ওয়ারদূন আসরার পর্ব-২৩

0
1366

#ওয়ারদূন_আসরার
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব – ২৩ ||

কমলা দেবী একপ্রকার ধমক দিয়ে যীনাতকে বলে,”তোর সাহস কেমতে হয় আর নাতিরে এমনে জড়াইয়া ধরণের? ছ্যা ছ্যা ছ্যা ঠাকুর তুমি আরে কি দেহাইলা। এই মাইয়ারে কতো ভালা ভাবতাম আর এই মাইয়া কিনা আর নাতির দিকে এমনে নজর দিলো? আর তো তোরে পথম থেইকাই সইয্য হইতো না ভালা হইসিলাম কিন্তু এহন বুজবার পারতাসি আই কি ভুল করসি। যার জম্মের ঠিক নাই হেয় আবার কেমতে ভালা হইবো!

শেষের কথায় জাইফ চেঁচিয়ে বলে,”ঠাম্মি!!”

যীনাত ছলছল চোখে কমলা দেবীর দিকে তাকালো। শেষ পর্যন্ত কিনা তার জম্ম ঠিক আছে কিনা সেই প্রশ্ন তোলা হলো? আল্লাহ এসব শুনানোর আগে মৃত্যু কেন দিলে না?

এসবই ভাবছে গালে হাত দিয়ে। যীনাতের রুম থেকে চিৎকার চেঁচামেঁচি শুনে সকলেই উপস্থিত হলো। কমলা দেবী বলে,”তুই চুপ কর ছ্যাড়া আর কতো এই মাইয়ারে বাচাইয়া রাখবি হ্যাঁ আইজ আমি এর হেস্তনেস্ত কইরাই ছাড়ুম। আর এই চরিত্রহীন মাইয়া তুই…”

কমলা দেবীর কথার মাঝে দিয়ে দেবনাথ দেব ধমকের সুরে বলে,”কমলা!! মুখ সামলে কথা বলো তুই কাকে কি বলছিস ভেবে বলছিস তো? সব জায়গায় সবসময় এতো বাড়াবাড়ি কিসের তোর? সাহস তো কম না তুই ওকে চরিত্রহীন বলছিস!”

– দেখ দাদা আর লগে লাগতে আহিস না। আমি নিজের চোখে কিছু না দেখলে তো কইতাম না। তোমরা কি তোমাগো পোলা আর এই মাইয়ার খোয রাহো? আইজ জানো কি করসে এইদুইটাই ছি ছি ছি রুচিতে বাধছে আর কইতে।

– দেখো ঠাম্মি ভনিতা না করে সোজাসাপটা বল কি হয়েছে এখানে শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয়না।

– হেইডা তোর গুনবতী দাদারে জিগা কি করসে আর এই মেয়ে আইজ তোর গায়ে ৪০ঘা চাবুক লাগাইয়া এই বাড়ি থেইকা বাইর করমু।

সবাই অবাক হয়ে কমলা দেবীর দিকে তাকায়। এবার নিকেশ বলে,”পিসি তুমি অন্যায় করতে পারো না। তুমি আমাদের বলো কি করেছে ওরা!”

– এই মাইয়া তোর পুতরে জড়াই ধইরা ছিলো আই নিজ চক্ষে দেখসি।

সবাই অবাক হয়ে একবার জাইফের দিকে তাকায় আরেকবার যীনাতের দিকে। যীনাত নিচের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে গালে হাত দিয়ে। জাইফের যেনো কোনোরকম হেলদোল নেই সে নিজেকে শক্ত রেখেছে। যীনাতের হাত ধরে কমলা দেবী যেই টান দিবে ওমনি কমলা দেবীর হাত দেবনাথ দেব ধরে ফেলে এবং বলে,”যীনাতকে ছাড়ো!”

– মানে কি দাদা ও অন্যায় করসে আর আই এরে ছাড়ি দিমু ভাবলি কেমনে?

– যীনাত কোনো অন্যায় করেনি কারণ যীনাত জাইফের বিবাহিতা স্ত্রী।

এই কথা শুনে সকলের অবস্থা দেখার মতো বিশেষ করে সোভন আর কমলা দেবী। কমলা দেবী চমকে বলে,”মানে কি কবে অগো বিয়া অইলো আর আরা তো কেউ জানতাম না অগো বিয়া হইসে।”

– আগে জানতে না এখন তো জানলা। এখন আশা করছি যীনাতকে চরিত্রহীন বলে গালি দেয়ার অধিকার তোমার নেই।(চোখমুখ গরম করে জাইফ)

কমলা দেবীর হাত থেকে যীনাতের হাত ছাড়িয়ে দেবনাথ দেব নিজের কাছে যীনাতকে রাখলো। যীনাত তো তখনো কেঁদেই চলেছে। কমলা দেবী আবার চেঁচিয়ে বলে,”না না না আই এই বিয়া মানিনা! আগো পুতের লগে এমন একটা মাইয়ার বিয়া হইসে যার না আছে যাতপাত আর না আছে জম্মের ঠিক! না না না একদম মানিনা আই বিয়া।”

জাইফ রাগে চিল্লিয়ে উঠলো। সকলে জাইফের রাগ দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো। দেবনাথ দেব তো চোখ গরম করে কমলা দেবীর দিকে তাকিয়ে আছে। জাইফ রাগে টি-টেবিলের উপরের কাঁচটা জোরে আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে ফেললো। সবাই ভয়ে কিছুটা কেঁপে উঠলো। এই প্রথম জাইফের এমন রাগ সবাই দেখলো। জাইফ হুংকারের সুরে বলে,”ঠাম্মি তুমি কতোটুকু জানো ওর সম্পর্কে যার জন্য বারবার ওকে এই উপাধি দিচ্ছো? কি হলো চুপ কেন এন্সা মি!!(চিল্লিয়ে) তুমি জানো যীনাতের বাবা একজন সরকারী কর্মকর্তা ছিলো। ওর বড় জেঠা ছিলো ভার্সিটির একজন প্রফেসর। পুরো পরিবার ছিলো উচ্চ শিক্ষিত কিন্তু বোম ব্লাস্টের জন্য পুরো পরিবার ধ্বং হয়ে গেছে। শুনতে পেরেছো আমার কথা? ধ্বংস হয়েছে গেছে দুর্ঘটনায়!!”

রিকেশ জাইফের কাছে গিয়ে জাইফকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করে। সবাই সবটা শুনে কেমন অপরাধবোধ করছে। কারণ এক মুহূর্তের জন্য তারা মুখে প্রকাশ না করুক তাদের মনে যীনাতের জন্য কিছুটা হলেও ঘৃণা জম্মেছিলো। কিন্তু মেয়েটা পরিবার হারিয়ে যে কতোটা অসহায়ভাবে ছিলো সেটা ভুলে গেছে। সত্যি তার এরূপ কাজে তারা ভীষণ লজ্জিত। যীনাত তখনো ফুঁপিয়ে কাঁদছে। হঠাৎ মল্লিকা দেবী বলে উঠলেন,”কিন্তু একজন সনাতন ধর্মের ছেলের সাথে এক মুসলিম মেয়ের বিয়ে কি করে হলো?”(অবাক হয়ে)

– জাইফ নিজেও ইসলাম গ্রহণ করেছে।

এটা শুনে শুরু হলো কমলা দেবীর চেঁচামেচি। সে জানতো না যীনাত মুসলিম তার উপর জাইফ যে ইসলাম গ্রহণ করেছে এখন তো কথাই নেই। ভাঙ্গা রেডিওর মতো চেঁচামেচি করে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। জাইফ রিকেশকে ইশারায় ইনজেকশনের কথা বললো। রিকেশ মাথা নাড়িয়ে কমলা দেবীকে টেনেটুনে নিচে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর অটোমেটিক কমলা দেবীর চিল্লানো বন্ধ হয়ে গেলো। নিকেশ জাইফের সাথে কথা না বলে চলে যেতে নিলে জাইফ এসে আটকায়।

– বাবা এভাবে কেন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছো?

– তুই আমায় বাবা ডাকবি না তোর বাবা ডাকার কোনোরকম অধিকার নেই। যখন অন্য ধর্ম গ্রহণ করবি তখন মনে ছিলো না তোর মা আছে বাবা আছে? হুট করে এভাবে অন্য একটা মেয়ের জন্য নিজের ধর্মকে বিসর্জন দিলি ছিহ! এখন আমি সমাজে কি করে মুখ দেখাবো হ্যাঁ.. কি করে?

– বাবা প্লিজ আমার কথা…

– আবার বাবা বলেছি না আমাকে বাবা ডাকবি না। মল্লিকা চলো এখান থেকে। ছেলে এখন বড় হয়েছে সে এখন তার নিজের সিদ্ধান্ত একাই নিতে জানে তার মা-বাবাকে বলার প্রয়োজনবোধ করেনা।

বলেই নিকেশ জাইফের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো আর মল্লিকা দেবী জাইফের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজেও চলে গেলো। আস্তে আস্তে সবাই চলে গেলো শুধু দেবনাথ দেব থেকে গেল। জাইফ কষ্টে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়। দেবনাথ দেব জাইফের কাধে হাত রেখে বলে,”চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে। আসলে ওরা তোর মা বাবা এমন বড় ধাক্কা সামলাতে পারেনি তাই কিছুটা অভিমান করেছে। কিছুদিন পর দেখবি এমনি-ই সব ঠিক হয়ে যাবে আর আমি তো আছি নাকি? তুই এখন যীনাতকে সামলা। যীনাতের পাশে ছায়া হয়ে দাঁড়া এবং ওকে সময় দে ভালো লাগবে।”

বলেই দেবনাথ দেব চলে গেলেন। জাইফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে যীনাতের কাছে গিয়ে বলে,”শুয়ে পরো গিয়ে।”

– কি.. কি.. কিন্তু!

– আমিও তোমার সাথে শুবো আসো।

যীনাত আর অমত করলো না জাইফের সাথে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

– নায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া কে মারলো আমার সৈন্যদের কার এতো বড় সাহস!!?

বলেই হাতে থাকা ওয়াইনের গ্লাসটা সামনে থাকা কারুকাজ করা আয়নায় ছুঁড়ে মারলো। রাগে যেনো তার গায়ে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। সআমনে থাকা অবয়ক টা কেঁপে উঠে বলে,”আপনি শান্ত হন সর্দার।”

– কি করে শান্ত হবো কি করেএএএ? ওয়ারদূন আসরারও হাত থেকে ছুটে গেলো আর ওই রাজকুমারকে তো খুঁজেই পাইনা। তাহলে কে বারবার আমার পরিকল্পনায় বা হাত ঢুকায়?? ওই মেয়ে কেন বারবার বেচে যায়?

– আমার কাছে একটা পরিকল্পনা আছে আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি আপনায় ধারণা দিতে পারি।

– যা পারো বলো তবে ভালো কিছু হতে হবে।

– ঠিক আছে আপনি শান্ত হোন আর শুনুন। আপনি মারিন রাজ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করুন। যুদ্ধতে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো ভাবে রাজকুমার আর সেই ওয়ারদূন আসরার আসবে। সেখান থেকে আমরা তাদের দুজনকে পেয়েও গেলাম আবার রাজ্যটাও আমাদের অধীনে চলে আসলো কি বলেন?

সহকারীর(অবয়ক) কথায় সর্দার কিছুক্ষণ ভেবে হেসে উত্তর দিলো,”হ্যাঁ তুমি মন্দ বলোনি তুমি এর জন্য পুরস্কার পাবে এখন তুমি আসতে পারো।”

সহকারী বেরিয়ে গেলো সর্দারের কক্ষ থেকে। আর সর্দার ভেতরে থেকে হু হা করে হেসে উঠে এবং বলতে লাগে,”রাজকুমার এবার তুই কোথায় পালাবি তোকে তো আমার আমার হাতে আসতেই হবে। তুই নিজেই তো আমার হাতে এসে ধরা পরবি।”

বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। কক্ষের বাইরে কেউ একজন ঠোঁটে একটা শয়তানি হাসি ঝুলিয়ে ভাবে,”আমার ফাঁদে শেষ পর্যন্ত পা দিলি৷ শালা বলদ মাথামোটা সর্দার। যেভাবে বুঝালাম সেভাবেই বুঝলো বলদ টায়। এখন দিন গুণতে থাক, যতো ইচ্ছা আরাম আয়েশ কর তুই!”

বলেই সহকারী চলে গেলো অন্যস্থানে।

————————————-

চলবে!!!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে