কি ছিলে আমার পর্ব-৩৯

0
1935

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩৯ (১ম অংশ)

“আসসালামু আলাইকুম শ্বাশুমা ইয়ে থুক্কু আন্টি ।”

কলিংবেলের তীব্র ঝংকা-রে ইরিনের বিকেলের মনমরা ঘুমটার সর্বনাশ করে দিল কেউ একজন। প্রচণ্ড মাথা ধ-রা নিয়ে টিকতে পারছিল না বলেই একটা নাপা খেয়ে ঘুমিয়েছিল৷ ঘরে একা একা এমনিতেও তার আজকাল থাকতে খুব খারাপ লাগে। ভেবেছিল সিলেট চলে যাবে কিছুদিনের জন্য কিন্তু ফখরুল সাহেব ছুটি নিতে পারছেন না। ময়ূখ লন্ডনে যাওয়ার পর থেকেই ইরিন শারীরিক দিক থেকে অ-সু-স্থ৷ মূলত মানসিক টানাপোড়েন থেকেই সৃষ্টি তার বিভিন্ন সমস্যা। কলিংবেলটা অনর্গল বাজতে থাকা আর সইতে না পেরেই এসে দরজা খুললেন৷ আর তখনই দরজার ওপাশ থেকে একটি মেয়ে চিকন স্বরে সালাম দিল। সম্পূর্ণ অচেনা একটি ; উহুম অল্প বয়সী দুটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওপাশে। তাদের মধ্যেই একজন সালাম দিয়েছে৷

“কে তোমরা কাকে খুঁজছো?” ইরিন প্রশ্নটি করছিল এরই মাঝে একটি মেয়ে ইরিনের পাশ ঘেঁষে ঘরের ভেতর উঁকি দিল৷ এমন আচরণে ইরিন যারপরনাই অবাক সাথে বির-ক্তও হলো৷ কি অভদ্র মেয়ে বলা নে, কওয়া নেই কারো ঘরে উঁকি দিচ্ছে!

” জ্বী আন্টি আমি অর্নি ও আয়শা। এটা তো ইরশাদ স্যারদের বাড়ি তাই না!” বিনয় যেন উপচে পড়ছে মেয়েটির কথাতে।

“হ্যাঁ! চিনতে পারলাম না তোমাদের।”

“আপনি? ”

“আমি ইরশাদের মা।”

“আন্টি আমি ইরশাদ স্যারের স্টুডেন্ট ছিলাম। স্যার তো মাস চারেক হয় কলেজ ছেড়েছেন কিন্তু আমার একটা হেল্প লাগত স্যারের তাই ।” ইতস্তত করছিল মেয়েটা কথা বলতে তা দেখেই বোঝা গেল। কিন্তু তার পাশের মেয়েটার আচরণ খুবই ভিন্ন। কথা না বলেও সে নিজের চঞ্চলতা প্রকাশ করছে মুখভঙ্গি আর চোখের দৃষ্টি দিয়েই৷ অর্নি আরও কিছু সময় নিয়ে হঠাৎ বলল তার ইরশাদের সাথে কথা বলা দরকার সে কি বাড়িতে আছে?

ইরিন জানিয়ে দিল ইরশাদ অন্য শহরে থাকে বউ নিয়ে। অর্নি এবার বলল, ফোন নম্বরটা যদি পাওয়া যায়! ইরিন মেয়েদুটির কথার সাথে আচরণে মিল খুঁজে পাচ্ছে না৷ একজন মাত্রাতিরিক্ত ভদ্র নম্র আর এতোটাই নম্র যে নিজের প্রয়োজনে স্যারের নম্বর নিবে তাতেও কেমন চো-র মুখো হয়ে আছে যেন চুরি ধরা পড়ে যাবার ভয় পাচ্ছে। আর দ্বিতীয়টি মানে আয়শা পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে খুবই আধুনিকা তবে উশৃংখলও হয়ত। দু-বার মুখ খুলেছে দু বারই নির্লজ্জের মত কথা বলেছে। প্রথম প্রশ্ন করেছে, “আচ্ছা আন্টি আপনার কি মনে হয় না ইরশাদ স্যারকে একটু তাড়াতাড়িই বিয়ে করিয়ে ফেলেছেন? না মানে, আশেপাশে অনেক মেয়েই থাকতে পারে যার স্যারকে পছন্দ কিন্তু বয়সের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারেনি৷ আরেকটু অপেক্ষা করলে তেমন কচি মেয়েগুলো পেতেন ছেলের বউ হিসেবে।”

“কিহ!” ইরিন চেঁচিয়ে উঠেছিল প্রায়। অর্নি আয়শাকে টেনে ধরে চুপ করালো৷ ইরিন ছেলের ব্যক্তিগত নম্বরটা দেবে কি দেবে না ভেবে অফিশিয়াল নম্বরটাই দিল৷ যাওয়ার পথে আয়শা আরেকটা কথা বলে গেল বে-য়া-দ-বের মত, “আপনি দেখতে অন্নেক সুন্দরী। আপনার কি প্রেমের বিয়ে ছিল নাকি এ্যারেঞ্জ?”

এ প্রশ্নে ইরিনের ইচ্ছে হলো মেয়েটাকে ধরে একটা থা-প্প-ড় লাগায়। বয়স কত হবে! তার ভাতিজি মেহেরের থেকে কিছুটা বড় এমনই হবে অথচ কথা বলার ধরণ! মেয়ে দুটো চলে গেলে জোর শব্দে দরজা বন্ধ করে তিনি আবারও বিছানা নিলেন।

“হায়! কি সুন্দর তোর স্যারের বাড়িটা অর্নি৷ ফ্ল্যাটটা ভীষণ খোলামেলা দেখেছিস ড্রয়িংরুমটা কেমন বড়!”

“আর ওতেই বুঝে গেলি ফ্ল্যাটটা সুন্দর! ”

“আরে ধ্যাৎ ওতে না আমি বুঝলাম দেয়ালের বিশাল বড় পেইন্টিংটা দেখে৷ ঘন জঙ্গলাকীর্ণ পর্বতের একপাশে ঝর্ণা বেয়ে নিচে সরু নদী আর তারই একপাশে শুভ্ররঙা ঘোড়া। আর ঘোড়ার পাশেই এক রাজকন্যা যার গায়ের চারপাশ শুভ্র আলোকছটায় ঝলসে যাচ্ছে।”

“বাব্বাহ্ মনে হচ্ছে আমার না তোরই মন পুরুষের বাড়ি গিয়েছিলাম আর তুই এক ঝলকে বাড়ির প্রতিটি কোণা মুখস্ত করে এসেছিস।”

অর্নির কথাটা শুনে একটুখানি হেসে আবার গম্ভীর হয়ে বলল, ” তুই ওই ব্যাটার নাম্বার কেন নিলি অর্নি এখন তো তার বউ আছে।”

আয়শার কথায় মন বাগানে আবারও বি-ষা-দ নামলো। গত চারটি মাস এক প্রকার মৃ-তের মত বেঁচে আছে সে। কলেজ জীবনের প্রথম দিনেই ইরশাদের প্রেমে পাগল হয়েছিল৷ ইরশাদ যখন ক্লাস নিতো তখন সে পড়া রেখে ইরশাদে মনোযোগ দিতো৷ তার লাজুক স্বভাবকে বদলে দিয়ে বহুবার বহু ভাবে সে মনের কথা জানিয়েছে স্যারকে। ক্লাসের অন্য মেয়েদেরকে ইচ্ছে করে উস্কে দিয়েছে স্যারের কাছে টিউশনি পড়ার জন্য এতে হয়ত একটু বেশি সময় মানুষটাকে দেখতে পাবে৷ এই আয়শাও তো কম বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করেনি তাকে। এমনকি আয়শা স্যারের ভাইকে কত কি বলে ঘুষটুষ দিয়ে তবেই না টিউশনের ব্যবস্থা করাতে চেয়েছে৷ কিন্তু না ইরশাদ স্যার রাজী হয়নি৷ ওই সমুদ্রের ফেনিল ঢেউওয়ালা চোখের মানুষটা কিছুতেই রাজী হয়নি টিউশনি পড়াতে। অর্নির মনে এবার কাঁচ ভা-ঙা-র মত কিছু ভেঙে পড়ল। মনে পড়ল স্যারকে পাঠানো তার সেই চিরকুটের কথা। স্যার চিরকুটটা পড়েছে এবং খুব সুন্দর করে ভ-য়ংক-রভাবে জবাব দিয়েছিল চিরকুটের।

“ভালোবাসার কি বোঝো তুমি? বয়স কত হয়েছে! বাবা-মা কি কলেজে এসে স্যারকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে পাঠিয়েছে? ফোন নম্বর বলো তোমার বাবার।” ভরা ক্লাসে এত কঠিনরকম অপমান সেদিন সইতে পারেনি অর্নি। স্যার সত্যিই তার বাবাকে ফোন করেছিল সবার সামনে এবং মুখের ওপর তার অপরাধ জানিয়েছিল৷ নম্র, শীতল মেয়ে অর্নি বাড়ি ফিরেই বাবার মুখোমুখি হওয়ার আগেই দাদীর ঔষধের বক্স থেকে এক পাতা ঘুমের ট্যাবলেট নিয়ে খেয়ে ফেলেছিল। কি যে দূ-র্বি-ষহ ছিল সে সময়টা তার জীবনে! এরপর তো আর কিছু স্বাভাবিক হলোই না উল্টো এ বছরেই কানে এলো স্যারের বিয়ে আর কলেজ ছাড়ার খবর। আরও একদফা ভ-য়া-নক কান্ড করল সে। দোতলা বিল্ডিংয়ের ছাঁদে ওঠে লাফ দিল৷ লাভের লাভ কিছুই হলো না উল্টো পা আর মেরুদন্ডে মারাত্মক আঘাতে চারমাস বিছানায় ছিল৷ এক সপ্তাহ ধরে চলাফেরা করতে পারে তাই আজ আয়শা আসতেই তাকে নিয়ে এসেছে স্যারের সাথে দেখা করতে। সেটাও করতো না যদি বাবা সাহেব তার হুট করে বিয়েটা ঠিক না করত। কালই পাত্র দেখতে এসে আংটি পরিয়ে গেছে। কমিশনারের মেয়ে বলে কথা মান সম্মান খোয়ানোর ভয়ে মেয়ে বিদায় করতে তৎপর তিনি৷ আয়শা অবশ্য অনেকবার বলেছে, চল তোর স্যারকে কিডন্যাপ করে তোর সাথে বিয়ে দেই। কিন্তু অর্নি বলে এটা কি করে সম্ভব!

“কি ভাবছিস এত বলতো? তোর হবু বর তো দেখতে সুন্দর। কষ্ট পাওয়ার কি আছে এমনিতেও স্যারকে তো বিয়ে করবি না বললি৷”

“আমার কান্না পাচ্ছে আয়শা। স্যারের বউ আছে কিন্তু আমার তবুও তাকেই বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে।” কথাটা বলতে বলতেই ফ্যা ফ্যা করে কেঁদে উঠলো।

“আরে বাল কথায় কথায় কাঁদিস ক্যান । কান্না দেখাবি বলে ঢাকা থেকে আনিয়েছিস?” প্রচণ্ড বিরক্ত হচ্ছে আয়শা এখন৷ অর্নির এনগেজমেন্ট হয়েছে ফুপুর কাছে শুনলেও তার পড়াশোনার চাপে এদিকে আসার ইচ্ছে ছিল না একদম। কিন্তু মেয়েটা প্রচুর আবেগী আর দূর্বল চিত্তের আবারও না কিছু করে বসে তাই এলো এমনিতেও নিজেরও বিশেষ আর গোপন উদ্দেশ্যে এসেছে তা সে আয়শাকেও জানায়নি৷ ভেবেছে বোনটির বিয়ের আগে একটু না হয় আদর করে বুঝিয়ে যাবে ইরশাদ আর তার হতেই পারে না। কিন্তু কান্নাকাটির বহর দেখেই সে এখানে এসেছে ইরশাদের বাড়িতে৷ নিজ চোখে দেখে গেল স্যার তার বউয়ের সাথে আছে কোথাও দূরে৷ ফোন নম্বরটিও নিলো একটিবার কথা বলিয়ে দিতে৷ তারপর খুব সুন্দর করে বোনটির ব্রেনওয়াশ করে বিয়ের জন্য আগ্রহী করে যাবে আপাতত এসবই তার পরিকল্পনা।

লন্ডনের আকাশে র-ক্ত-রাঙা ভোর। গত রাতের হ্যাংআউটে এখন মাথা হয়ে আছে ভার। আজ অফিসে যাওয়ার প্রয়োজনটা অনেক হলেও ইচ্ছেটা ক্ষীণ৷ তবুও হাতে সময় আছে বলে আরেকটু সময় মাথাচেপে পড়ে রইল ময়ূখ। মিনিট বিশেকের মাঝেই কানে এলো কলিংবেলের আওয়াজ তার মিনিট দুয়েকের মাঝে কানে এলো ব্রিটিশ একসেন্টে বলা একটি ছেলের কিছু কথা। কথাগুলো ড্রয়িংরুম থেকে আসছে বলেই শব্দটা খুব ধীর শোনাচ্ছে৷ ময়ূখ বোঝার চেষ্টা করলো ছেলেটি ঠিক বলছে! হুম, বোঝা গেল নোরার আজ কোথাও যাওয়ার কথা ছিল লম্বা সময়ের জন্য মেবি ডেট অর সামথিং লাইক দ্যাট! ভার মাথাটা এবার আরও বেশি শ-ক্ত মনে হচ্ছে , একপাশে বোধহয় চিনচিনে ব্য-থাও আছে৷ এ ব্য-থা-টা তার প্রায়ই হচ্ছে আজকাল৷ আগে কখনো এমন ধারার মাথাব্যথা ছিল না এখন হয়। কাল রাতে অফিস থেকে ফেরার পথে আন্টি শাইনের সাথে সে গিয়েছিল তাঁর ফ্ল্যাটে৷ আধঘন্টার মত সেখানে ছিল সে আন্টির পার্টনারের ককটেল পার্টি ছিল বলে৷ বলতে নেই, ময়ূখ শাইনের কিছু আচরণ পছন্দ করলেও কিছু আচরণে মনে মনে ভীষণ ঘৃণা করে৷ তারমধ্যে প্রথম ঘৃণ্য ব্যাপার হলো তারই সামনে শাইনের বয়ফ্রেন্ডের সাথে হাসিঠাট্টা। মনে মনে আফসোস হয় চাচার জন্য পরক্ষণেই নিজের জন্যও৷ নোরার মধ্যে চাচার প্রকৃতি কিছুটা থাকলেও চাচীর মানে প্রাক্তন চাচীর বেশিরভাগটাই বিদ্যমান৷ ময়ূখ যখন পার্টিতে গেল তখন সেখানে পেল একদল মধ্যবয়সী পুরুষ, মহিলা। শাইন অবশ্য ময়ূখকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল নোরার প্রফেসরের কথাতেই কিন্তু ভদ্রলোক কোন কারণে উপস্থিত হতে পারেননি। ময়ূখ ভেবেছিল চলে আসবে সে মুহূর্তেই বাধসাধল শাইনের পার্টনার। বাধ্যহয়েই দু চার প্যাগ গলায় ঢালল৷ মনে হলো মানসিক অস্বস্তি গুলো তাতেই কে-টে গেছে। মস্তিষ্কের উত্তেজনা কমছে ভেবে সে বসে পড়ল সেখানেই৷ এলকোহলিক তরলগুলো পরপর অনেকটা ঢেলে তবেই ফিরেছিল সে ফ্ল্যাটে৷ নোরা আগেই উপস্থিত ছিল। ময়ূখের অবস্থা বেগতিক দেখে এক গ্লাস লেমনেডও করে দিয়েছিল৷ ময়ূখ তা ছোঁয়নি ফলস্বরূপ এই ভোরে মাথার য-ন্ত্রণা পোহাচ্ছে । ড্রয়িংরুমের কথাবার্তা আর কানে আসছে না৷ একটু পরই নোরা এসে ঢুকলো রুমে৷

“আই থিংক ইউ নিড রেস্ট।”

“ফর হোয়াট!”

“যা সয় না তা কেন গিলতে গেলে?”

“ইটস নট ইউর কনসার্ন”

” ওকে! আমি বেরুচ্ছি। কখন ফিরব জানি না। ড্যাড ফোন করেছিল তোমার সাথে কথা আছে বলল। আর… ”

মুখ থেকে স্যরি শব্দটা আজ আর আসছে না নোরার। গতরাতে সে দ্রুতই ফিরেছিল ফ্ল্যাটে৷ ভেবেছিল কিছু একটা স্পেশাল করে স্যরি বলবে ময়ূখকে কিন্তু ইরিনের সাথে কথা বলে তার মেজাজ বিগড়ে গেছে বলে আর কিছুই করেনি। ফুপু তার বাচ্চা বাচ্চা করে মাথা ন-ষ্ট করে দিচ্ছে। আরে বিয়ের পরপরই যদি বাচ্চা নেওয়ার হতো তবে প্রথম বাচ্চা এ-বো-র্ট কেন করত সে! কিন্তু এ কথা তো ফুপিকে বলা যাবে না৷ তার কালচারে বাঙালিয়ানা না থাকলেও বোধবুদ্ধিতে বাঙালি ব্যাপারসেপার খুব জানা৷ বিয়ে হতেই শ্বাশুড়ি নাতিপুতি করে ক্যারিয়ার ধ্বং-স করতে উঠেপড়ে লাগে। তারওপর মাত্র মাস খানেক হলো তার নতুন একটা রিলেশন হলো জন নামের কানাডিয়ান ছেলের সাথে৷ রিলেশন নয় ঠিক জন তার প্রতি আগ্রহী তারও ভালো লাগছে তা দেখতে৷ সেই জনের সাথেই আজ ডেটের নামে টাইম স্পেন্ড করবে কিন্তু ক্লোজলি কিছু করবে না বলে ঠিক করেছে সে। ময়ূখ বোজা বোজা চোখে নোরাকে একবার লক্ষ্য করল। বসন্তের শেষ দিকের সময় বাতাসে উষ্ণতা না থাকলেও মোহনীয় কিছু আছে৷ এ ওয়েদারের সাথে তাল মিলিয়েই বোধহয় নোরা পরেছে ফ্রক টাইপ কিছু যা তার উরুতেই থেমে গেছে৷ ওপরেও বুকের বিভাজিকা স্পষ্ট করে স্লিভলেস লাল ফ্রকটা দারুণ ঢেউ তুলেছে সৌডল বুকে৷ হাতে রাখা লং কোট বোধহয় আর পায়ের হিলজোড়া পাহাড়চূড়োর মত৷ মেকাপ বলতে শুধুই ঠোঁটে ইটরঙা লিপস্টিক৷ চোখ ঝলসে যাওয়ার উপক্রম নোরার দেহের জামার ফাঁকে উঁকি দেওয়া মোমরঙা ত্বকটায়৷

” যাওয়ার পথে এক বোতল এসি-ড কিনে নিও।”

“হোয়াট!”
মুখ বিকৃত করে বলল নোরা।

“ওহ এ দেশে তো আবার সবই লাইসেন্স নিয়ে করতে হয় মেবি সে….” কথাটা উচ্চারণ করতে গিয়েও করলো না বলল, “বলছি এসি-ড যদি পাওয়া যায় কিনে নিও৷ ওই ধলা মূলাটা যে যে জায়গা স্পর্শ করবে সব জায়গায় সেটা ঢেলে পবিত্র হয়ে ফিরে এসো৷ গুড লাক, গুড নাইট নাউ ইউ গো টো হেল।”

কথাটা শেষ করেই ময়ূখ বালিশটা মাথার ওপর চেপে শুয়ে পড়ল৷ নোরা বি-ষ্ফো-রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ময়ূখের দিকে৷ কানে এলো বাইরে থেকে জন ডাকছে৷ বেরিয়ে গেল এবার সেও হয়ত রাতে ফিরে কিছু একটা করবে এ নিয়ে৷
নোরা যেতেই ময়ূখ বালিশটা সরিয়ে দিল মাথা থেকে৷ চোখের কার্নিশে জমে থাকা দু ফোঁটা অশ্রুকণা বা হাতের তর্জনীতে মুছে নিয়ে কল্পনা করলো সেদিনের ঘটনা। (উহ্য রাখা ঘটনা) নোরার বান্ধবীদের একজন ময়ূখের পেছনে খুব করে পেছনে পড়েছিল। “ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড” টাইপ তার এক রাতের জন্য হলেও ময়ূখকে চাই। ময়ূখ যখন এ কথা জানলো ঠিক তখনই নোরাকে প্রশ্ন করলো এসবের মানে কি! নোরা অকপটে বলে দিল, ভালোলাগা মন্দ কিছু নয়৷ তুমি চাইলে ডেট করতে পারো। এ কথার পরই ময়ূখ নোরাকে থাপ্পড় মে-রে-ছিল। ঠিক করেছিল চলে আসবে দেশে৷ এই নিচু মানসিকতার আগাগোড়া ন-ষ্টামিতে ভরা মনের মেয়েটার সাথে সে কিছুতেই থাকবে না৷ নোরা যখন বুঝল ময়ূখ দেশ ছাড়তে চাইবে তখনই সতর্ক-তার সাথে ময়ূখের পাসপোর্টসহ কিছু কাগজ লুকিয়ে ফেলল। নোরা ময়ূখকে চায় নিজের পাশে কিন্তু সে নির্দিষ্ট কোন বন্ধন চায় না৷ ময়ূখকে সে যখন ইচ্ছে কাছে টানবে কিন্তু এর মানে সে নির্দিষ্ট কোন বিচার বিভেদ, সংস্কৃতি, সংসার এসব চায় না। ময়ূখ সত্যিই সেদিন রেগে গিয়ে ঠিক করলো ফিরে যাবে সে দেশে৷ তারপক্ষে সম্ভব নয় শুধুই সেক্সুয়াল আশ মেটানো সম্পর্কে টিকে থাকা। তেমন হলে তো নোরা বিয়েটা না করলেও পারত কিন্তু না নোরা পবিত্র বন্ধনটাকে কলু-ষি-ত করে ফেলছে। ময়ূখ সাধুসন্ন্যাসী নয় তবুও তার মনে সম্পর্কের প্রতি সম্মান আছে। সে ভালোবাসে তার আম্মাকে আর আম্মার দেওয়া শিক্ষাকে। নোরার সাথে ঝা-মে-লার মাঝেই কাবার্ড খুলে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে। ফোন করে শাইনকে বলেছে তার ইমিডিয়েট টিকিট চাই দেশে ফেরার। শাইন বুদ্ধিমতি এমন একটা দিন আসবে তার আগেই জানা ছিল বুঝি! সেও বিনা বাক্যে ব্যবস্থা করবে বলে আশ্বাস দিল৷ কিন্তু ময়ূখ পড়লো ফ্যাসাদে৷ তন্ন তন্ন করে কোথাও তার পাসপোর্ট পেলো না। নোরা পাসপোর্ট সাথে নিয়েই বেরিয়েছে বাড়ি থেকে এদিকে ময়ূখ অনেক খোঁজাখুঁজি করল বেডরুমে। না পেয়ে যখন হতাশা ঘিরে ধরল তখনই কি মনে করে আবার ঢুকল কিচেনে। সেখানে কিচেন ক্যাবিনেটের মত করে লম্বাটে একটা ক্যাবিনেট আছে যা দেয়াল থেকে ভেতরের দিকে অনেকটা জায়গা নিয়ে তৈরি৷ ময়ূখ জানে সেটা স্টোর রুমের মত ব্যবহার করা হয়। তাতে অনেক ধরনের পুরনো কাগজপত্র, বইখাতা এমনকি পুরনো কাপড়চোপড়ও আছে৷ ময়ূখ দ্রুত পায়ে সেখানে গিয়ে কাগজগুলো নেড়েচেড়ে দেখলো। নাহ্ পাসপোর্ট নেই তবে সেখানে পেয়ে গেল তারচেয়েও মূল্যবান কোন যন্ত্রণার কারণ। একটা ফাইল তাতে মাত্র দুটো কাগজ। ময়ূখ সেটা ধরেই বসে পড়ল মেঝেতে। নোরার এবর্টশনের কাগজ দুটো। শক্তপোক্ত মানুষটার চোখ ফেটে জল গড়ালো, নিমেষেই চোখের সামনে আঁধার নামল। কাগজটাতে থাকা তারিখগুলো মিলিয়েই যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইল ময়ূখকের। এবোর্ট করা বাচ্চাটার বয়স সপ্তাহ হিসেব করেই বুঝে ফেলা যায় অংশটা ময়ূখেরই ছিল৷ পুরোপুরি হাত, পা, মাথা সবটা নিয়ে তৈরি হওয়ার আগেই সে অংশটাকে ফেলে দিয়েছে নিষ্ঠুর নারীটি৷ তারপর আর ময়ূখ কিছুই বলেনি নোরাকে। সে মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছিলো কিছু একটা করবে৷ কিচ্ছু তো করতেই হবে তার অনাগত সন্তানের খু-নীর বিরুদ্ধে। চাইলে নোরাকেই তো খু-ন করতে পারে৷ মনে মনে ময়ূখ তেমনই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল কিন্তু পারলো না। চোখের মাঝে ভেসে ওঠে আম্মার মুখটা৷ এখানে সে যাই করুক আম্মার কাছে না ফিরলে যে তার আম্মা বাঁচবে না। ঠিক এই জায়গাতে এসেই তার প্রতিশো-ধস্পৃহা থেমে গেল৷ এরপর চুপচাপ কা-টিয়ে দিল আরও দু মাস। পাসপোর্ট হাতে পেয়ে গেছে আরও আগেই সেই সাথে পেয়েছে জব৷ কিছুদিনের মাঝেই পেয়ে যাবে ড্রাইভিং লাইসেন্সও৷ সে মনে মনে আবারও ছক কষে নিচ্ছে। সময় দিবে সে নোরাকে আরও অনেকটা হতে পারে কয়েক মাস অথবা কয়েক বছর। প্রতিটা জিনিসের হিসেব তুলে তবেই না ময়ূখ ফিরে যাবে আম্মার কোলে।

চলবে

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩৯(২য় অংশ)

“একদম চুপ আর একটা আওয়াজ করলে তোর আজকের খাওয়া বন্ধ।” ধ-ম-ক দিতে না জানা মৈত্রী আজ নিরীহ পোষা পাখিগুলোকে ধমক দিয়ে অনাহারী রাখার ভয় দেখাচ্ছে। ভয়টা মূলত ইরশাদকেই দেখানোর ইচ্ছে তার কিন্তু মানুষটাকে কি দিয়ে ভয় দেখাবে তাই জানে না। ইরশাদ ডাইনিংয়ে বসে আলু চটকাচ্ছে ভর্তার জন্য। আজ সকালে রুটি পরোটা খাবে না বলে ভাত, ভর্তা রাঁধতে বলেছিল৷ মৈত্রী সকাল সকাল রেঁধেছে ভাত আর আলু সেদ্ধ, ডাল সেদ্ধ আর কালোজিরা ভেজে রেখেছে ভর্তার জন্য কিন্তু সব কাজ শেষ হওয়ার আগেই মৈত্রীর মেজাজের পারদ উঠল উঁচুতে। কোথাকার কোন মেয়ে এই সকাল সকাল ফোন দিয়ে বিরহের আলাপ জুড়েছে আর উনিও প্রশ্রয়ের সাথে জ্ঞান বন্টন করছেন মেয়েটিকে। কলটা যখন এলো তখন মৈত্রী রান্নাঘরে আর ইরশাদ ছিল শোবার ঘরে। ভর্তা সে করবে নাকি ইরশাদ করবে তা জানতেই এসেছিল ঘরে। তখনই কানে এলো ইরশাদের বলা কথাগুলো, “দ্যাখো অর্নি তোমাকে আমি বুঝিয়েছি অনেকবার না পেরে বাধ্য হয়েই ক্লাসে সেবার অপমানজনক কথাও বলেছি। এতকিছুর পরও তুমি নিজের আত্মসম্মানবোধ পায়ে মাড়িয়ে আবারও আমার সাথে কানেক্টেড হতে চাইছো সেটা খুবই বাজে ব্যাপার। তোমার তো বোঝা উচিত আমি কখনোই তোমাতে আগ্রহী ছিলাম না আর না হব ।”

ওপাশের মানুষটা কি বলল তা শুনতে পাচ্ছে না মৈত্রী কিন্তু এপাশে ইরশাদ আবারও বলল, “সু-ই-সা-ই-ড এর মত ফালতু কাজটা একমাত্র ইমম্যাচিউর বাচ্চারাই করে । আর তুমি এমন ফালতু কথা আমাকে শোনাতে কল করেছো!”

আবারও ওপাশে কিছু বলল তারপর ইরশাদ বলল, ” দেখো মেয়ে জীবনটা খেলনা নয়, যতক্ষণ ইচ্ছে খেললাম উপভোগ করলাম খেলা শেষ তাকে শেষ করে দিলাম। ফোন রাখো নিজেকে নিয়ে ভাবো ভবিষ্যতটাকে কিভাবে সুন্দর করা যায় সেটা ভাবো।”
ওপাশের মানুষটি কাঁদছে তাই ইরশাদ এবার অন্যরকম কথা বলে কাটাতে চাইল। এমনিতেই অফিসের সময় হয়ে গেছে নাশতা করা বাকি তাই আবার বলল, “আচ্ছা আপাতত রাখো আমি তোমাকে কল করছি ফ্রী হয়ে আর হ্যা সু-ই-সা-ই-ডে-র মত জঘন্য কোন ভাবনা ভুলেও মাথায় আনবে না। বাই ” মৈত্রী শুনেছে সবটা আর তাতেই রা-গে গজগজ করতে লাগল সে৷ কি চমৎকার ভাবে বলে দিল ফ্রী হয়ে কল করবে হুহ! সেই রাগ প্রশমনের উপায় হিসেবে পাখিগুলোকে বকে চলেছিল। ইরশাদ যখন মূল রহস্য উদ্ধার করল তখন তার ভীষণ আনন্দ হল৷ তার বউ একদম স্বাভাবিক আছে নইলে এত সহজভাবে সে হিংসে করত না। আর লোকে কিনা এই মেয়েটির সাথে সমন্ধ ভে-ঙে-ছিল তাকে মানসিক রো-গী আখ্যা দিয়ে! চট্টগ্রাম থেকে আসার পর সময়গুলো তাদের খুবই ভালো কেটেছে, দুজনের মধ্যে বাঁধনটাও হয়েছে আরও মজবুত। এরই মাঝে মৈত্রীর কাউন্সিলিং করানো হলে সাইকিয়াট্রিস জানালো মৈত্রীর সমস্যাগুলো প্রায় নব্বই শতাংশ সেরে গেছে। চাইলে এখন তারা বাচ্চার প্লানিং করতেই পারে তবে সেক্ষেত্রে একটাই শর্ত অবশ্যই সে সময়গুলো তার আশপাশটা কোলাহলময় হতে হবে৷ একাকীত্বই ছিল তার মানসিক য-ন্ত্র-ণার কারণ পুনরায় তেমন পরিবেশ হলে অনাগত সন্তানের জন্য আ-শ-ঙ্কাজনক হতে পারে। ডক্টরের ইঙ্গিত তার সিলেটের বাসস্থানের দিকে ছিল, ডক্টর জানতো ইরশাদ মৈত্রী বর্তমান যে পরিবেশে থাকছে। মৈত্রী ইরশাদের সাথেই বেশি স্বচ্ছন্দ্য কিন্তু দিনের বেশিরভাগ সময়টাই ইরশাদ ব্যস্ত থাকবে অফিসে আর সে সময়টা মৈত্রীর জন্য থাকবে সেনসিটিভ, ডেলিকেট কন্ডিশনে তার পাশে প্রতি মুহূর্তেই কাউকে না কাউকে লাগবে সেটাই স্বাভাবিক। ইরশাদ সবটা শুনে চিন্তিত হলো প্রথমে পরেই ভেবে নিলো সময়টা আসুক আগে তারপর না হয় ব্যবস্থা একটা করা যাবে। প্রয়োজনে চাকরিটা ছেড়ে রাজশাহীতেই খুঁজবে অথবা পুনরায় বাবার ব্যবসাটাকে ধরবে। তার জন্যই তো বাবা ছেড়েছিল সব। মানব মন যতই নিজে থেকে পরিকল্পনা করুক না কেন কিছুই সম্ভব নয় যদি না অদৃষ্টে থাকে। ইরশাদ মৈত্রীর জীবনেও তেমনই দূ-র্দ-শা হয়ে ধরা দিল অদৃষ্টের লিখন। সুখ ঘেরা রাজ্যে হঠাৎই উদয় হলো এক পশলা বৃষ্টির মতন দুঃখ। বিয়ের বছর তিন পেরিয়ে গেল, পার হলো দুজনের সিলেট বসবাসেরও তিন বছর। সংসারে চিত্র বদলে গেছে প্রায় পুরোটাই। ফখরুল সাহেব চাকরিতে অবসর নেওয়ার পর ইরশাদ জোর করে বাবা মা’কে নিয়ে গেল নিজের কাছে। আবারও আপন বসত ছেড়ে তারা ছেলে আর বউকে সাথে নিয়ে সিলেটবাসী হয়ে উঠলো৷ তিন বছরে ইরিন অ-সু-স্থ হয়ে পড়লেন ময়ূখের চি-ন্তা-য়। মৈত্রীও আবার বদলাতে লাগল, হতে লাগল প্র-তি-ক্রি-য়াহীন। এবার আর এই পরিবর্তনের পেছনে দায়ী তার একাকীত্ব নয় বরং সন্তান আকাঙ্খা। কত চেষ্টাচরিত, আধুনিক চিকিৎসা সবেতেই ঝুঁকে পড়েছে তারা বছরখানিক সময় ধরে কিছুতেই আর পাওয়া গেল না সুসংবাদ৷

সরু পথের দু পাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ব্রাইটন শহরের রঙ বেরঙের দোতলা বাড়ি। প্রত্যেকটা বাড়ির উচ্চতা, গঠন সবটাই এক শুধু দেয়ালের রঙেই যা ভিন্নতা। ময়ূখ এই রঙবেরঙের বাড়িগুলোরই একটিতে থাকে গত দু বছর ধরে। লন্ডনে থেকেছিল পুরো একটি বছর আর ধৈর্য্যশীল পুরুষের মত স্ত্রীর সাথে মিলেমিশে জীবনটা কা-টি-য়ে দেওয়ার এক নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। অবশেষে, হার মানতে হয়েছে তাকে। এবোর্শনের কথাটাকে নোরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক্সিডেন্ট হিসেবে প্র-মা-ণ করেছিল৷ ময়ূখ কিছু সময় এ নিয়ে বিক্ষিপ্ত থাকলেও পরে ঘটনা সত্যি ভেবে নিয়েছিল। তার মন বলছিল নোরা স্ত্রী কিংবা মানুষ হিসেবে যেমনই হোক মা হিসেবে নিশ্চয়ই এতোটাও নিচু হবে না! গর্ভস্রাবের বিষয়টা কোন ছোটখাটো ব্যাপার নয়। কিন্তু সম্পর্কের সুতো টানা যে কিছু কিছু মানুষের নাড়ীনক্ষত্রেই থাকে না তা যেন নোরাই প্রমাণ৷ মায়ের মতই সেও অন্যপুরুষে মজে যায়। এদিকে ময়ূখকেও সে ছাড়তে রাজী নয়। দিনরাত দু জনে এ নিয়ে কলহ লেগেই থাকত। ঠান্ডা মস্তিষ্কের ইরশাদ যেমন প্রেমিকার ধোঁ-কাবাজিতে তাকে খু-নও করতে উদ্ধত আচরণ করেছিল অথচ উগ্র চঞ্চল ময়ূখকেই দেখা গেল জীবনের সকল ভয়াভহ মুহূর্তগুলোতে শীতল আচরণ করতে। শত সহস্র মাইল দূর থেকেও ইরিন ভয়ে আ-তংকে ডুবে থাকত ছেলেটা নোরার অন্যায়গুলোতে ক্ষো-ভে কোন ভুল করে বসবে না তো! কিন্তু না তেমন কোন বার্তা যায়নি ইরিনকে পেতে হয়নি আর। তাকে ভ-য়মুক্ত রাখতেই যেন আম্মার বাবু হয়ে একটি বছর ময়ূখ ধৈর্য্য ধরেছিল, সংযম রেখেছিল সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে। শেষ পর্যন্ত আর পারেনি। যেখানে দুটি মানুষের মাঝে স্যাক্রিফাইস আর কম্প্রোমাইজ শব্দটির কোন স্থান নেই সেখানে সম্পর্কের ভীত হয় নড়বড়ে আর শেষতক পরিণতি হয় বি-চ্ছে-দ। আমাদের দেশে যতোটা প্রেমের বিয়ে হয় তারচেয়ে দ্বিগুণ হয় পারিবারিক ভাবে। সেসবে প্রত্যেকেরই নিজ নিজ জীবনসঙ্গী পছন্দের হয়! না, কতশত দম্পতি একে, অপরকে পছন্দই করে না কিংবা ভালোবাসার দ্বারপ্রান্তেও থাকে না তারা অথচ দিনশেষে তারাও একটা সম্পর্কের ধারক, বাহক হয়ে টিকে থাকে আমৃত্যু। জন্ম হয় তাদের পরবর্তী অস্তিত্বের তার পেছনের মূল কারণ রেসপেক্ট, স্যাক্রিফাইস, কম্প্রোমাইজ। আবার অনেকে ভালোবাসা বাসির পর বিয়ে করেও হতে পারে না আজন্মকালের সঙ্গী। সেখানে চিড় ধরে নানা সম্মান, ত্যাগ কিংবা সমঝোতার অভাবে৷ ময়ূখ চেয়েছিল তেমনটা তার সাথে না হোক। দিন শেষে তার স্ত্রীই হোক তার সম্পদ। বিসিএসটা হয়ে গিয়েছিল তার সুবর্ণ সুযোগ নিয়ে। বিচ্ছেদের আগের মাসটাতেও সে বুঝিয়েছিল নোরাকে সে দেশে ফিরুক৷ স্বপ্নটা তার রঙিন হয়েছে সে স্বপ্নের সাথী নোরাও থাকুক ভাগীদার হয়ে। প্রয়োজনে নোরা তার পড়াশোনা কমপ্লিট করা পর্যন্ত এখানেই থাক। এরপর না হয় দেশে ফিরে তার জন্য নিজস্ব চেম্বার এমনকি সরকারি ভাবেও কোন চেষ্টা করবে৷ কিন্তু না, কারো কারো জীবনে প্রথম জোড়া মিললেও তা ভুল হয়েই ধরা দেয়। যে কাজে নিয়ত পরিষ্কার না থাকে সে কাজের ফলাফল কি করে সুন্দর হবে! নোরার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে মধ্যিখানে, ময়ূখের পঁচিশ বছরের সুখময় জীবনে তিনটি বছরের দূ-র্বি-ষহ সময় যোগ হলো। হতে পারে এই দূর্বিপাকের সময়গুলো আবারও দূর হয়ে যাবে এক পশলা সুখবৃষ্টির দ্বারা! কে জানে জীবন কখন কাকে কোথায় আর কোন পরিস্থিতিতে ছেড়ে দেয় অদৃষ্টের পরীক্ষা হয়ে! বাড়ি থেকে অনেকটা দূর পায়ে হেঁটেই চলে এসেছে ময়ূখ। এখানে পথের ধারে গাছের সারি ভেতরেও ঝোপ। প্রধান সড়ক থেকে একটু ভেতরের এই পথে চলছে অক্টোবরের হিমেল হাওয়ার চঞ্চল আলিঙ্গন৷ এ শহরে তার টিকে থাকার আজ শেষ দিন। নিজের অস্তিত্বকে নোতুন করে চেনার এ শহরে শেষ দিন। কাল রাতের আকাশের তারার মেলা হয়ত দেখার সুযোগ হবে মায়ের ভূমিতেই। দেখতে দেখতে কত কি বদলে গেল জীবনের ডায়েরি থেকে৷ হিসেব মেলা ভার, তার পঁচিশতম জন্মদিন পর্যন্ত সে বুঝতে পারতো না জীবনে সংগ্রাম কি জিনিস? ধারণা ছিল না আম্মার অসুস্থায় তাঁর যত্ন করার বাইরে আর কি দ্বায়িত্ব থাকে৷ বুঝতেই পারেনি বাবা নামের ফুপা মানুষটার হাস্যরসাত্মক শাষণের বাইরের জীবনটা কেমন? মনে পড়ে না ভাইয়ের কাছে আবদার ধরে কখনো কিছু না পাওয়া! তার মাথার উপর ছাউনি ছিল তিনটি। প্রকৃতিতে শীতের টান বাতাসে গায়ে কাঁ-টা দেয়৷ রুম থেকে বেরিয়ে আসার আগেই সব গুছিয়ে এসেছে সে তাই আপাতত শেষ সময়ের এই একলা মুহূর্ত প্রকৃতির সাথেই কা-টা-তে বেরিয়েছে৷ হাঁটতে হাঁটতে চোখের সামনে দিয়ে সাঁই করে চলে গেল একটা লাল রঙের গাড়ি৷ গাড়িটি তার খুব চেনা। গাড়ির মালিকটি যদি তাকে দেখে থাকে তবে অবশ্যই ব্যাক করবে এদিকে৷ ময়ূখের এই ভাবনাটির স্থায়ীত্ব ঠিক তিরিশ সেকেন্ড তারপরই তার ঠিক পাশে এসে থামল গাড়িটি৷

“হেই ইয়াংম্যান!”

গাড়ির জানালা খুলে প্রফুল্ল কণ্ঠে ডেকে উঠল গাড়ির মালিক। আশি বছরের প্রবীণ মিষ্টার পিটার। ব্রাইটন শহরে ময়ূখের একমাত্র গলফ সঙ্গী এই ভদ্রলোক। দারুণ হাস্যরসাত্মক আর প্রাণোচ্ছল স্বভাবের পিটার দিন দশেক আগেই সঙ্গীহারা হয়েছেন। ময়ূখ গিয়েছিল তার সঙ্গীর কবরস্থ মুহূর্তের সাক্ষী হতে। ভদ্রলোক পুরো সময় নিস্তব্ধতা পালন করেছিলেন৷ ঘরে ফিরে এক বোতল ওয়াইন শেষ করে ময়ূখ আর অন্য নেইবারদের সাথে নিয়ে দাবা খেলেছেন মধ্যরাত অবধি। তারপর সকলকে বিদায় দিয়ে রাতভর কেঁদেছিলেন গুনগুন করে ঠিক মেয়েদের মত। প্রিয় সঙ্গীর সাথে ষাট বছর ধরে থেকেছিলেন পিটার কিন্তু বিয়ে করেননি । তারা একে অপরকে ভরসা করত, সম্মান দিতো, একে অপরের প্রয়োজন বুঝতে চেষ্টা করত এভাবেই কাটিয়ে দিয়েছে দীর্ঘ জীবনখানা৷ পিটারের ডাকে ময়ূখ হাসি বিনিময় করেছিল। পিটার জানে আজ ময়ূখ চলে যাবে নিজের দেশে তাই তাকে নিজের কাছে ডেকে বলল যাওয়ার আগে একটিবার আমার ওখানে এসো। ময়ূখ জানালো সে যাবে। পিটার গাড়ি নিয়ে চলে যেতেই ময়ূখ আবারও পা বাড়াচ্ছিল আরেকটু হাঁটবে বলে তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রীণের নামটি দেখে তৎক্ষনাৎ রিসিভ করল।

“হোয়্যার আর ইউ নাউ?”
শাইন তার গাড়ি থেকে নামতে নামতে প্রশ্নটি করল। ময়ূখ বোধহয় বুঝতে পারল শাইন তার বাড়িতেই এসেছে তাই সে বলল, “আ’ম কামিং।”

ময়ূখ একটি গাড়ি কিনেছিল ব্রাইটনে আসার আগেই। শাইনের মাধ্যমেই তার ভাল একটা জব হয়েছিল এ শহরে তাই সে লন্ডন ছাড়তে পেরেছিল সহজেই৷ মনে মনে সে কৃতজ্ঞ শাইনের প্রতি কারণ বিদেশ বিভূঁইয়ে এত অল্প সময়েই নোরার মত মেয়ের পাল্লা থেকে বের হওয়া, নিজের জন্য যোগ্যতানুযায়ী জব আর বাড়ি সম্ভব হতো না কিছুতেই৷ ময়ূখ বার কয়েক জানতে চেয়েছিল নোরাকে ছেড়ে তার জন্য কেন করছে এতোটা! শাইন জবাবে খুব বেশি কিছু বলেনি শুধু জানিয়েছে সে ডিজার্ভ করে এমন কিছুই৷ নোরা তার মেয়ে হলেও জাতীয়তাতে সে একজন ব্রিটিশ৷ তার জন্য তার মত কোয়ালিফাইড মেয়ের জন্য এখানে টিকে থাকা কোন সমস্যাই নয়। কিন্তু তোমার জন্য সবটাই মু-শ-কি-ল। শাইন এও জানিয়েছে সে হয়ত আফছারের সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারেনি তাই বলে জেনেশুনে কখনো আফছারের ক্ষতির কারণও হয়নি৷ তাই নিজের মেয়ের ভুলটা শুধরাতেই ময়ূখকে হেল্প করছে। শাইন আসার কিছু সময় পরই ময়ূখ বের হলো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। শাইন সুন্দর তিনটা প্যাকেট দিল ময়ূখকে৷ মামী বা চাচী হিসেবে কখনো কিছু দেয়নি সে ময়ূখ, মেহের বা ইরশাদকে৷ এভাবে সম্পর্কের ভাগ বাটোয়ারাও তার সংস্কৃতিতে নেই৷ কিন্তু আজ কোন এক সময় থাকা রিলেটিভের সন্তানদের জন্য গিফট দিল সে৷ একটি প্যাকেটে লেখা ইরশাদ, একটিতে ময়ূখ আর একটিতে নাম মেহেরের। ময়ূখের দেশে ফেরার কথা ছিল আর মাস কয়েক পরেই। হঠাৎ করে আব্বুর ফোন এলো পাত্র দেখছে মেহেরের জন্য , আম্মা জানালো মেহেরের বিয়েতে অবশ্যই তার ভাইদের থাকতে হবে৷ ব্যস, যা পরে করার কথা তা আগেই করছে৷ এরই মাঝে জানা গেল মেহেরের বিয়ে ঠিকও হয়ে গেছে৷ পাত্রের ছবি পাঠিয়েছে আব্বু ময়ূখ তো ছবি দেখেই অবাক। তারই ডাক্তার বন্ধু জারিফ।

“মৈত্রী আর কতক্ষণ লাগবে ময়ূখের পৌঁছাতে?”

ঘরময় পায়চারী করতে করতে ইরিন প্রশ্ন করছে। সকাল থেকে এই এক প্রশ্ন সে কম করে হলেও বিশবার জিজ্ঞেস করেছে৷ মৈত্রী এবার হেসে ফেলেছে শ্বাশুড়ির প্রশ্নে৷

“আম্মু এখনো এক রাত অর্ধেক দিন বাকি৷ ময়ূখ ভাইয়া প্লেনে উঠবে আমাদের দেশের রাত আটটায়৷ আপনি একটু চা খেয়ে হাঁটতে বের হন৷ বাবা কিন্তু আসরের নামাজের পর আর ফেরেনি হয়ত হাঁটছে।”

“আমি আজ আর হাঁটতে বের হবো না। তুমি না কাল পুড়ি খেতে চাইলে এক কাজ করো ময়দা মাখো বানাই।”

“একদম না আম্মু৷ আপনার ছেলে এসে এগুলো দেখলে আমাকে বকবে৷ কালই বলেছে ভাজাপোড়া খাওয়া বন্ধ আমাদের তিনজনেরই।”
ইরিন ছেলের বউয়ের কথা শুনে থেমে গেলেন। পুড়ি তো তিনি মৈত্রী খেতে চেয়েছে বলে নয় বরং ময়ূখের প্রিয় বলে বানাতে চেয়েছিলেন। মন অ-স্থি-র হয়ে আছে কখন ছেলেটা আসবে? ময়ূখ যেদিন টিকিট কে-টে-ছে সেদিন থেকে দিন গোনা শুরু ইরিনের৷ দিন অবশ্য মৈত্রীও গুনছে দুই দুইটা বিয়ে খাওয়ার জন্য৷ ননদের তো বিয়ে ঠিক হয়েই আছে। ময়ূখ এলেই তারা ঢাকায় যাবে মেহেরের বিয়ে খেতে। তারপরই লাগবে ময়ূখের পেছনে৷ এই দ্বায়িত্বটা অবশ্য ইরশাদ নিয়েছিল কিন্তু কি করে যেন মৈত্রী একটা মেয়ে পছন্দ করে নিলো ময়ূখের জন্য একদম ময়ূখের মতই স্বভাব যার। ইরশাদকে যখন মেয়ের ছবি আর বায়ো জানালো সে সাফ না করে দিল মৈত্রীকে। এমন চঞ্চল, পাগলাটে মেয়ে তার তার ভাইয়ের জন্য ঠিক হবে না। মৈত্রী মানতে নারাজ ; সবসময়ই মিল -অমিল দিয়ে সম্পর্ক হয় নাকি!

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে