ে মানুষের পড়াশোনা করতে দিতে হয়না৷ মেয়ে বড় হলে বিয়ে দিতে হবে৷ ধমক দিয়ে মসজিদের ইমাম সাহেব বললেন,
“এসব কথা বাদ দিয়ে মরহুমার জানাযা নামাজের ব্যবস্থা করেন৷ মৃত দেহ বাহিরে বেশিক্ষণ রাখা ঠিক না৷”
পারুলের মা কান্না জনিত ভেজা গলায় বললেন,
“ইমাম সাহেব আমার মেয়ের এত বড় ক্ষতি হলো আর আপনি বলছেন জানাযা নামাজের ব্যবস্থা করতে। আপনার মেয়ের সাথে এমন হলে আপনি এ কথা বলতে পারতেন৷”
ইমাম সাহেব কোন কথা বলল না৷ উনার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। পাশ থেকে অন্য জন বললেন,
“কি করে পারুলের এ অবস্থা হলো? আমরা কেউ কিছু জানি না। পুলিশের কাছে চিঠি লিখলেও পুলিশ আসতে এক সপ্তাহ সময় লাগবে৷ এখান থেকে কেউ পুলিশের কাছে গেলে আসতে অনেক সময় লাগবে৷”
পারুলের মা আয়েশা বেগম সব দিক বিবেচনা করে আর কোন কথা বাড়ালেন না৷ তিনি পারুলের জানাযা নামাজের অনুমতি দিলেন৷ সন্ধ্যায় আয়েশা বেগম নিজের ছোট মেয়ে পরীকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছেন৷ দুই মেয়েকে নিয়েই ছিল আয়েশা বেগমের পৃথিবী। যুদ্ধের সময় মা বাবা ভাই বোন সবাইকে হারিয়েছে৷ বাবা স্কুল শিক্ষক হওয়ায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সবাইকে হত্যা করে৷ বাঁচতে দেয়নি দুই বছরের শিশুকেও৷ আয়েশা বেগম কাছে বাহিরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যায় এবং পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে৷
পরী পারুলের থেকে অনেক ভীতু মেয়ে৷ বোনের এমন অবস্থা দেখেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে৷ কিছুক্ষণ আগে জ্ঞান ফিরে এসেছে৷ পরী কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“মা, আপু আর আমাদের কাছে ফিরে আসবে না৷”
পরীকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে কান্না করে যাচ্ছে৷ ৭১ এর যুদ্ধের সময়ও এতো কষ্ট হয়নি। সেখানে শত্রু চেনা ছিল৷ এখন অচেনা শত্রুর সাথে কিভাবে মোকাবেলা করবেন?”
____________
দুইদিন পর নদীর তীরে আরও একজন মেয়ের লাশ পাওয়া যায়৷ তারও অবস্থা পারুলের মতো৷ প্রথমে তার সম্মান আত্মসাৎ করেছে৷ তারপর কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ এতটা নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে দেখেই লোকজন ভয় পেয়ে গেছে৷ পরপর দুইজন মেয়ের সম্মানে হাত দেওয়ার ফলে আনন্দপুরে কোন মেয়েকে ঘর থেকে বের হতে দেয়না৷ সকলের মনে ভয় ঢুকে গেছে৷ মেয়েরা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে৷ পরীকে ঘর থেকে বের করা দায় হয়ে পড়েছে৷ আয়েশা বেগম পরীকে নিয়ে অনেক চিন্তায় আছেন৷ মেয়েটা অনেক ভীতু৷ কিছু হলেই ভয়ে বের হয়না৷ আয়েশা বেগম মেয়ের হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে৷ আর কত নিজেকে লুকিয়ে রাখবে৷
হেমন্তের সোনালী রোদের আলোয় খেলা করে স্কুলে যাচ্ছে পরী৷ সাথে মা আছে। তার কোন ভয় নেই৷ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলায় বাংলার প্রকৃতি ও জীবন। কার্তিক-অগ্রহায়ণ দুই মাস বাংলাদেশে হেমন্তকাল। এক অপরূপ রূপ হেমন্ত, যে ঋতুর সঙ্গে মানুষের হাসি-কান্না জড়িয়ে আছে। সকালের শিশির ভেজা ঘাস আর হালকা কুয়াশায় প্রকৃতিতে বেজে ওঠে শীতের আগমনী বার্তা। মাঠের পাকা সোনালি ধান, কৃষকের ধান ঘরে তোলার দৃশ্য,কৃষক-কৃষাণির আনন্দ সবই হেমন্তের রূপের অণুষঙ্গ। বৈচিত্র্য রূপের সাজে প্রকৃতিতে হেমন্ত বিরাজ করে। হেমন্ত ঋতুতে চলে শীত-গরমের খেলা। হেমন্তের শুরুর দিকে এক অনুভূতি আর শেষ হেমন্তে অন্য অনুভূতি। ভোরের আকাশে হালকা কুয়াশা, শিশিরে ভেজা মাঠ-ঘাট তারপর ক্রমেই ধরণী উত্তপ্ত হতে থাকে। সৌন্দর্য এবং বৈশিষ্ট্য লালিমায় বাংলার ঋতুর রানী হেমন্ত।
কৃষকরা মনের সুখে গানের সাথে ধান কাটছে৷ মৃদু হলকা বাতাসে ধানগুলো প্রকৃতির সাথে নৃত্য করছে৷ আঁকাবাকা মেঠো পথ ধরে মহিষের গাড়ি যাচ্ছে৷ কেউ একজন ধান কাটা বন্ধ করে আয়েশা বেগমকে ডাক দিয়ে বলল,
“তুমি ওহন আবার মাইয়াডারে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছো। এক মাইয়াকে হারাইয়া মন ভরে নাই৷ এহন পরীকেও হারাতে চাও৷”
লোকটির কথা শুনে পরী মায়ের হাত চেপে ধরে৷ চোখে মুখে ভয়ের অনুষঙ্গ স্পর্শ। মেয়েকে ইশারায় ভয় না পাওয়ার ইঙ্গিত দিলেন৷ আয়েশা বেগম সুন্দরভাবে গুছিয়ে জবাব দিলেন,
“মজিদ ভাই, মেয়েরা শুধু ঘরে বসে থাকার জন্য জন্ম নেয়নি৷ বেগম রোকেয়া মেয়েদের পড়াশোনার জন্য অনেক সংগ্রাম করেছে৷ আমি একজন শিক্ষিত মা হয়ে নিজেকে মেয়েকে কিভাবে মুর্খ বানায়৷ আমি চেষ্টা করব আমার মেয়েকে সর্বোচ্চ শিক্ষা দেওয়ার৷”
“দেখমু তোমার দেমাগ কতদিন থাকে৷ ঘর বাড়ির কাম কাজ শিখিয়ে বিয়ে দিয়ে দাও৷”
অন্য আরেকজন কৃষক বলল,
“মজিদ ভাই কি যে কন? আয়েশা বেগমের দেমাগ বেশি দেইক্কা ওর সোয়ামী ঢাকায় আর একটা বিয়া করছে৷”
সবাই হাসিতে মেতে উঠল৷ মজিদ পানের পিক ফেলে বলল,
“মাও তো মাস্টন্নি। মাইয়াও মাস্টন্নি হইব৷ মাস্টন্নি বানাতে গিয়ে পাড়ার ছেলেদের হাতে তুলে দিও না৷”
পরী তাদের কথোপকথন শুনে যাচ্ছে৷ পরীর চোখে পড়ে এক টুকরো মাটি৷ সূর্যের তাপে শক্ত হয়ে সাদাটে হয়ে গেছে৷ মায়ের অপমান যেন সহ্য হচ্ছে না৷ চোখ থেকে ভয়ের পর্দা কেটে গেছে৷ জ্বলছে প্রতিশোধের নেশা৷ মাটি হাতে নিয়ে কৃষকদের দিকে ছুঁড়ে দেয়। মজিদের চোখে লাগার ফলে চিৎকার করে চোখে হাত দেয়। পরী চিৎকার করে ক্ষোভ নিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
“আমার নামের কিছু বললে আমি সহ্য করব না৷ আমার মা খারাপ নয়৷ আমার মায়ের নামে আর একটা বাজে কথা বললে সবাইকে মেরে ফেলব৷”
পরীর এমন অগ্নিমূর্তি ন্যায় রুপ দেখে আয়েশা বেগম অবাক হয়ে যায়৷ দেখে মনে হচ্ছে কোন সাহসী যোদ্ধা। আয়োশা বেগম কোন কথা না বলে পরীকে স্কুলে দিয়ে যায়৷ অন্যদিকে কৃষকরা বাজে কথা বলেই যাচ্ছে৷
___________
আজ শুক্রবার। পরীর স্কুল বন্ধ। আয়েশা বেগম রান্না শেষে পরীর হাতে একটা লাঠি দেয় এবং আয়েশা বেগমের হাতে একটা লাঠি৷ পরী চাকিত হয়ে বলল,
“মা লাঠি দিয়ে কি করব?”
“আজ থেকে তোকে লাঠি খেলা শেখাব৷”
“কিন্তু লাঠি খেলা ছেলেদের কাজ৷ আমার গায়ে ছেলেদের মতো শক্তি নেই৷ কিভাবে খেলব এতো শক্তশালী খেলা৷”
“বেশি শক্তি থাকলেই লাঠি খেলায় জয় লাভ করা যায়না৷ জয় লাভ করতে হলে কৌশন জানতে হয়৷ কঠোর অত্যাবসায়ের প্রয়োজন হয়৷ গভীর মনোযোগী হতে হয়৷ বিপক্ষের দুর্বলতা খুঁজে বের করতে হয়৷”
পরী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
“মা আমি এই খেলা পারব না৷ আমার ভীষণ ভয় লাগে৷ আমি যদি মা’র খাই৷”
“মা’র খাইলে খাবি৷ তবুও তোকে লাঠি খেলা শিখতে হবে৷ আমি তোকে সকল বিষয়ে পারদর্শী দেখতে চাই৷ ভয়কে জয় করতে শিখ৷ তোর বোনের কথা ভাব৷ তোর বাবার কথা মনে কর৷ তারা কেন তোকে ছেঁড়ে চলে গেছে? তোর বোন লাঠি খেলা জানলে আজ বেঁচে থাকত৷”
পরী চোখের জল মুছে লাঠি খেলা শিখতে চাইল৷ কিন্তু প্রথমেই হেরে গেল৷ মাটিতে বসে কান্না করে দিল৷ আয়েশা বেগম কিছু বলল না৷ মেয়ের পাশে বসে মাথায় বিলি কেটে বলল,
“মারে, মেয়েদের সবাই নিচু করে দেখে৷ তুই যত বড় হবি না কেন তোকে কিছু লোক নিচু করেই দেখব৷ তাদের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য অনেক কিছু ত্যাগ করতে হবে না৷ তাদেরকে জবাব দেওয়ার জন্য অনেক কিছু শিখতে হবে৷”
___________
গ্রাম পঞ্চায়েতের বাড়ি থেকে ফিরার সময় কিছু বখাটে ছেলের উক্তি আয়েশা বেগমের কানে ভেসে উঠে৷ তাদের কথা শুনে মনে পড়ে যায় পারুলের কথা৷ সেখানে ছেলেগুলোর মাঝে বেশির ভাগই তার ছাত্র৷ আয়েশা বেগম চোখের কোণ থেকে মনের অজান্তেই চোখ গড়িয়ে পড়ল৷ ছেলেগুলোর কথা এতোটাই ভাবিয়ে তুলল যে, সেদিন রাতে উদরে কিছু পড়ল না৷
রাত গভীর হতেই অন্ধকারে চিৎকারের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে৷ আকুল আবেদনে প্রার্থনা সহিত বলছে,
“আমাকে ক্ষমা করে দেন৷ আমি আর কখনও এমন কাজ করব না৷ আমি একদম ভালো হয়ে যাব৷ কোনদিন মেয়েদের দিকে খারাপ নজরে দেখব না৷”
ছেলেটির কোন কথা ঘাতকের কর্ণধারে পৌঁছাল না। নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে৷ ফজরের আজান কানে আসার আগেই ছেলেটির দেহ থেকে জীবন চলে যায়৷ ফজরের আজান কানে আসতেই ঘাতক চিৎকার করে বলল,
“আমি পেরেছি নোংরা মানসিকতার মানুষকে শাস্তি দিতে৷ আল্লাহ তুমি আমার পাশে থাকবে৷ আমি দেশের বুকে এমন আবর্জনা রাখব না৷”
ভোরের আলো ফুটতেই চারদিকে রটে যায় ফিরুজ মিয়াকে কে জানি নদীর তীরে নির্মমভাবে হত্যা করেছে? সবথেকে বেশি চিন্তার বিষয় হচ্ছে ফিরোজের গোপন লিঙ্ক কেটে টুকরো টুকরো করে রেখেছে৷ পাশে রক্ত দিয়ে লেখা ❝ধ’র্ষ’ক❞। ধ’র্ষ’কদের পৃথিবীতে বেঁচে থাজার অধিকার নেই৷
চলবে