কি ছিলে আমার পর্ব-৩১+৩২

0
1827

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩১

পার্লারে এক সারিতে বসা ভূইয়া বাড়ির চার বউ। প্রথমে জুয়েনা তারপর নিপা এরপর সায়রা এবং তারই পাশে মৈত্রী। আজ ময়ূখের রিসেপশন বলে জুয়েনা ভেবেছিল তারা চার জা মিলে শাড়ি পরবে কিন্তু নিপা ছোট মানুষ জোরাজোরি করে লেহেঙ্গা পরবে বলে ঠিক করেছে। দুই সন্তানের পর জুয়েনার শরীরে মেদ জমে একদমই গোলগাল হয়ে গেছে। নিপারও মেয়ের পর এখন একটু একটু ভারী শরীর শুধু সায়রারই ছেলের জন্মের পরও শরীরের কোথাও বাড়তি মেদ চোখে পড়ে না। উল্টো বয়স আটাশের ঘর পেরিয়েও কেমন বিশ বছরের যুবতীর মত দেখায় তাকে। লেহেঙ্গা পরে চারজনই যখন তৈরি তখন বিউটিশানরা প্রায় একত্রে বলে বসলো, “আপনাকে একদম বলিউড হিরোইনদের মত লাগছে ম্যাম।”

সায়রা অপ্রস্তুত হলো এমন প্রশংসায়৷ এই প্রথম নয় সব সময়ই সে এমন প্রশংসায় পূর্ণ থাকে৷ আজ সে বাড়িতেই সাজতে চেয়েছিল কিন্তু বড় জা’য়ের বারংবার আদেশ আর নিপার আবদারে আসতে বাধ্য হয়েছে। ইমরানও চাইছিলো সে পার্লারে আসুক তাইতো আগেভাগে ছেলেকে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছে। মৈত্রীর সাথে তার দেখা হয়েছিল গেইটে এসে। বড় জা একে একে সবাইকে গিয়ে গাড়িতে উঠতে বলেছে। নিচে এসে যখন মৈত্রীকে দেখলো তখন সে এগিয়ে এসেছিলো কেমন আছে তা জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু হঠাৎই ইরশাদ নেমে এলো ওপর থেকে ব্যাগ হাতে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই সে তার স্ত্রীকে ডেকে বলল, “লেহেঙ্গার ব্যাগটাই তো নিয়ে আসোনি মৈত্রী।”

“স্যরি, আমি আসলে নোরার ব্যাগটা নিয়েছি বলে খেয়াল ছিলো না ওটার কথা।”

সায়রা চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল৷ চোখাচোখি হলেই ভেতরে একটা অ-গ্নিব-র্ষণ হয় আজও৷ ভয় হয় এই বুঝি ইরশাদ তাকে লোক সম্মুখে প্রতারক বলে গা-লি দিয়ে বসবে। আসলে তেমনটা তো হয়েও ছিলো একবার তাই ভ-য়-টা আজও তাড়া করে খুব। কিন্তু ইরশাদ তাকে দেখেও কেমন অদেখা করে স্ত্রীর ব্যাগটা গাড়িতে রেখে চলে গিয়েছিল। মৈত্রী তখনই কেমন করে যেন ধরে নিলো এ দুজনের মাঝে কোন গ-ভী-র এক রহস্য লুকিয়ে আছে। পার্লারে সবাই যখন সায়রার সৌন্দর্যের প্রশংসা করছে তখন মৈত্রীও বলল, ” দারুণ লাগছে ভাবীকে৷ সায়রা ভাবী সত্যিই অনিন্দ্য সুন্দর একজন মানুষ।”

“হু এজন্যই তো ইরশাদ ভাই…”
নিপা কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই তার হাতে চিমটি কে-টে কথা ঘুরিয়ে ফেলল জুয়েনা। এদিকে সায়রারও শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেছে ভয়ার্ত এক স্রোত। নিপা কি বলতে যাচ্ছিল এখনই! চোখ বন্ধ করে নিয়ে এমনই ভাবছিলো সায়রা আর জুয়েনা বলে,
“হু এজন্যই ইরশাদ, অন্তু ইমরানকে বউপাগল বলে ক্ষে-পা-য়। সায়রার জন্য তো বেশ পাগল আমার দেবরটা।”

জা’য়েরা ঠিক যতখানি কথার আড়াল তুলল ততোটা কার্যসিদ্ধি হয়নি তাদের৷ মৈত্রী বাইশের বুদ্ধিসপ্পন্না তরুণী সে আন্দাজ করেই নিলো তার স্বামী আর মেজো জা’য়ের মধ্যে কিছু একটা আছে অথবা অতীতে ছিল। কিন্তু সেই অতীতটা নিজের মত ভাবতে গিয়ে কেমন গা গুলিয়ে উঠলো তার। মনে মনে প্রার্থনা করলো তার ভাবনা যেন ভু-ল হয়। চার বউয়ের সাজ প্রায় একই সময়ে শেষ হয়েছে। মৈত্রী এবার খোঁজ করল নোরার কতটুকু হয়েছে। তারা চার জন একই ফ্লোরে থাকলেও নোরা ছিল অন্য ফ্লোরে। নোরার কথা জানতে চাইলে একজন এসে জানালো নোরা পার্লারে নেই। সে একটু আগেই শপিংয়ে গেছে। মৈত্রীসহ বাকিরাও বেশ অবাক হলো। মেয়েটা তাদের কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল! মৈত্রী ফোন বের করে প্রথমে নোরাকে কল করতেই জানালো সে অন্য পার্লারে গেছে ময়ূখের সাথে। বরের সাথে কনে গেছে এখানে কারো ভাববার কিছু নেই বলেই মনে করলো সবাই৷ তারা এবার সরাসরি কনভেনশন হলে চলে গেল।

হলের ভেতর আত্মীয় সমাগম ঠিক ইরশাদের বৌভাত অনুষ্ঠানের মতই। ফখরুল সাহেব বড় অল্প সময়েই নিজের জ্ঞাতিগুষ্ঠি, ময়ূখের নানাবাড়ি সবাইকে দাওয়াত করেছেন। আবরার খন্দকার কাল রাতে এসেছে পরিবার নিয়ে একদমই মেহমান সেজে। খাওয়া-দাওয়ার পর আবার চলেও যাবেন। ইরিনের এ নিয়ে জো-র জ-ব-রদস্তি নেই তবে মেহের মায়ের শরীরের কথা ভেবে তিনি থাকতে বলেছিলেন। মেহের মুখের ওপর বলে বসলো, তার সামনের মাসেই পরীক্ষা এখানে ন-ষ্ট করার মত সময় তার হাতে নেই। একমাত্র ইরশাদ বুঝেছিল এমন ধাঁচের কথার পেছনের কারণটা তাই ইচ্ছে করেই মা’কে থামিয়ে দিয়েছে সে। হল জুড়ে যখন মেহমানের কোলাহল তখন কনে নেই সেখানে। ময়ূখ আর ইরশাদ এক সঙ্গেই তৈরি হয়ে এসেছে৷ মৈত্রী এসে ইরশাদের পাশে পাশেই আছে। অনেকটা সময় বিলম্ব করে ময়ূখের ফোনে বার্তা এলো নোরাকে আনতে যাওয়ার তার সাজগোছ শেষ হয়েছে বলে। ময়ূখ বিউটি পার্লারের নিচে দাঁড়াতেই নোরা এগিয়ে এলো তার কাছে। স্বাভাবিক মুখশ্রী হঠাৎই বদলে শ-ক্ত হয়ে উঠেছে ময়ূখের। পরশুই তো ময়ূখ তাকে সাথে নিয়ে তারই পছন্দে লেহেঙ্গা কিনল অথচ মেয়েটা তা পরেনি৷ কালো লং ব্যাকলেস গাউন, গলার সামনেটাও মোটামুটি বড় যার দরুণ ক্লিভেজ স্পষ্ট, গায়ে ইরিনের দেওয়া কোন গয়নাই সে ধারণ করেনি। হোয়াইট ডায়মন্ড নেকপিস, হাতে সেই রিংটাও নেই যেটা পরশু ইরিন এনগেজমেন্ট হয়নি বলে এমনিতেই পরিয়েছিল। ময়ূখের মে-জা-জ অল্পতেই যেমন গরম হয় তেমনই সে তা নিয়ন্ত্রণেও রাখতে পারে। কিন্তু এ পর্যায়ে তার তিল পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না।

“কেমন লাগছে আমাকে?”
হাস্যজ্জ্বল মুখে জানতে চাইলো নোরা।

“এসব কি পরেছে?”

“ভালো লাগছে না!”

“নোরা, এটা ইউরোপ-আমেরিকা না সে কথা কি তুমি ভুলে গেছো?” বোধকরি, রা-গ সংবরন করতেই ময়ূখ দাঁতে দাঁত চে-পে বলল কথাটা। নোরাকে নিতে আসবে বলে আব্বুর গাড়িটা নিয়ে এসেছিল সে পকেট থেকে চাবিটা নোরার দিকে ছুঁ-ড়ে মারল। নোরাও এক থাবায় সেটা মুঠোবন্দী করে নিতেই ময়ূক আবার মুখ খুলল, ” এক্ষুনি এই মুহূর্তে বাড়ি গিয়ে ড্রেস বদলে ঠিক ত্রিশ মিনিটের মধ্যে হলে পৌঁছাবে। এন্ড ইউর টাইম স্টার্ট নাউ।”

নোরা কিছু বলবে তার আগেই সে একটি খালি রিকশা পেয়ে উঠে বসলো তাতে। নোরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে রইলো কিছু সময়। পার্সের ফোন বেজে উঠতেই তার হুঁশ হলো সে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে কিছু চোখ সানন্দে উপভোগ করছে বিদেশীনিরূপি পশ্চিমা পোষাক পরিধেয় মেয়েটির দেহ৷ নোরা অনেকটা সময় পার করে তবেই হলে পৌঁছেছে তবে সে বাড়ি যায়নি। তার সাথেই তো ছিল রিসেপশনের জন্য কেনা লেহেঙ্গাটা সেটাই আবার পরেছে গাড়িতে। মনে মনে বুঝি একটা পণও করে বসলো। ময়ূখকে এই দিনটির জন্য শা-স্তি তাকে পেতেই হবে এমনটাই তার আপাত ভাবনার বিষয়। হলে তাকে দেখে সবাই বিভ্রান্তিতে পড়লেও ইরিন বুদ্ধিমতি সে তৎক্ষনাৎ লোক সম্মুখে ময়ূখের একসাথে না আসার পেছনে একটা যুক্তি দাঁড় করিয়ে ময়ূখকে ফোনে ধরল। ময়ূখ এসে অব্দি চমৎকার হাসিখুশি ভাব বজায় রেখে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টেনেছে৷ সন্ধ্যা মুহূর্তে মৈত্রীই ইরশাদকে মনে করিয়ে দিলো নোরা চলে যাবে একটু পর তাই ময়ূখ আর নোরাকে একটু স্পেস দেওয়া দরকার। ইরশাদও তাই করলো; বাড়ি ফিরে আম্মুকে বলে ঘরের ভিড়ভাট্টা কমিয়ে দিলো। কিন্তু নোরা বা ময়ূখ কেউই সময়টুকু নিলো না নিজেদের করে। নোরা ঘরে ঢুকে প্রথমেই পোষাক বদলে জিন্স, ক্রপটপ তার সাথে হুডি পরে খুবই নরমাল হয়েছে। ময়ূখ শার্ট, কোট খুলতে খুলতে নোরাকে দেখলো। কিছুদিন আগেও নোরার দৃষ্টিতে সে অন্যকিছু দেখেছিল যা এখন আর নেই। তার বারংবার মনে হয় নোরা কোন সমস্যায় ভু-গছে৷ পাওয়ার লোভ এবং পেয়ে গেলে তি-ক্ত-তা বোধ করার সমস্যা অস্বাভাবিক কিছু না। বিজ্ঞানের ভাষায়ও এমন একটা মানসিক রোগ আছে কিন্তু নোরার আচরণ একেক সময় একেক রকম। ময়ূখ গায়ে টি শার্ট গলিয়ে নিজেও হুডি পরেছে। প্যান্ট বদলে বাড়িতে পরার একটা ট্রাউজার পরে পায়ে হাওয়াই চপ্পল। নোরাকে এয়ারপোর্টে ছাড়ার জন্য সে গাড়ি রিজার্ভ করলেও তা আর প্রয়োজন হয়নি তার আব্বুর জন্য৷ আবরার খন্দকার ছেলের ওপর রে-গে থাকলেও তার আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজনে অনেক কিছুই করেছেন তার মধ্যে একটা গাড়িও এনেছিলেন ঢাকা থেকে ড্রাইভারসহ। ময়ূখ প্রথমে রাখতে না চাইলেও প্রয়োজনের কয়েকদিনের জন্য রেখেছে। প্রয়োজন বলতে এই অনুষ্ঠানে এবং ইরশাদ -মৈত্রীকে নিয়ে সিলেটে যাওয়ার জন্যও প্রয়োজন। নোরা বেরিয়ে যাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো। গত কয়েকদিনে তাদের মাঝে পরিবর্তন বলতে শারীরিক সম্পর্ক করা আর দুজনের একটু আধটু যত্ন নেওয়াটাই ছিল বিশেষ৷ এই যাওয়ার মুহুর্তে ময়ূখের হঠাৎই মনে হলো তার স্ত্রী চলে যাচ্ছে। তার কি কিছু বলা উচিত নয় তাকে! অন্তত বন্ধুর মত কিছু ফেয়ারওয়েল ওয়ার্ডস কি তাকে দেওয়া যায় না! ময়ূখ যখন এমনটা ভাবছে তখন নোরা উল্টো ফিরে এসে তার ঠোঁট ছুঁয়েছে৷ ঘোর কে-টে-ছে বাঁধও ভে-ঙে-ছে ভেতরের। ময়ূখও এবার নিজের মাঝে জড়িয়ে বে-পরো-য়া চুমুতে ভরিয়ে দিলো স্ত্রীকে। হতে পারে দুজনই সাময়িক মোহে একে অপরের কাছে আ-ত্মস-ম-র্প-ণ করলো তবে এই করাই প্রকৃতির কিছু ছন্দ আপন সুরে বেঁধে নিলো নিজেদের।

নোরার ফ্লাইট ডিলে হয়েছে। সে প্লেনে চড়েছে রাত তিনটেয়। ময়ূখ পুরোটা সময় ওয়েটিং প্লেসে কা-টিয়েছে। নোরা আগেই ভেতরে চলে যাওয়ায় দুজন ছিল দু জায়গায় তবুও ময়ূখ বসেছিল৷ প্লেন রানওয়ে ছেড়ে আকাশ ছোঁয়ার পরই ময়ূখ ফিরেছে বাড়িতে আর তারই জন্য অপেক্ষায় রাত কে-টে-ছে ইরিনের। ময়ূখের জীবনটা যেন একা ইরিনেরই হাতে থাকা কোন ডাঙায় ছটফট করা মৎস্য। প্রতি মুহূর্তে কেমন অজানা এক আ-ত-ঙ্কে ডুবে আছে সে এই বুঝি মাছের প্রাণটা বেরিয়ে যাবে৷ আর তার প্রাণ যেতেই ইরিনে বুকটা খালি হয়ে যাবে। এ ভয় তো আগে কখনো ছিল না তার। হঠাৎ আসা ঝ-ড়ো হাওয়া সব কেমন নড়বড়ে করে গেল। ইরিন মনে মনে সেই ঝড়ো হাওয়াটার উৎসটা প্রতিনিয়ত খুঁজে বেড়াচ্ছে আর ভেতরে ভেতরে কেমন গু-মো-ট হয়ে আছে। ময়ূখ বাড়ি ফিরে ইরশাদকে কল করতেই যাচ্ছিলো তখন চোখে পড়লো দরজার নিচে একটুখানি আলোকরেখা। কেউ কি জেগে আছে! কৌতূহলী হয়ে দরজায় খুব ধীরে টোকা দিলো দু’বার। মুহূর্ত ব্যয় না করে ইরিন দরজা খুলতেই ময়ূখ বিষ্মিত হয়ে প্রশ্ন করলো, “আম্মা ঘুমাওনি?”

“তোরা কেউ জেগে থাকলে আমার ঘুম আসে না।”

ময়ূখ বিচলিত হয়ে আম্মার চোখ মুখ দেখলো। কেমন ফ্যাকাশে লাগছে আম্মাকে যেন শরীরে র-ক্ত-বিন্দু শূন্যের কোঠায়। ময়ূখ দু হাতে আম্মাকে ধরে সোফায় গিয়ে বসলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “কি নিয়ে এত চি-ন্তা করো বলো তো! কতগুলো দিন ধরে আমি একটু বেখেয়াল হতেই তোমার শরীর এমন কেন হলো?”

“বেখেয়াল কেন হলি বাবু?” প্রশ্নটা করতে গিয়ে কা-ন্না-য় গলা কেঁ-পে উঠল ইরিনের। কান্নার ঢেউ যে তার গলদেশ ছাপিয়ে আসতে চাইছে তা বুঝতেই আম্মাকে বুকে জড়িয়ে নিলো।

“কি হয়েছে আম্মা তুমি এত ভয় পাচ্ছো কি নিয়ে। এই যে আমি তো তোমার কাছে আছি বলো কি হয়েছে তোমার?”

“তোকে আমি এই এতটুকু থাকতে বুকে তুলে নিয়েছি। তোর হাসি দেখলে আমার খুব আনন্দ হয় বাবা বিশ্বাস কর তোর চোখ এমন মৃ-ত মাছের মত সাদা দেখার পর থেকেই আমার আত্মা কাঁদে। মনে হয় ম-র-ণ এসে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।” বলতে বলতে এবার হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো ইরিন। ময়ূখ আম্মাকে বুকের সাথে মিশিয়ে শা-ন্ত করতে চাইলো। ততক্ষণে ইরশাদ, মৈত্রী আর ফখরুল সাহেব তিনজনই নিজ নিজ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। ইরশাদের ঘর থেকে বসার ঘরের আওয়াজ কুব একটা শোনা যায় না। ফজরের সময় প্রায় হয়েই এসেছে বলে ইরশাদের ঘুম হালকা হয়েছে আর তাই বোধহয় তেমন কান্নার আওয়াজটা কানে এসেছে। তড়িঘড়ি করে ইরশাদ বিছানা ছাড়তেই মৈত্রীরও ঘুম ভে-ঙে গিয়েছে। ইরশাদের অস্থি-র হয়ে বের হওয়া দেখে সেও বেরিয়ে এসেছে বাইরে। ইরিনের কান্নার অর্থ বোধগম্য হতেই সবাই স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। সময় দিলো তাকে কেঁ-দে হালকা হোক। বাড়ির সকলেরই জানা ইরিনের বর্তমান মানসিক অবস্থা। ফজরের নামাজের পর সবাই আবারও ঘুমের জন্য যার যার বিছানায়। ইরশাদও সবে শুয়েছে বিছানায় ভেবেছিল মৈত্রী এবার শুয়ে পড়বে কিন্তু না সে আর শোয়নি। বারান্দার দরজা খুলে নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়ালো। ভোরের আলো তখনও কুয়াশার বেড়াজালে আটকে আছে দূর আকাশেই। মৈত্রী কুয়াশায় দৃষ্টি রেখে ভাবছে কাল রাতের কথা৷ সে কি খুব বেশিই রিয়াক্ট করে ফেলেছিল! নাকি উচিত ছিল খোলাখুলি মনের ভাবনাটা ইরশাদের সামনে উপস্থাপন করা! ভেবে ভেবে কোন কূল পায়নি সে তার আসলে কি করা উচিত। রাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মৈত্রী যখন তার গহনা খুলছিল তখন ইরশাদ ঘরে ঢুকেছে। গায়ের কোট খুলে চেয়ারে রেখে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে দাঁড়িয়েছিল আয়নার সামনে মৈত্রীর ঠিক পেছনে। মৈত্রীর হাত তখন গলার জড়োয়া খোলার চেষ্টায়৷ ইরশাদ তার হাত দুটো সরিয়ে নিজেই খুলে দিলো জড়োয়ার হুক৷ মাথা নিচু করে মেত্রীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে জানায় কতোটা সুন্দর লাগছে আজ তার অর্ধাঙ্গিনীকে। সৌন্দর্যের প্রশংসা করে আকস্মিক ঠোঁট ছোয়ায় মৈত্রীর ঘাড়ে। ঠিক তখনই মনে পড়ে নিপার বলা কথাটা, “হু এজন্যই তো ইরশাদ ভাই…” নিপার বলা অর্ধকথাটার পূর্ণরূপ কি হতে পারে তা অবচেতন মন নিজেই সাজিয়ে নিয়েছিল ইরশাদ তার ভাবীর প্রেমে পড়েছিল! অথবা ভাবীর সৌন্দর্যে মত্ত হয়ে কোন অ-বৈ-ধ সম্পর্কও করেছিল! ঠিক এই ভাবনাতেই তার গা ঘিন ঘিন করতে লাগলো আবারও। ইরশাদকে আচমকা সরিয়ে দিলো নিজের কাছ থেকে আর ইরশাদ হতভম্ব। যখন সে সম্বিৎ ফিরে পেল তকন মৈত্রীকে প্রশ্ন করেও কোন জবাব পায়নি কেন সে এমন করলো। ঘুমাতে গিয়ে যখন আবার ইরশাদ তাকে নিজের দিকে টেনে নিল তখনও টের পেল মৈত্রী অনুভূতিহীনের মত হয়ে আছে। নিজের কোন ভুল খুঁজে পেল না ইরশাদ কেন তার স্ত্রীর এমন আচরণ৷ মৈত্রীর এমন অবজ্ঞা যেন তার পৌরুষেয় আ-ঘা-ত করলো। ঠিক সেজন্যই আর ইরশাদ কোন কথা বলছে না মৈত্রীর সাথে।

চলবে

#কি-ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩২

“মৈত্রী, খাবারের ব্যাগ রেখেছো গাড়িতে?”

“না মামনি”

“কি যে করোনা! সেটাই তো আগে দিলাম। ময়ূখ ভেতরেই আছে এখনো তাই না ওকে কল দিয়ে বলো ব্যাগটা নিয়ে নামতে।”

কথা ছিল মৈত্রী আর ইরশাদ যাবে সিলেটে৷ কিন্তু যাওয়ার আগের রাতে কি করে যেন পরিস্থিতি বদলে গেল। ইরশাদকে যে বাড়িটি অফিস থেকে দেওয়া হয়েছে সেটা মোটামুটি বড় এক বাংলো বাড়ি৷ সেখানে নতুন অবস্থায় গিয়েই দুজনে মিলে কতটুকু গোছাবে, কি করবে কি ভাবে করবে ভেবে ভেবে কিছুটা চিন্তিত ছিল রোকসানা, মুজিব। সেই চিন্তা তারা যখন ইরিনের সামনেও প্রকাশ করলেন তখন ইরিন বলল, ” আপা আমিও তেমনই ভাবছিলাম।”
ইরিন যখন ফোনে রোকসানাকে এসব বলছিলেন পাশেই ছিলেন ফকরুল। সে হঠাৎ করে বলে ফেলল, “তুমি, ভাবী আর ময়ূখও না হয় সঙ্গে যাও। শুনেছি বাড়িটা বড় তোমরা সবাই মিলে গুছিয়ে সাজিয়ে দু দিন ঘুরে ফিরেও এলে।”

কথাটা মনে ধরলো ইরিনের তাই সাথে সাথেই রোকসানাকেও জানালেন। তারা এমনটাই চাইছিলো সকলে তাই রাতেই মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেল সবাই যাবে একসাথে। ময়ূখ রাতেই বড় গাড়ি ভাড়া করলো। ময়ূখ তার আব্বুর গাড়ি নিয়ে ড্রাইভারকে রাতেই ফিরে যেতে বলল। নতুন সংসার ঘরদোরের অনেক জিনিস লাগবে তাই ইরিন তাদের ভাড়া বাড়ির আসবাব সব ইরশাদকে নিতে বলেছিলেন। বছর পাঁচেকের ফার্ণিচারগুলো এখনও চকচকে কিন্তু মুজিব সাহেব আবদার করলেন মেয়ের ঘর তিনি সাজিয়ে দেবেন। সত্যি বলতে এই দিকটা ইরশাদ কিংবা ফখরুল কারোই পছন্দ হয়নি। মৈত্রী যখন বুঝলো শ্বশুর আর স্বামী দুজনেই রাজী নয় তার বাবার বাড়ির জিনিসগুলো নিতে এদিকে বাবারও মন খারাপ হচ্ছে তখন সে সকলের সামনে মুখ খুলল, “ও বাড়ির ডাইনিং টেবিল আর কিচেন সামগ্রীগুলো আমার খুব ভালো লাগে। আন্টির রুমের আলমারিটাও খুব সুন্দর আর ফ্রিজটাও মিডিয়াম সাইজের সেগুলো নিয়ে যাই আমরা। আর বাবার পছন্দে না হয় কিছু কিনি?”

মৈত্রী কথাটা খুব ভয়ে ভয়েই বলেছিল৷ কিন্তু তার বলার উদ্দেশ্য বোধগম্য হতেই সকলে রাজী হয়ে গেল। ইরশাদ চুপচাপ শুনেছিলো তার কথা এখানে তার আর বলার কিছু নেই। যাওয়ার সময় বেছে বেছে মৈত্রীর বলা জিনিসগুলোই নেওয়া হলো। ইরশাদ তার গাছগুলো কিছু সঙ্গে নিলো আর পাখির খাঁচায় আনা নতুন এক জোড়া পাখি নিয়ে বাকি এক জোড়া আর বেছে বেছে গোলাপ আর চন্দ্রমল্লিকার দুটো টব বাড়ি রেখে গেল। ময়ূখকে বলে গেল পরের বার ঢাকা যাওয়ার সময় যেন এগুলো মেহেরের জন্য নেয়।
রাতে রওনা দিলে কারো খুব একটা ক-ষ্ট হবে না ভেবে রাত করেই বেরিয়েছে তারা। ময়ূখ ড্রাইভার এর পাশে বসেছে। পরের সিটগুলোতে বড়রা আর শেলি বসেছে। একদম পেছনের সিটে ইরশাদ আর মৈত্রীকে বসতে বলা হয়েছে। ইরশাদ চাইছিল মৈত্রী প্রথমে বসুক তারপর সে পাশে বসবে কারণ মিশুও বসবে তাদের সাথে। গত দু রাত ধরে দুজনের মধ্যকার যে দূরত্ব তার কারণ ইরশাদ এখনো জানতে পারেনি। সুযোগও হয়ে উঠেনি এ নিয়ে মৈত্রীকে আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করার। একই ঘরের দুজন হয়েও কেমন হঠাৎ এক অদৃশ্য দেয়ালের দু প্রান্তের হয়ে আছে তারা। মৈত্রী নিজেও বুঝতে পারছে তার করা আচরণটা ভু-ল। ইরশাদের সাথে কথা না বলে আগেই এমন বৈরী আচরণ সম্পর্কের ওপর কতোটা ক্ষ-তি-কা-র-ক। কিন্তু মন অবুঝ তা এখনই মানতে চাইছে না কিছু। নিজের মত নিজেকে শান্ত করে তবেই যেন ইরশাদের মুখোমুখি হবে প্রশ্ন নিয়ে। অথচ সে বুঝতেই পারছে না তার মন আসলে আগে প্রশ্নের উত্তর না জেনে শান্ত হবে না। ইরশাদের পাশে বসেনি মৈত্রী। মিশুকে বসিয়ে দিয়েছে ইরশাদের পাশে তারপর সে বসেছে। সামনের কেউ খেয়াল না করেনি জিনিসটা কিন্তু ইরশাদ কোন রিয়াক্ট না করে সেভাবেই বসে রইলো। গাড়ি চলছে গন্তব্যে ইরশাদ শ-ক্ত মুখে বসে ছিল অনেকটা সময়। হঠাৎই খেয়াল হলো মিশু ঘুমিয়ে পড়েছে মৈত্রীর কাঁধে মাথা রেখে৷ গাড়ির বাতি নেভানো সবাই চুপচাপ চোখ বুঁজে আছে। ইরশাদ কয়েক মিনিট বোধহয় লক্ষ্য রাখলো সবার অবস্থান তারপরই এক আজব কান্ড করে বসলো। দু হাতে মিশুকে কোলে তুলে ধীরে ধীরে নিজের বা’পাশে বসিয়ে দিয়ে নিজেই মধ্যখানে এসে বসলো। মৈত্রী আঁধারে ডোবা গাড়ির ভেতরই বোঝার চেষ্টা করছিল ইরশাদ আসলে করছেটা কি। কিন্তু সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে মৈত্রীকে টেনে নিজের সাথে চেপে বসে রইলো৷ ডানে বায়ে স্ত্রী আর শ্যালককে জড়িয়ে পথ শেষ হলো তার। ভোরের আলো উঁকি দিচ্ছে চা বাগান আর পাহাড়ি পথে। গাড়ির গায়ে কুয়াশার আড় মাখানো সকালে বেশিরভাগেরই ঘুম ভা-ঙ-লো। রাতটা জেগে কা-ট-লো শুধুই গাড়ির ড্রাইভার আর ইরশাদ-ময়ূখের। নোরার মেসেজ ছিল সে যে কোন সময় ফ্রী হয়েই কল করবে ময়ূখকে। সে আশায় অপেক্ষায় প্রহর কেটেছে তার। এদিকে মৈত্রীও কখন ঘুমিয়ে পড়েছে ইরশাদের কাঁধে। দু হাতে দুজনকে ধরে রেখে ঘুম এলো না তার চোখেও। গন্তব্যে যখন সবাই গাড়ি থেকে নামলো তখন প্রত্যেকেই কেমন বিষ্ময়ে তাকালো দু ভাইয়ের দিকে। ইরশাদের শার্ট বুকের দিকটা একদমই থু-ব-ড়ে আছে, বিড়াল দুটি চোখ কেমন ফ্যাকাশে আর ফোলা ফোলা৷ ময়ূখের ঝাঁকড়া এলোমেলো চুল গুলো আরও বেশি অগোছালো যেন একটু আগেই পক্ষীকূলের মেলা বসেছিল ওখানটায় আর চোখ দুটোতে রক্তাভা। কাঁচা মাটির রাস্তা ধরে চা বাগান থেকে একটু বিপরীতে পাকা এক তলা বাড়ি৷ বাড়ির চারপাশ বাঁশের তৈরি বেড়া দিয়ে ঘেরা যা ঢেকে আছে বিভিন্ন গুল্মলতা আর রঞ্জনরশ্মি গাছের সারি। বাড়ির গেইটও সেই বাঁশের তৈরি। গেইট জুড়ে জড়িয়ে আছে অপরাজিতার লতা সবুজের ফাঁকফোকরে উঁকি দিচ্ছে নীলরঙা ফুল৷ একদিকে আছে গোলাপি বাগান বিলাস গেইটের ভেতর বাহির দু দিকেই ছড়িয়ে আছে গোলাপি সেই পাপড়ি৷ ময়ূখ গাড়ির ভাড়া, বখশিশ দিয়ে ড্রাইভারকে পাশেই কোন রেস্ট হাউজে থাকতে বলে বিদায় দিলো ততক্ষণে প্রত্যেকেই বাড়ির ভেতর ঢুকেছে। মৈত্রীর তখনো গুম কা-টে-নি ঠিকঠাক সে ভেতরে গাড়ি বারান্দার মত অংশে বেতের তৈরি ফোমবিহীন সোফা দেখে তাতেই বসে পড়লো। বড়রা চারপাশে নজর বুলাচ্ছে লন সাইড, ঘরের আশপাশ সবটা জুড়ে বিভিন্নরকম গাছগাছালি। শেলি আর মিশু বাড়ির একদিকে বড় এক জামগাছ তারই পাশে লোহার শিকলে বাঁধা দোলনা দেখে বসে পড়েছে৷ ইরশাদ ফোন বের করে অফিস থেকে বাড়ির কেয়ারটেকারের যে নম্বর দিয়েছিল তাতে ডায়াল করলো৷ মাত্র মিনিট দশের মাঝেই এসে পৌঁছুলো একজন বয়স্কলোক। দাঁড়ি নেই গোঁফের জঙ্গল মুখে সাদা চুলের একজন বৃদ্ধা। লোকটা এসেই কেমন সবাইকে সালাম দিতে লাগল। বড় ছোট প্রত্যেকেই একটু অস্বস্তিবোধ করলো এমন আচরণে। বৃদ্ধা পকেট থেকে একগোছা চাবি বের করলে জানতে চাইলো ইরশাদ শাহরিয়ার কে? ইরশাদ ‘আমি’ বলতেই লোকটা চাবি দিয়ে জানালো সে নয় তার ছেলে এ বাড়ি এবং পেছনের মালিকের বাড়ির কেয়ারটেকার। এ বাড়িটাও মালিকের থাকার ছিল তবে এটা বহু পুরাতন আর এতে আধুনিক অনেক ব্যবস্থাই নেই। এ বাড়ির পেছন দিকে মানে মূল সড়কের সামনের দিকে যে নতুন দোতলা বাড়িটি সেটা নতুন মালিকের পরিবার এলে সেখানেই থাকে। আর এ কারণেই কোম্পানির নতুন একাউন্ট্যান্টকে এত বড় বাড়িটও দেওয়া হয়েছে। সাধারণ কর্মীদের মধ্যে তো বাড়ি, কোয়ার্টার কিছুই দেওয়া হয় না। ইরশাদ চাবি নিয়ে ঘর খুলে দেখলো সবটাই ঝকঝকে-তকতকে রাখা। বুঝতে পারলো অফিস থেকেই সব করিয়েছে। ভেতরে ঢুকে গেল সকলেই ব্যাগপত্র নিয়ে। মৈত্রী তখনো ঘুমে ঢুলছিল তা দেখে ইরশাদ এগিয়ে এসে একবার বড়দের খুঁজলো৷ নাহ, বাইরে কেউ নেই আর তাই ঝট করে মৈত্রীকে পাজাকোলে তুলে নিলো। আকষ্মিক এমন শূন্যে চড়তেই আঁতকে উঠে চোখ মেলতেই সে চমকালো। ইরশাদ তাকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে!

“এ একি করছেন, নামান আমাকে আব্বা আম্মা সবাই…. ”

মৈত্রী কথা শেষ করতে পারেনি। খুব সুন্দর আদুরে আদুরে চোখদুটো ভীষণ, ভীষণরকমের ক্রো-ধ দেখাতেই সে থেমে গেছে। ভয়-ভীতি আর লজ্জা ভুলতেই চোখ নামিয়ে নিয়েছে। শার্টের বুক বরাবর বোতামটিতে যেন মহামূল্যবান কিছু লু-কিয়ে আছে ঠিক এমন ভঙ্গিতেই মৈত্রী তাকিয়ে আছে সেদিকে৷ এরই মাঝে ইরশাদ তাকে একটা ঘরে এনে বসিয়ে দিলো কাঠের একটি নড়বড়ে অতি পুরাতন চেয়ারে। মুহূর্তগুলো ঠিক কতখানি সুন্দর তা যেন বুঝতে পারছে মৈত্রী আর তাইতো শত রা-গ, অপ্রকাশিত ঘৃণার দলকে ছুটি দিয়ে চোখ বুঁজে উপভোগ করতে চাইছে। হায়! মানুষটার দেহের কেমন মাতাল মাতাল এক খুশবু সম্মোহিত করে দিচ্ছে মৈত্রী। চা- বাগানে লুকিয়ে পড়া ভোরের কুয়াশা আপনা থেকেই এসে জড়ো হচ্ছে তার চোখের সামনে। সব ধোঁয়াশা শুধুই তার মনপুরুষটি উজ্জ্বল। ইরশাদও যেন টের পেল তার সহধর্মিণীর বর্তমান অনুভূতি আর তাইতো কুঁজো হয়ে ঝুঁকে এলো মেয়েটির মুখের কাছে। বিগত দু দিনের জমে থাকা সকল তৃষ্ণা ওষ্ঠপুটে নিমেষেই মিটিয়ে নিলো। ঝ-ড়ে-র গতিতে ছুঁয়ে গেছে একে অপরের ঠোঁট দুটি। ইরশাদ আর দাঁড়ায়নি সেখানে যেন তৃষ্ণা মেটানোর পর তার দাঁড়িয়ে থাকা শা-স্তিযোগ্য অপরাধ।

ইরশাদদের ফার্নিচার যে পিক-আপ ভ্যানে ছিল সেটি এসে পৌছেঁছে এখানে কিন্তু সমস্যায় পড়লো ড্রাইভারটি ঠিকঠাক এলাকা চিনতে না পারায়। ময়ূখ ফখরুল সাহেবকে ফোন করে জানালো সে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। কিছু সময়ের মধ্যে সে এসে পৌছুলো পিকআপে করেই। লোক নিয়ে একে একে ফার্ণিচারগুলো নামাতেই ইরশাদও এগিয়ে এলো৷ মহিলারা সকলেই তখন রান্নাঘরে চা আর বাড়ি থেকে নিয়ে আসা খাবার গরম করায় ব্যস্ত। ইরশাদ-ময়ূখ নিজেও লোকেদের সাথে হাত মিলিয়ে সকল আসবাব গুছিয়ে নিয়েছে। লোকগুলো আর পিকআপের ভাড়া মিটিয়ে সবাই মিলে চা-নাশতা পর্ব সারতেই মুজিব সাহেব বললেন, এবার আমাদের এদিকে হাট- বাজারের খোঁজ নেওয়া দরকার।

ইরশাদও ভাবছিল, তারা সঙ্গে এনেছে একটি মাত্র খাট আর আম্মুর জোরাজোরিতে তিনটা তোশক আর একটা ম্যাট্রেস। কাঁথা কম্বলও আম্মু জ-ব-র-দস্তি তিন চারটে বেঁধে দিয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে এতগুলো মানুষ এসেছে তারা অথচ এখন শীতের মধ্যে ঘুমাতে গেলে এসবে হবে না। তারওপর এই পাহাড়ি এলাকায় দিন যত উষ্ণ রাত ঠিক ততোটাই হিম শীতল হবে। আর যাইহোক, এক খাটে চলবে না অন্তত আব্বু আম্মু, শ্বশুর শ্বাশুড়ি মেঝের বিছানায় ঘুমাতে পারবে না। তাই সে ঠিক করলো, সস্তার মধ্যেই আরেকটি খাট এবং আরও কিছু কম্বল, লেপ যা হয় কিনে আনতে হবে। নাশতার পর্ব শেষ হতেই ফখরুল, মুজিব, ইরশাদ, ময়ূখ চারজনে বেরিয়ে পড়লো বাজারের উদ্দেশ্যে। তাদের সহকারী হয়ে সঙ্গে গেল কেয়ারটেকার হামিদুর। জানা গেল লোকটা সিলেটের স্থায়ী বাসিন্দা কিন্তু নিজের ভিটেমাটি কিছুই নেই এখানে। খাওয়া পাগল পরিবার তার খাওয়ার পিছেই সব উজার করেছে। এখানে সপরিবারে থাকতে পারছে মালিকের বিশ্বস্ত হওয়ায় একটুখানি জমি আর কাঁচাঘর পেয়ে৷ পুরুষেরা সকলে যখন বাজারের দিকে গেল তখন মহিলাদের সুযোগ হলো একটু গুমিয়ে নেওয়ার। ময়ূখ নিজেই এক ঘরের মেঝেতে দুটো তোশক বিছিয়ে দিয়ে গেছে আর সেখানেই সকলে একটু গড়িয়ে নিচ্ছে৷ প্রথমেই শুয়েছে শেলি তার পাশে ইরিন৷ ইরিনের পাশে মৈত্রী, তারপর রোকসানা বেগম এবং তারও পরে মিশু। সবারই কমবেশি শরীরে হালকা ব্যথাবোধ একাটানা গাড়িতে বসে ঘুমানোর ফলে৷ তাই সমতল নরম বিছানা পেতে সকলেরই চোখ লেগে এসেছে৷ মৈত্রীও আবার ঘুম ঘুম অবস্থায় ছিল কিন্তু হুট করে রোকাসানা যখন কম্বলখানা তাকে আরেকটু জড়িয়ে ঢেকে দিল তখনই তার চোখ আলগা হলো। সেইসাথে বুঝি আলগা হলো মনের শক্ত দ্বার। মা হীন জীবনে এই আদরখানি সে পেয়েছিল তার এগারো কি বার বছর বয়স পর্যন্ত। বাবা রোজ রাতে এসে তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে যেতেন৷ কাঁথা লাগলে সেটা ঠিক করে দিতেন, গরমকালে লোতশেডিং হলে উঠে এসে তাকে হাত পাখায় বাতাস করতেন রাত জেগে৷ তারপর হুট করেই সে কেমন বড় হয়ে গেল। ঘুমাতে গেলে দরজা লাগিয়ে দিতো আর রাত জেগে বাবা তাকে বাতাস করতে পারতেন না, যখন তখন কোলে তুলে নিজের সাথে শুইয়ে দিতেন না। ঘুমের মাঝে পাওয়া সকল যত্ন শেষ হয়ে গিয়েছিল আবার শুরু হলো ইরশাদকে পেয়ে। কিন্তু মা কিংবা কোন নারীর মমতা আর পাওয়া হয়নি তার৷ চোখ ছাপিয়ে উঠলো আনমনেই। পাশ ফিরে সে চোখ বুজেই ফিরলো ইরিনের দিকে। কি আশ্চর্য! ইরিনও তাকে ঘুমন্ত ভেবে হাত বুলিয়ে দেখলো কম্বল ঠিকঠাক আছে কিনা। হুট করেই আবার বুকের কাছে জড়িয়ে রাখলেন যেন ছোট্ট একটি বাচ্চাকে নিয়ে ঘুমাচ্ছেন৷ ভারী জ্বালা তো! এরা দুজন এমন করে আদরে, স্নেহে চেপে ধরলে মৈত্রী তো আনন্দেই দম ব-ন্ধ হয়ে মারা যাবে৷ এদের এই মা মা আদর যে তার খোলসে ঢাকা মনটা সইতে পারবে না এত সহজে৷ কা-ন্না পাচ্ছে তার একটু যদি চিৎকার করে চোখের জল ফেলে কাঁ-দা যেত তবে বড্ড শান্তি লাগতো অন্তরটাতে। মৈত্রী একটুও থাকতে পারলো না এখানে৷ সে শোয়া থেকে উঠে পড়লো। ঘর ছেড়ে বের হচ্ছিলই কি তখন রেকসানা, ইরিন প্রায় একসাথেই বলে উঠলো, “কোথায় যাচ্ছো মৈত্রী? ঘুমিয়ে নাও একটু নইলে শরীর খারাপ করবে৷”

“ওয়াশরুমে যাব।”

দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হতে চলল। পাহাড়জুড়ে আজ রোদের দেখা মেলেনি আর এখন সন্ধ্যের আগেই যেন সন্ধ্যে নেমে এসেছে৷ মিশু আর শেলি ছাড়া কেউ দুপুরে কিছুই খায়নি ইরশাদরা ফেরেনি বলে৷ ফ্রীজে ইলেকট্রিক সংযোগ দেওয়া হলেও তাতে এখনও কোন কিছুই রাখা হয়নি৷ ইরিন বুদ্ধি করে অন্যান্য আসবাবের সাথে উনার ইলেকট্রিক প্রেশার কুকারটাও দিয়েছিলেন আর চাল-ডাল- আলুও এনেছিলেন সঙ্গে৷ ভাগ্যিস এনেছিলেন তাই পুরুষেরা না ফিরলেও তারা সহজ রান্না ভাত, ডাল আর আলুর ভর্তা করতে পেরেছেন৷ তবে পেঁয়াজের কথা কিছুতেই মনে ছিল না তাই আজকের আলুর ভর্তা তার শুধুই মরিচের৷ বিকেলের শেষ মুহূর্তে ফিরে এসেছে সকলে সাথে এসেছে আসবাবপত্রের মেলা। মুজিব সাহেব কারো কথাই শোনেননি। মেয়ের নতুন সংসারের জন্য বেছে বেছে খাট, সোফা, আলমারি, ড্রেসিংটেবিল, ডাইনিং টেবিল, লেপ-তোশক প্রায় প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটা জিনিসই তিনি কিনেছেন৷ ইরশাদ যখন রে-গে গেল শ্বশুরের এসব কেনা দেখে এমনকি সে তৎক্ষনাৎ সেখান থেকে বেরিয়েও পড়েছিল৷ কিন্তু মুজিব যখন বললেন মৈত্রীর মায়ের বড় সাধ ছিল নিজে মেয়ের জন্য এই কিনবেন, সেই কিনবেন তার ভবিষ্যত নাতি নাতনীর জন্য এক কথায় আবে্গী কিছু বাক্য ব্যবহার করেই তাকে শান্ত করতে পেরেছিল৷ বাড়ি ফিরে আবার একদফা আসবাব সাজানোর পেছনেই কে-টে গেল তাদের অনেকটা সময়। রাতের খাবারের সময় আবারও হলো আলুর ভর্তা আর বেগুন ভাজা। তবে এবারে ভর্তায় পেঁয়াজ -মরিচ সবই ঠিকঠাক দেওয়া গেল। কেয়ারটেকার তাদের কাঁচা বাজার করে দিলো৷ রাতের খাওয়া শেষে ঘুমের ফিরিস্তি দিল ময়ূখ বাবা আর আঙ্কেলের সাথে ঘুমাবে সে আর মিশু৷ আম্মা, শেলি আর আন্টি মিলে শোবে এক ঘরে আর একটিতে থাকবে মৈত্রী ইরশাদ। তাই হলো ; রাত বাড়লো সবাই ঘুমানোর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে গেল।

জীবন কখনো কখনো ঝ-ড়ে-র বেগে বদলে যায়। ময়ূখেরও বদলেছে তেমন করেই। হুট করেই নোরা জীবনের এমন এক অংশে জড়িয়ে গেছে যেখানে ভালোবাসা না থাকলেও দ্বায়িত্ব আছে শেষ নিঃশ্বাস অবধি৷ যাকে কাজিনের বাইরে অন্যকিছু স্বপ্নেও ভাবতে পারতো না সে, আজ তার রাত কা-টছে সেই মেয়েটির ফোনকল আসবে বলে৷ সমঝোতা, দ্বায়িত্ব এই দুটি জিনিস গলায় ঠিক ফাঁ-সের মত লেগে থাকা জিনিস। আর ময়ূখের জীবনটাতে সময় এখন এই ফাঁ-সেই তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে