কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে পর্ব-০৮

0
2088

কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৮.
পূর্ব দিকের লালাভ নীলিমা সূর্যোদয়ের জানান দিচ্ছে। নানান জাতের পাখির দল কিচিরমিচির শব্দে পরিবেশ মুখরিত করে তুলে চারদিকে ছুটেছে খাবারের খোঁজে। গ্রামের শিশু থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ সকলেই বিছানা ছেড়েছে সকাল হতেই। শিশুরা মক্তবে আর পুরুষরা ছুটছে নিজেদের কর্মস্থলে। মাঠে-মাঠে কৃষকরা নিজেদের কাজে লেগে পড়েছে। ভারী বৃষ্টিপাত থেকে ফসল রক্ষা করা নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা আর তাড়ার শেষ নেই। একজন স্কুল শিক্ষককে দেখা গেল সাইকেল নিয়ে স্কুলের দিকে যেতে। নৈঋতা তাকে দেখা মাত্রই সালাম জানাল। ব্যস্ত মাস্টার মশাইয়ের হয়তো সেদিকে খেয়াল ছিল না। নৈঋতার সালাম শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে-তাকাতে তার সাইকেল অনেকদূর চলে গেছে। সালামের জবাটুকু দিয়েছে কি না ঠিক বুঝা গেল না। রৌদ্রুপ প্রশ্ন করল,
“উনি কে নৈঋ?”
“আমগো স্কুলের মাস্টার। স্কুলে যাইতাছে।”
“এত সকালে?”
“হ, প্রাইভেট পড়াইব।”
“ওহ্ আচ্ছা। শোনো, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
“কী?”
“সামনেই তো আবার কলেজে ভর্তির কার্যক্রম শুরু হবে। এক বছর গ্যাপ পড়ে গেল তোমার। এবার কিন্তু তোমাকে ইন্টারে ভর্তি হতে হবে।”
নৈঋতা চোখ কপালে তুলে বলল,
“আবার পড়াশোনা করমু?”
“হ্যাঁ। কেন, তোমার ইচ্ছা করে না?”
“করে। কিন্তু পড়াশোনা চালাইতে পারি না দেইখাই তো ছাইড়া দিছি। আপনারে কইছিলাম না আরেকদিন? অহন আবার কেমনে করমু?”
“সেসব তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি আন্টি-আঙ্কেলের সাথে কথা বলে সব ব্যবস্থা করে দিবো।”
“আপনে কি টেকা খরচ কইরা আমারে পড়াইতে চাইতাছেন?”
“তোমাকে তা নিয়ে ভাবতে হবে না।”
“আমি অহনই আপনের টেকা খরচ কইরা পড়তে পারমু না।”
“দেখো নৈঋ, বিষয়টা টাকার নয়, তোমার জীবনের, আমাদের ভবিষ্যতের। জীবনটাকে এত সহজ ভেবো না। বাস্তবতা বুঝতে শেখো। ভবিষ্যতে যখন তুমি আমার পরিবারের একজন হবে, তখন কি তোমার ইচ্ছে হবে না আমার পরিবারের সাথে সমান তালে চলার? তাছাড়া কেউ যখন বলবে রৌদ্রুপের বউ তেমন পড়াশোনা করেনি, তখন সেটা শুনতে তোমার ভালো লাগবে, না আমার? একে তো তুমি বয়সে খুবই ছোটো। তার ওপর আবার আমার মা-বাবা যদি শোনে তুমি পড়াশোনা করো না, তাহলে তো সঙ্গে-সঙ্গে বলে দিবে এই মেয়েকে ছেলের বউ করব না। সবথেকে বড়ো কথা হচ্ছে, একটা মেয়ের নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মেয়েদের জীবন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনিশ্চিত।”
নৈঋতা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
“অনিশ্চিত ক্যান?”
“এই যেমন ধরো একটা ছেলে পড়াশোনা করে, চাকরি-বাকরি জুগিয়ে, প্রতিষ্ঠিত হয়ে পরে বিয়ের কথা ভাবতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ মেয়েদের ক্ষেত্রে হয় বিপরীত। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পায় কজন? অধিকাংশ ফ্যামিলি মেয়ে বড়ো হতে না হতেই বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগে। তাদের ধারণা মেয়ের বয়স বেড়ে গেলে ভালো পাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিয়ের পর সম্পূর্ণ নতুন সংসার, নতুন মানুষ, মানিয়ে নেওয়া, ধরাবাঁধা নিয়ম; এতসব একটা মেয়ের জন্য সহজ কিছু নয়। বিয়ের পর পড়াশোনা চালাতে গিয়েও অনেকে হিমশিম খায়। একদিকে সংসার, আরেকদিকে পড়াশোনা। আবার অনেকের তো পড়াশোনা বন্ধও হয়ে যায়। শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলো কেমন হবে তা-ও কিন্তু দারুণ এক অনিশ্চয়তা। তারপর ধরো যদি কোনো মেয়ে অকালে স্বামীহারা হয়, তার জীবন কেমন হয়ে যায় ভেবে দেখো। হয় দ্বিতীয় বিয়ে করতে হয়, নয় শ্বশুরবাড়ি বা বাবার বাড়ি পড়ে থাকতে হয়। কিন্তু একটা নি’র্মম সত্য হচ্ছে, কাজ ছাড়া কোথাও টিকে থাকা যায় না। স্বামী না থাকলে তোমার সম্মান সবার কাছে বজায় থাকবে কি না তা মোটেও বলা যায় না। সেটা বাবার বাড়ি হোক বা শ্বশুরবাড়ি। আবার কার জীবনে কখন কোন দুর্ঘটনা ঘটে যায়, বলা তো যায় না। তো এক্ষেত্রে যদি মেয়েরা অ্যাডুকেটেড হয়, তাহলে তার কারো ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করতে হয় না। পরনির্ভরশীলতা এড়ানো, ডিভোর্সি বা স্বামীহারা মেয়েদের কর্মসংস্থান, কিংবা নিজের আত্মসম্মান বজায় রাখার জন্য হলেও মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিত। এবার তোমার কথা বলি। একটু আগে যে বললাম নিজের সম্মান ধরে রাখার জন্যও তোমাকে পড়াশোনা করতে হবে? এবার অন্যভাবে ভাবো। হ্যাঁ এটা আমি হলফ করে বলতে পারি যে, আমি কোনোদিন তোমার আত্মসম্মানে আঘা’ত লাগতে দিবো না। যতদিন বাঁচব ততদিন নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখব। আমার দিক থেকে তুমি সম্পূর্ণ সাপোর্ট পাবে। কিন্তু আমার পরিবার আমার সাথে যতই ভালো হোক না কেন, তোমার সাথে কেমন হবে তা একমাত্র আল্লাহ্ জানে। কিছু মনে কোরো না। আমি সত্যিটাই বলছি। আমার বড়ো ভাবির সাথে মায়ের কদিন পর-পর কথা কা’টাকা’টি হয়, তা তো দেখি। বড়ো ভাবি একটু অন্যরকম। তার চাহিদা বেশি। এই নিয়ে ভাইয়ার সাথেও অনেক সময় মনোমালিন্য হয়। সবাইকে খোঁচা মে’রে কথা বলাটা তার অভ্যাস। দেখো আমি সোজাসাপ্টা কথা বলতে দ্বিধা করি না। ভাবি হয়তো তোমাকে গ্রামের মেয়ে, গরিবের মেয়ে, আনস্মার্ট, আনঅ্যাডুকেটেড এমন অনেকভাবে খোঁচা মে’রে কথা বলতে দুবার ভাববে না। যার দরুন আমাকে পাশে পাওয়ার পরও তুমি ঠিকই কষ্ট পাবে। পড়াশোনা করলে তুমি এসব সিচুয়েশন এড়াতে পারবে। নিজের পায়ে দাঁড়ালে ভবিষ্যতের অনেক অনিশ্চয়তা কা’টাতে পারবে। তোমার বাবা-মায়ের বয়স বাড়ছে, তার ওপর আবার সংসার চালানো কষ্টকর। একদিন তুমি চাইলে তাদের দায়িত্বও নিতে পারবে। বুঝেছ?”
নৈঋতা চোখে-মুখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে রৌদ্রুপের দ্বিধাহীন কথাগুলো শুনল। তার চোখ দুটি বুঝি সিক্ত হতে চাইছে। রৌদ্রুপ তার মুখের অবস্থা দেখে মুচকি হেসে পুনরায় বলল,
“মেয়ে, এত সহজে আবেগী হওয়া ঠিক না। আবেগ সামলাতে শেখো।”
নৈঋতা নরম গলায় বলল,
“আপনে কী সুন্দর কইরা কথা কন! এত ভালা ক্যান আপনে? আমিও আপনের মতো হমু।”
“একদিন তুমি আমাকেও টপকে যাবে পা’গ’লি, দেখো। আপাতত পড়াশোনার কথা ভাবো। আমি সবসময় তোমার পাশে আছি।”
নৈঋতা হাসিমুখে দ্রুত গতিতে পা চালাচ্ছে। এই তো মোটে তিন দিন হলো রৌদ্রুপের প্রণয়ের বন্ধনে সে বাঁধা পড়েছে। সেই থেকেই লোকটার যত পা’গলা’মি শুরু হয়েছে। প্রত্যেক দিন সকালে নদীর ঘাট থেকে ফিরতে দেরী হয়ে যায়। রৌদ্রুপ যত গল্প করে সময় ন’ষ্ট করে। নদীর ঘাট থেকে ফিরে বাড়িতে ঢুকেই তারা অবাক হলো। ঘরের দরজার সামনে আফিয়া বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। তার চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত। মলিন চিন্তিত মুখ। সামনে দুজন মহিলা দাঁড়িয়ে কী যেন বলছেন। রৌদ্রুপ আর নৈঋতা দ্রুত এগিয়ে গেল। নৈঋতা মায়ের সামনে বসে ব্যস্ত হয়ে বলল,
“কী হইছে মা? কাঁন্দো ক্যান?”
নৈঋতাকে দেখে আফিয়া বেগম এবার তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। অজানা আশং’কায় নৈঋতার ভয় বেড়ে গেল। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল কী হয়েছে। কিন্তু আফিয়া বেগম কান্নার তোপে উত্তরই দিতে পারছেন না। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা দুজনকে রৌদ্রুপ প্রশ্ন করল,
“আন্টি, উনি কাঁদছেন কেন?”
একজন মহিলা দ্বিধাভরা কন্ঠে উত্তর দিলেন,
“তাগো থিকাই হুনেন। আমগো কাম আছে, যাইগা।”
মহিলা দুজন একপ্রকার এড়িয়ে চলে গেলেন। রৌদ্রুপের চোখ গেল ঘরের ভেতর। চৌকির একপাশে পা ঝুলিয়ে থম মেরে বসে আছেন সামসুদ্দীন বেপারী। তার চোখেমুখের অবস্থাও আফিয়া বেগমের মতো চিন্তিত। রৌদ্রুপ ধীর পায়ে ঘরে ঢুকল। সামসুদ্দীন বেপারী চোখ তুলে তাকাতেই রৌদ্রুপ শুধাল,
“কী হয়েছে আঙ্কেল? আন্টি কাঁদছে, আপনি এভাবে বসে আছেন। কোনো সমস্যা হয়েছে?”
সামসুদ্দীন বেপারীর চোখের কোণ বেয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। রৌদ্রুপ ব্যস্ত ভঙ্গিতে পুনরায় একই প্রশ্ন করল। সামসুদ্দীন বেপারী এবার ধরা গলায় বললেন,
“সর্বনাশ হইছে গো বাপ। মাইয়াডারে মনে হয় জা’নোয়া’রগো হাত থিকা বাঁচাইতে পারুম না।”
রৌদ্রুপ অবাক হলো। বলল,
“কাদের হাত থেকে? আঙ্কেল, কী হয়েছে একটু খুলে বলবেন?”
“খাঁন বাড়ির পোলা কায়েসের নাম হুনছো না? ওই যে নসিবেরে ছাইপাঁশ খাওয়াইত?”
রৌদ্রুপ মাথা দুলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, একদিন দেখেছিলামও। আবার কী করেছে?”
“ওই জা’নোয়া’রের বাচ্চা গেরামের হগ্গল মাইয়াগো জীবন অতিষ্ঠ কইরা দেয়। রিতারেও কম জ্বা’লায়নায়। তুমি আওয়ার আগে একদিন একলগে কয়েকটা মাইয়ার লগে অসভ্যতামি করছিল। হেই মাইয়াগো লগে রিতাও আছিল। ওইদিন মাইয়াগুলান সইহ্য করতে না পাইরা হগ্গলে মিল্লা অরে জুতা দিয়া পিডাইছিল। কয়দিন সইহ্য করব? ওই ঘটনার পর কায়েসে আরও চেইতা গেছে। এতদিন মনে হয় সুযুগের আশায় রইছিল। গতকাইল সন্ধ্যার আগে মজিদের মাইয়া মাঠ থিকা খেইলা বাইত ফিরতাছিল, পতে ওই কু’লা’ঙ্গারের সামনে পড়ছিল। জা’নো’য়ারে মাইয়াডারে বাঁচতে দিলো না বাপ। ধৈঞ্চা খ্যাতে টাইন্না নিয়া হাত-পাগুলান বাইন্দা ইজ্জত কাইড়া নিছে, হেইয়াতেও ওর শান্তি হয়নায়। ফুলের মতোন মাইয়াডার জানডাও কাইড়া নিছে। মজিদের বুকটা খালি কইরা দিছে গো।”
রৌদ্রুপ চুপ মে’রে সামসুদ্দীন বেপারীর আহাজারি শুনছে। উনি থামতেই প্রশ্ন করল,
“সবাই জানল কীভাবে ও-ই কাজটা করেছে?”
“কী কও! এই গেরামের হগ্গলে অরে চিনে। অয় ছাড়া আর কেউ এমন জগইন্য কাম করতে পারে না।”
“ওকে পুলিশে দেয়নি?”
“দিছে। তয় লাভ নাই। দুইদিন পরই ছাইড়া দিবো।”
“কেন?”
“এমন কত জেলে ঢুকাইছে। বাপের টেকা আছে, ছাড়াইয়া লইয়া আহে। আমগো এইহানের পুলিশ হইল টেকা খাওইন্না। হাতে দুইডা টেকা পাইলেই সব খা’লাস।”
রৌদ্রুপের খারাপ লাগল। বেশ বুঝতে পারল ওনারা এখন নৈঋতাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছেন। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বাবা-মায়ের ভয়টা তাদের মুখেই স্পষ্ট। সামসুদ্দীন বেপারী পুনরায় আহাজারি করে উঠলেন,
“আমার মাইয়াডারেও অয় শান্তি দিবো না। আমার রিতার উপর অর নজর বহুদিনের। এর মইধ্যে আবার অহন ওয় এমন চেইত্তা গেছে। আল্লায় জানে কী হইব।”
রৌদ্রুপের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল। চিন্তা রেখাগুলো স্পষ্ট ফুটে উঠল। দুদিন পরই তাকে শহরে ফিরে যেতে হবে, আর আজই এমন দুঃসংবাদ। এ পর্যায়ে রৌদ্রুপের মনেও ভয় দানা বাঁধতে শুরু করল। মেয়েটাকে এই চরম বি’পদের মুখে ফেলে সে কীভাবে চলে যাবে? বলা তো যায় না, সত্যি-সত্যিই যদি কোনো দু’র্ঘট’না ঘটে যায়? সবে এক মিষ্টি সম্পর্কের সূচনা তাদের। সে যে কথা দিয়েছে তার ছোট্ট ভালোবাসাটাকে আগলে রাখবে। তবে এবার কী করবে সে? নিজের মনোভাব গোপন রেখে রৌদ্রুপ সামসুদ্দীন বেপারীর কাঁধে হাত রেখে শান্ত স্বরে বলল,
“ভয় পাবেন না আঙ্কেল। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন।”
শামসুদ্দীন বেপারীর পিতৃহৃদয় এই মিথ্যে সান্ত্বনা মানল না। সে তার মতোই আহাজারিতে মগ্ন। রৌদ্রুপ কিছুক্ষণ সেখানে বসে থেকে তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এল। আফিয়া বেগমের পাশ ঘেঁষে স্তব্ধ হয়ে বসা নৈঋতার দিকে দৃষ্টি স্থির হলো। নৈঋতা অশ্রুসিক্ত অসহায় দৃষ্টি তুলে রৌদ্রুপের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। দুজনের কারো মুখেই কোনো শব্দ এল না। রৌদ্রুপের ইচ্ছে করল এই মুহূর্তে মেয়েটাকে বুকে চেপে ধরে মাথায় ভরসার হাত বুলিয়ে বলতে, ‘এই মেয়ে, ভয় পাচ্ছ কেন? আমি আছি তো। আমি থাকতে কোনো বিপদ তোমাকে স্পর্শ করার সাহস পাবে না।’ কিন্তু বলা হলো না। মেয়েটার আশ’ঙ্কিত মুখটার দিকে তাকিয়ে সব এলোমেলো লাগল। রৌদ্রুপ আর সেখানে দাঁড়াল না। নিঃশব্দে প্রস্থান করল।

অতি সাবধানে দরজার খিল খুলে অতি সন্তর্পণে ঘর থেকে বেরিয়ে এল নৈঋতা। নিশুতি রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে চারপাশের কোনোকিছুই দৃশ্যমান নয়। হাতের ছোটো লাইটারের আলো জ্বেলে সে ছোটো ছোটো কদম ফেলে এগিয়ে গেল। ফোনের টর্চ জ্বা’লিয়ে মাচায় পা তুলে নীরবে বসে ছিল রৌদ্রুপ। নৈঋতার আগমনে মুখ তুলে তাকাল। নৈঋতা বিনা বাক্যে রৌদ্রুপের সামনে পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল। টর্চের আলোতে প্রেয়সীর শান্ত মুখ থেকে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করল না রৌদ্রুপের। গত তিন দিন ধরে প্রতিটা রাত এভাবেই কে’টেছে। নাহ্, রৌদ্রুপ মোটেও এই রাতে নৈঋতাকে বাইরে ডাকে না। নৈঋতা নিজেই আসে। মেয়েটা প্রেমে পড়ে সত্যিই আবেগী হয়ে পড়েছে। তার বয়সটাই যে এরজন্য দায়ী। রৌদ্রুপ এমন আবাগী বয়স পেরিয়ে এলেও, নৈঋতার জন্য এ নতুন কিছু। সে রোজ রাতে এসে পাশে বসে, বেশ অনেকটা সময় চুপ মে’রে বসেই থাকে, খানিক পর-পর দু-একটা কথা বলে। আবার যখন দুচোখে নিদ্রা এসে ভর করে, তখন ঘরে চলে যায়। আজ নৈঋতার মুখটা কেমন উদাসীন দেখাচ্ছে। টর্চ লাইটের আলোতেও প্রেয়সীর মুখোভাব বুঝতে রৌদ্রুপের ক্ষণকাল বিলম্ব হলো না। বুঝল মেয়েটার মন খারাপ। মন খারাপের কারণটাও তার অজানা নয়। রৌদ্রুপ মুখ খুলল না। অপেক্ষা করল কখন নৈঋতা স্বেচ্ছায় কথা বলবে। রৌদ্রুপ এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে নৈঋতা মুখ তুলে তাকাল। মাথার কাপড়টা টেনেটুনে ঠিক করে নড়েচড়ে বসল। অতঃপর শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল,
“আপনে আর কয়দিন আছেন?”
রৌদ্রুপ সহসা উত্তর দিতে পারল না। এই ছোটো প্রশ্নের মধ্যেই যেন সে হারিয়ে ফেলার বিশাল ভয় খুঁজে পেল। খানিক বাদে বলল,
“দুদিন। তুমি ভয় পাচ্ছ নৈঋ?”
নৈঋতা এই প্রশ্নের জবাব দিলো না। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসতেই সে হুড়মুড়িয়ে দৃষ্টি সরাল। রৌদ্রুপ চুপ থেকে নৈঋতাকে সময় দিলো নিজেকে সামলে নিতে। নত হয়ে নৈঋতা ক্রমাগত চোখের পানি মুছে চলেছে। রৌদ্রুপ জানে, ভালোবাসা, আত্মসম্মান, পারিবারিক সম্মান, সবকিছু হারানোর ভয় মেয়েটাকে ভেতর থেকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে। গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে সে নড়েচড়ে বসল। মৃদু কন্ঠে আহ্লাদী সুরে ডাকল,
“নৈঋ?”
নৈঋতা ভালোভাবে চোখ মুছে শুকনো একটা ঢোক গিলে মুখ তুলে তাকাল। তার টুকটুকে লাল নাকের ডগায় রোদ্রুপের দৃষ্টি আটকাল। নিজেকে ধাতস্থ করে রৌদ্রুপ প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে হুট করে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“আমায় বিশ্বাস করো তো?”
নৈঋতার ভ্রুদ্বয়ের মধ্যখানে কিঞ্চিত ভাঁজ পড়ল। পরক্ষণেই সে সোজাসাপ্টা উত্তর দিলো,
“নাহ্।”
রৌদ্রুপ চরম অবাক হলো। নৈঋতা তাকে বিশ্বাস করে না, কথাটা সহসা বিশ্বাস করে উঠতে পারল না। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই, নৈঋতা তার চোখের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে কোমল কন্ঠে পুনরায় বলে উঠল,
“পরিচয়ের প্রথম দিন করতাম না, দ্বিতীয় দিনও করতাম না, তৃতীয় দিন করছি। ভাবছিলাম এই মানুষটারে চোখ বন্ধ কইরা বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু অহন বুঝি, আমার ধারণা ভুল ছিল। আপনেরে বিশ্বাস করাডা আমার জীবনের সবচাইতে বড়ো ভুল ছিল। এই যে অহন আমার রাইতে ঘুম হয় না, সারাক্ষণ বুকের ভিতর হাঁসফাঁস করে, বারবার আপনের কাছে ছুইটা আইতে ইচ্ছা করে। এইসব বদঅভ্যাসের লাইগা কে দায়ী? আপনে। ওইদিন যদি আপনের প্রতি আমার বিশ্বাস না জন্মাইত, তবে আইজ আমার এমন অবস্থা হইত না।”
রৌদ্রুপ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে নৈঋতার কথাগুলো শুনছিল। সে মুচকি হেসে বলল,
“সেদিন বিশ্বাস জন্মেছিল বলেই তো আমি মেঘবতীকে নিজের করে পাওয়ার স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিলাম। এখন যে সে চোখের আড়াল হলেই আমার বুকের ব্য’থাটা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তাকে এক নজর দেখার জন্য প্রতিটা মিনিট পথ চেয়ে থাকি। তবে কি আমার এই অবস্থার জন্যও মেঘবতী দায়ী?”
নৈঋতা পারল না রৌদ্রুপের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। পূর্বের মতোই তড়িঘড়ি করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে লাজুক হাসল। কিন্তু হাসিটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“কইছিলাম না এই সম্পর্কে অপূর্ণতা নিশ্চিত? মাত্র তো তিনটা দিন হইল, আমার কথা মিলাইয়া নিয়েন কয়দিন পরই।”
রৌদ্রুপ নৈঋতার কথাটাকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে উলটো বলল,
“কাল একবার আমাকে তোমার স্কুলে নিয়ে যাবে?”
নৈঋতা প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আমার স্কুলে যাইবেন কী করতে? আমি তো আর অহন ওইহানে পড়ি না।”
“তোমার সার্টিফিকেট, মার্কশিট আর প্রশংসাপত্র আনতে যাব। কলেজে অ্যাডমিশনের সময় লাগবে তো।”
“লাগলে যহন লাগব তহনই আনা যাইব। অহন আপনের আনার কী দরকার? ওইগুলান আমিই আনতে পারমু।”
“এখন দরকার বলেই এখন আনব।”
“অহন কী দরকার?” ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করল নৈঋতা।
“কারণ তুমিও আমার সাথে শহরে যাচ্ছ।”
রৌদ্রুপের স্বাভাবিক কথাটা শুনে নৈঋতা হতচকিত হয়ে দ্বিধাভরা কন্ঠে বলল,
“কী যে কন! এইডা হয় না কি? আমি শহরে যামু কী করতে?”
“কারণ আমি তোমাকে সাথে নিয়ে যাব। জেনেশুনে গ্রামের কু’কুরদের মুখের সামনে তোমাকে ফেলে রেখে আমি যেতে পারব না। আমি অনেক ভেবেছি, এটা আমার পক্ষে সম্ভব না। কোনো একটা দু’র্ঘ’টনা ঘটে গেলে আমি কী করব নৈঋ? প্রতিনিয়ত অনুশোচনায় দ’গ্ধ হতে হবে আমায়। বলেছি না মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্ত আমি এই হাত ছাড়ব না?”
“পাগল হইছেন না কি? আমারে নিয়া কই রাখবেন আপনে?”
“কেন? আমি যেখানে থাকি সেখানেই। আমার বাড়িতে।”
নৈঋতা চোখ দুটো ছানাবড়া করে বলল,
“আপনের পরিবার কী কইব? বাইরের কোনো মাইয়ারে এত সহজে কেউ ঘরে তুলতে চায়? আর আপনে কী কইয়া আমারে আপনের বাইত রাখবেন?”
“ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। সবকিছু আমি ভেবে রেখেছি। আর আম্মার সাথে আমার কথা বলাও হয়ে গেছে এ ব্যাপারে।”
নৈঋতা চকিতে চেয়ে প্রশ্ন করল,
“কী কইছেন তারে?”
“বলেছি তোমার বোনের একমাত্র সুন্দরী মেয়ে গ্রামে খুব বি’পদের মুখে আছে। যেকোনো সময় খারাপ কোনো দু’র্ঘ’টনা ঘটে যেতে পারে। তুমি অনুমতি দিলে ওকে আমার সাথে ঢাকায় নিয়ে যাব। ও আমাদের বাসায় থেকেই পড়াশোনা করবে। এতে মেয়েটার পড়াশোনাও হবে আর নিরাপদও থাকবে।”
“পরে উনি কী কইছে?” উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করল নৈঋতা।
রৌদ্রুপ মুচকি হেসে বলল,
“বলেছে নিয়ে যেতে। আমার দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই। কাল তোমার বাবা-মাকে রাজি করাব, তাহলেই হবে।”
“এইডা কি ঠিক হইব? বাইরের একটা যুবতী মাইয়া বাইত রাখলে মাইনষেও খারাপ কইব পরে।”
“তুমি মোটেও বাইরের কেউ নও নৈঋ। আমার বর্তমান,‌ ভবিষ্যত তুমি। তাছাড়া তোমার সাথে আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্কও আছে।”
“তা তো আর অন্য মাইনষে জানে না।”
“বললাম তো তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমার ওপর ছেড়ে দাও। তুমি শুধু ঢাকায় যাওয়ার প্রস্তুতি নাও।”
“আব্বায় রাজি হইব না।”
“আমি যেভাবে পারি রাজি করাব।”
“আমার কিন্তু ভয় লাগতাছে,” কাঁচুমাচু মুখে বলল নৈঋতা।
রৌদ্রুপ নৈঋতার ডান হাতটা নিজের দুহাতের মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল। মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“নৈঋ, আমার চোখে চোখ রেখে সত্যি করে বলো তো, তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না?”
নৈঋতা রৌদ্রুপের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কী যে কন! বিশ্বাস না করলে কি এমনেই আপনের মায়ায় জড়াইছি?”
“ব্যস, এটুকুই যথেষ্ট। বিশ্বাস যেহেতু আছে সেহেতু আর কোনোকিছু ভাববে না। একটা সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস। তা যখন আছে, তখন নিশ্চিন্তে থাকো। এই হাতটা আমি এত সহজে ছাড়ছি না।”
নৈঋতা স্মিত হেসে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল। বেখেয়ালেই রৌদ্রুপের হাতের মুঠোয় থাকা হাতটা দিয়ে বন্ধনটা আরেকটু শক্ত করল।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে