কি ছিলে আমার পর্ব-৪০

0
1856

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৪০(১ম অংশ)

কথা ছিল ইরশাদ, মেহের, ইরিন আর ফখরুল থাকবে এয়ারপোর্টে কিন্তু শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদল হলো। আসলে বদলটা মেহের নিজে করেছে। আজ ময়ূখ এসে পৌঁছুবে তাই রাতের বাসে রওনা হয়েছিল ইরশাদ, মৈত্রী, ইরিন, ফখরুল৷ ময়ূখের ফ্লাইট পিছিয়েছে ; দুপুর দুটোর জায়গায় সে এসে পৌঁছুবে রাত আটটায়। মেহের খুশিতে আত্মহারা ভাইকে রিসিভ করবে, ভাইয়ের সাথে সারাটা বিকেল রাত গল্প করবে বলে হবু বরকেও আজকের দিনের ফোনকলে বারংবার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। কিন্তু হুট করেই তার সকল পরিকল্পনা স্থগিত হলো ইরশাদ সাথে যাচ্ছে শুনে। কি দিন ছিল সেগুলো যে সময়টায় সে পাগলের মত আচরণ করেছিল ইরশাদ ভাইকে ভালোবাসি বলে বলে! সেসব কথা মনে পড়লেই কি ভীষণ লজ্জা তাকে জড়িয়ে ধরে। মাত্র তিনটি বছর গত হয়েছে আর তাতেই কিনা কিশোরী মনের প্রেম বদলে হবু বরে ট্রান্সফার হয়েছে। এ কথা সত্যি এখনো তার ইরশাদ ভাইকে ভালো লাগে হয়ত ভালোও বাসে প্রথম প্রেম কিনা! রবী ঠাকুর বলেছিলেন,
“পৃথিবীতে বালিকার প্রথম প্রেমের মতো সর্বগ্রাসী প্রেম আর কিছুই নাই, প্রথম জীবনে বালিকা যাকে ভালবাসে তাহার মতো সৌভাগ্যবানও আর কেহই নাই। যদিও সে প্রেম অধিকাংশ সময়ে অপ্রকাশিতই থেকে যায়, কিন্তু সে প্রেমের আগুন সব বালিকাকে সারা জীবন পোড়ায়।”

মেহেরের ক্ষেত্রেও তেমনই হয়ত ইরশাদ থেকে যাবে মনের গোপন কুঠুরিতে কিন্তু সেই প্রেম এতোটাও সর্বগ্রাসী নয়। হতে একতরফা ছিল বলে! নইলে এত সহজেই কি নতুন কারো প্রেমে পড়া যেত। কিন্তু এখন তো লজ্জাও হয় সেইসব পা-গ-লা-মী গুলো মনে করে। মৈত্রীকে আগে ভাবী বলে স্বীকার করা অসম্ভব ছিল এখন আর সেই অসম্ভব ভাবনাটাই আর নেই। গত বছর ইদের পরও এসেছিল মৈত্রী, ইরশাদ মামা শ্বশুরের দাওয়াতে তখনও মেহের তাকে এড়িয়ে গেছে সুক্ষ্মভাবে এবার আর তা করছে না। বরং গত সপ্তাহেই ফুপিকে ফোন করে আগে আসার কথা বলার সময় বলেছিল, “ভাবীকেও নিয়ে এসো ফুপি আমার অনেক কেনাকাটা বাকি আছে। আম্মু অসুস্থ , তুমিও সেগুলো বুঝবে কিনা তাই!” মুখে জড়তা, মনে সংকোচ সবটা নিয়েই সে বলেছিল। বিয়ের পর সেই প্রথম ছিল মৈত্রীর সাথে মেহেরের আত্মীয়সুলভ কিছুটা আপন অনুভূতি মিশ্রিত আলাপ। সময় ফুরিয়েছে অপেক্ষার; ময়ূখ এসে দাঁড়িয়েছে আম্মার সামনে। একপলক আশপাশটাও তাকালো ভাই এসেছে, বাবা – আম্মাও এসেছে। মেহের আসবে বলেছিল আসেনি আর আব্বু! আব্বুর সাথে তার সম্পর্কটা এখনো ঠিকঠাক হয়ে উঠেনি নোরাকে বিয়ের পর। আগেও যে খুব ভাল ছিল তেমন নয়। ছোট থেকেই বিশেষ দূরত্ব আব্বুর সাথে কিন্তু তাতে গভীর শীতলতা ছিল না। কিন্তু নোরাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে তি-ক্ত-তা।

“কেমন আছো আম্মা?” ময়ূখ আম্মাকে প্রশ্ন করে জড়িয়ে ধরল৷ আর কোন কথা হওয়ার নয় শুরু হলো নিরব অ-শ্রুবর্ষণ। এয়ারপোর্টে অসংখ্য যাত্রীর ভীড়ে চক্ষু ছলছলকারী এ এক দৃশ্য আশেপাশে অনেকেরই দৃষ্টি কাড়ল। ইরিন কাঁদছে ময়ূখের বুকে পড়ে। ফখরুল সাহেবেরও চোখ জোড়া ভিজে উঠেছে তবুও শা-ষ-ণের গলায় বলে উঠলেন, এখানে তোমরা দৃশ্য বদল করো দ্রুত আশেপাশে আরো অনেকেই নিজেদের আপনজনদের ছেড়ে যেতে এসেছে তাদেরও সুযোগ দাও।”
ইরশাদ, ময়ূখ দুজনেই হেসে ফেলল ফখরুল সাহেবের কথা শুনে। ময়ূখ আম্মাকে ছেড়ে এবার বাবাকে জাপটে ধরলো, “এত সহজেই! আগে আমার বাবাকে ভিজিয়ে নেই।” হাসতে হাসতে বলা কথাটাতেও কেঁ-দে ফেলল ময়ূখ। অন্তরের সকল সুখ যেন এই মুহুর্তে এই দুজন মানুষকে জড়িয়ে ধরেই খুঁজে পেল সে। কত গুলো দিন! উহুম বছর, সে এই সুখ থেকে বঞ্চিত। যেন আত্মাটা হাতে নিয়ে গিয়েছিল পরদেশে আর আজ দেশে এসে আম্মা আর বাবাকে বুকে জড়িয়েই সেটা সঠিক জায়গায় পুনরায় প্রতিস্তাপিত হলো। আহা! এই সুখ থেকে বঞ্চিত ছিল সে নিজ ভুলে! ফখরুল সাহেব কা-ন্না চেপে রইলেন। এ কথা যেন ধ্রুব সত্য তিনি ময়ূখকে নিজের অংশ ভেবে আজীবন আগলে রেখেছেন। ময়ূখ বাবাকে ছেড়ে এবার ইরশাদের দিকে ফিরতেই ইরশাদ হাত ছড়িয়ে বলল, “আয় তো এবার অনেক হয়েছে কা-ন্না-কাটির নাটক।”

আবেগ লুকিয়ে পরম স্নেহে ইরশাদও জাপটে ধরল ময়ূখকে। গাড়িতে উঠে বসতেই ময়ূখ জানতে চাইলো বাড়ির সবাই কেমন আছে? ইরশাদই একে একে সবার কথা জানালো ভালো আছে তবে মামী মানে মেহেরের মায়ের অবস্থার কোন পরিবর্তন নেই। তিনি এখন হাঁটাচলা করতে জানলেও দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যা-টা-ক করায় স্বাভাবিক নেই। অনেকটা এ কারণেই মেহেরকে এত দ্রুত পাত্রস্থ করা হচ্ছে। বাড়ি ফিরে ময়ূখ প্রথমেই মুখোমুখি হলো জরিনা আর মৈত্রীর। দুজনেই রাতের খাবার গুছিয়ে রাখছে ডাইনিংয়ে। ইরশাদই ফোন করে বলেছে তারা প্রায় পৌঁছে গেছে।

“কেমন আছেন ময়ূখ ভাইয়া?” হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো মৈত্রী।

ময়ূখও হাসিসমেত জবাব দিলো, “ভাল, তুমি.. তুমি কেমন আছো?”

তুমি সম্মোধন করতেও গিয়েও কেমন বাঁধছিল ময়ূখের। অতীত ভেবে আবার বর্তমানকে মেলাতে গিয়েই যেন হোঁচট খেল একটু। তবুও শেষ অবধি সামলে নিয়েছে নিজেকে।

“জ্বী, আলহামদুলিল্লাহ।”

“কেমন আছো জগলুওওও।” কিছুটা টেনে লম্বা করে জিজ্ঞেস করলো জরিনাকে৷ বেচারি বিব্রতবোধ করলেও জবাব দিলো ভালো আছে৷ মেহের ছিল নিজের ঘরেই বসার ঘরে অনেকের কথা বলার আওয়াজ শুনে বুঝে নিলো ভাই চলে এসেছে। কানে ফোন হবু বরের সাথে কথা হচ্ছিলো। ভাই এসেছে বুঝতেই সে কিছু না বলেই কল কেটে দ্রুত পায়ে নেমে এলো নিচ তলায়। কোন দিকে তার দৃষ্টি নেই সে এসে জড়িয়ে ধরল ভাইকে। আম্মার মত বোনটিও কেঁদে ভাসালো তার বুকটা। ময়ূখ বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আবেগে৷ একেই বুঝি বলে র-ক্তের টান! মা এক না হলেও বাবা তো এক! ছোট থেকে একসাথে বড় হয়নি তারা৷ কেউ কারো বি-প-দে-আ-প-দে, প্রয়োজনে কেউ কারো পাশেও থাকতে পারেনি কখনো তবুও অন্তরের একটা অংশ তাদের একে অপরের জন্য মায়ায় পূর্ণ। বাড়ির সকলের সাথেই দেখা হলো, কথা হলো বাদ রইলো আব্বু। রাতের খাবারেও দেখা হলো না বাবা ছেলের। আবরার খন্দকার ব্যবসায়ের কাজে সেদিনই চলে গেলেন চট্টগ্রামে। সবাই বুঝলো অভিমান কিংবা ক্ষো-ভের জন্যই এভাবে আড়াল হলেন। রাতে খাওয়ার পর ময়ূখ আর মেহের বসল গল্প করতে। এরই মাঝে কথা হলো বন্ধু জারিফের সাথে। এখন অবশ্য সম্পর্কের নাম বদল হয়েছে বন্ধু যোগ বোনজামাই। অনেক বছর যোগাযোগ ছিল না কিছু বন্ধুর সাথে জারিফও তেমনই একজন। মেহের, ময়ূখের গল্পের মাঝেই ইরশাদ এলো মৈত্রীকে নিয়ে মেহেরের ঘরে।

“আমাদের প্রবেশের অনুমতি আছে কি?”

ইরশাদের প্রশ্নে ময়ূখ বলল, “আরেহ ভাই এসো তোমরা বসো।”

“এটা তো তোর ঘর না। যার ঘর সেই তো মুখ লুকিয়ে রেখেছে।”

“ভাবী বসো” বলেই মেহের বিছানায় নিজের পাশে জায়গা দিল মৈত্রীকে৷ এই প্রথম ইরশাদ শুনলো মেহের তার স্ত্রীকে ভাবী ডেকেছে। ইরশাদ, মৈত্রী বসার পর শুরু হলো বিয়ের আয়োজন নিয়ে আলাপ আলোচনা। ইরশাদ খেয়াল করল মেহের স্বাভাবিকবাবেই আলাপে যুক্ত আছে তা দেখে ভালো লাগল। ইরশাদ ভোরের ফ্লাইটে সিলেট চলে যাবে। তাই বেশিক্ষণ তাদের আলাপে না থেকে চলে গেল ঘুমাতে। ময়ূখও আম্মার সাথে একটু সময় কাটাবে বলে চলে গেল সেদিকে৷ ঘরে থাকল মেহের আর মৈত্রী তাই সুযোগ বুঝে মেহের প্রশ্ন করেই ফেলল, “ভাবীকে আপুকে জানিয়েছো ভাইয়া যে পৌঁছে গেছে?”

“কাকে! ওহ হ্যাঁ আমার মনেই ছিল না৷ কিন্তু তুমি তার কথা জানলে কি করে!” মৈত্রী সন্দিগ্ধ হলো মেহেরকে সে মেয়েটির কথা তো কখনোই বলেনি।

“ইয়ে মানে, ফুপি আমাকে আগেই বলে দিয়েছে সবটা৷” আমতা আমতা করে বলল মেহের।

“ওহ আচ্ছা! সমস্যা নেই আমিও আজ কালের মধ্যে জানাতাম তোমাকে৷ বড় মামাকে তো বাবা আর আম্মু মিলে জানিয়েছে বোধহয়! আচ্ছা আমি আমার ফোনটা নিয়ে আসি তাকে জানিয়েই দেই কথাটা।” মৈত্রী নিজের ঘরে গেল ফোন আনতে। মেহেরও ততক্ষণে তার হবু বরকে টেক্সট করে দিল আজ রাতে আর কথা হবে না যেন ঘুমিয়ে পড়ে সে৷ মৈত্রী ফোন এনে প্রথমেই টেক্সট করে জানালো ময়ূখ দেশে চলে এসেছে। চাইলে দু দিনের মধ্যে শপিং এর নামে দেখা করিয়ে দিতে পারে। ওপাশ থেকে তৎক্ষনাৎই জবাব এলো সেও রাজী। মেহের, মৈত্রী দুজনেই এরপর অনেকটা সময় হলুদ, মেহেদীর আয়োজন নিয়ে আলাপ করল। মৈত্রী নিজের বিয়ের আগে কখনোই বড়রকমের কোন বিয়ের আয়োজন কাছ থেকে দেখেনি। তার ঝুলিতে এসব নিয়ে আলোচনার অভিজ্ঞতাও শূন্য। কিন্তু এবার সেই শূন্যস্থান পূরণ হতে চলেছে মেহের বিয়ে উপলক্ষে৷ ইরশাদও তাকে খুব করে টেনে এনেছে এই আগাম আয়োজনে উপস্থিত রাখতে। কখনো কখনো কোলাহলপূর্ণ স্থান মানসিক প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে বিরাট ভূমিকা রাখে। মৈত্রীর জীবনে আগে সুযোগ ছিল না এসবের কিন্তু এখন তো এসেছে তাই সবটাই প্রাণ ভরে উপভোগ করুক সে আপ্রাণ প্রয়াস ইরশাদের। কাল থেকে বুধবার পর্যন্ত সিলেটে একা থাকতে হবে তাকে। আব্বু, আম্মু আর মৈত্রী একেবারে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তবেই ফিরবে। রাত বাড়ছে তাই মৈত্রীও ফ্রী হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। আগামী পাঁচটা দিন তাকে থাকতে হবে ইরশাদকে ছাড়া। বিয়ের পর এই প্রথম এই লম্বা সময়ের দূরত্ব আসতে চলেছে তাদের মাঝে। প্রতি ইদ, উৎসবে মৈত্রীর দু একটা দিন বাবার বাড়িতে কে-টে-ছে ইরশাদকে ছাড়া আর বাকি দিনগুলো শ্বশুর বাড়িতেই থাকতে হয়েছে। ইরশাদদের বংশ খুব বড় তাই বাড়ির বউ হিসেবে চাচী শ্বাশুড়িদের ডাকে তাদের সাথে এদিক সেদিকে ঘোরাঘুরি, বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে সময় দিয়েছে পুরোটাই ইরশাদের উপস্থিতিতে। বালিশে মাথা রেখেই মৈত্রী টের পেল ইরশাদের ভারী নিঃশ্বাস। বাহ্, ঘুমিয়ে পড়েছে লোকটা তাকে ছাড়াই! অভিমান হলো খুব কিন্তু সে অভিমান ধোপে টিকলো না। নিজেই অস্থি-র হয়ে ইরশাদের বুকের ওপর থেকে তার হাতটা সরিয়ে বুকটা দখল করে নিলো। আনমনেই হাত উঠিয়ে তার ক্লিনশেভড গালটা ছুঁয়ে বুকের ওপর চুমু খেল।

“ঘুমন্ত স্বামীর ইজ্জত লুটে নিতে চাইছো?” ঘুম ঘুম ভারী কণ্ঠে বলে উঠলো ইরশাদ।

“অসভ্য লোক!”

চলবে

কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব- ৪০ (২য় অংশ)

লালভ ভোরে চা বাগানের মাঝখানটায় এসে দাঁড়ালে মনভোলানো সমীরণের ধাক্কা এসে লাগে গায়ে। কৈশোরের প্রথম আবেগ কখনো কি ভুলে যাওয়া যায়! ছেলে কিংবা মেয়ে, নারী-পুরুষ প্রত্যেকেই তো তার প্রথম আবেগকে মনে রাখে অনন্তকাল। সুখের না হয় দুঃখের স্মৃতি ভেবেই রাখে। আর প্রথম ভালোবাসার মানুষটিকে যদি ভালোবাসা হয় সত্যিকারভাবে, অন্তরের অন্তস্থলে যদি একবার সিধে যায় সে মানুষ তাকে কি সহজে বের করা যায়! বয়স বিশে যে মানুষ হৃদয়ে প্রবেশ করে সে চল্লিশে এসেও ঠিক মনের দোরে কড়া নাড়ে বিষন্নতা অথবা দীর্ঘশ্বাস হয়ে। গুনে গুনে তেরো বছর আগের দিনগুলো খু্ঁচিয়ে দেয় ভেতরটাতে। আজ বহুদিন বাদে এই কাকডাকা ভোরে ইরশাদের ভেতরেও সেই রক্তক্ষ-র-ণ। মৈত্রী জীবনে যেভাবেই আসুক না কেন তার উপস্থিতি ইরশাদকে প্রফুল্ল রাখে, সতেজ আর করেছে সুখী তাই বিয়ের মাধ্যমে তার জীবন হয়েছে অপার্থিব এক সুখরাজ্য৷ কিন্তু এই চলমান জীবনে তাকে মৈত্রীর অনুপস্থিতি কতোটা অসু-খী করে তা আজকের এই প্রভাত হাওয়ার দোদুল্যমান মন খুব করে টের পেল৷ নইলে এমন হুট করেই কেন অতীতটা এসে পুরনো ক্ষ-ত তাজা করছে! ঢাকা থেকে এসে কে-টে গেছে পাঁচটা দিন। ফয়সাল আঙ্কেল বরাবরের মতই এক্সট্রা স্নেহে ছুটির পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ইরশাদ গ্রহণ করেনি সে ছুটি। পারসোনালি তিনি হয়ত তার মামার বন্ধু, পরিচিত আর খুব কাছের মানুষ কিন্তু প্রফেশনালি সেই সম্পর্ককে টেনে আনাটা অন্যা-য় মনে হয় তার। এমনিতেই সব দরকারেই অন্যদের চেয়ে একটু না একটু বেশিই সুবিধা ভোগ করছে এরপরও কাজের জায়গার এই বাড়তি ছাড়টা তার পছন্দ হয় না৷ ভোরের তাজা মুহূর্তটাকে মন ভরে উপভোগ করতে না পেরে বাড়ি ফিরে নাশতা তৈরি করল নিজের জন্য। সন্ধ্যায় মেহের গায়ে হলুদ, গতকাল ছিল মেহেন্দি। ইরশাদ শুনে প্রথমে অবাক হয়েছিল পরে অবশ্য মৈত্রী বুঝিয়ে বলল, এটা পশ্চিমা সংস্কৃতি ফলো করে করেছে৷ তাতে শুধু গান বাজনা আর পালা করে কনেসহ সব মেয়েই মেহেদী পরেছে হাতে। মৈত্রীও পরেছে আর তা ভিডিও কলে দেখেছে ইরশাদ। নিজের বিয়েতে বরের নাম লেখা হয়নি তার এবার সে সাধটাই পূরণ হলো। মেহেদী পরানো মেয়েটা তাকে জিজ্ঞেস করে এক কোণে ভীষণ সুক্ষ্ম কারুকাজে লিখে দিলো ‘ইরশাদ’ নামটা। কিন্তু আজ হলুদে ইরশাদ, মৈত্রী একই রঙের পোশাকে কাপল সেজে ঘুরবে সে অপেক্ষায় ছটফট করছে মৈত্রী৷ তাই ইরশাদও যথাসময়ে তৈরি হয়ে কেয়ারটেকার চাচাকে বাড়ির চাবি দিয়ে বেরিয়ে পড়ল এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।

আজ ভোর বেলাতেই ময়ূখকে ডেকে তুলে ফেলল ইরিন। ছেলেটা এসেছে এক সপ্তাহ হয়ে গেছে অথচ এখন পর্যন্ত বউ- শ্বাশুড়ির পরিকল্পনা সফল হয়নি৷ শপিংয়ের নামে বসুন্ধরায় গিয়ে তারা মেয়েটিকে নিয়ে বসেছিল ঘন্টা তিনেক৷ ময়ূখ কোন কাজে ফেঁসে গেছে বলে আসি আসি করেও শেষ মুহূর্তে বলল, “আম্মা আমি এসে কি করব তোমরাই কেনাকাটা করে নাও।”

কাল মেহেদী ছিল মেয়েটিও উপস্থিত ছিল বাড়িতে অথচ যার জন্য এলো সেই ছিল না। রা-গে দুঃখে ইরিন তো ময়ূখকে বলেই ফেলেছে, “তোর চাকরি আমি বের করছি দাঁড়া!”

মূলত, দেশে এসেই বিভিন্ন বন্ধুর মাধ্যমে সে পাঁচ দিনের মধ্যেই দুটো ইন্টারভিউ দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ইরিন এবার ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে ময়ূখের জীবন নিয়ে দুটো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রথমত ময়ূখ প্রথম বিয়েটা নিজে করেছে আর সেটা নেহায়েতই একজন ভুল মানুষকে যতোই সে নিজেদের র-ক্ত হোক না কেন! তাই এবার বিয়েটা তারাই করাবে। প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের জীবন নিয়ে বাবা-মা, অভিভাবকরা সিদ্ধান্ত নেবে এমন খুব একটা হয় না কিন্তু ময়ূখের ক্ষেত্রে তাই হবে এবার। দ্বিতীয়ত, আবরার খন্দকার বয়সে এখন প্রবীণ। আগের মত শক্তি, সামর্থ্য কোনটাই থাকবে না হয়ত কিছুদিন পর। নিজের সকল শ্রম, মেধা আর মৃত স্ত্রীর মাধ্যমে পাওয়া যে অর্থসম্পদ তার একমাত্র উত্তরাধিকারী ময়ূখই আছে তবে সেগুলো ছেড়ে সে পরের চাকরিতে কেন যাবে! যেখানে সে নিজে অসংখ্য মানুষের কাজের ক্ষেত্র হতে পারে সেখানে সে এসব ছেড়ে পরের কাজে যাওয়া সত্যিই বোকামি আর অ-ন্যা-য় বটে! তাই ইরিন ঠিক করেছে যে করেই হোক ময়ূখকে এবার ব্যবসায় দাঁড় করিয়ে ছাড়বে৷ আবরার অবশ্য চাইছিলেন ইরশাদও যুক্ত হোক ময়ূখের সাথে কিন্তু ইরশাদকে এখনো সে বিষয়ে খুব জোর দিয়ে কিছু বলেননি। তবে কিছুটা আভাস তো আগেই দিয়ে রেখেছেন সুযোগ পেলে আবারও দেবেন৷

সারাদিন ব্যস্ত থাকলো ময়ূখ। ছোট্ট বোনের বিয়ে উপলক্ষে কিছুতেই কমতি রাখবে না তাই আম্মা, আব্বু সবার কাছে জেনে নিয়ে সব রকম কাজে রাখছে নিজেকে। ইরশাদ এলো দুপুরে খাওয়ার সময় তখন মেহেরও বসলো পরিবারের সাথে খেতে। এই দুপুরটাই রাত থেকে আর হয়ত সুযোগ পাবে না তারা একত্রে খাওয়া-দাওয়া করার। মৈত্রী বাড়ির বউয়ের মতই সব কাজে এগিয়ে রাখছে নিজেকে। সবাই যখন টেবিলে মৈত্রী তখনো জরিনা আর অন্য একজন মেইডকে নিয়ে রান্নাঘর সামলাচ্ছে। ময়ূখ একবার পুরো টেবিলে চোখ ঘুরিয়ে নিলো৷ বাবা, আম্মা, মেহের, আব্বু, ইরশাদ ভাই আর আফছার চাচ্চু এ কয়েকজনই আছে। তারপরই মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে টেবিল ছেড়ে সে নিজের ঘরে গেল। মিনিট দুয়ের মাঝে ফিরে এলো হাতে তিনটি প্যাকেট নিয়ে।

“এগুলো কি?”

ইরিনই প্রথম প্রশ্ন করলো। বাকিরাও তাকিয়ে আছে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়েছে প্যাকেটগুলোর দিকে। ময়ূখ আগেই দেখেছিল প্যাকেট তিনটিতে প্রত্যেকের নাম আছে তাই সে একবার করে দেখে নিলো কার কোনটিতে নাম। তারপর সে একটি মেহের একটি ইরশাদ ভাইকে এগিয়ে দিল এবং অন্যটি নিজের কাছেই রাখল।

“আম্মা এগুলো শাইন আন্টি দিয়েছিলেন আমি চলে আসার দিন। আমাদের তিন ভাই বোনের জন্য গিফট।”

প্রত্যেকে কথাটা শুনলেও আবরার আর ইরিন প্রথমেই তাকালো আফছারের দিকে৷ যেন গিফটগুলো শাইন নয় সে-ই পাঠিয়েছে আর সেই কাজটা গর্হি-ত। নোরার কৃ-ত-ক-র্মের জন্য তিনি যথেষ্ট লজ্জিত বোধ করতেন বড় ভাই আর ছোট বোনের সামনে আসতে। তিনটি বছর পর মেহেরের বিয়ের উছিলাতেই ভাইবোনের মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু এই মুহুর্তে তাঁর প্রাক্তন স্ত্রীর দেওয়া গিফট দেখে সবাই যেভাবে তাতে তিনি বিব্রত বিশেষ করে ভাগ্নে, ভাতিজা, ভাতিজির সামনে এমন অবস্থা মোটেই কাম্য নয়৷

“ওই মহিলা দিলেই তোকে আনতে হবে? কি এমন গিফট যা না এনে একদমই পারলি না?”
রুষ্ট কণ্ঠে বলে উঠলেন ইরিন। ময়ূখ বোঝাতে চাইলো, “আম্মা রা-গ করছো কেন? আন্টি ভালোবেসে আমাদের দিয়েছেন৷ গিফট ছিল মুখের ওপর না করাটা খারাপ হতো না! এমনিতেও আন্টি আমার জন্য অনেকটা করেছেন নইলে…”

“প্রায়শ্চিত্ত করেছে ধরে নে। তার মেয়ের কী-র্তি-র জন্যই তোকে হেল্প করেছে।”

“আহ্ আম্মু তুমি এভাবে রিয়াক্ট করছো কেন?”

“তো কি করবে! ওই মা -মেয়ে মিলে আমার ভাই, আমার ছেলে দুজনের জীবনটা ন-ষ্ট করে দিল।”
এবার কথাটা আবরার খন্দকার বলল। ততক্ষণে মৈত্রী পায়েসের বাটি এনে রেখেছে টেবিলে। বোধকরি, বউমাকে দেখেই আবরার এবার থেমে গেলেন৷ মৈত্রীকে তিনি ভীষণ স্নেহ করেন বউমা হিসেবে। মৈত্রীও আওয়াজ পেয়েছে এখানে কিছু হয়েছে কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। ফখরুল সাহেব কথা ঘোরালেন, মা তোমার আব্বা-আম্মা কখন আসবেন?

“বাবা, তারা তো ভোরেই রওনা দিয়েছে কিন্তু এখনো ঢাকার বাইরেই আছে।”
মৈত্রী শ্বশুরের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে খাবার বেড়ে দিলো সবাইকে। খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই ময়ূখ মেহের আর ভাইকে ডেকে বলল, চলো এখানে বসেই দেখি কি গিফট দিয়েছে!

ইরশাদের খুব হাসি পেল। মনে পড়ে গেল তার ছোট বেলার জন্মদিনের কথা। ইরশাদের বার্থডে তে অনুষ্ঠান শেষে ময়ূখ বলত, “ভাই এখন এখানেই গিফট খোলো তোমার। তুমি কি কি পেয়েছো সেগুলো মিলিয়ে নেই নইলে তুমি ঘরে গিয়ে লুকিয়ে ফেলতে পারো।”

পুরনো স্মৃতি মনে করে ঠোঁটের কোণ প্রশস্ত হলো ইরশাদের। টেবিল গোছানোর ফাঁকে ইরশাদের দিকে চোখ পড়তেই মৈত্রীর চোখে পড়ল সেই প্রশস্ততা। ও মুখের হাসি তার হৃৎপিণ্ডের ধকধকানির কারণ হয় বারংবার আজও ব্যতিক্রম হলো না। ইশ, মানুষটার হাসিতেও তার বুকে চিনচিনে ব্য-থার নামে এক উচ্ছাস সৃষ্টি হয়। ময়ূখের ডাকের পরই মেহের তার প্যাকেটটি খুলে ফেলল। সবাই দেখলো তাতে খুব দামী কাপল ওয়াচ। খুব মনোযোগে দেখার পর বুঝতে পারলো লেডিজ ঘড়িটার চারপাশে ছোট ছোট হীরে বসানো৷ পুরুষ ঘড়িটির অবশ্য মেটালটাই দামী তাতে কোথাও হীরের পাথর নেই। সবাই বুঝতে পারলো শাইন গিফটটা মেহের এবং তার বরের উদ্দেশ্যে দিয়েছে৷ মেহেরের পর ইরশাদ খুলল নিজেরটা সেটাতেও সেইম গিফট। সবার সামনেই ইরশাদ ডাকলো মৈত্রীকে আর লেডিজ ঘড়িটা পরিয়ে দিল মৈত্রীকে৷ ইরশাদের এমন কাজে মৈত্রীর খুব লজ্জা লাগল। সামনেই শ্বশুর-শ্বাশুড়ি তাদের সামনেই কেমন বেহায়াপনা করছে মানুষটা!

সব শেষে ময়ূখ খুলল নিজেরটা। তারটাতে একটা ছোট্ট চিরকুট সমেত কাপল রিং। এটাতে ঘড়ি নেই তবে রিং দুটোও চোখ ধাঁধানো। ময়ূখ চিরকুটটা তুলে চোখ বুলালো। ইংরেজি বড় অক্ষরে লেখা একটি লাইন, Be wise and Happy.

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে