কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে পর্ব-১০

0
1989

কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১০.
রৌদ্রুপ বাইরে যাওয়ার পর নৈঋতা ঘর গোছানো শেষ করে তুলির সাথে খেলতে বসে পড়েছে। তুলি যেমনি মিষ্টি মেয়ে, তেমনি মিশুক। চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সে নৈঋতার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলেছে। সন্ধ্যার আজান হতেই তুলির মায়ের ডাক পড়ল। মাকে সে যথেষ্ট ভয় পায়। তাই ডাক শোনার সঙ্গে-সঙ্গেই নৈঋতার রুম থেকে চলে গেছে। নৈঋতা দরজা আটকে মাগরিবের নামাজ আদায় করে নিয়েছে। তার কিছুক্ষণ পরেই দরজায় টোকা পড়ল। নৈঋতা দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দেখল শাহানা খানম দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে দেখে সে দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকাল। শাহানা খানম ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলেন,
“বিশ্রাম নেওয়া হয়েছে তোমার?”
নৈঋতা নিচু স্বরে উত্তর দিলো,
“জি।”
“তাহলে এসো আমার সাথে।”
কথাটা বলেই শাহানা খানম ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা দিলেন। নৈঋতা শাহানা খানমকে অনুসরণ করে গেল রান্নাঘরে। রান্নাঘরটায় সে ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে নিল। এ বাড়ির সবকিছুই তার বেশ লাগে। কী সুন্দর পরিপাটি পরিবেশ!
“রান্না জানো?”
শাহানা খানমের প্রশ্নে নৈঋতা তার দিকে ফিরে তাকাল। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মাথাটা মৃদু দুলিয়ে বলল,
“জি।”
“সব কাজ জানো?”
অগত্যা নৈঋতা একইভাবে মাথা দোলাল। শাহানা খানম এবার বললেন,
“কিছু মনে কোরো না। আমাদের বাড়িতে একজন কাজ করার মানুষের খুব দরকার। তুমি যখন নতুন এসেছ, কাজে একটু সাহায্য কোরো। তোমার কি আপত্তি আছে?”
“না, ঠিক আছে।”
“তাহলে শোনো। আমি অগোছালো কাজ পছন্দ করি না। যা-ই করবে, খুব যত্ন সহকারে করবে। আমাদের তিন বেলার খাবার সময় মতো রান্না করতে হয়। সকাল-সকাল উঠে রুটি করতে হয়। আমার ছেলেরা তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে কাজে যায়। দুপুর একটার মধ্যে রান্না শেষ করতে হয়। আর রাত সাড়ে নয়টার মধ্যে রুটি, ভাত দুটোই করতে হয়। ওদের বাবার ডায়াবিটিস আছে। উনি রাতে রুটি খান। এতদিন বউমা রান্না করেছে আর আমি যতটুকু পেরেছি সাহায্য করেছি। আমার শরীর অত ভালো থাকে না তো, তাই কাজকর্ম তেমন করতে পারি না। তুমি কি রান্না করতে পারবে? তাহলে বউমা তোমাকে সাহায্য করবে।”
নৈঋতা প্রথমে অবাক হয়ে কথাগুলো শুনল। চরম বিস্ময়কে গোপন রেখে সে ওপর-নিচে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল। শাহানা খানম প্রশ্ন করলেন,
“তুমি কি খারাপভাবে নিয়েছ আমার কথা? ”
নৈঋতা তার এক কথার সাথে আরেক কথার সুরের তাল খুঁজে পেল না, বিধায় মাথা নেড়ে বলল,
“জি না।”
“তাহলে হাত লাগাও। দেখো, এখানে সবকিছু রাখা আছে। ভাত বসিয়ে তুমি এই সবজিগুলো কা’টো। আমি নিদ্রাকে পাঠাচ্ছি। মসলা পাতি কেমন দিবে তা দেখিয়ে দিবে তোমাকে, সেভাবেই রান্না কোরো।”
“আচ্ছা।”
“আর আমার মেয়ে আর নাতনি কিন্তু বেশি ঝাল খেতে পারে না। ওদের জন্য হালকা ঝাল দিয়ে আলাদা তরকারি রান্না করতে হবে।”
নৈঋতা এবারেও মাথা দুলিয়ে বলল,
“ঠিক আছে।”
শাহানা খানম চলে গেলেন নিদ্রাকে ডেকে পাঠাতে। নৈঋতা অবাক হয়ে ভাবল, এত কাজ একা তার ওপর দিলো কেন? পরক্ষণেই সহজ মনে ভেবে নিল, অন্যের বাড়িতে তো হাত-পা গুটিয়ে বসে শুধু খাওয়া চলে না। তাই এটুকু কাজ করতে হবে। নিদ্রা এসে সব দেখিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার পর নৈঋতা নিদ্রার সাহায্যে গ্যাসের চুলা জ্বা’লিয়ে ভাত বসাল। তারপর সবজি কা’টা, ধোয়ামোছা, রুটি বানানো, যত্ন সহকারে রান্না, সবটাই নৈঋতাকে একা করতে হলো। নিদ্রা পাশে দাঁড়িয়ে শুধু সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছে। নৈঋতা দ্বিধায় কিছু বলতেও পারেনি। নতুন পরিবেশে নতুন পদ্ধতিতে রান্না করতে তাকে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে। যদিও অনেক সময় লেগেছে; তবু তার কাছে খুব একটা মন্দ লাগেনি। বরঞ্চ নতুন কিছু শিখতে পেরে ভালোই লেগেছে। রান্না শেষে নিদ্রা নৈঋতাকে বলল রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসতে। তার কথামতো নৈঋতা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হলো। শাহানা খানমের ডাকে ফিরে এসে দেখল বাড়ির সবাই খেতে বসেছে। খাওয়া-দাওয়া বোধ হয় মাঝ পর্যায়ে। আসার পর রৌদ্রুপের বাবা ও বড়ো ভাইকে এই প্রথমবার নজরে পড়ল। নৈঋতা ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। তাকে খেয়াল করে সরফরাজ চৌধুরী প্রশ্ন করলেন,
“এটা আফিয়ার মেয়ে?”
শাহানা খানম ছোটো করে জবাব দিলেন,
“হুঁ।”
রৌদ্রুপের বড়ো ভাই তিহান বলল,
“ওকে আরও আগে ডাকবে না?”
নিদ্রা খাবার মুখে তুলে বলল,
“সমস্যা নেই, আমি দিয়ে দিচ্ছি ওর খাবার। রুমে গিয়ে খেয়ে নিবে।”
নিদ্রা নিজের খাওয়া থামিয়ে একটা প্লেটে ভাত বাড়ল। ভাতের সঙ্গে একটু ডাল আর ঝোল, তরকারি দিলো; তা-ও মাংস ছাড়া। তারপর প্লেটটা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে নিয়ে নৈঋতার দিকে এগিয়ে গেল। প্লেটটা তার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল,
“রুমে গিয়ে খেয়ে নিয়ো, ঠিক আছে?”
নৈঋতা মাথা দুলিয়ে, হাত বাড়িয়ে প্লেটটা নিয়ে চুপচাপ প্রস্থান করল। নিদ্রা গিয়ে নিজের চেয়ারে বসতেই দেখল তিহান তার দিকে সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছে। নিদ্রা জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে?”
“আজকের রান্না কে করেছে?” প্রশ্ন করল তিহান।
“কেন?”
“স্বাদ অন্যরকম মনে হচ্ছে।”
“ওই মেয়েটা করেছে।”
“মেয়েটা আজ নতুন এসেছে। আর তোমারা ওকে দিয়ে রান্না করিয়েছ?”
“কেন? সমস্যা কোথায়? গ্রামের মেয়ে, কাজকর্মের অভিজ্ঞতা আছে।”
“এইটুকু একটা মেয়ে ঠিক কতক্ষণে এত খাবার রান্না করেছে?”
নিদ্রা ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে বলল,
“এত প্রশ্ন করছ কেন তুমি?”
তিহান এবার গম্ভীর মুখে বলল,
“একটা বাচ্চা মেয়ে একা এত খাবার রান্না করেছে। আর তুমি ওর প্লেটে কী দিয়েছ? ভাতের সঙ্গে একটু ডাল আর তরকারি, তা-ও মাছ ছাড়া!”
নিদ্রা এবার বাজেভাবে কপাল কুঁচকে বলল,
“তো? তোমার এত দরদ উথলে উঠছে কেন?”
“দরদের কিছু নেই নিদ্রা। মেয়েটা আমাদের শাম্মীর চেয়েও ছোটো। তাছাড়া রৌদ্র এতদিন ওদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। আমাদের উচিত ওর একটু কেয়ার করা।”
শাহানা খানম বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলেন,
“কী নিয়ে পড়লি বল তো তিহান? থাম, চুপচাপ খেয়ে ঘুমাতে যা। এসব দেখার জন্য আমি আছি না?”
তিহান কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। সামনে তার বাবা উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তিনি গম্ভীর মুখে চুপচাপ বসে আছেন। তার বোধ হয় এখন কথা কা’টাকা’টি করার ইচ্ছে নেই। বাবা-মায়ের মুখের ওপর কথা বলার অভ্যাস তিহানদের কোনো ভাই-বোনেরই নেই। গলা পর্যন্ত আসা প্রতিবাদটুকু নীরবে গিলে নিয়ে সে চুপচাপ খাওয়ায় মনোনিবেশ করল।
নৈঋতা খাবার নিয়ে রুমে এলেও সে খাবারে হাত দেয়নি। তার মাথায় ঘুরছে রৌদ্রুপের চিন্তা। রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে, অথচ লোকটা এখনও বাড়ি ফেরেনি। সবাই তাকে রেখে রাতের খাবারও খেয়ে ফেলেছে। তাই সে ভাবল রৌদ্রুপ এলে তার সাথেই খাবে। নইলে মানুষটার একা-একা খেতে বুঝি ভালো লাগবে?
রৌদ্রুপ বাড়ি ফিরল রাত বারোটার দিকে। সচরাচর তার বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয় বলে সে নিজের কাছে বাড়তি চাবি রাখে, যাতে রাতবিরেতে কারো ঘুম না ভাঙাতে হয়। নিজের রুমের সামনে এসে পা থেমে গেল রৌদ্রুপের। নৈঋতার রুমের দরজা খোলা, লাইটও জ্বলছে। নিজের রুমে না ঢুকে রৌদ্রুপ নৈঋতার রুমের দিকে গেল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় টোকা দিয়ে বারকয়েক ডাকল। ভেতর থেকে কোনো সাড়া পেল না। নিরাশ হয়ে রৌদ্রুপ দু’পা এগিয়ে ভেতরে উঁকি দিলো। বিছানায় শয়িত ঘুমন্ত নৈঋতার মুখে তার দৃষ্টি স্থির হলো। বিছানার একপাশে গুটিসুটি মে’রে শুয়ে থাকা মেয়েটা যেন এই মাঝরাতে সৌরভ ছড়ানো এক রজনীগন্ধা। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মিনিট তিনেক প্রেমিকার মায়াবী মুখপানে চেয়ে থাকার পর হঠাৎ টেবিলের দিকে দৃষ্টি গেল। সেখানে খাবার ঢেকে রাখা আছে। রৌদ্রুপ ভ্রু কুঁচকাল। নৈঋতা খেয়েছে কি না দেখার জন্য রুমের ভেতরে প্রবেশ করল। টেবিলের কাছে গিয়ে ঢাকনা তুলে বুঝল, মেয়েটা না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। রৌদ্রুপ দ্রুত গিয়ে বিছানার পাশে দাঁড়াল। নিজের ডান হাতটা নৈঋতার মাথায় রেখে নাম ধরে ডাকল। কয়েকবার ডাকতেই নৈঋতার ঘুম ছুটে গেল। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে চোখ কচলাতে-কচলাতে ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,
“আইছেন? কয়টা বাজে?”
রৌদ্রুপ উত্তর দিলো,
“বারোটা।”
নৈঋতা যেন চমকে উঠল। চোখ দুটো বড়ো করে বলল,
“বারোটা! বাড়ি ফিরতে এত দেরি ক্যান আপনের?”
রৌদ্রুপ সশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধপ করে নৈঋতার পাশে বসে পড়ল। হতাশ গলায় বলল,
“আমার চাকরি চলে গেছে নৈঋ।”
নৈঋতা এবার আরও চমকাল। অবাক কন্ঠে শুধাল,
“ক্যান?”
“অফিস কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে এতদিন কামাই করার কারণে।”
নৈঋতা অসহায় মুখে বলল,
“অহন কী হইব?”
“কী আর হবে? নতুন চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত বসে-বসে বাপ-ভাইয়ের হোটেলে খেতে হবে। আমি কারো ওপর নির্ভরশীল থাকতে চাইনি বলেই চাকরিটা নিয়েছিলাম। অথচ টিকিয়ে রাখতে পারলাম না।”
রৌদ্রুপের চুপসানো কালো মুখটা নৈঋতার সহ্য করতে কষ্ট হলো। মানুষটাকে এই প্রথম সে এমন মলিন মুখে দেখছে। নৈঋতা যথাসম্ভব নরম কন্ঠে বলল,
“চিন্তা কইরেন না। আল্লাহ্ যা করেন ভালোর লাইগাই করেন। হইতে পারে উনি আপনের কপালে আরও ভালো কিছু লেইখা রাখছে।”
রৌদ্রুপ মাথাটা মৃদু দোলাল। প্রসঙ্গ পালটে পরক্ষণেই প্রশ্ন করল,
“খাওনি কেন এখনও?”
“আপনে তো ফিরতে দেরি করতাছিলেন। সবাইর খাওয়া-দাওয়া হইয়া গেছে দেখলাম। আপনে একলা খাইবেন ভাইবা অপেক্ষা করতাছিলাম। কোন সময় ঘুমাইয়া পড়ছি জানি না।”
“আমি সবসময়ই এমন রাত করে বাড়ি ফিরি। কেউ তখন জেগে থাকে না। থাকলেও যার-যার রুমে থাকে। তাই আমি কাউকে ডিস্টার্ব করি না। একাই খেয়ে নিই। তাই বলে তুমি এতরাত পর্যন্ত না খেয়ে থাকবে? ক্ষুধা পায়নি তোমার?”
নৈঋতা ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল। চাকরি হারানোর ফলে রৌদ্রুপের মনটা তেমন ঠিক নেই। তাই আজ রাতে খাবে না ভেবেছিল। কিন্তু নৈঋতা তার জন্য না খেয়ে অপেক্ষা করছিল শুনে তার খারাপ লাগল। মেয়েটা এতক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করল। এখন যদি শোনে সে খাবে না, তাহলে হয়তো নিজেও না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি নিচে যাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
নৈঋতা মাথা কাত করে সম্মতি জানাল। রৌদ্রুপ ধীর পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই নৈঋতা বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ল। তার খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে দ্রুত পায়ে নিচে নামল। রান্নাঘরে গিয়ে ঝটপট খাবারগুলো গরম করল। টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখার পরপরই রৌদ্রুপ এল। চেয়ার টেনে বসে সে নৈঋতাকেও নিজের পাশের চেয়ারে বসতে বলল। নৈঋতা রৌদ্রুপকে খাবার পরিবেশন করে তার পাশের চেয়ারে বসে পড়ল। নিদ্রা তাকে যে খাবার বেড়ে দিয়েছিল, সেই প্লেটটা নিজের দিকে টেনে নিল। প্রথম লোকমা মুখে তুলতে যাওয়ার মুহূর্তেই রৌদ্রুপের দৃষ্টি পড়ল নৈঋতার প্লেটে। রৌদ্রুপ মুখের সামনে থেকে খাবার নামিয়ে ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করল,
“তোমাকে খাবার দিয়েছিল কে, নৈঋ?”
“ভাবি।”
“আম্মা কোথায় ছিল তখন?”
“ওইসময় সবাই খাইতে বইছিল।”
“সবার সঙ্গে খেতে ডাকেনি তোমায়?”
নৈঋতা সহজভাবেই বলল,
“ভাবি কইছিল রুমে গিয়া খাইতে।”
“ওহ্,” কপাল কুঁচকে ছোটো করে উচ্চারণ করল রৌদ্রুপ।
তারপর নিজের হাতে দুই টুকরা মাংস তুলে দিলো নৈঋতার প্লেটে। নৈঋতা নিষেধ করলেও শুনল না। শেষে নৈঋতা বাধ্য মেয়ের মতো খেতে শুরু করল। খাওয়ার সময় টুকটাক কথার মাঝে নৈঋতা প্রশ্ন করল,
“চাকরির লাইগা কি আপনের মন বেশি খারাপ?”
রৌদ্রুপ পূর্বের মতোই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“চাকরিটা এতদিন আমাকে সাবলম্বী রেখেছে। নতুন চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত হাত খরচের টাকাটাও বাবার থেকে নিতে হবে। আমি চাকরি শুরু করেছিলাম বলেই বাবা তার ব্যবসায়ের দায়িত্ব ভাইয়ার হাতে তুলে দিয়েছিল। আমার চাকরি চলে গেছে শুনলে ভাইয়া হয়তো বলবে তার সাথে ব্যবসা দেখাশোনা করতে। কিন্তু ভাবি এটা সহজভাবে নিতে পারবে না। তাই আমিও এমনটা চাই না। তাছাড়া বললেই তো আর নতুন চাকরি এসে যাবে না।”
নৈঋতা চুপসানো মুখে বলল,
“আপনে মন খারাপ কইরা থাকলে আমার ভাল্লাগে না। আপনেরে হাসিমুখেই ভালা লাগে।”
রৌদ্রুপ ঠোঁট টেনে হেসে ফেলল। বাঁ হাতটা বাড়িয়ে নৈঋতার মাথায় বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা, আর মন খারাপ করব না। মেঘবতী যখন বলেছে, তখন চব্বিশ ঘন্টা শুধু হাসতে হবে।”
নৈঋতাও হাসল। পরক্ষণেই প্রশ্ন করল,
“আব্বায় ফোন করছিল?”
“হ্যাঁ, তখন আমি বাইরে ছিলাম। আর এখন তো ওনারা ঘুমিয়ে পড়েছেন। কাল সকালে ফোন করে দিবো, তখন কথা বোলো।”
“আইচ্ছা,” বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় কাত করে বলল নৈঋতা।
রৌদ্রুপের আগেই নৈঋতার খাওয়া শেষ হলো। তবু সে চেয়ার ছেড়ে উঠল না। সবকিছু গুছিয়ে রেখে যাবে ভেবে রৌদ্রুপের খাওয়া শেষ হবার অপেক্ষায় বসে রইল। রৌদ্রুপ ঘুমাতে যেতে বললেও সে শুনল না। কিছুক্ষণ ধরে অদূরে দাঁড়িয়ে তাদের দুজনের কার্যকলাপ লক্ষ্য করছিলেন শাহানা খানম, যা তার চোখে মোটেও ভালো লাগেনি। অসন্তুষ্টই হলেন তিনি। এবার তিনি এগিয়ে এলেন। তাকে দেখে রৌদ্রুপ কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
“আম্মা, তুমি এখনও জেগে আছো? না কি ঘুম ভেঙে গেছে?”
শাহানা খানম গম্ভীর মুখে একটা চেয়ার টেনে বসে বললেন,
“জেগেই ছিলাম।”
“কেন?”
“তোর সাথে কথা আছে।”
“বলো, কী কথা?
“পরে বলছি।”
রৌদ্রুপ মাথাটা মৃদু দোলাল।‌ শাহানা খানম নৈঋতার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“অনেক রাত হয়েছে। ঘুমাতে যাও। এসব আমি গুছিয়ে রাখব।”
নৈঋতা বুঝল মা-ছেলে কোনো ব্যক্তিগত কথা বলবে। তাই দ্বিরুক্তি না করে ‘আচ্ছা’ বলে উঠে চলে গেল। শাহানা খানম কিছু সময় চুপ থাকার পর মৃদু কন্ঠে ডাকলেন,
“রৌদ্র?”
রৌদ্রুপ মুখ তুলে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“জি আম্মা?”
“একটা অল্প পরিচিত মেয়েকে নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?”
রৌদ্রুপ শেষ লোকমাটা মুখে তুলতে গিয়েও থেমে গেল। অবাক কন্ঠে জানতে চাইল,
“কে, আম্মা?”
“আফিয়ার মেয়ের কথা বলছি। এসেছে যখন, পড়াশোনা করবে, কাজ-টাজ করবে। এত আহ্লাদ কিসের?”
রৌদ্রুপ বিস্ময় নিয়েই বলল,
“এসব কী বলছ? নৈঋ কাজ করবে কেন? আমি তো তোমাকে বলেছিলাম, মেয়েটা খুব বি’পদের মধ্যে আছে। তাই সাথে নিয়ে এসেছি।”
শাহানা খানম খানিক থমকালেন। ভ্রু দ্বয়ের মাঝে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে বললেন,
“হ্যাঁ বলেছিলি। তো মেয়েটাকে কাজের কথা কিছু বলিসনি?”
“না। তুমি এটা ভাবলে কেন?”
“কাজের মানুষ পাচ্ছি না, তা তো তুই জানিস। আমি তো ভেবেছিলাম, এইজন্যই তুই এই মেয়েকে নিয়ে আসছিস। বি’পদ থেকে বাঁচবে, পড়াশোনা করতে চাইলে করবে, সাথে কাজেও সাহায্য করবে।”
“না, না আম্মা। মেয়েটার পড়াশোনা করার খুব ইচ্ছা। কিন্তু সামর্থ্য নেই। তার মধ্যে আবার বি’পদে পড়েছে। তাই আমি ভাবলাম যদি একটু উপকারে আসা যায়। সামনে ওকে কলেজে ভর্তি করে দিবো। আর ওর ভাইয়ের জন্য একটা চাকরি খুঁজে দিবো। তারপর ওরা ভাই-বোন আলাদা কোনো বাসা ভাড়া করে থাকবে। ততদিন পর্যন্ত নৈঋ আমাদের বাড়িতেই থাকুক। বেশিদিন তো আর থাকবে না। কাজের কথা বললে খারাপ দেখায়। তাছাড়া ওরা আমার এত বড়ো উপকার করেছে। তার কাছে এটুকু কিছুই না। তুমি কী বলো, আম্মা?”
শাহানা খানম হতবাক হয়ে ছেলের কথা শুনলেন। তারপর শান্ত গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন,
“আসার আগে এসব আমাকে বললি না কেন?”
“এমনিতেই বলিনি। ভাবলাম, তুমি তো আর না বলবে না। এসেও বুঝিয়ে বলা যাবে। তাছাড়া আমি জানি তুমি নিষেধ করবে না। উপকারীর উপকার করাই যায়। নৈঋ তো তোমার বোনেরই মেয়ে।”
মায়ের প্রতি ছেলের এমন বিশ্বাসের বিপরীতে শাহানা খানম একটু দ্বিধা থেকে সহসা কিছু বলতে পারলেন না। কিছু সময় আপন মনে ভাবার পর ফের প্রশ্ন করলেন,
“খরচ কে দিবে ওর?”
এ পর্যায়ে এসে রৌদ্রুপ হোঁচট খেলো। মিইয়ে যাওয়া চিন্তিত কন্ঠে বলল,
“ওর ভাই আসার পর ওরা নিজেরাই পারবে। তার আগ পর্যন্ত আমাদেরই দিতে হবে। কলেজে ভর্তির আগে তো আর তেমন খরচ নেই। ভেবেছিলাম ভর্তির খরচ আমিই দিবো। কিন্তু, অফিস কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে এতদিন কামাই করায় আমার চাকরিটা চলে গেছে।”
শাহানা খানম চমকে উঠলেন। চোখে-মুখে-কন্ঠে দারুণ আফসোস নিয়ে বললেন,
“সেকি! চাকরিটাই চলে গেল! এখন কী হবে?”
“কী আর হবে? ভালো চাকরি পাওয়ার পর এমনিতেও তো এই চাকরিটা ছেড়ে দিতাম। একটু আগেই না হয় ছাড়তে হলো।”
শাহানা খানমের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“দেখ, আবার কবে চাকরি পাস।”
রৌদ্রুপ খাওয়া শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“চিন্তা কোরো না। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি ব্যবস্থা করে নিব। তুমি ঘুমাতে যাও।”
“আসল কথাটাই তো বলা হয়নি।”
“কী কথা?”
শাহানা খানম কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে নিচু স্বরে বললেন,
“শাম্মী বেড়াতে আসেনি। ওকে ওর শ্বশুড়বাড়ি থেকে পাঠিয়ে দিয়েছে।”
রৌদ্রুপ ভীষণভাবে চমকে উঠল। বি’স্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলল,
“মানে কী? বিয়ের মোটে দুই মাস হলো। এরমধ্যে কী এমন হয়ে গেল?”
শাহানা খানম হঠাৎই হুঁ-হুঁ করে কেঁদে উঠলেন। আহাজারি করে বললেন,
“বিয়ের আগে তো ও বিভিন্ন ক্রীম ব্যবহার করে সুন্দর হয়েছিল। শ্বশুরবাড়ির সবাই ওকে সুন্দরী ভেবে গায়ের সাদা চামড়া দেখে পছন্দ করেছিল। বিয়ের পর তারা টের পেয়ে গেছে ও আসলে সুন্দরী না। সত্য জানার পর জামাই ওর সাথে অনেক ঝামেলা করেছিল। এখন ওই বাড়ির কেউই ওকে রাখতে রাজি না। আমাদের ফোন করে বলেছিল আমরা যেন গিয়ে ওকে নিয়ে আসি। তোর বাবা, ভাই আর আমি গিয়ে অনেক অনুরোধ করেছিলাম, তা-ও তারা ওকে রাখতে নারাজ। উলটে আমাদের নানা কথা শুনিয়ে দিয়েছে। শেষমেষ বাধ্য হয়ে ওকে বাড়ি নিয়ে এসেছি। কী করব? উত্তর দেওয়ার তো মুখই ছিল না।”
রৌদ্রুপ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বেশ কিছুক্ষণ পর হতাশ গলায় বলল,
“বারবার নিষেধ করেছিলাম আম্মা। ওসব উলটা-পালটা জিনিস ব্যবহার করতে না বললেও তোমার মেয়ে শুনত না। তুমিও তখন ওকে সাপোর্ট করেছিলে। এবার বুঝতে পারছ, মানুষকে ঠকানোর ফল কী হয়? এটাই হওয়ার ছিল। আমার তখনই মনে হয়েছিল এসব নিয়ে কিছু না কিছু ঝামেলা হবেই।”
শাহানা খানম ওড়নায় চোখের পানি মুছে বললেন,
“কপালে যা ছিল তাই হয়েছে। এতে কারো হাত নেই। এখন আর কী করবে? আগের মতোই পড়াশোনা করতে থাকুক। মিটে গেলে তো ভালোই।”
রৌদ্রুপ তাচ্ছিল্য মাখা হাসিটুকু আড়াল করে নিল। আদরের বোনের জন্য মনের কোথাও একটা সূক্ষ্ম ব্যথাও অনুভব করল। বোনের মনের অবস্থার কথা ভেবে বেশ খারাপ লাগল।
‘ঘুমাতে গেলাম আম্মা’ বলে রৌদ্রুপ চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই শাহানা খানম পিছু ডাকলেন,
“শোন।”
রৌদ্রুপ ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকাল। শাহানা খানম সোজাসাপ্টা বললেন,
“আফিয়ার মেয়েকে নিয়েই যখন এসেছিহ, তখন আর কী করার আছে? আমাদের টাকা-পয়সার পাহাড় নেই যে, এত বড়ো মেয়েকে বসিয়ে-বসিয়ে খাওয়াব। যে কদিন এ বাড়িতে থাকবে, সে কদিন না হয় একটু-আধটু কাজে সাহায্য করবে। এমনিতেও একটা কাজের মেয়ে দরকার ছিল। পাচ্ছি না যেহেতু, একটু সাহায্য করলে উপকার হবে। আমার শরীরের অবস্থা ভালো না , নিদ্রাও তুলিকে সামলে সবসময় কাজে হাত লাগাতে পারে না।”
মায়ের কথাটা শুনে রৌদ্রুপের খারাপ লাগল। তবু প্রত্যুত্তরে কিছু বলার সাহস পেল না। কারণ সে জানে, মা বলেছে মানে সে কথা আর পালটাবে না। বরং এসব নিয়ে বেশি কথা বাড়ালে উলটো নৈঋতাকে নিয়ে ঝামেলা বাঁধতে পারে। মেয়েটাকে নতুন এসেই খারাপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হবে। তাছাড়া মায়ের কথার ওপর উলটো কথা বলায় সে তেমন অভ্যস্ত নয়। তাই নিজের মন খারাপটা উহ্য রেখে, মাথাটা মৃদু ঝাঁকিয়ে সে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করল।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে