কি ছিলে আমার পর্ব-২৭+২৮

0
1852

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-২৭

ল্যাপটপে কিছু জরুরি ইমেইল চেক করতে বসে খুব অবাক হলেন আবরার খন্দকার। সিলেটে নিজেদেরই পৈতৃক সম্পত্তির পাশেই বড় এক চা বাগান। সেই বাগানের মালিক ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা এবং আবরারের খুব কাছের বন্ধু ফয়সালের। ইমেইলটা এসেছে ফয়সালের চা বাগানের ম্যানেজারের পক্ষ থেকেই তারমানে ফয়সাল অবগত বলেই এসেছে এটা। ইমেইলের মূল বার্তা, ইরশাদ শাহরিয়ার চাকরি জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছে তাদের কোম্পানিতে এবং সে সিলেক্টেড। তার ভাগ্নে চাকরি করবে এটা কোন মজার ব্যাপার কিংবা ভুলভাল কোন ব্যাপারও নয় তবে বন্ধুর কাছ থেকে ইমেইলটা এসেছে খোঁ-চাস্বরূপ, টি-প্প-নীমূলক। এটাই খুব গায়ে লাগলো আবরারের। ফয়সালের খোঁচা এই তোর বোনকে নাকি খুব বড় জায়গায় বিয়ে দিয়েছিস তাহলে তোর ভাগ্নে চাকরি জন্য ঘুরছে কেন? আবার খোঁচা আরও একটা হতে পারে, তার নিজের একটা কোম্পানি, শো-রুম এবং নতুন করা গার্মেন্টস থাকতেও ভাগ্নে কেন চাকরি খুঁজছে! কিছু মানুষ নামে বন্ধু হলেও কাজেকর্মে সে শ-ত্রুকেও ছাড়িয়ে যায়। ফয়সাল ঠিক তেমনই বন্ধু সে বরাবরই শ-ত্রুতা করে এসেছে আবরারের সাথে। ইরিনের জন্য এ জীবনে কোনদিন বিয়ে থা করেনি আর আজ ইরিনের ছেলে তারই কাছে চাকরির জন্য গেছে মানে তার ভেতরকার শ-য়-তান চিত্ত এখানেই জেগে উঠেছে। আবরারের খুব ইচ্ছে করছিলো ফয়সালকে এই মুহুর্তে কল দিয়ে কিছু বি-শ্রী ভাষায় গালি দিতে কিন্তু কি লাভ! এখন বয়সটা তাদের অনেক বেড়ে গেছে, বোনের সংসারে পুত্রবধূ এসেছে এ বয়সে ফয়সালের মত পঁচা গলাকে ঘাটিয়ে দূ-র্গ-ন্ধ বের করার মানেই হয় না। নিজেকে ক-ড়া-ভাবে সা-ব-ধান করে বন্ধুর নম্বরটাতে কল বসালো। ওপাশে রিসিভ হলেও ফোনটা তুলল ফয়সালের ম্যানেজার। ফয়সালকে ফোন দিতে বলে আবরার মনে মনে কিছু বাক্য গুছিয়ে নিলো।

“হ্যালো, ফয়সাল খান বলছি।”

“আমি আবরার।”

“ওরে বন্ধু আজ কত দিন পর কল দিলি! এতদিনে মনে পড়লো আমাকে।”

‘সব নাটক’ মনে মনে উচ্চারণ করলো আবরার।

“মনে তো পড়ে কিন্তু জীবনের ব্যস্ততাই এমন অবস্থানে এনেছে যে, কারো সাথেই দু দন্ড কা-টা-নো-র সময় মিলছে না।”

“হু কত বড় বিজনেসম্যান হয়ে গেছিস, বউ, বাচ্চা সংসার সময় কি করে পাবি। তারওপর তোর ছেলেটাও তো ইরিনের কাছে। গতবছর তো ময়ূখদের ভার্সিটিতে এক অনুষ্ঠানে ছিলাম আমি দেখলাম তোর ছেলেটা গিটার বাজিয়ে গানবাজনা করছে। কি লাভ বন্ধু এতবড় ব্যবসা গড়ে ছেলেকে গায়ক বানাচ্ছিস। তারওপর যে জন্য তোকে আমার ম্যানেজার ইমেইল করলো তোর ভাগ্নের কথা জানিয়ে। বুঝলি আবরার আমার তো সম্পদের বড় পাহাড় হয়েছে সব ভাই-ভাতিজারাই খাবে তাই তুই বললে আমার চা- কারখানাটা ইরিনের ছেলেকে দিতে পারি কি বলিস?”

‘আসল রূপে চলে আসছিস শালা জা-নো-য়ারের বাচ্চা। এক কথা থেকে দশ কথা ঘেটে তবেই না তোর সুখ হয়’ মনে মনে এটা বললেও রাগ লুকিয়ে মুখে বলল, “কি বলছিস ফয়সাল। ইরশাদ কি টাকার অভাবে চাকরি খুঁজছে নাকি! সে স্বভাবে একটু সাধারণ তার বাবার মত। কোটি কোটি টাকা পয়সা পে-রে-শানি নিয়ে জীবনযাপন তার পছন্দ না। তাইতো ফখরুল নিজেও পৈতৃক ব্যবসা-বানিজ্য ছেড়ে চাকরি করলো এখন ছেলেটাও তেমন চায়। এইতো সপ্তাহে বিয়ে করালাম ভাগ্নেকে এবার চমৎকার সংসার করবে। ও আমাদের মত টাকা পয়সার খেলা পছন্দ করে না আর ইরিনও এসব চায় না।”

“বিয়ে করে ফেলেছে! ওহ কি বললি রে বন্ধু আর আমি তো ছেলের ছবি দেখে ভাবছিলাম আমার ভাতিজীর বিয়ের প্রস্তাব রাখব। কি সুন্দর হয়েছে ইরিনের ছেলেটা চোখে, মুখে একদম তারই ছাপ।”

এবার ভীষণ ক্ষেপছে আবরার। এই হারামিটা এত বছরেও তার বোনের নামধাম জড়িয়ে কথা বলে। দাঁতে দাঁত চেপে আবরার বলল, ” ইরশাদকে কি সিলেকশন লেটার দিয়ে ফেলেছিস? না দিয়ে থাকলে দেওয়ার দরকার নেই। ও চা বাগানে কি চাকরি করবে? আমি কথা বলে তাকে আমার ব্যবসা দেখতে বলবো। তুই অন্য কাউকে হ্যান্ডওভার করে দে৷”

ফয়সাল এ কথার জবাবে কোন উত্তর না দিয়ে বলল, “ফোন রাখছি দোস্ত একজন গেস্ট এসেছে পরে কথা বলছি।”

আবরার খন্দকার বুঝতে পেরেছেন বন্ধুর মিথ্যেটা৷ কিন্তু বুঝে পেলেন না ফয়সাল কি করে ইরশাদকে চিনলো সে ইরিনের ছেলে! নিজেই ইন্টারভিউ নেয় নাকি অফিসে বসে! আর ইরশাদ কিসের চাকরি করবে চায়ের কারখানায়!

ময়ূখের পাসপোর্ট রিনিউ না করে কোথাও যেতে পারবে না। তার ইন্ডিয়া ট্যুর ক্যা-ন্সে-ল হয়ে গেছে সেই সাথে তার জীবনের বড় ভুলটাও সে করে ফেলেছে ঝোঁকের ব-শে। বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে নোরাকে বিয়ে করে ফেলেছে। সে কথা বাড়িতে জানাজানি হওয়ার পর আর ময়ূখ চোখ তুলে কারো দিকে তাকাতে পারছে না। কাল যখন নোরার সাথে কথা-কা-টা-কা-টি হলো মৈত্রীকে নিয়ে তখন কি এমন হলো এখনও ময়ূখ বুঝতে পারছে না শুধু বুঝতে পারছে নোরার সাথে কথা বলতে বলতেই এক পর্যায়ে কেমন ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। শুধু মনে হচ্ছিল নোরা তার গাইড নোরা যা বলছে তাই যেন করা দরকার। তার কথা শুনলেই এ মুহূর্তে সকল দুঃখ ক-ষ্ট কর্পূরের মত মিলিয়ে যাবে। নোরা যখন বলল, “আমাকে বিয়ে করবে? আমি তো তোমাকে ভালোবাসি ময়ূখ। আমার ভালোবাসাকে একটু মূল্যায়ন করতে পারো না!”

কি এক আকুলতা তার মনে গেঁথে গেল সে মুহূর্তে। সে সত্যিই নোরার কথা মানলো। মাত্র ঘন্টা দুয়ের মাঝেই তারা কাজী অফিসে বিয়ে করে বাড়ি এলো। আবরার খন্দকারকে ফোন করে সে কথা বলতেই তিনি উ-ত্তে-জি-ত হয়ে পড়লেন। যেখানে নোরার মাকে কোনদিন বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নেননি সেখানে নোরাকে ছেলের জীবনে মানার প্রশ্নই আসে না। যতই হোক সে তার ভাইয়ের মেয়ে কিন্তু এই মেয়ের মাঝে অন্য ধর্মেরও রক্ত বইছে। তাঁর ধারণা এই মেয়ের মা যেমন কখনো তার ভাইয়ের হয়ে থাকতে পারেনি এই মেয়েও তা পারবে না। তারওপর ইরিনকে যখন জানানো হলো ঘটনা তিনি একদম ভে-ঙে পড়লেন। বিগত দিনে তিনি টের পাচ্ছিলেন ময়ূখের কিছু একটা হয়েছে কিন্তু সেই কিছু নোরা সম্পর্কিত একদমই নয়। তাই নোরাকে ময়ূখের বিয়ে করা তাও কিনা কাউকে না জানিয়ে! এ যেন চোখের পলকে দূ-র্ঘট-না ঘটে গেল। নিজ বাড়িতে যখন ছেলে আর বউ নিয়ে তার আনন্দ করার কথা তখন সে ময়ূখের শোকে ঘরে দোর বন্ধ করে বিছানায় পড়ে আছে৷ মানসিক আ-ঘা-ত বুঝি ময়ূখের করা অন্যায়ে পেলেন তিনি৷ অন্যায়ই বটে! যাকে বুক দিয়ে আগলে বড় করলো সে এমন হঠাৎ কোন কারণ ছাড়াই হঠকারী কাজ করলে আ-ঘা-ত তো লাগবেই৷ কষ্ট তো ফখরুল সাহেবও পেয়েছেন। আবরার জন্মদাতা হলেও ফখরুল ছিলো ময়ূখের আরেক পিতা। সকল আনন্দে ভাটা পড়ে গেছে যখন থেকে জানলো সবই নোরা আর ময়ূখের কীর্তি। শান্ত, গ-ম্ভী-র ইরশাদ হঠাৎই ভীষণ অশান্ত হয়ে গেছে। কাল মৈত্রীদের বাড়ি থেকে ফেরার পর শারীরিক অবস্থা কিছুটা ভালো বোধ করলেও রাতটা তার মানসিক অ-সুস্থ-তায় কে-টে-ছে মৈত্রীর প্রশ্নে। সায়রা-ইমরানও গিয়েছিলো তাদের আনতে আর সেখানেই মৈত্রী খেয়াল করেছিলো সায়রা কোন কথা বলেনি ইরশাদের সাথে৷ এমনিতেও বিয়ের রাতে সব জা, দেবর, ভাসুর, চাচা শ্বশুর, চাচী শ্বাশুড়ি সবাই যখন তাদের ফ্ল্যাটে থাকছে, রাতে খাচ্ছে সেখানে শুধুমাত্র সায়রা নামের মানুষটিই অনুপস্থিত ছিল। মৈত্রীদের বাড়িতে সবাই যখন ইরশাদের পেট খারাপ নিয়ে রসিকতা করছিলো তখন সায়রা চুপচাপ বসেছিলো এক কোণে ইমরানের পাশে। যখন ভাইরা সবাই একটু বাইরে ঘোরাঘুরি করছিলো মূলত বড় ভাইয়া, ইমরান ভাইয়া সিগারেট খেতে, অন্তু তার স্ত্রীর জন্য চকলেট আনবে বলেই বেরিয়েছিল ইরশাদের সাথে তখন ভাবীরা বসে মৈত্রীর সাথে গল্প করছিলো। কথাবার্তা চলাকালীন মৈত্রী যখন বলল, ইরশাদের জন্য আলু ভর্তা, পেপে ভর্তা ভেবেছিলো বাদাম ভর্তাও করবে সেটাই যখন বলল তখন মুখ ফসকে সায়রা বলে ফেলল, “বাদামে এলার্জি আছে ইরশাদের।”

মৈত্রী অবাক তাকিয়েছিল সায়রার দিকে, তাকিয়েছিল জুয়েনাও। সায়রা যখন নিজের ভুলটা বুঝতে পারলো তখন জুয়েনা ব্যপারটাকে সামলাতে বলল, ” ইরশাদের তো প্রচুর এলার্জি বাদামে। চাচী আম্মা তো তার জন্যই কখনো বাদামভর্তা খায় না ”

“ওহ!” ভাবীরা দেবর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে এটা বোধহয় স্বাভাবিক ব্যাপার। মৈত্রী তখন এ নিয়ে কিছু না বললেও মনে মনে কৌতূহলবোধ করলো পুরোটা সময়। এমনকি তার অবচেতন মন তারপর থেকেই লক্ষ্য করলো সায়রাকে পুরোটা সময়। তাদের বাড়ি থেকে ফেরার আগ পর্যন্ত দেখেছে সে সায়রা কেমন দৃষ্টি লুকিয়ে পুরো সময় ইমরানের সাথে সাথেই ছিল আর তাই সে রাতে ফিরে কথার ছলে ইরশাদকে সায়রার কথা জিজ্ঞেস করেছিলো। ইরশাদ কথাটা এড়িয়ে গেলেও মনে মনে অ-স্ব-স্তি-বোধ করলো। তার পরিণত বুদ্ধিমত্তা জানে মৈত্রীর মনে যে প্রশ্ন তা সে আজ না করলেও কোন একদিন করতোই। একই বাড়ির সদস্য হয়ে অতীতকে পা-থ-র-চা-পা রাখা অসম্ভব। কিন্তু হুট করে অতীত সামনে এলে যেকোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষই ভড়কাবে, শক্ত মনের মানুষ না হলে শুরুতেই ভে-ঙে পড়বে৷ ইরশাদ শুধু ওপরওয়ালার কাছে একটু সময় চায়। সম্পর্ক সে সততার সাথে পালন করবে তার জন্য একটু সময় অবশ্যই দরকার। বিয়ের তৃতীয় রাতটা কা-ট-লো সবচেয়ে অস্বস্তিপূর্ণ। সকালেই ইরশাদ মাকে বলল ঢাকায় যাবে৷ ইরিন নির্বিকার তার কোন জবাব ছিলো না এ কথার প্রেক্ষিতে। ফখরুল সাহেব বাঁধ সাধলেন, কোন দরকার নেই। কি করবে গিয়ে তোমার কি সেখানে? ওর বিয়ের বয়স হয়েছে, “ইচ্ছে হয়েছে বিয়ে করেছে এ নিয়ে তোমাদের বলার কিছু থাকতে পারে না।”

সকল প্রকার বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ, আত্মীয়-স্বজন সকলেই চলে গেছে যার যার মত। মৈত্রী তার স্বভাবসুলভ আচরণ থেকে কিছুটা বেরিয়ে এসেছে তিন দিনেই। সংসার মানেই খুব বড় একটা ‘দ্বায়িত্ব’ এমনটা বলেছিলো তার নানী। আজ মনে হলো দ্বায়িত্ব তার ওপর ন্যস্ত হয়েছে অলৌকিক ভাবে। সে সকালেই নিজে থেকে নাশতা তৈরি করেছে সবার জন্য তারপর শ্বশুরকে নাশতা খাইয়ে শ্বাশুড়ির জন্য নিয়ে গেল রুমেই। মৈত্রী রুটি বানাতে পারে না তাতে সহযোগিতা করেছে ইরশাদ নিজেই৷ মৈত্রী অনেক জোর করেও যখন শ্বাশুড়িকে কিছু খাওয়াতে পারলো না তখন সে মুখ খুলল, “আন্টি, ময়ূখ ভাইয়ার সাথে একটু কথা বলুন। আপনি এভাবে চুপ করে থাকলে সবাই চিন্তিত হচ্ছে।” ইরিন শুনলো কিছু বললো না। মৈত্রী কথা বলে খুব কম, মেপে মেপে কিন্তু আজ তার খা-রা-প লাগছে তাই চেষ্টা করলো আরও কিছু বলতে। কিন্তু তার চেষ্টা সফল হয়নি। ইরশাদ দূর থেকে দেখলো মৈত্রীর চেষ্টা মনে মনে খুশি হলো। কিন্তু বাবার নারাজ মুখ দেখে সে এবার জোর করেই বলল, ঢাকা সে যাবেই এবং আজই। ইরিন সেটা শুনলেন আর মুখ খুললেন, “মৈত্রীকেও নিয়ে যা সাথে দু তিন থেকে ঘুরে বেরিয়ে আসিস।”

বাড়ির পরিস্থিতি ভেবে মৈত্রী রাজী হচ্ছিলো না। ইরিনের পাশে তার থাকা জরুরি বলেই মনে হলো। ইরিন শুনলো না তাই মৈত্রীও বসলো যাওয়ার জন্য গোছগাছ নিয়ে। মৈত্রী লাগেজে কাপড় গোছাচ্ছিলো তখন ইরশাদ ল্যাপটপ খুলে বসলো। জবের জন্য সে রাজশাহীতেও একটা অফার পেয়েছিল সেটাই চেক করার উদ্দেশ্য ছিল। তখনই চোখে পড়লো, কংগ্রাচুলেশনস মেইল। তারপরই একটা অনলাইন এপয়েন্ট লেটার। রিসেন্ট ডেট দেখেই তার মাথা ন-ষ্ট হলো। বাড়ির পরিস্থিতি যা তাতে এখন এ কথা কি করে জানাবে সে! সিলেটে গিয়ে চাকরি করা তারমানে এখন বউ নিতে হবে সঙ্গে। সেখানে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে আম্মু- আব্বু এখানে থাকতে চাইলে তখনইবা কি করবে! আব্বুর রিটায়ারমেন্টে এখনও বছরখানেক সময় বাকি! ইরশাদের একদম মাথায় হাত। এসব কি হচ্ছে তার সাথে একসাথে এতদিকের ভালো-মন্দ!

রাতে রওনা হওয়ার আগে ইরশাদ মৈত্রীকে জিজ্ঞেস করলো, “কিসে যেতে চাও বাসে যাবে না ট্রেনে?”

” যদি বলি প্লেনে?”

“তবে তাই হবে বেগম সাহেবা।” বিড়াল দুটো চোখের পাতা ফেলে জবাব দিলো ইরশাদ। মৈত্রীর ভালো লাগলো সেই সেকেন্ডের পলক ফেলা দৃশ্যটা। কারো পলক ফেলার দৃশ্যও কি মনে লাগতে পারে এমন করে! মৈত্রীর কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে নিজের এমন ভাবনাতে। ইরশাদ সেদিকে লক্ষ্য করেনি সে আবারও বলল, “তবে এ রাতে সম্ভব নয় কাল করতে হবে ব্যবস্থা।”

“মজা করেছি। বাসে যেতে চাই।”

“উহুম প্লেনেই নেবো ভাবছি।”

“আমি বাসেই যাবো।”

“কেন?”

“বাসে একসাথে দুটো সিটে দুজন পাশাপাশি…. ” উচ্চারণ করলেও শব্দের উচ্চতা ক্ষীণ হওয়ায় ইরশাদ শুনতে পায়নি কথাটা। কিন্তু যাওয়ার সময় বাসে চড়েই সে বলে বসলো, “দুজন পাশাপাশি বসে যাওয়ার জন্য একমাত্র বাসই পারফেক্ট, কি বলো!”

লং জার্নি, পাশাপাশি দুজন, বাতাসে শীত আর গায়ে কাঁপন৷ রুক্ষ মনের ভেতরও কোমল আবেগ আপনাতেই জড়িয়ে নেয় দুজনকে। মৈত্রী বসেছে জানালার পাশের সিটে। শীতের তীব্রতা টের পেয়েও জানালার কাঁচ আধখোলা। ইরশাদের গায়ে মোটা জ্যাকেট, মৈত্রীর গায়ে শাল। বাসের বাতি নেভানো থাকায় কেউ কারো মুখটি দেখার জো নেই৷ ইরশাদ আচমকা তার জ্যাকেট খুলে কোলের ওপর রেখে দিলো৷ ফিসফিসিয়ে মৈত্রীর কানে বলল, “শীত লাগছে খুব একটু জড়িয়ে ধরবে?”

চলবে

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-২৮

মেহের মাত্রই স্কুলে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলো। সদর দরজা পেরিয়ে গাড়ির সামনে যেতেই তার চোখে পড়লো গেইট দিয়ে ঢুকছে গাঢ় সবুজ আর কালোর মিশেলে সেলোয়ার-কামিজ পরা এক মেয়ে। মেয়েটিকে চিনতে তার একদমই সময় লাগেনি৷ মেয়েটি মৈত্রী আর সে ঘুম থেকে উঠেই জরিনার সোর্স থেকে জানতে পেরেছে কাল রাতে ইরশাদ মৈত্রী রওনা দিয়েছে এ বাড়ির উদ্দেশ্যে। মিনিট গড়াতেই গেইটের ভেতর প্রবেশ করলো ইরশাদ পাশেই গেইটের দারোয়ান তার হাতে ব্যাগ। মেহেরের চোখ সব ছেড়ে থেমে রইলো ইরশাদের গলায় ঝুলানো শাল আর মৈত্রীর গায়ের জ্যাকেটে।দু জনের প্রেম যেন সামান্য জ্যাকেট পাল্টাপাল্টিতেই তার চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো। তারা যখন দু তিন পা এগিয়ে এলো মেহের সরে পড়লো জায়গাটা থেকে বাগানের দিকটায়। তারা ভেতরে যেতেই মেহের গাড়িতে গিয়ে বসলো। মনে মনে বলতে লাগলো, বাড়ি ফেরা না হোক আমার।

ময়ূখ কাল রাতে নিজের ঘরেই থেকেছে আর নোরা ছিলো মেহেরের পাশের ঘরটিতে। এত সকালে দুজনেরই ঘরের দরজা বন্ধ হয়তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তারা। আবরার সাহেব একা একা নাশতা করছিলেন আর জরিনাকে ডেকে বলছিলেন, “নোরাকে ডেকে বলো ময়ূখের ঘরে শিফট হতে৷ দ্রুত ঘর গোছায় ইরশাদ, বউমা যে কোন সময় পৌঁছে যাবে।”

আবরার খন্দকার এর কথা শেষ হওয়ার বোধহয় সেকেন্ড পার হলো তারই মাঝে দরজায় এসে দাঁড়ালো ইরশাদ। ভাগ্নে আর নতুন বউয়ের উপস্থিতি দেখেই আবরার আনন্দিত হলেন। বাড়িতে কত যে অ-ঘ-ট-ন ঘরটছে তার মাঝে নতুন বউয়ের আগমন এইটুকুই আনন্দের। মামা শ্বশুর হিসেবে প্রথমেই মৈত্রীকে সালামী দিলেন। চোখের ইশারায় জরিনাকে পাঠালেন নোরাকে জাগাতে। দূরের জার্নি করে এসে নিশ্চয়ই রেস্ট দরকার তাদের! জরিনা কথামত কাজ করলো। নোরা উঠে বাথরুমে ঢুকতেই জরিনা বেড কভার বদলে ঘরটা ঝাড়ু দিলো৷ দ্রুত হাতে ড্রেসিংটেবিল আর বারান্দাটাও সাফসুতরা করে বেরিয়ে এলো। নোরা ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে৷ ইরশাদ মৈত্রীর সাথে খানিকটা আলাপ করে নাশতা সারলো। মৈত্রীকে নিয়ে যাওয়া হলো মামী শ্বাশুড়ির ঘরে৷ মেহেরের মা খুব একটা সুস্থ স্বা-ভা-বিক না হলেও কিছুটা হাঁটাচলা, কথা বলা সবই পারেন৷ তাই মৈত্রীর সাথে খানিক সময় কথাবার্তা বলে তাকে রেস্ট করতে পাঠানো হলো৷ ইরশাদ আগেই রুমে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়েছিলো মৈত্রীও এবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো। ইরশাদের পাশে বসে থেকে ভাবছিলো ঘুমাবে কিনা এমনিতেও রাতভর সে ঘুমিয়েই কা-টি-য়ে-ছে। ইরশাদ বাসে বসে যখন বলল, “শীত লাগছে খুব একটু জড়িয়ে ধরবে?”

লজ্জায় মুখ তুলতে পারছিলো না সে৷ তা দেখে ইরশাদ নিজেই মৈত্রীর শালের ভেতর নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিল। দু জনের দেহের উষ্ণতা আরাম দিচ্ছিলো মৈত্রীকে খুব৷ কখন যে চোখ বুঁজেছে মনে নেই তার ভোরে ঘুম ভাঙতে দেখেছিল সে লেপ্টে আছে ইরশাদের বুকের ওপর। তখনও লজ্জায় র-ক্তি-ম হয়ে উঠেছিল তার গাল। কিন্তু এখন ঘুমন্ত ইরশাদকে দেখে লজ্জা সরে অন্য এক অনুভূতি জেগে উঠলো সেই সাথে তীব্র এক বাসনা। কম্বলে গা ঢাকা ইরশাদের কম্বলের নিচে নিজেও ঢুকে গেল। সতর্কতার সাথে একটা হাত তার বুকের ওপর দিয়ে জড়িয়ে ধরার চেষ্টায় বাড়িয়ে দিচ্ছিলো মৈত্রী। কে জানতো ঘুমন্ত মানুষটা একটুতেই সজাগ হয়ে যাবে! মৈত্রীর সতর্ক হাতকে শ-ক্ত করে ধরেই উল্টো বিছানায় চেপে ধরলো। কম্বলখানা এবার মাথাসহ ঢেকে মৈত্রীর অধরে নিজ ওষ্ঠের ছাপ ফেলল। প্রথম ওষ্ঠচুম্বন বড় ক-ঠি-ন আর শ্বাসরুদ্ধকর হলো মৈত্রীর জন্য । লজ্জায় সে চোখ খুলতেও ভুলে গেল সেসময়। ইরশাদের খুব হাসি পেল তার নব্য বিবাহিত বধূটির এই আ-র-ক্তি-ম অপ্রস্তুত অবস্থা দেখে। একের পর এক ওষ্ঠ ছোঁয়া সে চালিয়ে গেল অনেকটা সময় থেমে থেমে। মৈত্রীর তখন আচমকা ঝড়ের কচি ডালের নুয়ে পড়ার মতই অবস্থা। পুরুষের দৈহিক স্পর্শও সুন্দর হয় তাতে যদি লালসার ছোঁয়া না থাকে। ইরশাদের স্পর্শে মৈত্রী প্রেম -ভালোবাসা না পেলেও তাতে স্ত্রীর প্রতি সম্মানের ছোঁয়া টের পায়। তার মন বলে এই মানুষ অল্প সময়েই তাকে অগাধ ভালোবাসায় ডুবিয়ে দেবে। মন আরও অনেক কিছু বলে যা সবসময় সত্যি হয় না কিন্তু মৈত্রী এ কথা সত্যি হোক দোয়া করে মনে মনে। ইরশাদ তাকে খুব খুব খুব ভালোবাসবে একদিন।

সন্ধ্যের দিকে মুখোমুখি হলো দু ভাই। বাড়ির ছাঁদে মুখ ভার করে বসেছিলো নোরা। সকালে ইরশাদদের জন্য ঘর খালি করে দিয়ে সে মেহেরের ঘরে ঢুকেছিল আবারও ঘুমানোর জন্য কিন্তু তা বেশি সময় স্থায়ী হতে পারেনি। মেহের দু ঘন্টার মাঝেই বাড়ি ফিরে এলো ক্লাস না করে। নিজের ঘরে নোরাকে দেখে বি-ক্ষি-প্ত মেজাজটা আরও চ-টে গেল যেন। নোরাকে সে বোন হিসেবে কখনোই অপছন্দ করতো না কিন্তু ভাবী হিসেবে গ্রহণ করতে পারেনি কিছুতেই৷ তারওপর ইরশাদের সাথে মৈত্রীকে দেখে যে প্রতিক্রিয়া সে লুকিয়ে রাখছিল তাই যেন ভ-স্ম করলো নোরাকে। চেঁচামেচি করে ডেকে তুলে ঘর থেকে বের করে দিলো তাকে। নোরা হতবা-ক তার আকস্মিক আচরণে সেই থেকে ছাঁদে বসেছিল সে বাকিটা দিন। ময়ূখ ঘুম থেকে উঠে খোঁজ করেছিল কিন্তু কেউ বলতে পারেনি নোরা কোথায়। ফোনে ট্রাই করতেই বুঝতে পারলো ফোন ইরশাদ যে ঘরে আছে সেখানে। অনুমান করে নিলো ছাঁদে আছে নোরা। ময়ূখ গিয়ে ডাকার পরও সে আসেনি তখন মৈত্রী বলল, “আমি ডেকে আনি?”

মৈত্রী আর ময়ূখ দুজনেই গেল। ইরশাদ একটু বেরিয়েছিল বলে দেখা হয়নি তখনো ময়ূখের সাথে। বাড়ি ফিরে জরিনার কাছে জানতে পারলো মৈত্রী ছাঁদে। ইরশাদও গেল সেখানে আর তখনই দু ভাই দেখলো একে অপরকে। ময়ূখ ভাইকে দেখতেই মাথা নিচু করতেই ইরশাদ এসে আচমকা থা-প্প-ড় বসালো ময়ূখের গালে। নোরা-মৈত্রী দুজনেই প্রথম থা-প্প-ড় দেখে হা হয়ে গেল পরক্ষণেই ইরশাদ যখন ঘু-ষি মে-রে বসলো চোয়াল বরাবর তখন সকলের হতভম্ব ভাবটা আর রইলো না৷ ইরশাদ দ্বিতীয়বার ঘু-ষি মা-রতে হাত উঠাতেই মৈত্রী চেপে ধরলো হাতটা।নোরাও এসে দাঁড়ালো সামনে অথচ ময়ূখ নির্বিকার। তার চোখ জলে টলমল অথচ দৃষ্টি তুলে দেখছে না সে।

“থামুন আপনি এভাবে মা-রছেন কেন ময়ূখ ভাইকে?”

মৈত্রীই মুখ খুলল প্রথমে। ইরশাদ সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নোরাকে সরিয়ে ময়ূখের পরনের শার্ট চেপে ধরলো।

“খুব বড় হয়ে গেছিস? আম্মুর কথা, আব্বুর কথাও ভাবার নেই নিজের মনমতো কাজ করলেই হলো! বিয়ে করার শখ জেগেছে বলতে পারিসনি আমাকে আমি নিজে তোর বিয়ে দিতাম। আম্মুকে কেন বলিসনি , তোর সমস্যা কোথায় আগে সেটা বল। তুই পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন বল” চেঁচিয়ে কথাগুলো বলেই আরও একটা ঘু-ষি মেরে দিলো ইরশাদ। তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে আছে। নোরা, মৈত্রী দুজনেই টানাটানি করে দু ভাইকে দু দিকে সরালো।

“প্লিজ থামুন ইরশাদ ছোট বাচ্চা নাকি এভাবে মা-রছেন কেন?”
মৈত্রী ইরশাদকে বলছিলো নোরাও পাশ থেকে বলল, “কাম ডাউন ব্রো, ইফ ইউ ডু লাইক দিস দ্যান
ইউ উইল গেট হার্ট বোথ অফ ইউ”

অপরাধীর মত মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে ময়ূখ। ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে লেগে আছে র-ক্ত-বিন্দু। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে নোরা। ইরশাদ শুধু ময়ূখকে মা-রে-নি নোরাকেও কথা শুনিয়েছে কিছু। কিন্তু এই মুহুর্তে ইরশাদের মাথা প্রচণ্ড গরম হয়ে আছে বুঝতে পেরে মৈত্রীও নীরব। তার এখনও অবাক লাগছে ইরশাদের তখনকার আচরণ। এত শান্ত স্বভাবের লোকটা অত রে-গে গেল কেমন করে! তিনি কাউকে আ-ঘা-ত করতে পারে এ যেন অবিশ্বাস মৈত্রীর কাছে। ছাঁদ থেকে নামার আগেই ইরশাদ ঘোষণা দেওয়ার মত করে বলল, “নিচে গিয়ে তৈরি হয়ে নাও নোরা আর ওকেও বলো তৈরি হতে আমরা রাতেই রওনা দেব। ও আর ক’টা দিন দূরে থাকলে আম্মু এবার বিছানাবাসী হয়ে যাবে।”

রাতের খাবার খেতে বসে ইরশাদ তার মামাকে জানালো রাতেই তারা রাজশাহী ফিরে যাবে। মন মানসিকতা খুব একটা ভালো না থাকায় তিনি খুব একটা আপত্তি করলেন না তবুও যতটুকু না বললেই নয় তাই বললেন, “মেয়েটাকে নিয়ে এভাবে জার্নি করে এসে আজই ফিরে যাবে এ কেমন কথা? অসু-স্থ হয়ে পড়লে?”
মামার কথা শুনে ইরশাদেরও মনে হলো রেস্ট নেওয়া উচিত কিন্তু তার ঢাকায় আসার উদ্দেশ্যই ময়ূখকে যত শিগ্রই সম্ভব বাড়ি নিয়ে যাওয়া। সে তো জানে ময়ূখের জন্য তার মায়ের ঠিক কতখানি পোড়ে! ময়ূখের এই হঠাৎ বিয়ের পেছনে অন্য কোন কারণ অবশ্যই আছে যা তার আম্মু আন্দাজ করেই এমন ভে-ঙে পড়েছেন। শুধুমাত্র না জানিয়ে বিয়ে করাটা এই অসুস্থতার কারণ নয়৷ সে জানে তার আম্মু কতোটা আধুনিকা তিনি ছেলেদের পছন্দে বিয়ে করলে কখনোই দ্বিমত করবেন না। যেমনটা তার বেলায় করেনি তেমনটা ময়ূখের বেলায়ও করতেন না কিন্তু ময়ূখ কি লুকিয়ে রাখছে!

আজ আর বাসে ফেরার সুযোগ হলো না ইরশাদদের। আবরার খন্দকার ভাগ্নে ডেকে বললেন, তোমাদের নিয়ে ভাবার প্রয়োজন বোধ করছি না কিন্তু বউমার প্রতি স্নেহ থেকে বলছি বাড়ির গাড়ি করে যাও। তোমার মামীর গাড়ি তো বড় সেটাতে যাও ড্রাইভারকে কল দিয়েছি আমি। রাতে যেখানে সেখানে ব্রেক নিও না দেশের পরিস্থিতি ভালো নয়।”

ভরাট, গম্ভীর কণ্ঠে কথাগুলো বললেও মনে মনে চিন্তিত আবরার খন্দকার তা প্রকাশ করলেন না। রাত দশটার পরই সবাই প্রস্তুত হয়ে গাড়িতে বসলো৷ নোরা আর ময়ূখ পাশাপাশি বসেছে। তাদের পেছনে বসেছে ইরশাদ মৈত্রী। ময়ূখ ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলে নোরার দিকে তাকালো। বিয়ের প্রায় চল্লিশ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে অথচ দুজনে কোন কথা হয়নি আন্তরিকতার কিংবা সম্পর্কের দায়বদ্ধতার। দু জন কাজী অফিসে বিয়ে করে বাড়ি ফেরার পর থেকেই যে যার মত ছিল৷ ছাঁদে যখন ইরশাদের সাথে কথা হলো তখনও তাদের পারষ্পরিক কোন বাক্যলাপ হয়নি৷ এই প্রথম ময়ূখ কথা বলল, ” তুমি ঠিক আছো?”

“হুম ”

“কিছু লাগলে বোলো মানে পথে..”

“বলবো”

“ওটা হাতে কেন পরে নাও রাত বাড়তেই বাতাস, ঠান্ডা বেশি লাগবে।”

“এখন স্বাভাবিক লাগছে পরে নেবো। তুমি জ্যাকেট নাওনি কেন?”
নোরা প্রশ্ন করলো ময়ূখকে। সত্যিই ময়ূখ গরম কোন কাপড় গায়ে দেয়নি৷ শুধুই গায়ে একটা সি গ্রীণ রঙের শার্ট গায়ে। পেছন থেকে ইরশাদও শুনলো সে কথা। সেও জিজ্ঞেস করলো তার জ্যাকেট কোথায়? ময়ূখ বললো ব্যাগে আছে। ব্যাগ একদম পেছনে ইরশাদদের দিকে৷ ইরশাদ নিজের গায়ের জ্যাকেট খুলে সামনে দিয়ে দিলো ময়ূখকে।

“ভাই লাগবে না আমার শীত লাগছে না। তুমি ব্যাগটা দিয়ে দাও আমি নিয়ে নেব।”

” বা গাল ফোলেনি তোর তাই না! এরপর সেটাও ফুলবে আর একটা কথা বাড়ালে।” ধ-ম-কির ওপর ময়ূখকে সে জ্যাকেট ধরিয়ে দিলো। মৈত্রী তাড়া দিলো ইরশাদকে পেছন থেকে ময়ূখের জ্যাকেট পরতে।

“এক চাদরে হবে না আমাদের?” ফিসফিস করে বলল ইরশাদ। মৈত্রী বুঝলো মানুষটা মজা করার জন্য মুখিয়ে আছে৷ সে ধীরস্বরে জবাব দিলো, “আজ শীত প্রচণ্ড”

“আচ্ছা! কিন্তু আমি শুনেছি বউ পাশে থাকলে আর শীত লাগে না।”

“ভুল শুনেছেন।”

“ওহহহ! আফসোস করার মত করে বলল ইরশাদ তারপরই মনে পড়লো, ” ওহ স্যরি তোমাকে তো জিজ্ঞেসও করলাম না। এভাবে এসেই আবার ফিরে যাচ্ছি তোমার কি খুব বেশি খারাপ লাগছে? একটু ভালো জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগও দিলাম না।”

গাড়ির বাতি নেভানো কিন্তু পথের অন্যান্য গাড়ির এক চিলতে যে আলো ছিটকে এসে পড়ছে তাতে মৈত্রী দেখছে ইরশাদকে৷ প্রথম দেখা শীতল দুটো বিড়াল চোখ, গম্ভীর চোয়ালের মানুষটা এত নরম স্বরে কথা বলে কি করে! এত যত্নশীল একটা পুরুষ কি করে হতে পারে! সবসময়ই নিজেকে দূর্ভাগা ভাবা মৈত্রীর হঠাৎই মনে হলো তার মত সৌভাগ্য নিয়ে এ জগত সংসারে আর কেউ আসেনি৷ এই মানুষটার এত আদর-যত্ন তাকে মাত্র ক’দিনেই তৃপ্ততার স্বাদ দিচ্ছে। এই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতেই তাকে প্রতি মুহূর্তে রবের শুকরিয়া আদায় করতে বাধ্য করবে, করছেও। ইরশাদ নিজের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে মৈত্রীকে আবারও প্রশ্ন করেছে৷ মৈত্রী মুচকি হেঁসে জানালো একটুও খা-রা-প লাগছে না এই জার্নি বরং উপভোগ করছে। ভোরের দিকে তারা যখন পৌঁছে গেল বাড়ির সামনে তখন নোরা, মৈত্রী দু জনেই ঘুমিয়ে ছিল ইরশাদ, ময়ূখের কাঁধে। ভোরের কুয়াশামাখা আবছা আলোয় দৃশ্যটা ইরশাদই খেয়াল করেছে পেছন থেকে। সে মৈত্রীকে আলতো ভাবে গালে হাত রেখে ডেকে তুলল। মৈত্রী জেগে কাঁধ থেকে মাথা তুলতেই যাচ্ছিলো তখন ইরশাদ বলে উঠলো, “দু জন মিলে ভালোই তো রাত কাটালে আমাদের দু ভাইকে বালিশ বানিয়ে।”

মৈত্রী হা হয়ে গেল এ কথা শুনে। এই লোকটা এত কথা জানে! তার দেখা ইরশাদ তো কথাই বলতো না সবসময়। গাড়ি থেকে ময়ূখ নোরা নেমে যেতেই মৈত্রী তার স্বভাবসুলভ নিস্তেজ কণ্ঠে বলল, “ছোট ভাই আর তার বউয়ের ঘুমের দিকে তাকানো উচিত নয়।”

“আমি তো গাড়ির সামনের যাত্রীদের দেখেছি। বাই দ্য ওয়ে, তোমার মুখে আমার নামটা কিন্তু দারুণ লাগে।”

“জ্বী!”

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে