#কাছের_মানুষ_দূরে_থুইয়া
#পর্ব৭
#Raiha_Zubair_Ripti
বসার ঘরে সোফায় বসে আছে তটিনী তার পাশে তাসফি। সকালের নাস্তা টা সেরেই রওনা দিবে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে। জাহানারা বেগম জহুরি চোখে তাকিয়ে দেখছে তটিনী কে। তটিনী জাহানারা বেগমের চাহনি তে অস্বস্তিবোধ করে। মেঘলা হোসেন টেবিলে খাবার বেড়ে ডাক দেয় তাসফি আর তটিনী কে। তাসফি তটিনীর হাত ধরে বসা থেকে উঠতে উঠতে জাহানারা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে-
-“ এমন চাহনি নিয়ে আমার বউয়ের দিকে তাকিয়ো না দাদি। ওর থেকে আমার বেশি অস্বস্তি লাগে।
জাহানারা বেগম লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হতাশার সুরে বলে- হ এহন তো আমার চাহনি তে তর অস্বস্তি লাগবো। বউ পাইছস সুন্দর এহন কি আর আমার মতো বুড়ির চোখের নিচে কালি পড়া চামড়া কুচকানো চাহনি ভালো লাগবো?
তাসফি কিছু বললো না। তটিনীর জন্য চেয়ার টেনে দিয়ে নিজেও চেয়ারে বসে পড়লো। তানু টিফিন বক্সে তটিনী আর তাসফির জন্য খাবার প্যাক করছে। ওখানে গিয়ে গোছগাছ করতে করতে অনেক টা সময় লেগে যাবে সাথে রান্নার প্যারাতেও ভুগতে হতে পারে। সেজন্য খাবার দিয়ে দিচ্ছে।
তটিনী আর তাসফির খাওয়া শেষ হলে মেঘলা হোসেন তটিনী কে নিজের রুমে আসতে বলে। তটিনী শ্বাশুড়ির কথা মতো তার রুমে যায়। বিছানায় চার থেকে পাঁচ টা গয়নার লাল বক্স সাজানো। তটিনী কে দরজার কাছে দাঁড়ানো দেখে মেঘলা হোসেন ইশারায় ভেতরে আসতে বলে। তটিনী কাচুমাচু হয়ে ভেতরে ঢুকে।
-“ বসো আমার পাশে।
তটিনী মেঘলা হোসেনের পাশে বসে।
-“ এই গয়না গুলোর মধ্যে কোনটা পছন্দ হয় তোমার দেখো তো।
তটিনী গয়না গুলোর দিকে একবার চোখ বুলায়। গয়না গুলোর কারুকাজ ভীষণ সুন্দর। গয়না গুলোর মধ্যে থাকা ছোট্ট একটা চিকন হাড় ধরে উল্টেপাল্টে দেখে।
-“ এটা পছন্দ হয়েছে?
তটিনী উপর নিচ মাথা নাড়ায়। মেঘলা হোসেন স্মিত হেঁসে বলে- আর কিছু পছন্দ হয় নি?
-“ উঁহু।
মেঘলা হোসেন তটিনীর হাত থেকে হাড় টা নিয়ে তটিনীর গলায় পড়িয়ে দেয়। আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বলে- বাহ বেশ সুন্দর লাগছে তো তোমায়। পছন্দ আছে বলতে হবে তোমার।
তটিনী মুচকি হাসে।
-“ এবার চটপট রেডি হয়ে নাও। বেরোতে হবে তো।
তটিনী গলা থেকে হাড় টা খুলতে নিলে মেঘলা হোসেন বলে উঠে – আরে হাড় খুলছো কেনো? এটা তোমারই প্রাপ্য। তোমাকে বিয়ের পর কিছু দেওয়া হয় নি এখনও। সেজন্য এটা তোমার উপহার।
তটিনী ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষন চুপ থেকে হাড় টা নিয়ে রুম থেকে বের হয়।
তাসফি রেডি হয়ে বসে আছে রুমে। তটিনী কে দেখামাত্রই তাড়া দিয়ে বলে- রেডি হও তাড়াতাড়ি, যেতে হবে তো নাকি।
তটিনী হাড় টা তাসফির সামনে মেলে ধরে বলে- মা এটা দিলো।
তাসফি তাকায় হাড় টার দিকে। -“ ওহ্।
-“ হুমম।
তাসফি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মানিব্যাগ প্যান্টের পকেটে ভরে বলে- বোরকা পড়ে রেডি হইয়ো।
তটিনী চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় তাসফির দিকে।
-“ আমার তো বোরকা নেই।
-“ আলমারি তে আছে।
তটিনী আলমারির দিকে এগিয়ে যায়। পিংক কালারের একটা বোরখা সাথে হিজাব ও।
তটিনী পড়নে থাকা থ্রিপিস টার উপর দিয়েই বোরকা টা পড়ে রেডি হয়। তাসফি বিছানায় বসে বসে তটিনীর হিজাব বাঁধা দেখে নিলো। তটিনী পুরোপুরি রেডি হতেই তাসফি ল্যাগেজ হাতে করে তটিনী কে সাথে নিয়ে নিচে নামে।
তাজদিদ আর জাহাঙ্গীর হোসেন অফিসে গেছেন। তটিনী আর তাসফি মেঘলা হোসেন, তানু আর জাহানারা বেগমের থেকে বিদায় নিয়ে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।
রাজশাহী তে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে গেছে তটিনী আর তাসফির। তাসফি তার অফিস আর তটিনীর ভার্সিটির মাঝামাঝি একটা জায়গায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। দুজনের জন্য যাতায়াত সহজ। তাসফির ফ্রেন্ডে রোমানের সাহায্য আগেই রুম টা গুছিয়ে নিয়েছিল তাসফি। খাট,আলমারি, পড়ার টেবিল,ছোট্ট ফ্রিজ, ডাইনিং টেবিল প্রায় সবই আছে।
তাসফিদের ফ্ল্যাটের পাশের ফ্ল্যাটেই রুমান থাকে বউ নিয়ে।
তাসফি রা আসবে শুনেই রান্নাবান্না করে রেখেছে রুমানের বউ আলেয়া। তাসফি বলেছে খাবার সাথে করে নিয়ে এসেছে কিন্তু আলেয়া শুনেনি। খাবার রেখে গেছে রুমে। অগ্যত শেষ মেষ বাড়ি থেকে আনা খাবার গুলো ফ্রিজে রেখে দেয়।
তটিনী ওয়াশরুমে গেছে ফ্রেচ হতে। এই যানজটে এতদূর ট্রাভেল করার দরুন এখন ফ্রেশ না হলেই নয়।
তাসফি বসে আছে খাটে। তটিনী বের হলে সেও ঢুকবে ওয়াশরুমে। প্রায় বিশ মিনিট পর তটিনী ওয়াশরুম থেকে বের হলে তাসফি ওয়াশরুমে ঢুকে।
ওয়াশরুমে ঢোকার আগে তাসফি তটিনী কে বলে যায় খাবার সাজাতে।
তটিনী ভেজা টাওয়াল বেলকনিতে মেলে বসার ঘরে আসে। তাদের ফ্ল্যাটে দুটো রুম একটা কিচেন রুম আর ড্রয়িং রুম। তবে ড্রয়িং রুম টা খুব একটা বড় নয়।
টেবিলের কাছে এসে তটিনী ঢেকে রাখা খাবারের প্লেট টা উঁচু করে। প্লেটে পোলাও,গরুর মাংস আর মুরগীর মাংস দিয়ে বুটের ঘন ডাউল রান্না।
তটিনী নিজের প্লেটে খাবার বেড়ে তাসফির জন্য ও খাবার বেড়ে অপেক্ষা করে। তাসফি ভেজা টাওয়াল দিয়ে চুল মুছে সেন্টু গেঞ্জি পড়ে খাবার টেবিলে আসে। তটিনীর পাশে বসে বলে-
-“ অপেক্ষা করতে গেলে কেনো আমার জন্য।
তটিনী প্লেট টা এগিয়ে দিতে দিতে বলে-
-“ আপনাকে ফেলে একা একা খাবো নাকি?
-“ কেনো আমাকে একা রেখে খাওয়া বারন নাকি?
-“ আম্মু কে কখনও দেখি নি আব্বুকে রেখে একা খেতে।
-“ বাহ! ভালো কিছু শিখেছো তাহলে। নট ব্যাড। মুখে খাবার তুলে নিতে নিতে বলে কথাটা তাসফি।
তটিনী ও ততক্ষণে খাবার মুখে তুলে। কয়েক লোকমা খাওয়ার পর তটিনী বেশ ঝাল অনুভব করলো। আলেয়া রা খাবারে প্রায় ভালোই ঝাল খায়। কিন্তু তটিনী ঝাল খেতে পারে না। কয়েক লোকমা খাওয়ার পরই ঝালে কেশে উঠলো। তাসফি তড়িঘড়ি করে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। তটিনী কোনোরকমে পানি টা খেয়ে নিলো। ঝালে চোখ লাল হয়ে গেছে।
-“ খুব ঝাল লাগছে?
তটিনী উপর নিচ মাথা নাড়ালো। খাবারের কালার দেখে বোঝার উপায় নেই এই খাবারে এই মাত্রায় ঝাল থাকতে পারে।
তাসফি চেয়ার ছেড়ে উঠে রান্না ঘর থেকে আসার পথে কফির জন্য বয়ে আনা চিনির কৌটা টা নিয়ে তটিনীর সামনে ধরে বলে-
-“ একটু চিনি খাও ঠিক হয়ে যাবে।
তটিনী তাই করলো। চিনির কৌটা থেকে বেশ অনেক টাই চিনি খেয়ে নিলো। চিনি খাওয়ার পর ঝাল কমলে তাসফি জিজ্ঞেস করে – খাবে?
তটিনী এঁটো খাবারের দিকে তাকিয়ে বলে- অনেক ঝাল, খেতে পারবো না। কিন্তু না খেলে তো খাবার গুলো নষ্ট হবে।
-“ খেতে ইচ্ছে না করলে খেতে হবে না। বাসা থেকে আনা খাবার খাবে?
-“ না।
-“ আচ্ছা তাহলে হাত ধুয়ে ফেলো। খাবার টা আমি খেয়ে নিব।
-“ আপনি আমার এঁটো খাবার খাবেন? অবাক হয়ে বলে তটিনী।
-“ হুমম। তাসফির স্বাভাবিক হয়ে বলা কথাটায় কুঁচকে ফেলা ভ্রু সটান হয়। তারপর আর কোনো শব্দ ব্যায় না করে হাত ধুয়ে রুমে চলে আসে।
তাসফি খাবার খেয়ে প্লেট ধুয়েমুছে উল্টো করে রেখে দেয়। আর বাটিতে বেঁচে থাকা খাবার গুলো ফ্রিজে তুলে রাখে।
—————————
পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলে পড়েছে অনেক আগেই। ফ্ল্যাটের বড় বেলকনি টায় কয়েল জ্বালিয়ে চেয়ারে বসে আছে তটিনী আর তাসফি। আজকাল মশার উপদ্রব বেড়েছে প্রচুর। কয়েল ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব। এই ছয় তলার উপর থেকে সন্ধ্যার ব্যাস্ত শহর দেখছে তাসফি তটিনী। দিনের আলো বুজে যাওয়ায় রাস্তার পাশে থাকা সব কৃত্রিম আলো গুলো জ্বলে উঠেছে।
-“ কাল থেকে ভার্সিটি যাব?
তটিনীর কথায় নীরবতা ভাঙে। তাসফি ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়।
-“ কাল থেকে যাবে?
-“ হুমম,আপনি বললে।
-“ আচ্ছা। পৌঁছে দিয়ে আসবো?
-“ না না তার দরকার পরবে না। আমি তো চিনি এই শহর টা। কত ঘুরেছি। সব রাস্তা চেনা আমার।
উৎফুল্লতার সহিতে কথাটা বলল তটিনী।
-“ তোমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে? মুহূর্তে মুখের উৎফুল্লতা সরে গিয়ে গুমোট হয়। তটিনীর নীরবতা দেখে তাসফি ব’লে উঠে- এখনও ভালোবাসো তাকে? আই মিন মনে পড়ে?
তটিনী তড়িৎ গতিতে তাকালো তাসফির দিকে। কিয়ৎ ক্ষন চুপ থেকে বলে- আমি এখন বিবাহিত। প্রাক্তন কে মনে রেখে নিজ সংসারে অশান্তি বয়ে আনবো এমন মেয়ে আমি নই। আমি বর্তমান নিয়ে ভাবি। আর বর্তমান কেই ভালোবাসি।
তাসফি চুপচাপ শুনলো তটিনীর কথা। সন্ধ্যার আগ দিয়ে খাওয়ার দরুন তাসফির ক্ষিদে লাগছে না। কিন্তু তটিনী অল্প পরিমান খাওয়ায় তার এখন হাল্কা কিছু খেতে ইচ্ছে করছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে ভাবে তাসফি কে কি করে বলবে তার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে সেটা।
-“ তুমি একটু থাকো,আমি আলেয়া ভাবি কে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আসলে আমার একটু বাহিরে যেতে হবে।
কথাটা বলে উঠে দাঁড়ালো তাসফি। তটিনী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। পকেট থেকে ফোন বের করে রোমান কে টেক্সট করলো আলেয়া কে তটিনীর কাছে কিছুক্ষণের জন্য এসে থাকতে সে না আসা অব্দি।
তাসফি চলে যেতেই আলেয়া আসে তটিনীর কাছে। তটিনী তখন বসে ছিল বেলকনিতে। আলেয়া কে দেখে মুচকি হাসি উপহার দিলো। বিনিময়ে আলেয়া ও হাসি উপহার দিয়ে তটিনীর পাশে বসলো।
-“ খুব ঝাল লেগেছে খাবার? ইশ আমি জানতামই না তুমি ঝাল খেতে পারো না। খুব সরি। প্রথম দিনেই এমন বাজে পরিস্থিতি ফেলার জন্য।
তটিনীর বুঝতে বাকি রইলো না। কথাটা কি করে আলেয়ার কান অব্দি গেছে।
-“ সরি বলছেন কেনো আপু। ঝাল ছিল কিন্তু খাবার টা অনেক টেস্ট ছিলো। ঝালের জন্য খেতে পারি নি বলে আফসোস হচ্ছে।
-“ আমি কালই আবার রান্না করে দিব ঝাল কম করে। আফসোস করতেই দিব না। আচ্ছা রান্না বান্না পারো তুমি?
তটিনী মিনমিন সুরে বলল- খুব একটা ভালো পারি না। ভাত, ডাল,ডিম,ভাজি এসব পারি।
-“ সমস্যা নেই আমি তোমাকে শিখিয়ে দিব।
তটিনীর মুখ খুশিতে জ্বলে উঠলো- সত্যি!
-“ হুমম। আমাকে আপনি করে বলবে না তুমি করে বলবে কেমন?
-“ আচ্ছা।
আলেয়ার সাথে গল্পগুজব করতে করতে বেশ ফ্রী হয়ে যায় তটিনী। রাত আটটার দিকে তাসফি বাসায় আসে। হাতে কিছু ঠোঙা নিয়ে৷ ঠোঙা গুলো দেখেই তটিনী বুঝে ঠোঙায় ভাজাপোড়া কিছু আছে। ঠোঙা টা তটিণী-র হাতে ধরিয়ে দিতেই তটিনী দেখে ঠোঙার ভেতর পেঁয়াজু, বেগুনি আছে। তটিনী খাবার গুলো প্লেটে ঢেলে আলেয়ার সামনে এগিয়ে দেয়। আলেয়া স্মিত হেঁসে একটা বেগুনি উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়।
তটিনী এবার প্লেট টা তাসফির দিকে এগিয়ে দিলে তাসফি বলে- আমি খাবো না৷ তুমি খাও। তোমার জন্য এনেছি।
তটিনী আর জোর করলো না। দু একটা পেঁয়াজু খেয়ে রেখে দিলো বাকিটা।
ঘুমানোর আগ দিয়ে তটিনী শ্বাশুড়ি, বোন আর মায়ের সাথে কথা বলেছে। তটিনীর মা পইপই করে বলে দিয়েছে তাসফির কথা মতো চলতে। তটিনী চুপচাপ শুনেছে তার মায়ের কথা। বোন ও সেম কথা কথা বলেছে। শ্বাশুড়ি একটু ব্যাতিক্রম কথা বলেছে। সেটা হলো তাসফি কে দেখে রাখার। তাসফির সুবিধা অসুবিধা বুঝে নেওয়ার। ঝুটঝামেলা বিহীন সংসার তটিনীর। বেশ ভালোই লাগছে। তাসফিকে অতোটা খারাপ ও লাগছে না।
তাসফির পাশে শুয়ে শুয়ে আকাশকুসুম ভেবে চলছে তটিনী। কাল থেকে ভার্সিটি যাবে। ভার্সিটি তে যাওয়ার পথে আদিল দের বাসা সামে পড়ে। তখন যদি আদিলের সাথে বাই এনি চান্স দেখা হয় তখন কি তটিনী এড়িয়ে যাবে? এড়িয়েই তো যাওয়া উচিত।
এদিকে তাসফি কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। তটিনীর সাথে যে আদিলের দেখা হবে কোনো না কোনো এক সময় এটা নিয়ে সন্দেহ নেই। আদিল যে তটিনী কে সব বলবে এটা তাসফি খুব ভালো করেই জানে। তাসফিও চায় আদিল বলুক তাকে সব নিজের মুখে৷ আর তটিনী এসে তাকে জিগ্যেস করুক,অভিযোগ করুক।
#চলবে?