# কাগজের নৌকা
# লেখা: সাজ্জাদ আলম বিন সাইফুল ইসলাম
# পর্ব: ০৫
.
.
মা আর বাবুল চাচার বিয়ের আয়োজনে অনেকটা সময় পার হলো। কাজী ডেকে এনে বিয়েও পড়ানো হলো। আমি মনে মনে অনেকটা ভেঙে পড়েছি কিন্তু কাউকে বুঝতে দিচ্ছি না। মালা আমার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে। মাকে আমি বধূবেশে এখনও দেখিনি। নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর লাগছে। লাগবেই তো, আমার মা তো পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরী মা। হতেই হবে, মা কার সেটা তো দেখতে হবে। ছোট করে খাওয়ার আয়োজনও করা হয়েছে। বস্তির লোকজন সেখানে নাকি আমন্ত্রিত। হুট করেই এতকিছু হয়ে গেল। আমি সবটা বুঝে ওঠার আগেই যেন শেষ। খাওয়া-দাওয়ার জন্য বাবুল চাচা তার কাঁচা টাকা বের করে খরচ করতে দিয়েছে। এখনও বাবুল চাচাই বলছি। তাতে বাবা বা আব্বা ডাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। আমার আব্বা একজনই। আমার জন্মদাতা।
খাওয়ার সময় আমাকে আর মালাকে নিয়ে যাওয়া হলো। মায়ের পাশে আমাকে বসতে দেয়া হলো। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছে। এ কান্না আমার হৃদয়টাকে নরম করে দিচ্ছে বারবার। আমি নিজেকে চেপে রাখছি। আমি কান্না করলে এখানে অন্য আরেক পরিবেশের সৃষ্টি হবে। যেটা আমি একদমই চাই না।
এই প্রথম নিজের ঝুপড়িতেই নিজেকে অতিথি মনে হচ্ছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও খাবার খাচ্ছি। অল্প সময়ে তিনটা পদ করে ফেলেছে। আমার মায়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে বস্তিবাসীর এ নাটকটা আমার ঠিক পছন্দ হলো না। খাওয়া শেষ করে বাবুল চাচা আমাকে বললো,
‘আপন, তুই আর তোর মা আমার বাড়িতে থাকবি। এ ঝুপড়িতে থাকা চলবে না।’
তার এ কথা শুনে আমার মাথায় যেন বাজ পড়লো। কী বলে লোকটা? আমার আব্বার বানানো ঝুপড়ি ছেড়ে আমি নাকি তার ঘরে গিয়ে উঠব। পাগল নাকি?
‘না না, আমি এখানেই থাকুম। আপনে মাকে নিয়া যান।’
আমার কথা শুনে মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
‘না বাপ, তুইও চল। তোরে ছাড়া আমি থাকবার পারুম না।’
‘না মা, এ হয় না। ওটা তোর বাড়ি আর এটা আমার আব্বার ঝুপড়ি। আমার আব্বা নিজ হাতে এটা বানাইছে। আমি এটা ছাইড়া কোথাও যামু না।’
‘তোরে ফালাইয়া আমি কেমনে যামু বাপ। কেমনে থাকুম তোরে এইখানে একলা ফালাইয়া। চল বাপ, জেদ করিস না।’
কিন্তু আমি আমার কথায় অনঢ়। বললাম,
‘না মা। আমারে তুই জোর করিস না।’
এমন সময় বাবুল চাচা বলে উঠলো,
‘যাইবা না ঠিক আছে। তয় দিনে একবার হলেও মায়েরে দেইখা আসিস।’
আমি বললাম, ‘আসুম। আমি মায়েরে না দেইখা থাকবার পারুম না। প্রতিদিন একবার কইরা যামু।’
মা যাওয়ার সময় হাউমাউ করে কাঁদলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। আমি কাঁদি নাই। চুপচাপ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। শেষে শুধু একটা কথাই বললাম,
‘যা মা। দেরি হইতাছে।’
মা যাবার সময় বারবার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছিল। আমিও তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বুকটা আমার ফেটে যাচ্ছিল। চোখের পলক ফেলছিলাম না। ফেললে যদি চোখ দিয়ে পানি ঝরে, তাই।
কে যেন বলে উঠল,
‘যাক, আপদটা বিদেয় হলো।’
আমার মা আপদ ছিল? আমি মেকি হাসি। হায়রে সমাজ! যে সমাজ এক মুঠ ভাত দিতে পারে না সে সমাজ মানুষকে খুব সহজে অপরাধীর কাঠগড়ায় তুলে পুতুল নাচ নাচায়। কত রঙ দেখব মাবুদ! রঙের দুনিয়ায় তো রঙ লীলা তো চলবেই। যার ভুক্তভোগী হই আমরা, নিচু স্তরের মানুষেরা।
আস্তে আস্তে সবাই বিদায় হলো। শুধু মালা আমার পাশে দাঁড়িয়ে। সবাই যখন চলে গেল তখন মালা বলে উঠল,
‘কাঁদলি না তুই?’
‘ক্যান কাঁদব রে মালা? কোন দুঃখে?’
‘চাচী তোরে ছাইড়া যে চইলা গেল।’
‘তাতে কী মালা, মা তো সুখ পাইব। আমার জন্যে মা ক্যান সুখ থাইকা বঞ্চিত হইব, বল?
মালা মাথা নিচু করে চলে গেল। আমি ধপাস করে বসে পড়লাম। চোখের পলক ফেলতে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
.
ঝুপড়ির ভেতর আমি আজ একা। বালিশটা টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। পাশ ফিরে দেখি জায়গাটা খালি। মা থাকলে হয়তো ওখানেই ঘুমাতো। আমার চোখে পানি চলে আসলো। বুকটা হাহাকার করে উঠলো। আমি হুহু করে কেঁদে উঠলাম। জোরে জোরে কাঁদতে লাগলাম। আজ আমি একা বড্ড একা। আল্লাহ এ কী পরীক্ষা নিচ্ছেন আমার!
বাইরে প্রচণ্ড বাতাস বইছে। জানালা দিয়ে দেখলাম আকাশে খুব মেঘ। দমকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। আমি কাঁথাটা টেনে জড়োসড়োভাবে থাকলাম। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। আমার কান্নার শব্দ এ বৃষ্টির শব্দে নিশ্চয়ই কেউ শুনবে না। কেউ এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলবে না,
‘ভয় পাস না বাপ। আমি তো আছি।’
এই প্রথম নিজেকে এত একলা লাগছে। অথচ ছয় মাস আগেও কত সুখী ছিলাম আমরা। সেসব কথা ভাবতেই আরও বেশি কষ্ট পাচ্ছি।
নানান কথা ভাবতে ভাবতে রাতটা পার হয়ে গেল। চোখে আমার ঘুম নেই। ফুলে গেছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। বাইরে রোদ উঠেছে। ঝুপড়ির বাইরে থেকে আওয়াজ আসল,
‘আপন, ওঠ। আপন?’
আমি বিছানা থেকে উঠলাম,
‘আসতাছি।’
আওয়াজ দেখে বুঝলাম মালা এসেছে। ঝুপড়ির দরজা খুলে বিছানায় এসে বসলাম। মালা আমার পাশে বসলো।
‘তোর চোখ ফুলে গেছে ক্যান?’
‘মা নাই তাই ঘুম হয় নাই মনে হয়।’
‘তুই কাঁদছিলি?’
আমি মাথা নিচু করে বললাম,
‘না, কাঁদি নাই। ক্যান কাঁদব? মা তো সুখে থাকবো। মায়ের সুখেই আমার সুখ।’
‘চল বাইরে যাইরে যাই। ক্ষুধা পাইছে আমার।’
‘পটে মুড়ি আছে, নিয়ে খা।’
‘বাইরে যাবি না?’
‘না।’
‘ক্যান?’
‘ভাল্লাগে না।’
মালা আমার কথা শুনে মনটা খারাপ করে ফেললো। আমি বুঝতে পারলাম আমার মন খারাপ করে থাকাতে ও কষ্ট পেয়েছে। আপন বলতে মালাই এখন আমার সব।
‘আমি গেলাম।’
বলে মালা উঠতে লাগল। আমি বুঝলাম ও মন খারাপ করেছে। আমি বলে উঠলাম,
‘দাঁড়া। আমিও যাই।’
অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমি ঝুপড়ি বন্ধ করে বাইরে বের হলাম। আমি কখনওই মালাকে কষ্ট দিতে চাই না।
.
মাকে খুব মনে পড়ছে। কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। মালাকেও নয়। বিকালবেলা পুকুরপাড়ে বসে গতকাল ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে ভাবছি। কী থেকে কী হয়ে গেল! আচ্ছা মা ভালো আছে তো? আমাকে তার মনে আছে? নাকি নতুন সংসার পেয়ে আমাকে ভুলে গেছে? কই, একবারও তো ঝুপড়িতে আমাকে দেখতে আসল না। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে, খুব আশা করেছিলাম মা আসবে। আমাকে কাছে টেনে বলবে,
‘আমি আসছি রে বাপ। আর কোত্থাও যামু না।’
আমার চোখের কোনে পানি জমতে লাগল। একটা ইট সোজা পানিতে ঢিল মেরে চোখের পানি মোছার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। মা যদিও খুব দূরে থাকে না তবুও ওই হারামজাদার বাড়ি যেতে আমার ঘৃণা হচ্ছে। লোকটাকে আমার এখনও সুবিধার মনে হচ্ছে না। শুধুমাত্র মায়ের সুখের কথা ভেবে আমি কিছু বলিনি।
.
‘আপন, নে বাপ, খাইয়া নে। দেখ তোর জন্যে কত খাবার নিয়া আসছি।’
‘না মা আমি খামু না।’
‘ক্যান বাপ?’
‘আমি তোর উপর রাগ করছি। সারাদিন আসিস নাই ক্যান। তুই জানিস না, তোকে ছাড়া আমি খাইতে পারি না, ঘুমাইতে পারি না।’
‘এখন তো আসছি বাপ, নে খাইয়া নে।’
‘না খামু না।’
‘আচ্ছা আমি তোরে খাওয়াই দেই। নে হা কর।’
আমি হা করতেই চোখ খুললাম। অন্ধকার ঘর। পাশেই কুপিটা জ্বলছে। কোথাও কেউ নেই। চারপাশটা ভালো করে দেখলাম। না কেউ নেই। ঝুপড়ি থেকে বাইরে বেড়িয়ে আসলাম। নাহ! আসলেই কেউ নেই। তাহলে সেটা কি স্বপ্ন ছিল?
আমার চোখে আবার পানি চলে আসল। বিছানায় বসে শব্দহীন কান্না জুড়ে দিলাম। মায়ের শোয়ার জায়গাটা বারবার দেখতে লাগলাম। নেই, মা নেই। মা থাকতেও নেই। হয়তো আর কখনও কাছে পাব না তাকে। আমাকে কাছে টেনে বলবে না,
‘আয় বাপ তোর মাথায় হাত বুলাই দেই। তুই ঘুমা।’
এই ঝুপড়িটা কত ছোট, তাও কেন জানি কত বড় মনে হচ্ছে। যেখানে যা রাখছিল সেখানেই সেটা এখনও সাজানো আছে। কোনোকিছু ওলটপালট করিনি। মাকে খুব বলতে ইচ্ছে করছে,
‘মা, আমি তোকে ভালোবাসি মা।’
(চলবে)