কি ছিলে আমার পর্ব-৩৭+৩৮

0
1869

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩৭(১ম অংশ)

সফেদ কুয়াশার চাদর ভেদ করে সূর্যরশ্মি ছুঁয়ে গেছে হলদেটে মুখটাকে আদুরে স্পর্শে। সেই স্পর্শে নিভু নিভু চোখের পাতা কিছুটা সময় নিয়েই পুরোপুরি খুলতে পারল মৈত্রী। গাড়ির জানালায় মাথাটা এলিয়ে দিতে গিয়েও দিতে বাধা পেল শক্ত হাতের। পথ এখনো শেষ হয়নি! ভাবতেই চোখ ঝলসে গেল কাচরঙা রোদ্দুরে সবুজের সতেজতায়। ঘাড় ফিরিয়ে ইরশাদের হাতের ফাঁকে বাইরেটা দেখতে লাগল মুগ্ধ হয়ে। ট্যাক্সিটা চলছে উঁচু পথ ধরে আরও উঁচুতে। মৈত্রীর চোখে ধাঁধা লাগছে সে সত্যিই কি পাহাড়ি পথে আছে! আবার ফিরে তাকালো ইরশাদের দিকে৷ চওড়া আদলে সরু নাক, পুরু ঠোঁট, ঘুমন্ত চোখের পাতায় রোদ এসে মিলিয়ে যাচ্ছে আলতো করে। মানুষটা শেষ রাতেও সজাগ ছিল মৈত্রীকে বাহুতে ধরে। আধো ঘুম আধো জাগরণে সে টের পেয়েছে সবটাই তবুও দূরের জার্নি তার স-হ্য হয়না বলেই মটকা মে-রে পড়েছিল মানুষটার বুকে, কাঁধে। ভয় ছিল এই বুঝি বমি হবে, এই বুঝি মাথা ঘুরিয়ে জ্ঞান হারাবে কিন্তু না তেমন কিছুই হয়নি৷ উল্টো এখন জেগে প্রকৃতির খোলসহীন রূপ দেখতেই সকল ক্লান্তি ফুরফুর করে পালিয়ে গেল কোথাও।

“স্যার চলে এসেছি এটাই রিশাদ স্যারের বাড়ি।”

ড্রাইভারের ডাকে মৈত্রী নড়েচড়ে উঠলো। ইরশাদের বুকে হাত রেখে আলতো ঝাকিয়ে ডেকে তুলল ইরশাদকে। দুজনে গাড়ি থেকে বের হতেই লোহার গেইটের বাইরেই একজন মোটামুটি বয়স্ক লোককে দেখতে পেল তারা। ড্রাইভার ততক্ষণে গাড়ি থেকে ব্যাগপত্র নামিয়ে রাখলো। ইরশাদ এগিয়ে এসে গেইটে ধাক্কা দিতেই লোকটি জানতে চাইলো সে গেইট ধাক্কাচ্ছে কেন?

“আমি ইরশাদ রাজশাহী থেকে এসেছি।রিশাদ রায়হানের বাড়িই তো এটা?”

ইরশাদের প্রশ্ন শেষ হতেই ড্রাইভার এগিয়ে এসে নিজেই বলল, “স্যারের আত্মীয় এনারা। এখানে থাকবেন কিছুদিন মালপত্র ভিতরে নিন।”

দারোয়ান এবং ড্রাইভার দুজনই একে অপরের পরিচিত এবং ইরশাদদের বাস স্টপেজে তাদের জন্য রিশাদই নিজের ড্রাইভারকে পাঠিয়েছিল। রিশাদ নিজে অ-সু-স্থ সেই সাথে বোনের বাচ্চা হয়েছে, তার স্ত্রী মেবিশেরও মায়ের কাছে থাকার ইচ্ছে সব মিলিয়ে তাকে আরও দু তিন দিন ঢাকায় থাকতে হচ্ছে। তার যাতায়াত প্লেনে হওয়ায় গাড়িটি নিতে হয়নি৷

দারোয়ান আর ড্রাইভারের কথোপকথনের পর দুজনকে ভেতরে নেওয়া হলো। মিনিট কয়েকের মাঝেই ঘর খুলে দেওয়া হলো সবগুলোই। দারোয়ান নিজেই একজন পাহাড়ি ছেলেকে ডেকে তার বোনকে নিয়ে আসতে বলল। আনতুং পাহাড়ি নারী সে-ই বাড়ির নিয়মিত পরিচ্ছন্নতার কাজ করত আজ মেহমান এসেছে শুনে চলে এলো তাদের প্রয়োজনেই।

পাহাড়ের গায়ে শুভ্ররঙা একতলা বাড়ি। চারপাশে ফুলের গাছ, পেছনের দিকটায় বিশাল খা-দ। আনতুং মেহমানদের জন্য দ্রুতই বাজারের লিস্ট তৈরি করল। রিশাদ স্যাররা এখানে থাকেন না বছর পেরিয়ে গেছে তবে স্যার প্রায়ই আসত। কিন্তু এখানে থাকতেন না বলে বাজার সদাই কিছুই রাখা হয় না। আনতুং অবশ্য মেবিশ মেডামের ফোনকল পেয়েছে কোন এক আত্মীয় নাকি বউ নিয়ে আসবে। সে শুনেছে যারা আসবে তারা নতুন বিবাহিত দম্পতি তাই বুঝতে বাকি নেই তারা নিরিবিলি জায়গায় কেন এসেছে। ইরশাদরা ঘরগুলো একে একে ভেতরে গিয়ে দেখছিল তখন আনতুং তাদের পাশে। করিডোরের মাঝামাঝি যে ঘরটা সেটাতে ঢুকতেই চোখে পড়ল খাটের পেছনে ওয়াল জুড়ে খুব বড় আকৃতির একটা ফটো। ফটোতে রিশাদ বসে আছে বালুর ওপর কোলের ওপর নির্জন আর তার পেছন থেকে কাঁধের উপর উঁকি দেওয়া মেহউইশের মুখটা। পেছনে বিশাল সমুদ্র আর অসীম আকাশ সব মিলিয়ে প্রকৃতির অনিন্দ্য সুন্দরে ভরা একটি ফ্যামিলি ফটো। মৈত্রী অবাক হয়ে বলল, “এটা আপনার কাজিন আর তার বউ?”

“হু তাইতো মনে হচ্ছে।”

“কি!”

“রিশাদ ভাইয়ের বউ-ই মনে হচ্ছে।”

“মনে হবে কেন আপনি চেনেন না আপনার কাজিনের বউকে!” মৈত্রী ভীষণ অবাক হলো। ভাবল পাশে থাকা আনতুংকে জিজ্ঞেস করবে কিন্তু না মহিলা বেরিয়ে গেছে আগেই। ইরশাদ বুঝতে পারলো তার স্ত্রীর বিষ্মিত অভিব্যক্তি তাই একটু পরিষ্কার করতেই বলল, “ভাইয়ের প্রথম স্ত্রীকে চিনতাম ওই যে বলেছিলাম সেদিন প্রেমিকের সাথে ভেগেছে!” মনে করিয়ে দেবার মত করে বলল ইরশাদ। তারপরই বলল, “ইনি সম্ভবত মেবিশবাসী ভাই পরে যাকে বিয়ে করল।”

“ভাইয়া আর ভাবী কিন্তু অন্নেক সুন্দর ৷ দুজনকেই একদম পার্ফেক্ট কাপল মনে হচ্ছে। কি চমৎকার করে হাসছে ভাবি আর ভাইয়ার ফিটনেস দেখে তো মনেই হচ্ছে না ইনি আপনার বড়।”

মৈত্রী তার স্বভাবসুলভ আচরণের বাইরে এসে যেন প্রশংসা করল ফটোর কাপল দুটোর। ইরশাদ ভ্রু জোড়া বক্র করে তাকালো মৈত্রীর দিকে।

“বাই এনি চান্স তুমি কি আমাকে বুড়ো বললে?”

মৈত্রীর থতমত খেয়ে গেল, “ককখন!”

“মাত্রই বললে। রিশাদ ভাই থার্টি প্লাস আর আমি আটাশ প্লাস। তোমার কথা শুনে মনে হলো ভাইকে কচি লাগছে আর আমাকে দেখতে একদম পঞ্চাশের আধবুড়া লাগছে।” আপত্তি তুলতেই যেন কথাটা বলল ইরশাদ। তারপরই মনে হলো বউকে একটু ক্ষে-পা-তে পারলে ভালো হয় তাই ফট করে বলে ফেলল, “তবে যাই বলো তারা কাপল কিন্তু দারুণ। নির্জনের আম্মু পালিয়ে না গেলে এত কিউট ভাবী পাওয়া হতো না। ইশ কি যে গলুমলু লাগছে ভাবীকে! ভাবীর চোখ আর গালদুটো…. ” কথা সম্পূর্ণ করার আগেই মৈত্রী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।

“এ্যাই মৈত্রী কোথায় যাচ্ছো?”

“এ ঘরে থাকব না৷ ওপাশে রান্নাঘরের পাশেরটাতে থাকব আমি।”

বউ ক্ষেপেছে ; এখন আর চাইলেও ফাজলামো চলবে না তাই ইরশাদও ব্যাগ নিয়ে চলে গেল পাশের ঘরটায়। ভোরের আলোয় চারপাশ ধুয়েমুছে চকচকে হয়ে উঠেছে তবুও গাছের ডালের ফাঁকফোকরে এখনও কুয়াশার অস্তিত্ব৷ মৈত্রী রুমে ঢুকে পরিপাটি বিছানা দেখতেই গায়ের জ্যাকেট খুলে বিছানায় শুয়ে পড়ল। রাতের জার্নিতে ঘুম হলেও শরীরে একটা ম্যাজম্যাজে ভাব। ইরশাদও তাই গায়ের শার্ট,ব্লেজার খুলে টি শার্ট পরল। বাইরে এসে দারোয়ানকে ডেকে জানিয়ে দিলো তারা একটু রেস্ট করবে। আনতুং এলে বাজারসদাই রেখে যায়। রান্নাটা তারা নিজেই করবে। ইরশাদও এবার রুমে ঢুকতে যাচ্ছিল অন্য ঘরগুলো খুলে রাখা তাই নিজ দ্বায়িত্বে সেগুলো লক করে রুমে এসে মৈত্রীর পাশে শুয়ে পড়ল।

ভালোবাসা না থাকলেও সম্পর্কের দোহাই দিয়েই মনুষ্যজাতি এক্সপেক্টেশন রাখতে পছন্দ করে। প্রিয় মানুষ না কাছের আর আপন মানুষের কাছ থেকেও প্রায়োরিটি পাওয়ার এক তীব্র আকাঙ্খা কেবল মানুষই রাখতে জানে। আর তার দায়ভার সম্পূর্ণ মানুষের ভেতরকার মনটার। ময়ূখের যেখানে শেষরাতে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল সেখানে পৌঁছুলো ঠিক আট ঘন্টা লেট। ট্রানজিটে লাগা বাড়তি সময়ের জন্যই এত বিলম্ব হওয়া। তবুও সে সোশ্যাল নেটওয়ার্কির বদৌলত নোরাকে জানানো হয়েছিল সেটা কিন্তু মেয়েটা আসেনি এয়ারপোর্টে। ময়ূখের কাছে নোরার এড্রেস আছে, আছে নোরার মা শাইনের ঠিকানাও। চাইলেই সে ট্যাক্সি করে চলে যেতে পারে তবুও অবচেতন মন খুঁজছে নোরাকে। কিছু সময় চুপচাপ সে ব্যাগপ্যাক এ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল একই জায়গায় স্থির হয়ে তারপরই মনে হলো এই দাঁড়িয়ে থাকা, নোরার অপেক্ষা করা অযথা। সে যখন জানিয়েছিল ট্রানজিট টাইম তখন নোরা বলল, ” হোয়াট! ইট’স টু লেট ময়ূখ এন্ড দ্যাট টাইম আই হ্যাভ আ ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস৷”

ময়ূখ জবাব ‘ওহ’ বলতেই নোরা বলে দিল এড্রেস তো আছেই তুমি ট্যাক্সি করে চলে আসো। তোমার কাছে পাউন্ডস আছে নিশ্চয়ই!

কারেন্সি চেঞ্জ করাই আছে তার কাছে, এড্রেসও আছে তবুও মন চাইছিল যার জন্য আসা সেই না হয় নিয়ে যেত! কিছুটা সময় মিথ্যে অপেক্ষায় সময় কা-টে এরপরই ময়ূখ এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ডাকে। ফোন বের করে হোয়াটসঅ্যাপ থাকা লোকেশন বলল৷ হঠাৎই পেছন থেকে ভেসে এলো পরিচিত কণ্ঠ, “ময়ূখ!”

কণ্ঠটা ঠিক ঠিক শুনে কেমন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ালো ময়ূখ। পেছনে ফিরে দেখার ইচ্ছে হচ্ছে না তাই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। নোরা নিজেই এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখলো৷ এবার আর কাল বিলম্ব না করে ফিরে তাকায় ময়ূখ। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে নোরা জাপটে ধরে ময়ূখকে। নির্বিঘ্নে ঠোঁটে চুমু খেল। এক, দুই করে কে-টে গেছে কয়েক সেকেন্ড কিংবা মিনিট খানেক সময়। দুজনের সেই লম্বা চুমুতে বিরতি পড়লো ট্যাক্সি ড্রাইভারের ডাকে। ময়ূখ কিছু বলার আগে নোরাই ট্যাক্সিওয়ালাকে না করে দিল। নোরার নিজের গাড়ি আছে তাতে করেই দুজন রওনা হলো নোরার ফ্ল্যাটে।

চলবে

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩৭ (২য় অংশ)(১৮+ সতর্কতা)

ঝকঝকে লন্ডনের আকাশে কোথাও যেন এক ফোঁটা মেঘের বাস নেই। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে উঠেই নোরা উৎফুল্ল হয়ে বলল, “চেক ব্যাক সিট।”

ময়ূখ সবে সিট বেল্ট বেঁধেছিল। নোরার কথায় ‘হু!’ বলে পেছনে তাকালো। চমৎকার সাদা আর কমলা রঙের এক গুচ্ছ তাজা, সতেজ টিউলিপ। ময়ূখের চোখ হেসে উঠল লম্বা সফরের ক্লান্তি ভুলে। হাত বাড়িয়ে পেছন থেকে ফুলগুলো নিয়ে চুমু খেলো আলতো স্পর্শে। ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে নোরা সেটা দেখেই হেসে ফেলল, ” এই চুমুটা তো উপহারদাত্রীর পাওনা তাইনা!”

“সে তো আগেই নিয়ে নিয়েছে নিজেরটা।”

নোরা এবার সশব্দে হেসে উঠলো। গাড়ি চলছে সাথে চলছে দুজনের মধ্যে কথপোকথন বাড়ির সবাই কে কেমন আছে এ নিয়ে৷ কথার মাঝেই তারা পৌঁছে গেছে গন্তব্যে। নোরা গাড়ি পার্কিংয়ে নিয়েই থামাল। ব্যাগপত্র আর ময়ূখকে নিয়ে এগিয়ে গেল লিফটের দিকে ততক্ষণে ময়ূখ আশপাশটা দেখে নিয়েছে। ঝকঝকে সুন্দর লন, কার পার্কিং আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস হলো পার্কিংয়ের বিপরীতে থাকা লম্বাটে করে লাগানো কয়েক রকম ফার্ন গাছ আর বেগুনিরঙা অর্কিড। মনোমুগ্ধকর এই ফুল বাহারি জায়গাটুকু ময়ূখের ভীষণ ভাল লাগল এবং এই প্রথম সে এমন গাছ লতাপাতাতে আকৃ-ষ্ট হল। নোরাদের এপার্টমেন্টটা আটতলা আর নোরার ফ্ল্যাট পাঁচতলায়। এলিভেটরে উঠে দুজনে নিঃশব্দে কয়েক সেকেন্ড কা-টা-তেই নোরা চোখে চোখ রেখে কিছু বলল। ময়ূখ চোখের ভাষায় আনাড়ি তবুও যেন বুঝলো তার স্ত্রীর আবেদন। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে মুখোমুখি হলো। সময় ব্যয় না করে একটুখানি ঝুঁকে এলো নোরার দিকে সেকেন্ড অতিক্রম হতেই নোরা দু হাতে গলা জড়িয়ে ধরল ময়ূখের। ঠোঁটের ছোঁয়ায় আদিম উন্মাদনায় ছেয়ে গেল দুজনের দেহ মন। লিফট যখন পঞ্চম তলায় থামলো তখন নোরার হুঁশ ফিরলো ময়ূখের ছিটকে পড়ায়। প্রিয় মানুষের প্রতি যে আ-স-ক্তি প্রেম থেকে তৈরি হয় তার রেশ হয় তিরতিরিয়ে বয়ে যাওয়া কোমল হাওয়ার মত কিন্তু যে আসক্তির শুরুটা কোন বাধ্যবাধকতা কিংবা দৈ-হি-ক চাহিদা থেকে তৈরি তা বোধহয় উগ্র উদাসীন হয়। ময়ূখের অন্তত তেমনটাই মনে হচ্ছে। এই যে, নোরার সাথে মিট করতেই ঠোঁটচুমু খেলো মেয়েটা তাতে ময়ূখের ভালো লাগলেও আলাদা কোন আবেগী অনুভূতির টান নেই। প্রথমবার দৈ-হি-ক মিলনমুহূর্তেও ঠিক এমনটাই হয়েছে৷ নোরা কাছে টেনেছে সেও গেছে খুব কাছে যতোটা গেলে দেহ তৃপ্ত হয়, মস্তিষ্কের উ-ত্তে-জিত নিউরন শীতল হয় ঠিক ততোটাই৷ এখন লিফটের এই সময়টুকুও তার কাছে সেই তৃপ্ততার বাইরে কিছু কি! হয়তো না, বিপরীত জেন্ডারের আবেদন ফেলতে পারা মু-শকি-ল তাই উপেক্ষার চেয়ে টেনে নেওয়াটাই যেন সহজবোধ্য ছিল। লিফট থেকে বেরিয়ে নোরার ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়লো দুজন। বড় একটা অংশ জুড়ে ড্রয়িংরুম, একপাশে কিচেন লাগোয়া ডাইনিং আর দুটো রুম একটা বাথরুম। শুভ্র সাদা দেয়াল জুড়ে বর্গাকৃতির এক পেইন্টিং তার ঠিক নিচে সোফা, পাশেই চমৎকার কিছু ইনডোর প্লান্টস সাজানো৷ একপাশের দেয়াল সম্পূর্ণ কাঁচ-ঘেরা হওয়ায় উপরে খোলা আকাশ নিচের দিকে সরু পথের দৃশ্য স্পষ্ট৷ ময়ূখ দু চার পলকেই পুরো ফ্ল্যাটটাকে দেখে নিলো। মন্দ নয় দুজন মানুষের জন্য এমন একটা ফ্ল্যাট তবুও তার কেমন দ-ম-ব-ন্ধ লাগল৷ এখানে তার পরিচিত বাতাস আর বাতাসে মিশে থাকা অক্সিজেন নেই৷ পরিচিত, আপন মানুষগুলোও কেউ নেই পাশে এক নোরা ছাড়া৷ নোরা কি তার আপন মানুষ! এ ব্যাপারে বোধহয় ময়ূখ পুরোপুরি দ্বিধান্বিত। নোরাও বুঝতে পারলো ময়ূখের অবস্থা তবুও ক্লান্ত ময়ূখকে বলার মত কিছু খুঁজে পেলো না সে৷ আজ সে ক্লাসে যায়নি, প্রফেসরের সাথে দেখা করার কথা থাকলেও সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে না৷ নোরা তার বেডরুমটায় নিয়ে গেল ময়ূখকে৷ আজ থেকে সেটা ময়ূখেরও বেডরুম হলো৷ কিং সাইজ বেডরুম যার চারদিক সফেদ রঙের দেয়াল৷ বেডের মাথার দিকে বড় এক ফটো আছে নোরার। কোন এক পড়ন্ত বিকেলে পা মেলে বিচে বসা। ছবিতে গায়ের পোশাকটি নামমাত্র বলা যায়। ময়ূখের সেদিকে আর দৃষ্টি রইলো না বাকি তিন দেয়ালের একটি জুড়ে দেয়ালসম ক্লোথ কেবিনেট তা দেখেই বোঝা গেল। বাকি দু দেয়ালের একটি দরজা আর তার পাশেই ছোট্ট লাগোয়া বুক শেলফ যেখানে মাত্র তিনটি ছোট্ট খোপ। তাতে বইয়ের সংখ্যা হাতে গুণে পাঁচটি। অন্য দেয়ালটি সম্পূর্ণ ফাঁকা সে পাশে উইন্ডো আছে বলেই হয়ত। ময়ূখ চারপাশে নজর বুলিয়ে এবার বিছানায় বসে গায়ের কোটটা খুলে ফেলল। বাইরে ওয়েদার যতোটা শীতল ফ্ল্যাটের ভেতর ঠিক ততোটাই যেন উষ্ণ। নোরাও ঝটপট কিচেনে ঢুকে কফি মেকারে কফি করে নিয়ে এলো এক মগ৷ তার গায়েও একটু আগে ছিল ট্রেঞ্চ কোট এখন খেয়াল করলো ময়ূখ মেয়েটা কোট খোলার পর দেখা যাচ্ছে সাদা শার্ট ওপর থেকে কয়েকটা বোতাম খোলা। পুরুষ দৃষ্টিকে আকর্ষিত করতে এই এতটুকু বুক দেখানো পোশাক নিঃসন্দেহে যথেষ্ট বলা যায়। নোরার দৈহিক গঠন আর আধুনিক পোশাক সত্যিই নজর কাড়বে পুরুষদের ময়ূখেরও কাড়ল। সে চাইল সংযত থাকতে কিন্তু মেয়েটা কি তাকে থাকতে দেবে! নাহ, নোরা চাইছে অন্যকিছু তাই বুঝি কফি মগটা নিয়ে বসল ময়ূখেরই গা ঘেঁষে। নিজেই কফিটা মুখের কাছে ধরলো তার। স্ত্রীর আদুরে আচরণ কোন পুরুষেরই বোধহয় অগ্রাহ্য করার শক্তি থাকে না। প্রথম সিপেই ময়ূখ ক্লান্তিক-র সময়টাকে সতেজ অনুভব করল। পরের সিপ দেওয়ার আগেই সে নিজ নারীটির স্তনের স্প-র্শ টের পেল বাহুতে। ধীরে ধীরে ঠোঁটের স্পর্শও পেল ঘাড়, গলা বুকের মাঝে৷ এই স্পর্শের আধিক্য যত বাড়ছে ততোই ময়ূখ রক্তচ্ছ্বাস, উত্তেজনাও টের পাচ্ছে নিজের মাঝে। হুট করেই সে নোরাকে সরিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।

“আই নিড হট শাওয়ার” কথাটা বলেই ময়ূখ এদিক সেদিক তাকালো যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস খুঁজছে সে। নোরাও তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে গেল মুখোমুখি, “বাট আই ওয়ান্না কিস ইউ সো ব্যাড নাউ ।”

“লেট মি শাওয়ার ফার্স্ট দ্যান….”

ময়ূখ কথাটা শেষ করার আগেই নোরা দু হাতে জাপটে ধরে চুমু খেতে শুরু করল। সে চুমুতে উইয়ার্ড কোন ফিলিংস ছিল ময়ূখ উপেক্ষা করতে পারল না।

সূর্য ঢলেছে পশ্চিমে; কুয়াশারা দল বেঁধে দক্ষিণ থেকে উত্তরে, পশ্চিম থেকে পূর্বে ওড়ে ওড়ে এসে বসছে গাছের ডালে, পাতার ফাঁকে। পাহাড়ের চকচকে দিন অস্তমিত এখন রাতের চাদর নামবে বলে। ইরশাদ মৈত্রীর সারাটা দিন কে-টে গেল খাবার খেয়ে, ঘুমিয়ে আর বাড়িটির ফুলেল লনের পাশে মাদুর বিছিয়ে। দারোয়ানটা নাকি তাদের থাকার কয়েকটা দিন শুধু দিনেই থাকবে গেইটে রাতটা কাটাবে নিজের বাড়িতে এটাই ছিল রিশাদের আজ্ঞা। বাড়ি দূরে নয় দারোয়ান কিংবা পাহাড়ি ছেলে উকাচুংয়ের তাই সকল প্রয়োজনে গেইটে দাঁড়িয়ে হাঁক ছাড়লেই নাকি তারা চলে আসবে। মৈত্রী অবশ্য শুনে প্রথমেই আপত্তি করল এই নির্জন বাড়িতে তারা একা থাকবে বলে। ইরশাদ বোঝালো এখানে কোন সমস্যা নেই রিশাদ ভাই জেনেশুনেই তাদের এমন একলা ছাড়ল। হানিমুন যদি লোক সমাগমেই করবে তবে এই পাহাড়ে আসার কি দরকার ছিল! এ কথার প্রেক্ষিতে মৈত্রী আর কিছুই বলেনি৷ পাহাড়ে আঁধার যেন সমতলের আগেই নামল বলে মনে হলো মৈত্রীর৷ সে রাতের জন্য কি করবে জানতে চাইলে ইরশাদ বারণ করল, “কিছু করতে হবে না।”
“রাতে খাব না?”

“অবশ্যই খাব।”

“কি?”

“দুজন দুজনাকে ” কথাটা শেষ করেই হো হো করে হেসে উঠল ইরশাদ। মৈত্রী বিড়বিড় করল, “দিনকে দিন অসভ্য হয়ে উঠছেন আপনি।”

“রাতের জন্য খিচুড়ি করব আমি তোমাকে কিছু করতে হবে না।”

“কেন!” ভীষণ অবাক হলো মৈত্রী। ইরশাদ রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, “তুমি শুধু সেজেগুজে বসে থাকো আমার পাশে। মধুচন্দ্রিমা করতে এসে বউকে দিয়ে রান্না করানো ঠিক নয় এতে রোম্যান্সে বিঘ্ন ঘটতে পারে।”

“কিসব যাচ্ছেতাই কথা। আচ্ছা আমরা কাল ঘুরতে বেরবো না!”

“নিশ্চয়ই ম্যাম৷ ভোরেই উঠে দক্ষিণের পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে সূর্যদয় দেখব। রিশাদ ভাই বলল সে পাহাড়ে বুনো ফুলের সম্রাজ্য আছে৷ আর নাশতার পর আমরা ওপাশে ওই যে ছেলেটা এলো দুপুরে উকাচুং তাদের পাড়ায় ঘুরতে যাব। আপাতত প্ল্যান এইটুকুই বাকিটা কাল ঠিক করব।” কথা বলতে বলতে ইরশাদ রান্নাঘরের কেবিনেট খুঁজে খুঁজে হাঁড়িপাতিল, বোল নামালো। এ বাড়িতে বাজারসদাই বলতে কিছুই ছিল না কেউ থাকে না বলেই। আনতুংকে দিয়ে যে বাজার করিয়েছে সবটাই সামনে রাখা সেগুলো দেখে নিয়ে ইরশাদ প্রথমেই বোলে মুরগিটা রাখল৷ ভাগ্যিস এ বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি, ফ্রিজ সবটাই আছে। মশলাপাতিও একে একে সবটা দেখে নিয়ে রান্নার কাজ শুরু করলো ইরশাদ৷ মৈত্রী বার দুয়েক চেষ্টা করল কাজে সাহায্য করতে কিন্তু তার পতি মহোদয় পাকা রাঁধুনির মত একা হাতে সবটা করতে করতেই পত্নীকে তাড়া দিলো সেজেগুজে তৈরি হতে৷ তবে এই তাড়ার মাঝেই সতর্কতা জারি করল, লিপস্টিক দেওয়া বারণ বলে৷ মৈত্রীর ভালোলাগায় মন ফুরফুরে হয়ে গেল। খুব ভাগ্য করে মানুষটাকে পেয়েছে সে৷ এ জীবনে সকল চাওয়া নিয়ে উপরওয়ালার ওপর সে যতবেশি অভিযোগ করেছে সবটা যেন এক বারেই পুষিয়ে দিল আল্লাহ্ তায়ালা। কোথাও কোন কমতি রাখেননি তার জীবনে। একটা চাওয়ার মাঝেই সকল পাওয়ার প্রাপ্তি দিলেন। মৈত্রীও চলে গেল ঘরে। লাগেজ খুলে বেছে বেছে সুতির মাঝে সুতার কাজ করা শাড়ি বের করে নিলো একটা৷ ইরশাদ বলেছিল পাহাড়ে যাব শাড়ি, কামিজ এগুলো লাগবে না। তবুও মৈত্রী জোর করেই দুটো শাড়ি নিয়েছিল৷ এখন মনে হচ্ছে শাড়ি আনাটাই তার করা চমৎকার কাজ ছিল। হিম হিম কুয়াশা ওড়ে ওড়ে জমাট বেঁধেছে যেন রিশাদেরই বাড়িটা জুড়ে। ইরশাদ আগুনের পাশে থেকেও টের পাচ্ছে শীতল হাওয়ায় কাঁপন লাগা৷ খিচুড়ি আর ঝাল করে রান্না মাংস দু চুলোয় দুটো বসিয়ে দিয়ে শশা, লেবু কেটে নিলো। কাজের ফাঁকেই একবার ঘরে ঢুকে দেখে এলো মৈত্রী কি করছে তারপর গিয়ে বাইরেটাও দেখলো। গেইটের তালাও ঠিকঠাক লাগানো কিনা দেখে এলো৷ রান্না প্রায় শেষ হয়ে এলেও যখন মৈত্রী এলো না বেরিয়ে তখন ইরশাদ ভাবলো শীতে হয়তো মেয়েটা কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়েছে। পুরো রান্না শেষ করে সব গুছিয়ে সে মৈত্রীকে ডাকতে গেল৷

সাদার মাঝে খয়েরির মিশ্রণের শাড়ির ওপর টকটকে লাল শাল পেঁচিয়ে বিছানা ঝাড়ছে মৈত্রী৷

“বিছানা এখনই কেন গুছিয়ে নিচ্ছো?”

” কাজ কমিয়ে রাখছি যেন পরে আর করতে না হয়।”

“আচ্ছা! চলো রান্না শেষ।”

“কোথায় যাব?”

“ডাইনিং টেবিলে।”

“উহুম ওই খোলা ডাইনিংয়ে খাব না।”

ইরশাদ বাঁকা চোখে তাকালো৷ চোখ কাজল কালো, ঠোঁটেও গাঢ় লিপস্টিক। কত করে বলল লিপস্টিক লাগাবে না তবুও শুনলো না! চুলগুলো হাত খোঁপায় পড়ে আছে কাঁধের ওপর৷ অতি চেনা মৈত্রীর মুখশ্রীতে আজ কিছু একটা ভিন্ন চোখে পড়ছে কি! এক মুহূর্ত ভেবে কিছুই ভিন্ন খুঁজে পেল না তবুও মনে হল আজ কোথাও কিছু ভিন্নতা আছে।

“এখানে খাবে!” জানতে চাইলো নাকি শুধাল ঠিক নিজেই বুঝল না। মৈত্রীই এবার বলে দিল, “বাইরে বসব লনের ফাঁকা জায়গায়, আগুন জ্বালিয়ে, মাদুর বিছিয়ে খোলা আকাশের নিচে।”

“ওহহ ম্যাম আগে বলবেন তো!”

“এখন বললাম তো!”

“আচ্ছা জ্বী” কথাটা টেনে টেনে বলল ইরশাদ। তারপরই সে আবার গেল রান্নাঘরে সেখানে জমা করা লাকড়ি আছে, কেরোসিনের বোতলও ছিল হয়ত রিশাদরাও সেখানে শীতের আমেজ উপভোগের আয়োজন করত! ইরশাদ সত্যিই ব্যবস্থা করল আগুন জ্বালানোর, মাদুর বিছিয়ে খাবার সাজিয়ে মৈত্রীকে বসিয়ে নিজেও বসল। চমৎকার এই আয়োজনকে স্মৃতির পাতায় বেঁধে রাখতে ফোন বের করে কিছু ছবিও নিলো নিজেদের। মৈত্রীর কিছু একক ছবিও তুলে দিলো জোর করেই। এক পাশে আগুন অন্যপাশে তার সামনেই খাবার সাজিয়ে রাখা। ইরশাদ এ রাতের আয়োজনের একটা নাম দিল, উডফায়ার ডিনার। লোকে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করে সে তার স্মৃতিকে নিয়ে করছে কাঠের আগুনের আলোয় ডিনার। তবে শুধুই কাঠের আগুনে ডিনার করতে গিয়ে বুঝতে পারল জংলা পোকামাকড় সব তাদের খাবারের আশপাশে ওড়ে ওড়ে ঘুরছে৷ সাধের খাবার বেশিদূর খাওয়া হলো না এই খোলা আসমানকে সাক্ষী রেখে তাই দ্রুত হাতে কিছুটা খেয়েই সব গুছিয়ে নিয়ে রাখতে হলো ঘরে৷ তাড়াহুড়ায় সব নিয়ে ঘরে ঢুকতেই চোখাচোখি হলো দুজনে তাতেই মৈত্রী হেসে ফেলল। ইরশাদের লাগল খুব সে হাসি তাই শাস্তিস্বরূপ মৈত্রীকে নিয়ে আবারও বসল বাইরে। না এবার আর খাওয়াদাওয়া নয় পাশাপাশি বসে নির্জনতা ছাপিয়ে বন পাহাড়ের ঝিঁঝি আর বন্যপাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ শোনাই যেন উদ্দেশ্য ছিল। ইরশাদ বসেছিল পেছনে দু হাত রেখে মাটিতে ভর দিয়ে। তার সামনেই বসা মৈত্রী তারই বুকে পিঠ এলিয়ে। হিম বাতাসে বুনো ঘ্রাণ সাথে বুঝি মৈত্রীর চুলের শ্যাম্পুর সুবাস মিশে গেল৷ মিশ্র অথচ মিষ্টি সে সুবাস ইরশাদের বুকের ভেতর উষ্ণতা মিশিয়ে দিল তীব্র শীতের মাঝেই। মৈত্রীর গায়ের শাল সরে গেছে বাহু আর কোমর ছাড়িয়ে। শীতে গায়ে কাঁ-টা দিচ্ছে, থেকে থেকে কাঁপন তুলছে৷ ইরশাদ কি টের পেল সেই কাঁপুনি! পুরুষালি শ-ক্তপো-ক্ত একটা হাত আলগোছে উঠে এলো মৈত্রীর পেটের কাছে। খোলা অংশ আলতো ছুঁয়ে ছুঁয়ে আদর দিল। অন্যহাত ঘাড় টেনে নিয়ে এলো মুখের কাছে ঠোঁটের পাশে৷ “বলেছিলাম লিপস্টিক দিও না শুনলে নাতো এবার এগুলো আমি খেয়ে ফেলব” বলেই সে চুমু খেলো উগ্রভাবে। মুহূর্ত কয়েকের ব্যবধানে ঢেউ খেলল দেহ থেকে দেহে ঠোঁটের স্বাদে মত্ত হলো মানুষদুটো৷ কোন এক সময় তাদের আদিম নেশায় পেয়ে বসলো, সাঙ্গ হলো অগ্নিউৎসব। এরপর আর থাকা চলে না ঘরের বাইরে৷ ইরশাদও দু হাতে তুলে কোলে নিলো অর্ধাঙ্গিনীকে। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো না, বাতি নেভানোর প্রয়োজনও বোধ করল সে! উহুম, নেশায় পাওয়া মানুষের হুঁশ থাকে না। তীব্র শীতের রাত, নির্জনতার আব্রু যখন পাহাড়ঘেরা তখন আর হুঁশ থাকার নয় কোন কপোত-কপোতীর। সময় তখন তাদের নিরাবরণের উন্মাদনায় মত্ত হয়ে পেরুতে থাকে আপনগতিতে।

চলবে

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩৮

দক্ষিণ দিকের পাহাড়ের উচ্চতা যেন আকাশ ছুঁয়েছে দূর থেকে তেমনটাই মনে হয়েছিল। যত এগিয়ে উপরে উঠা যায় ততোই যেন আকাশটাও উঁচু হয়ে যাচ্ছে। ঘুম ভেঙে গরম পানিতে গোসলের পর মাত্র কয়েক মিনিটেই শরীর যেন অসাড় হয়ে এসেছিল মৈত্রীর। ভাগ্যিস রাতের জ্বালানো আগুনের অংশটাতে ইটের ঘেরার বাইরের কাঠগুলো ইরশাদ ঢেকে রেখেছিল। তাই ভোরেই আবার সেগুলো জ্বালিয়ে কিছু সময় আগুন পোহালো মৈত্রী। ইরশাদ গোসল শেষে বাইরে এসে তাড়া দিল দ্রুত তৈরি হতে তারা হাঁটতে বেরুবে। মৈত্রীর তখন মনে হলো এ ধরায় সবচেয়ে শীতল ভূমি এই পাহাড়টাই । তখনো আকাশে আঁধার কাটেনি ভোরের আগ মুহূর্ত৷ ইরশাদের জন্য তার রাতে ঘুম হয়নি আর না এই রাত শেষের সময়টাতে। ইরশাদ বুঝতে পারলো মৈত্রীর অবস্থাটা তাই টেনে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। আগেই সে জিন্স, শার্ট আর তার ওপর হুডি পরা ছিল ইরশাদ এবার নিজের মতই যে কেডস জোড়া এনেছিল তা বের করে দিল। মৈত্রী কিনতে চায়নি এগুলো ইরশাদই বলেছে পাহাড়ে চলতে এগুলোই কাজে দেবে। হাত মোজা, কেডস, হুডি কিছুই বাদ পড়েনি দুজনার। তৈরি হয়ে মৈত্রী আয়নায় তাকিয়েছিল৷ তার পাশে দাঁড়ানো ইরশাদকে দেখে আনমনেই সে হিংসুক হয়ে উঠল। লোকটা এত পরিপাটি, এত আধুনিক আর এতোটাই সুদর্শন মৈত্রীর মন খা-রা-প হয় তাকে দেখলে। একটা পুরুষ মানুষ এতবেশি নিঁখুত কেন হবে? কেন তার কোন ত্রুটি পাওয়া মু-শ-কি-ল হবে! মৈত্রীর ভাবনা বিস্তর হওয়ার আগেই ইরশাদ তাকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল ভোর ভ্রমণে৷ আঁধার কে-টে ভোর হয়, রক্তিম আকাশের শুভ্র হওয়া সবটাই দুজন মিলে দেখার যে অনুভূতি সবটাই মৈত্রীর উপভোগ করার সুযোগ হয়। মনে মনে সে অসংখ্য ধন্যবাদ জানায় ইরশাদকে এত চমৎকার মুহূর্তগুলোর সাক্ষী করার জন্য। পাহাড়ের উঁচুতে চড়তে গিয়ে টের পায় মৈত্রী তার হাঁটু আর কোমর একেবারেই যেন নড়ে যাচ্ছে জায়গা থেকে বোধহয় প্রথমবার এমন পথে চলছে বলে কিন্তু ভালো লাগছে এই চলা। মৈত্রীর ধারণা ছিল পাহাড় মানেই এবড়োখেবড়ো সুঁড়িপথ যেখানে পা ফেলতে প্রয়োজন হবে লাঠি, ট্র্যাকিং করার জুতো আরও কত কি! কিন্তু এ পথ তো মাটি কে-টে তৈরি করা সমান তালে নিচ থেকে উপরে উঠেছে। চারপাশে যে ঝোপজঙ্গল তার কল্পনায় ছিল এখানে পুরোপুরি তেমনটা নয়। কোথাও লতায়পাতায় ঘেরা কোথাও বা বড় বড় গাছ। কা-টাগুল্ম, রঙ বাহারি জংলি ফুল সবই আছে এখানটায়। পথ চলতে চলতে দুজনে যখন পাহাড়টার একদম উপরে মৈত্রী তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলল, “আমরা এখন পাহাড়ের চূড়ায় আমার একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না। সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের মাথায় চলে এসেছি! এ্যাই একটু চিমটি কাটুন না আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।”

মৈত্রী নিজের উচ্ছাস প্রকাশ করতেই যেন কথাগুলো গড়গড় করে বলে গেল। ইরশাদ অবাক হল এ কেমন উচ্ছ্বসিত হওয়া যেখানে ভেতর থেকে আবেগ এসেছে তা টের পাওয়া যায় না! আগে কখনো অনুভূতি প্রকাশ করা মৈত্রী জানতো না বা করতে চাইতো না এ কথা ঠিক৷ কিন্তু এখন সে সাধ্যমত রিয়াক্ট করে বা তার ভেতর থেকেই কিছু রিয়াকশন আপনা আপনি প্রকাশিত হয় কিন্তু এই মুহুর্তে তার মুখাবয়বে তেমন কিছুই নেই। ইরশাদের হঠাৎই মায়া হতে লাগল মৈত্রীর জন্য তার চেষ্টা সফল হয়নি৷ এই মেয়েটা এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি৷ মৈত্রীকে যে সাইকিয়াট্রিস দেখানো হয়েছিল তার দ্বিতীয়বার বিয়ে ভাঙার পর ইরশাদ কথা বলেছিল সেই ডক্টরের সাথে৷ মৈত্রী অস্বাভাবিক নয় তবুও সে সাধারণও নয়। তার ভেতরকার সেই ছোট্ট থেকে জমে থাকা একাকীত্বের গুমোট ভাব সেটা কা-টা-নো জরুরি৷ অন্তত বৈবাহিক জীবনে তাকে স্বাভাবিক করা জরুরি। আজ নয়তো কাল সে কনসিভ করবে প্রেগন্যান্সির মাসগুলোতে তার মানসিক দিকটা সবচেয়ে বেশি ফ্যাক্ট হবে তার সন্তানের জন্য৷ ইরশাদ সব জেনেশুনেই বিয়ে করেছে মৈত্রীকে তাই তার দ্বায়িত্বটাও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে৷ কথার ছলে মৈত্রীর পছন্দ অপছন্দের দিকগুলো সে জেনে নিয়েই কিছু না কিছু করতে থাকে মৈত্রীর জন্য এই পাহাড়ভ্রমণটাও তারই একটা দিক। স্বচ্ছ কাঁচের মত রোদের আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে দুজনার সারাদেহ। ইরশাদ গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মৈত্রীর মুখপানে। উজ্জ্বল মুখের রঙটা সূর্যরশ্মিতে আরও চকচকে হয়ে উঠেছে সেই সাথে টিকালো নাক, সরু চিবুক আর পেলব পাতলা ঠোঁটদুটো! ইরশাদের নজরজোড়া ঠিক এখানেই এসে দূর্বল হয়ে পড়ল৷ নিচ থেকে উঠে আসা কুয়াশারা যখন পাহাড়চূড়ায় এসে রোদে মিশে অদৃশ্য হয়ে উঠছে তখন ইরশাদ দেখল তার সামনে দাড়ানো মানবীটি আকস্মিক রহস্যময়ী সৌন্দর্যে ছেয়ে যাচ্ছে। মাথার ওপর নীলাকাশ, চারদিকে সবুজবীথি মধ্যিখানে তারা সম্মোহনী স্তরে অবস্থিত হয়েছে যেন। আপন নারীটিকে এই সবুজ ধরায় আচমকাই খুব করে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে তার তাতেই বুঝি দিকদিশা ভু-লে টেনে নিলো নিজের মাঝে। দু হাতের পাতায় তুলে নিলো মৈত্রীর মুখটি। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ছুঁয়ে গেল তার ঠোঁট এক, দুই, তিন করে কয়েক সেকেন্ড অথবা মিনিট! চুম্বনের শেষ মুহূর্ত অবধি মৈত্রী ছিল সম্মোহিত। অনুভূতির সবটা ছিল নির্জীব অথচ ইরশাদ ছেড়ে দিতেই অনুভূতিরা দলবেঁধে এসে জড়িয়ে ধরল তাকে৷ রাতমোহনায় গভীর আলিঙ্গনেও এতোটা লজ্জা ছোঁয়নি মৈত্রীকে যতোটা এ বেলা এক ওষ্ঠ চুম্বনে ছুঁয়ে গেল। থমকে থাকা পিঙ্গলবর্ণ মেঘেরা হুড়হুড় করে এসে জড়ো হলো এ পাহাড়ের চূড়ায়৷ তাদের এই প্রেমোপাখ্যানের সাক্ষী হতেই কি মেঘেরা এলো!

ফ্লাইট টাইম, ট্রানজিটের কারণে পুরো চব্বিশঘন্টার পর গন্তব্যে পৌছে ময়ূখ সুযোগ পেয়েছিল রেস্ট করার। কিন্তু নোরার এগ্রেসিভ আচরণ তাকে সে সুযোগটুকুও নিতে না দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছে সে। ফিজিক্যাল মোমেন্টগুলো উপভোগ করার জন্য যে মন মানসিকতার প্রয়োজন ময়ূখের মাঝে তা বিন্দুমাত্র ছিল না। অথচ নোরা তাকে প্রতি মুহূর্তে সি-ডি-উস করে গেছে মস্তিষ্কের বিপরীতে গিয়ে নিজেকে সে ছেড়ে দিয়েছিল তাই নোরার হাতেই। এরপর থেকেই সে অসহ্য মাথা য-ন্ত্র-ণা আর দৈহিক অবসাদে পড়ে আছে বিছানায়। টানা সাত ঘন্টা ঘুমিয়েও কোন পরিবর্তন পায়নি সে নিজের মাঝে৷ তারওপর এখানে এসে যে খাবার পেয়েছে তা তার জিভের স্বাদকে নষ্ট করে দিচ্ছে। খুব করে ইচ্ছে করছিল ঝাল করে কষা মাংস দিয়ে গরম ভাত খেতে অথচ কপালে জুটছে বেকড অথবা বয়েলড খাবার। আজ সকালে নোরার ক্লাস ছিল বলে সে চলে গেছে যথা সময়ে। যেতে যেতে ময়ূখের জন্য রেখে গেছে লেমন স্মুদি, সিরিয়াল, ব্রেড, জ্যাম৷ আর রেখে গেছে নোরার একটা কার্ড সে চাইলে বাইরে যেতে পারে পাশেই সুপারশপ থেকে শুরু করে পার্ক পর্যন্ত আছে। খাওয়া, ঘোরার সব ধরনের সুযোগ আছে৷ ময়ূখ বেডের পাশেই পেল তার ফোনটা কাল রাতে নোরা তার নতুন সিম, ইন্টারনেট কানেকশন দিয়েছে সেই সাথে তার সকল প্রকার কাগজপত্র চেক করে কি কি যেন করল এখানে থাকার জন্য৷ নোরা ব্রিটিশ ন্যাশনাল হওয়ায় ময়ূখের খুব একটা ঝামেলায় পড়তে হবে না বলেই জানিয়েছে নোরা। শোয়া থেকে না উঠেই ময়ূখ ফোনটা নিলো। এখানে দুপুর তার মানে বাংলাদেশে এখন বিকেল শেষ প্রায়! আম্মার সাথে কথা না বললে মনটা শান্ত হবে না এখানে টিকে থাকতে হলে তাকে প্রতি মুহূর্ত শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। সেই শক্তির উৎস তার একমাত্র আপন মানুষগুলোই। ফোনের ডায়াল প্যাডে আম্মার নাম্বার তুলে কল করল। প্রথমবারেই আম্মা রিসিভ করলেন তার কলটা। সালাম দিতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো রা-গী কণ্ঠস্বর, ” হা-রা-মীর দল একেকটা কল দিলি ক্যান আমি মরার পর দিতি৷ বউ পেয়ে একেকটা ভুলে গেছে বাপ -মা আছে তাদের!”

“কি হইছে আম্মা রেগে আছো ক্যান। আমার জেটল্যাগ কাটেনা আম্মা সারাক্ষণ ঘুমে কা-টা-ই-তেছি।”

ময়ূখ বুঝতে পারছে আম্মা তাকে মিস করছে হতে পারে ভাইকেও! ভাই সিলেটে যাওয়ার পরই সে খেয়াল করেছিল আম্মা যখন যখন ভাইকে মিস করে তখনই এমন বকে ধ-ম-কে কথা বলতে থাকে। সে যখন বছর কয়েক হলে রইল তখন ভাই পাশে ছিল আবার ভাই যখন সিলেটে তখন সে ছিল। কিন্তু এবার পাশে না ভাই আছে না সে তাই হয়ত আম্মা ক-ষ্ট পাচ্ছে ভীষণ। এখন মন বলছে এখানে আসার সিদ্ধান্তটা কি সে ভুল নিয়েছে! যে মানুষের সাথে মন- মানসিকতা , কালচার কিছুরই মিল নেই যেখানে মিলিয়ে নেওয়ার ইচ্ছেটাও আসে না ভেতর থেকে সে মানুষটার জন্য অতি আপন মানুষগুলোকে ফেলা আসা আদৌও কি ঠিক হলো! পরক্ষণেই মনে পড়ল, সে তো নোরার জন্য আসেনি। এসেছে নিজের জন্য নিজের মনের ভেতরকার যে পরিচিত এক ছায়ার রাজত্ব সেটাকে দূরে সরাতে। মৈত্রী তার জন্য মরিচীকা এখন তো আবার সাথে যুক্ত হয়েছে অন্য এক শব্দ “নি-ষি-দ্ধ ” হ্যাঁ সেই পেঁচামুখী মেয়েটা এখন নিষিদ্ধই বটে! ভাইয়ের বউ তাকে নিয়ে ভাবতে গেলেই পাপ হবে।

“কথা বলিস না ক্যান হা-রা-মী। নাকি বউ পেয়ে মুখে স্কচটেপ লাগিয়েছিস!”

আম্মার পুনরায় বকা শুনে ভাবনা থেকে ছিটকে পড়ল৷ সে বুঝতে পারছে এই মানুষটার দেখানো ক্রো-ধের পেছনে ঠিক কতোটা দুঃখ বিদ্যমান কিন্তু তার এখন কি করার আছে! মৈত্রীকে ঘিরে যে অনুভূতির দেয়াল তা অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত দেশে যাবার কথা ভাবতেও চায় না। কথায় আছে, “কায়া দেখলে মায়া বাড়ে” কথাটাকে ভীষণরকম বিশ্বাস করে তাই আপাতত কায়ার মায়া কা-টা-তে আর নোরার মায়া বাড়াতেই তার এখানে আসা। বাবাই তাকে এ নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছিল সেদিন৷ ফখরুল সাহেব যেদিন সিদ্ধান্ত নিলেন ময়ূখ তার বউয়ের সাথে থাকবে সেদিন ময়ূখকে এ ব্যপারে ভাবতেও তিনিই বাধ্য করেছেন। সবার অলক্ষ্যে তাকে ডেকে নিয়ে জানিয়েছিলেন নিজের মনের স-ন্দে-হের কথা৷ তিনি স্পষ্ট শব্দে বলেছিলেন, ” বাবা তুই নোরাকে বিয়েটা যে কারণেই করিস না কেন আমি বুঝতে পারছি তুই তাকে ভালোবাসিস না আর না ওর প্রতি তোর কোন মায়ার টান আছে। তোর কিছুদিনের আচরণে আমি এও বুঝতে পেরেছি তুই অন্যকোন মেয়ের জন্যই এমন এলোমেলো হয়ে গেছিস। আমি জানতে চাইব না কি হয়েছে বা কে সেই মেয়ে শুধু এইটুকু বলব বিয়ে তো করেই ফেলেছিস জীবনটাকে এই বিয়েতেই গুছিয়ে নে৷ আমাদের বয়স হয়েছে তোদের এখন অগোছালো দেখলে মৃ-ত্যু-সম য-ন্ত্র-ণা হয়। নোরা হয়ত এখানে আসবে না চাইলে তুই যেতে পারিস ওখানে আমরা হয়ত কিছুদিন ক-ষ্ট পাব পরে সয়ে যাবে। কিন্তু তোরা আলাদা থাকলে জীবনটা গুছিয়ে উঠতে পারবি না।”

ফখরুল সাহেব প্রথমে নরম সুরেই বুঝিয়েছিলেন ময়ূখ মানতে চায়নি৷ তাই পরবর্তীতে জোর দিয়ে, অধিকার খাটিয়ে সিদ্ধান্ত শুনিয়েছেন ফলশ্রুতিতে ময়ূখ আসার জন্য শ-ক্ত মনে তৈরি হতে পেরেছিল। আম্মার সাথে সে লম্বা সময় নিয়ে কথা বলল, বাবা বাড়িতে নেই তাই তাঁর সাথে কথা হলো না৷ জানতে পারল ইরশাদরা চট্টগ্রামে গিয়ে কোন হোটেলে নয় বরং রিশাদেরই পাহাড়ি বাড়িটাতে থাকছে৷ অনেকটা সময় কথার মাঝেও নোরার উপস্থিতি না পেয়ে ইরিন জানতে চাইলেন নোরা কোথায়। বলা বাহুল্য, ময়ূখ নিজেও এ ব্যাপারে অবগত নয়। তাকে বলেছে ক্লাস আছে কিন্তু ঘড়ির কাটা বলছে ক্লাসের সময় অনেক আগেই শেষ হয়েছে মেয়েটার এবং সে আরও জানিয়েছিল ফিরতে লেট হবে৷ ময়ূখের অবস্থা তেমন ছিল না সে প্রশ্ন করত কেন লেট হবে। হয়ত, প্রশ্ন করাটাও সমীচীন নয় তাই সে আগ্রহও প্রকাশ না করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কখন গেল, কখন আসবে এ নিয়ে তার ভাবতে ইচ্ছে করল না। আম্মাকে বলল, ” সে ক্লাস আছে বলে কলেজে গেছে।”

ইরিনের খুবই অপছন্দ নোরাকে ছেলের বউ হিসেবে। হতে পারে বাঙালি শ্বাশুড়িগতও কোন ব্যাপার এটা কে জানে! সে বলেই ফেলল, অসভ্য মেয়ে স্বামী তার কাছে গেল দু দিন পার হয়নি এখনই বেরিয়ে গেছে ড্যাং ড্যাং করতে। মনে হয় বাইরে একটা না-গ-র রেখে এসেছে তাকে না দেখলে প্রাণ চলে যাবে হুহ।” বলতে বলতেই ঘৃ-ণায় যেন মুখ বাঁকিয়ে নিলো ইরিন৷ ভিডিও কল হওয়ায় আম্মার বি-কৃ-ত করা মুখটা ময়ুখ দেখতে পেল সেই সাথে অবাকও হল। তার আম্মা কাউকে এভাবেও বলতে পারে! আম্মা রেগে গেলে তাকে আর ভাইকে বকাবকি করত এ কথা সত্য কিন্তু সেই বকাবকির ধরণ এমন নয়। গালি বলতেও হা-রা-মী, শ-য়-তান কিংবা বাঁদরের দল এগুলোই বলত৷ আম্মার সাথে কথা বলে মন কিছুটা ভাল হলো কিছুটা খা-রা-পও৷ নোরার আচরণ নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করল না সে নিজেই তো মানুষ হিসেবে ঠিক নয় তাহলে নোরার দো-ষ কেন ধরতে যাবে! ময়ূখ ভাবল ধীরে ধীরে গুছিয়ে উঠবে ঠিকঠাক হবে সব। কিন্তু না কিছুই ঠিক হলো না। প্রায় সপ্তাহ খানেক সময় কা-ট-ল দুজনের অস্বাভাবিকভাবে। দিনভর নোরা নিজের কাজকর্ম, পড়াশোনায় ব্যস্ত রাত হলে বিশ্রামের নামে দৈহিক আলিঙ্গন, ঘনিষ্ঠতা কখনো কখনো রাতের লন্ডনকে কাছ থেকে দেখার প্রয়াসে বেরিয়ে পড়া। এর মাঝে তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যপারে একটু ঝা-মে-লাও বাঁধল। নোরা সবসময়ই মশলাবিহীন, কম ঝাল খাবার তৈরি করে ময়ূখ করে সম্পূর্ণ বাঙালিয়ানা। ফলাফল একই কিচেনে দু পদের রান্না৷ প্রথম কয়েকদিন নোরা কিছু না বললেও পরে শুরু হলো টোকাটুকি। সে ময়ূখের হেলথ নিয়ে স্যাটিসফাইড তবুও ডায়েট করানোর ব্যাপারে পেছনে পড়ে রইল। ময়ূখের পছন্দ হয় না এমন বাঁধাধরা নিয়ম সে আম্মার রান্নায় নিয়মকানুন ছাড়াই খেয়ে বড় হয়েছে। এ কথা ঠিক হেলদি ফুডচার্ট করা মন্দ কিছু না তবুও স্বভাব বদলাতে সময় তো লাগবেই। এদিকে দেশে বেড়াতে যাওয়া নোরা আর এদেশে এসে দেখা নোরাকে ময়ূখ কিছুতেই মেলাতে পারছে না। সময় যত গড়াচ্ছে ততোই যেন দুজনের মাঝে দূরত্ব আরও বাড়ছে। ক্ষণে ক্ষণে উপলব্ধি করছে ময়ূখ নোরার মোহ কে-টে যাচ্ছে। প্রতি বছর দেশে গিয়ে নোরা তার পেছনে যেভাবে আঠার মত লেগে থাকত, কথায় কথায় বোঝাতে চাইত ভালোবাসা সেটা আদতে ভালোবাসা ছিলই না৷ কিছু কিছু জিনিসের প্রতি আমাদের হুট করে যেমন মোহ সৃষ্টি হয় তা পেয়ে গেলেই আবার সেই মোহ কে-টে যায় আপনাতেই ময়ূখের বোঝা হয়ে গেল নোরার কাছে তার অবস্থানটাও ঠিক তেমন। লন্ডনে থাকার একটা মাস ময়ূখের কে-টে গেল ঘুরেফিরে, জবের আশায় প্রাক্তন চাচী শাইনের সাথেও ঘোরাফেরা হলো অনেক কিন্তু মনপুত কাজ আর মিলল না৷ নিজের দেশে হরদম ভাব নিয়ে সিনা ফুলিয়ে দাপিয়ে বেড়ানো ছেলে এই শ্বেতাঙ্গদের ভীড়ে যা তা কাজ করতে মোটেও ইচ্ছুক নয়। শাইন অবশ্য বলেছিল বিজনেস শুরু করো ফুল সাপোর্ট আমি দেব ময়ূখের তাতেও সায় নেই৷ কেন নেই সে তা নিজেও জানে না শুধু বোঝে এখানে তার দম আটকে আসে৷ ক্ষণে ক্ষণে আম্মার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে সকল অস্বস্তি আর ক্লান্তিমাখা ভাবনাগুলোকে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে । নোরার বাইরের সময়গুলো ভালোই কাটছে কখনো ক্লাস, কখনো প্র্যাকটিস, কখনো বন্ধুদের সাথে বার, ক্যাসিনোতে ফূর্তি করে। ময়ূখকেও দু তিনবার নিয়ে গেছে কিন্তু তার সাথের মেয়েগুলো খুব করে হামলে পড়ে ময়ূখকে দেখলেই৷ “নিউ বয় নিউ টেস্ট” বলে একটা বাক্য প্রচলিত আছে তাদের মাঝে ময়ূখকে দেখে এখন সেটাই তাদের মাথায় ঘুরছে৷ ময়ূখ নিজেও মেয়েগুলোর ইনটেনশন বুঝতে পেরেছে কিন্তু তার এসবে গা ভাসাতে ইচ্ছে করে না৷ কলেজ লাইফে কিংবা ইউনিভার্সিটির সময়গুলোতে এসব ব্যাপার খুব উপভোগ্য ছিল তার জন্য অথচ এ দেশে সহজলভ্য পেয়ে বিন্দু মাত্র আগ্রহ পায় না৷ লন্ডনে আসার মাস দুয়েক পরের ঘটনা,
(উহ্য থাক আপাতত)

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে