ওয়ারদূন আসরার পর্ব-১৯

0
1431

#ওয়ারদূন_আসরার
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব – ১৯ ||

জাইফ পিপাসায় পাগল হয়ে বেলকনিতে ছুটে গেলো আর যীনাতও তার পিছে পিছে। জাইফ হিংস্র সিংহের মতো গর্জে উঠলো। জাইফের চিৎকার এতোটা ভয়ংকর এবং আওয়াজ যে উপরের চাঁদকে লুকিয়ে রাখা মেঘ মিলিয়ে গেলো। চাঁদের আলো টা সোজাসুজি জাইফের উপর এসে পড়লো এবং আশেপাশে তীব্র আলোড়ন ছেয়ে গেলো আর জাইফ নিজের অজান্তেই শূণ্যে উঠে যায়। আলোর বেগ এতোই বেশি যে যীনাত চোখে হাত দিয়ে রাখতে বাধ্য হলো। জাইফের ছোট ছোট ঘা গুলো সেরে যেতে লাগে এবং জাইফের গলার হলুদ আভাটাও ধীরে ধীরে গলে গেলো। চাঁদের আলোয় জাইফের সৌন্দর্য আরও বেড়ে গেলো। আস্তে আস্তে জাইফ বেলকনিতে আসে এবং অচেতন হয়ে পড়ে যায়। সবটা স্বাভাবিক হতেই যীনাত পিটপিট করে চোখ খুললো এবং দেখলো জাইফ ফ্লোরে অচেতন হয়ে পড়ে আছে। যীনাত চটজলদি জাইফের কাছে গিয়ে জাইফের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করে কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। উপায় না পেয়ে যীনাত পানি নিয়ে এসে জাইফের মুখে ছিটালো এতে ধীরে ধীরে জাইফের জ্ঞান ফিরে এবং সে উঠে বসে। তার চোখে মুখে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে। যীনাত উত্তেজিত হয়ে বলে,”আপনি ঠিক আছেন তো?”

জাইফ নিচের দিকে তাকিয়েই মাথা নাড়ায়। যীনাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর আবার শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,”আপনার কি হয়েছিলো?”

জাইফ সংকোচ ছাড়াই বলে,”জানিনা!”

যীনাত কি বলবে বুঝতে পারছে না। জাইফের হঠাৎ এরকম কান্ড যীনাত স্বপ্নেও ভাবেনি। আচ্ছা তার সাথে কেন কোনো প্যারানরমান ঘটনা আছে? জাইফ তৎক্ষনাৎ বলে,”রুমে যাও।”

যীনাত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে,”মা…মানে!”

– তোমাকে রুমে যেতে বলেছি কোনোরকম প্রশ্ন করিও না যাও!

জাইফের কঠিন গলা শুনে যীনাত আর সেখানে থাকতে পারলো না। বাধ্য মেয়ের মতো নিজের চলে আসে এবং দেখে আনুস্কা এখনো আরামের ঘুম দিচ্ছে৷ বাড়িতে এতোবড় একটা কান্ড ঘটে গেলো কেউ ঘূণাক্ষরেও টের পেলো না। তবুও যীনাতের জাইফের জন্য মন কেমন কু ডাকছে? জাইফের আবার কোনোরকম বিপদ হবে না তো? এসব ভাবতে ভাবতে আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে সে আনুস্কার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে।

জাইফ বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে নিজের হাতের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। তার হাত একবার মুঠি করে আবার খুললো এবং দেখলো তার হাতে কিছু আলোকরশ্মি বিদ্যমান। সেই আলোকরশ্মির দিকে আনমনে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো,”তুমি ঠিক ধরেছো যীনাত আমার সাথে অনেক প্যারানরমাল ঘটনা ঘটে আজ না দেখলে হয়তো কখনো জানতে পারতে না। কিন্তু আমি সবসময় সবার থেকে দূরে থাকি যেনো আমার এই সমস্যার জালে তারা কেউ ফেসে না যায়। জানিনা এটা আমার কেমন প্যারানরমাল প্রব্লেম! তবে এইটুকু বেশ ভালো বুঝতে পারি আমার এই পাওয়ার টা অনেক শক্তিশালী এবং ভয়ংকর নাহলে এতো দুরুত্বে থাকা আকাশের মেঘ আমার সামান্য চিৎকারের সাথে মিলিয়ে যেতো না। আর আমার হাতে…”

বলে চুপ করলো জাইফ তারপর একটা খালি বোতল দূরে খেয়াল করলো জাইফ। সেই খালি বোতলের দিকে একপলক তাকিয়ে কি মনে করে যেনো সেই বোতল বরাবর নিজের সেই আলোকরশ্মিতে থাকা হাতটা রাখলো। সাথে সাথেই সেই আলোকরশ্মি জাইফের হাত থেকে গিয়ে বোতলের উপর গিয়ে পড়লো আর সাথে সাথে অনেক শব্দের সাথে সেটা ব্লাস্ট হলো। ব্লাস্ট হতেই বোতলের টুকরা গুলো চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো। জাইফ নিজের এক আঙুল ঘুরাতেই যেনো সব টুকরো গুলোও জাইফের আদেশে ঘুরতে শুরু করে। জাইফ আঙুল যেদিকেই নিচ্ছে সেদিকেই টুকরো গুলো যাচ্ছে। এরকম করতে জাইফের কেন জানিনা বেশ তৃপ্তি লাগছে যেনো সে আগেও এসব করেছে৷ কিন্তু মনে কেন করতে পারছে না? এমন করতে করতেই ফজরের আযান দিয়ে দেয়। জাইফ সব স্বাভাবিক করে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়। তারপর কিছু না ভেবেই ওযু করতে চলে যায়।

পরেরদিন রাতে,,

আনুস্কা বধু সাজে ফুলেভরা বিছানায় ইয়া বড় একটা ঘোমটা দিয়ে চুপচাপ বসে আছেম কতোক্ষণ হয়ে গেলো এখনো রিকেশের আসার নামগন্ধ নেই। আনুস্কার রাগে মন চাচ্ছে নিজের চুল নিজেই ছিড়ে ফেলতে। আনুস্কা যা ভয়ানক রেগে আছে এতে করে রিকেশের যে কি হাল হয় সেটা ওপরওয়ালা ভালো জানেন। রিকেশ অনেক রাত করে আসলো আর আসতেই তার উপর হামলা চললো। রিকেশ “ও বাবাগো” বলতেই আনুস্কা মুখ চেপে ধরে এবং বল্ব,”ওই কাইষ্টা পোলা চুপ! তোর সাহস তো কম না তুই আমারে এতো রাইত পর্যন্ত বহাইয়া রাখসোস? এতোক্ষণ কোন মাইয়ার সাথে প্রেম করে আসছোস হ্যাঁ? ”

রিকেশ আনুস্কার হাত নিজের মুখ থেকে সরিয়ে বলে,”ওয়াট দ্যা হ্যাল! তোমার মাথা কি গেছে কিসব উল্টো পাল্টা বলছো তুমি? আমি আবার কার সাথে প্রেম করতে যাবো। আর তুমি যা কাল নাগিন তোমার জ্বালায় কোন কালে প্রেম করতে পারলাম!”

– ওই জলহস্তি চুপ কর! প্রেম করার খুব সখ হইসে না?প্রেমে করতে দেইনি বেশ করেছি এতে তোমার কোনো অসুবিধা? তখন তো কেউ ছিলে না এখন তুমি আমার লিগালি হাসবেন্ড ওকে? এখন আমাকে বুকে নিয়ে ঘুমাবা নইলে তোমাকে সোফায়ও ঘুমানোর জায়গা দিবো না।

– মানে কি হ্যাঁ? রুমটা আমার সেখানে আমি কোথায় ঘুমাবো না ঘুমাবো সেটা কি তুমি আমায় বুঝাবা!

– আপনার একার রুম না এখন থেকে এই রুম আমারও ওকে? এখন আসবেন নাকি…

বলেই আনুস্কা রিকেশের কলার টেনে বিছানার কাছে নিয়ে এলো এবং রিকেশকে ধাক্কা দিয়ে বেডে ফেলে দিলো। রিকেশ আনুস্কার হাত ধরে ছিলো যার ফলে আনুস্কাও তাল সামলাতে না পেরে রিকেশের উপর গিয়ে পড়লো। খুব ধস্তাধস্তির পর আনুস্কা রিকেশের বুকে আরামের ঘুম দিলো আর রিকেশ বেচারা এতোক্ষণ ধরে ছাড়াতে চেয়েও পারলো না। এখন আর কি করার বুকে নিয়েই ঘুমাও।

যীনাত খুব সকাল সকালই ঘুম থেকে উঠে নিচে চলে যায়। মল্লিকা দেবী অবাক না হয়ে পারেনা। যীনাত প্রতিদিন কেমনে এতো সকালে উঠে আর ওদিকে দেখো নিজের ছেলেমেয়েদের কখনো নিজে থেকে একদিনও জলদি উঠতে দেখেনি। মল্লিকা দেবী জাইফের জন্য কফি বানাচ্ছিলো তখনই যীনাত বলে উঠে,”আন্টি আমি কি আপনাকে কোনো ভাবে সাহায্য করবো? প্লিজ না করবেন না এই পর্যন্ত কখনোই আমাকে কোনো কিছু করতে দেননি এতে করে আমার বরিং লাগে।”

মল্লিকা দেবী হেসে বলে,”বাড়িতে এতো কাজের লোক থাকতে তোমাকে দিয়ে কাজ করাবো ভাবলে কি করে হুম?”

– তবুও কাজ করলে রেগুলার একটা এক্সারসাইজ হয়। আর সারাক্ষণ বসে থাকলে যেমন বরিংও লাগে তেমন শরীরে নানা রোগব্যাধি দেখা দেয়।

– ঠিক আছে মানলাম এতো করেই যখন বলছো তাহলে একটা ছোট উপকার করো!

যীনাত চোখমুখ চিকচিক করে বলে,”কি বলুন আমি রাজি আছি!”

যীনাতের হাতে এক কাপ কফি ধরিয়ে দিয়ে বলে,”এটা জাইফকে দিয়ে এসো মিনি যেতো কিন্তু মিনি পিসিমার কাছে গেছেন তার আপ্যায়ন করতে। তাই তুমি করে দেও।”

– ঠিক আছে।

বলেই যীনাত কফিটা নিয়ে আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে জাইফের রুমের দিকে যেতে লাগে। সেদিন জাইফের এমন কঠিন বিহেভিয়ারে যীনাত ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো। এমন কি জাইফের সাথে সে দেখা অব্দি করেনি ভয়ে। যদি কোনো কারণে আবার চড় থাপ্পড় মেরে দেয়। এখন তো মল্লিকা দেবী তাকে বাঘের খাচায় পাঠাচ্ছে। নিজেকেই নিজে বকতে লাগলো যীনাত কেন যে মল্লিকা দেবীকে আগ বাড়িয়ে বলতে গেছিলো কাজ করার কথা এখন নিজেই তো ফাদে পড়ে গেলো। কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়।

এসব নানান চিন্তা করতে করতে যীনাত জাইফের রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। যেই নক করবে ওমনি খেয়াল করলো দরজা ভেজানো। বিসমিল্লাহ বলে যীনাত আস্তে করে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো এবং গিয়ে দেখে জাইফ খালি গায়ে উবুড় হয়ে শুয়ে আছে। জাইফের বডি দেখে যীনাতের চোখ চড়কগাছ! এভাবে জাইফকে কখনো দেখেনি সে তাই এবার ভয় ছেড়ে নিজে লজ্জায় পড়ে গেলো। হঠাৎ মনে পড়ে গেলো কফির কথা৷ এখন কফি না খেলে তো কফি ঠান্ডা হয়ে যাবে। তাই যীনাত কাঁপা কাঁপা পায়ে বিছানার পাশের বেডবক্সে জাইফের কফিটা রাখলো এবং কিছুটা জোরে বলতে লাগে,”এইযে শুনছেন আপনার জন্য কফি এনেছি খেয়ে নিন নইলে ঠান্ডা হয়ে যাবে।”

জিয়াফ কিছুটা নড়াচড়া করে আবার ঘুমিয়ে গেলো। অনুরূপভাবে যীনাত একই ভাবে ডাকে এবং জাইফ নাড়াচাড়া দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। এবার যীনাত প্রচুর বিরক্ত হলো। যীনাত যেই জাইফের কাধে হাত রাখতে যাবে ওমনি জাইফ যীনাতের হাত ধরে টান দেয় আর যীনাত টাল সামলাতে না পেরে সোজা জাইফের বুকে গিয়ে পড়ে। এমন কান্ড যীনাত কখনোই কল্পনা পর্যন্ত করতে পারেনি তাই চোখ দুটো রসোগোল্লার মতো করে জাইফের দিকে তাকিয়ে রইলো। জাইফের চোখে মুখে রাগি ভাব! যীনাতের সাথে সাথে হুস আসে এবং জাইফের উপর থেকে উঠতে যেতে চাইলে এক চুল পরিমাণও নড়তে পারলো না।

– এসব কি হচ্ছে ছাড়ুন!

– কেন ছাড়বো?

– দেখুন এটা কিন্তু ঠিক না ছাড়ুন আমায় কেউ এসে দেখে ফেললে ঝামেলা হয়ে যাবে!

– কি দেখবে?

যীনাত আবার বিরক্ত হয়ে কিছু বলতে নিলে জাইফ যীনাতকে ঘুরিয়ে পাশে ফেলে নিজে যীনাতের উপর উঠে। যীনাত আবার অবাক হয়ে তাকায়। এবং জাইফ রেগে বলে,”তোমার সাহস তো কম না তুমি আমাকে দুইদিন ধরে ইগনোর করেছো? এতো সাহস হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলো তোমার?”

যীনাত জাইফের কথার উত্তর না দিয়ে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলে,”এসব হচ্ছে কি? কেন এভাবে আমার কাছাকাছি আসছেন হ্যাঁ? ছাড়ুন আমাকে আমার কাজ আছে। আর কেউ দেখে ফেললে এলাহি কান্ড ঘটে যাবে।”

– তাহলে তাই হোক তবুও আজ তোমার প্রশ্নের উত্তর না নিয়ে ছাড়ছি না!

– পাগল নাকি আপনি।

হঠাৎ কেউ বাইরে থেকে কথা বলতে বলতে জাইফের রুমের দিকে আসলো।

———————————

চলবে!!!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে