#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩৫
“এভাবে হয় না বাবু তুই এক জায়গায় বউ আরেক জায়গায়।” কিছুটা রা-গ কিছুটা বিরক্তি মিশিয়ে বললেন ইরিন। ময়ূখ চুপচাপ শুনছে কিন্তু তাতে ভ্রুক্ষেপহীন সে৷ বারবার মাথায় ঘুরছে নোরার মায়ের কথাগুলো৷ কাল রাতে আন্টি কল দিয়ে প্রথমেই তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, বিয়েটা নিয়ে কি ভাবছে সে৷ ময়ূখ দারুণ কোন জবাব দিতে পারেনি তবে জানিয়েছে সে বিয়েটাকে মেনে নিয়েছে।
“বিয়েটা মেনে নেওয়া মানে দুজনে একসাথে থাকা, নিজেদের অস্তিত্ব তৈরি করা তা নিয়ে আজীবন কা-টা-নো৷ কিন্তু নোরা সে কালচারে বড় হয়নি। নোরার বাবাও তো তাঁর সাথে থাকতে চেয়েছেন কিন্তু তিনি যেমন সব সংস্কৃতি, বাধ্যবাধকতা দেখিয়েছেন তা শাইন মানতে পারেনি৷ তার ফলশ্রুতিতে বিশ বছরেরও বেশি সময় একসাথে কা-টি-য়ে আবার যে যার পথে আলাদা। সবাই এক হবে তা কিন্তু নয় তবুও নোরা তার মেয়ে সে জানে নোরাও এমন বন্ধনে আজীবন থাকতে চাইবে না যতোই তার দেহে তার বাবার র-ক্ত থাকুক না কেন! শাইন ময়ূখকে একবার দেখেছিল সামনে থেকে তার একটু হলেও আন্দাজ বলে ময়ূখও তার চাচার মতই জীবন চাইবে একটা সময়। দেশি সংস্কৃতি, ধর্ম, বন্ধন এসবের মাঝে নোরাকে আনতে চাইবে ফলে তাদেরও সংসার ভে-ঙে যাবে৷ নোরার জন্য এ জিনিস খুব বেশি ম্যাটার না করলেও ময়ূখের জন্য যে করে তা শাইন নিজের প্রাক্তন স্বামী আফছারকে দিয়েই উপলব্ধি করেছে৷ এজন্যই যেচে পড়ে ছেলেটাকে সা-ব-ধান করতে চেয়ে ফোন করেছিল।
” কি রে কিছু বলছিস না কেন?” ইরিন প্রশ্ন করলো আবারও।
“আম্মা একটু সময় দাও না মা নোরা মাত্রই গেল। আমারও এদিকে কিছু একটা হোক তারপর না হয় এ নিয়ে ভাবা যাবে।”
“আমি এসব শুনতে চাই না বাবু আমার ভাল্লাগে না এসব৷ বিয়ে করেই ফেলেছিস যখন তখন এভাবে পবিত্র সম্পর্কটাকে হেলা করিস না।” ইরিন ক্লান্তিমাখা স্বরে কথাগুলো রোজ রোজই বলছেন ময়ূখকে। আশপাশে মানুষ কত কি বলে কখনো ভালোটা তো কখনো সমালোচনারূপে। মৈত্রীদের বাড়িতে এখন আর ভাড়া থাকা হচ্ছে না বলে ফখরুল সাহেবের অফিস যাতায়াতে একটু সমস্যা হচ্ছে। তিনি ঠিক করেছেন আবারও ভাড়া চলে যাবেন তবে এবার বেয়াই বাড়িতে তো সম্ভব না তাই সে এলাকায়ই অন্য কোথাও। ময়ূখকে নিয়ে তিনিও চিন্তিত তাই অনেক ভেবে নিজেও ময়ূখের সাথে কথা বলেছেন। ইরিন জে-দ ধরে আছে বউ দেশে আসবে সংসার করবে। কিন্তু ফখরুলের শুরু থেকেই মন বলছে ময়ূখ কিছু লুকিয়ে আছে। কোন মেয়ের কথাই সে লুকাচ্ছে নোরার সাথে বিয়েটা সে হয়ত সেই মেয়েকে ভুলতেই করেছে। অনেক ভেবে এই প্রথম তিনি ময়ূখের জন্য নিজে একটা সিদ্ধান্ত নিলেন এবং পিতৃ অধিকার খাটিয়ে তাকে জানিয়ে দিলেন। ময়ূখ বিদেশে চলে যাবে নোরার কাছে। সে যেন তার সংসার শুরু করে যেমনটা ইরশাদ করেছে। আকস্মিক এই সিদ্ধান্ত এক মুহূর্তে ভড়কে দিয়েছিল ইরিন আর ময়ূখ দুজনকেই৷ কিন্তু ইরশাদকে সে কথা জানাতে সেও বাবার সাথে সম্মত হয়ে ময়ূখকে বোঝালো কোথাও এক জায়গায় তো স্যাটেল হওয়া উচিত। হয় দেশে না হয় বিদেশে তবে ময়ূখ যে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (BCS) থাকতে চায় তাতো কারও অজানা নয়। যদি তার বিসিএসটা হয়ে যায় তখন! দেশেই ব্রাইট ফিউচার পেলে বিদেশে কে যেতে চায়? এদিকে নোরারও একটা ভালো চান্স আছে। আমাদের দেশে সাইকিয়াট্রিস্টকে যতোটা মূল্যায়ন করে তারচেয়ে দ্বিগুণ ইউরোপ, আমেরিকায় নোরা’ইবা কেন তার সুন্দর ভবিষ্যৎ সেখানে ফেলে আসতে চাইবে! সবাই কেমন বিচলিত হয়ে পড়ে তাদের নিয়ে ভাবতে গিয়ে। এ কেমন জোড়া তাদের! পরক্ষণেই মনে হয় উপরওয়ালা প্রত্যেকের জীবনেই পরীক্ষা রেখেছেন। কেউ কেউ সে পরীক্ষায় ধৈর্য্য আর সততা দ্বারা উত্তীর্ণ হয় কেউবা আবার হে-রে যায় সত্তা, সততা সবেতেই। তাই ময়ূখ নোরার ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন আর দুশ্চিন্তা করে লাভ কি! দুজনের একজনকে তো স্যাক্রিফাইস করতেই হবে। সংসার ধর্মই এমন তাতে স্যাক্রিফাইস আর কম্প্রোমাইজ শব্দ দুটো নিবিড়ভাবে জড়িত। ইরশাদ ভাবে, আমাদের বাবা-মায়েরাও স্যাক্রিফাইস করে করেই তো সুন্দর একটা সংসার সাজিয়েছে তবে আমরা কেন পারব না?
“রাজশাহীর চেয়ে শীত এখানে একটু বেশিই তাইনা!” কফির মগে চুমুক দিয়েই ইরশাদ কথাটা বলল। আধঘন্টার মধ্যে সে দু মগ কফি খেয়ে নিচ্ছে এ নিয়ে কিছুটা বির-ক্ত মৈত্রী৷ এই প্রথম সে চমৎকারভাবে আলুর ভর্তা করেছে কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা, লবণ আর সরিষার তেল সবকিছু একদম পারফেক্টলি দিতে পেরেছে৷ তাই ভেবেছিল ইরশাদ এলে সাথে সাথেই ডিনার করতে বসবে৷ গরম গরম ভাত আর ভর্তা নিশ্চয়ই এই তীব্র শীতের রাতে ভাল লাগবে খেতে৷ কিন্তু সেসব তো কিছুই হচ্ছে না৷ জনাব ফিরেই বলল, দ্রুত এক মগ কফি দিয়েন ম্যাম একটু কাজ করব।
মৈত্রী কফি নিয়ে বেডরুমে ঢুকে দেখলো লোকটা পোশাক পাল্টে মুখ হাত ধুয়ে তৈরি ল্যাপটপ নিয়ে বসার জন্য৷ সেই থেকেই তার বির-ক্ত লাগছে কিন্তু মুখে তো তা প্রকাশ হয় না তার। দু দিন হলো মৈত্রীকে নিয়ম করে পড়াশোনা করতে হচ্ছে তাই দুজনে সন্ধ্যায় খুব একটা গল্প করতে পারে না। রাতটাই যা আদরে, আহ্লাদে কাটে তবুও ইরশাদের আজকাল ক্লান্তির জন্য দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়তে হয়।
“কিছু বলছো না যে!”
ইরশাদ কফিটা শেষ করে আবার মৈত্রীকে প্রশ্ন করলো।
“কি বলবো?”
“মন খারাপ?”
“না”
“রে-গে আছো?”
“আপনার আরও কফি লাগবে?”
মৈত্রীর এবারের প্রশ্নে ইরশাদ বুঝলো বউ তার রে-গে আছে। কোলের ওপর থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে বিছানা থেকে নামল। মৈত্রী চেয়ারে বসে বইয়ের দিকে তাকানো। ইরশাদ পেছন থেকে দু হাত রাখলো মৈত্রীর কাঁধে। একটু ঝুঁকে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “ম্যাম দয়া করে বলুন না
রে-গে থাকার কারণটা।”
“আপনি কাজ করুন গিয়ে আর কফি খান৷ পেট ভরে কফি খান ছাড়ুন আমাকে।”
ইরশাদের এবার টনক নড়ল৷ সে অফিস থেকে ফেরার পরই মৈত্রী তাকে বলেছিল, আজ আমরা তাড়াতাড়ি ভাত খাব। নিশ্চয়ই কিছু বিশেষ ছিল এতে৷ এবার আর স্ত্রীকে রে-গে থাকার সুযোগ দেওয়া চলে না। মৈত্রীকে টেনে নিয়ে ডাইনিংয়ে বসল। খিদে পেয়েছে এমন বাহানা করেই বলল, “ভাত দাও জলদি আজ দ্রুত খেয়ে বিছানায় যাব।”
মৈত্রী বাঁকা চোখে ইরশাদকে দেখে চলে গেল রান্নাঘরে৷ ভাত, ভর্তা আর শুকনো করে ডাল রান্না করেছিল তাই নিয়ে এল টেবিলে৷ তার ভর্তা আজ সত্যিই চমৎকার হয়েছে৷ ইরশাদ খেতে খেতে খুব প্রশংসা করল তারপর হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভাবে বলল, অফিস থেকে একটা অফার এসেছে৷ মৈত্রী উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো কি অফার?
“ফয়সাল আঙ্কেল এসেছিলেন আজ অফিসে তিনি কথাবার্তার ফাঁকে জানতে চাইলেন আমার চাকরিটা কেমন লাগছে? তারপর হঠাৎই বললেন নতুন বিয়ে, সেসমেয়ই চাকরিতে জয়েন মানে হানিমুনের সুযোগটাও পাইনি তাই উনার পক্ষ থেকে একটা ছোট ট্রিপ ব্যবস্থা করতে চাচ্ছেন।”
” আজব তো!”
“আজব কেন?”
“আজব নয় তো কি! অফিসের একজন এমপ্লয় বিয়ে করেছে বলেই তাকে হানিমুন ট্রিপ দিবে? সবাইকেই দেয়?”
ইরশাদের খাওয়া প্রায় শেষ সে বোল থেকে মৈত্রীকে ভাত দিল এক চামচ মৈত্রী না করল তারও শেষ৷ প্লেট হাতে রান্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “সবাইকে দেয়না ইনফ্যাক্ট, কাউকেই দেয়নি সম্ভবত।”
মৈত্রীও প্লেট আর বেচে যাওয়া ভর্তার বাটি তুলে রান্নাঘরে ঢুকলো।
“তাহলে আপনার প্রতি এত সুনজর কেন? সেটাই কি আজব লাগছে না? এখানে আপনার যে জব তাতে স্যালারি একদম ঠিকঠাক দিচ্ছে তারপরও দেখেছি কিছু কিছু সুবিধা একটু বেশি বেশি এমন কেন?”
ইরশাদ নিজেও ভেবেছে এ কথা। সব কিছুতেই তাকে অফিসে কেমন যেন অগ্রাধিকার বেশি দিয়েছে আঙ্কেল। বলেছিলেন বড় মামার জিগরি দোস্ত তাই নাকি ইরশাদ খুব পছন্দের। তারওপর আঙ্কেলের নিজের কোন স্ত্রী সন্তান নেই তবুও বংশধরেরা তো আছে! এ নিয়ে আর ভাবার ইচ্ছে হলো না। ইরশাদ বড় মামাকে একবার এ ব্যাপারে জানাবে ঠিক করে রেখেছে কিন্তু আপাতত হানিমুন ট্রিপ ক্যান্সেল করার কোন মানে হয় না। মৈত্রী রান্নাঘরের কাজ গুছিয়ে গিয়ে আবারও পড়তে বসল। ইরশাদও টুকটাক কাজ ছিল তা করে একেবারে বিছানা গুছিয়ে বসল৷ মৈত্রী অবশ্য বলেছিল সে করবে ইরশাদ শোনেনি। সবসময় বউকেই বিছানা গোছাতে হবে কিংবা সংসার এমনটা কোথাও লেখা নেই৷ মৈত্রী পড়া শেষ করে বিছানায় যেতেই ইরশাদ প্রশ্ন করলো, ” পাহাড় কেমন লাগে তোমার?”
ইরশাদের পাশে শুয়ে পড়ে এক হাতে কম্বল টেনে নিলো মৈত্রী৷ চোখ বুঁজে বলল, ” প্রচণ্ড শীতে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ে এক চুমুক যেমনটা লাগে।”
হাত বাড়িয়ে খাটের পাশেই ল্যাম্পটা নিভিয়ে মৈত্রীকে দু হাতে বুকে চে-পে ধরে ইরশাদ বলল, “আর সমুদ্র!”
মৈত্রীও আরও গুটিয়ে গেল ইরশাদের বুকের মাঝে৷ খুব চেনা পুরুষালি গন্ধটা নিঃশ্বাসে টেনে নিয়ে জবাব দিল, “ঠিক এমন স্নিগ্ধ আবেশমাখা অনুভূতি।”
“গিয়েছো কখনো সমুদ্রে?”
“হু, কক্সবাজার আর ইনানি বিচ দু বার গিয়েছিলাম৷ পাহাড়ে কখনও যাওয়া হয়নি।”
“তাহলে এবার তোমাকে পাহাড় দেখাবো, সূর্যদয় আর সূর্যাস্তের মনভোলানো মুহূর্ত দেখার জন্য প্রস্তুতি নাও মিসেস শাহরিয়ার।” কথাটা বলেই টুপ করে মৈত্রীর ঠোঁট ছুঁলো ইরশাদ। ধীরে ধীরে ওষ্ঠচুম্বন নেমে এলো গলা, বক্ষবিভাজিকা, ছুঁয়ে গেল দেহ থেকে মন সবটাই। মৈত্রীও উপভোগ করে মিলনের প্রতিটি মুহূর্ত মন পুরুষের সাথে প্রত্যেকটা ক্ষণ। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে দুজনের মাঝে দেহের সাথে মনের টান৷ ভালো না বেসেও সুখের সবটা ইরশাদ দিয়ে চলেছে তার স্ত্রীকে৷ মৈত্রী জানে ঠিক একদিন ইরশাদের মুখে প্রকাশিত হবে ভালোবাসার উক্তিটিও।
“তোমরা চট্টগ্রাম যাবে ভালো কথা আমার আপত্তি নেই কিন্তু পা-হা-ড়ে যেও না। বিপদা-পদ একদম সইতে পারব না।”
” আম্মু বি-পদ হবে কেন?” মৈত্রী অবাক হয়ে শ্বাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলো। ইরশাদ সকালে অফিস যাওয়ার সময় বলে গেল আম্মুকে জানিও আমরা চট্টগ্রাম যাব। মৈত্রীও তাই নাশতা শেষে শ্বাশুড়িকে ফোন করল। ইরিন শুনেই চিন্তায় পড়ে গেল পাহাড়ে গিয়ে বি-প-দ হওয়ার ভ-য়ে। তারপর ইরিনই আবার জানতে চাইলো চট্টগ্রাম গিয়ে কোথায় উঠবে বুকিং দিয়েছে কিনা। দিলেও যেন ক্যান্সেল করে তারা কক্সবাজার যায় যেন! মৈত্রী মুখ ভার হলো শ্বাশুড়ির কথায়। তার তো পাহাড়েই যাওয়ার ইচ্ছে। কিন্তু শ্বাশুড়ির সাথে তর্কে যাওয়া যায় না তাই চুপচাপ হু হা তে জবাব দিল সে৷ এরপর কল দিল মামনিকে তিনি উল্টো সব রেখে প্রশ্ন করলেন, “মৈত্রী তোমার এ মাসে পিরিয়ড হয়েছে?”
এ কেমন প্রশ্ন ভেবেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে মৈত্রী৷ কোথায় তার ঘুরতে যাওয়ার ব্যপারে সুন্দর একটা স্যলুশন দিবে যেন শ্বাশুড়িকে ম্যানেজ করবে তা না!
” না মামনি।”
– ডেট কতদিন পার হলো?
খুব আপ্লুত শোনালো রোকসানার কণ্ঠ৷ মৈত্রী জবাব দিল, এখনো আসেইনি।
-ওহ!
“কি হলো মামনি?”
“কিছু না৷ এখন পাহাড়ে না গেলে হয় না?”
মৈত্রী মুখের ওপর কাউকে কিছু বলতে পারে না বলে তার খুব আফসোস হলো এখন। পাহাড়ে বেড়ানো কি এমন ভ-য়ংক-র কাজ? সে কি এভারেস্টে যাবে বলেছে! কি আশ্চর্য দুনিয়ার সব মানুষ আনন্দে পাহাড় ভ্রমণে যায় আর তারা মৈত্রীর যাওয়ার কথা শুনে রিয়াক্ট করছে! ভীষণ রা-গ হচ্ছে তার ভেতরে ভেতরে কিন্তু এমন রা-গ প্রকাশ করার উপায় নেই৷
ইরশাদ সকালে মৈত্রীকে বলে এসেছে বাড়িতে জানিয়ে দিও আম্মুকে আমরা ঘুরতে যাব এদিকে অফিসে এসেও সে ম্যানেজ করে নিয়েছে জানুয়ারিতে ছুটির জন্য৷ অথচ ফোন ঘেঁটে এখন রিশাদ ভাইয়ের নম্বর পাচ্ছে না। লাঞ্চ টাইম হয়ে এসেছে বলে বাড়ির দিকে এগোতে এগোতেই ময়ূখকে কল দিল৷
“হ্যাঁ ভাই কেমন আছো?”
“ভালো আছি, তুই কেমন আছিস?”
“এই তো আছি৷”
“আচ্ছা শোন, তোর কাছে রিশাদ ভাইয়ের ফোন নম্বর আছে?”
“জানি না ভাই দেখতে হবে৷ বছর খানেকের বেশি হবে কথা হয়নি তো।”
“ওহ, আচ্ছা পেলে আমাকে সেন্ড করিস তো।”
ইরশাদ ময়ূখ দুজনে আরও কিছুটা সময় কথাবার্তা হলো। তারপর ফোন রেখে ইরশাদ বাড়ি গেল লাঞ্চ করতে৷
ময়ূখ রাজশাহীতেই একটা কল সেন্টারে জব পেয়েছে৷ আবরার কিছুদিন ধরেই খুব প্রে-শার দিচ্ছিল তাদের অফিস জয়েন করার জন্য৷ একমাত্র ছেলে ছাড়া আর কে দেখবে এই সম্পত্তি৷ মেহেরকে বিয়ে দিলে না হয় তখন জামাই দেখবে অর্ধেকটা কিন্তু ছেলের ভাগ তো আর মেয়ের জামাইকে দিবেন না। তার ওপর আফছারের কোন ছেলে নেই নোরা আছে সে মেয়ে আজীবন বিদেশীই থাকবে তাতো তার আচরণেই বোঝা যায়। ইরশাদকেও বলা হয়েছিল নিজের মায়ের ভাগ বুঝে নিয়ে কিছু কর সেই ছেলেও রাজী নয় উল্টো শ-ত্রু-র কোম্পানিতে চাকরগিরি করছে। আবরার ইদানীং প্রচুর ক্ষো-ভ নিয়ে চলছে সবার সাথে। ময়ূখকে রোজ রোজ কল করে হয়রান সে শুনছে না কিছু। ময়ূখও এখন বাবার ওপর রেগে ফোন অফ করতে যাচ্ছিল তখনই ইরশাদের কলটা এলো। এখন সে লাঞ্চ না করে বসে বসে ফোন কন্টাক্ট চেক করছে। রিশাদ ভাইয়ের সাথে কারোই তেমন যোগাযোগ নেই বলা যায় ভাই নিজেই সকল আত্মীয়ের থেকে দূরত্ব বজায় রাখেন৷ অনেক খুঁজেও রিশাদের নাম্বার না পেয়ে ময়ূখ গুগল করে রিশাদের হোটেল ম্যানেজমেন্টের ফোন নম্বর বের করল৷ সেখানেই ফোন করে নিজের পরিচয় দিয়ে জানিয়ে রাখলো রিশাদ যেন একটাবার কল করে।
চলবে
#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩৬ (১ম অংশ)
“আমার ফোন নম্বর নেই তোর কাছে?” ফোনের ওপাশ থেকে রিশাদ বলল কথাটা। ময়ূখ কম্পিউটারে ব্যস্ত দৃষ্টি রেখে ফোন কানে তুলেছিল। রিশাদের কণ্ঠ শুনে প্রথমে চমকালেও পরে মনে পড়ল সে রিশাদের হোটেল ম্যানেজমেন্টে নম্বর চেয়েছিল।
” না ভাই তোমারটা নেই রাইমারটা ছিল সেটাও বোধহয়…”
ময়ূখকে কথা শেষ করতে না দিয়েই রিশাদ আবার বলল,
“ইরিন ফুপির কাছে ছিল তো! ইরশাদের বিয়ের সময় ফুপি, ফুপার সাথে কথা হলো।”
“মনে ছিল না ভাই আসলে ভাই এত তাড়া দিচ্ছিলো তোমার নম্বরের জন্য তাই হোটেলে কল করে নেওয়াটাই সহজ মনে হলো তখন।”
“কেমন আছিস তোরা?”
“ভালো। তোমরা কেমন আছো? রাইমার নাকি ঢাকাতেই বিয়ে হয়েছে?”
“হু আবরার চাচু এসেছিল তোরা তো কেউ তখন আসিসনি।”
“ইয়ে আসলে ব্যস্ততা ছিল।”
“আচ্ছা বল, কোন প্রয়োজন ছিল ইরশাদের তাড়া কেন দিচ্ছিলো?”
“আমি ঠিক জানি না। ভাই চট্টগ্রাম যাবে বলে শুনেছি সম্ভবত সেজন্যই তোমার সাথে কথা বলবে।”
“ঘুরতে গেলে বল কক্সবাজার চলে আসতে আমার হোটেলেই উঠবে না হয়৷ আমি ঢাকায় আছি তোর ভাবীকে নিয়ে আর রাইমার মেয়ে হয়েছে ফুপিকে বলিস।”
ময়ূখ আর রিশাদের আরও কিছু সময় কথা হলো৷ রিশাদের বাবা সম্পর্কে ইরিনের ফুপাতো ভাই৷ তাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকতার বাইরে খুব একটা যোগাযোগ না থাকলেও সম্পর্কে আন্তরিকতার গভীরতা বেশ। রিশাদ কিংবা ইরশাদরা প্রয়োজনে নির্দ্বিধায় একে অপরের পাশে থাকে ঠিক সেকারণেই ইরশাদ নিশ্চিন্তে চট্টগ্রাম যাওয়ার প্রোগ্রাম করেছে। সে জানে রিশাদ দ্বিতীয় বিয়ের পর অনেকটা সময় চট্টগ্রামেই ছিল তার স্ত্রী মেবিশকে নিয়ে। ইরশাদ মৈত্রীকে নিয়ে ঠিক কোথায় উঠলে তাদের পাহাড় ভ্রমণ চমৎকার হবে সে বিষয়েই হেল্প চাইবে রিশাদের কাছে।
ইরশাদ আজ অফিস ছুটির পর মৈত্রীকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিল। চা বাগানের শীত কেমন মৈত্রীর তা বোঝা হয়ে গেছে এখানে আসার পরই৷ কিন্তু রাতের শীত সে ঘরে বসে উপভোগ করেছে বাইরের হিম শীতল বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে ঘুরে বেড়ানো আর টঙের পাশে ভাড়ে চা খাওয়ার অভিজ্ঞতা মৈত্রীর কখনোই হয়নি৷ ইরশাদ জানে তার স্ত্রী ছোট থেকে একাকীত্বের জীবন কা-টি-য়ে-ছে। তাই নিজ সাধ্য আর সামর্থ্যনুযায়ী সে মৈত্রীকে পৃথিবীটাকে উপভোগ করাতে চায়। মনে মনে সে ভেবেই রেখেছে এবার পাহাড় দেখাবে পরে সিলেটের চমৎকার জায়গাগুলোরও দর্শন করাবে৷ দু জনে একটু আগেই বের হয়েছে। আজ প্রথমবার দুজনে কোথাও ঘুরতে যাবে শুনতেই মৈত্রীর চোখে মুখে যে উচ্ছাসের দ্যুতি ইরশাদ দেখেছে তা যে ছিল বড্ড মনোলোভা।
“এই পোশাকে আমাকে আজব লাগছে না!”
ইরশাদের ডান হাতটা জড়িয়ে উঁচুনিচু পাহাড়ি মাটির রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আনমনেই প্রশ্ন করলো মৈত্রী। ইরশাদ দু দিন আগেই এখানকার স্থানীয় এক মার্কেট থেকে দু জনের জন্য একইরকম দুটো হুডি কিনে এনেছে। মৈত্রীর জন্য দুটো গলা বন্ধ ফুল স্লিভ টপও এনেছে কিছুটা মোটা কাপড়ের। সে প্রায় খেয়াল করেছে মৈত্রী এটা সেটা করার সময় শাল জড়িয়ে থাকতে পারে না। তাই নিজেই এগুলো কিনে এনেছে তার কাজের সুবিধার জন্য। আজ ঘুরতে বের হবে বলে শাড়ি পরবে, জামা পরবে, গাউন পরবে কি পরবে এত দ্বিধা করছিল তা দেখে ইরশাদ নিজেই বুদ্ধি দিল এসব না বাইরে প্রচুর শীত ভালো লেগিংস থাকলে পরো সাথে তার আনা সেই টপ দুটো থেকে একটা তার উপর হুডি। কি আজব কথা সে বউ মানুষ এসব পরে বের হলে লোকে কি বলবে! এমনিতেও সে লেগিংস, জিন্স যাই পরে কূর্তি, কাফতান এর ওপর এভাবে থোড়াই! ইরশাদ সে কথায় পাত্তা দেয়নি উল্টো বুঝিয়েছে তার পোশাকের মাধ্যমে দৈহিক গঠন অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের কারণ না হয়। মৈত্রী সে কথা শুনেই পরেছিল কাপড়গুলো এখন নিজের দিকে তাকিয়ে তার এখন কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে তাই প্রশ্ন করছে। দুজনে কুয়াশার দেয়াল সরিয়ে হেঁটে অনেকটা পথ গিয়ে ছোট্ট এক ঘুপচি দোকান পেল। মাচার ওপর পঞ্চাশোর্ধ প্রৌঢ় বসে স্টোভে চা করছে, দু চার রকম বিস্কিট ছাড়া আর কিছুই নেই৷ মৈত্রীকে নিয়ে সেখানেই দাঁড়ালো সে।
“চাচা চা দিন দু কাপ”
“সেকি! এখন চা খেলে ভাত খেতে চাইবেন না আপনি।” বাধ সাধলো মৈত্রী।
“লোকটাকে দেখো কেমন হাঁড় কাঁপানো শীতে এই পাহাড়ের গায়ে মাত্র একটা চাদর আর টুপি পরে অপেক্ষা করছে কাস্টমারের৷ অথচ শীতের এ সময় এই বাগানের আশপাশের মানুষগুলো সন্ধ্যার পরই ঘরবন্দী হয়ে গা বাঁচায়। তাই লোকটার চায়ের ক্রেতা হাতে দু চারজন পথিক তারমধ্যে আজ আমরাও আছি। আমাদের দু কাপ চায়ে নিশ্চয়ই উনার থলিতে কিছু পয়সা ঢুকবে!” মৈত্রীর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কথাটা বলেই ইরশাদ লোকটাকে বলল কিছু বিস্কিট যেন কাগজে মুড়ে দেয়৷ মৈত্রী জানে তার এই প্রিয় মানুষটি বড়ই উদার মনের কিন্তু তার উদার মনটা ঠিক কতখানি বড় তা যেন আজই উপলব্ধি করতে পারল সে। দোকানটায় হারিকেন জ্বলছিল হারিকেনের সেই হলদে আলোয় মৈত্রী অবাক চোখে তাকিয়ে রইল মানুষটির দিকে। কখনো কখনো মন অজান্তেই কিছু ভালো মানুষকে বেছে নিতে পারে নিজের জন্য এমনটাই মনে হলো মৈত্রীর। পাশাপাশি বাঁশের চিকন মাচায় বসে মাটির ভাড়ে চা খেলো দুজনে৷ ইরশাদ কাঁচের বৈয়ামে থাকা গোল গোল দুই টাকা দামের এক প্রকার বিস্কিট কাগজে মুড়ে নিলো। বসা থেকে উঠে দাম মিটিয়ে এক হাতে মৈত্রীর হাত অন্য হাতে বিস্কিট নিয়ে এবার রওনা দিল বাড়ির দিকে৷ চলতে চলতে বাতাসে বুনো ফুলের গন্ধ আর থেকে থেকে পেঁচার ডাক উপভোগ করলো দুজনাতে। ভালো বাসাবাসি শুধু মানুষে মানুষে নয় কখনও কখনও মানুষে প্রকৃতিতেও হয় মৈত্রী আজ তাই জানলো। ঘরে ফিরে ইরশাদ বিস্কুটগুলো মৈত্রীকে দিলো রেখে দেওয়ার জন্য পরে কখনো খাওয়া যাবে৷ ইরশাদ জুতো খুলে, হুডি বদলে বেডরুমে ঢুকতেই তার ফোন বাজে৷ আম্মু ভিডিও কল দিচ্ছে দেখে রিসিভ করে সালাম দিল। ক্যামেরার সামনেই আব্বু, আম্মু তাদের মধ্যিখানে ময়ূখ বসে আছে।
“আরেব্বাহ্ আমি নেই তাই সুযোগ পেয়ে একদম আব্বু-আম্মুর কোলে উঠে বসে আছিস।” ইরশাদ টিপ্পনী কেটে বলল।
“থাকবোই তো এখন এই দুই দুনিয়া আমার একার ভাই৷ থাকো তুমি জঙ্গলে পড়ে সব আদর আমি নিয়ে নেবো।” কথাটা বলার মাঝেই ময়ূখ দু হাতে আম্মা আর বাবাকে জড়িয়ে ধরেছে নিজের সাথে। দু ভাইয়ে মিলে মা-বাবাকে নিয়ে খুনসুটিতে মেতে উঠেছে। মৈত্রী রান্নাঘরের টুকিটাকি কাজ করে এসে দেখলো শ্বশুর শ্বাশুড়ি ক্যামেরায়। ইরশাদের পাশে দাঁড়িয়ে সেও তাদের সালাম জানায়। ময়ূখ হঠাৎ মৈত্রীর মুখটা দেখে কথার মাঝেই থেমে গেছে৷ মৈত্রী নিজেই প্রশ্ন করলো, “কেমন আছেন ময়ূখ ভাইয়া, নোরা কেমন আছে?”
“ভাল” কথাটা বলার পরই বলল, “ভাই আমি লন্ডনে যাচ্ছি শিগ্রই।”
ময়ূখের মুখটা কেমন বিবর্ণ হয়ে গেল কথাটা বলার সময়। ইরশাদ সেদিকে লক্ষ্য করতেই জানতে চাইলো হঠাৎ কেন! ইরিন রে-গে গেল, “হঠাৎ মানে কি বউ থাকবে এক জায়গায় সে থাকবে আরেক জায়গায়!”
“আম্মু ময়ূখের তো বিসিএসের রেজাল্ট…”
“চুপ কর কিসের রেজাল্ট বউ, সংসারই এখন ওর রেজাল্ট বিয়ে করার সময় মনে ছিল না সেসব?”
ইরিনের ধ-ম-কে আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না ইরশাদ। সে ফোন ধরিয়ে দিলো মৈত্রীকে আপাতত বউ শ্বাশুড়ি গল্প করুক। মৈত্রী কথা শুরু করতেই ইরিন ময়ূখ আর ফখরুল সাহেবকে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন৷ ইরশাদ তা খেয়াল করতেই আবার এগিয়ে এলো, “এই আম্মু তুমি কি সিক্রেট কথা বলবে?”
“যাই বলি না কেন চোখের সামনে থেকে দূর হ তুই।”
ইরশাদ বুঝলো কথাটা বউ শ্বাশুড়ির তাই সে ওয়াশরুমে ঢুকলো।
“মৈত্রী তোমাদের যাওয়াটা কি ক্যান্সেল করা যায় না! দেখো এখন তো সময় দেখার কি হয় না হয় অন্তত এ ডেটটা যেতে দাও।”
মৈত্রী মাথা নাড়লো তাতে কি বোঝালো কে জানে! ইরশাদ বাথরুম থেকে বেরিয়েছিল তোয়ালে নিতে। মায়ের কথা শুনে কিছু না বুঝলেও বেশ অবাক হলো সে।
“কিসের কথা বলছে আম্মু?”
চলবে
#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩৬( ২য় অংশ)
চোখের পলকে সময় কাটছে। শীত শেষ হতে চলল শেষ হচ্ছে জানুয়ারি মাসটাও। ইরিনের দোনোমোনো আচরণে ইরশাদ-মৈত্রীর ঘুরতে যাওয়া বানচাল হলো প্রায় বিশ দিনের মত। এদিকে ময়ূখেরও কাগজপত্র যাচাই-বাছাই এমবাসি দৌঁড়াদৌড়ি সব শেষ হয়ে চলে এসেছে কাঙ্খিত দিনটি। কাঙ্খিত! শুধুমাত্র নোরার জন্যই আকাঙ্ক্ষিত ইরিন তো মনে মনে চাইছিলেন ছেলে তার সাথে থাকবে বউ নিয়ে অন্তত এক বাড়িতে না হোক এক দেশেই! কিন্তু না নোরা আসবে না তার উজ্জ্বল ভবিষ্যত ছেড়ে তাই স্যাক্রিফাইসটা ময়ূখ আর পরিবারকেই করতে হচ্ছে৷ ইরশাদের আগে থেকেই এক সপ্তাহের ছুটির এপ্লাই করা ছিল হানিমুন ট্রিপে কিন্তু সে ডেট যেহেতু আম্মুর জন্য পেছাতেই হবে তাই সে ঠিক করল জানুয়ারির ঊনত্রিশ তারিখ থেকে ছুটি কাটাবে। ময়ূখের ফ্লাইট ত্রিশ তারিখ তাই আটাশ তারিখ রাতে সে মৈত্রীকে নিয়ে যাবে রাজশাহী। ময়ূখকে এয়ারপোর্টে ছেড়ে সে রাতেই আবার তারা রওনা হবে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। হাতে চারদিন সময় নিয়ে পাহাড়ের বুকের আবেশে হারাবে দুজন তারপরই সেখান থেকে সরাসরি সিলেটে এসে উঠবে এমনটাই ঠিক হলো। মৈত্রী সকালেই দুপুরের রান্না শেষ করে ব্যাগ গোছাতে বসলো। দুটো লাগেজ নিতে চাইলে ইরশাদ বলল, কোন দরকার নেই। বোঝা টেনে চলতে ফিরতে একদমই ভাল্লাগে না তারওপর বউ সাথে থাকবে। তার চেয়ে ভালো হয় একটা বড় দেখে ট্রলিব্যাগ গোছাও কিন্তু বিপত্তি অত বড় ব্যাগ নেই এখানে। আলমারি থেকে ইরশাদের কাপড় বের করে তাকে কল দিলো মৈত্রী।
“আরেহ আজ ভর দুপুরে বউয়ের কল এলো? বিশেষ কিছু রান্না হলো নাকি!”
“একদমই না। আজ শুধু মাছ ভাজা আর ভাত হয়েছে কিন্তু আপনি বলেন আপনার কি কি গোছাব?”
“যা ভাল্লাগে নিয়ে নাও।”
“তা কি করে হয়? ওখানে কেমন শীত, কেমন পোশাক পরবেন তা ঠিকঠাক বলুন না।”
“আচ্ছা বলছি, প্রথমেই একটা লুঙ্গি, ফুলস্লিভ টি শার্ট নাও দুইটা ওই যে সাদা আর কালোটাও নিও রাউন্ড নেক।”
“আচ্ছা আর শার্ট?”
“শার্ট তো সব অফিসের গুলাই আছে এখানে বাড়ি গিয়ে দেখতে হবে কিছু আছে কিনা! আর শোনো আন্ডারওয়্যার, মোজা এবং অবশ্যই বেল্ট এই জিনিসগুলো একদম হাতের কাছে রাখবে।”
“পারফিউম এর কথা তো ভুলেই গেলেন।”
“উফ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস মনে করালেন বেগম সাহেবা থ্যাংক ইউ উম্মাহ্।”
“আরেহ আরেহ অফিসে বসে এসব কি!”
“বউয়ের জন্য এসব সব জায়গায়ই চলে এবার ফোন রাখুন প্লিজ আজ বস এসেছে অফিসে বাই।”
“বাই”
মৈত্রী কল কে-টে আবারও কাজে মন দিল। কাজ করতে করতেই মনে পড়লো সেদিনের কথা যেদিন তাদের হানিমুন ট্রিপ নিয়ে ইরিন ক-ঠি-নরকম বাধ সাধলেন। ইরশাদ যখন মৈত্রী আর তার মায়ের ভিডিও কলে বলা কথা শুনে মৈত্রীকে প্রশ্ন করেছিল, কিসের কথা বলছে আম্মু? মৈত্রী আমতা আমতা করে বলেই দিয়েছিল আম্মু আর মামনি গুড নিউজ শুনতে চায়। ইরশাদ খুব করে রিয়াক্ট করেছিল, ” এজন্যই কি তুমি প্রোটেকশনের ব্যপারটা এভোয়েড করতে চাইছিলে এতদিন?”
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের সবরকম জড়তা ছাড়িয়ে গেছে তাদের জীবনে তবুও সেদিন ইরশাদের প্রশ্নে মৈত্রীর খুব লজ্জা লাগল। ইরশাদ অ-ধৈ-র্য্য সে উত্তর শুনতে চায় মৈত্রীও শেষতক কথা লুকাতে পারেনি। মাথা নেড়ে জানালো “হ্যা” কারণ, আম্মু আর মামনি দুজনেই বলেছেন, তোমাদের বয়স একদম পার্ফেক্ট প্রথম সন্তানের জন্য আবার বিভিন্ন কারণে পরে সমস্যাও হয় আজকালকার মানুষদের। ইরশাদ নেয়াহেতই বি-র-ক্ত হয় মৈত্রীর কাছে সব শুনে। বাচ্চার শখ তো তার নিজেরও আছে তাই বলে এত তাড়া দেওয়ার কি আছে। সামনেই মৈত্রীর দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা এ সময়টা কোন স্ট্রেস না আসুক। পরীক্ষাটা শেষ হলেই না হয় চেষ্টা করবে। মৈত্রীর খুব বেশিই লজ্জা লাগছিল এসব নিয়ে কথাবার্তা বলতে তবুও ইরশাদ যেভাবে ধমকে ওঠেছে তাতে ভ-য়-টাও কম লাগেনি। এখন কাপড় গোছাতে গোছাতে সেসব ভেবেই মুখে হাসি এলো। কাজের জন্য যে ভাবী আসেন তিনি ঘর মোছা শেষ বলে মৈত্রীকে বলতে এসেছিলেন চলে যাচ্ছেন। কিন্তু তাকে একা একা হাসতে দেখে এগিয়ে এসে বলল,
“ইয়া আফনে হাসইন তাও আবার এখলা এখলা ! আফনে হাসতেও জানইননি না জ্বিনে ধরিয়া হাসার ?” (“ওমা আপনি হাসছেন তাও আবার একা! আপনি হাসতেও জানেম নাকি জ্বিনে ধরে হাসাচ্ছে?”)
মহিলাটি আঞ্চলিক ভাষায় এটুকু বলেই আবার বলল, “কাম শেষ আমি যাইরাম গি ভাবি”
মৈত্রী প্রথম বাক্যের শুধু হাসি আর জ্বীন শব্দদুটোর অর্থই বুঝতে পারলো কিন্তু পুরো বাক্যটা আন্দাজ করে নিলো। তারপরই মনে হলো সত্যিই তাকে জ্বীনে ধরেছে নইলে সে এভাবে হাসে নাকি! কাপড় গোছানো বলতে শুধু ইরশাদেরই কয়েকটা গোছানো হল। ইরশাদ বলেছে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য শাড়ি, সেলোয়ার-কামিজ দরকার নেই তুমি লং কূর্তিটুর্তি কিছু নিয়ে নাও তারওপর চাদর বা জ্যাকেট কিছু তো থাকবেই। কিন্তু এখানে মৈত্রীর তেমন কাপড় হাতে গুণে দুটো ইরশাদই কিনেছিলো কয়েকদিন আগে। বাড়িতেও যে খুব একটা আছে তা নয় সে তো বরাবরই কামিজে অভ্যস্ত। তবুও খালামনির দেওয়া ভালো টপ, প্যান্ট আর চমৎকার শীতের পোশাকও আছে। বাড়ি গিয়ে আবার বাপের বাড়িও যেতে হবে কাপড়গুলোর জন্যই এসব ভেবেই মৈত্রী অস্থির হচ্ছে৷ হাতে সময় কম অথচ কত কাজ বাকি! সারাটা দিন এই করব, সেই করতে হবে। ঘরের সব ঠিকঠাক করে রাখা আছে কিনা! সে সাতদিন না থাকলে ঘরের কিছু ন-ষ্ট হবে কিনা এসবের খেয়ালেও মৈত্রী অ-স্থির। ইরশাদ সন্ধ্যায় ফিরতেই মৈত্রীকে দেখে অবাক হলো৷ এত অল্প সময়েই একটা মেয়ে তার সংসারে ঠিক কতোটা জুড়ে গেলে এমন চঞ্চল হতে পারে! মৈত্রীর যে টান জমেছে সংসারের প্রতি তা যেন তার ছটফট করা দেখেই বুঝে নিলো ইরশাদ। মুখ হাত ধুয়ে ডাইনিং টেবিলের সামনে গিয়ে ইরশাদ ডাকল,
“মৈত্রী”
“জ্বী!”
“খাবার দাও।”
“আনছি ” বলেই মৈত্রী ভাত, শিমের ভর্তা আর ডিম ভুনা বেড়ে দিল। ইরশাদ প্লেটে ভাত, ভর্তা নিয়ে মেখে মৈত্রীকে আবার ডাকলো, “এখানে একটু বসো তো!”
মৈত্রীও বসলো ইরশাদের দেখানো তার পাশের চেয়ারটিতে৷ ইরশাদ ভাতের লোকমা তুলে ধরলো মৈত্রীর মুখের সামনে৷
“হা করো, এত কেন চিন্তিত হচ্ছো বলো তো!” আমাদের ঘরে তেমন কোন কিছুই নেই পঁচে গলে ন-ষ্ট হওয়ার মত৷ কাঁচা বাজার শেষ তুমিই তো সকালে বললে। ফ্রিজে মাছ- মাংস কিছু থাকলে সেগুলো চাইলে কেয়ারটেকার চাচার বাড়িতে দিয়ে দিব তারা খেয়ে নেবে কেমন! আর আমার পাখিগুলো তো আনিইনি তাই টেনশন নেই। যাওয়ার সময় ঘরদোর সব ঠিকঠাক লাগিয়ে নেবো। বাইরের বাগানের গাছেদের জন্য মালি চাচা তো আসবেনই।” কথাগুলো বলতে বলতেই ইরশাদ একবার মৈত্রীর মুখে তো একবার নিজের মুখে খাবার তুলছে। খাওয়া শেষে মৈত্রী রান্নাঘর সাফ করে থালা-বাটি সব ধুয়ে রাখলো৷ ইরশাদও ততক্ষণে ফ্রিজে থাকা কিছু মাছ আর একটা মুরগি ছিল তাই ব্যাগে ভরে চলে গেল কেয়ারটেকারের বাড়ি৷ ভদ্রলোক ইরশাদের কাছ থেকে সেগুলো নিতে বেশ ইতস্তত করছিলেন তা বুঝতে পেরে সে বাড়ির মহিলাকে খুঁজে হাতে দিল৷ তারপরই মনে হলো ঘরদোর মোছে যে মহিলাটি সেও তো বেশ অভাবি এগুলো কি তাকে দিলেই বেশি ভালো হতো না! কিন্তু ততক্ষণে আর উপায় নেই সেগুলো নেওয়ার। মনে মনে খা-রা-প লাগলো বলেই ভাবলো কিছু টাকা বেশি দিয়ে দেবে এ মাসে৷ বাড়ি ফিরে মৈত্রীকে তৈরি হতে বলে ইরশাদও তৈরি হয়ে নিলো। দশটার মধ্যেই বাস স্টপেজে থাকতে হবে হাতে সময় কম৷ দুজনেই তৈরি হয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাসে চড়লো৷
“ময়ূখ! ভাইজানের ফোন ধরছিস না কেন?” ফখরুল সাহেব ফোন হাতে ময়ূখের রুমে ঢুকেই প্রশ্ন করলো। তার গোছগাছ শেষ হয়েছে আজ বিকেলেই। ইরিন নিজে দু লাগেজ গুছিয়েছে ময়ূখের সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে। কা-ন্না করবে না বলে বলেই বারংবার কেঁদে চলছে সে। সন্ধ্যা থেকে তো দরজা এঁটে কাঁ-দ-তে বসেছে আর তাতেই ময়ূখের মন বি-ক্ষি-প্ত হয়ে আছে। আবরার অনেক বার কল দিলেও ময়ূখ কথা বলেনি। আম্মার কা-ন্না তার কিছুতেই স-হ্য হচ্ছে না এই দুনিয়াদারি দিয়ে কি হবে! মন বলছে বাদ দেই এ যাওয়া। নোরার ইচ্ছে হলে নিজে আসুক পরক্ষণেই মনে হচ্ছে না গেলে কিছুতেই ভাল হবে না। মৈত্রীকে সে ভুলতে পারেনি একফোঁটাও। দেশে থাকা মানে সকল উৎসব, আয়োজনে কাছাকাছি থাকবে আর বেহায়া মনটা সবচেয়ে বড় পা-প-টাই করবে৷ নোরার কাছে গেলে হয়ত তার সঙ্গ পেয়ে এই পাপী মনের পাপিষ্ঠ ভাবনাগুলো মিলিয়ে যাবে কোথাও এমন ভাবনাতেই যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে সে। কিন্তু আম্মার কা-ন্না যে বুকটা এফোড় ওফোড় করে দেয়। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আম্মার ছায়াতলে তার প্রশান্তির হাওয়া মিলেছে তা আর কোথাও মিলবে না। ফখরুল সাহেব নিজেও ময়ূখের অবস্থা বুঝতে পারছেন। হাতে থাকা ফোনটা এগিয়ে দিলেন, “নে ভাইজানের সাথে কথা বল। কথা শেষ করে খেতে আয়।”
ঘরের চারপাশে চোখ বুলায় ময়ূখ৷ বাতি জ্বলছে তবুও অন্ধকার সবটা এমন কেমন লাগছে! অন্যমনস্ক ভাবেই আব্বুর নম্বরে ডায়াল করে। প্রথম কলেই রিসিভ হয় কিন্তু ওপাশ থেকে মেহেরের কান্না আসছে।
“হ্যালো, মেহের! কি হয়েছে মেহের তুই কাঁদছিস কেন? আব্বু কোথায়?”
“তুমি যেও না ভাইয়া৷ আব্বু ক-ষ্ট পাচ্ছে, আমিও পাচ্ছি৷ তুমি আমাদের কাছে চলে এসো ভাইয়া।”
“এ্যাই বোকা কাঁদছিস কেন আমি তো চলে আসব আবার।”
“না ভাইয়া যেও না তুমি গেলে আর আসবে না আমি জানি।”
“ধুর পাগল! আমার বাড়ি এখানে না এসে কোথায় থাকব? তোর ভাবীর কাছেও তো যেতে হবে তাই না! কাঁদে না বোন আমার আমি বেড়াতে যাচ্ছি আবার চলেও আসব দেখিস।”
ময়ূখ বোনকে কত কি বলে বোঝাচ্ছে অথচ তার নিজের মনটাই বলছে যাস না সেখানে৷ কিন্তু , এভাবে কি চলতে পারে! সংসারটা তো করতেই হবে তার৷ নোরাকেই’বা ক-ষ্ট দেবে কেন মেয়েটা তাকে ভালোবাসে। ময়ূখ আরও অনেক কিছুই বলে নিজের মনকে। রাতে খাবার খেতে ইরিন বের হলো না ঘর থেকে তাই ময়ূখেরও খাওয়া হলো না, হলো না ফখরুলেরও। ঘরের তিনটি মানুষই সে রাত না খেয়ে পার করলো। ইরশাদরা এসে পৌঁছুলো পরের দিন দুপুরে। হাতে সময় কম তবুও মৈত্রী এসেই নিজে রান্নাবান্নায় নেমে গেল। শ্বাশুড়ির চোখ-মুখ দেখতেই বুঝতে পেরেছে তিনি ঠিক কতোটা ভে-ঙে পড়েছে৷ রান্না শেষ হতেই ইরশাদ জোর করে মা আর ময়ূখকে খাবার খাওয়ালো। সন্ধ্যের দিকে আবার মৈত্রীকে নিয়ে গেল তার বাপের বাড়ি৷ এত ছুটোছুটির মাঝে মৈত্রীর ভয় ছিল অসুস্থ হয়ে পড়ার কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। শুধু ক্লান্তিটাই একটু বেশি ছিল সেটাও উবে গেল রাতে ভালো ঘুমাতে পেরে। ময়ূখের সাথে এয়ারপোর্টে ইরশাদ ছাড়া আর কাউকে নেওয়া হলো না৷ ইরিন কান্নাকাটিতে একদমই নিজের মধ্যে নেই বলেই তাকে নেওয়া হয়নি, ফখরুল সাহেবও তাঁর ভিন্ন ছিলেন না। ময়ূখ যে তাঁর জন্য নিজের সন্তানই ছিলো। আবরারের চেয়ে বেশি তিনিই ক-ষ্ট পাচ্ছেন ময়ূখের এই বিদেশ বিভূঁইয়ে কিন্তু সিদ্ধান্তটাও যে তিনিই নিয়েছেন৷ ভেবেছিলেন ইরশাদের জীবনটা অগোছালো আর ময়ূখটাকেই দেখবেন গোছালো জীবনে। কিন্তু কি এক অজানা, উন্মাদ হাওয়ায় মোড় বদলে গেল ছেলে দুটোর জীবনের। ইরশাদকে দেখে অন্তর এখন প্রশান্তি পায় কিন্তু ময়ূখটার সাথে কেন এমন হলো! ক-ষ্ট পান ভেবে ভেবে কিন্তু কি করবেন সেটাও তো জানেন না।
চলবে